রকিবুল হাসান
আকবর হোসেন গত শতকের পঞ্চাশ-সত্তরের দশকের জনপ্রিয় ঔপন্যাসিক হিসেবে খ্যাতিমান ছিলেন। কিন্তু তিনি যে বহুমাত্রিক লেখক ছিলেন, তা অনাবিষ্কৃত থেকে গেছে। উপন্যাসের পাশাপাশি তিনি ছোটগল্প, কবিতা, গান, প্রবন্ধ ও নাটক লিখতেন। পত্রিকা সম্পাদনা করতেন। অভিনয় করতেন। আকবর হোসেন কুষ্টিয়া জেলার কুমারখালী উপজেলার কয়া গ্রামে ১লা অক্টোবর ১৯১৭ সালে জন্মগ্রহণ করেন। সাহিত্য-সংস্কৃতি-ইতিহাস-ঐতিহ্যে কুমারখালী বিশেষ এক মর্যাদার অধিকারী। রবীন্দ্রনাথের রবীন্দ্রনাথ হয়ে-ওঠার পেছনে কুমারখালীর শিলাইদহ ও এ অঞ্চলের মানুষ-মাটি-নদীর ভূমিকা বিশেষভাবে গুরুত্বপূর্ণ। বাউলসম্রাট লালন শাহ্, উনিশ শতকের শ্রেষ্ঠ মুসলিম কথাসাহিত্যিক মীর মশাররফ হোসেন, চারণকবি-প্রাবন্ধিক-সাংবাদিক কাঙাল হরিনাথ মজুমদার, নাট্যকার অক্ষয়কুমার মৈত্রেয়, বাউল কবি গগন হরকরা- যাঁর ‘কোথায় পাব তারে/আমার মনের মানুষ যে রে’ গানের অনুপ্রেরণায় রবীন্দ্রনাথ ‘আমার সোনার বাংলা’ রচনা করেছেন, সুসাহিত্যিক ললিতকুমার চট্টোপাধ্যায়, সাহিত্যিক, শিক্ষাবিদ, ড. কাজী মোতাহার হোসেন, কবি শরৎশশী দেবী, কবি-শিশুসাহিত্যিক জোবেদা খানম, গীতিকার মাসুদ করিম কুমারখালীর উর্বরমাটির নক্ষত্রসন্তান। এখানকার আর এক মহান বিপ্লবী বাঘা যতীন বিদ্রোহের অগ্নিশিখার দীপ্তবীর হয়েও অন্তরে লালন করতেন সাহিত্য-সংস্কৃতি। তিনি কবিতা ও গল্প লিখেছেন, নিজের সম্পাদনায় ‘সত্যাগ্রহ’ সাহিত্যপত্রিকা প্রকাশ করেছেন। সারা পৃথিবীতে যে ক’জন বাঙালির জন্যে মাথা উঁচু করে দাঁড়ানো যায়, বুক উঁচিয়ে গর্ব করা যায়, বাঘা যতীন তাঁদের মধ্যে প্রধানতম একজন। আকবর হোসেন এ উর্বর মাটিরই সন্তান। তাঁর পিতা হাজি আব্দুল আলী বিশ্বাস, মা মাজেদা বেগম। আব্দুল আলী বিশ্বাস ব্যবসায়ী কর্মকা-ের সাথে যুক্ত থাকলেও তাঁদের পরিবারটি ছিল শিক্ষানুরাগী ও সংস্কৃতিমনস্ক।
আকবর হোসেন ছোটবেলা কয়া মডেল স্কুলে ভর্তি হন। সেখান থেকে তিনি বৃত্তি নিয়ে কুষ্টিয়া হাইস্কুলে ভর্তি হন। ১৯৩৫ সালে কুষ্টিয়া হাইস্কুল থেকে দ্বিতীয় বিভাগে ম্যাট্রিক পাস করে পাবনা এডওয়ার্ড কলেজে উচ্চ মাধ্যমিক শ্রেণিতে ভর্তি হন। আইএ পাস করার পর কলকাতা রিপন কলেজে বি.এ. ভর্তি হন। কলকাতা গিয়ে তিনি লেখাপড়ার চেয়ে কবিতা লেখার প্রতিই বেশি ঝুঁকে পড়েন। সেখানে কবিতাচর্চায় বেশ দক্ষতার পরিচয় রেখেছিলেন এবং সুপরিচিত হয়ে ওঠেন কবি হিসেবে। ১৯৪১ সালে তিনি বি.এ. পাস করেন।
আকবর হোসেন ১৯৪১ সালে সামরিক বিভাগে অফিসার পদে পরীক্ষা দিয়ে চাকরি পেয়েছিলেন। এই চাকরি পাওয়ার পর বিদেশে ট্রেনিংয়ের কথা জানিয়ে বাড়িতে চিঠি দিলে তাঁর পিতা এবং শ্বশুরের পক্ষ থেকে কেউই তাঁকে বিদেশে ট্রেনিং গ্রহণে অনুমতি না দেওয়ায় তিনি চাকরি ছেড়ে দিতে বাধ্য হন। ঐ বছরেই রাইটার্স বিল্ডিং মেডিক্যাল ডিপার্টমেন্টে চাকরি গ্রহণ করেন। এ চাকরিটি বেশিদিন করেননি। ১৯৪২ সালে তিনি ডেপুটেশনে ‘সিভিল সাপ্লাই ডিপার্টমেন্ট অব ফুড’-এ ইন্সপেক্টর পদে (কেরোসিন ও কয়লা সেকশনে) চাকরি গ্রহণ করেন। অফিস ছিল কলকাতার ভবানীপুরে। দেশ-বিভাগের কারণে তিনি ভবানীপুরের অফিস থেকে ১৪ই আগস্ট ১৯৪৭ সালে রিলিজ পান এবং পূর্ব পাকিস্তানে ঐ একই ডিপার্টমেন্টে ১৯৪৭ সালের ১৯শে আগস্ট যোগদান করেন। তৎকালীন সময়ে সরকার ‘সাপ্লাই ডিপার্টমেন্ট অব ফুড’ ডিপার্টমেন্ট উঠিয়ে দেওয়ার ভিত্তিতে এই ডিপার্টমেন্টে কর্মরত অফিসার ও কর্মচারীদের বিভিন্ন ডিপার্টমেন্টে উচ্চপদে নিয়োগের ব্যবস্থা করে। ঔপন্যাসিক আকবর হোসেন এক্ষেত্রে ‘ডেপুটি ম্যাজিস্ট্রেট পদ গ্রহণের সুযোগ পেয়েও তিনি গ্রহণ করেননি। তিনি ১৯৪৮ সালে নিজের পছন্দমতে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের ‘অডিট অফিসার’ পদটি বেছে নেন। এই ডিপার্টমেন্টেও তাঁকে ‘অডিট অফিসার’ পদটির চেয়ে উচ্চ পদ দেওয়া সত্ত্বেও তিনি তা গ্রহণ করেননি। তিনি সবসময় ভাবতেন উচ্চ পদ গ্রহণ করলে সাধারণ মানুষের সাথে অবাধ মেলামেশার সুযোগ ব্যহত হবে। সারাজীবন সাধারণ মানুষের সাথে একাত্মভাবে মিশে থাকতে চেয়েছিলেন তিনি। সে কারণে তেত্রিশ বছরের চাকরিজীবনে কোনো প্রমোশন গ্রহণে সম্মত হননি। অবসর গ্রহণের সামান্য কিছুদিন আগে একরকম বাধ্য হয়েই প্রমোশন গ্রহণ করেছিলেন। সরকার তাঁকে আরো দুই বছরের পুনঃ নিয়োগ দান করলে তিনি তা গ্রহণ করেননি।
বাংলা সাহিত্যে আকবর হোসেন (১৯১৭-১৯৮১) জনপ্রিয় ও গুরুত্বপূর্ণ একজন ঔপন্যাসিক। তিনি কবিতা, গল্প, প্রবন্ধ ও নাটক রচনা করলেও মূলত ঔপন্যাসিক হিসেবেই তাঁর পরিচিতি ও খ্যাতি। তাঁর অন্যসব রচনা অধিকাংশই অপ্রকাশিত। পাঠকের অজানা। যে কারণে তার পরিচয় কথাসাহিত্যের শাখাতেই সীমাবদ্ধ। আকবর হোসেনের একমাত্র নাটক ‘যৌবনটাই জীবন নয়’। দীর্ঘকাল ধরে নাটকটি অপ্রকাশিত। লেখকের কনিষ্ঠপুত্র শ্রদ্ধাভাজন ফেরদৌস হাসান তার পিতার অপ্রকাশিত রচনাসামগ্রী আমাকে দেখার ও কাজ করার আন্তরিক সুযোগ দিয়ে কৃতজ্ঞতায় আবদ্ধ করেছেন। তার সহযোগিতা ব্যতীত এটি আবিষ্কার ও প্রকাশ প্রায় অসম্ভব ছিল।এ নাটকের পান্ডুলিপির বেশকিছু পাতাও প্রায় ক্ষয়ে গেছে। অনেক কষ্টে পাঠোদ্ধার করা হয়েছে। অক্ষরগুলো কোথাও কোথাও আবছা আবছা হয়ে গেছে। ভাবতে অবাক লাগে, আকবর হোসেনের মতো গুরুত্বপূর্ণ ও জনপ্রিয় একজন লেখকের নাটক প্রায় একাত্তর বছর অপ্রকাশিত অবস্থায় আছে! অথচ এই নাটকের মাধ্যমেই নাট্য-সাহিত্যের আরেক নতুন প্রস্রবণ খুলে যেতে পারত। আরও বেশি করে জানা যেতে পারত ব্যক্তি ও শিল্পী আকবর হোসেনকে। শিল্পমান বিচারে নাটকটির উত্তীর্ণ-অনুত্তীর্ণ যা-ই হোক, আকবর হোসেনের সৃষ্টি হিসেবে এর বিশেষ গুরুত্ব রয়েছে। ঔপন্যাসিক হিসেবে তিনি যেমন সমাজ সমকাল সচেতন শিল্পী, এ নাটকের ক্ষেত্রেও তার ব্যতিক্রম ঘটেনি। নাটকে বাংলা-ভাগ, সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা, শিক্ষিতা-রূপশ্রী নারীর অহমিকা ও অনৈতিক-উচ্চাভিলাষী জীবনযাপন- মোহগ্রস্ততা ও মোহভঙ্গ, দাম্পত্য-সংকট, বিচ্ছেদ-বেদনা, বিবাহবহির্ভূত সম্পর্ক, শিক্ষিত সমাজের নৈতিক স্খলন, নগর সভ্যতা-আধুনিকতা ও প্রগতির নামে অসভ্যতা- উচ্ছৃঙ্খলা, পারিবারিক মূল্যবোধের ক্ষয়, আদর্শ এক পিতার আত্মদংশন এবং শেষ পর্যন্ত ভয়াবহ করুণ পরিণতি মূল বিষয়। জাহানারা শিক্ষিত নারী হয়েও নিজের রূপ পুঁজি করে আধুনিকতা ও প্রগতির নামে নিজে অনৈতিক উচ্চাভিলাষী জীবন বেছে নিয়েছে। যেখানে যুক্ত আছে এ সমাজের বিভিন্ন শ্রেণির অর্থশালী ও ক্ষমতাবানরা। শিক্ষিত ও সুন্দরী তরুণী জাহানারা অর্থ ও দামি উপহারে এদের নিত্যশয্যাসঙ্গী। বিবাহ ব্যাপারটি তার কাছে সমাজের নিছক নিয়মরক্ষার ব্যাপার। মাতৃত্ব বা সন্তান ধারণ এসব তার কাছে গুরুত্বহীন। যে কারণে প্রফেসর জাফর চৌধুরীর মতো আদর্শবান ব্যক্তি তার কাছে অবহেলিত হয়েছে, বিচ্ছেদ ঘটেছে দাম্পত্য জীবনের। বরং বিবাহের আগেই জাহানারা খালেদের সঙ্গে প্রেমের সম্পর্ক ও অবাধ শারীরিক সম্পর্ক গড়ে তোলে। এ সম্পর্কের ভেতর দিয়েই জাহানারা অর্থ আর দামি উপহারের মোহে চোরাবালির মতো আর্মি অফিসার, ডাক্তারসহ বিভিন্ন ব্যবসায়ী সংগঠনের প্রধান ব্যক্তিদের সঙ্গেও বিশেষ সম্পর্ক স্থাপন করে। এমনকি যারা একসময় সমাজ-ঘৃণিত ছিল; কিন্তু কোনোভাবে অর্থশালী হয়েছে, তাদের কাছেও সে সহজলভ্য নারীতে পরিণত হয়। আদর্শবান কবি হেলাল তাকে বারবার এ জীবন থেকে সরে আসার অনুরোধ জানালেও তাতে সে কর্ণপাত করেনি। একসময় জাহানারার নষ্ট-উচ্চাভিলাষী জীবনের কথা প্রকাশ হলে সবাই তাকে ঘৃণাভরে ত্যাগ করে। এরপর নেমে আসে তার জীবনের করুণ অধ্যায়- একরকম ভিখারিনী-জীবন- ধুঁকে ধুঁকে মৃত্যু। আকবর হোসেনের উপন্যাসের মতো তার নাটকেও আকর্ষণীয় ভাষা-সংলাপ ব্যবহার করেছেন। ‘যৌবনটাই জীবন নয়’ সমাজ সমকাল বিবেচনায় গুরুত্বপূর্ণ। আকবর হোসেনের কৃতিত্বে নাটকটি ভিন্নমাত্রা সংযোজন করবে আশা করি।
একসময়ের তুমুল জনপ্রিয় ঔপন্যাসিক আকবর হোসেনকে এই সময়কালীন পাঠকমহল এ নাটকের মাধ্যমে নতুন করে জানার সুযোগ পাবে এবং আকবর হোসেনও নতুনভাবে মূল্যায়িত হবেন- এ প্রত্যাশা স্বাভাবিক।
রকিবুল হাসান
বৃহস্পতিবার, ০২ অক্টোবর ২০২৫
আকবর হোসেন গত শতকের পঞ্চাশ-সত্তরের দশকের জনপ্রিয় ঔপন্যাসিক হিসেবে খ্যাতিমান ছিলেন। কিন্তু তিনি যে বহুমাত্রিক লেখক ছিলেন, তা অনাবিষ্কৃত থেকে গেছে। উপন্যাসের পাশাপাশি তিনি ছোটগল্প, কবিতা, গান, প্রবন্ধ ও নাটক লিখতেন। পত্রিকা সম্পাদনা করতেন। অভিনয় করতেন। আকবর হোসেন কুষ্টিয়া জেলার কুমারখালী উপজেলার কয়া গ্রামে ১লা অক্টোবর ১৯১৭ সালে জন্মগ্রহণ করেন। সাহিত্য-সংস্কৃতি-ইতিহাস-ঐতিহ্যে কুমারখালী বিশেষ এক মর্যাদার অধিকারী। রবীন্দ্রনাথের রবীন্দ্রনাথ হয়ে-ওঠার পেছনে কুমারখালীর শিলাইদহ ও এ অঞ্চলের মানুষ-মাটি-নদীর ভূমিকা বিশেষভাবে গুরুত্বপূর্ণ। বাউলসম্রাট লালন শাহ্, উনিশ শতকের শ্রেষ্ঠ মুসলিম কথাসাহিত্যিক মীর মশাররফ হোসেন, চারণকবি-প্রাবন্ধিক-সাংবাদিক কাঙাল হরিনাথ মজুমদার, নাট্যকার অক্ষয়কুমার মৈত্রেয়, বাউল কবি গগন হরকরা- যাঁর ‘কোথায় পাব তারে/আমার মনের মানুষ যে রে’ গানের অনুপ্রেরণায় রবীন্দ্রনাথ ‘আমার সোনার বাংলা’ রচনা করেছেন, সুসাহিত্যিক ললিতকুমার চট্টোপাধ্যায়, সাহিত্যিক, শিক্ষাবিদ, ড. কাজী মোতাহার হোসেন, কবি শরৎশশী দেবী, কবি-শিশুসাহিত্যিক জোবেদা খানম, গীতিকার মাসুদ করিম কুমারখালীর উর্বরমাটির নক্ষত্রসন্তান। এখানকার আর এক মহান বিপ্লবী বাঘা যতীন বিদ্রোহের অগ্নিশিখার দীপ্তবীর হয়েও অন্তরে লালন করতেন সাহিত্য-সংস্কৃতি। তিনি কবিতা ও গল্প লিখেছেন, নিজের সম্পাদনায় ‘সত্যাগ্রহ’ সাহিত্যপত্রিকা প্রকাশ করেছেন। সারা পৃথিবীতে যে ক’জন বাঙালির জন্যে মাথা উঁচু করে দাঁড়ানো যায়, বুক উঁচিয়ে গর্ব করা যায়, বাঘা যতীন তাঁদের মধ্যে প্রধানতম একজন। আকবর হোসেন এ উর্বর মাটিরই সন্তান। তাঁর পিতা হাজি আব্দুল আলী বিশ্বাস, মা মাজেদা বেগম। আব্দুল আলী বিশ্বাস ব্যবসায়ী কর্মকা-ের সাথে যুক্ত থাকলেও তাঁদের পরিবারটি ছিল শিক্ষানুরাগী ও সংস্কৃতিমনস্ক।
আকবর হোসেন ছোটবেলা কয়া মডেল স্কুলে ভর্তি হন। সেখান থেকে তিনি বৃত্তি নিয়ে কুষ্টিয়া হাইস্কুলে ভর্তি হন। ১৯৩৫ সালে কুষ্টিয়া হাইস্কুল থেকে দ্বিতীয় বিভাগে ম্যাট্রিক পাস করে পাবনা এডওয়ার্ড কলেজে উচ্চ মাধ্যমিক শ্রেণিতে ভর্তি হন। আইএ পাস করার পর কলকাতা রিপন কলেজে বি.এ. ভর্তি হন। কলকাতা গিয়ে তিনি লেখাপড়ার চেয়ে কবিতা লেখার প্রতিই বেশি ঝুঁকে পড়েন। সেখানে কবিতাচর্চায় বেশ দক্ষতার পরিচয় রেখেছিলেন এবং সুপরিচিত হয়ে ওঠেন কবি হিসেবে। ১৯৪১ সালে তিনি বি.এ. পাস করেন।
আকবর হোসেন ১৯৪১ সালে সামরিক বিভাগে অফিসার পদে পরীক্ষা দিয়ে চাকরি পেয়েছিলেন। এই চাকরি পাওয়ার পর বিদেশে ট্রেনিংয়ের কথা জানিয়ে বাড়িতে চিঠি দিলে তাঁর পিতা এবং শ্বশুরের পক্ষ থেকে কেউই তাঁকে বিদেশে ট্রেনিং গ্রহণে অনুমতি না দেওয়ায় তিনি চাকরি ছেড়ে দিতে বাধ্য হন। ঐ বছরেই রাইটার্স বিল্ডিং মেডিক্যাল ডিপার্টমেন্টে চাকরি গ্রহণ করেন। এ চাকরিটি বেশিদিন করেননি। ১৯৪২ সালে তিনি ডেপুটেশনে ‘সিভিল সাপ্লাই ডিপার্টমেন্ট অব ফুড’-এ ইন্সপেক্টর পদে (কেরোসিন ও কয়লা সেকশনে) চাকরি গ্রহণ করেন। অফিস ছিল কলকাতার ভবানীপুরে। দেশ-বিভাগের কারণে তিনি ভবানীপুরের অফিস থেকে ১৪ই আগস্ট ১৯৪৭ সালে রিলিজ পান এবং পূর্ব পাকিস্তানে ঐ একই ডিপার্টমেন্টে ১৯৪৭ সালের ১৯শে আগস্ট যোগদান করেন। তৎকালীন সময়ে সরকার ‘সাপ্লাই ডিপার্টমেন্ট অব ফুড’ ডিপার্টমেন্ট উঠিয়ে দেওয়ার ভিত্তিতে এই ডিপার্টমেন্টে কর্মরত অফিসার ও কর্মচারীদের বিভিন্ন ডিপার্টমেন্টে উচ্চপদে নিয়োগের ব্যবস্থা করে। ঔপন্যাসিক আকবর হোসেন এক্ষেত্রে ‘ডেপুটি ম্যাজিস্ট্রেট পদ গ্রহণের সুযোগ পেয়েও তিনি গ্রহণ করেননি। তিনি ১৯৪৮ সালে নিজের পছন্দমতে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের ‘অডিট অফিসার’ পদটি বেছে নেন। এই ডিপার্টমেন্টেও তাঁকে ‘অডিট অফিসার’ পদটির চেয়ে উচ্চ পদ দেওয়া সত্ত্বেও তিনি তা গ্রহণ করেননি। তিনি সবসময় ভাবতেন উচ্চ পদ গ্রহণ করলে সাধারণ মানুষের সাথে অবাধ মেলামেশার সুযোগ ব্যহত হবে। সারাজীবন সাধারণ মানুষের সাথে একাত্মভাবে মিশে থাকতে চেয়েছিলেন তিনি। সে কারণে তেত্রিশ বছরের চাকরিজীবনে কোনো প্রমোশন গ্রহণে সম্মত হননি। অবসর গ্রহণের সামান্য কিছুদিন আগে একরকম বাধ্য হয়েই প্রমোশন গ্রহণ করেছিলেন। সরকার তাঁকে আরো দুই বছরের পুনঃ নিয়োগ দান করলে তিনি তা গ্রহণ করেননি।
বাংলা সাহিত্যে আকবর হোসেন (১৯১৭-১৯৮১) জনপ্রিয় ও গুরুত্বপূর্ণ একজন ঔপন্যাসিক। তিনি কবিতা, গল্প, প্রবন্ধ ও নাটক রচনা করলেও মূলত ঔপন্যাসিক হিসেবেই তাঁর পরিচিতি ও খ্যাতি। তাঁর অন্যসব রচনা অধিকাংশই অপ্রকাশিত। পাঠকের অজানা। যে কারণে তার পরিচয় কথাসাহিত্যের শাখাতেই সীমাবদ্ধ। আকবর হোসেনের একমাত্র নাটক ‘যৌবনটাই জীবন নয়’। দীর্ঘকাল ধরে নাটকটি অপ্রকাশিত। লেখকের কনিষ্ঠপুত্র শ্রদ্ধাভাজন ফেরদৌস হাসান তার পিতার অপ্রকাশিত রচনাসামগ্রী আমাকে দেখার ও কাজ করার আন্তরিক সুযোগ দিয়ে কৃতজ্ঞতায় আবদ্ধ করেছেন। তার সহযোগিতা ব্যতীত এটি আবিষ্কার ও প্রকাশ প্রায় অসম্ভব ছিল।এ নাটকের পান্ডুলিপির বেশকিছু পাতাও প্রায় ক্ষয়ে গেছে। অনেক কষ্টে পাঠোদ্ধার করা হয়েছে। অক্ষরগুলো কোথাও কোথাও আবছা আবছা হয়ে গেছে। ভাবতে অবাক লাগে, আকবর হোসেনের মতো গুরুত্বপূর্ণ ও জনপ্রিয় একজন লেখকের নাটক প্রায় একাত্তর বছর অপ্রকাশিত অবস্থায় আছে! অথচ এই নাটকের মাধ্যমেই নাট্য-সাহিত্যের আরেক নতুন প্রস্রবণ খুলে যেতে পারত। আরও বেশি করে জানা যেতে পারত ব্যক্তি ও শিল্পী আকবর হোসেনকে। শিল্পমান বিচারে নাটকটির উত্তীর্ণ-অনুত্তীর্ণ যা-ই হোক, আকবর হোসেনের সৃষ্টি হিসেবে এর বিশেষ গুরুত্ব রয়েছে। ঔপন্যাসিক হিসেবে তিনি যেমন সমাজ সমকাল সচেতন শিল্পী, এ নাটকের ক্ষেত্রেও তার ব্যতিক্রম ঘটেনি। নাটকে বাংলা-ভাগ, সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা, শিক্ষিতা-রূপশ্রী নারীর অহমিকা ও অনৈতিক-উচ্চাভিলাষী জীবনযাপন- মোহগ্রস্ততা ও মোহভঙ্গ, দাম্পত্য-সংকট, বিচ্ছেদ-বেদনা, বিবাহবহির্ভূত সম্পর্ক, শিক্ষিত সমাজের নৈতিক স্খলন, নগর সভ্যতা-আধুনিকতা ও প্রগতির নামে অসভ্যতা- উচ্ছৃঙ্খলা, পারিবারিক মূল্যবোধের ক্ষয়, আদর্শ এক পিতার আত্মদংশন এবং শেষ পর্যন্ত ভয়াবহ করুণ পরিণতি মূল বিষয়। জাহানারা শিক্ষিত নারী হয়েও নিজের রূপ পুঁজি করে আধুনিকতা ও প্রগতির নামে নিজে অনৈতিক উচ্চাভিলাষী জীবন বেছে নিয়েছে। যেখানে যুক্ত আছে এ সমাজের বিভিন্ন শ্রেণির অর্থশালী ও ক্ষমতাবানরা। শিক্ষিত ও সুন্দরী তরুণী জাহানারা অর্থ ও দামি উপহারে এদের নিত্যশয্যাসঙ্গী। বিবাহ ব্যাপারটি তার কাছে সমাজের নিছক নিয়মরক্ষার ব্যাপার। মাতৃত্ব বা সন্তান ধারণ এসব তার কাছে গুরুত্বহীন। যে কারণে প্রফেসর জাফর চৌধুরীর মতো আদর্শবান ব্যক্তি তার কাছে অবহেলিত হয়েছে, বিচ্ছেদ ঘটেছে দাম্পত্য জীবনের। বরং বিবাহের আগেই জাহানারা খালেদের সঙ্গে প্রেমের সম্পর্ক ও অবাধ শারীরিক সম্পর্ক গড়ে তোলে। এ সম্পর্কের ভেতর দিয়েই জাহানারা অর্থ আর দামি উপহারের মোহে চোরাবালির মতো আর্মি অফিসার, ডাক্তারসহ বিভিন্ন ব্যবসায়ী সংগঠনের প্রধান ব্যক্তিদের সঙ্গেও বিশেষ সম্পর্ক স্থাপন করে। এমনকি যারা একসময় সমাজ-ঘৃণিত ছিল; কিন্তু কোনোভাবে অর্থশালী হয়েছে, তাদের কাছেও সে সহজলভ্য নারীতে পরিণত হয়। আদর্শবান কবি হেলাল তাকে বারবার এ জীবন থেকে সরে আসার অনুরোধ জানালেও তাতে সে কর্ণপাত করেনি। একসময় জাহানারার নষ্ট-উচ্চাভিলাষী জীবনের কথা প্রকাশ হলে সবাই তাকে ঘৃণাভরে ত্যাগ করে। এরপর নেমে আসে তার জীবনের করুণ অধ্যায়- একরকম ভিখারিনী-জীবন- ধুঁকে ধুঁকে মৃত্যু। আকবর হোসেনের উপন্যাসের মতো তার নাটকেও আকর্ষণীয় ভাষা-সংলাপ ব্যবহার করেছেন। ‘যৌবনটাই জীবন নয়’ সমাজ সমকাল বিবেচনায় গুরুত্বপূর্ণ। আকবর হোসেনের কৃতিত্বে নাটকটি ভিন্নমাত্রা সংযোজন করবে আশা করি।
একসময়ের তুমুল জনপ্রিয় ঔপন্যাসিক আকবর হোসেনকে এই সময়কালীন পাঠকমহল এ নাটকের মাধ্যমে নতুন করে জানার সুযোগ পাবে এবং আকবর হোসেনও নতুনভাবে মূল্যায়িত হবেন- এ প্রত্যাশা স্বাভাবিক।