alt

কবি আসাদ চৌধুরী : ঘরে ফেরা হলো না তাঁর

জয়দুল হোসেন

: বৃহস্পতিবার, ০২ অক্টোবর ২০২৫

আসাদ চৌধুরী/ জন্ম: ১৯৪৩ সালের ১১ ফেব্রুয়ারি, মৃত্যু: ৫ অক্টোবর ২০২৩

গত শতকের ষাটের দশকের বিশিষ্ট কবি ও মুক্তিযোদ্ধা আসাদ চৌধুরী ১৯৬৪ সালে ব্রাহ্মণবাড়িয়া কলেজে তাঁর চাকরি জীবন শুরু করেন। প্রায় আট বছর এই কলেজে অধ্যাপনা করেছেন। ঐ সময় ব্রাহ্মণবাড়িয়ার সাহিত্য ও সাংস্কৃতিক অঙ্গনের সঙ্গে ওতপ্রোতভাবে জড়িত ছিলেন। সাহিত্য-সংস্কৃতিকে সমৃদ্ধ করেছেন, পত্র-পত্রিকা প্রকাশ করেছেন, জাতীয়ভাবে স্থানীয় সাহিত্য সংস্কৃতির যোগসূত্র স্থাপন করেছেন। কৃষক আন্দোলনের সঙ্গেও জড়িত ছিলেন, গ্রামে গ্রামে ঘুরে কৃষকদের সংগঠিত করেছেন, কৃষক সমিতির মাধ্যমে কৃষকদেরকে অধিকার সচেতন করেছেন। প্রগতিশীল সাহিত্য-সংস্কৃতি ও রাজনৈতিক আন্দোলনের সঙ্গে জড়িত ছিলেন। ষাটের দশকে একটি মহল যখন রবীন্দ্রবিরোধিতায় মত্ত হয়েছিল তখন তিনি এর বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়িয়েছিলেন। রবীন্দ্রনাথের পক্ষে বক্তৃতা বিবৃতি দিয়েছেন, পত্র-পত্রিকা ও সংকলন প্রকাশ করেছেন। কলেজে অধ্যাপনার পাশাপাশি এ কাজগুলোও করেছেন। ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় তিনি সর্বজন শ্রদ্ধেয় এবং খুবই জনপ্রিয় ব্যক্তিত্ব হিসেবে পরিচিতি লাভ করেছিলেন।

ব্রাহ্মণবাড়িয়াকে তিনিই প্রথম সংস্কৃতির রাজধানী বলে ঘোষণা করেছিলেন। বলেছিলেন, “আমি সম্পূর্ণ স্বজ্ঞানে, সুস্থ শরীরে, রীতিমতো ভাবনা-চিন্তা করেই অত্যন্ত আনন্দের সঙ্গে একটি ঘোষণা দিচ্ছি, বলা প্রয়োজন, এর জন্য আমি ছাড়া অন্য কেউ আমাকে প্ররোচনা দেয়নি, শলাপরামর্শ দেয়নি, কোনও চাপ প্রয়োগ করেনি। ঘোষণাটি এই, ব্রাহ্মণবাড়িয়াকে শুধু বাংলাদেশেরই নয়, এই উপমহাদেশের সংস্কৃতির রাজধানী হিসেবে ঘোষণা করছি। With great pleasure I hereby declare, henceforth Brahmanbaria shall be the cultural capital of the sulecontinent”.

একটি অঞ্চলের প্রতি কত বেশি ভালোবাসা থাকলে একজন মানুষ এরূপ ঘোষণা দিতে পারেন! তাঁর এই ঘোষণা ব্রাহ্মণবাড়িয়ার মানুষ, বিশেষ করে শিক্ষিতজনেরা মেনে নিয়েছেন। পরবর্তী সময়ে ২০১৮ সালে সরকারি উদ্যোগে দেশের জেলাসমূহকে যখন ‘ব্রান্ডিং’-এর আওতায় নেওয়া হয়, তখন ব্রাহ্মণবাড়িয়া জেলা ব্র্যান্ডিং-এর স্লোগান নির্ধারণ করা হয়, ‘মুক্তিযুদ্ধের চেতনাদীপ্ত সংস্কৃতির রাজধানী ব্রাহ্মণবাড়িয়া।’ এক্ষেত্রে ‘সংস্কৃতির রাজধানী ব্রাহ্মণবাড়িয়া’ কথাটা কবি আসাদ চৌধুরীর কাছ থেকেই ধার নেওয়া হয়েছে। কিন্তু ব্রাহ্মণবাড়িয়াবাসী কবি আসাদ চৌধুরীর জন্য কী করেছে? ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় তাঁকে বিশেষ মর্যাদার আসনে অধিষ্ঠিত করা প্রয়োজন বলে আমরা মনে করি।

দায়িত্বটা কী কেবল সংস্কৃতির? নাকি রাজনীতিরও? রাজনীতিটা এগিয়ে আসলে সংস্কৃতিটাও এগোয়। আবার সংস্কৃতিও অনেক সময় রাজনীতিকে পথ দেখিয়ে এগিয়ে নেয়। এক্ষেত্রে একে অপরের পরিপূরক। তবে রাজনীতির দায়িত্বটাই বেশি।

ব্রাহ্মণবাড়িয়াকে তিনি দ্বিতীয় জন্মস্থান মনে করতেন। তাই তো বারবার ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় চলে আসতেন। ডাক পেলে তো আসতেনই, না পেলেও আসতেন। সাংস্কৃতিক অঙ্গন থেকে ডাকা না হলে স্বেচ্ছায় শ্বশুরলায়ে চলে আসতেন। সাংস্কৃতিক কর্মীরা তখন তাঁর শ্বশুরালয়ে গিয়ে যোগাযোগ করতেন। আড্ডা দিতেন, সাহিত্যের আড্ডা, সংস্কৃতির আড্ডা, এমনকি তুচ্ছ-তাচ্ছিল্য বিষয় নিয়েও আড্ডা হতো। যে কোনো বিষয় নিয়েই আসাদ চৌধুরী জমজমাট আড্ডা জমাতে পারতেন। সমসাময়িক রাজনীতি নিয়েও আলোচনা হতো। রাজনীতি সচেতন কবি ছিলেন তিনি। তাঁর রাজনীতিটা ছিল কৃষক-শ্রমিক আর সাধারণ মানুষের রাজনীতি, প্রগতিশীলতার রাজনীতি। সেই রাজনৈতিক আদর্শই প্রতিফলিত হয়েছে তাঁর কবিতায়। কবিতায় তিনি প্রেম, প্রীতি ও ভালোবাসার পাশাপাশি গণমানুষের কথাই বলেছেন। মানুষের সুখ-শান্তি ও কল্যাণ কামনাই ছিল তাঁর আরাধ্য বিষয়।

বর্ণাঢ্য জীবনের অধিকারী ছিলেন কবি আসাদ চৌধুরী। তাঁর মধ্যে কোনরূপ অহংকার ছিল না। সকলের সঙ্গেই হাসিমুখে কথা বলেছেন। বাংলা কবিতার অনন্য বরপুত্র ছিলেন তিনি। কবিতা গদ্য, স্মৃতিকথা, জীবনী, ছড়া ও শিশুসাহিত্যসহ বাংলা সাহিত্যের বিভিন্ন শাখায় তিনি বিশেষ অবদান রেখেছেন।

সারল্য ছিল তাঁর চরিত্রের সহজাত বৈশিষ্ট্য। সেই সারল্যের ভাষা ও উপমা বিদ্যমান তাঁর কবিতায়। বলা হয়ে থাকে যে, কবিকে পাওয়া যাবে তাঁর কবিতায়। বাংলা সাহিত্যের কাব্যাঙ্গনে তিনি অমর হয়ে থাকলেন। সঙ্গীত বিষয়েও তাঁর অনুরাগ ছিল। সঙ্গীতকে ভালোবাসতেন। সঙ্গীত ও কবিতার মাধ্যমেই মানুষের প্রতি ভালোবাসা ছড়িয়ে দিয়েছেন। বেতার ও টেলিভিশনে শিল্প-সাহিত্যের অনুষ্ঠান উপস্থাপনা করতেন। সেই উপস্থাপনার মাধ্যমে খুবই জনপ্রিয় হয়ে উঠেছিলেন তিনি। সবকিছু ছাড়িয়ে আধুনিক বাংলা কবিতার এক অনিবার্য নাম আসাদ চৌধুরী। ষাটের দশকের কবিতা আন্দোলনের কীর্তিমান ব্যক্তিত্ব তিনি। এরপর থেকে প্রায় ছয়দশক ধরে বাংলা কবিতাকে সমৃদ্ধ করেছেন। তাঁর কবিতায় বাংলার প্রকৃতি ও জনজীবন চিত্রায়িত হয়েছে। কবিতায় তিনি সত্যকে অনুসন্ধান করেছেন। বলেছেন- “কোথায় পালালো সত্য? / দুধের বোতলে, ভাতের হাঁড়িতে! নেই তো / রেস্টুরেন্টে, হোটেলে, সেলুনে, / গ্রন্থাগারের গভীর গন্ধে, / টেলিভিশনে বা সিনেমা, বেতারে / নৌকার খোলে, সাপের ঝাঁপিতে, নেই তো।”

এভাইে বৈঠকি ঢং এ সত্যকে অনুসন্ধান করেছেন কবি আসাদ চৌধুরী। বাংলা সাহিত্যে বৈঠকি কবিতা বলার ধারাটা আসাদ চৌধুরীই প্রবর্তন করেছেন। এক্ষেত্রেও তিনি সফল।

‘বোবার শত্রু নাই’ কবিতায় বলেছেন :

‘বোবার শত্রু নাই, কখনো থাকেন না’।

এ রকম শুনে শুনে শৈশব কৈশোর গ্যালো,

চুপ,

চুপ,

চুপ-

পাখি সেও গান ভুলে ধমক দিয়েছে,

গাছ- বোবা গাছ, সারাক্ষণ জ্বেলে রাখে যারা

নিরীহ সবুজ বাতিগুলো, লাল সিগন্যাল জ্বেলে

বলে, ‘চুপ করো, শুধু ঠোঁট বুঁজে থাক’

বোবাদের শত্রু নাই, মিত্র নাই, কিছুই থাকে না।

... ... ...

প্রচলিত সমাজ ব্যবস্থার প্রতি কতটুকু ক্ষোভ ও দুঃখ থাকলে একজন কবি এরূপ কথা বলতে পারেন তা সহজেই অনুমেয়। অভাব-অনটনে জর্জরিত মানুষের দুঃখ কষ্টে কবিও বিচলিত হতেন। তাই তো ‘লোকটা’ কবিতায় লিখেছেন: “ওদের হাতে ঘড়ি তো নেই, / সময় তো নেই- / সূর্য হলেন ঘড়ি / কয়েক ছটাক চালের জন্য / ডালের জন্য / সবজি-আনাজ, লবণ-ত্যানা, ওষুদ-বিষুধ, / যোগাড় করতে, করতে, করতে, / করতে, করতে- / দাড়ি পাকনো চুলও পাকলো, / কশাইগুলোর পাকা হাতও আরো বেশি / পাকা হল, / কিন্তু /কয়েক ছটাক এটা-সেটা / সবজি-আনাজ, লবণ-ত্যানা / যোগাড় হয়নি, যোগাড় হয় না / হয়না, হয় না, হয় না- / ওদের হাতে ঘড়ি তো নেই / সময় তো নেই / সূর্য হলেন ঘড়ি / কয়েক ছটাক চালের জন্য / ডালের জন্য / সবজি-আনাজ লবণ-ত্যানা ওষুধ-বিষুদ / যোগাড় করতে, করতে, করতে, / করতে, করতে, করতে...”

এভাবেই-অভাবী মানুষের দুঃখ-কষ্ট ও টানাপোড়েনের কথা বলেছেন কবি আসাদ চৌধুরী।জীবনানন্দ দাশ যে বলেছেন : “অদ্ভুত আঁধার এক এসেছে এই পৃথিবীতে আজ / যারা অন্ধ সবচেয়ে বেশি আজ চোখে দেখে তারা / যাদের হৃদয়ে প্রেম নেই প্রীতি নেই / করুণার আলোড়ন নেই / পৃথিবী অচল আজ তাদের সুপরামর্শ ছাড়া”

তেমনিভাবে কবি আসাদ চৌধুরীও উচ্চারণ করেন: “সত্য কথা বলা সহজ যদি না হয় বিপদ, / বাঘের চেয়েও ডরাই তারে যদি সে হয় দ্বিপদ। / সত্যবাণীর উচ্চারণে বুদ্ধিজীবী কাঁপে- / গজ ও ফিতার ধরে রাখেন নিজের পরিমাণে।”

এখানে বুদ্ধিজীবীদের সুবিধাবাদের কথাই বলা হয়েছে। কটাক্ষ করা হয়েছে তাদের নৈতিকতার প্রতি। বুদ্ধিজীবীরা যদি রীতিনীতিহীন হয়ে যায় তবে তো সমাজে আর কিছুই থাকে না। তাই তো বলেছেন : “মাথা থেকে শুরু হয়ে মাছের পচন, / তারপর ক্রমে পচে সমস্ত শরীর / মাছি ভিড় ক’রে তার দ্যাখায় প্রণয় / আমিষানুরাগী হাঁটে নাকে হাত দিয়ে। / মানব-সমাজে যাঁরা মাথার মুকুট / তাঁদের পচন ধরে এই মাথা থেকে / মাছি নয়, লোভ, ভীতি চিহ্ন রাখে দেহে / শান্তি পান বুদ্ধিজীবী পুরস্কার ভেবে। / এসমাজে বাস করে কুকুর, বেড়াল / স্বস্তি পেতে পারে, কিন্তু মানুষ পারে না।”

প্রচলিত সমাজ ব্যবস্থায় মানুষেরা স্বস্তিতে বসবাস করতে পারে না। কবিও স্বস্তিতে বসবাস করতে পারেননি। তাই তো বারবার উচ্চারণ করেছেন ক্ষোভ, দুঃখ ও বেদনার পঙ্ক্তি। ‘সাম্প্রতিক’ কবিতায় বলেছেন: “শিকে ঝোলানো মাংসের দিকে তাকিয়ে তাকিয়ে /শেষে আনাজের দোকানেই যাই- / মাছের রূপালি পিঠ দেখে / খালি হাতে / ঘরে ফিরে আসি, / না, এমন কথা ছিলো না। / খেতে বসে আদরের বেড়ালটাকেও / কাছে পাই নে, / এমন কী জরুরি কাজে, ইদানীং / ভাত বেড়েই তুমিও চলে যাও, / না, না, এমন তো কথা ছিলো না।”

তবুও কবি স্বপ্ন দেখেন, স্বপ্ন দেখতেন সুখী ও সমৃদ্ধ বাংলাদেশের। কিন্তু সেই স্বপ্নও যখন ভেঙে যায় তখন তিনি উচ্চারণ করেন: “স্বপ্নটা তো ভালোই ছিলো / মিছিমিছি ভাঙলে / শোকের হবে, দুঃখের হবে / কেমন ক’রে জানলে? / ঘরে অভাব বিশ্রী স্বভাব, / এ-সব টেনে আনলে। / স্বপ্নটাই তো ভালো ছিলো / মিছিমিছি ভাঙলে।”

কিন্তু অন্ধ হলেই যেমন প্রলয় বন্ধ থাকে না, তেমনি স্বপ্নের মধ্যে ডুবে থেকেও দুঃখকে দূর করা যায় না। দুঃখ যাদের পিছু নিয়েছে, সুখ তাদের কাছে সুদূর পরাহত। তাই তো ‘দুঃখ পড়তে ভাল্ লাগে না’ কবিতায় বলেছেন:

দুঃখ পড়তে ভাল্ লাগে না, ভাল্ লাগে না

আকাশ থেকে দুঃখ দুঃখ-বৃষ্টি

গাছের মতো মাটি ফুঁড়ে দুঃখ- ¯রাতের কলকলানি,

মন তোমাকে এই অবেলায় কোথায় রাখি,

কোথায় রাখি?

রাজ্য জুড়ে যখন অন্ধকার বিরাজ করে তখনো কবি গরিব দুঃখী মানুষের মনে আলো ছড়াতে চান। তাই তো বলেন: “ট্রেন যায় হিশ-হিশ, / বায়ু করে ফিশ-ফিশ, / চোর যায় চুপ-চাপ / গাড়ি যায় ধুপ-ধাপ, / গরিবের দিন যায় / কী করে? / জানিবার সাধ হ’লে / হাত দাও শিকড়ে।”

শিকড়ের মানুষের উন্নতিতেই দেশের উন্নতি। তাই তো শিকড়ের মানুষের উন্নতিই কবির কাম্য ছিল।

কবি আসাদ চৌধুরী জমিদার পরিবারের সন্তান। বরিশালের উলানিয়া জমিদার পরিবারেই তাঁর জন্ম। তাঁর জীবনে কোনো দুঃখ থাকার কথা নয়। তবুও তিনি দুঃখকে সঙ্গে নিয়েই বসবাস করেছেন। মানুষের দঃখে ব্যথিত হয়েছেন। জমিদারি ঠাট ছেড়ে দিয়ে এসে চাকরি করেছেন বেসরকারি কলেজে। ব্রাহ্মণবাড়িয়া কলেজ তখন বেসরকারিই ছিল। পরবর্তীতে যা অর্জন করেছেন তা নিজের চেষ্টায়। তবুও তিনি সাধারণ মানুষের সুখ-দুঃখের কথা বলেছেন কবিতায়। সুখী ও সমৃদ্ধ একটি বাংলাদেশ দেখে যেতে চেয়েছেন। তাঁর আকাক্সক্ষা পূরণ হয়নি এখনো। তবে একদিন পূরণ হবে, এমন আশা তো আমরা করতেই পারি।

গত কয়েক বছর ধরে তিনি সপরিবারে কানাডায় বসবাস করছিলেন। মাটি ও মানুষের টানে মাঝেমধ্যেই বাংলাদেশে চলে আসতেন। বিশেষ করে একুশের বইমেলাকে সামনে রেখে তো আসতেনই। বাংলা একাডেমিতে চাকরি করার সময় বইমেলার গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্বগুলো তিনিই পালন করতেন। তাই তো বইমেলা তাঁকে টানতো। বইমেলার সময় দেশে থাকলে তো অবশ্যই, বিদেশে থাকলেও চলে আসতেন। কিন্তু দুঃখজনক এই যে বইমেলার টানে তিনি আর বাংলাদেশে আসতে পারবেন না। সপরিবারে কানাডায় অবস্থানকালে সেখানেই প্রয়াত হয়েছেন। পারিবারিক ইচ্ছায় সেখানেই তাঁকে সমাহিত করা হয়েছে। দেশে ফিরিয়ে আনার কথা কেউ ভাবলেন না। না সরকার, না দেশের কবি-সাহিত্যিকগণ।

তাঁর একটি কাব্যগ্রন্থের নাম, ‘ঘরে ফেরা সোজা নয়।’ কবিরা ভবিষ্যৎদ্রষ্টা- একথা হয় তো তিনি আগেই বুঝতে পেরেছিলেন, তাই তো কাব্যগ্রন্থের এরূপ নামকরণ করেছিলেন।

ঘরে ফিরতে না পারার আক্ষেপ কবি আসাদ চৌধুরীর প্রথম কাব্যগ্রন্থ ‘তবক দেওয়া পান’-এর উৎসর্গপত্রেই লক্ষ্য করা যায়: “আমার গোটা শরীর কিছুতেই ঘরে আসতে চায় না, / হয়তো সবটা দেহ / কোনোদিন ঘরে ফেরে নি। / এটা আমি আগে টের পাই নি, / আর পেলেই বা কী হতো? / চিকিৎসার জন্য আমি তো আর ডাক্তারের কাছে যাচ্ছি না / সাহানা, তোমার কাছেই এসেছি। / এবার দ্যাখো তো, / আমার শরীরের কিছু অংশ / বাইরে কোথাও / ফেলে এলাম কি না?”

কে জানতো কবির এই আক্ষেপই সত্যে পরিণত হবে? তারপর একই কাব্যগ্রন্থের ‘ঘরের বাঁশি’ কবিতার শেষাংশে বলেছেন : “ঘরের বাঁশি তো সব প্রবাসীই শোনেন / সাঁই এলেন, / সে তো খালি হাতে / ধুকে ধুকে আসছে না- / ও ময়ূর, আমি পাগল হয়ে যাব।” কবি আসাদ চৌধুরীও প্রবাসে থেকে ঘরের বাঁশি শুনেছেন। কিন্তু ঘরে ফেরা সহজ হলো না।

কবি আসাদ চৌধুরী ১৯৪৩ সালের ১১ ফেব্রুয়ারি বরিশালের মেহেন্দীগঞ্জ উপজেলাধীন উলানিয়ায় জন্মগ্রহণ করেন এবং ৫ অক্টোবর ২০২৩ তারিখে কানাডার একটি হাসপাতালে ইন্তেকাল করেন। তাঁর বয়স হয়েছিল ৮০ বছর। তাঁর পিতার নাম মোহাম্মদ আরিফ চৌধুরী, মাতার নাম সৈয়দা মাহমুদা বেগম। স্ত্রীর নাম সাহানা বেগম। দুই ছেলে ও এক কন্যা সন্তানের জনক জননী তাঁরা। পুত্রদের নাম: আসিফ চৌধুরী ও জারিফ চৌধুরী। কন্যার নাম নূসরাত জাহান চৌধুরী শাওলী, কন্যার জামাতা নাদিম ইকবাল।

কবি আসাদ চৌধুরীর বাল্য ও কৈশোর কটেছে বরিশালে। বরিশালের উলানিয়া হাই স্কুল থেকে ১৯৫৭ সালে মাধ্যমিক এবং ১৯৬০ সালে ব্রজমোহন কলেজ থেকে উচ্চমাধ্যমিক পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হন। পরবর্তী কালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে বাংলা ভাষা ও সাহিত্যে অধ্যয়ন করেন। ১৯৬৩ সালে ¯স্নাতক এবং ১৯৬৪ সালে স্নাতকোত্তর ডিগ্রি লাভ করেন। অতঃপর ব্রাহ্মণবাড়িয়া কলেজে অধ্যাপনার মাধ্যমে কর্মজীবনে প্রবেশ করেন। ১৯৬৪ সালের ডিসেম্বর থেকে ১৯৭৩ এর জানুয়ারি পর্যন্ত তিনি ব্রাহ্মণবাড়িয়া কলেজে অধ্যাপনা করেছেন। মাঝখানে ১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধে অংশ নেওয়ার জন্য ভারতে চলে যান। সেখানে স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র ও জয়বাংলা পত্রিকা অফিসে কাজ করেছেন। মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে সংবাদ ভাষ্য, কথিকা ও প্রতিবেদন লিখেছেন। তাঁর কথিকা ও সংবাদভাষ্য জয়বাংলা পত্রিকা এবং স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রের মাধ্যমে গণসচেতনতা সৃষ্টি করেছে, মুক্তিযোদ্ধাদেরকে উদ্বুদ্ধ করেছে। দেশ স্বাধীন হওয়ার পর ভারত থেকে ফিরে এসে ১৯৭২ সালে তিনি পুনরায় ব্রাহ্মণবাড়িয়া কলেজে যোগদান করেন।

১৯৭৩ সালে আসাদ চৌধুরী বাংলা একাডেমিতে যোগদান করে ঢাকায় থিতু হন। তখনো ব্রাহ্মণবাড়িয়ার সাথে নিয়মিত যোগাযোগ রেখেছেন। ব্রাহ্মণবাড়িয়ার মেয়েকে বিয়ে করেছেন। ইচ্ছা ছিল ব্রাহ্মণবাড়িয়াতেই স্থায়ীভাবে বসবাস করবেন। কিন্তু বাস্তবতার জটিলতা তা হতে দিল না।

১৯৮৫ থেকে ১৯৮৮ সাল পর্যন্ত ভয়েজ অব জার্মানির বাংলা বিভাগে চাকরি করেছেন। তখন তিনি সপরিবারে সেখানে বসবাস করেছেন। ১৯৮৮ সালে সেখান থেকে ফিরে এসে পুনরায় বাংলা একাডেমিতে যোগদান করেন। পরবর্তীতে বাংলা একাডেমির পরিচালক হিসেবে চাকরি থেকে অবসর গ্রহণ করেন।

কবি আসাদ চৌধুরী ১৯৮৭ সালে বাংলা একাডেমি পুরস্কার এবং ২০১৩ সালে একুশে পদক লাভ করেন। এছাড়াও বিভিন্ন সময়ে আবুল হাসান স্মৃতি পুরস্কার, অগ্রণী ব্যাংক শিশুসাহিত্য পুরস্কার, জাতীয় কবিতা পরিষদ পুরস্কার, আলাওল সাহিত্য পুরস্কার, বঙ্গবন্ধু সম্মাননা, খান মোহম্মদ ফারাবী সাহিত্য পুরস্কার, অশ্বিনীকুমার পদক, জীবনানন্দ দাশ পদক, অতীশদীপঙ্কর স্বর্ণপদক, ত্রিভুজ সাহিত্য পুরস্কার শম্ভুগঞ্জ এনায়েতপুরী স্বর্ণপদক, বরিশাল বিভাগীয় স্বর্ণপদক, শব্দভূমি আজীবন সাহিত্য সম্মাননা ইত্যাদি পদক ও পুরস্কারে ভূষিত হয়েছেন।

১৯৭৫ সালে কবির প্রথম কাব্যগ্রন্থ ‘তবক দেওয়া পান’ প্রকাশিত হয়। গ্রন্থটির মাধ্যমে তিনি ব্যাপক জনপ্রিয়তা অর্জন করেন। এরপর পর্যায়ক্রমে প্রকাশিত হয় প্রায় শতাধিক গ্রন্থ।

ছবি

ধ্রুপদী বোধ ও ব্যাধির কবিতা

ছবি

সুকান্তর কবিতায় বিপ্লবী চেতনা

সাময়িকী কবিতা

ছবি

মগ্নচৈতন্যে সৌন্দর্যধ্যান

ছবি

অধুনাবাদী নিরীক্ষার অগ্রসাধক

ছবি

‘বায়ান্নর আধুনিকতা ও প্রগতিশীল ধারাকে বহন করতে চেয়েছি’

ছবি

জাতীয় চেতনার অমলিন ধারক

ছবি

নক্ষত্রের অনন্ত যাত্রা

ছবি

আহমদ রফিক ও ভাষামুক্তি সাধনা

ছবি

জীবনবোধের অনবদ্য চিত্ররূপ ‘স্বপ্নছোঁয়ার পদযাত্রা’

ছবি

অনালোকিত ইতিহাসের সন্ধানে

ছবি

কবিরের দোঁহা

ছবি

আকবর হোসেন ও ‘যৌবনটাই জীবন নয়’

ছবি

স্বোপার্জিত

ছবি

সংগ্রামের অগ্নিশিখা থেকে হেলাল হাফিজ

ছবি

কোনো এক শরৎসন্ধ্যা : কোথায় পাব তারে

শারদ পদাবলি

ছবি

লক্ষীপুর-হ

ছবি

যে জীবন ফড়িংয়ের

সাময়িকী কবিতা

ছবি

বিশাল ডানাওলা এক থুত্থুরে বুড়ো মানুষ

ছবি

খুদে গল্পের যাদুকর ওসামা অ্যালোমার

ছবি

নিমগ্ন লালন সাধক ফরিদা পারভীন

ছবি

কেন তিনি লালনকন্যা

ছবি

টি এস এলিয়টের সংস্কৃতি চিন্তার অভিমুখ

ছবি

আধুনিক বাংলা কবিতার একশ’ বছর

ছবি

বিশ্বসাহিত্যে এর প্রতিফলন

ছবি

মোজগান ফারামানেশ-এর কবিতা

ছবি

চোখ

ছবি

যোগফল শূন্য

সাময়িকী কবিতা

ছবি

লাল লুঙ্গি

ছবি

শ্বেতা শতাব্দী এষের কবিতা

ছবি

বিপন্ন মানুষের মনোবাস্তবতার স্বরূপ

ছবি

দিনু বিল্লাহ: জীবনমরণের সীমানা ছাড়ায়ে

জেলার সিরিজ কবিতা

tab

কবি আসাদ চৌধুরী : ঘরে ফেরা হলো না তাঁর

জয়দুল হোসেন

আসাদ চৌধুরী/ জন্ম: ১৯৪৩ সালের ১১ ফেব্রুয়ারি, মৃত্যু: ৫ অক্টোবর ২০২৩

বৃহস্পতিবার, ০২ অক্টোবর ২০২৫

গত শতকের ষাটের দশকের বিশিষ্ট কবি ও মুক্তিযোদ্ধা আসাদ চৌধুরী ১৯৬৪ সালে ব্রাহ্মণবাড়িয়া কলেজে তাঁর চাকরি জীবন শুরু করেন। প্রায় আট বছর এই কলেজে অধ্যাপনা করেছেন। ঐ সময় ব্রাহ্মণবাড়িয়ার সাহিত্য ও সাংস্কৃতিক অঙ্গনের সঙ্গে ওতপ্রোতভাবে জড়িত ছিলেন। সাহিত্য-সংস্কৃতিকে সমৃদ্ধ করেছেন, পত্র-পত্রিকা প্রকাশ করেছেন, জাতীয়ভাবে স্থানীয় সাহিত্য সংস্কৃতির যোগসূত্র স্থাপন করেছেন। কৃষক আন্দোলনের সঙ্গেও জড়িত ছিলেন, গ্রামে গ্রামে ঘুরে কৃষকদের সংগঠিত করেছেন, কৃষক সমিতির মাধ্যমে কৃষকদেরকে অধিকার সচেতন করেছেন। প্রগতিশীল সাহিত্য-সংস্কৃতি ও রাজনৈতিক আন্দোলনের সঙ্গে জড়িত ছিলেন। ষাটের দশকে একটি মহল যখন রবীন্দ্রবিরোধিতায় মত্ত হয়েছিল তখন তিনি এর বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়িয়েছিলেন। রবীন্দ্রনাথের পক্ষে বক্তৃতা বিবৃতি দিয়েছেন, পত্র-পত্রিকা ও সংকলন প্রকাশ করেছেন। কলেজে অধ্যাপনার পাশাপাশি এ কাজগুলোও করেছেন। ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় তিনি সর্বজন শ্রদ্ধেয় এবং খুবই জনপ্রিয় ব্যক্তিত্ব হিসেবে পরিচিতি লাভ করেছিলেন।

ব্রাহ্মণবাড়িয়াকে তিনিই প্রথম সংস্কৃতির রাজধানী বলে ঘোষণা করেছিলেন। বলেছিলেন, “আমি সম্পূর্ণ স্বজ্ঞানে, সুস্থ শরীরে, রীতিমতো ভাবনা-চিন্তা করেই অত্যন্ত আনন্দের সঙ্গে একটি ঘোষণা দিচ্ছি, বলা প্রয়োজন, এর জন্য আমি ছাড়া অন্য কেউ আমাকে প্ররোচনা দেয়নি, শলাপরামর্শ দেয়নি, কোনও চাপ প্রয়োগ করেনি। ঘোষণাটি এই, ব্রাহ্মণবাড়িয়াকে শুধু বাংলাদেশেরই নয়, এই উপমহাদেশের সংস্কৃতির রাজধানী হিসেবে ঘোষণা করছি। With great pleasure I hereby declare, henceforth Brahmanbaria shall be the cultural capital of the sulecontinent”.

একটি অঞ্চলের প্রতি কত বেশি ভালোবাসা থাকলে একজন মানুষ এরূপ ঘোষণা দিতে পারেন! তাঁর এই ঘোষণা ব্রাহ্মণবাড়িয়ার মানুষ, বিশেষ করে শিক্ষিতজনেরা মেনে নিয়েছেন। পরবর্তী সময়ে ২০১৮ সালে সরকারি উদ্যোগে দেশের জেলাসমূহকে যখন ‘ব্রান্ডিং’-এর আওতায় নেওয়া হয়, তখন ব্রাহ্মণবাড়িয়া জেলা ব্র্যান্ডিং-এর স্লোগান নির্ধারণ করা হয়, ‘মুক্তিযুদ্ধের চেতনাদীপ্ত সংস্কৃতির রাজধানী ব্রাহ্মণবাড়িয়া।’ এক্ষেত্রে ‘সংস্কৃতির রাজধানী ব্রাহ্মণবাড়িয়া’ কথাটা কবি আসাদ চৌধুরীর কাছ থেকেই ধার নেওয়া হয়েছে। কিন্তু ব্রাহ্মণবাড়িয়াবাসী কবি আসাদ চৌধুরীর জন্য কী করেছে? ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় তাঁকে বিশেষ মর্যাদার আসনে অধিষ্ঠিত করা প্রয়োজন বলে আমরা মনে করি।

দায়িত্বটা কী কেবল সংস্কৃতির? নাকি রাজনীতিরও? রাজনীতিটা এগিয়ে আসলে সংস্কৃতিটাও এগোয়। আবার সংস্কৃতিও অনেক সময় রাজনীতিকে পথ দেখিয়ে এগিয়ে নেয়। এক্ষেত্রে একে অপরের পরিপূরক। তবে রাজনীতির দায়িত্বটাই বেশি।

ব্রাহ্মণবাড়িয়াকে তিনি দ্বিতীয় জন্মস্থান মনে করতেন। তাই তো বারবার ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় চলে আসতেন। ডাক পেলে তো আসতেনই, না পেলেও আসতেন। সাংস্কৃতিক অঙ্গন থেকে ডাকা না হলে স্বেচ্ছায় শ্বশুরলায়ে চলে আসতেন। সাংস্কৃতিক কর্মীরা তখন তাঁর শ্বশুরালয়ে গিয়ে যোগাযোগ করতেন। আড্ডা দিতেন, সাহিত্যের আড্ডা, সংস্কৃতির আড্ডা, এমনকি তুচ্ছ-তাচ্ছিল্য বিষয় নিয়েও আড্ডা হতো। যে কোনো বিষয় নিয়েই আসাদ চৌধুরী জমজমাট আড্ডা জমাতে পারতেন। সমসাময়িক রাজনীতি নিয়েও আলোচনা হতো। রাজনীতি সচেতন কবি ছিলেন তিনি। তাঁর রাজনীতিটা ছিল কৃষক-শ্রমিক আর সাধারণ মানুষের রাজনীতি, প্রগতিশীলতার রাজনীতি। সেই রাজনৈতিক আদর্শই প্রতিফলিত হয়েছে তাঁর কবিতায়। কবিতায় তিনি প্রেম, প্রীতি ও ভালোবাসার পাশাপাশি গণমানুষের কথাই বলেছেন। মানুষের সুখ-শান্তি ও কল্যাণ কামনাই ছিল তাঁর আরাধ্য বিষয়।

বর্ণাঢ্য জীবনের অধিকারী ছিলেন কবি আসাদ চৌধুরী। তাঁর মধ্যে কোনরূপ অহংকার ছিল না। সকলের সঙ্গেই হাসিমুখে কথা বলেছেন। বাংলা কবিতার অনন্য বরপুত্র ছিলেন তিনি। কবিতা গদ্য, স্মৃতিকথা, জীবনী, ছড়া ও শিশুসাহিত্যসহ বাংলা সাহিত্যের বিভিন্ন শাখায় তিনি বিশেষ অবদান রেখেছেন।

সারল্য ছিল তাঁর চরিত্রের সহজাত বৈশিষ্ট্য। সেই সারল্যের ভাষা ও উপমা বিদ্যমান তাঁর কবিতায়। বলা হয়ে থাকে যে, কবিকে পাওয়া যাবে তাঁর কবিতায়। বাংলা সাহিত্যের কাব্যাঙ্গনে তিনি অমর হয়ে থাকলেন। সঙ্গীত বিষয়েও তাঁর অনুরাগ ছিল। সঙ্গীতকে ভালোবাসতেন। সঙ্গীত ও কবিতার মাধ্যমেই মানুষের প্রতি ভালোবাসা ছড়িয়ে দিয়েছেন। বেতার ও টেলিভিশনে শিল্প-সাহিত্যের অনুষ্ঠান উপস্থাপনা করতেন। সেই উপস্থাপনার মাধ্যমে খুবই জনপ্রিয় হয়ে উঠেছিলেন তিনি। সবকিছু ছাড়িয়ে আধুনিক বাংলা কবিতার এক অনিবার্য নাম আসাদ চৌধুরী। ষাটের দশকের কবিতা আন্দোলনের কীর্তিমান ব্যক্তিত্ব তিনি। এরপর থেকে প্রায় ছয়দশক ধরে বাংলা কবিতাকে সমৃদ্ধ করেছেন। তাঁর কবিতায় বাংলার প্রকৃতি ও জনজীবন চিত্রায়িত হয়েছে। কবিতায় তিনি সত্যকে অনুসন্ধান করেছেন। বলেছেন- “কোথায় পালালো সত্য? / দুধের বোতলে, ভাতের হাঁড়িতে! নেই তো / রেস্টুরেন্টে, হোটেলে, সেলুনে, / গ্রন্থাগারের গভীর গন্ধে, / টেলিভিশনে বা সিনেমা, বেতারে / নৌকার খোলে, সাপের ঝাঁপিতে, নেই তো।”

এভাইে বৈঠকি ঢং এ সত্যকে অনুসন্ধান করেছেন কবি আসাদ চৌধুরী। বাংলা সাহিত্যে বৈঠকি কবিতা বলার ধারাটা আসাদ চৌধুরীই প্রবর্তন করেছেন। এক্ষেত্রেও তিনি সফল।

‘বোবার শত্রু নাই’ কবিতায় বলেছেন :

‘বোবার শত্রু নাই, কখনো থাকেন না’।

এ রকম শুনে শুনে শৈশব কৈশোর গ্যালো,

চুপ,

চুপ,

চুপ-

পাখি সেও গান ভুলে ধমক দিয়েছে,

গাছ- বোবা গাছ, সারাক্ষণ জ্বেলে রাখে যারা

নিরীহ সবুজ বাতিগুলো, লাল সিগন্যাল জ্বেলে

বলে, ‘চুপ করো, শুধু ঠোঁট বুঁজে থাক’

বোবাদের শত্রু নাই, মিত্র নাই, কিছুই থাকে না।

... ... ...

প্রচলিত সমাজ ব্যবস্থার প্রতি কতটুকু ক্ষোভ ও দুঃখ থাকলে একজন কবি এরূপ কথা বলতে পারেন তা সহজেই অনুমেয়। অভাব-অনটনে জর্জরিত মানুষের দুঃখ কষ্টে কবিও বিচলিত হতেন। তাই তো ‘লোকটা’ কবিতায় লিখেছেন: “ওদের হাতে ঘড়ি তো নেই, / সময় তো নেই- / সূর্য হলেন ঘড়ি / কয়েক ছটাক চালের জন্য / ডালের জন্য / সবজি-আনাজ, লবণ-ত্যানা, ওষুদ-বিষুধ, / যোগাড় করতে, করতে, করতে, / করতে, করতে- / দাড়ি পাকনো চুলও পাকলো, / কশাইগুলোর পাকা হাতও আরো বেশি / পাকা হল, / কিন্তু /কয়েক ছটাক এটা-সেটা / সবজি-আনাজ, লবণ-ত্যানা / যোগাড় হয়নি, যোগাড় হয় না / হয়না, হয় না, হয় না- / ওদের হাতে ঘড়ি তো নেই / সময় তো নেই / সূর্য হলেন ঘড়ি / কয়েক ছটাক চালের জন্য / ডালের জন্য / সবজি-আনাজ লবণ-ত্যানা ওষুধ-বিষুদ / যোগাড় করতে, করতে, করতে, / করতে, করতে, করতে...”

এভাবেই-অভাবী মানুষের দুঃখ-কষ্ট ও টানাপোড়েনের কথা বলেছেন কবি আসাদ চৌধুরী।জীবনানন্দ দাশ যে বলেছেন : “অদ্ভুত আঁধার এক এসেছে এই পৃথিবীতে আজ / যারা অন্ধ সবচেয়ে বেশি আজ চোখে দেখে তারা / যাদের হৃদয়ে প্রেম নেই প্রীতি নেই / করুণার আলোড়ন নেই / পৃথিবী অচল আজ তাদের সুপরামর্শ ছাড়া”

তেমনিভাবে কবি আসাদ চৌধুরীও উচ্চারণ করেন: “সত্য কথা বলা সহজ যদি না হয় বিপদ, / বাঘের চেয়েও ডরাই তারে যদি সে হয় দ্বিপদ। / সত্যবাণীর উচ্চারণে বুদ্ধিজীবী কাঁপে- / গজ ও ফিতার ধরে রাখেন নিজের পরিমাণে।”

এখানে বুদ্ধিজীবীদের সুবিধাবাদের কথাই বলা হয়েছে। কটাক্ষ করা হয়েছে তাদের নৈতিকতার প্রতি। বুদ্ধিজীবীরা যদি রীতিনীতিহীন হয়ে যায় তবে তো সমাজে আর কিছুই থাকে না। তাই তো বলেছেন : “মাথা থেকে শুরু হয়ে মাছের পচন, / তারপর ক্রমে পচে সমস্ত শরীর / মাছি ভিড় ক’রে তার দ্যাখায় প্রণয় / আমিষানুরাগী হাঁটে নাকে হাত দিয়ে। / মানব-সমাজে যাঁরা মাথার মুকুট / তাঁদের পচন ধরে এই মাথা থেকে / মাছি নয়, লোভ, ভীতি চিহ্ন রাখে দেহে / শান্তি পান বুদ্ধিজীবী পুরস্কার ভেবে। / এসমাজে বাস করে কুকুর, বেড়াল / স্বস্তি পেতে পারে, কিন্তু মানুষ পারে না।”

প্রচলিত সমাজ ব্যবস্থায় মানুষেরা স্বস্তিতে বসবাস করতে পারে না। কবিও স্বস্তিতে বসবাস করতে পারেননি। তাই তো বারবার উচ্চারণ করেছেন ক্ষোভ, দুঃখ ও বেদনার পঙ্ক্তি। ‘সাম্প্রতিক’ কবিতায় বলেছেন: “শিকে ঝোলানো মাংসের দিকে তাকিয়ে তাকিয়ে /শেষে আনাজের দোকানেই যাই- / মাছের রূপালি পিঠ দেখে / খালি হাতে / ঘরে ফিরে আসি, / না, এমন কথা ছিলো না। / খেতে বসে আদরের বেড়ালটাকেও / কাছে পাই নে, / এমন কী জরুরি কাজে, ইদানীং / ভাত বেড়েই তুমিও চলে যাও, / না, না, এমন তো কথা ছিলো না।”

তবুও কবি স্বপ্ন দেখেন, স্বপ্ন দেখতেন সুখী ও সমৃদ্ধ বাংলাদেশের। কিন্তু সেই স্বপ্নও যখন ভেঙে যায় তখন তিনি উচ্চারণ করেন: “স্বপ্নটা তো ভালোই ছিলো / মিছিমিছি ভাঙলে / শোকের হবে, দুঃখের হবে / কেমন ক’রে জানলে? / ঘরে অভাব বিশ্রী স্বভাব, / এ-সব টেনে আনলে। / স্বপ্নটাই তো ভালো ছিলো / মিছিমিছি ভাঙলে।”

কিন্তু অন্ধ হলেই যেমন প্রলয় বন্ধ থাকে না, তেমনি স্বপ্নের মধ্যে ডুবে থেকেও দুঃখকে দূর করা যায় না। দুঃখ যাদের পিছু নিয়েছে, সুখ তাদের কাছে সুদূর পরাহত। তাই তো ‘দুঃখ পড়তে ভাল্ লাগে না’ কবিতায় বলেছেন:

দুঃখ পড়তে ভাল্ লাগে না, ভাল্ লাগে না

আকাশ থেকে দুঃখ দুঃখ-বৃষ্টি

গাছের মতো মাটি ফুঁড়ে দুঃখ- ¯রাতের কলকলানি,

মন তোমাকে এই অবেলায় কোথায় রাখি,

কোথায় রাখি?

রাজ্য জুড়ে যখন অন্ধকার বিরাজ করে তখনো কবি গরিব দুঃখী মানুষের মনে আলো ছড়াতে চান। তাই তো বলেন: “ট্রেন যায় হিশ-হিশ, / বায়ু করে ফিশ-ফিশ, / চোর যায় চুপ-চাপ / গাড়ি যায় ধুপ-ধাপ, / গরিবের দিন যায় / কী করে? / জানিবার সাধ হ’লে / হাত দাও শিকড়ে।”

শিকড়ের মানুষের উন্নতিতেই দেশের উন্নতি। তাই তো শিকড়ের মানুষের উন্নতিই কবির কাম্য ছিল।

কবি আসাদ চৌধুরী জমিদার পরিবারের সন্তান। বরিশালের উলানিয়া জমিদার পরিবারেই তাঁর জন্ম। তাঁর জীবনে কোনো দুঃখ থাকার কথা নয়। তবুও তিনি দুঃখকে সঙ্গে নিয়েই বসবাস করেছেন। মানুষের দঃখে ব্যথিত হয়েছেন। জমিদারি ঠাট ছেড়ে দিয়ে এসে চাকরি করেছেন বেসরকারি কলেজে। ব্রাহ্মণবাড়িয়া কলেজ তখন বেসরকারিই ছিল। পরবর্তীতে যা অর্জন করেছেন তা নিজের চেষ্টায়। তবুও তিনি সাধারণ মানুষের সুখ-দুঃখের কথা বলেছেন কবিতায়। সুখী ও সমৃদ্ধ একটি বাংলাদেশ দেখে যেতে চেয়েছেন। তাঁর আকাক্সক্ষা পূরণ হয়নি এখনো। তবে একদিন পূরণ হবে, এমন আশা তো আমরা করতেই পারি।

গত কয়েক বছর ধরে তিনি সপরিবারে কানাডায় বসবাস করছিলেন। মাটি ও মানুষের টানে মাঝেমধ্যেই বাংলাদেশে চলে আসতেন। বিশেষ করে একুশের বইমেলাকে সামনে রেখে তো আসতেনই। বাংলা একাডেমিতে চাকরি করার সময় বইমেলার গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্বগুলো তিনিই পালন করতেন। তাই তো বইমেলা তাঁকে টানতো। বইমেলার সময় দেশে থাকলে তো অবশ্যই, বিদেশে থাকলেও চলে আসতেন। কিন্তু দুঃখজনক এই যে বইমেলার টানে তিনি আর বাংলাদেশে আসতে পারবেন না। সপরিবারে কানাডায় অবস্থানকালে সেখানেই প্রয়াত হয়েছেন। পারিবারিক ইচ্ছায় সেখানেই তাঁকে সমাহিত করা হয়েছে। দেশে ফিরিয়ে আনার কথা কেউ ভাবলেন না। না সরকার, না দেশের কবি-সাহিত্যিকগণ।

তাঁর একটি কাব্যগ্রন্থের নাম, ‘ঘরে ফেরা সোজা নয়।’ কবিরা ভবিষ্যৎদ্রষ্টা- একথা হয় তো তিনি আগেই বুঝতে পেরেছিলেন, তাই তো কাব্যগ্রন্থের এরূপ নামকরণ করেছিলেন।

ঘরে ফিরতে না পারার আক্ষেপ কবি আসাদ চৌধুরীর প্রথম কাব্যগ্রন্থ ‘তবক দেওয়া পান’-এর উৎসর্গপত্রেই লক্ষ্য করা যায়: “আমার গোটা শরীর কিছুতেই ঘরে আসতে চায় না, / হয়তো সবটা দেহ / কোনোদিন ঘরে ফেরে নি। / এটা আমি আগে টের পাই নি, / আর পেলেই বা কী হতো? / চিকিৎসার জন্য আমি তো আর ডাক্তারের কাছে যাচ্ছি না / সাহানা, তোমার কাছেই এসেছি। / এবার দ্যাখো তো, / আমার শরীরের কিছু অংশ / বাইরে কোথাও / ফেলে এলাম কি না?”

কে জানতো কবির এই আক্ষেপই সত্যে পরিণত হবে? তারপর একই কাব্যগ্রন্থের ‘ঘরের বাঁশি’ কবিতার শেষাংশে বলেছেন : “ঘরের বাঁশি তো সব প্রবাসীই শোনেন / সাঁই এলেন, / সে তো খালি হাতে / ধুকে ধুকে আসছে না- / ও ময়ূর, আমি পাগল হয়ে যাব।” কবি আসাদ চৌধুরীও প্রবাসে থেকে ঘরের বাঁশি শুনেছেন। কিন্তু ঘরে ফেরা সহজ হলো না।

কবি আসাদ চৌধুরী ১৯৪৩ সালের ১১ ফেব্রুয়ারি বরিশালের মেহেন্দীগঞ্জ উপজেলাধীন উলানিয়ায় জন্মগ্রহণ করেন এবং ৫ অক্টোবর ২০২৩ তারিখে কানাডার একটি হাসপাতালে ইন্তেকাল করেন। তাঁর বয়স হয়েছিল ৮০ বছর। তাঁর পিতার নাম মোহাম্মদ আরিফ চৌধুরী, মাতার নাম সৈয়দা মাহমুদা বেগম। স্ত্রীর নাম সাহানা বেগম। দুই ছেলে ও এক কন্যা সন্তানের জনক জননী তাঁরা। পুত্রদের নাম: আসিফ চৌধুরী ও জারিফ চৌধুরী। কন্যার নাম নূসরাত জাহান চৌধুরী শাওলী, কন্যার জামাতা নাদিম ইকবাল।

কবি আসাদ চৌধুরীর বাল্য ও কৈশোর কটেছে বরিশালে। বরিশালের উলানিয়া হাই স্কুল থেকে ১৯৫৭ সালে মাধ্যমিক এবং ১৯৬০ সালে ব্রজমোহন কলেজ থেকে উচ্চমাধ্যমিক পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হন। পরবর্তী কালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে বাংলা ভাষা ও সাহিত্যে অধ্যয়ন করেন। ১৯৬৩ সালে ¯স্নাতক এবং ১৯৬৪ সালে স্নাতকোত্তর ডিগ্রি লাভ করেন। অতঃপর ব্রাহ্মণবাড়িয়া কলেজে অধ্যাপনার মাধ্যমে কর্মজীবনে প্রবেশ করেন। ১৯৬৪ সালের ডিসেম্বর থেকে ১৯৭৩ এর জানুয়ারি পর্যন্ত তিনি ব্রাহ্মণবাড়িয়া কলেজে অধ্যাপনা করেছেন। মাঝখানে ১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধে অংশ নেওয়ার জন্য ভারতে চলে যান। সেখানে স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র ও জয়বাংলা পত্রিকা অফিসে কাজ করেছেন। মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে সংবাদ ভাষ্য, কথিকা ও প্রতিবেদন লিখেছেন। তাঁর কথিকা ও সংবাদভাষ্য জয়বাংলা পত্রিকা এবং স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রের মাধ্যমে গণসচেতনতা সৃষ্টি করেছে, মুক্তিযোদ্ধাদেরকে উদ্বুদ্ধ করেছে। দেশ স্বাধীন হওয়ার পর ভারত থেকে ফিরে এসে ১৯৭২ সালে তিনি পুনরায় ব্রাহ্মণবাড়িয়া কলেজে যোগদান করেন।

১৯৭৩ সালে আসাদ চৌধুরী বাংলা একাডেমিতে যোগদান করে ঢাকায় থিতু হন। তখনো ব্রাহ্মণবাড়িয়ার সাথে নিয়মিত যোগাযোগ রেখেছেন। ব্রাহ্মণবাড়িয়ার মেয়েকে বিয়ে করেছেন। ইচ্ছা ছিল ব্রাহ্মণবাড়িয়াতেই স্থায়ীভাবে বসবাস করবেন। কিন্তু বাস্তবতার জটিলতা তা হতে দিল না।

১৯৮৫ থেকে ১৯৮৮ সাল পর্যন্ত ভয়েজ অব জার্মানির বাংলা বিভাগে চাকরি করেছেন। তখন তিনি সপরিবারে সেখানে বসবাস করেছেন। ১৯৮৮ সালে সেখান থেকে ফিরে এসে পুনরায় বাংলা একাডেমিতে যোগদান করেন। পরবর্তীতে বাংলা একাডেমির পরিচালক হিসেবে চাকরি থেকে অবসর গ্রহণ করেন।

কবি আসাদ চৌধুরী ১৯৮৭ সালে বাংলা একাডেমি পুরস্কার এবং ২০১৩ সালে একুশে পদক লাভ করেন। এছাড়াও বিভিন্ন সময়ে আবুল হাসান স্মৃতি পুরস্কার, অগ্রণী ব্যাংক শিশুসাহিত্য পুরস্কার, জাতীয় কবিতা পরিষদ পুরস্কার, আলাওল সাহিত্য পুরস্কার, বঙ্গবন্ধু সম্মাননা, খান মোহম্মদ ফারাবী সাহিত্য পুরস্কার, অশ্বিনীকুমার পদক, জীবনানন্দ দাশ পদক, অতীশদীপঙ্কর স্বর্ণপদক, ত্রিভুজ সাহিত্য পুরস্কার শম্ভুগঞ্জ এনায়েতপুরী স্বর্ণপদক, বরিশাল বিভাগীয় স্বর্ণপদক, শব্দভূমি আজীবন সাহিত্য সম্মাননা ইত্যাদি পদক ও পুরস্কারে ভূষিত হয়েছেন।

১৯৭৫ সালে কবির প্রথম কাব্যগ্রন্থ ‘তবক দেওয়া পান’ প্রকাশিত হয়। গ্রন্থটির মাধ্যমে তিনি ব্যাপক জনপ্রিয়তা অর্জন করেন। এরপর পর্যায়ক্রমে প্রকাশিত হয় প্রায় শতাধিক গ্রন্থ।

back to top