আবিদ আজাদ
মাহফুজ আল-হোসেন
আবিদ আজাদ / জন্ম: ১৬ নভেম্বর ১৯৫২; মৃত্যু: ২২ মার্চ ২০০৫
আবিদ আজাদ, আধুনিক বাংলা কবিতার এক ভীষণ রকমের অবমূল্যায়িত কবি। অন্যায্যভাবে সরলীকরণ কিংবা পার্শ্বদৃষ্টি থেকে তার সম্পর্কে কোনো না কোনো গড়পড়তা মন্তব্য প্রায়শই করা হয়ে থাকে। বোধগম্য হলে তা আর কবিতা থাকে না বলে যারা মনে করেন তাদের কাছে আবিদ আজাদ কেন রবীন্দ্রনাথ কিংবা শামসুর রাহমানের লেখা অনেক কবিতাই কবিতা পদবাচ্য নয়। কালানুক্রমিক বিবেচনায় আবিদ আজাদকে বিংশ শতাব্দীর সত্তরের দশকের কবি হিসেবে দেখা হয়। তবে ‘সত্তর দশকের বাংলা কবিতা’ এবং ‘সত্তর দশকে আবির্ভূত কবি’- এ দুটি প্রত্যয়ের মধ্যে ঐতিহাসিকভাবে ভিন্নতা রয়েছে।
আবিদ আজাদের প্রথম কাব্যগ্রন্থ ‘ঘাসের ঘটনা’ ১৯৭৬ সালে প্রকাশিত হয়, তখন তার বয়স ছিল মাত্র ২৪। সবুজ শ্যামল গ্রাম থেকে উঠে আসা এক তরুণের কবিতায় গ্রামের প্রকৃতিমুগ্ধতা থাকলেও আঙ্গিক ও কাব্যভাষায় ছিল শাহরিক চাকচিক্য:
‘ঘাসে ঘাসে নিঃশব্দ চাকচিক্য ঝরানো
গুচ্ছ গুচ্ছ পিচ্ছিল আলজিভ
এইভাবে আমার রক্তপ্রহর শুরু হয়েছিল।’
তবে সত্তরের দশকের প্রতিটি কাব্য আলোচনায় অনিবার্যভাবেই চলে আসে কবি আবিদ আজাদের নাম। রচনাকালের এই যে দশকী বিবেচনা- সেটি নিয়েও প্রশ্ন উত্থাপিত হতে পারে। কারণ শিল্পসুকৃতির কাল-নিরপেক্ষ বিচার এক্ষেত্রে উপেক্ষিত। অন্যদের বড়ো করতে গিয়ে গৌণ কবিদের কাতারে আবিদ আজাদকে দেখার যে চেষ্টা (অপচেষ্টা বলবো) দশকভিত্তিক এসব কোনো কোনো আলোচনার মূল লক্ষ্য। তবে আবিদ আজাদের কবিসত্তা নিয়ে কারো মনে যদি প্রশ্ন থাকে, তার একটা চমৎকার জবাব দিয়েছেন কবি ও সাহিত্য পর্যালোচক আব্দুল মান্নান সৈয়দ : ‘আবিদ আজাদ কবি, আপাদমস্তক কবি, কবি ছাড়া আর কিছুই নন। কবিতা ছাড়া তিনি নাটক ও গল্প লিখেছেন, প্রবন্ধ ও গ্রন্থালোচনা লিখেছেন- কিন্তু তাঁর সব রচনাই ভেসে গেছে কবিতার অপ্রতিরোধ্য জোয়ারে। নাটক ও গল্পের নামে, প্রবন্ধ ও গ্রন্থালোচনার ছদ্মবেশে তিনি কবিতাই লিখেছেন। তাঁর সমস্ত রচনাতেই কবিতার গোপন সঞ্চার, কবিতার অনিরুদ্ধ আঘাত। আবিদ আজাদের উচ্চারণ মাত্রই কবিতা।’ (আব্দুল মান্নান সৈয়দ, করতলে মহাদেশ, ১৯৯৩, পৃ: ১৯৬)। আবিদ আজাদ পুরোদস্তুর কবি বলেই এসব সমালোচনার জবাব তিনি কবিতাতেই দিয়ে গেছেন:
‘সমালোচনা থামুক এবার তর্ক উঠুক গাছের মাথায়
কবিতা কি গোয়ার্তুমি, আটি খুঁড়ে তুলবো খাতায়?’
(সমালোচকের উদ্দেশে)
যুদ্ধোত্তর বাংলাদেশে আকাশকুসুম প্রত্যাশার সাথে প্রাপ্তির অমিল থাকায় আশাভঙ্গের বেদনা থেকে জন্ম নেয় অবিমৃষ্যকারী অতিবিপ্লবী তৎপরতা। সত্তরের কবিতার এক বিরাট ক্যানভাস জুড়ে রয়েছে হতাশায় নিমজ্জিত ক্লেদাক্ত নাগরিক জীবনের চালচ্চিত্র। জীবন জীবিকার সন্ধানে মেট্রোপলিটন শহরে আসা তরুণ কবি আবিদ আজাদের পঙ্ক্তিতেও আমরা আবিষ্কার করি ব্যক্তিগত নৈরাশ্য ও একান্ত আত্মগত নিঃসঙ্গতার বোধ আর নোংরা আবর্জনাময় পরিবেশে অসহনীয় নাগরিক জীবন:
১.
“যে পথে যাই আমার আজ নিজের সাথে দেখা / যেখানে যাই আজকে আমি আমার সাথে একা” (অবেলা)
২.
“বরং এখানেই থেকে যাবে তুমি / মুখচেনা শহরের পরিচিত এই গলিতেই থাকবে তুমি / আর অন্ধকার এক গলি থেকে অন্য গলিতে / পচা তেনাতাগা এবং ন্যাকড়ার গন্ধে দাঁড়িয়ে থাকা গলিঘুঁজিতে / তুমি নিজেই তোমার পিছনে গুপ্তচরের মতো ঘুরবে সারাদিন / তুমি নিজেই তোমার আততায়ীর মতো ঢুকে পড়বে তালা খুলে তোমার নিঃসঙ্গ কামরায়।” (তোমার নিস্তার নেই)
৩.
“যে শহরে আমি নেই আমি থাকব না সে শহরে যুদ্ধ শেষের ভাঙা পোড়া একটা এয়ারপোর্টের মতো বেঁচে থাকবে তুমি/ তোমাকে ঘিরে সারাক্ষণ দাঁড়িয়ে থাকবে স্কার্টপরা বুড়ি বার্মিজ মহিলার মতো ভৌতিক নির্জনতা / তোমাকে ঘিরে সারাক্ষণ ঝুলে থাকবে তছনছ তারের জটিলতা / লতাগুল্মময় ক্রেনের কঙ্কাল, জংপড়া লোহালক্কড় আর হিং¯্র ঘাসের মধ্যে ধু-ধু করবে তোমার জীবন / ভয়ার্ত সব মিলিটারি ভ্যান আর উল্টে থাকা ট্রলির পাশে ক্ষত-বিক্ষত একটা চাঁদ ওঠা রানওয়ের মতো / তুমি মুখ লুকিয়ে রাখবে গা-ছমছম করা জ্যোৎস্নায়। / যে শহরে আমি নেই আমি থাকব না সে শহরে জনহীন কোনো পেট্রোল পাম্পের দেয়াল ঘেঁষে একটা মরা শিউলি গাছের মতো বেঁচে থাকবে তুমি-/ তোমাকে ঘিরে হা-হা করবে নিদাঘরাত / দেখবে পর্যুদস্ত একটা হেলমেটের ফাটল দিয়ে মাথা তুলছে একগুচ্ছ সবুজ তৃণ / শুনবে ধ্বংসস্তূপের মধ্যে অর্ধডোবা সূর্যাস্তের মতো আগুন লাগা বিলুপ্তপ্রায় লাউঞ্জ থেকে ভেসে আসছে প্রেতহাসির শব্দ / আর তোমাকে ঘিরে নামবে এক জোড়া জনশূন্য বুটের স্তব্ধতা।” (যে শহরে আমি নেই আমি থাকবো না)
আবার নিবিষ্ট সাধনায় উপর্যুক্ত বিচ্ছিন্নতার বোধ এবং নৈরাশ্যকে জয় করে সত্তরের দশকের তরুণ কবিদের মধ্যে অনেকেই স্বতন্ত্রস্বর তৈরিতে সফল হয়েছিলেন, এর মধ্যে আবিদ আজাদ অন্যতম। আবিদ আজাদের কবিতায় বিধৃত হয়েছে মুক্তিসংগ্রামের গৌরবময় ইতিহাস,বাংলার জল হাওয়া মৃত্তিকাসঞ্জাত স্বদেশপ্রেমের উচ্চারণ: “বাংলাদেশ ব্যাংকের সামনে ফুটে উঠলো আমার শাদা শাপলাফুল। / এই শাদা ফুলের ছায়ায় ফুটে আছে কুঁড়েঘর / যে কুঁড়েঘরের চালগুলি বহুদিন শুনেছে যুদ্ধ বিমানের গর্জন / যে কুঁড়েঘরগুলি উঠানে দাঁড়িয়ে খড়ের গাদার পাশে শুনেছে লাজুক কিষাণীর আর্তনাদ / যে কুঁড়েঘরগুলি গভীর জোৎস্নারাতে দেখেছে চকচকে বন্দুকের নল” (নির্মিত কহলারে যেন পাই আবক্ষ বাংলাদেশ)
আবিদ আজাদের কবিতাকে লিরিকধর্মী বলা হয়ে থাকে। গীতলতা নিঃসন্দেহে তাঁর কবিতার অন্যতম বৈশিষ্ট্য। অনেক কবিতায় একই গীতভাষ্য পুনরাবৃত্ত হয়ে সাঙ্গীতিক আবহ তৈরি করে:
ক.
“তোমাদের উঠোনে কি বৃষ্টি নামে? রেলগাড়ি থামে? / বলো থামে? / হাসো কেন? প্লিজ, বলো নামে-/ নামে বৃষ্টি হুশহুশ ধোঁয়ায়? / ঘরের ফুসফুস ভরে ওঠে হঠাৎ উত্তুরে হাওয়ায়! / নামে বৃষ্টি ঝরঝরে খোয়ায়? / সবজি ক্ষেত পাতা ভরে তুলে রাখে ছাই? / পাটকরা শাড়ির ভাঁজের মতো সাদা ছাই? / ইস্ত্রি-ভাঙা জামাকাপড়ের মতো কালো ছাই? / মখমলের মতো পাছা তুলে হঠাৎ এক লাল গাই” (তোমাদের স্টেশনে কি বৃষ্টি নামে? রেলগাড়ি থামে?)
খ.
“চুমুর টিলায় দাঁড়িয়েছিলাম / মনে আছে, মনে? / দুলল আকাশ দুলল পাতাল / পায়ের নিচের পৃথিবী মাতাল / মনে আছে, মনে? / কেবল আমরা টলিনি দুইজনে” (চুমু)
গ.
“আমি একটা উজ্জ্বল ঝলমলে ডানার সুন্দর মোরগ / ছাইগাদার ভিতর থেকে ঠুকরে-ঠুকরে তুলছি / লাউয়ের ফুলের মতো টগবগে আগুন / আর খুঁটে-খুঁটে খাচ্ছি তোমার বাড়ির অপরাহ্ণময় হৃদরোগ।” (মোরগ)
আবিদ আজাদের কবিতার এই যে গীতল বৈশিষ্ট্য সেটিকে কেউ কেউ আউটডেটেড ভেবে নেতিবাচক মন্তব্য করেন; কিন্তু তাঁর কাব্যভাষা যে সর্বাংশে আধুনিক সেটি কৌতূহলী পাঠক লক্ষ্য করলেই বুঝতে পারবেন। মগ্নচৈতন্যপ্রবাহ, পরাবাস্ততা, এমনকি উত্তরাধুনিক ব্যক্তিক অনুভব তাকে প্রণোদিত করছে ইন্দ্রিয়শাসিত উদ্দাম কাব্য নির্মিতিতে।
এক.
“মুহূর্তে আমার মনে হলো/ একটি ছিদ্রের মতো ভোর / আর শিশিরেরা ডানা মেলে / উড়ে আসছে / উঠে আসছে অফুরন্ত মাছি / মাছি... মাছি... / কুয়াশায় ঘাসের মাছির / উড়ন্ত প্রবাহ থেকে ছিঁড়ে / নিঃসঙ্গ উজ্জ্বল দুটি মাছি / বিমানের অবতরণের / মতো ঘুরে-ঘুরে উড়ে-উড়ে / পৃথিবীতে কোথাও একটি / নিরাপদ বিমানবন্দর / না পেয়ে নামল অবশেষে / আমাদেরই ভোরের টেবিলে। (উড়ে যাবে তর্কে বহুদূর)
দুই.
“আমার মনে হলো মানুষের জীবন এরকমই এক ধরনের অবর্ণনীয় আর অলৌকিক একটা অপ্রতিরোধ্য বিনিময় আমার জীবনের ভিতরেও কোথায় যেন এমনি একটি উৎসুক পাতাবাহারের গাছ আছে যার অনেক পাতার ভিড়ের মধ্যে হলুদ আর লাল-সাদার প্রিন্টআঁকা একান্ত ইন্দ্রিয়প্রবণ একটি পাতার ওপর কোনো এক অদৃশ্য কার্নিস থেকে চুয়ে-চুয়ে বৃষ্টিফোঁটার মতো অনবরত তোমাকে চাওয়ার তোমাকে পাওয়ার তোমাকে হারাবার গতানুগত সেই দিনগুলোর অনেক চুম্বন আর অনেক গ্লানির অনেক আলিঙ্গন আর অনেক যৌনমিলনের শরীরী তীব্রতার আনন্দের ক্লান্তির আর অবসাদের স্মৃতির ফোঁটাগুলো ঝরে পড়েছে প্রচ- নিঃশব্দে- ভয়ংকর শ্লথতায়-
আর আমি আমার কবিতায় এই অবর্ণনীয় বিনিময়ের অভিজ্ঞতাগুলোই পুনর্বিন্যস্ত করতে চেয়েছি আজীবন।”(বৃষ্টির ফোঁটা ও পাতাবাহার গাছ নিয়ে)
তিন.
“তারপর সেই বেবি সাইকেল / বধ্যভূমির অসংখ্য হাড় ও কঙ্কালের মধ্যে / বসন্তের দুরন্ত হাওয়ার মতো পাক খেয়ে বেরিয়ে এল / স্টোর কক্ষ থেকে। / কিচেনের পাশ দিয়ে করিডোর পেরিয়ে / বেডরুমের দরজা খুলে / ড্রইংরুমে ঢুকে কয়েকটা এলোমেলো চক্কর দিয়ে / সিঁড়ি বেয়ে নিচে নেমে গেলো রাস্তায় / মিশে গেল ব্যক্ত মানুষ ও যানবাহনের ভিড়ে।” (একটি বেবি সাইকেল নিয়ে)
চার.
“নৌকাভ্রমণে গিয়ে অভিজ্ঞতা হলো, / একবার দুজন খুব জলের কাছে সরে / এসে / নুয়ে তাকিয়েছিলাম নিচে / যেখানে থির জলে ফুটেছিল আমাদের নৌকার গলুই / আর / কান্তিমান চলন্ত চোখে-চোখে তাকিয়ে / মনে হয়েছিল আমার / নৌকার গলুইটা যেন জলের নিচের গলুইটাকে / চুমু খাবে বলে ভেসে গেল সারা দিন ধরে- / কিন্তু সারা জীবনে কোনোদিন চুমু খাওয়া হবে না তার / আমি বুঝেছিলাম, তুমিও বুঝেছিলে / তবু তো সেই নৌকাযাত্রার দুপুরে
আমরা আমাদের জীবনের দীর্ঘতম চুমুটি খেয়েছিলাম, মনে আছে?” (অভিজ্ঞতা)
পাঁচ.
“আমি ছুঁয়েছিলাম তার স্তন / এমন মর্মরিত নৈঃশব্দ্য আমি জীবনে ছুঁইনি / আমি ছুঁয়েছিলাম তার আঙুলগুচ্ছের অন্ধকার / এমন অসাধারণ ব্যর্থতার পাশে আর আমি কোনোদিন দাঁড়াইনি / আমি নাক ডুবিয়ে দিয়েছিলাম তার চুলে / এমন পল্লবিত গাছের ঘ্রাণ আমি আর কখনো পাইনি / আমি মুখ গুঁজে দিয়েছিলাম তার কাঁধে / এমনভাবে আর আমি ভেঙে পড়িনি কোনোদিন / আমি চুমু খেয়েছিলাম তার ঠোঁটে / এমন দীর্ঘ নৈঃসঙ্গ্যের কবলে / আমি আর কোনোদিন পড়িনি” (ভ্রমণ কাহিনী)
আবিদ আজাদের কবিতায় ছিলো দৈশিক ঐতিহ্যিক উপাদান, সেই সাথে যুক্ত হয়েছিলো আন্তর্জাতিকতার বোধ ও বিশ্ব রাজনীতি। আমরা এখন চতুর্থ শিল্পবিপ্লবের উপকণ্ঠে। মানুষের প্রতিদ্বন্দ্বী হিসেবে আবির্ভূত হতে যাচ্ছে স্বসৃষ্ট কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তাসম্পন্ন যন্ত্রদানব রোবোট, মানুষের আবেগ অনুভূতির চিরন্তনতা, চিন্তাশীলতা ও সৃজনশীলতা পড়তে যাচ্ছে চ্যালেঞ্জের মুখে, রাষ্ট্রব্যবস্থা-বিশ্বব্যবস্থা জিম্মি হয়ে পড়েছে মহাক্ষমতাধর কর্পোরেট পুঁজির সর্বগ্রাসী আগ্রাসনের কাছে, তার খামখেয়ালিপূর্ণ খেলাধুলার কাছে। আশ্চর্য হতে হয়, এহেন পরিস্থিতিতেও আবিদ আজাদের কবিতার পঙ্ক্তিমালা প্রাসঙ্গিকতা হারায়নি:
১.
“আমি জানি পৃথিবীর সমস্ত সমুদ্রপথ যদিও এখন / সমরাস্ত্রবাহী সব রণতরীদের ভয়ে আতঙ্কিত আজ / যদিও শঙ্কিত / নও তুমি উৎকণ্ঠিত” (চা)
২.
“এ যুগ খেলনার যুগ / এ যুগে সবকিছু খেলনা / মানুষ খেলনা / মানুষের স্বাধীনতাও খেলনা / রাষ্ট্র খেলনা / জাতীয় পতাকাও খেলনা / সার্বভৌমত্ব খেলনা / জাতিসংঘও খেলনা / এক খেলনা আরেক খেলনা নিয়ে / খেলতে খেলতে ক্লান্ত হয়ে ঘুমিয়ে পড়ে / তাদের খেলনা-জীবনে।” (খেলনা যুগ)
আবিদ আজাদ কেন লিখেছেন সে প্রশ্নের উত্তরও দিয়ে গেছেন অসামান্য উপমায়, আর অতুলনীয় উপমাগুলো ছিলো কবি হিসেবে তাঁর শক্তিমত্তার জায়গা: “কেন দেখি প্রচ- বৃষ্টির মধ্যে সবুজ পাতার / বাথরুমে স্নান করে নির্জনতা: / পাশে তার একটি রক্তিম ফল- / কেন দেখি একজোড়া ঝকঝকে নতুন টেলিফোন সেটের মতন সাদা/ দুটো ভীরু খরগোশ হঠাৎ লাফিয়ে ওঠে দুপুরে দুরন্ত বিছানায়? / তাই লিখি।” (কেন লিখি)
মাত্র বায়ান্ন বছরের জীবন পেয়েছিলেন কবি আবিদ আজাদ। আমৃত্যু করে গেছেন কবিতাশিল্পের অমৃত অন্বেষণ। তাঁর কবিতার আবেদন চিরন্তন এবং সর্বকালিক। সেজন্য আমার ক্ষুদ্র বিবেচনায় কবি আবিদ আজাদকে বাংলা কবিতায় অধুনাবাদী নিরীক্ষার নির্জনতম অগ্রসাধক বললেও বোধহয় অত্ত্যুক্তি হবেনা।
তথ্যসূত্র :
১. অরণি : বাংলা কবিতার পঞ্চাশ বছর, জানুয়ারি-জুন ২০১১
২. আব্দুল মান্নান সৈয়দ, করতলে মহাদেশ, অবসর, ১৯৯৩
৩. উদয় নারায়ণ সিংহ, সাহিত্যের ভাষা : ভাষার সাহিত্য, অনুষ্টুপ, কোলকাতা, আগস্ট ২০১০
৪. ওবায়েদ আকাশ (সম্পাদিত), শালুক, ২০ বছর পূর্তি নিবিড় সম্মিলন সংখ্যা ২০১৯
৫. বাঙালি বাংলাদেশ, ১৪০০ সাল উদযাপন পরিষদ, পহেলা বৈশাখ ১৪০০
৬. বিশ্বজিৎ ঘোষ, বাংলাদেশের সাহিত্য, আজকাল প্রকাশনী, মে ২০১৮ (পরিমার্জিত ও পরিবর্ধিত সংস্করণ)
৭. শহীদ ইকবাল, বাংলাদেশের কবিতার ইতিহাস : ১৯৪৭-২০০০, রোদেলা প্রকাশনী, ২০১৩
৮. হুমায়ুন আজাদ (সম্পাদিত), আধুনিক বাংলা কবিতা, আগামী, ফেব্রুয়ারি ১৯৯৪
৯. www.google.com
আবিদ আজাদ
মাহফুজ আল-হোসেন
আবিদ আজাদ / জন্ম: ১৬ নভেম্বর ১৯৫২; মৃত্যু: ২২ মার্চ ২০০৫
বৃহস্পতিবার, ০৯ অক্টোবর ২০২৫
আবিদ আজাদ, আধুনিক বাংলা কবিতার এক ভীষণ রকমের অবমূল্যায়িত কবি। অন্যায্যভাবে সরলীকরণ কিংবা পার্শ্বদৃষ্টি থেকে তার সম্পর্কে কোনো না কোনো গড়পড়তা মন্তব্য প্রায়শই করা হয়ে থাকে। বোধগম্য হলে তা আর কবিতা থাকে না বলে যারা মনে করেন তাদের কাছে আবিদ আজাদ কেন রবীন্দ্রনাথ কিংবা শামসুর রাহমানের লেখা অনেক কবিতাই কবিতা পদবাচ্য নয়। কালানুক্রমিক বিবেচনায় আবিদ আজাদকে বিংশ শতাব্দীর সত্তরের দশকের কবি হিসেবে দেখা হয়। তবে ‘সত্তর দশকের বাংলা কবিতা’ এবং ‘সত্তর দশকে আবির্ভূত কবি’- এ দুটি প্রত্যয়ের মধ্যে ঐতিহাসিকভাবে ভিন্নতা রয়েছে।
আবিদ আজাদের প্রথম কাব্যগ্রন্থ ‘ঘাসের ঘটনা’ ১৯৭৬ সালে প্রকাশিত হয়, তখন তার বয়স ছিল মাত্র ২৪। সবুজ শ্যামল গ্রাম থেকে উঠে আসা এক তরুণের কবিতায় গ্রামের প্রকৃতিমুগ্ধতা থাকলেও আঙ্গিক ও কাব্যভাষায় ছিল শাহরিক চাকচিক্য:
‘ঘাসে ঘাসে নিঃশব্দ চাকচিক্য ঝরানো
গুচ্ছ গুচ্ছ পিচ্ছিল আলজিভ
এইভাবে আমার রক্তপ্রহর শুরু হয়েছিল।’
তবে সত্তরের দশকের প্রতিটি কাব্য আলোচনায় অনিবার্যভাবেই চলে আসে কবি আবিদ আজাদের নাম। রচনাকালের এই যে দশকী বিবেচনা- সেটি নিয়েও প্রশ্ন উত্থাপিত হতে পারে। কারণ শিল্পসুকৃতির কাল-নিরপেক্ষ বিচার এক্ষেত্রে উপেক্ষিত। অন্যদের বড়ো করতে গিয়ে গৌণ কবিদের কাতারে আবিদ আজাদকে দেখার যে চেষ্টা (অপচেষ্টা বলবো) দশকভিত্তিক এসব কোনো কোনো আলোচনার মূল লক্ষ্য। তবে আবিদ আজাদের কবিসত্তা নিয়ে কারো মনে যদি প্রশ্ন থাকে, তার একটা চমৎকার জবাব দিয়েছেন কবি ও সাহিত্য পর্যালোচক আব্দুল মান্নান সৈয়দ : ‘আবিদ আজাদ কবি, আপাদমস্তক কবি, কবি ছাড়া আর কিছুই নন। কবিতা ছাড়া তিনি নাটক ও গল্প লিখেছেন, প্রবন্ধ ও গ্রন্থালোচনা লিখেছেন- কিন্তু তাঁর সব রচনাই ভেসে গেছে কবিতার অপ্রতিরোধ্য জোয়ারে। নাটক ও গল্পের নামে, প্রবন্ধ ও গ্রন্থালোচনার ছদ্মবেশে তিনি কবিতাই লিখেছেন। তাঁর সমস্ত রচনাতেই কবিতার গোপন সঞ্চার, কবিতার অনিরুদ্ধ আঘাত। আবিদ আজাদের উচ্চারণ মাত্রই কবিতা।’ (আব্দুল মান্নান সৈয়দ, করতলে মহাদেশ, ১৯৯৩, পৃ: ১৯৬)। আবিদ আজাদ পুরোদস্তুর কবি বলেই এসব সমালোচনার জবাব তিনি কবিতাতেই দিয়ে গেছেন:
‘সমালোচনা থামুক এবার তর্ক উঠুক গাছের মাথায়
কবিতা কি গোয়ার্তুমি, আটি খুঁড়ে তুলবো খাতায়?’
(সমালোচকের উদ্দেশে)
যুদ্ধোত্তর বাংলাদেশে আকাশকুসুম প্রত্যাশার সাথে প্রাপ্তির অমিল থাকায় আশাভঙ্গের বেদনা থেকে জন্ম নেয় অবিমৃষ্যকারী অতিবিপ্লবী তৎপরতা। সত্তরের কবিতার এক বিরাট ক্যানভাস জুড়ে রয়েছে হতাশায় নিমজ্জিত ক্লেদাক্ত নাগরিক জীবনের চালচ্চিত্র। জীবন জীবিকার সন্ধানে মেট্রোপলিটন শহরে আসা তরুণ কবি আবিদ আজাদের পঙ্ক্তিতেও আমরা আবিষ্কার করি ব্যক্তিগত নৈরাশ্য ও একান্ত আত্মগত নিঃসঙ্গতার বোধ আর নোংরা আবর্জনাময় পরিবেশে অসহনীয় নাগরিক জীবন:
১.
“যে পথে যাই আমার আজ নিজের সাথে দেখা / যেখানে যাই আজকে আমি আমার সাথে একা” (অবেলা)
২.
“বরং এখানেই থেকে যাবে তুমি / মুখচেনা শহরের পরিচিত এই গলিতেই থাকবে তুমি / আর অন্ধকার এক গলি থেকে অন্য গলিতে / পচা তেনাতাগা এবং ন্যাকড়ার গন্ধে দাঁড়িয়ে থাকা গলিঘুঁজিতে / তুমি নিজেই তোমার পিছনে গুপ্তচরের মতো ঘুরবে সারাদিন / তুমি নিজেই তোমার আততায়ীর মতো ঢুকে পড়বে তালা খুলে তোমার নিঃসঙ্গ কামরায়।” (তোমার নিস্তার নেই)
৩.
“যে শহরে আমি নেই আমি থাকব না সে শহরে যুদ্ধ শেষের ভাঙা পোড়া একটা এয়ারপোর্টের মতো বেঁচে থাকবে তুমি/ তোমাকে ঘিরে সারাক্ষণ দাঁড়িয়ে থাকবে স্কার্টপরা বুড়ি বার্মিজ মহিলার মতো ভৌতিক নির্জনতা / তোমাকে ঘিরে সারাক্ষণ ঝুলে থাকবে তছনছ তারের জটিলতা / লতাগুল্মময় ক্রেনের কঙ্কাল, জংপড়া লোহালক্কড় আর হিং¯্র ঘাসের মধ্যে ধু-ধু করবে তোমার জীবন / ভয়ার্ত সব মিলিটারি ভ্যান আর উল্টে থাকা ট্রলির পাশে ক্ষত-বিক্ষত একটা চাঁদ ওঠা রানওয়ের মতো / তুমি মুখ লুকিয়ে রাখবে গা-ছমছম করা জ্যোৎস্নায়। / যে শহরে আমি নেই আমি থাকব না সে শহরে জনহীন কোনো পেট্রোল পাম্পের দেয়াল ঘেঁষে একটা মরা শিউলি গাছের মতো বেঁচে থাকবে তুমি-/ তোমাকে ঘিরে হা-হা করবে নিদাঘরাত / দেখবে পর্যুদস্ত একটা হেলমেটের ফাটল দিয়ে মাথা তুলছে একগুচ্ছ সবুজ তৃণ / শুনবে ধ্বংসস্তূপের মধ্যে অর্ধডোবা সূর্যাস্তের মতো আগুন লাগা বিলুপ্তপ্রায় লাউঞ্জ থেকে ভেসে আসছে প্রেতহাসির শব্দ / আর তোমাকে ঘিরে নামবে এক জোড়া জনশূন্য বুটের স্তব্ধতা।” (যে শহরে আমি নেই আমি থাকবো না)
আবার নিবিষ্ট সাধনায় উপর্যুক্ত বিচ্ছিন্নতার বোধ এবং নৈরাশ্যকে জয় করে সত্তরের দশকের তরুণ কবিদের মধ্যে অনেকেই স্বতন্ত্রস্বর তৈরিতে সফল হয়েছিলেন, এর মধ্যে আবিদ আজাদ অন্যতম। আবিদ আজাদের কবিতায় বিধৃত হয়েছে মুক্তিসংগ্রামের গৌরবময় ইতিহাস,বাংলার জল হাওয়া মৃত্তিকাসঞ্জাত স্বদেশপ্রেমের উচ্চারণ: “বাংলাদেশ ব্যাংকের সামনে ফুটে উঠলো আমার শাদা শাপলাফুল। / এই শাদা ফুলের ছায়ায় ফুটে আছে কুঁড়েঘর / যে কুঁড়েঘরের চালগুলি বহুদিন শুনেছে যুদ্ধ বিমানের গর্জন / যে কুঁড়েঘরগুলি উঠানে দাঁড়িয়ে খড়ের গাদার পাশে শুনেছে লাজুক কিষাণীর আর্তনাদ / যে কুঁড়েঘরগুলি গভীর জোৎস্নারাতে দেখেছে চকচকে বন্দুকের নল” (নির্মিত কহলারে যেন পাই আবক্ষ বাংলাদেশ)
আবিদ আজাদের কবিতাকে লিরিকধর্মী বলা হয়ে থাকে। গীতলতা নিঃসন্দেহে তাঁর কবিতার অন্যতম বৈশিষ্ট্য। অনেক কবিতায় একই গীতভাষ্য পুনরাবৃত্ত হয়ে সাঙ্গীতিক আবহ তৈরি করে:
ক.
“তোমাদের উঠোনে কি বৃষ্টি নামে? রেলগাড়ি থামে? / বলো থামে? / হাসো কেন? প্লিজ, বলো নামে-/ নামে বৃষ্টি হুশহুশ ধোঁয়ায়? / ঘরের ফুসফুস ভরে ওঠে হঠাৎ উত্তুরে হাওয়ায়! / নামে বৃষ্টি ঝরঝরে খোয়ায়? / সবজি ক্ষেত পাতা ভরে তুলে রাখে ছাই? / পাটকরা শাড়ির ভাঁজের মতো সাদা ছাই? / ইস্ত্রি-ভাঙা জামাকাপড়ের মতো কালো ছাই? / মখমলের মতো পাছা তুলে হঠাৎ এক লাল গাই” (তোমাদের স্টেশনে কি বৃষ্টি নামে? রেলগাড়ি থামে?)
খ.
“চুমুর টিলায় দাঁড়িয়েছিলাম / মনে আছে, মনে? / দুলল আকাশ দুলল পাতাল / পায়ের নিচের পৃথিবী মাতাল / মনে আছে, মনে? / কেবল আমরা টলিনি দুইজনে” (চুমু)
গ.
“আমি একটা উজ্জ্বল ঝলমলে ডানার সুন্দর মোরগ / ছাইগাদার ভিতর থেকে ঠুকরে-ঠুকরে তুলছি / লাউয়ের ফুলের মতো টগবগে আগুন / আর খুঁটে-খুঁটে খাচ্ছি তোমার বাড়ির অপরাহ্ণময় হৃদরোগ।” (মোরগ)
আবিদ আজাদের কবিতার এই যে গীতল বৈশিষ্ট্য সেটিকে কেউ কেউ আউটডেটেড ভেবে নেতিবাচক মন্তব্য করেন; কিন্তু তাঁর কাব্যভাষা যে সর্বাংশে আধুনিক সেটি কৌতূহলী পাঠক লক্ষ্য করলেই বুঝতে পারবেন। মগ্নচৈতন্যপ্রবাহ, পরাবাস্ততা, এমনকি উত্তরাধুনিক ব্যক্তিক অনুভব তাকে প্রণোদিত করছে ইন্দ্রিয়শাসিত উদ্দাম কাব্য নির্মিতিতে।
এক.
“মুহূর্তে আমার মনে হলো/ একটি ছিদ্রের মতো ভোর / আর শিশিরেরা ডানা মেলে / উড়ে আসছে / উঠে আসছে অফুরন্ত মাছি / মাছি... মাছি... / কুয়াশায় ঘাসের মাছির / উড়ন্ত প্রবাহ থেকে ছিঁড়ে / নিঃসঙ্গ উজ্জ্বল দুটি মাছি / বিমানের অবতরণের / মতো ঘুরে-ঘুরে উড়ে-উড়ে / পৃথিবীতে কোথাও একটি / নিরাপদ বিমানবন্দর / না পেয়ে নামল অবশেষে / আমাদেরই ভোরের টেবিলে। (উড়ে যাবে তর্কে বহুদূর)
দুই.
“আমার মনে হলো মানুষের জীবন এরকমই এক ধরনের অবর্ণনীয় আর অলৌকিক একটা অপ্রতিরোধ্য বিনিময় আমার জীবনের ভিতরেও কোথায় যেন এমনি একটি উৎসুক পাতাবাহারের গাছ আছে যার অনেক পাতার ভিড়ের মধ্যে হলুদ আর লাল-সাদার প্রিন্টআঁকা একান্ত ইন্দ্রিয়প্রবণ একটি পাতার ওপর কোনো এক অদৃশ্য কার্নিস থেকে চুয়ে-চুয়ে বৃষ্টিফোঁটার মতো অনবরত তোমাকে চাওয়ার তোমাকে পাওয়ার তোমাকে হারাবার গতানুগত সেই দিনগুলোর অনেক চুম্বন আর অনেক গ্লানির অনেক আলিঙ্গন আর অনেক যৌনমিলনের শরীরী তীব্রতার আনন্দের ক্লান্তির আর অবসাদের স্মৃতির ফোঁটাগুলো ঝরে পড়েছে প্রচ- নিঃশব্দে- ভয়ংকর শ্লথতায়-
আর আমি আমার কবিতায় এই অবর্ণনীয় বিনিময়ের অভিজ্ঞতাগুলোই পুনর্বিন্যস্ত করতে চেয়েছি আজীবন।”(বৃষ্টির ফোঁটা ও পাতাবাহার গাছ নিয়ে)
তিন.
“তারপর সেই বেবি সাইকেল / বধ্যভূমির অসংখ্য হাড় ও কঙ্কালের মধ্যে / বসন্তের দুরন্ত হাওয়ার মতো পাক খেয়ে বেরিয়ে এল / স্টোর কক্ষ থেকে। / কিচেনের পাশ দিয়ে করিডোর পেরিয়ে / বেডরুমের দরজা খুলে / ড্রইংরুমে ঢুকে কয়েকটা এলোমেলো চক্কর দিয়ে / সিঁড়ি বেয়ে নিচে নেমে গেলো রাস্তায় / মিশে গেল ব্যক্ত মানুষ ও যানবাহনের ভিড়ে।” (একটি বেবি সাইকেল নিয়ে)
চার.
“নৌকাভ্রমণে গিয়ে অভিজ্ঞতা হলো, / একবার দুজন খুব জলের কাছে সরে / এসে / নুয়ে তাকিয়েছিলাম নিচে / যেখানে থির জলে ফুটেছিল আমাদের নৌকার গলুই / আর / কান্তিমান চলন্ত চোখে-চোখে তাকিয়ে / মনে হয়েছিল আমার / নৌকার গলুইটা যেন জলের নিচের গলুইটাকে / চুমু খাবে বলে ভেসে গেল সারা দিন ধরে- / কিন্তু সারা জীবনে কোনোদিন চুমু খাওয়া হবে না তার / আমি বুঝেছিলাম, তুমিও বুঝেছিলে / তবু তো সেই নৌকাযাত্রার দুপুরে
আমরা আমাদের জীবনের দীর্ঘতম চুমুটি খেয়েছিলাম, মনে আছে?” (অভিজ্ঞতা)
পাঁচ.
“আমি ছুঁয়েছিলাম তার স্তন / এমন মর্মরিত নৈঃশব্দ্য আমি জীবনে ছুঁইনি / আমি ছুঁয়েছিলাম তার আঙুলগুচ্ছের অন্ধকার / এমন অসাধারণ ব্যর্থতার পাশে আর আমি কোনোদিন দাঁড়াইনি / আমি নাক ডুবিয়ে দিয়েছিলাম তার চুলে / এমন পল্লবিত গাছের ঘ্রাণ আমি আর কখনো পাইনি / আমি মুখ গুঁজে দিয়েছিলাম তার কাঁধে / এমনভাবে আর আমি ভেঙে পড়িনি কোনোদিন / আমি চুমু খেয়েছিলাম তার ঠোঁটে / এমন দীর্ঘ নৈঃসঙ্গ্যের কবলে / আমি আর কোনোদিন পড়িনি” (ভ্রমণ কাহিনী)
আবিদ আজাদের কবিতায় ছিলো দৈশিক ঐতিহ্যিক উপাদান, সেই সাথে যুক্ত হয়েছিলো আন্তর্জাতিকতার বোধ ও বিশ্ব রাজনীতি। আমরা এখন চতুর্থ শিল্পবিপ্লবের উপকণ্ঠে। মানুষের প্রতিদ্বন্দ্বী হিসেবে আবির্ভূত হতে যাচ্ছে স্বসৃষ্ট কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তাসম্পন্ন যন্ত্রদানব রোবোট, মানুষের আবেগ অনুভূতির চিরন্তনতা, চিন্তাশীলতা ও সৃজনশীলতা পড়তে যাচ্ছে চ্যালেঞ্জের মুখে, রাষ্ট্রব্যবস্থা-বিশ্বব্যবস্থা জিম্মি হয়ে পড়েছে মহাক্ষমতাধর কর্পোরেট পুঁজির সর্বগ্রাসী আগ্রাসনের কাছে, তার খামখেয়ালিপূর্ণ খেলাধুলার কাছে। আশ্চর্য হতে হয়, এহেন পরিস্থিতিতেও আবিদ আজাদের কবিতার পঙ্ক্তিমালা প্রাসঙ্গিকতা হারায়নি:
১.
“আমি জানি পৃথিবীর সমস্ত সমুদ্রপথ যদিও এখন / সমরাস্ত্রবাহী সব রণতরীদের ভয়ে আতঙ্কিত আজ / যদিও শঙ্কিত / নও তুমি উৎকণ্ঠিত” (চা)
২.
“এ যুগ খেলনার যুগ / এ যুগে সবকিছু খেলনা / মানুষ খেলনা / মানুষের স্বাধীনতাও খেলনা / রাষ্ট্র খেলনা / জাতীয় পতাকাও খেলনা / সার্বভৌমত্ব খেলনা / জাতিসংঘও খেলনা / এক খেলনা আরেক খেলনা নিয়ে / খেলতে খেলতে ক্লান্ত হয়ে ঘুমিয়ে পড়ে / তাদের খেলনা-জীবনে।” (খেলনা যুগ)
আবিদ আজাদ কেন লিখেছেন সে প্রশ্নের উত্তরও দিয়ে গেছেন অসামান্য উপমায়, আর অতুলনীয় উপমাগুলো ছিলো কবি হিসেবে তাঁর শক্তিমত্তার জায়গা: “কেন দেখি প্রচ- বৃষ্টির মধ্যে সবুজ পাতার / বাথরুমে স্নান করে নির্জনতা: / পাশে তার একটি রক্তিম ফল- / কেন দেখি একজোড়া ঝকঝকে নতুন টেলিফোন সেটের মতন সাদা/ দুটো ভীরু খরগোশ হঠাৎ লাফিয়ে ওঠে দুপুরে দুরন্ত বিছানায়? / তাই লিখি।” (কেন লিখি)
মাত্র বায়ান্ন বছরের জীবন পেয়েছিলেন কবি আবিদ আজাদ। আমৃত্যু করে গেছেন কবিতাশিল্পের অমৃত অন্বেষণ। তাঁর কবিতার আবেদন চিরন্তন এবং সর্বকালিক। সেজন্য আমার ক্ষুদ্র বিবেচনায় কবি আবিদ আজাদকে বাংলা কবিতায় অধুনাবাদী নিরীক্ষার নির্জনতম অগ্রসাধক বললেও বোধহয় অত্ত্যুক্তি হবেনা।
তথ্যসূত্র :
১. অরণি : বাংলা কবিতার পঞ্চাশ বছর, জানুয়ারি-জুন ২০১১
২. আব্দুল মান্নান সৈয়দ, করতলে মহাদেশ, অবসর, ১৯৯৩
৩. উদয় নারায়ণ সিংহ, সাহিত্যের ভাষা : ভাষার সাহিত্য, অনুষ্টুপ, কোলকাতা, আগস্ট ২০১০
৪. ওবায়েদ আকাশ (সম্পাদিত), শালুক, ২০ বছর পূর্তি নিবিড় সম্মিলন সংখ্যা ২০১৯
৫. বাঙালি বাংলাদেশ, ১৪০০ সাল উদযাপন পরিষদ, পহেলা বৈশাখ ১৪০০
৬. বিশ্বজিৎ ঘোষ, বাংলাদেশের সাহিত্য, আজকাল প্রকাশনী, মে ২০১৮ (পরিমার্জিত ও পরিবর্ধিত সংস্করণ)
৭. শহীদ ইকবাল, বাংলাদেশের কবিতার ইতিহাস : ১৯৪৭-২০০০, রোদেলা প্রকাশনী, ২০১৩
৮. হুমায়ুন আজাদ (সম্পাদিত), আধুনিক বাংলা কবিতা, আগামী, ফেব্রুয়ারি ১৯৯৪
৯. www.google.com