সুনীল কুমারের চতুর্থ একক প্রদর্শনী
জাহিদ মুস্তাফা
একটি ভালোবাসার জন্মকথা, ক্যনভাসে জল রং ২০২৫
ছোটবেলা থেকে ছবি আঁকার প্রতি অনুরাগ সুনীল কুমার পথিককে পথ দেখিয়েছে শিল্পী হয়ে ওঠার নেপথ্যে। চিত্রকলা পাঠের পর এদিক ওদিক নানা কাজে যুক্ত হলেও তাঁর আকণ্ঠ তৃষ্ণা ছিল অঙ্কন ও চিত্রায়ণের প্রতি। শেষাবধি আঁকাআঁকিতেই থিতু হয়েছেন। এখন নিজের আঁকাআঁকির পাশাপাশি আগ্রহী শিক্ষার্থীদের আঁকতে শেখান।
সুনীলকে আমার চেনা অনেকদিন। তাঁর চিত্রবিদ্যা অর্জন বাংলাদেশের প্রধান দু’টি বিশ্ববিদ্যালয়ে- চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় থেকে স্নাতক, পরে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে স্নাতকোত্তর করেছেন। চারটি একক চিত্র প্রদর্শনী হয়েছে তাঁর। প্রথম দু’টি প্রদর্শনী অনেক আগে হয়েছে। এ দু’টি প্রদর্শনীর কাজে দৃষ্টিনন্দন নিসর্গ ও নারীর সুললিত ফিগর দেখেছি। শিল্পীর তৃতীয় একক প্রদর্শনী অনুষ্ঠিত হয়েছে এ বছরের মে মাসে ঢাকার লালমাটিয়ায় গ্যালারি ভূমিতে। মাত্র তিন মাসের ব্যবধানে হলো তাঁর চতুর্থ একক।
ঢাকার গুলশানে ভারতীয় হাইকমিশনের ইন্দিরা গান্ধী সাংস্কৃতিক কেন্দ্রের আয়োজনে সুনীল কুমারের চতুর্থ একক চিত্র প্রদর্শনী চলছে। তিন সপ্তাহব্যাপী এই প্রদর্শনী গত ১৮ সেপ্টেম্বর শুরু হয়ে চলেছে ১০ অক্টোবর ২০২৫ পর্যন্ত।
১৮ সেপ্টেম্বর বিকালে দেশের নবীন প্রবীণ শিল্পী ও বিশিষ্টজনদের উপস্থিতিতে বাংলাদেশে নিযুক্ত ভারতীয় হাইকমিশনার প্রণয় ভার্মা এ প্রদর্শনীর উদ্বোধন করেন। ইন্দিরা গান্ধী সাংস্কৃতিক কেন্দ্রের পরিচালক আন মেরি জর্জের সঞ্চালনায় এতে বিশেষ অতিথির বক্তব্য রাখেন বরেণ্যশিল্পী মনিরুল ইসলাম।
এ ছাড়াও উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে সংক্ষিপ্ত বক্তব্যে শিল্পী সুনীল কুমার তাঁর অনুভূতি প্রকাশ করেন এবং প্রধান অতিথি মি. ভার্মা ও আন মেরিকে তাঁদের প্রতিকৃতি উপহার দেন। দর্শকসারিতে উপস্থিত অগ্রজ শিল্পীদের মধ্যে ছিলেন- আবদুল মান্নান, নাসিম আহমেদ নাদভী, অধ্যাপক নাঈমা হক, আইভি জামান, রেজাউন নবী, অশোক কর্মকার, রফি হক প্রমুখ।
প্রকৃতি ও নগরসংলগ্ন মানুষ নিয়ে যাঁরা ছবি আঁকছেন সুনীল তাঁদের অন্যতম। তাঁর এখনকার কাজ অঙ্কন প্রধান। কয়েক বছর ধরে দেখতে পাচ্ছি মানবদেহ-প্রধান চিত্রচর্চায় স্বাতন্ত্র্যের সন্ধান করছেন তিনি। বিশেষ করে তাঁর চিত্রপটে প্রধান চরিত্র হচ্ছে নারী। নারী সৌন্দর্যকে ফুটিয়ে তোলা শুধু নয়, শিল্পী নারীর সামাজিক অন্তরায় ও নারীকে আবদ্ধ রাখার সামাজিক প্রতিবন্ধকতাকে প্রতীকীভাবে তুলে ধরেছেন নিজের ছবিতে। নারীত্বের মাহাত্ম্য তিনি উপলব্ধি করেন শিল্পীসুলভ সুন্দর ও সুস্থ মানসিকতা দিয়ে। তাই অসুন্দরের বিরুদ্ধে তিনি নারীর প্রতিবাদী সত্তাকে চিত্রিত করেছেন সংবেদনশীল একজন মানুষ হিসাবে।
এমনই এক অঙ্কনপ্রধান চিত্রকর্ম- ‘নারী ও ফুলের গল্প’ শিরোনামের চিত্রকর্মের কেন্দ্রস্থলে খোঁপায় গোঁজা ফুলসমেত হাজির সুশ্রী অবয়বের এক তরুণী। তাঁর চোখের সামনে এক তরুণের পুষ্পাঞ্জলি। তরুণীর সামনে পেছনে আরও পুরুষ অবয়ব। চারকোল ও পেন্সিলে আঁকা এই চিত্র ছাড়াও এমনতর বিষয় আমরা দেখতে পাই অন্য কয়েকটি চিত্রকর্মে।
সভ্যতা যেমন দিনে দিনে আমাদের সুবিধা এনে দিয়েছে, তেমনই এর পাশাপাশি মানুষের হাত ধরেই অসভ্যতারও বিস্তার ঘটেছে দুনিয়ায়। মানুষ তার মানবিক মূল্যবোধ থেকে বিচ্যুত হয়ে ক্রমশ যান্ত্রিক হয়ে উঠছে। এজন্য মানুষী দেহের জ্যামিতিক উপস্থাপন শিল্পীর কাছে যুক্তিযুক্ত মনে হয়েছে।
তাঁর আঁকা নারী ও পুরুষের শরীরের বাঁকে বাঁকে যান্ত্রিক নাটবল্টু! এ যেন সভ্যতার যন্ত্রপ্রধান হয়ে ওঠার প্রতিকচিহ্ন। মানুষের ক্রমাগত যান্ত্রিক হয়ে ওঠার এক ধরনের প্রতীকচিহ্ন।
নারীর প্রতি সহিংসতা, লোভ দেখানো, নারীকে বিভ্রান্ত করা, ধর্ষণ, হত্যা এসব অপরাধকে মাথায় রেখে শিল্পী তাঁর চিত্রপটে নারীদেহকে কেন্দ্রে রেখে নানাবিধ অভিব্যক্তির অনেকগুলো পুরুষ অবয়বকে স্থাপন করেন। হিন্দু মিথের রাবণ চরিত্রের অনেকগুলো অবয়বকেন্দ্রিক ভিন্ন ভিন্ন অভিব্যক্তির সঙ্গে এসব তুলনীয়। সেই সঙ্গে ফুল-পাখি ও প্রাণির অবয়বকে প্রয়োগ করেছেন স্পেসকে যথাযথ ব্যবহারের অভিপ্রায়ে। রিয়ালিস্টিক ফর্মের সঙ্গে কিউবিক ফর্মের মেলবন্ধনের পরেও কেমন একটা স্যুরিয়ালিস্টিক মেজাজের দেখা মিলছে তাঁর চিত্রকর্মে।
যেমন বড় ক্যানভাসে তেলরঙে আঁকা ‘অপেক্ষা’ চিত্রটিতে অস্তগামী সূর্যের লালচে আভার মৃদু আলোয় শিল্পী এক অপেক্ষমাণ সুন্দরী নারী ও তার ছায়ামূর্তির ছবি এঁকেছেন। এই দুই ছায়া যেন তাঁর আরও দু’টি অস্তিত্ব বহন করছে! প্রথম ছায়াটি সামনের সুসজ্জিত নারীর পেছনে স্থির হয়ে দূরের দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে, আর অন্যজন পূজার থালায় নৈবেদ্য সাজিয়ে হাতে পা বাড়ানো এক নারী পূজারি। চিত্রে মানব অস্তিত্ব ও মনের একাধিক আকাক্সক্ষার ঘটেছে। শারদোৎসবের সময় প্রদর্শনী আয়োজনে দেবী দূর্গার অসুর বধের দৃশ্য সম্বলিত এক তেলচিত্র প্রদর্শিত হয়েছে। অঙ্কনের স্বকীয়তা ও বর্ণপ্রয়োগের পরিমিতি এবং কুশলতায় তাঁর এসব কাজ ছন্দোময় ও সাবলীল হয়ে উঠেছে। কৃষক ও শ্রমিকশ্রেণির অধিকার আদায়ের সংগ্রামকে উপজীব্য করে আঁকা ছবিও এখানে স্থান দিয়েছেন শিল্পী। এতে শ্রমজীবী মানুষ, যারা দেশের অর্থনীতির চালিকাশক্তি তাদের জীবনমান বাড়ানোর জন্য শিল্পীর অঙ্গীকার প্রতিফলিত হয়েছে।
এর বাইরে সুন্দরের প্রতি শিল্পীর মনের টান ও আবেগের স্ফুরণ প্রত্যক্ষ করি কোনো কোনো চিত্রে। এমনতর চিত্রে আমরা শিল্পীর রোম্যান্টিক মনের সন্ধান পাই, অপরিসীম দরদে প্রেমিকের মন দিয়ে তিনি নারীর সৌন্দর্য ও কমনীয়তাকে চিত্রিত করেছেন। এঁকেছেন প্রেমিক-প্রেমিকা ও দম্পতির প্রেমময় অভিব্যক্তির ছবি।
অঙ্কনপ্রধান এসব চিত্রকর্ম তাঁর সাম্প্রতিক কাজ, অঙ্কনের দৃঢ়তা আনতে প্রচুর রেখার ব্যবহার করেছেন। এঁকেছেন কাগজে চারকোল, পেন্সিল, জলরঙ ও ক্যানভাসে এক্রেলিক রঙে। তাঁর কাজ বাস্তবতার কাছাকাছি হলেও চিত্রে বর্ণ-আলিম্পন ঠিক বাস্তবানুগ নয়, পাত্র-পাত্রীর দেহ-অবয়ব নীলচে, তামাটে ও হলদেটে। বর্ণপ্রয়োগে তাঁর পরিমিতিবোধ দেখতে পাই। কামরুল হাসান, কাইয়ুম চৌধুরী ও মুর্তজা বশীর প্রমুখ বরেণ্যশিল্পী এবং আমাদের প্রাচ্যচিত্রকলার শিল্পীদের চিত্রে আমরা এসব বর্ণের বহুল ব্যবহার দেখি।
সুনীলের তৃতীয় ও চতুর্থ একক চিত্র প্রদর্শনীর কাজগুলো দেখে আমার ধারণা হলো- তাঁর শিল্পপ্রয়াসের বাঁকবদল ঘটেছে। দীর্ঘদিন ধরে তাঁর অঙ্কনচর্চা ও শ্রমসাধ্য সৃজন-সাধনার সুফল ডানা মেলতে ধরেছে! এর প্রমাণ- ঢাকার ভারতীয় হাই কমিশনের উদ্যোগে তাঁর চতুর্থ একক প্রদর্শনী।
সুনীল কুমারের চতুর্থ একক প্রদর্শনী
জাহিদ মুস্তাফা
একটি ভালোবাসার জন্মকথা, ক্যনভাসে জল রং ২০২৫
বৃহস্পতিবার, ০৯ অক্টোবর ২০২৫
ছোটবেলা থেকে ছবি আঁকার প্রতি অনুরাগ সুনীল কুমার পথিককে পথ দেখিয়েছে শিল্পী হয়ে ওঠার নেপথ্যে। চিত্রকলা পাঠের পর এদিক ওদিক নানা কাজে যুক্ত হলেও তাঁর আকণ্ঠ তৃষ্ণা ছিল অঙ্কন ও চিত্রায়ণের প্রতি। শেষাবধি আঁকাআঁকিতেই থিতু হয়েছেন। এখন নিজের আঁকাআঁকির পাশাপাশি আগ্রহী শিক্ষার্থীদের আঁকতে শেখান।
সুনীলকে আমার চেনা অনেকদিন। তাঁর চিত্রবিদ্যা অর্জন বাংলাদেশের প্রধান দু’টি বিশ্ববিদ্যালয়ে- চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় থেকে স্নাতক, পরে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে স্নাতকোত্তর করেছেন। চারটি একক চিত্র প্রদর্শনী হয়েছে তাঁর। প্রথম দু’টি প্রদর্শনী অনেক আগে হয়েছে। এ দু’টি প্রদর্শনীর কাজে দৃষ্টিনন্দন নিসর্গ ও নারীর সুললিত ফিগর দেখেছি। শিল্পীর তৃতীয় একক প্রদর্শনী অনুষ্ঠিত হয়েছে এ বছরের মে মাসে ঢাকার লালমাটিয়ায় গ্যালারি ভূমিতে। মাত্র তিন মাসের ব্যবধানে হলো তাঁর চতুর্থ একক।
ঢাকার গুলশানে ভারতীয় হাইকমিশনের ইন্দিরা গান্ধী সাংস্কৃতিক কেন্দ্রের আয়োজনে সুনীল কুমারের চতুর্থ একক চিত্র প্রদর্শনী চলছে। তিন সপ্তাহব্যাপী এই প্রদর্শনী গত ১৮ সেপ্টেম্বর শুরু হয়ে চলেছে ১০ অক্টোবর ২০২৫ পর্যন্ত।
১৮ সেপ্টেম্বর বিকালে দেশের নবীন প্রবীণ শিল্পী ও বিশিষ্টজনদের উপস্থিতিতে বাংলাদেশে নিযুক্ত ভারতীয় হাইকমিশনার প্রণয় ভার্মা এ প্রদর্শনীর উদ্বোধন করেন। ইন্দিরা গান্ধী সাংস্কৃতিক কেন্দ্রের পরিচালক আন মেরি জর্জের সঞ্চালনায় এতে বিশেষ অতিথির বক্তব্য রাখেন বরেণ্যশিল্পী মনিরুল ইসলাম।
এ ছাড়াও উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে সংক্ষিপ্ত বক্তব্যে শিল্পী সুনীল কুমার তাঁর অনুভূতি প্রকাশ করেন এবং প্রধান অতিথি মি. ভার্মা ও আন মেরিকে তাঁদের প্রতিকৃতি উপহার দেন। দর্শকসারিতে উপস্থিত অগ্রজ শিল্পীদের মধ্যে ছিলেন- আবদুল মান্নান, নাসিম আহমেদ নাদভী, অধ্যাপক নাঈমা হক, আইভি জামান, রেজাউন নবী, অশোক কর্মকার, রফি হক প্রমুখ।
প্রকৃতি ও নগরসংলগ্ন মানুষ নিয়ে যাঁরা ছবি আঁকছেন সুনীল তাঁদের অন্যতম। তাঁর এখনকার কাজ অঙ্কন প্রধান। কয়েক বছর ধরে দেখতে পাচ্ছি মানবদেহ-প্রধান চিত্রচর্চায় স্বাতন্ত্র্যের সন্ধান করছেন তিনি। বিশেষ করে তাঁর চিত্রপটে প্রধান চরিত্র হচ্ছে নারী। নারী সৌন্দর্যকে ফুটিয়ে তোলা শুধু নয়, শিল্পী নারীর সামাজিক অন্তরায় ও নারীকে আবদ্ধ রাখার সামাজিক প্রতিবন্ধকতাকে প্রতীকীভাবে তুলে ধরেছেন নিজের ছবিতে। নারীত্বের মাহাত্ম্য তিনি উপলব্ধি করেন শিল্পীসুলভ সুন্দর ও সুস্থ মানসিকতা দিয়ে। তাই অসুন্দরের বিরুদ্ধে তিনি নারীর প্রতিবাদী সত্তাকে চিত্রিত করেছেন সংবেদনশীল একজন মানুষ হিসাবে।
এমনই এক অঙ্কনপ্রধান চিত্রকর্ম- ‘নারী ও ফুলের গল্প’ শিরোনামের চিত্রকর্মের কেন্দ্রস্থলে খোঁপায় গোঁজা ফুলসমেত হাজির সুশ্রী অবয়বের এক তরুণী। তাঁর চোখের সামনে এক তরুণের পুষ্পাঞ্জলি। তরুণীর সামনে পেছনে আরও পুরুষ অবয়ব। চারকোল ও পেন্সিলে আঁকা এই চিত্র ছাড়াও এমনতর বিষয় আমরা দেখতে পাই অন্য কয়েকটি চিত্রকর্মে।
সভ্যতা যেমন দিনে দিনে আমাদের সুবিধা এনে দিয়েছে, তেমনই এর পাশাপাশি মানুষের হাত ধরেই অসভ্যতারও বিস্তার ঘটেছে দুনিয়ায়। মানুষ তার মানবিক মূল্যবোধ থেকে বিচ্যুত হয়ে ক্রমশ যান্ত্রিক হয়ে উঠছে। এজন্য মানুষী দেহের জ্যামিতিক উপস্থাপন শিল্পীর কাছে যুক্তিযুক্ত মনে হয়েছে।
তাঁর আঁকা নারী ও পুরুষের শরীরের বাঁকে বাঁকে যান্ত্রিক নাটবল্টু! এ যেন সভ্যতার যন্ত্রপ্রধান হয়ে ওঠার প্রতিকচিহ্ন। মানুষের ক্রমাগত যান্ত্রিক হয়ে ওঠার এক ধরনের প্রতীকচিহ্ন।
নারীর প্রতি সহিংসতা, লোভ দেখানো, নারীকে বিভ্রান্ত করা, ধর্ষণ, হত্যা এসব অপরাধকে মাথায় রেখে শিল্পী তাঁর চিত্রপটে নারীদেহকে কেন্দ্রে রেখে নানাবিধ অভিব্যক্তির অনেকগুলো পুরুষ অবয়বকে স্থাপন করেন। হিন্দু মিথের রাবণ চরিত্রের অনেকগুলো অবয়বকেন্দ্রিক ভিন্ন ভিন্ন অভিব্যক্তির সঙ্গে এসব তুলনীয়। সেই সঙ্গে ফুল-পাখি ও প্রাণির অবয়বকে প্রয়োগ করেছেন স্পেসকে যথাযথ ব্যবহারের অভিপ্রায়ে। রিয়ালিস্টিক ফর্মের সঙ্গে কিউবিক ফর্মের মেলবন্ধনের পরেও কেমন একটা স্যুরিয়ালিস্টিক মেজাজের দেখা মিলছে তাঁর চিত্রকর্মে।
যেমন বড় ক্যানভাসে তেলরঙে আঁকা ‘অপেক্ষা’ চিত্রটিতে অস্তগামী সূর্যের লালচে আভার মৃদু আলোয় শিল্পী এক অপেক্ষমাণ সুন্দরী নারী ও তার ছায়ামূর্তির ছবি এঁকেছেন। এই দুই ছায়া যেন তাঁর আরও দু’টি অস্তিত্ব বহন করছে! প্রথম ছায়াটি সামনের সুসজ্জিত নারীর পেছনে স্থির হয়ে দূরের দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে, আর অন্যজন পূজার থালায় নৈবেদ্য সাজিয়ে হাতে পা বাড়ানো এক নারী পূজারি। চিত্রে মানব অস্তিত্ব ও মনের একাধিক আকাক্সক্ষার ঘটেছে। শারদোৎসবের সময় প্রদর্শনী আয়োজনে দেবী দূর্গার অসুর বধের দৃশ্য সম্বলিত এক তেলচিত্র প্রদর্শিত হয়েছে। অঙ্কনের স্বকীয়তা ও বর্ণপ্রয়োগের পরিমিতি এবং কুশলতায় তাঁর এসব কাজ ছন্দোময় ও সাবলীল হয়ে উঠেছে। কৃষক ও শ্রমিকশ্রেণির অধিকার আদায়ের সংগ্রামকে উপজীব্য করে আঁকা ছবিও এখানে স্থান দিয়েছেন শিল্পী। এতে শ্রমজীবী মানুষ, যারা দেশের অর্থনীতির চালিকাশক্তি তাদের জীবনমান বাড়ানোর জন্য শিল্পীর অঙ্গীকার প্রতিফলিত হয়েছে।
এর বাইরে সুন্দরের প্রতি শিল্পীর মনের টান ও আবেগের স্ফুরণ প্রত্যক্ষ করি কোনো কোনো চিত্রে। এমনতর চিত্রে আমরা শিল্পীর রোম্যান্টিক মনের সন্ধান পাই, অপরিসীম দরদে প্রেমিকের মন দিয়ে তিনি নারীর সৌন্দর্য ও কমনীয়তাকে চিত্রিত করেছেন। এঁকেছেন প্রেমিক-প্রেমিকা ও দম্পতির প্রেমময় অভিব্যক্তির ছবি।
অঙ্কনপ্রধান এসব চিত্রকর্ম তাঁর সাম্প্রতিক কাজ, অঙ্কনের দৃঢ়তা আনতে প্রচুর রেখার ব্যবহার করেছেন। এঁকেছেন কাগজে চারকোল, পেন্সিল, জলরঙ ও ক্যানভাসে এক্রেলিক রঙে। তাঁর কাজ বাস্তবতার কাছাকাছি হলেও চিত্রে বর্ণ-আলিম্পন ঠিক বাস্তবানুগ নয়, পাত্র-পাত্রীর দেহ-অবয়ব নীলচে, তামাটে ও হলদেটে। বর্ণপ্রয়োগে তাঁর পরিমিতিবোধ দেখতে পাই। কামরুল হাসান, কাইয়ুম চৌধুরী ও মুর্তজা বশীর প্রমুখ বরেণ্যশিল্পী এবং আমাদের প্রাচ্যচিত্রকলার শিল্পীদের চিত্রে আমরা এসব বর্ণের বহুল ব্যবহার দেখি।
সুনীলের তৃতীয় ও চতুর্থ একক চিত্র প্রদর্শনীর কাজগুলো দেখে আমার ধারণা হলো- তাঁর শিল্পপ্রয়াসের বাঁকবদল ঘটেছে। দীর্ঘদিন ধরে তাঁর অঙ্কনচর্চা ও শ্রমসাধ্য সৃজন-সাধনার সুফল ডানা মেলতে ধরেছে! এর প্রমাণ- ঢাকার ভারতীয় হাই কমিশনের উদ্যোগে তাঁর চতুর্থ একক প্রদর্শনী।