জাপানি সাহিত্যে তানকা
মালেক মুস্তাকিম
জাপানের তানকা কবি মাচি তাওয়ারা ও তার বিখ্যাত তানকা সংকলন: “সালাদ অ্যানিভার্সারি”
জাপানের কবিতার কথা শুনলেই চট করে যে জিনিসটা প্রথমেই মনে আসে তা হলো হাইকু। জাপানের হাইকুর কথা কম বেশি আমরা সবাই জানি। স্বল্পমাত্রার এই কবিতার জন্য জাপানি সাহিত্যের আলাদা একটা কদর আছে, জাপানকে এজন্য হ্রস্বতম কবিতার দেশও বলা হয়। বিশ্বের অনেক দেশের সাহিত্যেই হাইকুর প্রভাব আছে। আমাদের বাংলা সাহিত্যেও হাইকু বেশ জনপ্রিয়। আমাদের অনেক কবি লেখক হাইকু লিখেছেন, এখনো লিখছেন।
হাইকু লেখা শুরু হওয়ার অনেক আগে আরেক ধরনের কবিতা লেখা হতো জাপানি সাহিত্যে যা তানকা নামে পরিচিত। সেই অর্থে তানকা হলো হাইকুর পূর্বপুরুষ। তানকা কবিতাকে ওয়াকা নামেও অভিহিত করা হয়ে থাকে। তানকা হাইকুর চেয়ে দীর্ঘমাত্রার। হাইকু ৫-৭-৫ ধ্বনির অন্যদিকে তানকার ধ্বনি হলো ৫-৭-৫-৭-৭। তানকার একটি গুরুত্বপূর্ণ দিক হলো- এটি সাহিত্যে র্যাপিড মোমেন্ট, আভাস বা আবেগের সংক্ষিপ্ত স্পন্দন উপস্থাপনে দক্ষ। তানকার দৃষ্টিভঙ্গি হচ্ছে- “কমিয়ে বলো, কিন্তু গভীরভাবে বলো।” তানকার শক্তি ও সামর্থ্যরে জায়গাটি হলো তার সংক্ষিপ্ততা, উদ্বুদ্ধতা, ইমেজ প্রবলতা এবং ভাষার ঘনত্ব।
জাপানি তানকার প্রায় এক হাজার বছরের ইতিহাস রয়েছে। খ্রিস্টীয় পাঁচ শকের আগ পর্যন্ত জাপানের নিজস্ব কোনো লিখিত ভাষা ছিল না। চীন থেকে ধার করা বর্ণমালা প্রচলিত ছিল। তানকার উৎপত্তি সম্পর্কে জানা যায় এটি প্রাচীন জাপানের অন্যতম কাব্যভাষা। সপ্তম শতকে এর গোড়াপত্তন। “কোজিকি” ও “নিহনশোকি” প্রাচীন গ্রন্থের মূলে যেসব গীত বা “কায়ো” ছিল, সেখানেই ৫ ৭ ৫ ৭ ৭ ধাঁচের গান দেখা যায়। “মন্যোশু” গ্রন্থে প্রায় ৪২০০ টির মতো কবিতা রয়েছে, যাদের বেশিরভাগই তানকা ধাঁচের। বাংলা সাহিত্যে চর্যাপদের যেমন চর্যার পদগুলো মুখে মুখে গাওয়া হতো তেমনি প্রাচীন সময়ের তানকাগুলোও প্রকাশের মাধ্যম ছিল মানুষের মুখের ভাষা বা গান। এ তানকাগুলোর প্রধান বৈশিষ্ট্য ছিল- প্রকৃতি, ভালোবাসা, মানবিক যন্ত্রণাসহ সাধারণ দিনের অতি সাধারণ অনুভূতির একনিষ্ঠ প্রকাশ। মধ্যযুগে এসে জাপানি তানকা এক ধরনের চ্যালেঞ্জের মুখে পড়ে যায়। এ সময় জাপানি কবিতা বাকবদলের পালায় পড়ে। হাইকু বা রেঁগু ধরনের নতুন স্বল্পরূপ কবিতা বেশি জনপ্রিয় হয়ে উঠতে থাকে। তবুও তানকা পুরোপুরি বিলুপ্ত হয়নি। বিশেষ করে কোকুগ্যাকুশার মতো কিছু শিক্ষাবিদ যারা জাপানি জাতীয় সাহিত্যকে গুরুত্ব দিতেন, তারা প্রাচীন কাব্যিকতার পুনরুজ্জীবনের উপরে জোর দিয়েছিলেন। তবে মেইজি যুগের শুরুতে তানকার আধুনিকীকরণ ও নতুন মাত্রা নির্মাণের কাজ শুরু হয়। এসময়ের কবি মাসাওকা শিকি ও অন্যান্য কবিগণ কবিতা থেকে অতিরিক্ত অলঙ্কার বাদ দিয়ে অভিজ্ঞতা, দৃশ্য ও অনুভূতির সরল ও তাজা অভিব্যক্তি আনতে শুরু করেছিলেন। শিকির মৃত্যুর পরে, তাঁর কবি শিক্ষার্থীরা নতুন তানকার ধারায় কাজ শুরু করেছিল। ইতো সাচিও শিকির ঘনিষ্ঠ শিষ্য- তানকার একটি সাহিত্য সংকেত “আরারাগি” ম্যাগাজিন প্রতিষ্ঠা করেন এবং আধুনিক তানকার নেতা হিসেবে আবির্ভূত হন। পরবর্তীতে ইয়োসানো আকিকো নারী কণ্ঠকে কেন্দ্রে এনে, পুরুষতান্ত্রিক কবিতার ধরনকে চ্যালেঞ্জ করে তানকার সৌন্দর্য ও চিন্তায় নতুন দিগন্ত তৈরি করেন। পরবর্তী সময়ে, সাইতো মোকিচি নামের আরেক কবি তানকার আরও গভীর, মনস্তাত্ত্বিক এবং সুষম মাত্রা আনেন- আধুনিক মন ও অভিজ্ঞতার বিশ্লেষণ, বিশেষ করে মানুষের মানসিক অবস্থা, বোধ, স্মৃতি ও বেদনায় তানকা একটি শক্তিশালী যন্ত্রণা হয়ে ওঠে।
বর্তমানে মাচি তাওয়ারা তানকার আধুনিক নবজন্মের প্রতীক হিসেবে বিবেচিত। তাঁর জনপ্রিয় গ্রন্থ “সালাদ অ্যানিভার্সারি” জাপানে ব্যাপক জনপ্রিয়তা লাভ করে এবং সাধারণ পাঠকের তানকার প্রতি আগ্রহ জাগায়। মাচি তাওয়ারা প্রথাগত ধাঁচ ও আধুনিক বিষয়কে মিশ্রিত করে, সহজ ভাষায় তানকার সৌন্দর্য তুলে ধরেন।
জাপানি সাহিত্যে তানকা এক ধরনের ধারাবাহিক যৌগিক গতি পেরিয়ে আসতে হয়েছে- প্রাচীন কবিতার ধারা থেকে শুরু করে মধ্যযুগ, পুনরুজ্জীবন, আধুনিকীকরণ, এবং অবশেষে সমকালীন সৃষ্টিতে তার প্রতিফলন। তানকার সংক্ষিপ্ততা ও অভিব্যক্তিমূলক শক্তি তাকে সময়ের পরীক্ষায় টিকিয়ে রেখেছে। কবিরা ধাপে ধাপে ধরনে পরিবর্তন এনে, ব্যক্তিকেন্দ্রিকতা, মনস্তাত্ত্বিক দিক এবং আধুনিক বিষয় অন্তর্ভুক্ত করেছেন। জাপানি সাহিত্যে বিশেষ করে কবিতায় তানকার সংক্ষিপ্ততা ও সীমিত যাঁকাকৃতি, বিষয়বস্তুর বৈচিত্র্য এবং ব্যতিক্রমী ভাষাকাঠামো ও অভিব্যক্তি অনেক আধুনিক কবিতার ধারণাকে প্রভাবিত করেছে।
বাঙালি সাহিত্যিকদের মধ্যে সুরেন্দ্রনাথ মৈত্র “জাপানি ঝিনুক” নামে কিছু হাইকু অনুবাদ করেন। রবীন্দনাথ ঠাকুর বেশ কিছু হাইকু লিখেছেন। সত্যেন্দ্রনাথ দত্ত কিছু তানকা রচনা লিখেছেন যা এখন পর্যন্ত বাংলা সাহিত্যের আদি তানকা। তবে এখন অনেকেই তানকার আদলে স্বল্পদৈর্ঘ্যরে এ কবিতা চর্চা চালিয়ে যাচ্ছেন।
জাপানি সাহিত্যে তানকা
মালেক মুস্তাকিম
জাপানের তানকা কবি মাচি তাওয়ারা ও তার বিখ্যাত তানকা সংকলন: “সালাদ অ্যানিভার্সারি”
বৃহস্পতিবার, ০৯ অক্টোবর ২০২৫
জাপানের কবিতার কথা শুনলেই চট করে যে জিনিসটা প্রথমেই মনে আসে তা হলো হাইকু। জাপানের হাইকুর কথা কম বেশি আমরা সবাই জানি। স্বল্পমাত্রার এই কবিতার জন্য জাপানি সাহিত্যের আলাদা একটা কদর আছে, জাপানকে এজন্য হ্রস্বতম কবিতার দেশও বলা হয়। বিশ্বের অনেক দেশের সাহিত্যেই হাইকুর প্রভাব আছে। আমাদের বাংলা সাহিত্যেও হাইকু বেশ জনপ্রিয়। আমাদের অনেক কবি লেখক হাইকু লিখেছেন, এখনো লিখছেন।
হাইকু লেখা শুরু হওয়ার অনেক আগে আরেক ধরনের কবিতা লেখা হতো জাপানি সাহিত্যে যা তানকা নামে পরিচিত। সেই অর্থে তানকা হলো হাইকুর পূর্বপুরুষ। তানকা কবিতাকে ওয়াকা নামেও অভিহিত করা হয়ে থাকে। তানকা হাইকুর চেয়ে দীর্ঘমাত্রার। হাইকু ৫-৭-৫ ধ্বনির অন্যদিকে তানকার ধ্বনি হলো ৫-৭-৫-৭-৭। তানকার একটি গুরুত্বপূর্ণ দিক হলো- এটি সাহিত্যে র্যাপিড মোমেন্ট, আভাস বা আবেগের সংক্ষিপ্ত স্পন্দন উপস্থাপনে দক্ষ। তানকার দৃষ্টিভঙ্গি হচ্ছে- “কমিয়ে বলো, কিন্তু গভীরভাবে বলো।” তানকার শক্তি ও সামর্থ্যরে জায়গাটি হলো তার সংক্ষিপ্ততা, উদ্বুদ্ধতা, ইমেজ প্রবলতা এবং ভাষার ঘনত্ব।
জাপানি তানকার প্রায় এক হাজার বছরের ইতিহাস রয়েছে। খ্রিস্টীয় পাঁচ শকের আগ পর্যন্ত জাপানের নিজস্ব কোনো লিখিত ভাষা ছিল না। চীন থেকে ধার করা বর্ণমালা প্রচলিত ছিল। তানকার উৎপত্তি সম্পর্কে জানা যায় এটি প্রাচীন জাপানের অন্যতম কাব্যভাষা। সপ্তম শতকে এর গোড়াপত্তন। “কোজিকি” ও “নিহনশোকি” প্রাচীন গ্রন্থের মূলে যেসব গীত বা “কায়ো” ছিল, সেখানেই ৫ ৭ ৫ ৭ ৭ ধাঁচের গান দেখা যায়। “মন্যোশু” গ্রন্থে প্রায় ৪২০০ টির মতো কবিতা রয়েছে, যাদের বেশিরভাগই তানকা ধাঁচের। বাংলা সাহিত্যে চর্যাপদের যেমন চর্যার পদগুলো মুখে মুখে গাওয়া হতো তেমনি প্রাচীন সময়ের তানকাগুলোও প্রকাশের মাধ্যম ছিল মানুষের মুখের ভাষা বা গান। এ তানকাগুলোর প্রধান বৈশিষ্ট্য ছিল- প্রকৃতি, ভালোবাসা, মানবিক যন্ত্রণাসহ সাধারণ দিনের অতি সাধারণ অনুভূতির একনিষ্ঠ প্রকাশ। মধ্যযুগে এসে জাপানি তানকা এক ধরনের চ্যালেঞ্জের মুখে পড়ে যায়। এ সময় জাপানি কবিতা বাকবদলের পালায় পড়ে। হাইকু বা রেঁগু ধরনের নতুন স্বল্পরূপ কবিতা বেশি জনপ্রিয় হয়ে উঠতে থাকে। তবুও তানকা পুরোপুরি বিলুপ্ত হয়নি। বিশেষ করে কোকুগ্যাকুশার মতো কিছু শিক্ষাবিদ যারা জাপানি জাতীয় সাহিত্যকে গুরুত্ব দিতেন, তারা প্রাচীন কাব্যিকতার পুনরুজ্জীবনের উপরে জোর দিয়েছিলেন। তবে মেইজি যুগের শুরুতে তানকার আধুনিকীকরণ ও নতুন মাত্রা নির্মাণের কাজ শুরু হয়। এসময়ের কবি মাসাওকা শিকি ও অন্যান্য কবিগণ কবিতা থেকে অতিরিক্ত অলঙ্কার বাদ দিয়ে অভিজ্ঞতা, দৃশ্য ও অনুভূতির সরল ও তাজা অভিব্যক্তি আনতে শুরু করেছিলেন। শিকির মৃত্যুর পরে, তাঁর কবি শিক্ষার্থীরা নতুন তানকার ধারায় কাজ শুরু করেছিল। ইতো সাচিও শিকির ঘনিষ্ঠ শিষ্য- তানকার একটি সাহিত্য সংকেত “আরারাগি” ম্যাগাজিন প্রতিষ্ঠা করেন এবং আধুনিক তানকার নেতা হিসেবে আবির্ভূত হন। পরবর্তীতে ইয়োসানো আকিকো নারী কণ্ঠকে কেন্দ্রে এনে, পুরুষতান্ত্রিক কবিতার ধরনকে চ্যালেঞ্জ করে তানকার সৌন্দর্য ও চিন্তায় নতুন দিগন্ত তৈরি করেন। পরবর্তী সময়ে, সাইতো মোকিচি নামের আরেক কবি তানকার আরও গভীর, মনস্তাত্ত্বিক এবং সুষম মাত্রা আনেন- আধুনিক মন ও অভিজ্ঞতার বিশ্লেষণ, বিশেষ করে মানুষের মানসিক অবস্থা, বোধ, স্মৃতি ও বেদনায় তানকা একটি শক্তিশালী যন্ত্রণা হয়ে ওঠে।
বর্তমানে মাচি তাওয়ারা তানকার আধুনিক নবজন্মের প্রতীক হিসেবে বিবেচিত। তাঁর জনপ্রিয় গ্রন্থ “সালাদ অ্যানিভার্সারি” জাপানে ব্যাপক জনপ্রিয়তা লাভ করে এবং সাধারণ পাঠকের তানকার প্রতি আগ্রহ জাগায়। মাচি তাওয়ারা প্রথাগত ধাঁচ ও আধুনিক বিষয়কে মিশ্রিত করে, সহজ ভাষায় তানকার সৌন্দর্য তুলে ধরেন।
জাপানি সাহিত্যে তানকা এক ধরনের ধারাবাহিক যৌগিক গতি পেরিয়ে আসতে হয়েছে- প্রাচীন কবিতার ধারা থেকে শুরু করে মধ্যযুগ, পুনরুজ্জীবন, আধুনিকীকরণ, এবং অবশেষে সমকালীন সৃষ্টিতে তার প্রতিফলন। তানকার সংক্ষিপ্ততা ও অভিব্যক্তিমূলক শক্তি তাকে সময়ের পরীক্ষায় টিকিয়ে রেখেছে। কবিরা ধাপে ধাপে ধরনে পরিবর্তন এনে, ব্যক্তিকেন্দ্রিকতা, মনস্তাত্ত্বিক দিক এবং আধুনিক বিষয় অন্তর্ভুক্ত করেছেন। জাপানি সাহিত্যে বিশেষ করে কবিতায় তানকার সংক্ষিপ্ততা ও সীমিত যাঁকাকৃতি, বিষয়বস্তুর বৈচিত্র্য এবং ব্যতিক্রমী ভাষাকাঠামো ও অভিব্যক্তি অনেক আধুনিক কবিতার ধারণাকে প্রভাবিত করেছে।
বাঙালি সাহিত্যিকদের মধ্যে সুরেন্দ্রনাথ মৈত্র “জাপানি ঝিনুক” নামে কিছু হাইকু অনুবাদ করেন। রবীন্দনাথ ঠাকুর বেশ কিছু হাইকু লিখেছেন। সত্যেন্দ্রনাথ দত্ত কিছু তানকা রচনা লিখেছেন যা এখন পর্যন্ত বাংলা সাহিত্যের আদি তানকা। তবে এখন অনেকেই তানকার আদলে স্বল্পদৈর্ঘ্যরে এ কবিতা চর্চা চালিয়ে যাচ্ছেন।