সাদ কামালী
আহমদউল্লাহ স্বভাবে চিন্তক, গভীর ও বিশ্লেষণী না হলেও কোনো কোনো বিষয়ে তার মনে প্রশ্ন তৈরি হয়। নিজেই তার উত্তর খোঁজার চেষ্টা করে। যেমন বাসের জন্য শংকর বাসস্ট্যান্ডে দাঁড়িয়ে থাকার সময় মনে হলো শংকর নামটির উৎস কী? শিবশংকরের জটা থেকে নাকি শংকরাচার্যের দর্শনদেউ নাকি বাঙালি শংকর জাতির শংকর থেকে। স্বভাবী চিন্তক এই চরিত্রটি গল্পের ভর ও প্রাণ। কিন্তু চিন্তা বা দর্শন তার চরিত্রের পরিমিতি গল্পের সীমা ছাড়িয়ে ‘ইন্টেলেকচুয়াল’ হয়ে ওঠে না। অর্থাৎ সাহিত্য জ্ঞানের দানবিক ওজন বহনের বাহন নয়, বরং মানবিক ওজন প্রবাহের স্বতঃস্ফূর্ত ধারা যেখানে তার প্রাণবান বিকাশ ঘটে। অর্থাৎ ‘প্রাণের ধর্ম সুমিতি, আর্টের ধর্মও তাই। এই সুমিতিতেই প্রাণের স্বাস্থ্য ও আনন্দ, এই সুমিতিতেই আর্টের শ্রী ও সম্পূর্ণতা।’
আহমদউল্লাহর মনের জিজ্ঞাসাও ‘সুমিতি’ ছাড়িয়ে দর্শন শাস্ত্রে হারিয়ে যায় না। যদিও এই পরিমিত দার্শনিক স্বভাবটি প্রেমিকা সাজেদা শীলার অত ভাল লাগে না, আর্টের প্রাণও করে না। তখন গল্পের আর্টিস্ট শুধু চরিত্রের একটি দিক উল্লেখ করেই দর্শনের ওজনকে মানবিক ওজনের পাল্লায় তুলে দিয়ে শিল্পের প্রাণকে বাঁচিয়ে দেয়। আহমদউল্লাহর সৃষ্টিকর্তা সৈয়দ মনজুরুল ইসলাম তেমন একটা পথ করে দিয়ে শিল্পের প্রাণকে প্রতিষ্ঠা করলেন বটে, কিন্তু আহমদউল্লাহর! তার প্রাণ দানবিক আঘাতে মানবিক বিশে^ আলোড়ন তোলে অথবা এমন একটা অন্তরজগত, মনোজগত তৈরি হলো শিল্পের সুমিতির সব দাবি মিটিয়ে নিটোল আর্ট হয়ে উঠল। এই আর্টের সৃষ্টি করলেন সৈয়দ মনজুরুল ইসলাম, ইংরেজি সাহিত্যের অধ্যাপক ছিলেন। এটি একটি সর্বজ্ঞাত তথ্য। কিন্তু তিনি তাঁর সাহিত্য পাঠ ও সর্বশেষ সাহিত্যের ট্রেন্ড নিয়ে সহজ ও সাবলীল ভাষায় লিখতেন এবং কথা বলতেন। তাঁর এই সহজ পথটি অলংকৃত হতো অসাধারণ রসবোধের সঙ্গে পরিমিত বিশেষণে। প্রবন্ধ রচনা তাঁর মুখ্য কাজ হলেও তিনি অসাধারণ ছোটগল্প লিখেছেন। এবং কথা বলার মতোই তাঁর গল্পের প্রকাশভঙ্গিটি খুব অন্তরঙ্গ।
১৯৯৪ সালে প্রথম গল্পগ্রন্থ ‘স্বনির্বাচিত শ্রেষ্ঠগল্প’ প্রকাশিত হয়। এক বছর পরই বের হয় ‘থাকা না থাকার গল্প’ (১৯৯৫), ‘কাচ ভাঙ্গা রাতের গল্প’ (১৯৯৮), ‘আলো ও অন্ধকার দেখার গল্প’ (২০০১), ‘প্রেম ও প্রার্থনার গল্প’ (২০০৫), ‘সুখদুঃখের গল্প’ (২০১১) এবং ‘বেলা অবেলার গল্প’ (২০১২)। সব গ্রন্থের নামেই ‘গল্প’ শব্দটি আছে। গল্প ভিতর থেকে হয়ে ওঠার সহজ কিন্তু সংবেদী নির্মাণ পথটি তাঁর আয়ত্তে ছিল। গল্পকে থামিয়ে জ্ঞান জাহিরের চেষ্টা তিনি করেননি। জ্ঞানের বুদ্ধিগত মূল্য বা সম্মান যতই থাক, সাহিত্যে চরিত্রের অনুগত হয়ে বিনীতভাবে যদি না আসে তাহলে জ্ঞানের কারাগারে তার কদর থাকলেও সহিত্যের পৃষ্ঠায় তার কপালে নিন্দা ছাড়া আর কিছু জোটে না।
যাই হোক, সৈয়দ মনজুরুল ইসলামের ‘জিন্দা লাশ’ গল্পের আহমদউল্লাহ ‘চিন্তক’ হলেও তার চিন্তাকে গল্প ছাড়িয়ে যাওয়ার অধিকার গল্পকার দেন না। যখনই সে ‘শংকর’ নাম নিয়ে শিবশংকর থেকে শংকরাচার্যের ভিতর অনুসন্ধান থেকে অনুসিদ্ধান্তে পৌঁছতে যাবে তখনই পাশের নির্মীয়মান বাসিলা টাওয়ারের দশতলা উঁচু থেকে ইট এসে পড়ল হঠাৎ তার মাথায়। এ যেন গল্পের দেবতা গল্পের পথ তৈরি করে দিতেই চিন্তার হেঁয়ালি থেকে মুক্তি দিল। গল্পকার লিখেছেন, “...তার মস্তিষ্কের যে জায়গা থেকে চিন্তার উৎপত্তি, মগজের সেই বাঁ দিকে, আকাশ থেকে একটা ইট এসে পড়ল।’ যুক্তিবাদী গল্পকার আকাশ থেকে পড়ার কথাটি ভেঙে পাশের ওই টাওয়ারটির কথা বলেন। মাথার ওপর ইট ফেলে গল্পকার অত্যন্ত অন্তরঙ্গ ভঙ্গিতে গল্পে প্রবেশের সূচনা করলেন। গল্পের আহমদউল্লাহর বিষয়ে সাধারণ তথ্য এই- জাতীয় ক্রীড়া পরিষদে একটি পদন্নতি পেয়ে আহমদউল্লাহ সেকশন চিফ হয়েছে। সরকারি এই কাজে চাপ, ব্যস্ততা বা নিয়ম পালনের কঠিন শাসন নেই। সংসারের বড় সন্তান হিসেবে নি¤œমধ্যবিত্ত পরিবারের সেই একমাত্র উপার্জনকারী ব্যক্তি। বাবা স্টিমারের মাস্টার এখন অবসরপ্রাপ্ত। ছোট ভাইবোনদের পড়ালেখা, কারও কারও বেকারত্ব, কারও কারও বিয়ের বয়স হয়ে যাওয়ার চাপ নিয়ে আহমদউল্লাহ দায়িত্ব পালন করে আসছিল। সংসারের দায় যেমন তার কাঁধে, তেমনি জগৎ-সংসার নিয়ে ভাবনার দায়িত্বও যেন তার। কিন্তু গল্পকার সুকৌশলে চরিত্রের এইসব অভিমুখগুলো দেখিয়েই নতুন একটা জগৎ নির্মাণের পথে এগোয়, সেই পথটিই গল্পটিকে শিল্পকর্ম করে তোলে। মস্তিষ্কের আঘাতে আহমদউল্লাহ অল্প সময়ের মধ্যে হাসপাতালের বিছানায় ‘কমা’য় চলে যায়। লাইফ সাপোর্ট দিয়ে তাকে বাঁচিয়ে রাখলেও তিন দিনের মধ্যে হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ আহমদউল্লাহর কোনো পরিচয়, পরিজনের খোঁজ পায় না। তবে তিন দিন পর নিজের পরিবার, অফিসের সহকর্মী তার খোঁজ পায়। খোঁজ পায় তার প্রেমিকা সাজেদা শীলাও। চেতন অবচেতন-নিরপেক্ষ ‘সবজি’-জীবন নিয়ে হাসপাতালের বিছানায় ‘জিন্দা লাশ’ হয়ে পড়ে থাকে কয়েক মাস। চিকিৎসক নিজেই এই সবজি-পরিণতির উন্নতি আশা করে না। অন্যদিকে আহমদউল্লাহর পরিবার ধীরে ধীরে উপার্জনক্ষম মানুষটির অনুপস্থিতির বাস্তবতায় একদিকে যেমন পরিবারের কেউ কেউ আয়-উপার্জনের সংসারের হাল ধরে অন্যদিকে সবজি হয়ে পড়ে থাকা মানুষটির আবেদন ফিকে হতে থাকে তাদের মনে। দিনে দিনে হাসপাতালে আহমদউল্লাহর দর্শনার্থী কমে যায়, এমনকি শীলাও এখন সবজি-শরীরের অপেক্ষায় বৃথা সময় ব্যয় না করে সময়কে নতুন অর্থময় সম্পর্কের সম্ভাবনায় আলোকিত করে তোলে। এই সব ন্যারেটিভের কেজো কথার বাইরে গল্পের মূল বিকাশ কেন্দ্রে গুরুত্বপূর্ণ হয়ে ওঠে মনোজগতের এক অনন্য যাত্রা। চিকিৎসকের ঘোষিত সবজি-জীবনের অন্তরালে লেখক অন্য একটি মনকে আবিষ্কার করেন- ক্লাসিকস এবং সমকালীন বিশ^সাহিত্যের নিবিষ্ট পাঠক সৈয়দ মনজুরুল ইসলাম জানেন কোন কৌশলে দেহ থেকে মন বা দেহনিরপেক্ষ এক সত্তা শিল্পীর কলমে জন্ম নিয়ে ঘুরেফিরে দেখে তার নিকটজনদের ঘরগেরস্তালির সঙ্গে তাদের মনের অবস্থাটিও। বিশেষ করে আপনজনের মনে কতটুকু সে বেঁচে আছে, কীভাবে আছে। সবজি-জীবন এখন অতিরিক্ত মনে হলেও আহমদউল্লাহ দেখে সংসারের নিত্যতায় গতি ফিরেছে, আয় ও জীবন প্রাথমিক বিপন্ন অবস্থা কাটিয়ে সম্ভব সচ্ছন্দ ও জীবন যৌবনে স্বাভাবিক বেগ-আবেগের সঞ্চার ঘটেছে। প্রেম, বিয়ে, চাকরি ও সুখ-অসুখের সংসার তাকে ছাড়াই অভ্যস্ত হয়ে ওঠে স্বাভাবিক পথে।
আহমদউল্লাহ যখন নিজের ঘরে আসে, দেখে তার সংকীর্ণ ঘরটি তার ভাই আপন করে নিয়েছে। বোন অন্য ভাই বাবা মা সবজি জীবনের বাস্তবতা কী তারা জেনে নিয়েছে। এমনকি আহমদউল্লাহ হাসপাতালের ডাক্তার নার্স প্রত্যেকের টেবিলে টেবিলে ঘুরে তাদের সাথে কথা বলে বুঝে নিয়েছে, একদা একটি সংসারের একমাত্র উপার্জনক্ষম মানুষটির অনুপস্থিতি যখন গভীর শূন্যতায়, গাঢ় বেদনায় ডুবে যায়নি, তখন ডাক্তার নার্স প্রমুখ পেশাজীবীগণ রোগীর পরিবারের মতামত নিয়ে সবজি-জীবনের অবশিষ্টটুকুও মিলিয়ে দিতে প্রস্তুত হয়ে ওঠে।
সৈয়দ মনজুরুল ইসলামের অহমিকামুক্ত আধুনিক মনের সরল আচরণ এবং তাঁর সরস আলোচনা তরুণ লেখক-পাঠক ও তাঁর ছাত্রদের কাছে প্রিয় হয়েছিল। তাঁর এই মনের গভীরে আছে শিল্প-সাহিত্যের সকল ঘরানা বা জন্রা বিষয়ে পাঠ ও ইতিবাচক গুণাগুণ। ফলে তরুণ থেকে তরুণতর লেখকদের সাহিত্যের খবর তিনি রাখতেন। বিশ^সাহিত্যের সমকালীন বিশিষ্ট রচনাগুলোর পাঠ তিনি সংবাদ-এর সাহিত্য পাতায় ‘অলস দিনের হাওয়া’ শিরোনামে চার দশক আগেই লিখতে শুরু করেছিলেন। এই গদ্যের লেখকও আন্তরিক শ্রদ্ধা ও কৃতজ্ঞতার সঙ্গে স্মরণ করছে তাঁর ওই ‘অলস দিনের হাওয়া’র যেসব লেখক ভেসে এসেছিলেন আমাদের অচলায়তনে, তাঁদের সম্পর্কে কৌতূহলী হয়ে ওঠা এবং পরে পাঠ সম্ভব হয়। মনে পড়ছে চিনোয়া আচেবে, নাগিব মাহফুজ, সালমান রুশদি প্রমুখের নাম ও লেখা সম্পর্কে অবগত হই, পড়তে আগ্রহী হয়ে উঠি ওই ‘হাওয়া’র সুবাদে।
‘জিন্দা লাশ’ গল্পের আহমদউল্লাহ কি গ্রেগর সামসা নয়? পরিবারের একমাত্র উপার্জনক্ষম গ্রেগর সামসা এক ভোরে আকস্মিকভাবে আবিষ্কার করে সে এক বিকট পোকা হয়ে গেছে। তখনও তার মধ্যে মানুষের বোধ থাকলেও আকার-আকৃতি-সক্ষমতায় সে তেলাপোকাসদৃশ একটা পোকামাত্র, উপাজর্নে অক্ষম। সংসারের মা-বাবা এবং বোন ক্রমে তাদের জীবনের নিত্যতায় অভ্যস্ত হতে হতে সময়কালে গ্রেগর পোকা বোঝা হয়ে ওঠে। পোকা গ্রেগর থেকে তারা মুক্তি চায়। বিশেষ করে ভীষণ ¯েœহের বোনও তাই চায়, বাবা চায়ই। অথচ সংসারের সব খরচ নির্বাহে পরিশ্রান্ত সেলস্ম্যান গ্রেগর সামসা বাবার ঋণ পরিশোধের দায়িত্বও কাঁধে নিয়েছিল। কাফকার ‘মেটামরফসিসের’ বহু বছর পরে ২০০৪ সালে ইংরেজি সাহিত্যের অধ্যাপক বিশ^সাহিত্যের গভীর পাঠক সৈয়দ মনজুরুল ইসলামের হাতেই সম্ভব মনোজগত এবং অবচেতনায় সক্রিয় চরিত্র সৃষ্টির সফল গল্প, নির্মিত হয় অনায়াস সাধ্যেই। প্রবন্ধ, সৃজনশীল লেখা অথবা আড্ডায় মনজুরুল ইসলামের অনায়াস সরস ভূমিকা অতুলনীয়। তাঁর মনোগ্রাহী সহজ প্রকাশ তাঁর সাহিত্যেরও বিশিষ্ট দিক। বিষয় বৈচিত্র্যের বৈভবে তাঁর ব্যক্তিত্ব ও সাহিত্য নতুন মাত্রা যোগ করেছে আমাদের সংস্কৃতি অঙ্গনে।
১. সাহিত্যের মাত্রা, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
২. জিন্দা লাশ, প্রেম ও প্রার্থনার গল্প, সৈয়দ মনজুরুল ইসলামে
সাদ কামালী
বৃহস্পতিবার, ১৬ অক্টোবর ২০২৫
আহমদউল্লাহ স্বভাবে চিন্তক, গভীর ও বিশ্লেষণী না হলেও কোনো কোনো বিষয়ে তার মনে প্রশ্ন তৈরি হয়। নিজেই তার উত্তর খোঁজার চেষ্টা করে। যেমন বাসের জন্য শংকর বাসস্ট্যান্ডে দাঁড়িয়ে থাকার সময় মনে হলো শংকর নামটির উৎস কী? শিবশংকরের জটা থেকে নাকি শংকরাচার্যের দর্শনদেউ নাকি বাঙালি শংকর জাতির শংকর থেকে। স্বভাবী চিন্তক এই চরিত্রটি গল্পের ভর ও প্রাণ। কিন্তু চিন্তা বা দর্শন তার চরিত্রের পরিমিতি গল্পের সীমা ছাড়িয়ে ‘ইন্টেলেকচুয়াল’ হয়ে ওঠে না। অর্থাৎ সাহিত্য জ্ঞানের দানবিক ওজন বহনের বাহন নয়, বরং মানবিক ওজন প্রবাহের স্বতঃস্ফূর্ত ধারা যেখানে তার প্রাণবান বিকাশ ঘটে। অর্থাৎ ‘প্রাণের ধর্ম সুমিতি, আর্টের ধর্মও তাই। এই সুমিতিতেই প্রাণের স্বাস্থ্য ও আনন্দ, এই সুমিতিতেই আর্টের শ্রী ও সম্পূর্ণতা।’
আহমদউল্লাহর মনের জিজ্ঞাসাও ‘সুমিতি’ ছাড়িয়ে দর্শন শাস্ত্রে হারিয়ে যায় না। যদিও এই পরিমিত দার্শনিক স্বভাবটি প্রেমিকা সাজেদা শীলার অত ভাল লাগে না, আর্টের প্রাণও করে না। তখন গল্পের আর্টিস্ট শুধু চরিত্রের একটি দিক উল্লেখ করেই দর্শনের ওজনকে মানবিক ওজনের পাল্লায় তুলে দিয়ে শিল্পের প্রাণকে বাঁচিয়ে দেয়। আহমদউল্লাহর সৃষ্টিকর্তা সৈয়দ মনজুরুল ইসলাম তেমন একটা পথ করে দিয়ে শিল্পের প্রাণকে প্রতিষ্ঠা করলেন বটে, কিন্তু আহমদউল্লাহর! তার প্রাণ দানবিক আঘাতে মানবিক বিশে^ আলোড়ন তোলে অথবা এমন একটা অন্তরজগত, মনোজগত তৈরি হলো শিল্পের সুমিতির সব দাবি মিটিয়ে নিটোল আর্ট হয়ে উঠল। এই আর্টের সৃষ্টি করলেন সৈয়দ মনজুরুল ইসলাম, ইংরেজি সাহিত্যের অধ্যাপক ছিলেন। এটি একটি সর্বজ্ঞাত তথ্য। কিন্তু তিনি তাঁর সাহিত্য পাঠ ও সর্বশেষ সাহিত্যের ট্রেন্ড নিয়ে সহজ ও সাবলীল ভাষায় লিখতেন এবং কথা বলতেন। তাঁর এই সহজ পথটি অলংকৃত হতো অসাধারণ রসবোধের সঙ্গে পরিমিত বিশেষণে। প্রবন্ধ রচনা তাঁর মুখ্য কাজ হলেও তিনি অসাধারণ ছোটগল্প লিখেছেন। এবং কথা বলার মতোই তাঁর গল্পের প্রকাশভঙ্গিটি খুব অন্তরঙ্গ।
১৯৯৪ সালে প্রথম গল্পগ্রন্থ ‘স্বনির্বাচিত শ্রেষ্ঠগল্প’ প্রকাশিত হয়। এক বছর পরই বের হয় ‘থাকা না থাকার গল্প’ (১৯৯৫), ‘কাচ ভাঙ্গা রাতের গল্প’ (১৯৯৮), ‘আলো ও অন্ধকার দেখার গল্প’ (২০০১), ‘প্রেম ও প্রার্থনার গল্প’ (২০০৫), ‘সুখদুঃখের গল্প’ (২০১১) এবং ‘বেলা অবেলার গল্প’ (২০১২)। সব গ্রন্থের নামেই ‘গল্প’ শব্দটি আছে। গল্প ভিতর থেকে হয়ে ওঠার সহজ কিন্তু সংবেদী নির্মাণ পথটি তাঁর আয়ত্তে ছিল। গল্পকে থামিয়ে জ্ঞান জাহিরের চেষ্টা তিনি করেননি। জ্ঞানের বুদ্ধিগত মূল্য বা সম্মান যতই থাক, সাহিত্যে চরিত্রের অনুগত হয়ে বিনীতভাবে যদি না আসে তাহলে জ্ঞানের কারাগারে তার কদর থাকলেও সহিত্যের পৃষ্ঠায় তার কপালে নিন্দা ছাড়া আর কিছু জোটে না।
যাই হোক, সৈয়দ মনজুরুল ইসলামের ‘জিন্দা লাশ’ গল্পের আহমদউল্লাহ ‘চিন্তক’ হলেও তার চিন্তাকে গল্প ছাড়িয়ে যাওয়ার অধিকার গল্পকার দেন না। যখনই সে ‘শংকর’ নাম নিয়ে শিবশংকর থেকে শংকরাচার্যের ভিতর অনুসন্ধান থেকে অনুসিদ্ধান্তে পৌঁছতে যাবে তখনই পাশের নির্মীয়মান বাসিলা টাওয়ারের দশতলা উঁচু থেকে ইট এসে পড়ল হঠাৎ তার মাথায়। এ যেন গল্পের দেবতা গল্পের পথ তৈরি করে দিতেই চিন্তার হেঁয়ালি থেকে মুক্তি দিল। গল্পকার লিখেছেন, “...তার মস্তিষ্কের যে জায়গা থেকে চিন্তার উৎপত্তি, মগজের সেই বাঁ দিকে, আকাশ থেকে একটা ইট এসে পড়ল।’ যুক্তিবাদী গল্পকার আকাশ থেকে পড়ার কথাটি ভেঙে পাশের ওই টাওয়ারটির কথা বলেন। মাথার ওপর ইট ফেলে গল্পকার অত্যন্ত অন্তরঙ্গ ভঙ্গিতে গল্পে প্রবেশের সূচনা করলেন। গল্পের আহমদউল্লাহর বিষয়ে সাধারণ তথ্য এই- জাতীয় ক্রীড়া পরিষদে একটি পদন্নতি পেয়ে আহমদউল্লাহ সেকশন চিফ হয়েছে। সরকারি এই কাজে চাপ, ব্যস্ততা বা নিয়ম পালনের কঠিন শাসন নেই। সংসারের বড় সন্তান হিসেবে নি¤œমধ্যবিত্ত পরিবারের সেই একমাত্র উপার্জনকারী ব্যক্তি। বাবা স্টিমারের মাস্টার এখন অবসরপ্রাপ্ত। ছোট ভাইবোনদের পড়ালেখা, কারও কারও বেকারত্ব, কারও কারও বিয়ের বয়স হয়ে যাওয়ার চাপ নিয়ে আহমদউল্লাহ দায়িত্ব পালন করে আসছিল। সংসারের দায় যেমন তার কাঁধে, তেমনি জগৎ-সংসার নিয়ে ভাবনার দায়িত্বও যেন তার। কিন্তু গল্পকার সুকৌশলে চরিত্রের এইসব অভিমুখগুলো দেখিয়েই নতুন একটা জগৎ নির্মাণের পথে এগোয়, সেই পথটিই গল্পটিকে শিল্পকর্ম করে তোলে। মস্তিষ্কের আঘাতে আহমদউল্লাহ অল্প সময়ের মধ্যে হাসপাতালের বিছানায় ‘কমা’য় চলে যায়। লাইফ সাপোর্ট দিয়ে তাকে বাঁচিয়ে রাখলেও তিন দিনের মধ্যে হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ আহমদউল্লাহর কোনো পরিচয়, পরিজনের খোঁজ পায় না। তবে তিন দিন পর নিজের পরিবার, অফিসের সহকর্মী তার খোঁজ পায়। খোঁজ পায় তার প্রেমিকা সাজেদা শীলাও। চেতন অবচেতন-নিরপেক্ষ ‘সবজি’-জীবন নিয়ে হাসপাতালের বিছানায় ‘জিন্দা লাশ’ হয়ে পড়ে থাকে কয়েক মাস। চিকিৎসক নিজেই এই সবজি-পরিণতির উন্নতি আশা করে না। অন্যদিকে আহমদউল্লাহর পরিবার ধীরে ধীরে উপার্জনক্ষম মানুষটির অনুপস্থিতির বাস্তবতায় একদিকে যেমন পরিবারের কেউ কেউ আয়-উপার্জনের সংসারের হাল ধরে অন্যদিকে সবজি হয়ে পড়ে থাকা মানুষটির আবেদন ফিকে হতে থাকে তাদের মনে। দিনে দিনে হাসপাতালে আহমদউল্লাহর দর্শনার্থী কমে যায়, এমনকি শীলাও এখন সবজি-শরীরের অপেক্ষায় বৃথা সময় ব্যয় না করে সময়কে নতুন অর্থময় সম্পর্কের সম্ভাবনায় আলোকিত করে তোলে। এই সব ন্যারেটিভের কেজো কথার বাইরে গল্পের মূল বিকাশ কেন্দ্রে গুরুত্বপূর্ণ হয়ে ওঠে মনোজগতের এক অনন্য যাত্রা। চিকিৎসকের ঘোষিত সবজি-জীবনের অন্তরালে লেখক অন্য একটি মনকে আবিষ্কার করেন- ক্লাসিকস এবং সমকালীন বিশ^সাহিত্যের নিবিষ্ট পাঠক সৈয়দ মনজুরুল ইসলাম জানেন কোন কৌশলে দেহ থেকে মন বা দেহনিরপেক্ষ এক সত্তা শিল্পীর কলমে জন্ম নিয়ে ঘুরেফিরে দেখে তার নিকটজনদের ঘরগেরস্তালির সঙ্গে তাদের মনের অবস্থাটিও। বিশেষ করে আপনজনের মনে কতটুকু সে বেঁচে আছে, কীভাবে আছে। সবজি-জীবন এখন অতিরিক্ত মনে হলেও আহমদউল্লাহ দেখে সংসারের নিত্যতায় গতি ফিরেছে, আয় ও জীবন প্রাথমিক বিপন্ন অবস্থা কাটিয়ে সম্ভব সচ্ছন্দ ও জীবন যৌবনে স্বাভাবিক বেগ-আবেগের সঞ্চার ঘটেছে। প্রেম, বিয়ে, চাকরি ও সুখ-অসুখের সংসার তাকে ছাড়াই অভ্যস্ত হয়ে ওঠে স্বাভাবিক পথে।
আহমদউল্লাহ যখন নিজের ঘরে আসে, দেখে তার সংকীর্ণ ঘরটি তার ভাই আপন করে নিয়েছে। বোন অন্য ভাই বাবা মা সবজি জীবনের বাস্তবতা কী তারা জেনে নিয়েছে। এমনকি আহমদউল্লাহ হাসপাতালের ডাক্তার নার্স প্রত্যেকের টেবিলে টেবিলে ঘুরে তাদের সাথে কথা বলে বুঝে নিয়েছে, একদা একটি সংসারের একমাত্র উপার্জনক্ষম মানুষটির অনুপস্থিতি যখন গভীর শূন্যতায়, গাঢ় বেদনায় ডুবে যায়নি, তখন ডাক্তার নার্স প্রমুখ পেশাজীবীগণ রোগীর পরিবারের মতামত নিয়ে সবজি-জীবনের অবশিষ্টটুকুও মিলিয়ে দিতে প্রস্তুত হয়ে ওঠে।
সৈয়দ মনজুরুল ইসলামের অহমিকামুক্ত আধুনিক মনের সরল আচরণ এবং তাঁর সরস আলোচনা তরুণ লেখক-পাঠক ও তাঁর ছাত্রদের কাছে প্রিয় হয়েছিল। তাঁর এই মনের গভীরে আছে শিল্প-সাহিত্যের সকল ঘরানা বা জন্রা বিষয়ে পাঠ ও ইতিবাচক গুণাগুণ। ফলে তরুণ থেকে তরুণতর লেখকদের সাহিত্যের খবর তিনি রাখতেন। বিশ^সাহিত্যের সমকালীন বিশিষ্ট রচনাগুলোর পাঠ তিনি সংবাদ-এর সাহিত্য পাতায় ‘অলস দিনের হাওয়া’ শিরোনামে চার দশক আগেই লিখতে শুরু করেছিলেন। এই গদ্যের লেখকও আন্তরিক শ্রদ্ধা ও কৃতজ্ঞতার সঙ্গে স্মরণ করছে তাঁর ওই ‘অলস দিনের হাওয়া’র যেসব লেখক ভেসে এসেছিলেন আমাদের অচলায়তনে, তাঁদের সম্পর্কে কৌতূহলী হয়ে ওঠা এবং পরে পাঠ সম্ভব হয়। মনে পড়ছে চিনোয়া আচেবে, নাগিব মাহফুজ, সালমান রুশদি প্রমুখের নাম ও লেখা সম্পর্কে অবগত হই, পড়তে আগ্রহী হয়ে উঠি ওই ‘হাওয়া’র সুবাদে।
‘জিন্দা লাশ’ গল্পের আহমদউল্লাহ কি গ্রেগর সামসা নয়? পরিবারের একমাত্র উপার্জনক্ষম গ্রেগর সামসা এক ভোরে আকস্মিকভাবে আবিষ্কার করে সে এক বিকট পোকা হয়ে গেছে। তখনও তার মধ্যে মানুষের বোধ থাকলেও আকার-আকৃতি-সক্ষমতায় সে তেলাপোকাসদৃশ একটা পোকামাত্র, উপাজর্নে অক্ষম। সংসারের মা-বাবা এবং বোন ক্রমে তাদের জীবনের নিত্যতায় অভ্যস্ত হতে হতে সময়কালে গ্রেগর পোকা বোঝা হয়ে ওঠে। পোকা গ্রেগর থেকে তারা মুক্তি চায়। বিশেষ করে ভীষণ ¯েœহের বোনও তাই চায়, বাবা চায়ই। অথচ সংসারের সব খরচ নির্বাহে পরিশ্রান্ত সেলস্ম্যান গ্রেগর সামসা বাবার ঋণ পরিশোধের দায়িত্বও কাঁধে নিয়েছিল। কাফকার ‘মেটামরফসিসের’ বহু বছর পরে ২০০৪ সালে ইংরেজি সাহিত্যের অধ্যাপক বিশ^সাহিত্যের গভীর পাঠক সৈয়দ মনজুরুল ইসলামের হাতেই সম্ভব মনোজগত এবং অবচেতনায় সক্রিয় চরিত্র সৃষ্টির সফল গল্প, নির্মিত হয় অনায়াস সাধ্যেই। প্রবন্ধ, সৃজনশীল লেখা অথবা আড্ডায় মনজুরুল ইসলামের অনায়াস সরস ভূমিকা অতুলনীয়। তাঁর মনোগ্রাহী সহজ প্রকাশ তাঁর সাহিত্যেরও বিশিষ্ট দিক। বিষয় বৈচিত্র্যের বৈভবে তাঁর ব্যক্তিত্ব ও সাহিত্য নতুন মাত্রা যোগ করেছে আমাদের সংস্কৃতি অঙ্গনে।
১. সাহিত্যের মাত্রা, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
২. জিন্দা লাশ, প্রেম ও প্রার্থনার গল্প, সৈয়দ মনজুরুল ইসলামে