সৈয়দ মনজুরুল ইসলাম
বার্গাস ইয়োসার নায়কেরা মারিও বার্গাস ইয়োসা সম্পর্কে একটি সাধারণ ধারণা প্রচলিত রয়েছে যে, গাব্রিয়েল গার্সিয়া মার্কেজের মতো তাঁর লেখাতেও রয়েছে জাদুবাস্তবতার আবহ। গার্সিয়া মার্কেজের মতো তাঁর লেখাতেও কল্পনা ও বাস্তবতার একটা স্বপ্নময় মিশ্রণ, অস্তিত্ব বিষয়ে একটা অস্পষ্টতা, সময়ের ধারাবাহিকতায় ছেদ টেনে সময়কে মনের একটি তাগিদ অথবা তাগিদহীনতা হিসেবে দেখা, অথবা চরিত্রদেরকে বাস্তবের ভেতর দিয়ে এক নতুন দৃশ্যপটে স্থাপন করা- যার মাত্রাগুলো পরিচিত হলেও রূপটি অচেনা, অনেক ক্ষেত্রে অজ্ঞাত- এরকম জাদুবাস্তবতাধর্মী বৈশিষ্ট্যের দেখা পাওয়া যায়। কিন্তু এগুলোর ব্যবহারে সবসময় তিনি সেই পূর্বাপরতা রক্ষা করেননি, যা গার্সিয়া মার্কেজ তাঁর প্রায় প্রতিটি কাজেই করেছেন। মারিও বার্গাস ইয়োসা বরং নিজেকে তাঁর সময়ের বর্ণনাকারী, গল্পকার ও ইতিহাস-লেখক হিসেবে দেখতেই বেশি আগ্রহী। তাঁর পছন্দ মানুষ, বিশেষ করে শক্তিশালী নায়কেরা এবং তাদের সঙ্গে সময়, পরিবেশ, প্রকৃতি এবং ইতিহাসের সম্পর্ক। এ জন্য বাস্তবতার চিত্রটি অনেক সময় প্রকট হয়ে দাঁড়ায় তাঁর বর্ণনায়। ল্যাটিন আমেরিকার সংস্কৃতিতে নায়কোচিত যে কিছু গুণাবলিকে সমীহ করা হয়, যাদের ম্যাচিসমোর প্রয়াস ঘটাতে চেয়েছেন। এজন্য তাঁর উপন্যাসে নায়কের চরিত্রটি শক্তিশালী, যদিও তার নৈতিক কল্পনার শৈথিল্য শেষ পর্যন্ত তাকে প্রশ্নবিদ্ধ করে। বার্গাস ইয়োসার প্রথম উপন্যাস, কুকুরের শহর (‘লা সিউদাদ ই লস পেরোস’) বেরোয় ১৯৬২ সালে। ইংরেজি অনুবাদে এর নাম ‘দি টাইম অফ দি হিরো’ (১৯৬৭) অর্থাৎ ‘নায়কের সময়’। এই বইতে ওই কুকুর অর্থাৎ তরুণ কিছু শিক্ষার্থীর ম্যাচিসমো বলে সাধারণত বর্ণনা করা হয়, অনেক উপন্যাসে বার্গাস ইয়োসা সেই ম্যাচিসমো অর্জনের প্রয়াসটাই প্রধান বিষয়। এর দু’এক বছর আগে (তারিখটা বলতে পারব না, বইটি যেহেতু হাতের কাছে নেই) বেরিয়েছে ‘দি স্টোরিটেলার’ (এল আব্লাদোর)। বইটি কিনে উৎসাহ নিয়ে পড়েছিলাম। এ গল্পটি ভিন্নবর্তী একটি অবলোকনের ভেতর দিয়ে আমাদের নিয়ে যায়। ১৯৬৬ সালে লেখা ‘দি গ্রিন হাউস’ (‘লা কাসা ভের্দে’) যেমন কিছুটা আজগুবি মনে হয়েছিল, ‘দি স্টোরিটেলারকে’ও সেরকম মনে হয়েছে। দুজন গল্পকথককে নিয়ে আবর্তিত উপন্যাসটি, ‘দি গ্রিন-হাউস’-এর মতো। পেরুর আমাজন অঞ্চলের এক জঙ্গলের আদিম অধিবাসীদের নিয়ে উপন্যাসের একটা বড় অংশ রচিত। উভয় উপন্যাসে একজন নৃতত্ত্ববিদ আছেন, তাদের ভূমিকাও বেশ বিচিত্র।
কিছুদিন আগে একটি জার্নালে প্রকাশের জন্য লেখা একটি প্রবন্ধ আমার কাছে আসে এর ওপর বিশেষজ্ঞ মতামত দেয়ার জন্য। প্রবন্ধের বিষয় বার্গাস ইয়োসার ‘দি স্টোরিটেলার’, বিশেষ করে এই উপন্যাসে বার্গাস ইয়োসার পোয়েটিক্স ও রাজনীতি। চমৎকার বিশ্লেষী প্রবন্ধ। বিষয়টি কঠিন, কিন্তু লেখাটি প্রাঞ্জল। সেটি পড়ে দুয়েকটি বিষয় আবার দেখে নেওয়ার জন্য ‘দি স্টোরিটেলার’ খুঁজতে গিয়ে দেখি, বইটি উধাও। কেউ নিয়ে আর ফেরত দেননি।
কিন্তু খুঁজতে গিয়ে হাতে উঠে এল ‘দি টাইম অফ দি হিরো’। আমার প্রিয় একটি উপন্যাস। আবার পড়া যায়, এরকম একটি বই, যদিও ব্যক্তি হিসেবে বার্গাস ইয়োসা তেমন প্রিয় নন আমার। পেরুর স্বৈরাচারী শাসক বেলাউন্দে তেরির দোসর ছিলেন তিনি, তাঁর অবস্থান ছিল গণমানুষের বিপক্ষে। পেরুর রাষ্ট্রপতি নির্বাচনে অংশ নিয়েছিলেন, আলবের্তো ফুজিমোরোর কাছে পরাজিত হয়েছিলেন, কিন্তু তারপর রাজনীতি থেকে দূরেই চলে যান। বলা যায় সাধারণ মানুষ সম্পর্কে তাঁর কোনো ভাবনা নেই, উচ্ছ্বাস নেই। কিন্তু একসময় ছিল। এক সময় তিনি, যাকে বলে বিদ্রোহীই ছিলেন, তাঁর প্রথম উপন্যাসটি ওই বিদ্রোহেরই ফসল।
‘দি টাইম অফ দি হিরো’ কিছু তরুণ শিক্ষার্থীর জীবন নিয়ে লেখা। ম্যাচিসমো অর্জন তাদের সামনে একটা আদর্শ হিসেবে তুলে ধরেছে তাদের সামরিক শিক্ষা প্রতিষ্ঠান লিওনচিও প্রাদো একাডেমি। বার্গাস ইয়োসা নিজে ওই সামরিক একাডেমির ছাত্র ছিলেন। এই প্রতিষ্ঠানকে ভেতর থেকে দেখেছিলেন বলে নিজের অভিজ্ঞতা থেকে তার যে নিখুঁত বর্ণনা দেন ‘দি টাইম অফ দি হিরো’ উপন্যাসে, তাতে দান্তের ইনফার্নোর সেই অন্ধকার, অবিশ্বাস্য, শ্বাসরুদ্ধকর বর্ণনারই পুনরাবৃত্তি ঘটে। পেরুর শাসকগণ এতটা উত্তেজিত হয়ে পড়েন বইটি প্রকাশের পর যে, লিওনচিও প্রাদো একাডেমি উপন্যাসটির এক হাজার কপিতে অগ্নিসংযোগ করে একাডেমির চত্বরে। আঁতে ঘা লাগার সরল বিষয়টি ছাড়াও শাসককুল চিন্তিত ছিল যুক্তরাষ্ট্র থেকে সামরিক সাহায্য আসা কমে যাবে, নিজেদের মেদ ও লাবণ্যে ঘাটতি পড়বে, যদি উপন্যাসটি বহুল প্রচারিত হয় সেই ভয়ে।
‘দি টাইম অফ দি হিরো’তে যা ঘটে, তা একটি ক্ষুদ্রায়তন বিশ্বে কিছু কিশোর-তরুণকে নিয়েই ঘটে। অথচ সেই সব ঘটনার ব্যাপ্তি বিশাল, ওই কিশোর তরুণ জীবন থেকে বড় এক একটি অবস্থানের প্রতীক হয়ে দাঁড়ায়। লিওনচিও প্রাদো একাডেমি উপন্যাসটির অনুবিশ্ব, তাঁর চৌহদ্দিতে যেমন পেরুর সমকালীন সমাজ, তেমনি তৃতীয় বিশ্বেরও একটি সুনিশ্চিত উপস্থিতি। উপন্যাসের ঘটনা অবশ্য ওই একাডেমি ছড়িয়ে লিমা শহরে বিস্তৃত হয়। শহরের নিষিদ্ধ পল্লী, নি¤œমধ্যবিত্ত অঞ্চল, বিপণি এলাকাগুলোতে আমাদের নিয়ে যান ঔপন্যাসিক এবং আমরা দেখি কীভাবে এক অন্ধকার, অনুপ্রেরণাহীন সমাজের প্রতিটি রন্ধ্রে ঢুকে পড়া অবক্ষয়কে তিনি মূর্ত করেন। বিশাল লিমা শহরের যত বর্ণনা, তার একটিও ভালোবাসার নয়- বিবমিষার কিছু, অনীহার অনেক। কিন্তু বার্গাস ইয়োসা বর্ণনার স্টাইল ব্যবহার করেছেন আত্মকথনের, চরিত্রদের ইন্টেরিয়র মনোলগের, তাতে পুরনো স্মৃতি (কিশোর তারুণ্যের স্মৃতি আর কত পুরনো হতে পারে? কিন্তু মানসিকভাবে তারা প্রায় বৃদ্ধ; বয়স তাদের, সেই পুরনো কথায় ফিরে গিয়ে বলা যায়, পৃথিবীর সমান) অনেক স্থানকে একটি আলাদা মহিমা দেয়। কখনো খুব রোমান্টিক হয়ে পড়ে স্থান, দুদিকে গাছের সারি, কোনো শীতল এভিন্যু, মিরাফ্ল্যোরেস এর সাজানো ঘরবাড়ি হঠাৎ এক স্বপ্নিল স্পর্শ পায়। কিন্তু ওই রোমান্টিকতা বরং বাস্তবতাকে আরো বেশি বিদ্রুপ করে। এই উপন্যাসের ঘরবাড়ি পতনোন্মুখ, সংসারগুলোও বিচ্ছিন্ন। যে পাঁচ-ছয়জন কিশোর যুবকের বয়ানিতে এই উপন্যাস, তারা ভয়ানক বিচ্ছিন্নতায় আক্রান্ত। বার্গাস ইয়োসা এইসব কিশোর তরুণের মধ্য দিয়ে, অনেকটা উইলিয়াম গোল্ডিং যেমন করেছিলেন এ লর্ড অফ দি ফ্লাইস-এ, বয়স্ক পৃথিবীকে ব্যঙ্গ করেন। তবে সেই ব্যঙ্গে নিজেও জড়িয়ে পড়েন- আমরা জানি এই সব চরিত্রের কোনো একটি তিনি নিজে হয়ত- আলবের্তো দি পোয়েট, অথবা রিকার্দো নামের ক্রীতদাসটি (যার আচার-ব্যবহার অনুগত ভৃত্যের মতো) অথবা জাগুয়ার, এদের কারো কারো মধ্যে তিনি আছেন। আত্মজৈবনিক বলে এই উপন্যাসটি আরো বেশি অস্বস্তির উদ্রেক করে, আরো বেশি তাৎক্ষণিক হয় তার আবেদন।
লিওনচিও প্রাদো মিলিটারি একাডেমিতে তিনটি উপরের ক্লাসে যে তিন বছর কাটাতে হয় একজন ক্যাডেটকে, উপন্যাসটির প্রেক্ষাপট রচনা করে সেই তিন বছর সময়। প্রথম বছরের (যাকে তৃতীয় বর্ষ বলে উল্লেখ করা হয়) শিক্ষানবিশ ক্যাডেটদের ‘ডগ’ বলে সম্বোধন করা হয়, তাদের সঙ্গে কুকুরের মতো দুর্ব্যবহার করা হয়; সিনিয়র ছাত্ররা- বিশেষ করে উপরের বর্ষের, তাদের ওপর অমানবিক অত্যাচার করে, একাডেমি জীবনে তাদের অধিষ্ঠিত করার নামে। ডগরাও প্রতিশোধের চেষ্টা চালায়। এইসব কিশোর তরুণের বয়স পনেরো থেকে সতেরো। একাডেমির আরোপিত কঠোর শৃঙ্খলার জীবন নিরানন্দ, বৈচিত্র্যহীন- প্যারেড, ড্রিল, ক্লাস, ফিল্ড এক্সারসাইজ। কিন্তু এসব ফাঁকি দিয়ে প্রায় সকল নিষিদ্ধ কর্মকা- চলে, কিশোর তরুণেরা সামরিক বাহিনীর জন্য প্রস্তুত হয় বটে, কিন্তু প্রস্তুত হয় চরম অবক্ষয়ের এক প্রাপ্তবয়স্ক জীবনের জন্যও। মদ্যপান, জুয়া, ধুমপান, যৌনাচার, চিত্তবিকৃতি- নৈরাজ্যের আর অনাচারের ষেলোকলা পূর্ণ হয়। উপন্যাসের গল্প ওসব নিয়ে, কিন্তু মূল কাহিনিটি ওই একাডেমির শেষ বর্ষের কিছু ক্যাডেটের একটি গোপন চক্র বা সার্কেল নিয়ে। তারা রসায়ন বিষয়ের একটি প্রশ্নপত্র চুরি করে- এই ঘটনাটি জানাজানি হলে তাদের শাস্তি হয়। চক্রের একজন বিশ্বাসঘাতকতা করে, মূল হোতার নাম বলে দেয় কর্তৃপক্ষের কাছে, তাকে একসময় খুন করা হয়, ফিল্ড এক্সারসাইজের সময়। ওই খুন আরো ঘটনার জট পাকায়। অবিশ্বাস্য ভয় ও ভীতি গ্রাস করে অন্যদের। একাডেমির স্থূল এবং ভঙ্গিসর্বস্ব অফিসারদের মধ্যে একজন যে একটু নীতিবাগিশ, লেঃ গাম্বোয়া, সে প্রচেষ্টা চালায় ওই খুনের ব্যাপারে তদন্তের। সামরিক বাহিনী অপ্রিয় ঘটনা স্বীকার করতে রাজি হয় না, ধামাচাপা পড়ে ঘটনাটি, গাম্বোয়াকে বদলি হতে হয় একটি পার্বত্য সেনা ক্যাম্পে, শাস্তি হিসেবে। তার আশাভঙ্গ, হত্যার মূল নায়কের আশাভঙ্গ- এসব নদীর সিকস্তির মতো সমাজের ভিত ধসানোর রূপক। ছায়াছবির মতো আমাদের চোখের সামনে দিয়ে একটি সমাজ পতনের দিকে এগিয়ে চলে।
মারিও বার্গাস ইয়োসা সময়কে তার ক্রমিক পরিচিত থেকে আলাদা করে ভিন্ন একটি পরিচিতি দেন। এজন্য একই সঙ্গে যেন সবকিছু ঘটে উপন্যাসে- একই সঙ্গে সকল স্মৃতি জীবন্ত হয়। যেন একটিই অতীত আছে সকল চরিত্রের, একটি অভিন্ন বর্তমান এবং একটিই ভবিষ্যৎ। চরিত্রদের স্মৃতি রোমন্থনে একেক গৃহস্থালির করুণ ছবি উঠে আসে- কারো পিতা নিষ্ঠুর, প্রবঞ্চক, মা দুখিনী; কারো অভিজ্ঞতায় সুর চিরপলাতক, কারো জীবনে সুন্দরের প্রবেশ ঘটে- প্রাগৈতিহাসিক সময়ে, পরে কুৎসিতের মুখ হা করা ব্যাপ্তি তাকে তাড়না করতে থাকে। আমরা প্রশ্ন করি, এই সমাজে বেঁচে থাকার ভিত্তি তাহলে কী? এসব নিষ্ঠুরতা, নিপীড়ন, প্রবঞ্চনা, অবক্ষয় ও পতন কি অনিবার্য এবং অপ্রতিরোধ্য? একটি উত্তর একসময় মেলে, তবে উপন্যাসের ঘটনায় নয়, তার বিশ্লেষণে। একদল অপাপবিদ্ধ কিশোরের পাপাচারকে আমরা যখন স্বাভাবিক বলে ধরে নিতে পারি না, তখন আমাদের দৃষ্টি যায় প্রাপ্তবয়স্ক পৃথিবীর দিকে এবং সেইখানে আসল পচনটি আবিস্কার করি আমরা। বরং উপন্যাসের শেষে, জাগুয়ারের চরিত্রটি যখন ট্র্যাজিক একটি চরিত্রে রূপান্তরিত হয়, তখন একটি আশাবাদ জন্মে আমাদের- যে, তরুণেরা উঠে দাঁড়াবে, প্রতিবাদী হবে, অসুন্দরকে শনাক্ত করবে, পচনকে ঠেকাবে। এই আশাবাদ বার্গাস ইয়োসার মতো ঔপন্যাসিককেও স্পর্শ করে।
- ৯ জুন ২০০০
সৈয়দ মনজুরুল ইসলাম
বৃহস্পতিবার, ১৬ অক্টোবর ২০২৫
বার্গাস ইয়োসার নায়কেরা মারিও বার্গাস ইয়োসা সম্পর্কে একটি সাধারণ ধারণা প্রচলিত রয়েছে যে, গাব্রিয়েল গার্সিয়া মার্কেজের মতো তাঁর লেখাতেও রয়েছে জাদুবাস্তবতার আবহ। গার্সিয়া মার্কেজের মতো তাঁর লেখাতেও কল্পনা ও বাস্তবতার একটা স্বপ্নময় মিশ্রণ, অস্তিত্ব বিষয়ে একটা অস্পষ্টতা, সময়ের ধারাবাহিকতায় ছেদ টেনে সময়কে মনের একটি তাগিদ অথবা তাগিদহীনতা হিসেবে দেখা, অথবা চরিত্রদেরকে বাস্তবের ভেতর দিয়ে এক নতুন দৃশ্যপটে স্থাপন করা- যার মাত্রাগুলো পরিচিত হলেও রূপটি অচেনা, অনেক ক্ষেত্রে অজ্ঞাত- এরকম জাদুবাস্তবতাধর্মী বৈশিষ্ট্যের দেখা পাওয়া যায়। কিন্তু এগুলোর ব্যবহারে সবসময় তিনি সেই পূর্বাপরতা রক্ষা করেননি, যা গার্সিয়া মার্কেজ তাঁর প্রায় প্রতিটি কাজেই করেছেন। মারিও বার্গাস ইয়োসা বরং নিজেকে তাঁর সময়ের বর্ণনাকারী, গল্পকার ও ইতিহাস-লেখক হিসেবে দেখতেই বেশি আগ্রহী। তাঁর পছন্দ মানুষ, বিশেষ করে শক্তিশালী নায়কেরা এবং তাদের সঙ্গে সময়, পরিবেশ, প্রকৃতি এবং ইতিহাসের সম্পর্ক। এ জন্য বাস্তবতার চিত্রটি অনেক সময় প্রকট হয়ে দাঁড়ায় তাঁর বর্ণনায়। ল্যাটিন আমেরিকার সংস্কৃতিতে নায়কোচিত যে কিছু গুণাবলিকে সমীহ করা হয়, যাদের ম্যাচিসমোর প্রয়াস ঘটাতে চেয়েছেন। এজন্য তাঁর উপন্যাসে নায়কের চরিত্রটি শক্তিশালী, যদিও তার নৈতিক কল্পনার শৈথিল্য শেষ পর্যন্ত তাকে প্রশ্নবিদ্ধ করে। বার্গাস ইয়োসার প্রথম উপন্যাস, কুকুরের শহর (‘লা সিউদাদ ই লস পেরোস’) বেরোয় ১৯৬২ সালে। ইংরেজি অনুবাদে এর নাম ‘দি টাইম অফ দি হিরো’ (১৯৬৭) অর্থাৎ ‘নায়কের সময়’। এই বইতে ওই কুকুর অর্থাৎ তরুণ কিছু শিক্ষার্থীর ম্যাচিসমো বলে সাধারণত বর্ণনা করা হয়, অনেক উপন্যাসে বার্গাস ইয়োসা সেই ম্যাচিসমো অর্জনের প্রয়াসটাই প্রধান বিষয়। এর দু’এক বছর আগে (তারিখটা বলতে পারব না, বইটি যেহেতু হাতের কাছে নেই) বেরিয়েছে ‘দি স্টোরিটেলার’ (এল আব্লাদোর)। বইটি কিনে উৎসাহ নিয়ে পড়েছিলাম। এ গল্পটি ভিন্নবর্তী একটি অবলোকনের ভেতর দিয়ে আমাদের নিয়ে যায়। ১৯৬৬ সালে লেখা ‘দি গ্রিন হাউস’ (‘লা কাসা ভের্দে’) যেমন কিছুটা আজগুবি মনে হয়েছিল, ‘দি স্টোরিটেলারকে’ও সেরকম মনে হয়েছে। দুজন গল্পকথককে নিয়ে আবর্তিত উপন্যাসটি, ‘দি গ্রিন-হাউস’-এর মতো। পেরুর আমাজন অঞ্চলের এক জঙ্গলের আদিম অধিবাসীদের নিয়ে উপন্যাসের একটা বড় অংশ রচিত। উভয় উপন্যাসে একজন নৃতত্ত্ববিদ আছেন, তাদের ভূমিকাও বেশ বিচিত্র।
কিছুদিন আগে একটি জার্নালে প্রকাশের জন্য লেখা একটি প্রবন্ধ আমার কাছে আসে এর ওপর বিশেষজ্ঞ মতামত দেয়ার জন্য। প্রবন্ধের বিষয় বার্গাস ইয়োসার ‘দি স্টোরিটেলার’, বিশেষ করে এই উপন্যাসে বার্গাস ইয়োসার পোয়েটিক্স ও রাজনীতি। চমৎকার বিশ্লেষী প্রবন্ধ। বিষয়টি কঠিন, কিন্তু লেখাটি প্রাঞ্জল। সেটি পড়ে দুয়েকটি বিষয় আবার দেখে নেওয়ার জন্য ‘দি স্টোরিটেলার’ খুঁজতে গিয়ে দেখি, বইটি উধাও। কেউ নিয়ে আর ফেরত দেননি।
কিন্তু খুঁজতে গিয়ে হাতে উঠে এল ‘দি টাইম অফ দি হিরো’। আমার প্রিয় একটি উপন্যাস। আবার পড়া যায়, এরকম একটি বই, যদিও ব্যক্তি হিসেবে বার্গাস ইয়োসা তেমন প্রিয় নন আমার। পেরুর স্বৈরাচারী শাসক বেলাউন্দে তেরির দোসর ছিলেন তিনি, তাঁর অবস্থান ছিল গণমানুষের বিপক্ষে। পেরুর রাষ্ট্রপতি নির্বাচনে অংশ নিয়েছিলেন, আলবের্তো ফুজিমোরোর কাছে পরাজিত হয়েছিলেন, কিন্তু তারপর রাজনীতি থেকে দূরেই চলে যান। বলা যায় সাধারণ মানুষ সম্পর্কে তাঁর কোনো ভাবনা নেই, উচ্ছ্বাস নেই। কিন্তু একসময় ছিল। এক সময় তিনি, যাকে বলে বিদ্রোহীই ছিলেন, তাঁর প্রথম উপন্যাসটি ওই বিদ্রোহেরই ফসল।
‘দি টাইম অফ দি হিরো’ কিছু তরুণ শিক্ষার্থীর জীবন নিয়ে লেখা। ম্যাচিসমো অর্জন তাদের সামনে একটা আদর্শ হিসেবে তুলে ধরেছে তাদের সামরিক শিক্ষা প্রতিষ্ঠান লিওনচিও প্রাদো একাডেমি। বার্গাস ইয়োসা নিজে ওই সামরিক একাডেমির ছাত্র ছিলেন। এই প্রতিষ্ঠানকে ভেতর থেকে দেখেছিলেন বলে নিজের অভিজ্ঞতা থেকে তার যে নিখুঁত বর্ণনা দেন ‘দি টাইম অফ দি হিরো’ উপন্যাসে, তাতে দান্তের ইনফার্নোর সেই অন্ধকার, অবিশ্বাস্য, শ্বাসরুদ্ধকর বর্ণনারই পুনরাবৃত্তি ঘটে। পেরুর শাসকগণ এতটা উত্তেজিত হয়ে পড়েন বইটি প্রকাশের পর যে, লিওনচিও প্রাদো একাডেমি উপন্যাসটির এক হাজার কপিতে অগ্নিসংযোগ করে একাডেমির চত্বরে। আঁতে ঘা লাগার সরল বিষয়টি ছাড়াও শাসককুল চিন্তিত ছিল যুক্তরাষ্ট্র থেকে সামরিক সাহায্য আসা কমে যাবে, নিজেদের মেদ ও লাবণ্যে ঘাটতি পড়বে, যদি উপন্যাসটি বহুল প্রচারিত হয় সেই ভয়ে।
‘দি টাইম অফ দি হিরো’তে যা ঘটে, তা একটি ক্ষুদ্রায়তন বিশ্বে কিছু কিশোর-তরুণকে নিয়েই ঘটে। অথচ সেই সব ঘটনার ব্যাপ্তি বিশাল, ওই কিশোর তরুণ জীবন থেকে বড় এক একটি অবস্থানের প্রতীক হয়ে দাঁড়ায়। লিওনচিও প্রাদো একাডেমি উপন্যাসটির অনুবিশ্ব, তাঁর চৌহদ্দিতে যেমন পেরুর সমকালীন সমাজ, তেমনি তৃতীয় বিশ্বেরও একটি সুনিশ্চিত উপস্থিতি। উপন্যাসের ঘটনা অবশ্য ওই একাডেমি ছড়িয়ে লিমা শহরে বিস্তৃত হয়। শহরের নিষিদ্ধ পল্লী, নি¤œমধ্যবিত্ত অঞ্চল, বিপণি এলাকাগুলোতে আমাদের নিয়ে যান ঔপন্যাসিক এবং আমরা দেখি কীভাবে এক অন্ধকার, অনুপ্রেরণাহীন সমাজের প্রতিটি রন্ধ্রে ঢুকে পড়া অবক্ষয়কে তিনি মূর্ত করেন। বিশাল লিমা শহরের যত বর্ণনা, তার একটিও ভালোবাসার নয়- বিবমিষার কিছু, অনীহার অনেক। কিন্তু বার্গাস ইয়োসা বর্ণনার স্টাইল ব্যবহার করেছেন আত্মকথনের, চরিত্রদের ইন্টেরিয়র মনোলগের, তাতে পুরনো স্মৃতি (কিশোর তারুণ্যের স্মৃতি আর কত পুরনো হতে পারে? কিন্তু মানসিকভাবে তারা প্রায় বৃদ্ধ; বয়স তাদের, সেই পুরনো কথায় ফিরে গিয়ে বলা যায়, পৃথিবীর সমান) অনেক স্থানকে একটি আলাদা মহিমা দেয়। কখনো খুব রোমান্টিক হয়ে পড়ে স্থান, দুদিকে গাছের সারি, কোনো শীতল এভিন্যু, মিরাফ্ল্যোরেস এর সাজানো ঘরবাড়ি হঠাৎ এক স্বপ্নিল স্পর্শ পায়। কিন্তু ওই রোমান্টিকতা বরং বাস্তবতাকে আরো বেশি বিদ্রুপ করে। এই উপন্যাসের ঘরবাড়ি পতনোন্মুখ, সংসারগুলোও বিচ্ছিন্ন। যে পাঁচ-ছয়জন কিশোর যুবকের বয়ানিতে এই উপন্যাস, তারা ভয়ানক বিচ্ছিন্নতায় আক্রান্ত। বার্গাস ইয়োসা এইসব কিশোর তরুণের মধ্য দিয়ে, অনেকটা উইলিয়াম গোল্ডিং যেমন করেছিলেন এ লর্ড অফ দি ফ্লাইস-এ, বয়স্ক পৃথিবীকে ব্যঙ্গ করেন। তবে সেই ব্যঙ্গে নিজেও জড়িয়ে পড়েন- আমরা জানি এই সব চরিত্রের কোনো একটি তিনি নিজে হয়ত- আলবের্তো দি পোয়েট, অথবা রিকার্দো নামের ক্রীতদাসটি (যার আচার-ব্যবহার অনুগত ভৃত্যের মতো) অথবা জাগুয়ার, এদের কারো কারো মধ্যে তিনি আছেন। আত্মজৈবনিক বলে এই উপন্যাসটি আরো বেশি অস্বস্তির উদ্রেক করে, আরো বেশি তাৎক্ষণিক হয় তার আবেদন।
লিওনচিও প্রাদো মিলিটারি একাডেমিতে তিনটি উপরের ক্লাসে যে তিন বছর কাটাতে হয় একজন ক্যাডেটকে, উপন্যাসটির প্রেক্ষাপট রচনা করে সেই তিন বছর সময়। প্রথম বছরের (যাকে তৃতীয় বর্ষ বলে উল্লেখ করা হয়) শিক্ষানবিশ ক্যাডেটদের ‘ডগ’ বলে সম্বোধন করা হয়, তাদের সঙ্গে কুকুরের মতো দুর্ব্যবহার করা হয়; সিনিয়র ছাত্ররা- বিশেষ করে উপরের বর্ষের, তাদের ওপর অমানবিক অত্যাচার করে, একাডেমি জীবনে তাদের অধিষ্ঠিত করার নামে। ডগরাও প্রতিশোধের চেষ্টা চালায়। এইসব কিশোর তরুণের বয়স পনেরো থেকে সতেরো। একাডেমির আরোপিত কঠোর শৃঙ্খলার জীবন নিরানন্দ, বৈচিত্র্যহীন- প্যারেড, ড্রিল, ক্লাস, ফিল্ড এক্সারসাইজ। কিন্তু এসব ফাঁকি দিয়ে প্রায় সকল নিষিদ্ধ কর্মকা- চলে, কিশোর তরুণেরা সামরিক বাহিনীর জন্য প্রস্তুত হয় বটে, কিন্তু প্রস্তুত হয় চরম অবক্ষয়ের এক প্রাপ্তবয়স্ক জীবনের জন্যও। মদ্যপান, জুয়া, ধুমপান, যৌনাচার, চিত্তবিকৃতি- নৈরাজ্যের আর অনাচারের ষেলোকলা পূর্ণ হয়। উপন্যাসের গল্প ওসব নিয়ে, কিন্তু মূল কাহিনিটি ওই একাডেমির শেষ বর্ষের কিছু ক্যাডেটের একটি গোপন চক্র বা সার্কেল নিয়ে। তারা রসায়ন বিষয়ের একটি প্রশ্নপত্র চুরি করে- এই ঘটনাটি জানাজানি হলে তাদের শাস্তি হয়। চক্রের একজন বিশ্বাসঘাতকতা করে, মূল হোতার নাম বলে দেয় কর্তৃপক্ষের কাছে, তাকে একসময় খুন করা হয়, ফিল্ড এক্সারসাইজের সময়। ওই খুন আরো ঘটনার জট পাকায়। অবিশ্বাস্য ভয় ও ভীতি গ্রাস করে অন্যদের। একাডেমির স্থূল এবং ভঙ্গিসর্বস্ব অফিসারদের মধ্যে একজন যে একটু নীতিবাগিশ, লেঃ গাম্বোয়া, সে প্রচেষ্টা চালায় ওই খুনের ব্যাপারে তদন্তের। সামরিক বাহিনী অপ্রিয় ঘটনা স্বীকার করতে রাজি হয় না, ধামাচাপা পড়ে ঘটনাটি, গাম্বোয়াকে বদলি হতে হয় একটি পার্বত্য সেনা ক্যাম্পে, শাস্তি হিসেবে। তার আশাভঙ্গ, হত্যার মূল নায়কের আশাভঙ্গ- এসব নদীর সিকস্তির মতো সমাজের ভিত ধসানোর রূপক। ছায়াছবির মতো আমাদের চোখের সামনে দিয়ে একটি সমাজ পতনের দিকে এগিয়ে চলে।
মারিও বার্গাস ইয়োসা সময়কে তার ক্রমিক পরিচিত থেকে আলাদা করে ভিন্ন একটি পরিচিতি দেন। এজন্য একই সঙ্গে যেন সবকিছু ঘটে উপন্যাসে- একই সঙ্গে সকল স্মৃতি জীবন্ত হয়। যেন একটিই অতীত আছে সকল চরিত্রের, একটি অভিন্ন বর্তমান এবং একটিই ভবিষ্যৎ। চরিত্রদের স্মৃতি রোমন্থনে একেক গৃহস্থালির করুণ ছবি উঠে আসে- কারো পিতা নিষ্ঠুর, প্রবঞ্চক, মা দুখিনী; কারো অভিজ্ঞতায় সুর চিরপলাতক, কারো জীবনে সুন্দরের প্রবেশ ঘটে- প্রাগৈতিহাসিক সময়ে, পরে কুৎসিতের মুখ হা করা ব্যাপ্তি তাকে তাড়না করতে থাকে। আমরা প্রশ্ন করি, এই সমাজে বেঁচে থাকার ভিত্তি তাহলে কী? এসব নিষ্ঠুরতা, নিপীড়ন, প্রবঞ্চনা, অবক্ষয় ও পতন কি অনিবার্য এবং অপ্রতিরোধ্য? একটি উত্তর একসময় মেলে, তবে উপন্যাসের ঘটনায় নয়, তার বিশ্লেষণে। একদল অপাপবিদ্ধ কিশোরের পাপাচারকে আমরা যখন স্বাভাবিক বলে ধরে নিতে পারি না, তখন আমাদের দৃষ্টি যায় প্রাপ্তবয়স্ক পৃথিবীর দিকে এবং সেইখানে আসল পচনটি আবিস্কার করি আমরা। বরং উপন্যাসের শেষে, জাগুয়ারের চরিত্রটি যখন ট্র্যাজিক একটি চরিত্রে রূপান্তরিত হয়, তখন একটি আশাবাদ জন্মে আমাদের- যে, তরুণেরা উঠে দাঁড়াবে, প্রতিবাদী হবে, অসুন্দরকে শনাক্ত করবে, পচনকে ঠেকাবে। এই আশাবাদ বার্গাস ইয়োসার মতো ঔপন্যাসিককেও স্পর্শ করে।
- ৯ জুন ২০০০