ফারহানা আফরোজ বাপ্পীর চিত্র প্রদর্শনী
আনিস রহমান
দূরত্ব দৃশ্যকে আড়াল করে, তখন দৃষ্টির বাইরে চলে যায় দৃশ্য। তার মানে দৃশ্যের অস্তিত্ব শেষ হয়ে যায় না। এটাই বাস্তবতা। সূর্যের আলোয় রাতের আকাশ মিশে যায়। তারারা নির্বাসিত হয় অসীম অনন্ত কোনো লোকে। তার মানে তারার অস্তিত্ব, রাতের আকাশ হারিয়ে যায় না। তারা তার অস্তিত্ব নিয়ে দিব্যি প্রকাশমান। তবে দৃষ্টির আড়ালে কেন? এখানে এক ধরনের সিম্ফনি রয়েছে, তা হলো তারার প্রকাশ তখনই সত্যি হয়, যখন আকাশে অন্ধকার এসে ছায়া ফেলে। তারার ঔজ্জ্বল্যের সংগে অন্ধকারের রিদম রয়েছে। অন্ধকার পেলেই তারা তার আপন সত্তায় বিকশিত হয়। রৌদ্রচ্ছটায় তা সম্ভব হয় না। একইভাবে দূরত্ব কমে গেলে দৃশ্য তখন দৃশ্যমান হয়। কারণ সে আছে। সে আছে তার পরিপূর্ণ অস্তিত্ব নিয়েই। শুধু দূরত্বের জন্যে দৃশ্যের সাময়িক অনুপস্থিতি। দূরত্ব ঘুচলেই সেখানে আবার দৃশ্য বিকাশিত, প্রকাশিত হয় পরিপূর্ণভাবে। এ কথাগুলো প্রাসঙ্গিক ফারহানা আফরোজ বাপ্পীর শিল্পকর্ম প্রসংগে। ফারহানার একক চিত্র প্রদর্শনী শেষ হয় ১৪ অক্টোবর ২০২৫ তারিখে। ০৩ অক্টোবর এ প্রদর্শনীর উদ্বোধন হয়। ঢাকার লালমাটিয়ার দ্বীপ গ্যালারিতে আয়োজন করা হয় এ প্রদর্শনী।
দৃশ্য কিংবা অন্ধকার। অন্ধকার কিংবা তারা। এসবের প্রকাশ কিংবা অস্তিত্বের সংগে রিদম বা ছন্দের কথা এলো এ কারণে যে ফারহানা তার চিত্রকর্মে এক ধরনের ছন্দের অন্বেষণ করেছেন বরাবর।
‘এ পিস অন মেডিটেশন’ নামকরণে এ প্রদশর্নীর মূল সুরই হচ্ছে দিনের পর রাত, মেঘের পর নীলাকাশ কিংবা নদীর ভাঙনের পরেই সেখানে গড়ার পালার মধ্যে যে ছান্দসিক পালাবদল ঘটে। তেমনি করে সময় নির্মিত হয় নানা ঘাত-প্রতিঘাতের মধ্য দিয়ে। নানা চড়াই-উৎরাই পেরিয়ে। সময় এবং পরিবেশকে কেন্দ্র করে মানবজীবনে যে চড়াই-উৎরাই তার জীবনকে প্রভাবিত করে, তার মনোচেতনাকে প্রতিবিম্বিত করে সেই বাস্তবতাকেই মূর্ত করে তুলেছেন ফারহানা তার তুলি আর ক্যানভাস, রঙ ও রেখার সমন্বয়ে।
মূলত প্যানডামিক সময়ের এক বিমূর্ত আলেখ্য, ফারজানার চিত্রকর্ম। স্মরকালের ভয়াবহতম, মানবিক, সামাজিক ও প্রাকৃতিক বিপর্যয় ছিলো করোনার অভিঘাত। সাম্প্রতিক সময়ের এক বিস্ময়কর ও বিভীষিকাময় দুর্যোগ ছিলো করোনা। দীর্ঘসময় ধরে বিরাজমান এ প্যানডামিক সময়ে বৈশ্বিক বিপর্যয়ের অভিঘাত ছিলো অত্যন্ত মর্মান্তিক। আতঙ্কময়, র্নিয়ন্ত্রণহীন সেই মরণব্যাধী শুধুমাত্র আমাদের সামাজিক ক্ষেত্রেই লকডাউন কিংবা স্থবিরতার সৃষ্টি করেনি, মানুষের মনস্তাত্ত্বিক ক্ষেত্রেও নেমে এসেছে এক চরম বন্ধ্যাত্ব ও বিকারহীনতা। বিশ্ব এখন হাতের মুঠোয়। বিশ্ব এখন এক উঠোনের কিছু ঘরবাড়ি। ফলে বৈশ্বিক প্রতিক্রিয়া ও তার অভিঘাত তরঙ্গায়িত হয়ে মুহূর্তে আমাদের মনন ও মানসিকতাকে উদ্বেলিত করছে, উৎকণ্ঠিত করছে। উদ্বেগজনক এক অস্থিরতা আমাদের চেতনাকে খ-িত করছে। এমনি স্থবির সময়ের স্থবির মানুষ, তার মনুষ্যত্ববোধ ও তার মানবিকতার নানা মেরুকরণের উপভাষার অলঙ্করণে ফারহানা এবারে তাঁর প্রদর্শনীকে সাজিয়েছেন।
আসলে প্যানডামিক শুধু মানুষের মধ্যে আতঙ্কই তৈরি করেনি, মৃত্যু চেতনাকেও গভীরভাবে প্রোথিত করেছে মানুষের বোধে, তার চিন্তা-ভাবনা ও আচরণে এবং দৃষ্টিভংগিতে। মানুষে মানুষে বিচ্ছিন্নতাবোধ তৈরি করেছে উদ্বেগজনকভাবে। আপন আর আপন থাকেনি যদি সে হয় করোনাক্রান্ত। ব্রিটিশ সময়ে কালাপার্বন নির্বাসনের মতো এক ধরনের নির্বাসনের সংস্কৃতি চালু হয়েছিলো করোনাসময়ে। আক্রান্ত মানুষ যতোই আপন হোক, তাকে খাবার তুলে দিতেও ছিলো চরম আতঙ্ক। এই আতঙ্কের নেপথ্যে কাজ করেছে আত্মপরতা, স্বার্থপরতা এবং নিজেকে বাঁচিয়ে রাখার এক অদৃশ্য ইচ্ছা ও চেষ্টা। এর ফলে মানবপ্রবৃত্তিতে শুধু নয়, আপনজনেরও চিন্তায়, অনুভবে বোধে ও আবেগে মারাত্মক পরিবর্তন লক্ষ করা যায়—যা শিল্পী মনকেও বিষণœ করে, বিপন্ন করে এবং বোধহীন এক কায়া চারপাশ থেকে আষ্টেপৃষ্ঠে জড়িয়ে রাখে তার সময়কে, চারপাশের পরিবেশকে। চেতনারহিত বিকলাঙ্গ ও জড় এ সময়কে ক্যানভাসে চিত্রায়িত করেছেন শিল্পী তাঁর আপন মহিমায়। এ প্রসংগে শিল্পী ফারহানা আফরোজ বলেন, “করোনার আগের মানুষ আর করোনার পরের মানুষের মধ্যে মননগতভাবে বিস্তর ফারাক তৈরি হয়েছে।” এ প্রসংগে শিল্পীর মনন ও অনুভাবের রেশ টেনে বলা যায়, করোনাকালে প্রতিনিয়ত ক্ষত ও ক্ষরণের তীব্র প্রভাব মানুষের বোধকে বোধশূন্যতার দিকে ঠেলে দিয়েছে। বোধের গভীরে এক মূক আবহের সৃষ্টি করেছে। করোনা পরবর্তী মানুষের মধ্যে আবেগ অনুভূতি মায়া ও সহানুভূতির তীব্র অভাব কাজ করছে। এ প্রসংগে ফারহানা আরও বলেন, “আপনজনের মৃত্যুতেও মানুষ এখন আর সেভাবে কষ্ট পায় না। কোনো যন্ত্রণার দহন তাকে ক্ষত করে না। ফলে আমরা আসলে আবেগহীন একটি সময়ের মধ্যে দিয়ে যাচ্ছি। যা আমাদের মননশীলতা ও সৃষ্টিশীলতার জন্যে খুবই ক্ষতিকর প্রভাব নিয়ে আসছে।”
এমনি এক বিপণœ সময়কে উপজীব্য করেই শিল্পী তাঁর নির্মাণশৈলীকে প্রবাহিত করেছেন। ফলে আপাতদৃষ্টিতে তাঁর ছবিতে এক ধরনের বিষাদময়তার ছায়া থাকলেও তা কখনোই নিবিড় অন্ধকারের দিকে ধাবিত হয়নি। বরং ক্ষণে ক্ষণে তার ছবিতে উজ্জ্বলতা দেখতে পাই। প্রায় প্রতিটি ছবির মধ্যে এক ধরনের উজ্জ্বলতার প্রকাশ আসলে শিল্পীমনের এক আশাবাদী চেতনাকে উৎসারিত করে। যা মানুষের চিরায়ত এবং অজেয় শক্তিকেই নির্দেশ করে। মানুষের ভেতর যে অসীম শক্তি, সামর্থ্য ও দুর্জেয় শক্তির নিহীত রূপ বিরাজমান, শিল্পীর আশাবাদী চেতনার মধ্য দিয়ে শিল্পী সেই সত্যকেই আবার প্রকাশিত করেছেন ভিন্নমাত্রায়, অন্য এক নতুন মাত্রায়।
শিল্পী শুধু আলোর সংকেত দিয়েই এক নতুন সময়কে নির্মাণে প্রয়াসী হয়েছেন তা নয়, তার ছবিতে এক ধরনের তরঙ্গায়িত ছন্দের প্রকাশও আমাদের মোহিত করে। মানুষের চেতনায় যখন ইতিবাচক প্রভাব কাজ করে তখন সেখানে একধরনের তরঙ্গ, ছন্দ বা রিদমের প্রকাশ ঘটে। অর্থাৎ মানুষের চেতনা তার অস্তিত্ব যখন সক্রিয়, যখন সে নির্মাণ আর সৃষ্টিতে সক্ষম, যখন সে পরিবর্তন প্রত্যাশী। এবং পুরনোকে ভেঙে নতুনের আহ্বানে সক্রিয়। চেতনার মধ্যে তারই প্রকাশ দৃপ্তিময়। তখনই বোঝা যায়—এখানে জীবন আছে। আর যেখানে জীবন আছে সেখানে স্বপ্ন আছে। আছে বাঁচার আকাক্সক্ষা এবং নতুন নির্মাণের এক প্রত্যয়ী সূচনার ইঙ্গিত। এ সত্যকেই বারবার, প্রতিনিয়ত তুলে ধরতে চেয়েছেন শিল্পী ফারহানা তাঁর নির্মাণশৈলীতে।
মূলত রেখা ও রঙের সমন্বয়ে শিল্পী নির্মাণ করেছেন তার শিল্পকর্ম। রেখার টানে এবং রঙের সংমি¤্রণে বোধ, বোধি চিন্তা ও অনুভূতির জাল বুনেছেন শিল্পী। বুননের ফাঁকে ফাঁকে রঙের বিস্তার। সেখানে কখনও আলো আছে। কখনও নীলিমার প্রকাশ শ্যামল প্রান্তরের গান। কোথাও আছে নতুন সূর্যের আবাহন। নতুন একটি দিনের প্রত্যয়ী ঘোষণা। শিল্পী এমনি নানামাত্রিক রঙের ব্যবহারের মধ্য দিয়ে তাঁর চেতনার ভিন্ন ভিন্ন প্রকাশ ঘটিয়েছেন। তবে সব নির্মাণের গভীরে রয়েছে অনাকাক্সিক্ষত সময়ের প্রতিচ্ছবি। যেখানে আছে আতঙ্ক আছে মৃত্যু যন্ত্রণা, আছে বিচ্ছেদ বেদনা আছে আত্মপরতা-স্বার্থপরতা, পঙ্কিলতা। আছে সংঘাত ও সংকীর্ণতার এক দ্বান্দ্বিক উপস্থিতি। কিন্তু সবকিছুকে পরাভূত করে মানব জীবনকে একটি গতিশীল ধারায় প্রবাহিত করতে। মূলত মানুষকে তার আপন ঠিকানায় পৌঁছে দিতে তার অবদমিত ভঙ্গুর এবং বিশৃঙ্খলিত ....নাচেতনাকে একটি শৃঙ্খলায় আবদ্ধ করে বার বার অনাবিলভাবে সুন্দরের জয়, আলো ও উজ্জ্বলতার জয় অনাগত স্বপ্ন জয়ের হাতছানি আমাদের মানবচৈতন্যকে দারুণভাবে আশাবাদী করে। ফলে স্বপ্নচারী বিহঙ্গ হয়ে উড়ে যাবার এক প্রত্যয়ী অভিলাষে অভিসিক্ত করে।
ফারহানার বেশকিছু ছবিতে নীলিমায় স্নিগ্ধ এক উজ্জ্বল আকাশের প্রকাশ আমাদের মনকে যেন কোনো এক সমুদ্রের বিশালতার সামনে এনে দাঁড় করায়। সেখানে যে বোধের জন্ম হয় তা আমাদের আশাবাদী করে, স্বপ্নচারী করে এবং মনজুড়ে প্রশান্তি কিংবা একধরনের নির্মলতা দান করে। তখন আত্মবিশ্বাসী মন বলে ওঠে, এ আঁধার একদিন ঠিকই মুছে যাবে। মানুষ ফিরে যাবে তার আপন অস্তিত্ব। খুঁজে পাবে তার নিজস্ব সত্তা।
গ্যালারি ঘুরে ঘুরে চিত্রকর্মগুলো দেখে মনে হয়, কী এক বোধের জানালায় দাঁড়িয়ে দূরের আকাশ দেখছি। প্রান্তরের সবুজকে আলিঙ্গন করছি। এবং এখানেই ফারহানা আফরোজের নির্মাণ এবং শিল্প প্রদর্শনীর সার্থকতা। শিল্পীর ক্যানভাসে তার নির্মাণশৈলীতে এ চেতনা যখন দর্শক মনে তরঙ্গের সৃষ্টি করে, তখনই মনে হয়, “এ পিস অন মেডিটেশন” এর আবর্তে আমরা কেবলই সম্মোহিত। বিমোহিত এবং নিমজ্জিত হচ্ছি অসীম কোনো প্রশান্তির আহ্বানে।
এমনি নির্মাণের সমবায়ে মানুষের চিত্ত চেতনা ও চৈতন্যের এক অনাবিল মুক্তির গানই বলে দেয় ফারহানা আফরোজ বাপ্পীর শিল্পশৈলী আসলে মানবতা-বান্ধব এক আনন্দেরই বহুমাত্রিক প্রকাশ এবং এখানেই তাঁর আয়োজনের স্বার্থকতা।
ফারহানা আফরোজ বাপ্পীর চিত্র প্রদর্শনী
আনিস রহমান
বৃহস্পতিবার, ১৬ অক্টোবর ২০২৫
দূরত্ব দৃশ্যকে আড়াল করে, তখন দৃষ্টির বাইরে চলে যায় দৃশ্য। তার মানে দৃশ্যের অস্তিত্ব শেষ হয়ে যায় না। এটাই বাস্তবতা। সূর্যের আলোয় রাতের আকাশ মিশে যায়। তারারা নির্বাসিত হয় অসীম অনন্ত কোনো লোকে। তার মানে তারার অস্তিত্ব, রাতের আকাশ হারিয়ে যায় না। তারা তার অস্তিত্ব নিয়ে দিব্যি প্রকাশমান। তবে দৃষ্টির আড়ালে কেন? এখানে এক ধরনের সিম্ফনি রয়েছে, তা হলো তারার প্রকাশ তখনই সত্যি হয়, যখন আকাশে অন্ধকার এসে ছায়া ফেলে। তারার ঔজ্জ্বল্যের সংগে অন্ধকারের রিদম রয়েছে। অন্ধকার পেলেই তারা তার আপন সত্তায় বিকশিত হয়। রৌদ্রচ্ছটায় তা সম্ভব হয় না। একইভাবে দূরত্ব কমে গেলে দৃশ্য তখন দৃশ্যমান হয়। কারণ সে আছে। সে আছে তার পরিপূর্ণ অস্তিত্ব নিয়েই। শুধু দূরত্বের জন্যে দৃশ্যের সাময়িক অনুপস্থিতি। দূরত্ব ঘুচলেই সেখানে আবার দৃশ্য বিকাশিত, প্রকাশিত হয় পরিপূর্ণভাবে। এ কথাগুলো প্রাসঙ্গিক ফারহানা আফরোজ বাপ্পীর শিল্পকর্ম প্রসংগে। ফারহানার একক চিত্র প্রদর্শনী শেষ হয় ১৪ অক্টোবর ২০২৫ তারিখে। ০৩ অক্টোবর এ প্রদর্শনীর উদ্বোধন হয়। ঢাকার লালমাটিয়ার দ্বীপ গ্যালারিতে আয়োজন করা হয় এ প্রদর্শনী।
দৃশ্য কিংবা অন্ধকার। অন্ধকার কিংবা তারা। এসবের প্রকাশ কিংবা অস্তিত্বের সংগে রিদম বা ছন্দের কথা এলো এ কারণে যে ফারহানা তার চিত্রকর্মে এক ধরনের ছন্দের অন্বেষণ করেছেন বরাবর।
‘এ পিস অন মেডিটেশন’ নামকরণে এ প্রদশর্নীর মূল সুরই হচ্ছে দিনের পর রাত, মেঘের পর নীলাকাশ কিংবা নদীর ভাঙনের পরেই সেখানে গড়ার পালার মধ্যে যে ছান্দসিক পালাবদল ঘটে। তেমনি করে সময় নির্মিত হয় নানা ঘাত-প্রতিঘাতের মধ্য দিয়ে। নানা চড়াই-উৎরাই পেরিয়ে। সময় এবং পরিবেশকে কেন্দ্র করে মানবজীবনে যে চড়াই-উৎরাই তার জীবনকে প্রভাবিত করে, তার মনোচেতনাকে প্রতিবিম্বিত করে সেই বাস্তবতাকেই মূর্ত করে তুলেছেন ফারহানা তার তুলি আর ক্যানভাস, রঙ ও রেখার সমন্বয়ে।
মূলত প্যানডামিক সময়ের এক বিমূর্ত আলেখ্য, ফারজানার চিত্রকর্ম। স্মরকালের ভয়াবহতম, মানবিক, সামাজিক ও প্রাকৃতিক বিপর্যয় ছিলো করোনার অভিঘাত। সাম্প্রতিক সময়ের এক বিস্ময়কর ও বিভীষিকাময় দুর্যোগ ছিলো করোনা। দীর্ঘসময় ধরে বিরাজমান এ প্যানডামিক সময়ে বৈশ্বিক বিপর্যয়ের অভিঘাত ছিলো অত্যন্ত মর্মান্তিক। আতঙ্কময়, র্নিয়ন্ত্রণহীন সেই মরণব্যাধী শুধুমাত্র আমাদের সামাজিক ক্ষেত্রেই লকডাউন কিংবা স্থবিরতার সৃষ্টি করেনি, মানুষের মনস্তাত্ত্বিক ক্ষেত্রেও নেমে এসেছে এক চরম বন্ধ্যাত্ব ও বিকারহীনতা। বিশ্ব এখন হাতের মুঠোয়। বিশ্ব এখন এক উঠোনের কিছু ঘরবাড়ি। ফলে বৈশ্বিক প্রতিক্রিয়া ও তার অভিঘাত তরঙ্গায়িত হয়ে মুহূর্তে আমাদের মনন ও মানসিকতাকে উদ্বেলিত করছে, উৎকণ্ঠিত করছে। উদ্বেগজনক এক অস্থিরতা আমাদের চেতনাকে খ-িত করছে। এমনি স্থবির সময়ের স্থবির মানুষ, তার মনুষ্যত্ববোধ ও তার মানবিকতার নানা মেরুকরণের উপভাষার অলঙ্করণে ফারহানা এবারে তাঁর প্রদর্শনীকে সাজিয়েছেন।
আসলে প্যানডামিক শুধু মানুষের মধ্যে আতঙ্কই তৈরি করেনি, মৃত্যু চেতনাকেও গভীরভাবে প্রোথিত করেছে মানুষের বোধে, তার চিন্তা-ভাবনা ও আচরণে এবং দৃষ্টিভংগিতে। মানুষে মানুষে বিচ্ছিন্নতাবোধ তৈরি করেছে উদ্বেগজনকভাবে। আপন আর আপন থাকেনি যদি সে হয় করোনাক্রান্ত। ব্রিটিশ সময়ে কালাপার্বন নির্বাসনের মতো এক ধরনের নির্বাসনের সংস্কৃতি চালু হয়েছিলো করোনাসময়ে। আক্রান্ত মানুষ যতোই আপন হোক, তাকে খাবার তুলে দিতেও ছিলো চরম আতঙ্ক। এই আতঙ্কের নেপথ্যে কাজ করেছে আত্মপরতা, স্বার্থপরতা এবং নিজেকে বাঁচিয়ে রাখার এক অদৃশ্য ইচ্ছা ও চেষ্টা। এর ফলে মানবপ্রবৃত্তিতে শুধু নয়, আপনজনেরও চিন্তায়, অনুভবে বোধে ও আবেগে মারাত্মক পরিবর্তন লক্ষ করা যায়—যা শিল্পী মনকেও বিষণœ করে, বিপন্ন করে এবং বোধহীন এক কায়া চারপাশ থেকে আষ্টেপৃষ্ঠে জড়িয়ে রাখে তার সময়কে, চারপাশের পরিবেশকে। চেতনারহিত বিকলাঙ্গ ও জড় এ সময়কে ক্যানভাসে চিত্রায়িত করেছেন শিল্পী তাঁর আপন মহিমায়। এ প্রসংগে শিল্পী ফারহানা আফরোজ বলেন, “করোনার আগের মানুষ আর করোনার পরের মানুষের মধ্যে মননগতভাবে বিস্তর ফারাক তৈরি হয়েছে।” এ প্রসংগে শিল্পীর মনন ও অনুভাবের রেশ টেনে বলা যায়, করোনাকালে প্রতিনিয়ত ক্ষত ও ক্ষরণের তীব্র প্রভাব মানুষের বোধকে বোধশূন্যতার দিকে ঠেলে দিয়েছে। বোধের গভীরে এক মূক আবহের সৃষ্টি করেছে। করোনা পরবর্তী মানুষের মধ্যে আবেগ অনুভূতি মায়া ও সহানুভূতির তীব্র অভাব কাজ করছে। এ প্রসংগে ফারহানা আরও বলেন, “আপনজনের মৃত্যুতেও মানুষ এখন আর সেভাবে কষ্ট পায় না। কোনো যন্ত্রণার দহন তাকে ক্ষত করে না। ফলে আমরা আসলে আবেগহীন একটি সময়ের মধ্যে দিয়ে যাচ্ছি। যা আমাদের মননশীলতা ও সৃষ্টিশীলতার জন্যে খুবই ক্ষতিকর প্রভাব নিয়ে আসছে।”
এমনি এক বিপণœ সময়কে উপজীব্য করেই শিল্পী তাঁর নির্মাণশৈলীকে প্রবাহিত করেছেন। ফলে আপাতদৃষ্টিতে তাঁর ছবিতে এক ধরনের বিষাদময়তার ছায়া থাকলেও তা কখনোই নিবিড় অন্ধকারের দিকে ধাবিত হয়নি। বরং ক্ষণে ক্ষণে তার ছবিতে উজ্জ্বলতা দেখতে পাই। প্রায় প্রতিটি ছবির মধ্যে এক ধরনের উজ্জ্বলতার প্রকাশ আসলে শিল্পীমনের এক আশাবাদী চেতনাকে উৎসারিত করে। যা মানুষের চিরায়ত এবং অজেয় শক্তিকেই নির্দেশ করে। মানুষের ভেতর যে অসীম শক্তি, সামর্থ্য ও দুর্জেয় শক্তির নিহীত রূপ বিরাজমান, শিল্পীর আশাবাদী চেতনার মধ্য দিয়ে শিল্পী সেই সত্যকেই আবার প্রকাশিত করেছেন ভিন্নমাত্রায়, অন্য এক নতুন মাত্রায়।
শিল্পী শুধু আলোর সংকেত দিয়েই এক নতুন সময়কে নির্মাণে প্রয়াসী হয়েছেন তা নয়, তার ছবিতে এক ধরনের তরঙ্গায়িত ছন্দের প্রকাশও আমাদের মোহিত করে। মানুষের চেতনায় যখন ইতিবাচক প্রভাব কাজ করে তখন সেখানে একধরনের তরঙ্গ, ছন্দ বা রিদমের প্রকাশ ঘটে। অর্থাৎ মানুষের চেতনা তার অস্তিত্ব যখন সক্রিয়, যখন সে নির্মাণ আর সৃষ্টিতে সক্ষম, যখন সে পরিবর্তন প্রত্যাশী। এবং পুরনোকে ভেঙে নতুনের আহ্বানে সক্রিয়। চেতনার মধ্যে তারই প্রকাশ দৃপ্তিময়। তখনই বোঝা যায়—এখানে জীবন আছে। আর যেখানে জীবন আছে সেখানে স্বপ্ন আছে। আছে বাঁচার আকাক্সক্ষা এবং নতুন নির্মাণের এক প্রত্যয়ী সূচনার ইঙ্গিত। এ সত্যকেই বারবার, প্রতিনিয়ত তুলে ধরতে চেয়েছেন শিল্পী ফারহানা তাঁর নির্মাণশৈলীতে।
মূলত রেখা ও রঙের সমন্বয়ে শিল্পী নির্মাণ করেছেন তার শিল্পকর্ম। রেখার টানে এবং রঙের সংমি¤্রণে বোধ, বোধি চিন্তা ও অনুভূতির জাল বুনেছেন শিল্পী। বুননের ফাঁকে ফাঁকে রঙের বিস্তার। সেখানে কখনও আলো আছে। কখনও নীলিমার প্রকাশ শ্যামল প্রান্তরের গান। কোথাও আছে নতুন সূর্যের আবাহন। নতুন একটি দিনের প্রত্যয়ী ঘোষণা। শিল্পী এমনি নানামাত্রিক রঙের ব্যবহারের মধ্য দিয়ে তাঁর চেতনার ভিন্ন ভিন্ন প্রকাশ ঘটিয়েছেন। তবে সব নির্মাণের গভীরে রয়েছে অনাকাক্সিক্ষত সময়ের প্রতিচ্ছবি। যেখানে আছে আতঙ্ক আছে মৃত্যু যন্ত্রণা, আছে বিচ্ছেদ বেদনা আছে আত্মপরতা-স্বার্থপরতা, পঙ্কিলতা। আছে সংঘাত ও সংকীর্ণতার এক দ্বান্দ্বিক উপস্থিতি। কিন্তু সবকিছুকে পরাভূত করে মানব জীবনকে একটি গতিশীল ধারায় প্রবাহিত করতে। মূলত মানুষকে তার আপন ঠিকানায় পৌঁছে দিতে তার অবদমিত ভঙ্গুর এবং বিশৃঙ্খলিত ....নাচেতনাকে একটি শৃঙ্খলায় আবদ্ধ করে বার বার অনাবিলভাবে সুন্দরের জয়, আলো ও উজ্জ্বলতার জয় অনাগত স্বপ্ন জয়ের হাতছানি আমাদের মানবচৈতন্যকে দারুণভাবে আশাবাদী করে। ফলে স্বপ্নচারী বিহঙ্গ হয়ে উড়ে যাবার এক প্রত্যয়ী অভিলাষে অভিসিক্ত করে।
ফারহানার বেশকিছু ছবিতে নীলিমায় স্নিগ্ধ এক উজ্জ্বল আকাশের প্রকাশ আমাদের মনকে যেন কোনো এক সমুদ্রের বিশালতার সামনে এনে দাঁড় করায়। সেখানে যে বোধের জন্ম হয় তা আমাদের আশাবাদী করে, স্বপ্নচারী করে এবং মনজুড়ে প্রশান্তি কিংবা একধরনের নির্মলতা দান করে। তখন আত্মবিশ্বাসী মন বলে ওঠে, এ আঁধার একদিন ঠিকই মুছে যাবে। মানুষ ফিরে যাবে তার আপন অস্তিত্ব। খুঁজে পাবে তার নিজস্ব সত্তা।
গ্যালারি ঘুরে ঘুরে চিত্রকর্মগুলো দেখে মনে হয়, কী এক বোধের জানালায় দাঁড়িয়ে দূরের আকাশ দেখছি। প্রান্তরের সবুজকে আলিঙ্গন করছি। এবং এখানেই ফারহানা আফরোজের নির্মাণ এবং শিল্প প্রদর্শনীর সার্থকতা। শিল্পীর ক্যানভাসে তার নির্মাণশৈলীতে এ চেতনা যখন দর্শক মনে তরঙ্গের সৃষ্টি করে, তখনই মনে হয়, “এ পিস অন মেডিটেশন” এর আবর্তে আমরা কেবলই সম্মোহিত। বিমোহিত এবং নিমজ্জিত হচ্ছি অসীম কোনো প্রশান্তির আহ্বানে।
এমনি নির্মাণের সমবায়ে মানুষের চিত্ত চেতনা ও চৈতন্যের এক অনাবিল মুক্তির গানই বলে দেয় ফারহানা আফরোজ বাপ্পীর শিল্পশৈলী আসলে মানবতা-বান্ধব এক আনন্দেরই বহুমাত্রিক প্রকাশ এবং এখানেই তাঁর আয়োজনের স্বার্থকতা।