রাসেল সাইদ
বি.এ. ফেল রবি এখন ঢাকা এসে রিকশা চালায়। দু’-দু’বার পরীক্ষা দিয়েও শেষপর্যন্ত সে বি.এ.-টা পাস করতেই পারল না! অবধারিতভাবে তাই তার লেখাপড়া বন্ধ হয়ে গেল সেখানেই। ছাত্রত্বের পাট চুকিয়ে এরপর প্রায় এক বছর গ্রামের বাড়িতে এটা-সেটা করে, এদিক-সেদিক ঘুরেফিরে, ইয়ার-বন্ধুদের সঙ্গে আড্ডা মেরে- অবশেষে গ্রাম ছেড়ে সোজা ঢাকায় এসে খুঁটি গেড়েছে। বলতে কী, ভাগ্যচক্রে পড়ে তাকে ঢাকায় আসতে হয়েছে। অথচ তার দূর-কল্পনাতেও ছিল না একদিন তাকে ঢাকায় আসতে হবে। রিকশা চালাতে হবে।
রবি আজকাল অবসরে প্রায়ই পুরনো দিনের কথা ভাবে। অনেক নিশ্চিন্ত জীবন ছিল তখন। কত কী ভেবে শেষে একটা দীর্ঘনিশ^াস ছেড়ে মনে মনে নিজেই নিজেকে বলে, আমি এখন এক রিকশা-ড্রাইভার! ফুঃ, ভাগ্যের কী জাদুখেলা!
আপাতত রবির ভাগ্য ভালো-মন্দ যা-ই হোক না কেন, তার বউ জুঁইয়ের ভাগ্য যে ভালো, এ ব্যাপারে সে অনেকটাই নিশ্চিত।
রবি নিজে বি.এ. ফেল করলে কী হবে, জুঁই কিন্তু ইন্টারমিডিডেট পাস। এ বছর, দু’মাস আগে পরীক্ষার রেজাল্ট হয়েছে জুঁইয়ের। আহা, বেচারী বউ! রেজাল্টের দিনেই বাড়ি ছেড়েছুড়ে মেয়েটাকে পালাতে হলো কি না তার সঙ্গে। মনটা রবির একটু খারাপ হয়ে গিয়েছিল এতে। কিন্তু কাজী অফিসে বিয়ে সেরেই ঢাকাগামী লঞ্চে চড়ে জুঁইকে ভীষণ আনন্দিত দেখাচ্ছিল সেদিন। লঞ্চে বসে নব স্বামীর কানের কাছে মুখ নিয়ে ফিসফিস করে জুঁই বলছিল, ‘আমি পরীক্ষার রেজাল্ট আর ম্যারেজ ডে- দুটোই পেলাম একই দিনে। আমার খুবই ভালো লাগছে।’
রবি অবাক চোখে জুঁইয়ের দিকে তাকিয়ে বলেছিল, ‘অ্যাঁ, তোমার ভালো লাগছে, সত্যি!’
জুঁই ঠোঁট টিপে হেসে হেসে মাথা নেড়ে বলল, ‘হু। আমি মিথ্যা কথা কই না।’
তাদের পালানো ছক অবশ্য আগে থেকেই সমস্তটাই ঠিক করা ছিল। দু’জনে মিলে শলাপরামর্শ করে দিনক্ষণ ধার্য করে রেখে ছিল। সব পূর্বপরিকল্পনা মতো ঠিকঠাক। শুধু মাঝখান থেকে ফট করে রেজাল্টের ডেট চলে এল। এবং এল, ঠিক সেদিনটাই ঠিক করে এল! আর কোনো দিন তারিখ পেল না! পালানোর দু’দিন আগে ঘোষিত হলো রেজাল্টের তারিখ। শুনে মনমেজাজ খারাপ হয়ে গেছিল রবির। কিন্তু ততদিনে পরিকল্পনা অনেকদূর এগিয়ে নিয়েছে তারা। পালানোর তারিখ পেছানো কিংবা মত পাল্টানো কোনোটাই আর সম্ভব ছিল না তাদের দু’জনের কাছে।
২
গ্রামের বাড়িতে রবিদের অবস্থা খুব ভালোও নয়, খুব খারাপও নয়; মোটামুটি। তার সব ভাইবোন যে যার মতন ভালোভাবেই সংসারে স্থির আছে। কেবল রবি যেন গন্তব্যহীন এক অস্থির ছায়া। উদ্বিগ্ন তার মা। মায়ের কিছু হলে পিতৃহীন রবির কী হবে- তা-ই তিনি ভাবেন। প্রায়ই তিনি বলতে থাকেন, ‘রবিউল রে, কাজকাম কিছু একটা দেখ বাপ। বিয়েশাদী করবি না? দেশের মানুষ খারাপ কথা কইতাছে তরে আর জুঁইরে লইয়া। আমি কিন্তুক আগেই কইয়া দেই, তুই জুঁইরে বিয়া করতে পারবি না। অত সুন্দর মাইয়া আমারতন একটুও ভাল্লাগে না।’
গ্রামে জুঁইদের অবস্থাও ভালো। বরং রবিদের চেয়ে জুঁইয়েরা বেশি অবস্থাসম্পন্ন। জুঁইয়ের বাবার নিজগ্রামে আলাদা দাপট আছে। গ্রামে তিনি সম্মানী এক লোক। বিচার-সালিশ করে বেড়ান।
সম্প্রতি জুঁইয়ের বাবা মাসুম মিদ্দা তাঁর স্ত্রী এবং কন্যা জুঁইকে একটা জরুরি ঘোষণা দিয়ে ফেলেছেন। এই ঘোষণা অবশ্য তিনি এখন বাড়িতে আসতে যেতে দিয়েই যাচ্ছেন। ঘোষণাটি এরকম- ‘আমার মানসম্মান আর কিছু নাই। দোকানঘরের দিকে গেলে নানা কথা কানে আয়ে। মাইয়ার লেগা আর মুখ দেখান যাইতো না।’
তারপর তিনি থম ধরে দু’দ- বসে থেকে ফের ক্রুদ্ধ স্বরে বলেন, ‘এই এক হপ্তাহের মইধ্যে মাইয়ারে বিয়া দিয়া দিমু। অর লেখাপড়ার গুল্লি মারি। এক হপ্তাহের মইধ্যে যদি অর বিয়া না দিছি, তইলে আমার নাম মাসুম মিদ্দা-ই না। মানুষের হাবিজাবি কথা হুনতে আর পারুম না। অরে লইয়া রাইজ্যের যত্ত কথা...।’
অগত্যা সমস্ত কথা পেছনে ফেলে, চাঁদপুর ছেড়ে, মেঘনা আর ডাকাতিয়া নদী পারের দু’জন মানুষ- রবি-জুঁই সোজা চলে এল ঢাকায়, বুড়িগঙ্গার দক্ষিণ পারে। জায়গাটার নাম কেরানীগঞ্জ।
৩.
ঢাকা মহানগরীতে না চললেও, বুড়িগঙ্গার দক্ষিণ পারের রাস্তায়-রাস্তায় সমানে চলাচল করে ব্যাটারিচালিত রিকশা। এই একটা অটোরিকশা এখন চালায় রবি। তাকে এই ক’দিনে রিকশা চালানোর সমস্ত বন্দোবস্ত করে দিয়েছে তারই বাল্যকালের বন্ধু সামিদ। এরা দু’জনে একই গ্রামের। একসঙ্গে লেখাপড়া করত। সামিদ এস.এস.সি. পরীক্ষায় পাস করেও আর লেখাপড়ার দিকে যায়নি। একসময় ঢাকায় চলে এসেছিল। অনেকদিন ধরে সে এ অঞ্চলে আছে। রিকশা চালায়। রবি ঢাকায় আসার আগে সামিদের সঙ্গে সবকথা ঠিকঠাক করেই এসেছে। বলতে গেলে রবি ঢাকা চলে এসেছে সামিদের ভরসাতেই।
সামিদ তাকে শুধু রিকশার ব্যবস্থা করে দেয়নি, থাকার একটা ব্যবস্থাও করে দিয়েছিল। আগে থেকে মোটামুটি সব ঠিকঠাক করা ছিল। এজন্য রবি তার বন্ধুর প্রতি খুব কৃতজ্ঞ। এই কৃতজ্ঞতার যেন অন্ত নেই। আর-একটি কথাও রবি মনে করে। এ সবকিছু এতটা সহজে হয়েছে জুঁইয়ের ভাগ্যে।
প্রথম চৌদ্দ দিন থাকার জায়গা নিয়ে কিছুটা কষ্ট করলেও, এখন তারা ভালো আছে। আজ তাদের এক রুমের একটা সুন্দর ঘর আছে। ঘরের ভেতরেই বাথরুম। ঘরের এককোণে এক চিলতে বারান্দা। সেখানেই এখন বসে জুঁইয়ের প্রতিদিনের রান্নার আয়োজন।
এর মধ্যে বিকেলে জুঁইয়ের কাছে দুটো দুটো করে চারটি বাচ্চা পড়তে আসে। বাচ্চগুলো এ বাড়ির উপরের তলার দু’জন, পাশের বাড়ির দু’জন। নিচের ক্লাসের পড়া- অ-আ-ক-খ এবং ক্লাস ওয়ান ও টু। জুঁই এজন্য প্রায় চব্বিশশো টাকা পেয়ে যায় ঘরে বসেই। বাচ্চাগুলোর পড়া দেখানোর কাজটা সে নিজেই খুঁজে নিয়েছে বুদ্ধি করে।
এবং গতকাল প্রথম মাসের টিউশনির বেতন হাতে পেয়েছে সে।
৪.
আজ রবি রিকশা নিয়ে বেরুবে না। রিকশা-মালিক, গ্যারেজ- সবই ম্যানেজ করবে সামিদ। কথা এমনই বলা আছে।
রবিকে আজ কাজে যেতে না করেছিল জুঁই। আজকের দিনটাকে নিয়ে তার অন্যরকম একটা প্ল্যান আছে। অবশ্য আজকের দিন তাদের কারোর জন্যই বিশেষ কোনো দিন নয়। অন্যান্য দিনের মতন সাধারণ একটা দিন। তবুও জুঁই চায় আজকের দিনটাকে তারা দু’জনে উপভোগ করুক একটু আলাদা ভাবে। দিনটা আজ দীর্ঘ হোক উচ্ছ্বাসে-উৎফুল্লে-আনন্দে। একটা দিন এমন করে কাটালে কী এমন ক্ষতি? জুঁইয়ের ইচ্ছে, আজ তারা দু’জন মিলে চড়ুইভাতি খেলবে। রবি ক্লান্ত হয়ে বাজার থেকে মাছ-তরকারি নিয়ে আসবে। জুঁই সেগুলো নিয়ে ব্যস্ত হয়ে রান্নাবান্না শুরু করবে। রান্নার একফাঁকে জুঁই এক কাপ চা করে এনে দিবে রবির হাতে। তার নিজেরও মন চাইলে এক কাপ চা হাতে নিতে পারে।
গতকাল রাতে ঘুমানোর আগে বিছানায় শুয়ে শুয়ে রবিকে এটা-সেটা কত কথাই জুঁই বলছিল। একপর্যায়ে আদুরে গলায় বলল, ‘সকালে তাড়াতাড়ি ঘুম থেকে উঠে বাজারে যাবে। একটা বড়ো ইলিশ মাছ কিনবে। এক কেজির মতন হলেই হবে। বড়ো দেখে একটা কচু নিবে। দুপুরে খাব ইলিশ-কচু। আর রাতে ইলিশ ভাজা, সঙ্গে শুকনো মরিচ। ব্যস, কালকে আমাদের চড়–ইভাতি।’
জুঁইয়ের চোখ তখন খুশিতে চকচক করছিল।
রবি আমতা আমতা করে একবার বলল, ‘কী দরকার এত টাকা খরচ করার? এক মাস বাচ্চাগুলোকে পড়িয়ে টাকা ক’টা পেয়েছ। থাক না টাকগুলো তোমার কাছে জমা।’ পরক্ষণেই জুঁইয়ের চোখের দিকে তাকিয়ে সে হঠাৎ থেমে গেল।
জুঁইয়ের জন্যে তার খুব মায়া।
এখন সকাল আটটা। সকালের ঝকঝকে রোদ এসে ঢুকে পড়েছে ঘরে। জুঁইয়ের ছিপছিপে গায়ের ওপরেও পড়েছে সেই রোদ। সদ্য গোসল সেরে আসা জুঁই মাথার ভেজা চুল গামছা দিয়ে মুছতে মুছতে বলল, তাড়া দিয়েই বলল, ‘উঠে নাস্তা করে জলদি বাজারে যাও। নইলে ভালো মাছ-তরকারি কিছু পাবে না। ওঠো, শিগগিরই ওঠো।’
রবি ঘুমচোখে বিছানায় গড়াগড়ি করতে করতে জানালার কাছে দাঁড়ানো জুঁইয়ের দিকে তাকাল।
জানালা দিয়ে রোদ এসে জুঁইয়ের গায়ে পড়েছে। চেহারায় পড়েছে। জুঁইয়ের ফর্সা ত্বকে যেন অপার্থিব আলোর ঝলকানি।
রবি অবাক হয়ে কিছু সময় ওদিকে তাকিয়ে রইল তো রইল-ই।
এই ছোট ঘরটাতে হঠাৎ এত আলো কেন! এত আলো এল কোত্থকে!
রাসেল সাইদ
বৃহস্পতিবার, ১৬ অক্টোবর ২০২৫
বি.এ. ফেল রবি এখন ঢাকা এসে রিকশা চালায়। দু’-দু’বার পরীক্ষা দিয়েও শেষপর্যন্ত সে বি.এ.-টা পাস করতেই পারল না! অবধারিতভাবে তাই তার লেখাপড়া বন্ধ হয়ে গেল সেখানেই। ছাত্রত্বের পাট চুকিয়ে এরপর প্রায় এক বছর গ্রামের বাড়িতে এটা-সেটা করে, এদিক-সেদিক ঘুরেফিরে, ইয়ার-বন্ধুদের সঙ্গে আড্ডা মেরে- অবশেষে গ্রাম ছেড়ে সোজা ঢাকায় এসে খুঁটি গেড়েছে। বলতে কী, ভাগ্যচক্রে পড়ে তাকে ঢাকায় আসতে হয়েছে। অথচ তার দূর-কল্পনাতেও ছিল না একদিন তাকে ঢাকায় আসতে হবে। রিকশা চালাতে হবে।
রবি আজকাল অবসরে প্রায়ই পুরনো দিনের কথা ভাবে। অনেক নিশ্চিন্ত জীবন ছিল তখন। কত কী ভেবে শেষে একটা দীর্ঘনিশ^াস ছেড়ে মনে মনে নিজেই নিজেকে বলে, আমি এখন এক রিকশা-ড্রাইভার! ফুঃ, ভাগ্যের কী জাদুখেলা!
আপাতত রবির ভাগ্য ভালো-মন্দ যা-ই হোক না কেন, তার বউ জুঁইয়ের ভাগ্য যে ভালো, এ ব্যাপারে সে অনেকটাই নিশ্চিত।
রবি নিজে বি.এ. ফেল করলে কী হবে, জুঁই কিন্তু ইন্টারমিডিডেট পাস। এ বছর, দু’মাস আগে পরীক্ষার রেজাল্ট হয়েছে জুঁইয়ের। আহা, বেচারী বউ! রেজাল্টের দিনেই বাড়ি ছেড়েছুড়ে মেয়েটাকে পালাতে হলো কি না তার সঙ্গে। মনটা রবির একটু খারাপ হয়ে গিয়েছিল এতে। কিন্তু কাজী অফিসে বিয়ে সেরেই ঢাকাগামী লঞ্চে চড়ে জুঁইকে ভীষণ আনন্দিত দেখাচ্ছিল সেদিন। লঞ্চে বসে নব স্বামীর কানের কাছে মুখ নিয়ে ফিসফিস করে জুঁই বলছিল, ‘আমি পরীক্ষার রেজাল্ট আর ম্যারেজ ডে- দুটোই পেলাম একই দিনে। আমার খুবই ভালো লাগছে।’
রবি অবাক চোখে জুঁইয়ের দিকে তাকিয়ে বলেছিল, ‘অ্যাঁ, তোমার ভালো লাগছে, সত্যি!’
জুঁই ঠোঁট টিপে হেসে হেসে মাথা নেড়ে বলল, ‘হু। আমি মিথ্যা কথা কই না।’
তাদের পালানো ছক অবশ্য আগে থেকেই সমস্তটাই ঠিক করা ছিল। দু’জনে মিলে শলাপরামর্শ করে দিনক্ষণ ধার্য করে রেখে ছিল। সব পূর্বপরিকল্পনা মতো ঠিকঠাক। শুধু মাঝখান থেকে ফট করে রেজাল্টের ডেট চলে এল। এবং এল, ঠিক সেদিনটাই ঠিক করে এল! আর কোনো দিন তারিখ পেল না! পালানোর দু’দিন আগে ঘোষিত হলো রেজাল্টের তারিখ। শুনে মনমেজাজ খারাপ হয়ে গেছিল রবির। কিন্তু ততদিনে পরিকল্পনা অনেকদূর এগিয়ে নিয়েছে তারা। পালানোর তারিখ পেছানো কিংবা মত পাল্টানো কোনোটাই আর সম্ভব ছিল না তাদের দু’জনের কাছে।
২
গ্রামের বাড়িতে রবিদের অবস্থা খুব ভালোও নয়, খুব খারাপও নয়; মোটামুটি। তার সব ভাইবোন যে যার মতন ভালোভাবেই সংসারে স্থির আছে। কেবল রবি যেন গন্তব্যহীন এক অস্থির ছায়া। উদ্বিগ্ন তার মা। মায়ের কিছু হলে পিতৃহীন রবির কী হবে- তা-ই তিনি ভাবেন। প্রায়ই তিনি বলতে থাকেন, ‘রবিউল রে, কাজকাম কিছু একটা দেখ বাপ। বিয়েশাদী করবি না? দেশের মানুষ খারাপ কথা কইতাছে তরে আর জুঁইরে লইয়া। আমি কিন্তুক আগেই কইয়া দেই, তুই জুঁইরে বিয়া করতে পারবি না। অত সুন্দর মাইয়া আমারতন একটুও ভাল্লাগে না।’
গ্রামে জুঁইদের অবস্থাও ভালো। বরং রবিদের চেয়ে জুঁইয়েরা বেশি অবস্থাসম্পন্ন। জুঁইয়ের বাবার নিজগ্রামে আলাদা দাপট আছে। গ্রামে তিনি সম্মানী এক লোক। বিচার-সালিশ করে বেড়ান।
সম্প্রতি জুঁইয়ের বাবা মাসুম মিদ্দা তাঁর স্ত্রী এবং কন্যা জুঁইকে একটা জরুরি ঘোষণা দিয়ে ফেলেছেন। এই ঘোষণা অবশ্য তিনি এখন বাড়িতে আসতে যেতে দিয়েই যাচ্ছেন। ঘোষণাটি এরকম- ‘আমার মানসম্মান আর কিছু নাই। দোকানঘরের দিকে গেলে নানা কথা কানে আয়ে। মাইয়ার লেগা আর মুখ দেখান যাইতো না।’
তারপর তিনি থম ধরে দু’দ- বসে থেকে ফের ক্রুদ্ধ স্বরে বলেন, ‘এই এক হপ্তাহের মইধ্যে মাইয়ারে বিয়া দিয়া দিমু। অর লেখাপড়ার গুল্লি মারি। এক হপ্তাহের মইধ্যে যদি অর বিয়া না দিছি, তইলে আমার নাম মাসুম মিদ্দা-ই না। মানুষের হাবিজাবি কথা হুনতে আর পারুম না। অরে লইয়া রাইজ্যের যত্ত কথা...।’
অগত্যা সমস্ত কথা পেছনে ফেলে, চাঁদপুর ছেড়ে, মেঘনা আর ডাকাতিয়া নদী পারের দু’জন মানুষ- রবি-জুঁই সোজা চলে এল ঢাকায়, বুড়িগঙ্গার দক্ষিণ পারে। জায়গাটার নাম কেরানীগঞ্জ।
৩.
ঢাকা মহানগরীতে না চললেও, বুড়িগঙ্গার দক্ষিণ পারের রাস্তায়-রাস্তায় সমানে চলাচল করে ব্যাটারিচালিত রিকশা। এই একটা অটোরিকশা এখন চালায় রবি। তাকে এই ক’দিনে রিকশা চালানোর সমস্ত বন্দোবস্ত করে দিয়েছে তারই বাল্যকালের বন্ধু সামিদ। এরা দু’জনে একই গ্রামের। একসঙ্গে লেখাপড়া করত। সামিদ এস.এস.সি. পরীক্ষায় পাস করেও আর লেখাপড়ার দিকে যায়নি। একসময় ঢাকায় চলে এসেছিল। অনেকদিন ধরে সে এ অঞ্চলে আছে। রিকশা চালায়। রবি ঢাকায় আসার আগে সামিদের সঙ্গে সবকথা ঠিকঠাক করেই এসেছে। বলতে গেলে রবি ঢাকা চলে এসেছে সামিদের ভরসাতেই।
সামিদ তাকে শুধু রিকশার ব্যবস্থা করে দেয়নি, থাকার একটা ব্যবস্থাও করে দিয়েছিল। আগে থেকে মোটামুটি সব ঠিকঠাক করা ছিল। এজন্য রবি তার বন্ধুর প্রতি খুব কৃতজ্ঞ। এই কৃতজ্ঞতার যেন অন্ত নেই। আর-একটি কথাও রবি মনে করে। এ সবকিছু এতটা সহজে হয়েছে জুঁইয়ের ভাগ্যে।
প্রথম চৌদ্দ দিন থাকার জায়গা নিয়ে কিছুটা কষ্ট করলেও, এখন তারা ভালো আছে। আজ তাদের এক রুমের একটা সুন্দর ঘর আছে। ঘরের ভেতরেই বাথরুম। ঘরের এককোণে এক চিলতে বারান্দা। সেখানেই এখন বসে জুঁইয়ের প্রতিদিনের রান্নার আয়োজন।
এর মধ্যে বিকেলে জুঁইয়ের কাছে দুটো দুটো করে চারটি বাচ্চা পড়তে আসে। বাচ্চগুলো এ বাড়ির উপরের তলার দু’জন, পাশের বাড়ির দু’জন। নিচের ক্লাসের পড়া- অ-আ-ক-খ এবং ক্লাস ওয়ান ও টু। জুঁই এজন্য প্রায় চব্বিশশো টাকা পেয়ে যায় ঘরে বসেই। বাচ্চাগুলোর পড়া দেখানোর কাজটা সে নিজেই খুঁজে নিয়েছে বুদ্ধি করে।
এবং গতকাল প্রথম মাসের টিউশনির বেতন হাতে পেয়েছে সে।
৪.
আজ রবি রিকশা নিয়ে বেরুবে না। রিকশা-মালিক, গ্যারেজ- সবই ম্যানেজ করবে সামিদ। কথা এমনই বলা আছে।
রবিকে আজ কাজে যেতে না করেছিল জুঁই। আজকের দিনটাকে নিয়ে তার অন্যরকম একটা প্ল্যান আছে। অবশ্য আজকের দিন তাদের কারোর জন্যই বিশেষ কোনো দিন নয়। অন্যান্য দিনের মতন সাধারণ একটা দিন। তবুও জুঁই চায় আজকের দিনটাকে তারা দু’জনে উপভোগ করুক একটু আলাদা ভাবে। দিনটা আজ দীর্ঘ হোক উচ্ছ্বাসে-উৎফুল্লে-আনন্দে। একটা দিন এমন করে কাটালে কী এমন ক্ষতি? জুঁইয়ের ইচ্ছে, আজ তারা দু’জন মিলে চড়ুইভাতি খেলবে। রবি ক্লান্ত হয়ে বাজার থেকে মাছ-তরকারি নিয়ে আসবে। জুঁই সেগুলো নিয়ে ব্যস্ত হয়ে রান্নাবান্না শুরু করবে। রান্নার একফাঁকে জুঁই এক কাপ চা করে এনে দিবে রবির হাতে। তার নিজেরও মন চাইলে এক কাপ চা হাতে নিতে পারে।
গতকাল রাতে ঘুমানোর আগে বিছানায় শুয়ে শুয়ে রবিকে এটা-সেটা কত কথাই জুঁই বলছিল। একপর্যায়ে আদুরে গলায় বলল, ‘সকালে তাড়াতাড়ি ঘুম থেকে উঠে বাজারে যাবে। একটা বড়ো ইলিশ মাছ কিনবে। এক কেজির মতন হলেই হবে। বড়ো দেখে একটা কচু নিবে। দুপুরে খাব ইলিশ-কচু। আর রাতে ইলিশ ভাজা, সঙ্গে শুকনো মরিচ। ব্যস, কালকে আমাদের চড়–ইভাতি।’
জুঁইয়ের চোখ তখন খুশিতে চকচক করছিল।
রবি আমতা আমতা করে একবার বলল, ‘কী দরকার এত টাকা খরচ করার? এক মাস বাচ্চাগুলোকে পড়িয়ে টাকা ক’টা পেয়েছ। থাক না টাকগুলো তোমার কাছে জমা।’ পরক্ষণেই জুঁইয়ের চোখের দিকে তাকিয়ে সে হঠাৎ থেমে গেল।
জুঁইয়ের জন্যে তার খুব মায়া।
এখন সকাল আটটা। সকালের ঝকঝকে রোদ এসে ঢুকে পড়েছে ঘরে। জুঁইয়ের ছিপছিপে গায়ের ওপরেও পড়েছে সেই রোদ। সদ্য গোসল সেরে আসা জুঁই মাথার ভেজা চুল গামছা দিয়ে মুছতে মুছতে বলল, তাড়া দিয়েই বলল, ‘উঠে নাস্তা করে জলদি বাজারে যাও। নইলে ভালো মাছ-তরকারি কিছু পাবে না। ওঠো, শিগগিরই ওঠো।’
রবি ঘুমচোখে বিছানায় গড়াগড়ি করতে করতে জানালার কাছে দাঁড়ানো জুঁইয়ের দিকে তাকাল।
জানালা দিয়ে রোদ এসে জুঁইয়ের গায়ে পড়েছে। চেহারায় পড়েছে। জুঁইয়ের ফর্সা ত্বকে যেন অপার্থিব আলোর ঝলকানি।
রবি অবাক হয়ে কিছু সময় ওদিকে তাকিয়ে রইল তো রইল-ই।
এই ছোট ঘরটাতে হঠাৎ এত আলো কেন! এত আলো এল কোত্থকে!