‘তবুু না ফুরায়’
নবনীতা চক্রবর্তী
মতিয়ার রহমান পাটোয়ারীর ‘তবু না ফুরায়’ উপন্যাসটি বর্তমান সময়ের অভিঘাতে আমাদের মনোজগতের অতলান্তিকে প্রবেশের এক সাহসী প্রয়াস। মানুষের আবেগ-অনুভূতির পরিবর্তনশীলতা, প্রেম ও বিচ্ছেদ, সমাজ ও সংস্কারের দ্বন্দ্ব, আত্মঅনুসন্ধান ও শূন্যতার যাত্রার এই উপন্যাসে প্রতিটি স্তর গভীরভাবে বিশ্লেষিত হয়েছে। উপন্যাসটি কেবল একটি প্রেমের আখ্যান নয়, বরং একটি প্রজন্মের মানসিক ঘূর্ণির দলিল, যাকে পাঠক অনুভব করে নিজের একান্ত অভিজ্ঞতা হিসেবেই।
উপন্যাসের কেন্দ্রে রয়েছে রুমু ও রাহাত নামক দুটি চরিত্র, যারা প্রেমের সম্পর্কে আবদ্ধ হলেও মনোজগতের দ্বন্দ্ব তাদের একত্র হওয়ার পথে অন্তরায় হয়ে দাঁড়ায়। রাহাত প্রেমের স্বাভাবিক উন্মাদনায়, প্রেমিকাকে একটু কাছে পাওয়া, তার পবিত্র স্পর্শ পাওয়ার এক চিরন্তন প্রত্যাশী। অপরদিকে রুমু প্রতিনিধিত্ব করে চিরকালীন বাংলার মধ্যবিত্ত সমাজের। যার কাছে ভালোবাসা মানে আবেগ, বিশ্বাস, সমাজ, স্বীকৃতি এবং ধর্ম। নিটোল ভাবে প্রেমকে অনুভব করার নির্মলতা সেখানে মুখ্য। যেখানে নারীর চিন্তা জুড়ে থাকে, পুরুষকে মন দেওয়া যায়, ভালোবাসা যায়, সতত তার চিন্তায় মগ্ন থাকা যায় কিন্তু ভালোবাসার পুরুষকে ভালোবাসার স্পর্শের কথা ভাববার স্পর্ধা করা যায় না। স্বাভাবিকভাবেই তার মুখ দিয়ে নির্গত হয় ‘তুমি একটা অমানুষ’!
এই বাক্যটি যেন গোটা উপন্যাসের একটি মোক্ষম বাঁক। এই একটি সংলাপ সমাজ, সংস্কার ও ব্যক্তিগত চাহিদার দ্বন্দকে যেন একত্র করে। রাহাত বুঝতে চেষ্টা করে, তার ভালোবাসার অনুভব কি অশুদ্ধ ছিল? সে বারবার আত্মজিজ্ঞাসায় ফিরে যায়, সমাজের মূল্যবোধ আর বাস্তব জীবনের ভালোবাসার মেলবন্ধনের জায়গা কোথায়? পাঠককেও এই প্রশ্নের মুখোমুখি করে তোলে উপন্যাসটি।
ভুল বোঝাবুঝি, সামাজিক টানাপোড়েন, পারিবারিক বাধা এবং অন্তর্জগতে তীব্র দ্বন্দ্বের মধ্য দিয়ে রাহাত ও রুমুর সম্পর্ক ভেঙে পড়ে। রাহাত একসময় রুমুকে হারায়, এবং সেই ক্ষতি তাকে আত্মভিত্তির সংকটে ফেলে দেয়। উপন্যাসের শক্তিশালী দিক হলো, লেখক রাহাতের মানসিক ভাঙনকে কোনো নাটকীয়তায় নয়, বরং একেবারে স্বাভাবিক জীবনঘনিষ্ঠ ভাষায় উপস্থাপন করেছেন। তাই রাহাত আমাদের চেনা এক চরিত্র হয়ে ওঠে- হয়তো আমাদের আত্মপরিচয়েরই প্রতিচ্ছবি।
রাহাতের জীবনে একের পর এক বিপর্যয়, বিশেষত রুমুর মৃত্যু, এক ধরনের শূন্যতার বোধ তৈরি করে, যা আমাদের ভাবায়- ভালোবাসা কি কেবল প্রাপ্তির মধ্যেই সীমাবদ্ধ, না কি বেদনাও তার একটি রূপ? রাহাতের নিঃসঙ্গতা ও আত্মসংযমের প্রয়াস পাঠককে তার মানসিক পুনর্গঠনের প্রক্রিয়ার সঙ্গে একাত্ম করে তোলে।
ভাষাশৈলীতে লেখক মতিয়ার রহমান পাটোয়ারী ব্যবহার করেছেন সহজ-সরল অথচ গভীর অনুভবসম্পন্ন শব্দচয়ন। চরিত্র নির্মাণে যতœশীলতা, মনোজাগতিক বিশ্লেষণে তীক্ষœতা, আর সামাজিক বাস্তবতার নির্ভুল প্রতিফলন উপন্যাসটিকে নিছক প্রেমকাহিনি থেকে আর এক স্তরে উন্নীত করেছে। সময়ের প্রেক্ষাপটে প্রজন্মের মানসিক পরিবর্তন, সামাজিক রক্ষণশীলতার চাপ ও ব্যক্তিস্বান্ত্র্যের লড়াই সব মিলিয়ে এটি এক প্রাসঙ্গিক সাহিত্যকর্ম।
উপন্যাসের নাম ‘তবু না ফুরায়’ নিজেই যেন একটি কবিতা। স্মৃতি, বেদনা ও ভালোবাসা সব কিছু হারিয়েও যেন কিছু রয়ে যায়, যা কখনো ফুরায় না। পাঠ শেষে একটি দীর্ঘশ্বাসের মতো অনুভব থাকে, থেকে যায় কিছু অমীমাংসিত প্রশ্ন যা পাঠককে চিন্তার রাজ্যে স্থায়ীভাবে গ্রন্থিত করে। একটি হৃদয়গ নিঙড়ানো ও ভাবনাসঞ্চারী মনোজাগতিক কাহিনি, যা পাঠককে আবেগ, বেদনা ও আত্মজিজ্ঞাসার এক ভিন্ন ভুবনে নিয়ে যায়। যা শুধু পড়ার নয়, উপলব্ধির-অনুভূতির এক গভীর রেখাপাত।
উপন্যাসটি প্রকাশ করেছে বাংলাপ্রকাশ। প্রচ্ছদ করেছেন ধ্রুব এষ। মূল্য: ৩০০.০০
‘তবুু না ফুরায়’
নবনীতা চক্রবর্তী
বৃহস্পতিবার, ১৬ অক্টোবর ২০২৫
মতিয়ার রহমান পাটোয়ারীর ‘তবু না ফুরায়’ উপন্যাসটি বর্তমান সময়ের অভিঘাতে আমাদের মনোজগতের অতলান্তিকে প্রবেশের এক সাহসী প্রয়াস। মানুষের আবেগ-অনুভূতির পরিবর্তনশীলতা, প্রেম ও বিচ্ছেদ, সমাজ ও সংস্কারের দ্বন্দ্ব, আত্মঅনুসন্ধান ও শূন্যতার যাত্রার এই উপন্যাসে প্রতিটি স্তর গভীরভাবে বিশ্লেষিত হয়েছে। উপন্যাসটি কেবল একটি প্রেমের আখ্যান নয়, বরং একটি প্রজন্মের মানসিক ঘূর্ণির দলিল, যাকে পাঠক অনুভব করে নিজের একান্ত অভিজ্ঞতা হিসেবেই।
উপন্যাসের কেন্দ্রে রয়েছে রুমু ও রাহাত নামক দুটি চরিত্র, যারা প্রেমের সম্পর্কে আবদ্ধ হলেও মনোজগতের দ্বন্দ্ব তাদের একত্র হওয়ার পথে অন্তরায় হয়ে দাঁড়ায়। রাহাত প্রেমের স্বাভাবিক উন্মাদনায়, প্রেমিকাকে একটু কাছে পাওয়া, তার পবিত্র স্পর্শ পাওয়ার এক চিরন্তন প্রত্যাশী। অপরদিকে রুমু প্রতিনিধিত্ব করে চিরকালীন বাংলার মধ্যবিত্ত সমাজের। যার কাছে ভালোবাসা মানে আবেগ, বিশ্বাস, সমাজ, স্বীকৃতি এবং ধর্ম। নিটোল ভাবে প্রেমকে অনুভব করার নির্মলতা সেখানে মুখ্য। যেখানে নারীর চিন্তা জুড়ে থাকে, পুরুষকে মন দেওয়া যায়, ভালোবাসা যায়, সতত তার চিন্তায় মগ্ন থাকা যায় কিন্তু ভালোবাসার পুরুষকে ভালোবাসার স্পর্শের কথা ভাববার স্পর্ধা করা যায় না। স্বাভাবিকভাবেই তার মুখ দিয়ে নির্গত হয় ‘তুমি একটা অমানুষ’!
এই বাক্যটি যেন গোটা উপন্যাসের একটি মোক্ষম বাঁক। এই একটি সংলাপ সমাজ, সংস্কার ও ব্যক্তিগত চাহিদার দ্বন্দকে যেন একত্র করে। রাহাত বুঝতে চেষ্টা করে, তার ভালোবাসার অনুভব কি অশুদ্ধ ছিল? সে বারবার আত্মজিজ্ঞাসায় ফিরে যায়, সমাজের মূল্যবোধ আর বাস্তব জীবনের ভালোবাসার মেলবন্ধনের জায়গা কোথায়? পাঠককেও এই প্রশ্নের মুখোমুখি করে তোলে উপন্যাসটি।
ভুল বোঝাবুঝি, সামাজিক টানাপোড়েন, পারিবারিক বাধা এবং অন্তর্জগতে তীব্র দ্বন্দ্বের মধ্য দিয়ে রাহাত ও রুমুর সম্পর্ক ভেঙে পড়ে। রাহাত একসময় রুমুকে হারায়, এবং সেই ক্ষতি তাকে আত্মভিত্তির সংকটে ফেলে দেয়। উপন্যাসের শক্তিশালী দিক হলো, লেখক রাহাতের মানসিক ভাঙনকে কোনো নাটকীয়তায় নয়, বরং একেবারে স্বাভাবিক জীবনঘনিষ্ঠ ভাষায় উপস্থাপন করেছেন। তাই রাহাত আমাদের চেনা এক চরিত্র হয়ে ওঠে- হয়তো আমাদের আত্মপরিচয়েরই প্রতিচ্ছবি।
রাহাতের জীবনে একের পর এক বিপর্যয়, বিশেষত রুমুর মৃত্যু, এক ধরনের শূন্যতার বোধ তৈরি করে, যা আমাদের ভাবায়- ভালোবাসা কি কেবল প্রাপ্তির মধ্যেই সীমাবদ্ধ, না কি বেদনাও তার একটি রূপ? রাহাতের নিঃসঙ্গতা ও আত্মসংযমের প্রয়াস পাঠককে তার মানসিক পুনর্গঠনের প্রক্রিয়ার সঙ্গে একাত্ম করে তোলে।
ভাষাশৈলীতে লেখক মতিয়ার রহমান পাটোয়ারী ব্যবহার করেছেন সহজ-সরল অথচ গভীর অনুভবসম্পন্ন শব্দচয়ন। চরিত্র নির্মাণে যতœশীলতা, মনোজাগতিক বিশ্লেষণে তীক্ষœতা, আর সামাজিক বাস্তবতার নির্ভুল প্রতিফলন উপন্যাসটিকে নিছক প্রেমকাহিনি থেকে আর এক স্তরে উন্নীত করেছে। সময়ের প্রেক্ষাপটে প্রজন্মের মানসিক পরিবর্তন, সামাজিক রক্ষণশীলতার চাপ ও ব্যক্তিস্বান্ত্র্যের লড়াই সব মিলিয়ে এটি এক প্রাসঙ্গিক সাহিত্যকর্ম।
উপন্যাসের নাম ‘তবু না ফুরায়’ নিজেই যেন একটি কবিতা। স্মৃতি, বেদনা ও ভালোবাসা সব কিছু হারিয়েও যেন কিছু রয়ে যায়, যা কখনো ফুরায় না। পাঠ শেষে একটি দীর্ঘশ্বাসের মতো অনুভব থাকে, থেকে যায় কিছু অমীমাংসিত প্রশ্ন যা পাঠককে চিন্তার রাজ্যে স্থায়ীভাবে গ্রন্থিত করে। একটি হৃদয়গ নিঙড়ানো ও ভাবনাসঞ্চারী মনোজাগতিক কাহিনি, যা পাঠককে আবেগ, বেদনা ও আত্মজিজ্ঞাসার এক ভিন্ন ভুবনে নিয়ে যায়। যা শুধু পড়ার নয়, উপলব্ধির-অনুভূতির এক গভীর রেখাপাত।
উপন্যাসটি প্রকাশ করেছে বাংলাপ্রকাশ। প্রচ্ছদ করেছেন ধ্রুব এষ। মূল্য: ৩০০.০০