alt

জন্মদিনের শ্রদ্ধাঞ্জলি

বহুমাত্রিক শামসুর রাহমান

নাসির আহমেদ

: বৃহস্পতিবার, ২৩ অক্টোবর ২০২৫

বাংলা ভাষার কবিদের মধ্যে মাইকেল, রবীন্দ্রনাথ, নজরুল, সুকান্ত এবং জীবনানন্দ দাশের পরে এমন কবি খুব কমই এসেছেন যাঁদের কৃতি কিংবা অবদানের কথা গণমাধ্যম এবং পাঠকসমাজ স্বতঃস্ফূর্তভাবে স্মরণ করে। বিশেষ করে জন্ম-মৃত্যু বার্ষিকীতে সশ্রদ্ধ স্মরণের আলোয় যাঁদের উদ্ভাসিত করা হয়, সে সংখ্যা একেবারে হাতেগনা। জীবনানন্দ দাশের পরে শামসুর রাহমানই সম্ভবত সেই কবি যাঁকে তাঁর কোনও ভক্ত কিংবা স্বজনের প্রয়াস ছাড়াই স্বতঃস্ফূর্তভাবে স্মরণ করা হয়। সংবাদ সাময়িকীর সম্পাদক কবি ওবায়েদ আকাশ যখন শামসুর রাহমানের জন্মবার্ষিকী উপলক্ষে একটি লেখা চাইলেন, তখনই মনে এলো মরণোত্তর কবিস্মরণ বিষয়ক এই কথাগুলো।

মৃত্যু এমনই এক নির্মম বাস্তবতা- যা অনেক উজ্জ্বল কিছুও ধূসর ম্লান করে দেয়। এমনকি এক সময় বিস্মরণের অন্ধকারেও নিয়ে যায়। এটা কবি শামসুর রাহমানের পূর্ববর্তী পরবর্তী অনেকের ক্ষেত্রেই দেখেছি। কেউ কেউ শুধু বেঁচে থাকেন সাহিত্য গবেষকদের গবেষণায় কিন্তু গণমানুষের মনোজগতে নয়। কেন থাকেন আর কেন থাকেন না- এই প্রশ্নের মধ্যেই খুঁজে পাবো বহুমাত্রিক কবি শামসুর রাহমানের বিশেষত্ব।

কবি সাহিত্যিকদের অনেকেই অতিক্রান্ত শৈশব কিংবা কৈশোরেই সাহিত্যচর্চা শুরু করেন।শামসুর রাহমান পরিণত বয়সে অর্থাৎ যৌবনে কবিতার চর্চা শুরু করেছিলেন। প্রথম কাব্যগ্রন্থ “প্রথম গান দ্বিতীয় মৃত্যুর আগে” বেরিয়েছিল ৩১ বছর বয়সে। প্রথম কাব্যগ্রন্থ প্রকাশের আগেই সচেতন পাঠকসমাজের দৃষ্টি আকর্ষণ করতে সক্ষম হয়েছিলেন কবি শামসুর রাহমান। বিশেষ করে বুদ্ধদেব বসু সম্পাদিত কবিতা পত্রিকায় “রূপালি স্নান” কবিতাটি প্রকাশিত হবার পর কবি সাহিত্যিক মহলে ব্যাপক পরিচিতি অর্জন করেন তরুণ কবি শামসুর রাহমান। এর কারণ ওই কবিতায় এমন কিছু ছিল, যা বক্তব্যের দিক থেকে যেমন, তেমনি ভাষা এবং আঙ্গিকের দিক থেকেও পূর্ববঙ্গের কবিতার জন্য ছিল নতুন। বেঁচে থাকার জন্য অন্নবস্ত্র আশ্রয়ের মতো জীবনের দৈনন্দিন চাহিদার সঙ্গে সঙ্গে নান্দনিক ক্ষুধাতৃষ্ণা মেটানোর আকাক্সক্ষার কথাও ব্যক্ত করেছিলেন কবি ছয় মাত্রার মাত্রাবৃত্ত ছন্দে লেখা রূপালি স্নান কবিতায়। রুপালি স্নান-এ এমনই পরিপক্ক এক কবির আবির্ভাব সে যুগের সচেতন পাঠক লক্ষ্য করেছিলেন, যা শামসুর রাহমানের জন্য ছিল বিরল মর্যাদার। বই প্রকাশের আগেই যা তৈরি করে রেখেছিল এক সম্মানের আসন।

শামসুর রাহমানের প্রথম তিনটি কাব্যগ্রন্থে (প্রথম গান দ্বিতীয় মৃত্যুর আগে, ১৯৬০, রৌদ্র করোটিতে, ১৯৬৩, বিধ্বস্ত নীলিমা ১৯৬৭) এমন এক জগতের মুখোমুখি হই আমরা যে জগত নান্দনিকতার, প্রবল রোমান্টিকতার সঙ্গে দার্শনিক উপলব্ধির। প্রতীক, চিত্রকল্পে বাঙময় হয়ে উঠেছিল সেই নান্দনিক কবিতার ভুবন। কিন্তু শামসুর রাহমান নিরালোকের দিব্যরথ (১৯৬৮) এবং ১৯৭০ সালে প্রকাশিত নিজ বাসভূমে কাব্যগ্রন্থের মধ্য দিয়ে সমাজ রাজনীতির প্রতি ক্রমাগত অগ্রসরমানতার চিহ্ন খচিত করতে সক্ষম হন। বিশেষ করে ভিয়েতনাম যুদ্ধ, বাংলাদেশে ১৯৬৬ পরবর্তীকালের প্রতিটি গণআন্দোলন তাঁকে প্রবলভাবে স্পর্শ করে। “সফেদ পাঞ্জাবি”, “আসাদের শার্ট”-এর মতো কবিতাগুলো ৬৮-৬৯-এর গনগনে রাজনৈতিক উত্তাপে ঋদ্ধ। এরপর বন্দী শিবির থেকে (১৯৭২)দুঃসময়ে মুখোমুখি (১৯৭৩) ফিরিয়ে নাও ঘাতক কাঁটা (১৯৭৪)আমি অনাহারী ইত্যাদি কাব্যগ্রন্থের মধ্যদিয়ে ক্রমাগত বিপুল জনসম্পৃক্ততায়উদ্ভাসিত হতে থাকেন শামসুর রাহমান। “এ লাশ আমরা রাখবো কোথায়” শিরোনামের কবিতায় নিহত বঙ্গবন্ধুকে যেভাবে চিত্রিত করেছেন তা ওই প্রতিকূল সময়ের সাহসের ব্যাপার বটে। টেলেমেকাস শিরোনামের কবিতাটিও সম্ভবত ওই কাছাকাছি সময়েরই।

১৯৮২ সালে জেনারেল এরশাদের সামরিক শাসন জারির পর শামসুর রাহমান বাংলাদেশে মৌলবাদের উত্থান এবং সামরিক শাসনের ছত্রছায়ায় লুটপাটের অর্থনীতির ভয়াবহ ব্যাপ্তি দেখে যেন আঁতকে ওঠেন। ১৯৮৩ সালে প্রকাশ হয় তাঁর ‘উদ্ভট উটের পিঠে চলেছে স্বদেশ’। সাড়া ফেলে দেয় এই কাব্যগ্রন্থ। এরপরের ইতিহাস আমাদের সকলেরই জানা। “বুক তার বাংলাদেশের হৃদয়” শিরোনামের কবিতায় গণতন্ত্রের জন্য বুক পেতে বুলেট গ্রহণকারী শহীদ নূর হোসেনের জন্য যে গভীর ভালোবাসা প্রকাশ করেছেন কবি, তা মর্মস্পর্শী। ওই শিরোনামে একটি কাব্যগ্রন্থই প্রকাশ করেছেন।

১৯৭১ সালে অবরুদ্ধ বাংলাদেশের পাড়াতলী গ্রামে বসে শামসুর রাহমান লিখেছিলেন তাঁর বন্দী শিবির থেকে কাব্যগ্রন্থের কবিতাগুলো। স্বনামেই কলকাতায় মুক্তিযোদ্ধাদের হাত দিয়ে পাঠিয়েছিলেন কবিতা। ‘স্বাধীনতা তুমি’ এবং ‘তোমাকে পাওয়ার জন্য হে স্বাধীনতা’ কবিতা দুটি দেশ পত্রিকা প্রকাশ করে মজলুম আদিব এই ছদ্মনামে। কবির এই ছদ্মনাম দিয়েছিলেন প্রখ্যাত সাহিত্যিক রবীন্দ্র গবেষক আবু সয়ীদ আইয়ুব। বিশ শতকের ৮০ এবং ৯০-এর দশকে শামসুর রাহমান এমন আরো অনেক কবিতা লিখেছিলেন, যা সমকালীন হয়েও চিরকালীনতাকে স্পর্শ করেছিল।

এ কথা ঠিক শামসুর রাহমান প্রধানত romantic এবং নন্দনতাত্ত্বিক দর্শনে বিশ্বাসী কবি হিসেবেই যাত্রা শুরু করেছিলেন। কিন্তু সময়ের অঙ্গীকার পাল্টে দিয়েছিল সেই চেতনা। আত্মমুখী নান্দনিক বোধে নিমজ্জিত কবিই একসময় এমন বহির্মুখী হলেন যে, তিনি জনগণের কবি হয়ে উঠলেন এবং একইসঙ্গে আন্তর্জাতিকও।

বাংলাদেশে শামসুর রাহমানই বোধহয়, সেই কবি যিনি জীবদ্দশায় সবচেয়ে বেশি সামাজিক মর্যাদা লাভ করেছিলেন। তিনি সেই কবি এদেশে প্রথম যাঁর জন্মদিন (৫০ বছর) বিশাল আয়োজনে নাগরিক সংবর্ধনার মাধ্যমে আনুষ্ঠানিকভাবে উদযাপিত হয়েছিল। কবি সম্পর্কিত বহুকালের প্রচলিত দরিদ্র অবহেলিত নেতিবাচক ধারণাটাই বদলে দিয়েছিলেন শামসুর রাহমান। সবকিছু মিলিয়ে শামসুর রাহমান জীবদ্দশায় এমন সেলিব্রেটি হয়েছিলেন যে মৃত্যুর পরেও তাঁর সেই আলো এখনো বিচ্ছুরিত হচ্ছে।

কবিতার পাশাপাশি আরে নানা ধরনের লেখা লিখেছেন শামসুর রহমান। প্রায় ৭০টির মতো কাব্যগ্রন্থের গৌরবের আলোয় অনেকখানি আড়াল হয়ে গেছে তাঁর অন্যান্য রচনা।

“স্মৃতির শহর ঢাকা”র মতো স্মৃতিকথামূলক বই খুব কমই লেখা হয়েছে। তাঁর আত্মজৈবনিক স্মৃতিচারণমূলক গ্রন্থ “কালের ধুলোয় লেখা” শুধু তাঁর জীবনের স্মৃতি নয়, আমাদের সমাজ সাহিত্য আর সংস্কৃতি অঙ্গনের সময়ের দলিল হিসেবেও স্মরণীয় হয়ে থাকবে। এই আত্মজৈবনিক স্মৃতিচারণ গ্রন্থটির লেখাগুলোর দ্বিতীয় পাঠক হওয়ার সৌভাগ্য হয়েছিল আমার। আমি নিজেই কবির শ্যামলীর বাসভবন থেকে সংগ্রহ করে আনতাম এবং দৈনিক জনকণ্ঠের সাময়িকী পাতায় প্রতি সপ্তাহে প্রকাশ করতাম। এ প্রসঙ্গে কত স্মৃতি মনের কোণে জমা হয়ে আছে, থাক তা আমার ব্যক্তিগত।

শামসুর রাহমান তাঁর পূর্ববর্তী এবং সমসময়ের অনেকের ওপর স্মৃতিচারণমূলক এবং মূল্যায়নধর্মী লেখা লিখেছিলেন বিভিন্ন পত্রপত্রিকায়। এসব লেখার সংকলন “অন্যের মানসে বসবাস” একটি অসাধারণ সুন্দর বই- যেখানে বাংলাদেশের সাহিত্য সংস্কৃতি অঙ্গনের কিংবদন্তিতুল্য ব্যক্তিদের সম্পর্কে এমন অনেক কিছু জানা যাবে, যা আমরা অনেকেই জানতাম না।

শামসুর রাহমান বেশ কয়েকটি উপন্যাস এবং ছোটগল্পও লিখেছেন, যা গ্রন্থাকারে প্রকাশিত হয়েছে। উপন্যাস- অক্টোপাস, অদ্ভুত আঁধার এক,নিয়ত মন্তাজ ইত্যাদি। অনুবাদ করেছেন বিশ্ববিখ্যাত কবি রবার্ট ফ্রস্টের অনেক কবিতা- যা‘রবার্ট ফ্রস্টের কবিতা শিরোনামে’ বহু বছর আগে বই বেরিয়েছে। অনুবাদ করেছেন খাজা ফরিদের কবিতাও। সেই কবিতাও গ্রন্থাকারে প্রকাশিত হয়েছে।

‘মৈনাকের দিনলিপি’ শিরোনামে দীর্ঘদিন কলাম লিখেছেন দৈনিক পাকিস্তান এবং মুক্তিযুদ্ধ পরবর্তী দৈনিক বাংলায়। সেসব কলাম বুদ্ধিদীপ্ত এক সৃজনশীল কবির অসামান্য পর্যবেক্ষণের উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত। এছাড়া অনেক প্রবন্ধ লিখেছেন শামসুর রাহমান। “আমৃত্যু তাঁর জীবনানন্দ” শিরোনামের প্রবন্ধ গ্রন্থটি এক রতœ ভা-ার বললে অতিশয়োক্তি হবে না। পূর্ববর্তী কালের কবি-সাহিত্যিকদের এমন মূল্যায়নধর্মী অনেক প্রবন্ধ আছে- যা সাহিত্য মূল্যায়নের ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ বিবেচিত হতে পারে। আবার বিতর্কিত প্রবন্ধ আছে যেমন পূর্ব বাংলার সাম্প্রতিক কবিতা শিরোনামের একটি প্রবন্ধ। যা প্রকাশের পর তাঁর সমসময়ের এবং পূর্ববর্তী অনেকে একমত হতে পারেননি। বুদ্ধদেব বসুর সঙ্গে সাক্ষাৎ এবং তাঁর ‘কবিতা’ পত্রিকা সম্পর্কিত একটি চমৎকার লেখা ওই প্রবন্ধ গ্রন্থে সংকলিত রয়েছে। দৈনিক বাংলায় তাঁর দীর্ঘদিনের সহকর্মী সালেহ চৌধুরীর সম্পাদনায় সময় প্রকাশনী থেকে ২০০৪ সালে সেরা ‘শামসুর রাহমান’ নামে একটি সংকলন গ্রন্থ বেরিয়েছিল- যেখানে শামসুর রাহমানের সব ধরনের রচনা থেকে বাছাই করা লেখা সংকলিত হয়েছে। পড়েছিলাম একান্ত ভাবনা শিরোনামে শামসুর রাহমানের বেশ কিছু গদ্য রচনা। শিরোনামগুলি শুনলেই পাঠক বুঝতে পারবেন লেখার ধরন লিবারেলিজমের ফাঁকফোকর, আত্মজীবনী লেখার সাহস স্মৃতির রতœ ভা-ার গালিবের কাব্য মৃত মধুসূদনের সমাধি, পাবলো নেরুদা, তাঁর মনোজ সওগাত, প্রচলকাব্যরীতির বদল ইত্যাদি ভিন্ন স্বাদের গদ্য। তার একটি প্রবন্ধ “আমাদের সমাজ এবং লেখকের স্বাধীনতা” কত আগে লেখা, অথচ এখনো প্রাসঙ্গিক! আরো একটি লেখার কথায় মুহূর্তে মনে পড়ে সেটি শিরোনাম শুধু দাম বারেমে লেখা।

কবিতা বিষয়ের শামসুর রহমানের অনেকগুলো গদ্য রচনা রয়েছে বিভিন্ন জায়গায়। যেমন একটি লেখার শিরোনাম “প্রেম এবং কবিতা”। পড়ে মুগ্ধ হয়েছি। প্রেম সম্পর্কে কবিতা নিজের ধারণার কথা বলতে গিয়ে তাঁর রোমান্টিক মনোজগতের যেমন পরিচয় দিয়েছেন, এমনি বৈষ্ণব কবিদের কবিতাও উদ্ধৃত করে প্রেমের গভীরতা প্রকাশ করেছেন। কলাম টাইপের লেখা সম্ভবত কলাম হিসেবে লিখেছিলেন। শুরুটা এক শীত সকালে শয্যার বর্ণনা দিয়ে। “আমি ভালোবাসি”, এই দুটি শব্দ মনে রেখে উচ্চারণ করে যে আনন্দ লাভ করছি শীত-সকালের এই মুহূর্তে, তার তুলনা নেই। হ্যাঁ, আমি ভালোবাসি। বালিশে ঠোঁট চেপে ‘আমি ভালোবাসি’ শব্দদ্বয় বারবার আবৃত্তি করতে খুব ভালো লাগছে আমার।

জেনেছি কাকে চাই, কে এলে চোখে ফোটে/নিমেষে শরতের খুশির জ্যোতিকণা।

কাকে চাই, জানি। এ-ও জানি, এ মুহূর্তে সে আসবে না এখানে। ইচ্ছে করলেও আসতে পারে না। সে বসবে না আমার পাশে।...

ব্যক্তিগত প্রেম, প্রেমিকা প্রসঙ্গে লিখতে লিখতে কবি যখন লেখেন বৈষ্ণব পদক কর্তাদের প্রেমানুভূতির কথা তখন আমরা মুগ্ধ হই। লিখেছেন : প্রেম যার মনের কপাটে এসে কখনো কড়া নাড়েনি তার পক্ষে আর যা-ই হোক, প্রেমের কবিতা লেখা সম্ভব হবে না। তিনি যদি লেখেনও তবে সেটি হবে খুবই কৃত্রিম, বানানো রচনা। যিনি প্রেমে পড়েছেন তিনিই লিখতে পারেন হীরকখ-তুল্য এই পঙক্তি চতুষ্টয়- “জনম অবধি হাম রূপ নেহারিলু /নয়ন না তিরপিত ভেল/ লাখ লাখ যুগ হিয়ে হিয়ে রাখলু, / তবু হিয়া জুড়ন না গেল।”

বৈষ্ণব পদকর্তাগণ অনেক সময় রাধা-কৃষ্ণের প্রেমকথার আবরণে নিজেদের মনের কথাই উচ্চারণ করেছেন এবং সেসব উচ্চারিত বাণী যুগ যুগ ধরে অম্লান হয়ে রয়েছে মানুষের স্মৃতিতে।”

এ প্রসঙ্গে উল্লেখ করতেই হয় রাজনৈতিক কবিতার জন্ম জনমানসে শামসুর রাহমান বিপুলভাবে নন্দিত হয়েছেন বটে, কিন্তু তাঁর প্রেমের কবিতার পাঠকও কম নয়। প্রেমের কবিতায় তিনি এতটাই ইমোশনাল যে, ষাটোত্তীর্ণ বয়সেও যেসব প্রেমের কবিতা লিখেছেন, মনে হয় যেন ২২ বছরের যুবক তার প্রিয় মানুষ উপস্থিত প্রকাশ করছেন।

প্রেমের কবিতায়ও শামসুর রাহমান সব সময়ই উদ্দীপ্ত জীবন্ত। জীবদ্দশায় প্রকাশিত সেরা শামসুর রাহমান গ্রন্থে কবি একটি ব্যক্তিগত প্রেমপত্র প্রকাশের সাহস দেখিয়েছেন, যা বিস্মিত করবে মুগ্ধ করবে যেকোনো পাঠককে। ওই প্রেমপত্রটি এমনই আবেগ বিহবল ভাষায় লেখা, যা একজন তরুণের পক্ষেই লেখা সম্ভব, প্রবীণের পক্ষে প্রায় অসম্ভব। কর্মসূত্রে শামসুর রাহমানকে খুব কাছে থেকে দেখার সুযোগ হয়েছে বহু বছর। সত্যিকার অর্থেই সুকবির পাশাপাশি তিনি একজন অত্যন্ত সুদর্শন, আমৃত্যু প্রেমিক ছিলেন।

কিন্তু তাঁর এই প্রেমিক সত্তা তাঁর কবিসত্তাকে কখনো আক্রান্ত করেনি। বরং সমাজ রাজনীতি প্রগতি চিন্তা সর্বদাই সমান্তরালে বহমান ছিল প্রেমিক কবির হৃদয়ে। বহির্জগত এবং অন্তরজগতকে তিনি একই মোহনায় এনে দাঁড় করাতে সক্ষম হয়েছিলেন আশ্চর্য নৈপুণ্যে। তাঁর কবি মানস পরিপূর্ণভাবে উপলব্ধি করতে হলে কবিতার পাশাপাশি তাঁর লেখা গান, ব্যক্তিগত রচনা, চিঠিপত্র, গল্প-উপন্যাস এবং কলামগুলো পড়তে হবে। শিশুদের জন্য লেখা তাঁর শিশু-কিশোর পার্থক কিশোর কবিতাগুলোও আমাদের সাহিত্যের উজ্জ্বল সঞ্চয়।

শামসুর রহমান স্বপ্ন দেখতেন একটি আধুনিকতায় উজ্জ্বল অগ্রসর প্রগতিশীল সমাজের। তাঁর লেখা থেকে উদ্ধৃত করি।

“নিজেকে ব্যক্ত করার অদম্য ইচ্ছা এবং সত্যের সন্ধান একজন লেখকের প্রধান কর্তব্য। সত্য যদি তার নিজের বিরুদ্ধেও যায়,তবু সত্যের দিক থেকে মুখ ফিরিয়ে নেয়া অনুচিত। সর্বোপরি যে কোন মূল্যে মনুষ্যত্ব বজায় রাখার সাধনায় অবিচল থাকাই একান্ত জরুরি একজন লেখকের পক্ষে।”

ওই লেখাতেই তিনি আক্ষেপ করেছেন : “সত্যি বলতে কি, আমার মনের মতো সমাজ এ দেশে গড়ে ওঠেনি আজো। মুক্ত চিন্তাসমৃদ্ধ, শোষণমুক্ত, অসাম্প্রদায়িক সমাজ আমার কাম্য। সেরকম সমাজের প্রতীক্ষায় আছি, জানি না দেখে যেতে পারব কিনা যে দাঁতাল, স্থুল সময়ে আমরা বাস করছি তার অবসান সহজে ঘটবে বলে মনে হয় না। যদি কোনদিন হয় তাহলে আমাদের লড়াই একেবারে ব্যর্থ হয়নি , এ-কথা আমাদের পরবর্তী প্রজন্ম হয়তো স্বীকার করবে।”

আজ এই ২০২৫ সালে যদি কবি শামসুর রাহমান বেঁচে থাকতেন, তাহলে কী লিখতেন তাও আমরা নিশ্চয়ই উপলব্ধি করতে পারি। সেই সুন্দরের সাধক প্রগতিশীল সমাজের সাপ্নিক কবির জন্য জন্মদিনের সশ্রদ্ধ শুভেচ্ছা এবং ভালোবাসা জানাতেই এই লেখা। এই স্বল্পপরিসর লেখায় শামসুর রাহমানের মতো কবিরমূল্যায়ন অসম্ভব।

ছবি

সত্যেন সেনের উপন্যাস: মিথ ও ইতিহাসলগ্ন মানুষ

ছবি

বিস্ময়ের সীমা নাই

ছবি

নগর বাউল ও ত্রিকালদর্শী সন্ত কবি শামসুর রাহমান

সাময়িকী কবিতা

ছবি

ও বন্ধু আমার

ছবি

লোরকার দেশে

ছবি

শামসুর রাহমানের কবিতায় ‘মিথ’

ছবি

দূর-সময়ের সার্বভৌম কবি

ছবি

মাহফুজ আল-হোসেন-এর দশটি কবিতা

ছবি

মনোজগতের অন্বেষায়

সাময়িকী কবিতা

ছবি

এক ঘর রোদ

ছবি

দ্রোহের রম্য পঙ্ক্তিমালা

ছবি

সংবেদী রঙে ও রেখায় প্রাণের উন্মোচন

ছবি

অলস দিনের হাওয়া

ছবি

লাসলো ক্রাসনাহোরকাইয়ের মর্মস্পর্শী ও দূরদর্শী সাহিত্যকর্ম

ছবি

‘ভাষার আরোপিত কারুকাজে খেই হারিয়ে ফেলি’

ছবি

সৈয়দ মনজুরুল ইসলামের জিন্দা লাশ কি প্রকৃত লাশ

ছবি

সৈয়দ মনজুরুল ইসলামের শিক্ষা দর্শন ও অলস দিনের হাওয়া

ছবি

ধ্রুপদী বোধ ও ব্যাধির কবিতা

ছবি

সুকান্তর কবিতায় বিপ্লবী চেতনা

সাময়িকী কবিতা

ছবি

মগ্নচৈতন্যে সৌন্দর্যধ্যান

ছবি

অধুনাবাদী নিরীক্ষার অগ্রসাধক

ছবি

‘বায়ান্নর আধুনিকতা ও প্রগতিশীল ধারাকে বহন করতে চেয়েছি’

ছবি

জাতীয় চেতনার অমলিন ধারক

ছবি

নক্ষত্রের অনন্ত যাত্রা

ছবি

আহমদ রফিক ও ভাষামুক্তি সাধনা

ছবি

কবি আসাদ চৌধুরী : ঘরে ফেরা হলো না তাঁর

ছবি

জীবনবোধের অনবদ্য চিত্ররূপ ‘স্বপ্নছোঁয়ার পদযাত্রা’

ছবি

অনালোকিত ইতিহাসের সন্ধানে

ছবি

কবিরের দোঁহা

ছবি

আকবর হোসেন ও ‘যৌবনটাই জীবন নয়’

ছবি

স্বোপার্জিত

ছবি

সংগ্রামের অগ্নিশিখা থেকে হেলাল হাফিজ

ছবি

কোনো এক শরৎসন্ধ্যা : কোথায় পাব তারে

tab

জন্মদিনের শ্রদ্ধাঞ্জলি

বহুমাত্রিক শামসুর রাহমান

নাসির আহমেদ

বৃহস্পতিবার, ২৩ অক্টোবর ২০২৫

বাংলা ভাষার কবিদের মধ্যে মাইকেল, রবীন্দ্রনাথ, নজরুল, সুকান্ত এবং জীবনানন্দ দাশের পরে এমন কবি খুব কমই এসেছেন যাঁদের কৃতি কিংবা অবদানের কথা গণমাধ্যম এবং পাঠকসমাজ স্বতঃস্ফূর্তভাবে স্মরণ করে। বিশেষ করে জন্ম-মৃত্যু বার্ষিকীতে সশ্রদ্ধ স্মরণের আলোয় যাঁদের উদ্ভাসিত করা হয়, সে সংখ্যা একেবারে হাতেগনা। জীবনানন্দ দাশের পরে শামসুর রাহমানই সম্ভবত সেই কবি যাঁকে তাঁর কোনও ভক্ত কিংবা স্বজনের প্রয়াস ছাড়াই স্বতঃস্ফূর্তভাবে স্মরণ করা হয়। সংবাদ সাময়িকীর সম্পাদক কবি ওবায়েদ আকাশ যখন শামসুর রাহমানের জন্মবার্ষিকী উপলক্ষে একটি লেখা চাইলেন, তখনই মনে এলো মরণোত্তর কবিস্মরণ বিষয়ক এই কথাগুলো।

মৃত্যু এমনই এক নির্মম বাস্তবতা- যা অনেক উজ্জ্বল কিছুও ধূসর ম্লান করে দেয়। এমনকি এক সময় বিস্মরণের অন্ধকারেও নিয়ে যায়। এটা কবি শামসুর রাহমানের পূর্ববর্তী পরবর্তী অনেকের ক্ষেত্রেই দেখেছি। কেউ কেউ শুধু বেঁচে থাকেন সাহিত্য গবেষকদের গবেষণায় কিন্তু গণমানুষের মনোজগতে নয়। কেন থাকেন আর কেন থাকেন না- এই প্রশ্নের মধ্যেই খুঁজে পাবো বহুমাত্রিক কবি শামসুর রাহমানের বিশেষত্ব।

কবি সাহিত্যিকদের অনেকেই অতিক্রান্ত শৈশব কিংবা কৈশোরেই সাহিত্যচর্চা শুরু করেন।শামসুর রাহমান পরিণত বয়সে অর্থাৎ যৌবনে কবিতার চর্চা শুরু করেছিলেন। প্রথম কাব্যগ্রন্থ “প্রথম গান দ্বিতীয় মৃত্যুর আগে” বেরিয়েছিল ৩১ বছর বয়সে। প্রথম কাব্যগ্রন্থ প্রকাশের আগেই সচেতন পাঠকসমাজের দৃষ্টি আকর্ষণ করতে সক্ষম হয়েছিলেন কবি শামসুর রাহমান। বিশেষ করে বুদ্ধদেব বসু সম্পাদিত কবিতা পত্রিকায় “রূপালি স্নান” কবিতাটি প্রকাশিত হবার পর কবি সাহিত্যিক মহলে ব্যাপক পরিচিতি অর্জন করেন তরুণ কবি শামসুর রাহমান। এর কারণ ওই কবিতায় এমন কিছু ছিল, যা বক্তব্যের দিক থেকে যেমন, তেমনি ভাষা এবং আঙ্গিকের দিক থেকেও পূর্ববঙ্গের কবিতার জন্য ছিল নতুন। বেঁচে থাকার জন্য অন্নবস্ত্র আশ্রয়ের মতো জীবনের দৈনন্দিন চাহিদার সঙ্গে সঙ্গে নান্দনিক ক্ষুধাতৃষ্ণা মেটানোর আকাক্সক্ষার কথাও ব্যক্ত করেছিলেন কবি ছয় মাত্রার মাত্রাবৃত্ত ছন্দে লেখা রূপালি স্নান কবিতায়। রুপালি স্নান-এ এমনই পরিপক্ক এক কবির আবির্ভাব সে যুগের সচেতন পাঠক লক্ষ্য করেছিলেন, যা শামসুর রাহমানের জন্য ছিল বিরল মর্যাদার। বই প্রকাশের আগেই যা তৈরি করে রেখেছিল এক সম্মানের আসন।

শামসুর রাহমানের প্রথম তিনটি কাব্যগ্রন্থে (প্রথম গান দ্বিতীয় মৃত্যুর আগে, ১৯৬০, রৌদ্র করোটিতে, ১৯৬৩, বিধ্বস্ত নীলিমা ১৯৬৭) এমন এক জগতের মুখোমুখি হই আমরা যে জগত নান্দনিকতার, প্রবল রোমান্টিকতার সঙ্গে দার্শনিক উপলব্ধির। প্রতীক, চিত্রকল্পে বাঙময় হয়ে উঠেছিল সেই নান্দনিক কবিতার ভুবন। কিন্তু শামসুর রাহমান নিরালোকের দিব্যরথ (১৯৬৮) এবং ১৯৭০ সালে প্রকাশিত নিজ বাসভূমে কাব্যগ্রন্থের মধ্য দিয়ে সমাজ রাজনীতির প্রতি ক্রমাগত অগ্রসরমানতার চিহ্ন খচিত করতে সক্ষম হন। বিশেষ করে ভিয়েতনাম যুদ্ধ, বাংলাদেশে ১৯৬৬ পরবর্তীকালের প্রতিটি গণআন্দোলন তাঁকে প্রবলভাবে স্পর্শ করে। “সফেদ পাঞ্জাবি”, “আসাদের শার্ট”-এর মতো কবিতাগুলো ৬৮-৬৯-এর গনগনে রাজনৈতিক উত্তাপে ঋদ্ধ। এরপর বন্দী শিবির থেকে (১৯৭২)দুঃসময়ে মুখোমুখি (১৯৭৩) ফিরিয়ে নাও ঘাতক কাঁটা (১৯৭৪)আমি অনাহারী ইত্যাদি কাব্যগ্রন্থের মধ্যদিয়ে ক্রমাগত বিপুল জনসম্পৃক্ততায়উদ্ভাসিত হতে থাকেন শামসুর রাহমান। “এ লাশ আমরা রাখবো কোথায়” শিরোনামের কবিতায় নিহত বঙ্গবন্ধুকে যেভাবে চিত্রিত করেছেন তা ওই প্রতিকূল সময়ের সাহসের ব্যাপার বটে। টেলেমেকাস শিরোনামের কবিতাটিও সম্ভবত ওই কাছাকাছি সময়েরই।

১৯৮২ সালে জেনারেল এরশাদের সামরিক শাসন জারির পর শামসুর রাহমান বাংলাদেশে মৌলবাদের উত্থান এবং সামরিক শাসনের ছত্রছায়ায় লুটপাটের অর্থনীতির ভয়াবহ ব্যাপ্তি দেখে যেন আঁতকে ওঠেন। ১৯৮৩ সালে প্রকাশ হয় তাঁর ‘উদ্ভট উটের পিঠে চলেছে স্বদেশ’। সাড়া ফেলে দেয় এই কাব্যগ্রন্থ। এরপরের ইতিহাস আমাদের সকলেরই জানা। “বুক তার বাংলাদেশের হৃদয়” শিরোনামের কবিতায় গণতন্ত্রের জন্য বুক পেতে বুলেট গ্রহণকারী শহীদ নূর হোসেনের জন্য যে গভীর ভালোবাসা প্রকাশ করেছেন কবি, তা মর্মস্পর্শী। ওই শিরোনামে একটি কাব্যগ্রন্থই প্রকাশ করেছেন।

১৯৭১ সালে অবরুদ্ধ বাংলাদেশের পাড়াতলী গ্রামে বসে শামসুর রাহমান লিখেছিলেন তাঁর বন্দী শিবির থেকে কাব্যগ্রন্থের কবিতাগুলো। স্বনামেই কলকাতায় মুক্তিযোদ্ধাদের হাত দিয়ে পাঠিয়েছিলেন কবিতা। ‘স্বাধীনতা তুমি’ এবং ‘তোমাকে পাওয়ার জন্য হে স্বাধীনতা’ কবিতা দুটি দেশ পত্রিকা প্রকাশ করে মজলুম আদিব এই ছদ্মনামে। কবির এই ছদ্মনাম দিয়েছিলেন প্রখ্যাত সাহিত্যিক রবীন্দ্র গবেষক আবু সয়ীদ আইয়ুব। বিশ শতকের ৮০ এবং ৯০-এর দশকে শামসুর রাহমান এমন আরো অনেক কবিতা লিখেছিলেন, যা সমকালীন হয়েও চিরকালীনতাকে স্পর্শ করেছিল।

এ কথা ঠিক শামসুর রাহমান প্রধানত romantic এবং নন্দনতাত্ত্বিক দর্শনে বিশ্বাসী কবি হিসেবেই যাত্রা শুরু করেছিলেন। কিন্তু সময়ের অঙ্গীকার পাল্টে দিয়েছিল সেই চেতনা। আত্মমুখী নান্দনিক বোধে নিমজ্জিত কবিই একসময় এমন বহির্মুখী হলেন যে, তিনি জনগণের কবি হয়ে উঠলেন এবং একইসঙ্গে আন্তর্জাতিকও।

বাংলাদেশে শামসুর রাহমানই বোধহয়, সেই কবি যিনি জীবদ্দশায় সবচেয়ে বেশি সামাজিক মর্যাদা লাভ করেছিলেন। তিনি সেই কবি এদেশে প্রথম যাঁর জন্মদিন (৫০ বছর) বিশাল আয়োজনে নাগরিক সংবর্ধনার মাধ্যমে আনুষ্ঠানিকভাবে উদযাপিত হয়েছিল। কবি সম্পর্কিত বহুকালের প্রচলিত দরিদ্র অবহেলিত নেতিবাচক ধারণাটাই বদলে দিয়েছিলেন শামসুর রাহমান। সবকিছু মিলিয়ে শামসুর রাহমান জীবদ্দশায় এমন সেলিব্রেটি হয়েছিলেন যে মৃত্যুর পরেও তাঁর সেই আলো এখনো বিচ্ছুরিত হচ্ছে।

কবিতার পাশাপাশি আরে নানা ধরনের লেখা লিখেছেন শামসুর রহমান। প্রায় ৭০টির মতো কাব্যগ্রন্থের গৌরবের আলোয় অনেকখানি আড়াল হয়ে গেছে তাঁর অন্যান্য রচনা।

“স্মৃতির শহর ঢাকা”র মতো স্মৃতিকথামূলক বই খুব কমই লেখা হয়েছে। তাঁর আত্মজৈবনিক স্মৃতিচারণমূলক গ্রন্থ “কালের ধুলোয় লেখা” শুধু তাঁর জীবনের স্মৃতি নয়, আমাদের সমাজ সাহিত্য আর সংস্কৃতি অঙ্গনের সময়ের দলিল হিসেবেও স্মরণীয় হয়ে থাকবে। এই আত্মজৈবনিক স্মৃতিচারণ গ্রন্থটির লেখাগুলোর দ্বিতীয় পাঠক হওয়ার সৌভাগ্য হয়েছিল আমার। আমি নিজেই কবির শ্যামলীর বাসভবন থেকে সংগ্রহ করে আনতাম এবং দৈনিক জনকণ্ঠের সাময়িকী পাতায় প্রতি সপ্তাহে প্রকাশ করতাম। এ প্রসঙ্গে কত স্মৃতি মনের কোণে জমা হয়ে আছে, থাক তা আমার ব্যক্তিগত।

শামসুর রাহমান তাঁর পূর্ববর্তী এবং সমসময়ের অনেকের ওপর স্মৃতিচারণমূলক এবং মূল্যায়নধর্মী লেখা লিখেছিলেন বিভিন্ন পত্রপত্রিকায়। এসব লেখার সংকলন “অন্যের মানসে বসবাস” একটি অসাধারণ সুন্দর বই- যেখানে বাংলাদেশের সাহিত্য সংস্কৃতি অঙ্গনের কিংবদন্তিতুল্য ব্যক্তিদের সম্পর্কে এমন অনেক কিছু জানা যাবে, যা আমরা অনেকেই জানতাম না।

শামসুর রাহমান বেশ কয়েকটি উপন্যাস এবং ছোটগল্পও লিখেছেন, যা গ্রন্থাকারে প্রকাশিত হয়েছে। উপন্যাস- অক্টোপাস, অদ্ভুত আঁধার এক,নিয়ত মন্তাজ ইত্যাদি। অনুবাদ করেছেন বিশ্ববিখ্যাত কবি রবার্ট ফ্রস্টের অনেক কবিতা- যা‘রবার্ট ফ্রস্টের কবিতা শিরোনামে’ বহু বছর আগে বই বেরিয়েছে। অনুবাদ করেছেন খাজা ফরিদের কবিতাও। সেই কবিতাও গ্রন্থাকারে প্রকাশিত হয়েছে।

‘মৈনাকের দিনলিপি’ শিরোনামে দীর্ঘদিন কলাম লিখেছেন দৈনিক পাকিস্তান এবং মুক্তিযুদ্ধ পরবর্তী দৈনিক বাংলায়। সেসব কলাম বুদ্ধিদীপ্ত এক সৃজনশীল কবির অসামান্য পর্যবেক্ষণের উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত। এছাড়া অনেক প্রবন্ধ লিখেছেন শামসুর রাহমান। “আমৃত্যু তাঁর জীবনানন্দ” শিরোনামের প্রবন্ধ গ্রন্থটি এক রতœ ভা-ার বললে অতিশয়োক্তি হবে না। পূর্ববর্তী কালের কবি-সাহিত্যিকদের এমন মূল্যায়নধর্মী অনেক প্রবন্ধ আছে- যা সাহিত্য মূল্যায়নের ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ বিবেচিত হতে পারে। আবার বিতর্কিত প্রবন্ধ আছে যেমন পূর্ব বাংলার সাম্প্রতিক কবিতা শিরোনামের একটি প্রবন্ধ। যা প্রকাশের পর তাঁর সমসময়ের এবং পূর্ববর্তী অনেকে একমত হতে পারেননি। বুদ্ধদেব বসুর সঙ্গে সাক্ষাৎ এবং তাঁর ‘কবিতা’ পত্রিকা সম্পর্কিত একটি চমৎকার লেখা ওই প্রবন্ধ গ্রন্থে সংকলিত রয়েছে। দৈনিক বাংলায় তাঁর দীর্ঘদিনের সহকর্মী সালেহ চৌধুরীর সম্পাদনায় সময় প্রকাশনী থেকে ২০০৪ সালে সেরা ‘শামসুর রাহমান’ নামে একটি সংকলন গ্রন্থ বেরিয়েছিল- যেখানে শামসুর রাহমানের সব ধরনের রচনা থেকে বাছাই করা লেখা সংকলিত হয়েছে। পড়েছিলাম একান্ত ভাবনা শিরোনামে শামসুর রাহমানের বেশ কিছু গদ্য রচনা। শিরোনামগুলি শুনলেই পাঠক বুঝতে পারবেন লেখার ধরন লিবারেলিজমের ফাঁকফোকর, আত্মজীবনী লেখার সাহস স্মৃতির রতœ ভা-ার গালিবের কাব্য মৃত মধুসূদনের সমাধি, পাবলো নেরুদা, তাঁর মনোজ সওগাত, প্রচলকাব্যরীতির বদল ইত্যাদি ভিন্ন স্বাদের গদ্য। তার একটি প্রবন্ধ “আমাদের সমাজ এবং লেখকের স্বাধীনতা” কত আগে লেখা, অথচ এখনো প্রাসঙ্গিক! আরো একটি লেখার কথায় মুহূর্তে মনে পড়ে সেটি শিরোনাম শুধু দাম বারেমে লেখা।

কবিতা বিষয়ের শামসুর রহমানের অনেকগুলো গদ্য রচনা রয়েছে বিভিন্ন জায়গায়। যেমন একটি লেখার শিরোনাম “প্রেম এবং কবিতা”। পড়ে মুগ্ধ হয়েছি। প্রেম সম্পর্কে কবিতা নিজের ধারণার কথা বলতে গিয়ে তাঁর রোমান্টিক মনোজগতের যেমন পরিচয় দিয়েছেন, এমনি বৈষ্ণব কবিদের কবিতাও উদ্ধৃত করে প্রেমের গভীরতা প্রকাশ করেছেন। কলাম টাইপের লেখা সম্ভবত কলাম হিসেবে লিখেছিলেন। শুরুটা এক শীত সকালে শয্যার বর্ণনা দিয়ে। “আমি ভালোবাসি”, এই দুটি শব্দ মনে রেখে উচ্চারণ করে যে আনন্দ লাভ করছি শীত-সকালের এই মুহূর্তে, তার তুলনা নেই। হ্যাঁ, আমি ভালোবাসি। বালিশে ঠোঁট চেপে ‘আমি ভালোবাসি’ শব্দদ্বয় বারবার আবৃত্তি করতে খুব ভালো লাগছে আমার।

জেনেছি কাকে চাই, কে এলে চোখে ফোটে/নিমেষে শরতের খুশির জ্যোতিকণা।

কাকে চাই, জানি। এ-ও জানি, এ মুহূর্তে সে আসবে না এখানে। ইচ্ছে করলেও আসতে পারে না। সে বসবে না আমার পাশে।...

ব্যক্তিগত প্রেম, প্রেমিকা প্রসঙ্গে লিখতে লিখতে কবি যখন লেখেন বৈষ্ণব পদক কর্তাদের প্রেমানুভূতির কথা তখন আমরা মুগ্ধ হই। লিখেছেন : প্রেম যার মনের কপাটে এসে কখনো কড়া নাড়েনি তার পক্ষে আর যা-ই হোক, প্রেমের কবিতা লেখা সম্ভব হবে না। তিনি যদি লেখেনও তবে সেটি হবে খুবই কৃত্রিম, বানানো রচনা। যিনি প্রেমে পড়েছেন তিনিই লিখতে পারেন হীরকখ-তুল্য এই পঙক্তি চতুষ্টয়- “জনম অবধি হাম রূপ নেহারিলু /নয়ন না তিরপিত ভেল/ লাখ লাখ যুগ হিয়ে হিয়ে রাখলু, / তবু হিয়া জুড়ন না গেল।”

বৈষ্ণব পদকর্তাগণ অনেক সময় রাধা-কৃষ্ণের প্রেমকথার আবরণে নিজেদের মনের কথাই উচ্চারণ করেছেন এবং সেসব উচ্চারিত বাণী যুগ যুগ ধরে অম্লান হয়ে রয়েছে মানুষের স্মৃতিতে।”

এ প্রসঙ্গে উল্লেখ করতেই হয় রাজনৈতিক কবিতার জন্ম জনমানসে শামসুর রাহমান বিপুলভাবে নন্দিত হয়েছেন বটে, কিন্তু তাঁর প্রেমের কবিতার পাঠকও কম নয়। প্রেমের কবিতায় তিনি এতটাই ইমোশনাল যে, ষাটোত্তীর্ণ বয়সেও যেসব প্রেমের কবিতা লিখেছেন, মনে হয় যেন ২২ বছরের যুবক তার প্রিয় মানুষ উপস্থিত প্রকাশ করছেন।

প্রেমের কবিতায়ও শামসুর রাহমান সব সময়ই উদ্দীপ্ত জীবন্ত। জীবদ্দশায় প্রকাশিত সেরা শামসুর রাহমান গ্রন্থে কবি একটি ব্যক্তিগত প্রেমপত্র প্রকাশের সাহস দেখিয়েছেন, যা বিস্মিত করবে মুগ্ধ করবে যেকোনো পাঠককে। ওই প্রেমপত্রটি এমনই আবেগ বিহবল ভাষায় লেখা, যা একজন তরুণের পক্ষেই লেখা সম্ভব, প্রবীণের পক্ষে প্রায় অসম্ভব। কর্মসূত্রে শামসুর রাহমানকে খুব কাছে থেকে দেখার সুযোগ হয়েছে বহু বছর। সত্যিকার অর্থেই সুকবির পাশাপাশি তিনি একজন অত্যন্ত সুদর্শন, আমৃত্যু প্রেমিক ছিলেন।

কিন্তু তাঁর এই প্রেমিক সত্তা তাঁর কবিসত্তাকে কখনো আক্রান্ত করেনি। বরং সমাজ রাজনীতি প্রগতি চিন্তা সর্বদাই সমান্তরালে বহমান ছিল প্রেমিক কবির হৃদয়ে। বহির্জগত এবং অন্তরজগতকে তিনি একই মোহনায় এনে দাঁড় করাতে সক্ষম হয়েছিলেন আশ্চর্য নৈপুণ্যে। তাঁর কবি মানস পরিপূর্ণভাবে উপলব্ধি করতে হলে কবিতার পাশাপাশি তাঁর লেখা গান, ব্যক্তিগত রচনা, চিঠিপত্র, গল্প-উপন্যাস এবং কলামগুলো পড়তে হবে। শিশুদের জন্য লেখা তাঁর শিশু-কিশোর পার্থক কিশোর কবিতাগুলোও আমাদের সাহিত্যের উজ্জ্বল সঞ্চয়।

শামসুর রহমান স্বপ্ন দেখতেন একটি আধুনিকতায় উজ্জ্বল অগ্রসর প্রগতিশীল সমাজের। তাঁর লেখা থেকে উদ্ধৃত করি।

“নিজেকে ব্যক্ত করার অদম্য ইচ্ছা এবং সত্যের সন্ধান একজন লেখকের প্রধান কর্তব্য। সত্য যদি তার নিজের বিরুদ্ধেও যায়,তবু সত্যের দিক থেকে মুখ ফিরিয়ে নেয়া অনুচিত। সর্বোপরি যে কোন মূল্যে মনুষ্যত্ব বজায় রাখার সাধনায় অবিচল থাকাই একান্ত জরুরি একজন লেখকের পক্ষে।”

ওই লেখাতেই তিনি আক্ষেপ করেছেন : “সত্যি বলতে কি, আমার মনের মতো সমাজ এ দেশে গড়ে ওঠেনি আজো। মুক্ত চিন্তাসমৃদ্ধ, শোষণমুক্ত, অসাম্প্রদায়িক সমাজ আমার কাম্য। সেরকম সমাজের প্রতীক্ষায় আছি, জানি না দেখে যেতে পারব কিনা যে দাঁতাল, স্থুল সময়ে আমরা বাস করছি তার অবসান সহজে ঘটবে বলে মনে হয় না। যদি কোনদিন হয় তাহলে আমাদের লড়াই একেবারে ব্যর্থ হয়নি , এ-কথা আমাদের পরবর্তী প্রজন্ম হয়তো স্বীকার করবে।”

আজ এই ২০২৫ সালে যদি কবি শামসুর রাহমান বেঁচে থাকতেন, তাহলে কী লিখতেন তাও আমরা নিশ্চয়ই উপলব্ধি করতে পারি। সেই সুন্দরের সাধক প্রগতিশীল সমাজের সাপ্নিক কবির জন্য জন্মদিনের সশ্রদ্ধ শুভেচ্ছা এবং ভালোবাসা জানাতেই এই লেখা। এই স্বল্পপরিসর লেখায় শামসুর রাহমানের মতো কবিরমূল্যায়ন অসম্ভব।

back to top