alt

ধারাবাহিক ভ্রমণ কাহিনী-১৪

লোরকার দেশে

চৌধুরী সালাহউদ্দীন মাহমুদ

: বৃহস্পতিবার, ২৩ অক্টোবর ২০২৫

(পূর্ব প্রকাশের পর)

ঝকঝকে রোদেরমালাগা থেকে দমকা হাওয়ার তরিফা এসে ভাবলাম নিসর্গের রূপ বদলাবে। না, তা হলো না। সূর্যালোক, সৈকত ও হাওয়া দিয়ে ভরা স্পেনের পুরো দক্ষিণ এলাকা, তার পাশে বয়ে চলেছে পর পর দুটো সাগর।

এ দুটো সাগর যেখানে মিলেছে, সে জায়গাটি দিয়েই শুরু হলো আমাদের তরিফা ভ্রমণ। মালাগা থেকে প্রায় ১৬০ কিলোমিটার দূরে আসলাম তরিফা-র প্রান্তে, যেখানে শেষ হয়েছে স্পেনের মূল ভূখ-। তা থেকে ছিটকে বেরিয়ে গেছে এক টুকরো দ্বীপ-‘ইসলা দি তরিফা’- ইউরোপের দক্ষিণতম এলাকা। মূল ভূখ-ের সাথে তাকে যুক্ত করেছে একটি সরু রাস্তা। সেটি হেঁটে পার হয়ে আমরা পেঁৗঁছলাম দ্বীপটিতে, যা দুটি মহাদেশ ও দুটি সাগরের এক বিশেষ সঙ্গমস্থল। সামনে জিব্রাল্টার প্রণালি, তার অপর পাশে আফ্রিকা। এখানে কেউ যেন সাগরের গলা চেপে ধরেছে, তাই এটি বেশ সরু। মাত্র ১৪ কিলোমিটার- দুপাশে ইউরোপ ও আফ্রিকা খুব কাছাকাছি, আবছা দেখা যাচ্ছে মরক্কোর উপকূল। আমি বললাম, এ সরু প্রণালি দেখে মনে হচ্ছে অতীতে ইউরোপ ও আফ্রিকা যুক্ত ছিল। নাবিল বলল, সৃষ্টির সময় পৃথিবীর সব ভূখ- এক ছিল, পরে আস্তে আস্তে বিভিন্ন মহাদেশে ভাগ হয়ে যায়।

হাঁটতে হাঁটতে চলে এলাম সাগর পাড়ে। একটি জায়গায় বেশ ভিড়, অনেকে ছবি তুলছে। সেখানে একটি টাঙানো সাইনবোর্ডে দুটি তীর দুটি সাগরের নাম দিয়ে চিহ্নিত- বাম পাশে ভূমধ্যসাগর, আর ডান পাশে আটলান্টিক। এক যুগল সেলফি নিচ্ছে- মেয়েটি ভূমধ্যসাগরের দিকে, ছেলেটি আটলান্টিকে- দুজনে হাত ধরাধরি করে আছে। নাবিল বলল, দুটি একই সাগর। একদিন মাঝখানে এক রেখা কল্পনা করে একজন বলল, এ রেখার এ পাশে ভূমধ্যসাগর, ও পাশে আটলান্টিক। ব্যস, এক সাগরকে দুই সাগরে ভাগ করা হয়ে গেল। নাতাশা বলল, না। দুটি সাগরের জল প্রবাহ ভিন্ন, তাই এখান্ েদুটি সাগরই আলাদাভাবে দেখা যায়। ভূমধ্যসাগর বেশ শান্ত, আটলান্টিক একটু উত্তাল। আমি ভাল করে তাকালাম, দেখি- সুনীল জলের বিশাল অবয়বে দুটি সাগর এক হয়ে আছে। আমরা চারজন ছবি তুললাম দুটি সাগরের মিলিত ¯্রােতধারার সামনে দাঁড়িয়ে- এ এক চমৎকার অনুভব ও অভিজ্ঞতা।

ইসলা দি তরিফা দ্বীপটির অবস্থান এক বিশেষ সঙ্গমস্থলে, তাই ১৮শ’ শতাব্দীতে এখানে তৈরি করা হয়েছে এক সামরিক স্থাপনা। আর স্থাপিত হয়েছে জাহাজ চলাচলে সহায়তার জন্য এক লাইট হাউস- ফারো দি পুনতা দি তরিফা- যা সাগরের দিকে মুখ রেখে মাথা তুলে আছে সূর্যে।

এখানে সবদিকে হাওয়ার মাতম, যা মনে করিয়ে দিল ইউরোপে সবচেয়ে বেশি হাওয়া বয়ে যায় এই তরিফা-য়। তাইতো এ হাওয়ার ওপর ভর করে গড়ে উঠেছে এখানকার পর্যটন শিল্প- বায়ু ও জল-ক্রীড়ার বহু আয়োজন। সৈকত সবদিকে, এরকম কাছের একটি ‘লস লেনসেস’। এখানে এসে দেখলাম সবদিকে চলছে কাইট-সার্ফিং ও উইন্ড-সার্ফিং। নাবিল ও নাতাশা দুজনেই বলল, আমরা কাইট-সার্ফিং করব। আমি বরাবরের মতোই বললাম- দেখ, তোমরা আগে কখনো সার্ফিং করোনি। দুজনেই বলল, আগে করিনি বলে এখন করতে পারব না? কোনো এক সময় তো স্টার্ট করতে হবে! আমি সমঝোতার সুরে বললাম, তা ঠিক, তবে সার্ফিং শেখার জন্য একটু সময় লাগবে, তা আমাদের হাতে নেই। তার চেয়ে তোমরা বরং সার্ফিং দেখ। তাতেই শেখার কাজ অনেক হয়ে যাবে।

ঘোষণা
‘লোরকার দেশে’ শিরোনামে প্রকাশিত চৌধুরী সালাহউদ্দীন মাহমুদের ধারাবাহিক ভ্রমণ কাহিনীটি লেখকের ব্যস্ততার কারণে ১৩ পর্ব পর্যন্ত প্রকাশিত হবার পর স্থগিত করতে হয়। সম্প্রতি লেখক আবার লিখতে শুরু করেছেন। এখন থেকে ভ্রমণ কাহিনীটি নিয়মিত প্রকাশিত হবে। -বি. স.

আকাশ-ঘুড়ি-হাওয়া-জল-সার্ফবোর্ড-মানুষ নিয়ে যেন এক বর্ণিল খেলা কাইট-সার্ফিং। ওপরে ধনুক আকারের রঙ-বেরঙের ঘুড়ি, মনে হচ্ছে অনেক ঈগল পাখি উড়ছে আকাশে। দমকা বাতাস টেনে নিয়ে যাচ্ছে ঘুড়ি, তার সাথে লাগানো সাগরের ওপর সার্ফবোর্ডে মানুষ- ঢেউয়ের ওপর ধরে রাখছে নিজেকে, আবার ঢেউয়ের সাথে ভেসে যাচ্ছে,কখনো লাফ দিয়ে উঠে যাচ্ছে জল থেকে শূন্যে, আবার আছড়ে পড়ছে জলে, কখনো উল্টে পড়ে যাচ্ছে সাগরে, আবার উঠে পড়ছে সার্ফবোর্ডে। আরো আছে উইন্ড-সার্ফিং পালে হাওয়ার টানে ছুটছে ডিঙি নৌকা, আর তা ধরে সাগরে ঘুরছে অগণন মানুষ। সাগরের শোঁ শোঁ গর্জনের সাথে বাতাসের হু হু শব্দ মিলে সৃষ্টি হয়েছে অনন্য এক সিম্ফনি।

হাওয়া ও সাগরের এ উৎসবে মাতোয়ারা হয়ে ছিলাম আমরা সবাই। তাই কখন বেলা গড়িয়ে সূর্য ডোবার সময় এসে গেল খেয়াল করিনি। সুযোগ এলো দু’সাগরের মাঝে সূর্যাস্ত দেখার, এক সাগরের ওপর তা অনেক দেখেছি। এখন মন ভরে দাঁড়িয়ে দেখছি অপূর্ব এক চিত্রপট- দুটি সাগর, তার মাঝে সূর্য ধীরে ধীরে তার রক্তিম আভা ছড়িয়ে দিল, সে আভায় মিশে গেল দু’সাগরের ভেদ রেখা, সাথে আকাশ, মেঘ, সৈকত, ঘুড়ি ও মানুষ। তাদের সবাইকে রেখে আস্তে বিদায় নিল সূর্য। বিদায়ের পালা আমাদেরও!

সারাদিন প্রকৃতির কোলে সময় কাটিয়ে শেষে ইতিহাসে ফিরতে নাবিল-নাতাশার কোনো আপত্তি ছিল না। রাতে তরিফা শহরের পুরনো এলাকায় ঘোরাঘুরি করে সার্ফিং দেখা ব্যস্ত দিনের সমাপ্তি টানতে যাচ্ছি।

প্রধান তোরণ ‘পুয়ের্তা দি হেরেছ’দিয়ে প্রবেশ করলাম পুরনো শহরে। ইসলামী ও গথিক স্থাপত্যের মিশেলে তেরশ শতাব্দীতে মুররা নির্মাণ করেন সুদৃশ্য এ তোরণ; উদ্দেশ্য ছিল প্রতিরক্ষা, যার প্রয়োজনে পুরো শহর ছিল দেয়াল ঘেরা। এখনো তার কিছু অংশ রয়ে গেছে।

দুপাশে ঘন হয়ে থাকা পুরনো ঘর-বাড়ি, যার বেশিরভাগই সাদা চুনকাম করা, সামনে ব্যালকনিতে ঝোলানো ফুলের টব, মাঝে নুড়ি বিছানো সর্পিল রাস্তা, মাঝে মাঝে ক্যাফে-রেঁস্তোরা-বার, ফুল-ফলের দোকান, কয়েকটি বুটিক শপ। স্পেনের পুরনো শহরের এক সাধারণ ছবি, তরিফাও অনেকটা এ রকম। তবে এর মধ্যে আলাদা যোগ হয়েছে সার্ফিং-এর আবহ। পুরো ইউরোপ থেকে উৎসাহীরা এখানে ছুটে আসেন এর টানে, আর চারদিকে তারই আয়োজন।

তরিফাকে ইন্দোনেশিয়ার বালি-র সাথে তুলনা করে বলা হয় ‘বালি অফ ইউরোপ’। এ দুটি শহরের বোহেমিয়ান রূপ সম্ভবত তার কারণ। তরিফা শহর কেন্দ্রের কাছাকাছি ‘লা পেনা’ এলাকায় কাঠের তৈরি বহু কুটিরের সমাহারে গড়ে উঠেছে এক বোহেমিয়ান পল্লী, যা তরুণদের কাছে খুবই প্রিয়। এর সাথে মিলেছে শিল্প-সাহিত্যের লোকদের ভিড়। স্পেনের পল্লীর স্বাদ পেতে এখানে নিয়েছি এক কুটির। এসে দেখলাম এটি পুরোপুরি পল্লীও নয়, আবার শহরও নয়। রাত ঘনিয়ে আসতে ফিরে এলাম এই বোহেমিয়ান পল্লীতে আমাদের কুটিরে।

ঘুমানোর প্রস্তুতি নিতেই কানে বাজল গান-বাজনা-হৈ-চৈ এর মিলিত আওয়াজ, মনে হলো কাছেই। বের হয়ে দেখি তরুণ-যুবার একটি দল গিটার-ট্রামপেট বাজাচ্ছে, আর নাচছে, গাইছে- আরেক দল তাল মিলিয়ে হাততালি দিচ্ছে। পাশেই আনন্দের এ আয়োজনে কি ঘুমানো যায়? এ নাচ-গানে আমরাও যোগ দিলাম, ক্লাািন্ত ও নিদ্রা যেন নিমিষেই মিলিয়ে গেল।

গান-বাজনায় মেতে থাকাতে রাতে বেশি ঘুম হয়নি। তারপরও ভোরে উঠে ছুটলাম, গন্তব্য-‘বাইলো ক্লদিয়া’- তরিফা শহরের দক্ষিণে পুরনো রোমান শহর, টেক্সি করে পৌঁছতে লাগল ২০ মিনিট। এটি যখন স্পেন, এতে নিসর্গের সৌন্দর্যের সাথে ইতিহাসের চিহ্নও থাকবে কিছু না কিছু। তরিফাও তার ব্যতিক্রম নয়। এর নামেই রয়েছে ইতিহাস। তরিফা নামটির মূল উত্তর আফ্রিকার সেনাপতি তরিফ ইবনে মালিক, যিনি ৭১০ সালে এ অঞ্চলে অভিযান পরিচালনা করেন। এ অভিযান তার পরের বছরে মুর সেনাপতি তারিক ইবনে জায়েদ এর স্পেন বিজয় এর সূচনা করে।

ইতিহাসের অনেক চিহ্ন ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছেবাইলো ক্লদিয়াতে। দেখলাম খৃষ্টপূর্ব ২য় শতাব্দীর রোমান পূরাকীর্তি- একটি ব্যাসিলিকা, জলপ্রবাহের রাস্তা, ফোরাম, ৪টি মন্দির।

রোমানদের কীর্তি থেকে এরপর আসলাম মুরদের কীর্তিতে। মুররা স্পেনে প্রায় আটশ’ বছরের শাসনকালে অনেক দুর্গ নির্মাণ করেছে, তার একটি হলো কাস্তিয়ো দি তরিফা। সাগরের পাড়ে অনেক উঁচু এক শিলাখণ্ডের উপর এটি নির্মিত হয়েছে ৯৬০ সালে। সাগর দিয়ে তরিফা ঢুকতেই এটি প্রথম স্বাগত জানাবে, আবার সতর্কও করবে। বিশাল দুর্গের ভেতরে ঘুরে সবাই উঠলাম এর টাওয়ারে- দেখা গেল সাগরের ওপারে মরক্কোর পাহাড় ও উপকূল।

মরক্কোর তাঞ্জিয়ার এখান থেকে কাছেই- মাত্র আধা ঘণ্টায় ফেরিতে যাওয়া যায়। সমুদ্র ও বাতাস উত্তাল হলে সময়ও বেশি লাগে- কোনো সময় ঘণ্টার উপর লেগে যায়। কম দূরত্বের কারণে তরিফা হয়ে উঠেছে ইউরোপ থেকে আফ্রিকা প্রবেশের প্রধান কেন্দ্র। দুই মহাদেশের মাঝে যাতায়াত দেখতে ফেরি ঘাটে গেলাম। লম্বা লাইন দিয়ে ফেরিতে উঠছে একদিকে গাড়ি, অন্যদিকে যাত্রী। তা ছাড়াও আছে যাত্রীবাহী জাহাজ, কার্গো জাহাজ, ছোট-বড় নৌকা, আর ওপরে গাঙচিল- সব মিলিয়ে সাগরের বুকে ও ওপরে বিচিত্র এক চাঞ্চল্য।

সার্ফিং করতে পারেনি বলে নাবিল ও নাতাশার মন একটু খারাপ হয়ে আছে। তাই বললাম, কাল তোমাদের নিয়ে যাব এক এডভেঞ্চার-এ, যা সার্ফিং-এর চেয়ে কম নয়। ওরা সবসময় এডভেঞ্চার নিয়ে থাকতে চায়। তাই আমার প্রস্তাব শুনে ‘ওয়াও’ বলে জিজ্ঞেস করল, এটি কোথায়? বললাম, এখন বলব না। একটু সাসপেন্স থাক!

তরিফার সাগরে ডলফিন ও তিমি মাছ দেখা এখানকার আরেকটি বড় আকর্ষণ। খুব ভোরে উঠতে হলো তা দেখার জন্য। কফি ও ক্রসন্ট হাতে হাতে নিয়ে ছুটলাম সাগর পাড়ের ঘাটে, তিমি দেখার একটি বোটে উঠে গেলাম। ভাগ্য ভাল, টিকিট পেয়ে গেলাম, কজন তাদের বুকিং বাতিল করেছে। না হয় অনেক আগে থেকে টিকিট কিনে রাখতে হয়।

ছোট একটি বোটে আমরা ৮ জন। সাথে আমাদের চালক ও গাইড, নাম আচাভেডো, সবার সাথে পরিচিত হলো। চেহারা ও কথা থেকে বুঝতে পারলাম সে একজন জিপসি তরুণ, তামাটে মুখের গম্ভীর চেহারা যেন এক সূক্ষ্ম বিষাদকে আড়াল করছে। জিপসিরা স্পেনের প্রান্তিক জনগোষ্ঠী, তাই তাদের জন্য রয়েছে আমাদের এক মমত্ববোধ। আচাভেডো-র সাথে ধীরে ধীরে আমরা বেশ আলাপ জমিয়ে তুললাম।

বোটটি আমাদের নিয়ে আসল জিব্রাল্টার প্রণালির মাঝামাঝি। স্কুল জীবনে মুসলিমদের স্পেন বিজয়ের কাহিনিতে এ নাম শুনেছি। এ পথ দিয়ে এসেই তারা স্পেনে বিজয়ী হয়। একটি জায়গায় যেয়ে বোটটি থেমে থাকল। এখন অপেক্ষার পালা। আবহাওয়া ও সমুদ্রের গতি-প্রকৃতির উপর তিমিদের চলাফেরা কিছুটা নির্ভর করে। এমন হতে পারে তিমি বা ডলফিনের দেখা মিলল না। এ দুটির অনেক খেলা দেখেছি সান এন্টিনিও শহরের কাছে সি ওয়ার্ল্ড-এর প্রমোদ কেন্দ্রে। তবে বন্দী প্রাণিদের খেলা দেখার চেয়ে মুক্ত প্রাণিদের দৌড়-ঝাঁপ দেখা হবে অনেক বেশি অকৃত্রিম। তবে নাবিল ও নাতাশার অভিযোগ: প্রাণিদের নিয়ে এ রকম প্রমোদ করা আনফেয়ার। তাদেরকে তাদের মতো থাকতে দাও। আমরা তাদের এলাকায় এসে ডিসটার্ব করছি। আমি বললাম- ঠিকই তো, আমরা এসে এদের রাজ্যে হামলা করছি। তবে আমরা কি তিমি ডলফিন না দেখে ফিরে যাব? এখানে আরো অনেকে আছে, আমরা ছাড়া আরো ৪ জন। তারা কি মানবে? এবারকার মতো আর কি করা যায়? ভবিষ্যতে সাবধান হবো।

সাগরে এক ডলফিন লাফ দিয়ে উঠে আমাদের আলাপে বিঘœ ঘটালো। নাবিল ও নাতাশা দুজনেই ‘ওয়াও’ বলে তাদের আনন্দ-উত্তেজনা প্রকাশ করল। তারা একটু আগের তোলা অভিযোগ ভুলে গেল, পাশে ডলফিনের লাফ দেখে তাদের আনন্দ আর ধরে না! বাকি সবাই সোল্লাসে হৈ চৈ নাচানাচি করে উঠলো।

এরপর বিশাল এক তিমি ভেসে উঠতেই আনন্দের সাথে যোগ হলো বিস্ময়! নীল আকাশের নিচে, নীল সাগরের জলে, বিশাল এক তিমি, তবে নীল রঙের নয়। তাও বিশালতা ও সৌন্দর্যের এক সমাহার! এর চেয়ে সুন্দর দৃশ্য আর কী হতে পারে! ‘এনজয় দি মোমেন্ট’- নাবিল-নাতাশার কথাটি মনে হলো। তাই ছবি-ভিডিও তোলা বাদ দিয়ে চোখ ভরে দেখতে লাগলাম এ অনুপম দৃশ্য।

এরপর আসল আরো অনেক তিমি, অনেক ডলফিন- ওপরে সিগাল- কত আকারের, কত ধরনের। আমাদের গাইড ভাঙা ইংরেজিতে এদের বর্ণনা দিয়ে যাচ্ছে। নাবিল নাতাশা সেদিকে কান দিচ্ছে না, কারণ তারা জানে ‘এনজয় দি মোমেন্ট’। তবে আমি মোমেন্ট এনজয় করার সাথে সাথে তা ছবিতে ধরে রাখার চেষ্টা করি।

খুব ইচ্ছে ছিল নীল রঙের তিমি দেখব। আমাদের গাইড আচাভেডো বলল, শীতকালে নীল তিমি এদিকে আসে না। যে সব তিমি বাইরে থেকে এখানে আসে, তারা আসে গরমকালে। তোমাদের ভাগ্য ভাল যে, আজ এতগুলি তিমি ও ডলফিন দেখেছ। নীল রঙের তিমি দেখতে হলে গরমকালে আসতে হবে। মে থেকে আগস্ট সবচেয়ে ভাল সময়। এখন যে তিমি দেখছ এগুলো সব স্থানীয় তিমি, অতিথি তিমি নয়। আমি হাসতে হাসতে বললাম, অতিথি হিসেবে আমরা আবার আসব অতিথি তিমির সাথে সাথে। তিমিরা থাকবে সাগরে, আমরা থাকব তোমার বাসায়। আচাভেডো এতক্ষণ পরে একবার হাসল, তবে মলিন সে হাসি। বলল, আমার নিজের বাসাতো নেই তোমাদের থাকতে দেব। আমি থাকি পাশেই এক বন্ধুর বাড়িতে, তার এক রুম ভাড়া নিয়ে। বললাম, এখানে সাগরের পাড়ে বাড়ি কিনে ফেলতে পার। আচাভেডো বলল, সে কোনোদিন সম্ভব হবে না। পুরো দুনিয়ার লোকজন এখানে আসে সাগর পাড়ে বাড়ি কিনতে। তার জন্য অনেক টাকার দরকার, তা আমার নেই। আর আমাকে সাহায্য করতে হয় আমার বুড়ো মাকে, যিনি থাকেন গ্রামে, এখান থেকে ৮০ মাইল দূরে। সাত বছর হলো, ডলফিন শিকার করতে যেয়ে এ সাগরের ঝড়ে প্রাণ হারিয়েছেন আমার বাবা। এটি বলে আচাভেডো তার বুকের লকেটে রাখা বাবার ছবি দেখাল। একটু থেমে সে তার বুকে ক্রস আঁকল বাবার জন্য প্রার্থনায়। মনে হলো আচাভেডোর দু-চোখের কোণ ভিজে উঠেছে। তারপর সাগরের দিকে আঙুল তুলে সে বলল: এরপরও এ সাগরকে নিয়েই চলছে আমার জীবন। আজ ছয় বছর এ নোনা জলে বোট চালিয়ে আসছি, পর্যটকদের সাগরের আনন্দ দেখাই, আর নিজের দুঃখকে ভুলে থাকতে চাই।

সাগরের আনন্দের মাঝে মানুষের এ দুঃখের কথাই তো লোরকা বলেছেন: “সাগর / দূর থেকে হেসে ওঠে। / দাঁত ঝিকিমিকি ফেনা, / আকাশস্বর্গের দুটি ঠোঁট। / ‘কী নিয়ে চলেছ খোলা বুকে বয়ে বাতাসের হাটে, / কালো মেয়ে?’ / ‘আমার বেসাত, বাবু, / সাগরের জল।’ / ‘কী নিয়ে চলেছ বয়ে রক্তে মিশোল, / কালো ছেলে?’ / ‘আমি নিয়ে যাই, বাবু, / সাগরের জল।’ / ‘মা গো, ওই নোনতা চোখের জল / কোনখান থেকে বয়ে আসে?; / ‘আমার কান্না যে, বাছা, / সাগরের জল।”১

সাগরের জলে লোরকা দেখেন মায়ের কান্না!

ফেরার পথে কল্পনায় দেখলাম সাগরে হারানো আচাভেডো-র বাবার মুখ ও দূর গ্রামে তার মায়ের কান্না। সাগর দেখে এবার নিয়ে আসলাম এক অনুভূতি- বিষাদের! ক্রমশ...

Ref: 1. Romance de la Sal, সাগরজলের বালাদ: অনুবাদ: দেবীপ্রসাদ বন্দ্যোপাধ্যায়

ছবি

সত্যেন সেনের উপন্যাস: মিথ ও ইতিহাসলগ্ন মানুষ

ছবি

বিস্ময়ের সীমা নাই

ছবি

নগর বাউল ও ত্রিকালদর্শী সন্ত কবি শামসুর রাহমান

সাময়িকী কবিতা

ছবি

ও বন্ধু আমার

ছবি

শামসুর রাহমানের কবিতায় ‘মিথ’

ছবি

বহুমাত্রিক শামসুর রাহমান

ছবি

দূর-সময়ের সার্বভৌম কবি

ছবি

মাহফুজ আল-হোসেন-এর দশটি কবিতা

ছবি

মনোজগতের অন্বেষায়

সাময়িকী কবিতা

ছবি

এক ঘর রোদ

ছবি

দ্রোহের রম্য পঙ্ক্তিমালা

ছবি

সংবেদী রঙে ও রেখায় প্রাণের উন্মোচন

ছবি

অলস দিনের হাওয়া

ছবি

লাসলো ক্রাসনাহোরকাইয়ের মর্মস্পর্শী ও দূরদর্শী সাহিত্যকর্ম

ছবি

‘ভাষার আরোপিত কারুকাজে খেই হারিয়ে ফেলি’

ছবি

সৈয়দ মনজুরুল ইসলামের জিন্দা লাশ কি প্রকৃত লাশ

ছবি

সৈয়দ মনজুরুল ইসলামের শিক্ষা দর্শন ও অলস দিনের হাওয়া

ছবি

ধ্রুপদী বোধ ও ব্যাধির কবিতা

ছবি

সুকান্তর কবিতায় বিপ্লবী চেতনা

সাময়িকী কবিতা

ছবি

মগ্নচৈতন্যে সৌন্দর্যধ্যান

ছবি

অধুনাবাদী নিরীক্ষার অগ্রসাধক

ছবি

‘বায়ান্নর আধুনিকতা ও প্রগতিশীল ধারাকে বহন করতে চেয়েছি’

ছবি

জাতীয় চেতনার অমলিন ধারক

ছবি

নক্ষত্রের অনন্ত যাত্রা

ছবি

আহমদ রফিক ও ভাষামুক্তি সাধনা

ছবি

কবি আসাদ চৌধুরী : ঘরে ফেরা হলো না তাঁর

ছবি

জীবনবোধের অনবদ্য চিত্ররূপ ‘স্বপ্নছোঁয়ার পদযাত্রা’

ছবি

অনালোকিত ইতিহাসের সন্ধানে

ছবি

কবিরের দোঁহা

ছবি

আকবর হোসেন ও ‘যৌবনটাই জীবন নয়’

ছবি

স্বোপার্জিত

ছবি

সংগ্রামের অগ্নিশিখা থেকে হেলাল হাফিজ

ছবি

কোনো এক শরৎসন্ধ্যা : কোথায় পাব তারে

tab

ধারাবাহিক ভ্রমণ কাহিনী-১৪

লোরকার দেশে

চৌধুরী সালাহউদ্দীন মাহমুদ

বৃহস্পতিবার, ২৩ অক্টোবর ২০২৫

(পূর্ব প্রকাশের পর)

ঝকঝকে রোদেরমালাগা থেকে দমকা হাওয়ার তরিফা এসে ভাবলাম নিসর্গের রূপ বদলাবে। না, তা হলো না। সূর্যালোক, সৈকত ও হাওয়া দিয়ে ভরা স্পেনের পুরো দক্ষিণ এলাকা, তার পাশে বয়ে চলেছে পর পর দুটো সাগর।

এ দুটো সাগর যেখানে মিলেছে, সে জায়গাটি দিয়েই শুরু হলো আমাদের তরিফা ভ্রমণ। মালাগা থেকে প্রায় ১৬০ কিলোমিটার দূরে আসলাম তরিফা-র প্রান্তে, যেখানে শেষ হয়েছে স্পেনের মূল ভূখ-। তা থেকে ছিটকে বেরিয়ে গেছে এক টুকরো দ্বীপ-‘ইসলা দি তরিফা’- ইউরোপের দক্ষিণতম এলাকা। মূল ভূখ-ের সাথে তাকে যুক্ত করেছে একটি সরু রাস্তা। সেটি হেঁটে পার হয়ে আমরা পেঁৗঁছলাম দ্বীপটিতে, যা দুটি মহাদেশ ও দুটি সাগরের এক বিশেষ সঙ্গমস্থল। সামনে জিব্রাল্টার প্রণালি, তার অপর পাশে আফ্রিকা। এখানে কেউ যেন সাগরের গলা চেপে ধরেছে, তাই এটি বেশ সরু। মাত্র ১৪ কিলোমিটার- দুপাশে ইউরোপ ও আফ্রিকা খুব কাছাকাছি, আবছা দেখা যাচ্ছে মরক্কোর উপকূল। আমি বললাম, এ সরু প্রণালি দেখে মনে হচ্ছে অতীতে ইউরোপ ও আফ্রিকা যুক্ত ছিল। নাবিল বলল, সৃষ্টির সময় পৃথিবীর সব ভূখ- এক ছিল, পরে আস্তে আস্তে বিভিন্ন মহাদেশে ভাগ হয়ে যায়।

হাঁটতে হাঁটতে চলে এলাম সাগর পাড়ে। একটি জায়গায় বেশ ভিড়, অনেকে ছবি তুলছে। সেখানে একটি টাঙানো সাইনবোর্ডে দুটি তীর দুটি সাগরের নাম দিয়ে চিহ্নিত- বাম পাশে ভূমধ্যসাগর, আর ডান পাশে আটলান্টিক। এক যুগল সেলফি নিচ্ছে- মেয়েটি ভূমধ্যসাগরের দিকে, ছেলেটি আটলান্টিকে- দুজনে হাত ধরাধরি করে আছে। নাবিল বলল, দুটি একই সাগর। একদিন মাঝখানে এক রেখা কল্পনা করে একজন বলল, এ রেখার এ পাশে ভূমধ্যসাগর, ও পাশে আটলান্টিক। ব্যস, এক সাগরকে দুই সাগরে ভাগ করা হয়ে গেল। নাতাশা বলল, না। দুটি সাগরের জল প্রবাহ ভিন্ন, তাই এখান্ েদুটি সাগরই আলাদাভাবে দেখা যায়। ভূমধ্যসাগর বেশ শান্ত, আটলান্টিক একটু উত্তাল। আমি ভাল করে তাকালাম, দেখি- সুনীল জলের বিশাল অবয়বে দুটি সাগর এক হয়ে আছে। আমরা চারজন ছবি তুললাম দুটি সাগরের মিলিত ¯্রােতধারার সামনে দাঁড়িয়ে- এ এক চমৎকার অনুভব ও অভিজ্ঞতা।

ইসলা দি তরিফা দ্বীপটির অবস্থান এক বিশেষ সঙ্গমস্থলে, তাই ১৮শ’ শতাব্দীতে এখানে তৈরি করা হয়েছে এক সামরিক স্থাপনা। আর স্থাপিত হয়েছে জাহাজ চলাচলে সহায়তার জন্য এক লাইট হাউস- ফারো দি পুনতা দি তরিফা- যা সাগরের দিকে মুখ রেখে মাথা তুলে আছে সূর্যে।

এখানে সবদিকে হাওয়ার মাতম, যা মনে করিয়ে দিল ইউরোপে সবচেয়ে বেশি হাওয়া বয়ে যায় এই তরিফা-য়। তাইতো এ হাওয়ার ওপর ভর করে গড়ে উঠেছে এখানকার পর্যটন শিল্প- বায়ু ও জল-ক্রীড়ার বহু আয়োজন। সৈকত সবদিকে, এরকম কাছের একটি ‘লস লেনসেস’। এখানে এসে দেখলাম সবদিকে চলছে কাইট-সার্ফিং ও উইন্ড-সার্ফিং। নাবিল ও নাতাশা দুজনেই বলল, আমরা কাইট-সার্ফিং করব। আমি বরাবরের মতোই বললাম- দেখ, তোমরা আগে কখনো সার্ফিং করোনি। দুজনেই বলল, আগে করিনি বলে এখন করতে পারব না? কোনো এক সময় তো স্টার্ট করতে হবে! আমি সমঝোতার সুরে বললাম, তা ঠিক, তবে সার্ফিং শেখার জন্য একটু সময় লাগবে, তা আমাদের হাতে নেই। তার চেয়ে তোমরা বরং সার্ফিং দেখ। তাতেই শেখার কাজ অনেক হয়ে যাবে।

ঘোষণা
‘লোরকার দেশে’ শিরোনামে প্রকাশিত চৌধুরী সালাহউদ্দীন মাহমুদের ধারাবাহিক ভ্রমণ কাহিনীটি লেখকের ব্যস্ততার কারণে ১৩ পর্ব পর্যন্ত প্রকাশিত হবার পর স্থগিত করতে হয়। সম্প্রতি লেখক আবার লিখতে শুরু করেছেন। এখন থেকে ভ্রমণ কাহিনীটি নিয়মিত প্রকাশিত হবে। -বি. স.

আকাশ-ঘুড়ি-হাওয়া-জল-সার্ফবোর্ড-মানুষ নিয়ে যেন এক বর্ণিল খেলা কাইট-সার্ফিং। ওপরে ধনুক আকারের রঙ-বেরঙের ঘুড়ি, মনে হচ্ছে অনেক ঈগল পাখি উড়ছে আকাশে। দমকা বাতাস টেনে নিয়ে যাচ্ছে ঘুড়ি, তার সাথে লাগানো সাগরের ওপর সার্ফবোর্ডে মানুষ- ঢেউয়ের ওপর ধরে রাখছে নিজেকে, আবার ঢেউয়ের সাথে ভেসে যাচ্ছে,কখনো লাফ দিয়ে উঠে যাচ্ছে জল থেকে শূন্যে, আবার আছড়ে পড়ছে জলে, কখনো উল্টে পড়ে যাচ্ছে সাগরে, আবার উঠে পড়ছে সার্ফবোর্ডে। আরো আছে উইন্ড-সার্ফিং পালে হাওয়ার টানে ছুটছে ডিঙি নৌকা, আর তা ধরে সাগরে ঘুরছে অগণন মানুষ। সাগরের শোঁ শোঁ গর্জনের সাথে বাতাসের হু হু শব্দ মিলে সৃষ্টি হয়েছে অনন্য এক সিম্ফনি।

হাওয়া ও সাগরের এ উৎসবে মাতোয়ারা হয়ে ছিলাম আমরা সবাই। তাই কখন বেলা গড়িয়ে সূর্য ডোবার সময় এসে গেল খেয়াল করিনি। সুযোগ এলো দু’সাগরের মাঝে সূর্যাস্ত দেখার, এক সাগরের ওপর তা অনেক দেখেছি। এখন মন ভরে দাঁড়িয়ে দেখছি অপূর্ব এক চিত্রপট- দুটি সাগর, তার মাঝে সূর্য ধীরে ধীরে তার রক্তিম আভা ছড়িয়ে দিল, সে আভায় মিশে গেল দু’সাগরের ভেদ রেখা, সাথে আকাশ, মেঘ, সৈকত, ঘুড়ি ও মানুষ। তাদের সবাইকে রেখে আস্তে বিদায় নিল সূর্য। বিদায়ের পালা আমাদেরও!

সারাদিন প্রকৃতির কোলে সময় কাটিয়ে শেষে ইতিহাসে ফিরতে নাবিল-নাতাশার কোনো আপত্তি ছিল না। রাতে তরিফা শহরের পুরনো এলাকায় ঘোরাঘুরি করে সার্ফিং দেখা ব্যস্ত দিনের সমাপ্তি টানতে যাচ্ছি।

প্রধান তোরণ ‘পুয়ের্তা দি হেরেছ’দিয়ে প্রবেশ করলাম পুরনো শহরে। ইসলামী ও গথিক স্থাপত্যের মিশেলে তেরশ শতাব্দীতে মুররা নির্মাণ করেন সুদৃশ্য এ তোরণ; উদ্দেশ্য ছিল প্রতিরক্ষা, যার প্রয়োজনে পুরো শহর ছিল দেয়াল ঘেরা। এখনো তার কিছু অংশ রয়ে গেছে।

দুপাশে ঘন হয়ে থাকা পুরনো ঘর-বাড়ি, যার বেশিরভাগই সাদা চুনকাম করা, সামনে ব্যালকনিতে ঝোলানো ফুলের টব, মাঝে নুড়ি বিছানো সর্পিল রাস্তা, মাঝে মাঝে ক্যাফে-রেঁস্তোরা-বার, ফুল-ফলের দোকান, কয়েকটি বুটিক শপ। স্পেনের পুরনো শহরের এক সাধারণ ছবি, তরিফাও অনেকটা এ রকম। তবে এর মধ্যে আলাদা যোগ হয়েছে সার্ফিং-এর আবহ। পুরো ইউরোপ থেকে উৎসাহীরা এখানে ছুটে আসেন এর টানে, আর চারদিকে তারই আয়োজন।

তরিফাকে ইন্দোনেশিয়ার বালি-র সাথে তুলনা করে বলা হয় ‘বালি অফ ইউরোপ’। এ দুটি শহরের বোহেমিয়ান রূপ সম্ভবত তার কারণ। তরিফা শহর কেন্দ্রের কাছাকাছি ‘লা পেনা’ এলাকায় কাঠের তৈরি বহু কুটিরের সমাহারে গড়ে উঠেছে এক বোহেমিয়ান পল্লী, যা তরুণদের কাছে খুবই প্রিয়। এর সাথে মিলেছে শিল্প-সাহিত্যের লোকদের ভিড়। স্পেনের পল্লীর স্বাদ পেতে এখানে নিয়েছি এক কুটির। এসে দেখলাম এটি পুরোপুরি পল্লীও নয়, আবার শহরও নয়। রাত ঘনিয়ে আসতে ফিরে এলাম এই বোহেমিয়ান পল্লীতে আমাদের কুটিরে।

ঘুমানোর প্রস্তুতি নিতেই কানে বাজল গান-বাজনা-হৈ-চৈ এর মিলিত আওয়াজ, মনে হলো কাছেই। বের হয়ে দেখি তরুণ-যুবার একটি দল গিটার-ট্রামপেট বাজাচ্ছে, আর নাচছে, গাইছে- আরেক দল তাল মিলিয়ে হাততালি দিচ্ছে। পাশেই আনন্দের এ আয়োজনে কি ঘুমানো যায়? এ নাচ-গানে আমরাও যোগ দিলাম, ক্লাািন্ত ও নিদ্রা যেন নিমিষেই মিলিয়ে গেল।

গান-বাজনায় মেতে থাকাতে রাতে বেশি ঘুম হয়নি। তারপরও ভোরে উঠে ছুটলাম, গন্তব্য-‘বাইলো ক্লদিয়া’- তরিফা শহরের দক্ষিণে পুরনো রোমান শহর, টেক্সি করে পৌঁছতে লাগল ২০ মিনিট। এটি যখন স্পেন, এতে নিসর্গের সৌন্দর্যের সাথে ইতিহাসের চিহ্নও থাকবে কিছু না কিছু। তরিফাও তার ব্যতিক্রম নয়। এর নামেই রয়েছে ইতিহাস। তরিফা নামটির মূল উত্তর আফ্রিকার সেনাপতি তরিফ ইবনে মালিক, যিনি ৭১০ সালে এ অঞ্চলে অভিযান পরিচালনা করেন। এ অভিযান তার পরের বছরে মুর সেনাপতি তারিক ইবনে জায়েদ এর স্পেন বিজয় এর সূচনা করে।

ইতিহাসের অনেক চিহ্ন ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছেবাইলো ক্লদিয়াতে। দেখলাম খৃষ্টপূর্ব ২য় শতাব্দীর রোমান পূরাকীর্তি- একটি ব্যাসিলিকা, জলপ্রবাহের রাস্তা, ফোরাম, ৪টি মন্দির।

রোমানদের কীর্তি থেকে এরপর আসলাম মুরদের কীর্তিতে। মুররা স্পেনে প্রায় আটশ’ বছরের শাসনকালে অনেক দুর্গ নির্মাণ করেছে, তার একটি হলো কাস্তিয়ো দি তরিফা। সাগরের পাড়ে অনেক উঁচু এক শিলাখণ্ডের উপর এটি নির্মিত হয়েছে ৯৬০ সালে। সাগর দিয়ে তরিফা ঢুকতেই এটি প্রথম স্বাগত জানাবে, আবার সতর্কও করবে। বিশাল দুর্গের ভেতরে ঘুরে সবাই উঠলাম এর টাওয়ারে- দেখা গেল সাগরের ওপারে মরক্কোর পাহাড় ও উপকূল।

মরক্কোর তাঞ্জিয়ার এখান থেকে কাছেই- মাত্র আধা ঘণ্টায় ফেরিতে যাওয়া যায়। সমুদ্র ও বাতাস উত্তাল হলে সময়ও বেশি লাগে- কোনো সময় ঘণ্টার উপর লেগে যায়। কম দূরত্বের কারণে তরিফা হয়ে উঠেছে ইউরোপ থেকে আফ্রিকা প্রবেশের প্রধান কেন্দ্র। দুই মহাদেশের মাঝে যাতায়াত দেখতে ফেরি ঘাটে গেলাম। লম্বা লাইন দিয়ে ফেরিতে উঠছে একদিকে গাড়ি, অন্যদিকে যাত্রী। তা ছাড়াও আছে যাত্রীবাহী জাহাজ, কার্গো জাহাজ, ছোট-বড় নৌকা, আর ওপরে গাঙচিল- সব মিলিয়ে সাগরের বুকে ও ওপরে বিচিত্র এক চাঞ্চল্য।

সার্ফিং করতে পারেনি বলে নাবিল ও নাতাশার মন একটু খারাপ হয়ে আছে। তাই বললাম, কাল তোমাদের নিয়ে যাব এক এডভেঞ্চার-এ, যা সার্ফিং-এর চেয়ে কম নয়। ওরা সবসময় এডভেঞ্চার নিয়ে থাকতে চায়। তাই আমার প্রস্তাব শুনে ‘ওয়াও’ বলে জিজ্ঞেস করল, এটি কোথায়? বললাম, এখন বলব না। একটু সাসপেন্স থাক!

তরিফার সাগরে ডলফিন ও তিমি মাছ দেখা এখানকার আরেকটি বড় আকর্ষণ। খুব ভোরে উঠতে হলো তা দেখার জন্য। কফি ও ক্রসন্ট হাতে হাতে নিয়ে ছুটলাম সাগর পাড়ের ঘাটে, তিমি দেখার একটি বোটে উঠে গেলাম। ভাগ্য ভাল, টিকিট পেয়ে গেলাম, কজন তাদের বুকিং বাতিল করেছে। না হয় অনেক আগে থেকে টিকিট কিনে রাখতে হয়।

ছোট একটি বোটে আমরা ৮ জন। সাথে আমাদের চালক ও গাইড, নাম আচাভেডো, সবার সাথে পরিচিত হলো। চেহারা ও কথা থেকে বুঝতে পারলাম সে একজন জিপসি তরুণ, তামাটে মুখের গম্ভীর চেহারা যেন এক সূক্ষ্ম বিষাদকে আড়াল করছে। জিপসিরা স্পেনের প্রান্তিক জনগোষ্ঠী, তাই তাদের জন্য রয়েছে আমাদের এক মমত্ববোধ। আচাভেডো-র সাথে ধীরে ধীরে আমরা বেশ আলাপ জমিয়ে তুললাম।

বোটটি আমাদের নিয়ে আসল জিব্রাল্টার প্রণালির মাঝামাঝি। স্কুল জীবনে মুসলিমদের স্পেন বিজয়ের কাহিনিতে এ নাম শুনেছি। এ পথ দিয়ে এসেই তারা স্পেনে বিজয়ী হয়। একটি জায়গায় যেয়ে বোটটি থেমে থাকল। এখন অপেক্ষার পালা। আবহাওয়া ও সমুদ্রের গতি-প্রকৃতির উপর তিমিদের চলাফেরা কিছুটা নির্ভর করে। এমন হতে পারে তিমি বা ডলফিনের দেখা মিলল না। এ দুটির অনেক খেলা দেখেছি সান এন্টিনিও শহরের কাছে সি ওয়ার্ল্ড-এর প্রমোদ কেন্দ্রে। তবে বন্দী প্রাণিদের খেলা দেখার চেয়ে মুক্ত প্রাণিদের দৌড়-ঝাঁপ দেখা হবে অনেক বেশি অকৃত্রিম। তবে নাবিল ও নাতাশার অভিযোগ: প্রাণিদের নিয়ে এ রকম প্রমোদ করা আনফেয়ার। তাদেরকে তাদের মতো থাকতে দাও। আমরা তাদের এলাকায় এসে ডিসটার্ব করছি। আমি বললাম- ঠিকই তো, আমরা এসে এদের রাজ্যে হামলা করছি। তবে আমরা কি তিমি ডলফিন না দেখে ফিরে যাব? এখানে আরো অনেকে আছে, আমরা ছাড়া আরো ৪ জন। তারা কি মানবে? এবারকার মতো আর কি করা যায়? ভবিষ্যতে সাবধান হবো।

সাগরে এক ডলফিন লাফ দিয়ে উঠে আমাদের আলাপে বিঘœ ঘটালো। নাবিল ও নাতাশা দুজনেই ‘ওয়াও’ বলে তাদের আনন্দ-উত্তেজনা প্রকাশ করল। তারা একটু আগের তোলা অভিযোগ ভুলে গেল, পাশে ডলফিনের লাফ দেখে তাদের আনন্দ আর ধরে না! বাকি সবাই সোল্লাসে হৈ চৈ নাচানাচি করে উঠলো।

এরপর বিশাল এক তিমি ভেসে উঠতেই আনন্দের সাথে যোগ হলো বিস্ময়! নীল আকাশের নিচে, নীল সাগরের জলে, বিশাল এক তিমি, তবে নীল রঙের নয়। তাও বিশালতা ও সৌন্দর্যের এক সমাহার! এর চেয়ে সুন্দর দৃশ্য আর কী হতে পারে! ‘এনজয় দি মোমেন্ট’- নাবিল-নাতাশার কথাটি মনে হলো। তাই ছবি-ভিডিও তোলা বাদ দিয়ে চোখ ভরে দেখতে লাগলাম এ অনুপম দৃশ্য।

এরপর আসল আরো অনেক তিমি, অনেক ডলফিন- ওপরে সিগাল- কত আকারের, কত ধরনের। আমাদের গাইড ভাঙা ইংরেজিতে এদের বর্ণনা দিয়ে যাচ্ছে। নাবিল নাতাশা সেদিকে কান দিচ্ছে না, কারণ তারা জানে ‘এনজয় দি মোমেন্ট’। তবে আমি মোমেন্ট এনজয় করার সাথে সাথে তা ছবিতে ধরে রাখার চেষ্টা করি।

খুব ইচ্ছে ছিল নীল রঙের তিমি দেখব। আমাদের গাইড আচাভেডো বলল, শীতকালে নীল তিমি এদিকে আসে না। যে সব তিমি বাইরে থেকে এখানে আসে, তারা আসে গরমকালে। তোমাদের ভাগ্য ভাল যে, আজ এতগুলি তিমি ও ডলফিন দেখেছ। নীল রঙের তিমি দেখতে হলে গরমকালে আসতে হবে। মে থেকে আগস্ট সবচেয়ে ভাল সময়। এখন যে তিমি দেখছ এগুলো সব স্থানীয় তিমি, অতিথি তিমি নয়। আমি হাসতে হাসতে বললাম, অতিথি হিসেবে আমরা আবার আসব অতিথি তিমির সাথে সাথে। তিমিরা থাকবে সাগরে, আমরা থাকব তোমার বাসায়। আচাভেডো এতক্ষণ পরে একবার হাসল, তবে মলিন সে হাসি। বলল, আমার নিজের বাসাতো নেই তোমাদের থাকতে দেব। আমি থাকি পাশেই এক বন্ধুর বাড়িতে, তার এক রুম ভাড়া নিয়ে। বললাম, এখানে সাগরের পাড়ে বাড়ি কিনে ফেলতে পার। আচাভেডো বলল, সে কোনোদিন সম্ভব হবে না। পুরো দুনিয়ার লোকজন এখানে আসে সাগর পাড়ে বাড়ি কিনতে। তার জন্য অনেক টাকার দরকার, তা আমার নেই। আর আমাকে সাহায্য করতে হয় আমার বুড়ো মাকে, যিনি থাকেন গ্রামে, এখান থেকে ৮০ মাইল দূরে। সাত বছর হলো, ডলফিন শিকার করতে যেয়ে এ সাগরের ঝড়ে প্রাণ হারিয়েছেন আমার বাবা। এটি বলে আচাভেডো তার বুকের লকেটে রাখা বাবার ছবি দেখাল। একটু থেমে সে তার বুকে ক্রস আঁকল বাবার জন্য প্রার্থনায়। মনে হলো আচাভেডোর দু-চোখের কোণ ভিজে উঠেছে। তারপর সাগরের দিকে আঙুল তুলে সে বলল: এরপরও এ সাগরকে নিয়েই চলছে আমার জীবন। আজ ছয় বছর এ নোনা জলে বোট চালিয়ে আসছি, পর্যটকদের সাগরের আনন্দ দেখাই, আর নিজের দুঃখকে ভুলে থাকতে চাই।

সাগরের আনন্দের মাঝে মানুষের এ দুঃখের কথাই তো লোরকা বলেছেন: “সাগর / দূর থেকে হেসে ওঠে। / দাঁত ঝিকিমিকি ফেনা, / আকাশস্বর্গের দুটি ঠোঁট। / ‘কী নিয়ে চলেছ খোলা বুকে বয়ে বাতাসের হাটে, / কালো মেয়ে?’ / ‘আমার বেসাত, বাবু, / সাগরের জল।’ / ‘কী নিয়ে চলেছ বয়ে রক্তে মিশোল, / কালো ছেলে?’ / ‘আমি নিয়ে যাই, বাবু, / সাগরের জল।’ / ‘মা গো, ওই নোনতা চোখের জল / কোনখান থেকে বয়ে আসে?; / ‘আমার কান্না যে, বাছা, / সাগরের জল।”১

সাগরের জলে লোরকা দেখেন মায়ের কান্না!

ফেরার পথে কল্পনায় দেখলাম সাগরে হারানো আচাভেডো-র বাবার মুখ ও দূর গ্রামে তার মায়ের কান্না। সাগর দেখে এবার নিয়ে আসলাম এক অনুভূতি- বিষাদের! ক্রমশ...

Ref: 1. Romance de la Sal, সাগরজলের বালাদ: অনুবাদ: দেবীপ্রসাদ বন্দ্যোপাধ্যায়

back to top