alt

ও বন্ধু আমার

শামীম আজাদ

: বৃহস্পতিবার, ২৩ অক্টোবর ২০২৫

প্রতিদিনই আমরা কিছু না কিছু হারাই

প্রতিদিনই কোথাও না কোথাও থেকে

কেউ না কেউ চলে যায়

একদিন, শুধু একদিনই

এতজনের মধ্য থেকে

কোনো একজন চলে গেলে

বাকি সকলেই

নিজ-উচ্চতা হারায়।

অপ্রত্যাশিত এবং আকস্মিক সংবাদ পেলাম মনজুর অসুস্থ। কিন্তু তারপর ক্ষণস্থায়ী একটু আলোর ঝিলিক দেখেছিলাম। সাত সাগর আর তেরো নদীর এপার থেকে তখন সকল আশংকা দূরে ঠেলে বিধাতার কাছে অবনত হয়েছিলাম, সারাক্ষণ, প্রার্থনায়। কিন্তু ভয়াবহ সে আশঙ্কা সত্যি হয়ে গেল। বিদেশে বসে এমন ভীষণ দুঃসংবাদ একজন মানুষকে একদম চোরাগুপ্তা হামলার মতো গুঁড়িয়ে ফেলে। ফোন করা ছাড়া কিছু করার থাকে না। যাদের করলাম তাদেরকে পেলাম আরো অস্থির আরো বেফানা। দেশে থাকলে দৌড়ে গিয়ে ভাইবেরাদরের গলা জড়িয়ে কাঁদতে পারতাম।কিন্তু এ শোকের উপশম হতো কি! উপরের ঐ নির্বিকার আকাশেই তাকাই, এ আকাশই তো বর্ধিত হয়ে আমার দেশেও ছাদ হয়ে আছে। আমরা সবাই পুরাতন এই অবিচলিত এক আকাশের নিচে হাহাকার করছি।

একসময় আর না পেরে আমার এই একজোড়া বয়স্ক নড়বড়ে পা নিয়েই উ™£ান্তের মতো হাঁটতে থাকি। মনে মনে বলি- আমি আছিও এ শোকের মিছিলে। শান্তি পাবো কোথায় গিয়ে? কোথায় গিয়ে একটু নিরলে বসে আমার বন্ধুর জন্য উচ্চৈঃস্বরে কাঁদতে পারবো? আমার ক্রন্দন ভেঙে দিতে কেউ বলবে না, এটাই নিয়ম, এভাবেই সবাইকে চলে যেতে হবে।তুমিও যাবে শামীম।

দেখি ভাবতেই ভাবতেই মাইল্যান্ডের ইংলিশ রোড-সংলগ্ন বিশাল বিশাল বৃক্ষ পরিবৃত পরিচিত সুমসাম সেমেট্রিতে চলে এসেছি।সামনে ও অদূরের দেখা মসে ঢাকা বহু পুরাতন সমাধি আর এপিটাফ। এই সমাধি স্থাপনাটা সেমেট্রি পার্ক বলেই সবাই জানে। পার্ক তো বলেই। এখানে মৃতের কাছে জীবিতের নিত্য আনাগোনা। দৈনন্দিন হাঁটা, দৌড় ও ভ্রমণ ছাড়াও আসে স্কুলের ছেলেমেয়েরা। তাঁদের শিক্ষক গাছ চেনান, ইতিহাস বলেন আর গাছের নিচের ঝরাপাতা দিয়ে বলেন জীবনের চক্রের গল্প। এমনকি নানান সংগঠনের কবিতা পাঠ ও নানান আয়োজনও হয়। এখানে একদল মানুষ স্বেচ্ছায় মাসে একদিন এর ময়লা পরিষ্কার করেন।ইদানীং আমিও যোগ দিয়েছি। মন খারাপ হলে চলে আসি।

মনে পড়লো কবরে এসে পা ভাঙার কারণে সে হেসেছিল। এমনি এক আর্দ্রদিনে স্কুলের ছেলেমেয়েদের শিক্ষা সফরে নিয়ে এসে হঠাৎ ভেজা ঘাসে পা ফসকে যায়। তারপর মাতিতে শুয়ে শুয়ে অবাক হয়ে উপরে তাকিয়ে দেখি গাছের ফাঁকে ফাঁকে লন্ডন হাসপাতালের হেলিকপ্টার এ্যাম্বুলেন্স ঘুরছে। একেবারে ফিল্মের মতো। মনজুর সে সময় নিউইয়র্কে বক্তৃতা যাবার পথে। লন্ডনের প্রীন স্ট্রিটে ছোটবোন বেবির বসায় যাত্রা বিরতীতে। পায়ে প্লাস্টার নিয়ে বাসায় ফিরে ফোনে হেলিকপ্টারের গল্প ক্রি। সে বলে আরে রাখো ‘ওয়ান ফুট ইন দ্য গ্রেইভেই তো চলে গেছিল!তুমিতো রীতিমত ভিক্টর মেল্ড্রু হয়ে গেছ। আসলে তখন বিবিসি টিভিতে ডেভিড রেইন উইকের লেখা জনপ্রিয় সিটকম ‘ওয়ান ফুট ইন দা গ্রেভ’ চলছিলো। মেজাজি বুড়োর অভিনয় করে ভিক্টর মেল্ড্রু খুব নাম করেছিলেন।ওঁর মতো এত ওয়াকিবহাল আমার কোন বন্ধু ছিল না।

আমার শিল্পযাত্রার সতীর্থ মনজুর বিশ্ববিদ্যালয়ে আমার এক ক্লাস উপরে পড়তেন। ক্ষীণ আত্মীয়তার বন্ধনও ছিলো আর আমরা সিলেটীও।আড্ডায় বসলে অপ্রচলিত সিলেটী শব্দের ব্যঞ্জনা ও বুৎপত্তি নিয়ে হাস্যরসে বিলেতের কত রাত গভীর হয়েছে! সে সময় কোনো না কোনো ভাবে তাঁর হুরু নানা সৈয়দ মুজতবা আলীর গল্প চলে আসতো। হুরু নানার মধুমেহ ছিলো বলেই মনজুরকে বলতেন মিষ্টি কিনে সোজা তাঁর ধানমন্ডির বাড়ির ছাদে গিয়ে অপেক্ষা করতে। কিন্তুপ্রায়শই নানা-নাতি ধরা পড়তেন নানীর কাছে। কখনো এই বেড়াবার স্বল্প সময়েও আমার কবিতা নিয়ে দু’জনে অনুবাদ করেছি।কবিতায় সিলেটী শব্দের ব্যবহার তাঁকে আনন্দিত করতো।

১৯৮৮/৮৯-এ আমেরিকান কবি ক্যারোলাইন রাইট বাংলাদেশের কবি-নারীদের কবিতা অনুবাদ করেন যৌথভাবে। ফাইনাল পর্যায়ে তাঁরা বসেছেন কবির সঙ্গে। আমাদের কী দারুণ আড্ডা হয়েছে রুবী রহমান, দিলারা হাফিজ, তসলিমা নাসরীন, নাসিমা সুলতানার সঙ্গে। ছোট একটা গাড়ি চালিয়ে পরিবাগে পার্ক করেই চলতো ধুম শিল্প আড্ডা। মনজুরের সে সময়ের হৃদয় দিয়ে কাজ করাতেই না আমি এই বিভূঁইয়ে কবি হিসেবে মিডিয়ার নজরেই পড়লাম। অনেকটা বিশ্ব-মানচিত্রে বাংলাদেশের ক্রিকেটে পরিচিতির মতো। তার আগে আমাদের দেশখানা ঝড়জল, দারিদ্র্য আর বন্যার জন্যই ছিল পরিচিত। তেমনি বিলেতে পরিচয়ই ছিল বাংলা টাউন কারি রেস্তোঁরা ও কারি-বাণিজ্য। সেখান থেকেই আমার যুক্ততা ব্যাপ্ত হলো সামার ইউনিভারসিটির কবিতা প্রশিক্ষক হিসেবে।কবিতা নিয়ে এলাম বৈশাখী মেলায়, বইলিট ফেস্টিভ্যালে ও অল্টারনেটিভ আর্টসে। আর আমার রিজার্ভয়ার ছিলো আমার বন্ধু। বাংলা থেকে ইংরাজি কবিতা লেখার প্রেরণাও তারই। বলেছিল, আর কতদিন আমাদের অনুবাদ ফেরী করবে শামীম? তোমারই ক্লাসে, ইংলিশ কারিকুলম পড়ানোর সময় তোমারই হাতেধরে ছেলেমেয়েরা ইংরাজি কবিতা গল্প লিখছে-তুমি শুরু করো তো! সত্যিকার অর্থে সৈয়দ মনজুরুল ইসলামের মতো দ্বিভাষিক সাহিত্যিক এমন একজনই আমাদের ছিলেন। যখন তখন পরামর্শের জন্য ফোন করতাম। কাজে থাকলে মোবাইলে টেক্সট আসতো, আমি ক্লাস শেষে ফোন করছি শামীম।ইংল্যান্ডে আমার কাজের জন্য মনজুর ছিলেন বাংলাদেশের এক অপরিহার্য অনুপান। লন্ডন বারা অব টাওয়ার হ্যামলেটসে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের সার্ধ শতবার্ষিকীর মূল প্রবন্ধ, নজরুল সেন্টারে আলোচনা, সোয়াসে উইলিয়াম রাদিচের সঙ্গে বিদেশিদের বাংলা ভাষা শিক্ষার কার্যক্রম ও কৌশল নিয়ে কথা, সৈয়দ মুজতবা আলী উৎসব পরিকল্পনা, হাসন, লালন যা কিছুই আমরা বিলেতে উদ্যোগ নিয়েছি তাঁকে ছাড়া এগুতে পারিনি। তাঁর মননে পাশ্চাত্যের ভাবধারা ও সংস্কৃতিতে প্রাচ্যের প্রাজ্ঞ প-িত্য ছিলো সমান্তরাল। আমরা তাঁকে এ্যাম্ফিয়ান বলতাম।

তো ১৯৯৭ সালের কথা, ভারত উপমহাদেশের স্বাধীনতার ৫০ বছর পূর্তি উপলক্ষে ইংল্যান্ডে নানান তোড়জোর চলছে। আমিও সে উপলক্ষে লন্ডন ইন্টারন্যাশনাল ফেস্টিভ্যাল অব থিয়েটার (লিফট)-এ দুই বছর মেয়াদি এক আবাসিকত্ব পেয়েছি। দিন ঘনিয়ে আসছে, প্রমেনোদ স্টাইলে টেমসের পাড়ে ডকল্যান্ডে বিশাল উৎসব হবে। কবি ও স্টোরিটেলার হিসেবে প্রশিক্ষকের কাজ করছি।এমন সময় আমেরিকার নিউইয়োর্কার পত্রিকার বিশেষ সংখ্যায় আমার কবিতা নির্বাচিত হয়েছে সে সংবাদ পাই। আর তো আমার মাথা খারাপ হবার দশা। সংখ্যাটিতে সালমান রুশদি, বিক্রম জাব্বালা, অমিতাভ ঘোষ বা চৌধুরী, অরুদ্ধতী রায় এদের মতো সাহিত্যিকদের পাকিস্তানের স্বনামধন্য আরো একজন সঙ্গে বাংলাদেশের শুধু একটি অনুবাদ কবিতা ‘ডই মোস্ট বিউটিফুল সুইট থিং’ ছাপা হয়েছে- আর তা এই নগণ্য কবির! সে এক দারুণ কা-! আমি নিউইয়র্কারের কারের একটি সংখ্যা হাতে তাঁকে নিয়ে গাড়ি চালিয়ে তাঁকে নিয়ে গেলাম হার্ভেস্টারে। সেদিন উজ্জ্বল বিকেলে বাইরে বাগানে একটা ভিমরুল ভোঁ ভোঁ করে উড়ছিল। একপর্যায়ে আবেগে ভরপুর গলায় বললাম, জানো সৈয়দ জাফরি এ কবিতার প্রশস্তি করে আমাকে দোয়া করে দিয়েছেন। এর সবই হয়েছে তোমাদের অসম্ভব সুন্দর ইংরাজি অনুবাদের কারণে! হেসে অভিনন্দন জানিয়ে সিলেটীতে বলে উঠেছিল, আর ভু ভু না। স্টপ! জলদি জলদি দেখাও নিজর নামতা ছাপার অকর্মে ডেকি। তোমার কবিতার দায় নিউইয়োর্কারো আমার নাম ছাপা অইছে!বুঝুন! কে কাকে বলে? এত মহাত্মা আমার বন্ধুর।

সড়ক চিহ্নিত হয় কিলোমিটার ফলকে। মানুষ চিহ্নিত হয় ব্যতিক্রমী আচারে।আর একটি দেশের ছায়া থেকে আরেকটি দেশের ছায়া আলাদা করা যায় তার উচ্চতা কিংবা অধগামিতা চিহ্নায়নে। আমাদের যে স্বল্প ক’জন মানুষ হতভাগা দেশটিকে এক উচ্চতায় নিয়ে যাচ্ছিলেন মনজুরের অকস্মাৎ প্রয়াণে সব ছানবইন হয়ে গেল।অভাগা দেশের কথাই বড়ো বেশি মনে হচ্ছে। সদ্য প্রয়াত এমিরিটাস এ অধ্যাপক ছিলেন জনপ্রিয় শিক্ষক, পরিশীলিত ব্যক্তিত্ব, শিল্প-বিদগ্ধ, খাঁটি দেশপ্রেমিক, বিরল সাহিত্যিক, নিপুণ অনুবাদক, প্রাগ্রসর চিন্তক, পবিত্রাত্মা। এদেশে এমন মানুষ তো দশকে দশকেও জন্মায় না। তাঁর এবং তাঁরই মতো ব্যক্তিত্বের কারণে আমরা বাংলাদেশের শিল্প সাহিত্য শিক্ষা এবং নৈতিকতার ক্ষেত্রে একটা ভরসার জায়গা তৈরি হয়েছিলো। বহুমাত্রিক মনজুর ছিলেন আমাদের শিল্পের শ্বাসে অক্সিজেন। এই একজন মানুষকে দেখেছি যিনি একা একা নয় যূথবদ্ধভাবে বেড়ে ওঠায় বিশ্বাস করতেন। সামগ্রিক উচ্চতা অর্জনে আস্থা রাখতেন। দেশের এই ক্রান্তি কালে শুধু মনে হচ্ছে মনে হচ্ছে আমরা যেন খাটো থেকে আরো খাটো হয়ে গেছি।

আমি এদিক ওদিক তাকাই।মনে পড়ে যায় শঙ্খ ঘোষের হামাগুড়ি কবিতাটা। বিশ্বের কাছে আমাদের ওজন হ্রাস পেয়েছে। এখন যেন আমাদের আমাদের উচ্চতাও যেতে বসেছে।আমি খুঁজছি আমাদের উচ্চতা।

বাইরে মানুষভরা দোতলা লালবাস চলে গেল। ফুটপাত ধরে শিশুর হাত ধরে পার্কে প্রবেশ করছে এক অল্প বয়সী মা। আশ্চর্য, সবই চলছে ঠিকঠাক শুধু মনজুর নেই। আমি আর উঠতে পারছি না। মন ভারি হলে নাকি মানুষ গা ছেড়ে দেয় আর সে মানুষ মৃতদেহের সমান হয়ে যায়। আমি যাবই বা কোথায়? বন্ধু চলে গেলে গন্তব্যও গুলিয়ে যায়।তাকিয়ে দেখি একটি টকটকে লাল পাতা শাখা থেকে টুপ করে পড়ে গেল। সমৃদ্ধ হলে পরে কেউ কি আর থাকে! না, স্থান পাল্টায়!

মানুষ চলে গেলে পালক ফেলে যায়

জ্ঞাতি-চিহ্ন খুঁজে খুঁজে পরশ বুলায়

হে বন্ধু বিদায়...

ছবি

সত্যেন সেনের উপন্যাস: মিথ ও ইতিহাসলগ্ন মানুষ

ছবি

বিস্ময়ের সীমা নাই

ছবি

নগর বাউল ও ত্রিকালদর্শী সন্ত কবি শামসুর রাহমান

সাময়িকী কবিতা

ছবি

লোরকার দেশে

ছবি

শামসুর রাহমানের কবিতায় ‘মিথ’

ছবি

বহুমাত্রিক শামসুর রাহমান

ছবি

দূর-সময়ের সার্বভৌম কবি

ছবি

মাহফুজ আল-হোসেন-এর দশটি কবিতা

ছবি

মনোজগতের অন্বেষায়

সাময়িকী কবিতা

ছবি

এক ঘর রোদ

ছবি

দ্রোহের রম্য পঙ্ক্তিমালা

ছবি

সংবেদী রঙে ও রেখায় প্রাণের উন্মোচন

ছবি

অলস দিনের হাওয়া

ছবি

লাসলো ক্রাসনাহোরকাইয়ের মর্মস্পর্শী ও দূরদর্শী সাহিত্যকর্ম

ছবি

‘ভাষার আরোপিত কারুকাজে খেই হারিয়ে ফেলি’

ছবি

সৈয়দ মনজুরুল ইসলামের জিন্দা লাশ কি প্রকৃত লাশ

ছবি

সৈয়দ মনজুরুল ইসলামের শিক্ষা দর্শন ও অলস দিনের হাওয়া

ছবি

ধ্রুপদী বোধ ও ব্যাধির কবিতা

ছবি

সুকান্তর কবিতায় বিপ্লবী চেতনা

সাময়িকী কবিতা

ছবি

মগ্নচৈতন্যে সৌন্দর্যধ্যান

ছবি

অধুনাবাদী নিরীক্ষার অগ্রসাধক

ছবি

‘বায়ান্নর আধুনিকতা ও প্রগতিশীল ধারাকে বহন করতে চেয়েছি’

ছবি

জাতীয় চেতনার অমলিন ধারক

ছবি

নক্ষত্রের অনন্ত যাত্রা

ছবি

আহমদ রফিক ও ভাষামুক্তি সাধনা

ছবি

কবি আসাদ চৌধুরী : ঘরে ফেরা হলো না তাঁর

ছবি

জীবনবোধের অনবদ্য চিত্ররূপ ‘স্বপ্নছোঁয়ার পদযাত্রা’

ছবি

অনালোকিত ইতিহাসের সন্ধানে

ছবি

কবিরের দোঁহা

ছবি

আকবর হোসেন ও ‘যৌবনটাই জীবন নয়’

ছবি

স্বোপার্জিত

ছবি

সংগ্রামের অগ্নিশিখা থেকে হেলাল হাফিজ

ছবি

কোনো এক শরৎসন্ধ্যা : কোথায় পাব তারে

tab

ও বন্ধু আমার

শামীম আজাদ

বৃহস্পতিবার, ২৩ অক্টোবর ২০২৫

প্রতিদিনই আমরা কিছু না কিছু হারাই

প্রতিদিনই কোথাও না কোথাও থেকে

কেউ না কেউ চলে যায়

একদিন, শুধু একদিনই

এতজনের মধ্য থেকে

কোনো একজন চলে গেলে

বাকি সকলেই

নিজ-উচ্চতা হারায়।

অপ্রত্যাশিত এবং আকস্মিক সংবাদ পেলাম মনজুর অসুস্থ। কিন্তু তারপর ক্ষণস্থায়ী একটু আলোর ঝিলিক দেখেছিলাম। সাত সাগর আর তেরো নদীর এপার থেকে তখন সকল আশংকা দূরে ঠেলে বিধাতার কাছে অবনত হয়েছিলাম, সারাক্ষণ, প্রার্থনায়। কিন্তু ভয়াবহ সে আশঙ্কা সত্যি হয়ে গেল। বিদেশে বসে এমন ভীষণ দুঃসংবাদ একজন মানুষকে একদম চোরাগুপ্তা হামলার মতো গুঁড়িয়ে ফেলে। ফোন করা ছাড়া কিছু করার থাকে না। যাদের করলাম তাদেরকে পেলাম আরো অস্থির আরো বেফানা। দেশে থাকলে দৌড়ে গিয়ে ভাইবেরাদরের গলা জড়িয়ে কাঁদতে পারতাম।কিন্তু এ শোকের উপশম হতো কি! উপরের ঐ নির্বিকার আকাশেই তাকাই, এ আকাশই তো বর্ধিত হয়ে আমার দেশেও ছাদ হয়ে আছে। আমরা সবাই পুরাতন এই অবিচলিত এক আকাশের নিচে হাহাকার করছি।

একসময় আর না পেরে আমার এই একজোড়া বয়স্ক নড়বড়ে পা নিয়েই উ™£ান্তের মতো হাঁটতে থাকি। মনে মনে বলি- আমি আছিও এ শোকের মিছিলে। শান্তি পাবো কোথায় গিয়ে? কোথায় গিয়ে একটু নিরলে বসে আমার বন্ধুর জন্য উচ্চৈঃস্বরে কাঁদতে পারবো? আমার ক্রন্দন ভেঙে দিতে কেউ বলবে না, এটাই নিয়ম, এভাবেই সবাইকে চলে যেতে হবে।তুমিও যাবে শামীম।

দেখি ভাবতেই ভাবতেই মাইল্যান্ডের ইংলিশ রোড-সংলগ্ন বিশাল বিশাল বৃক্ষ পরিবৃত পরিচিত সুমসাম সেমেট্রিতে চলে এসেছি।সামনে ও অদূরের দেখা মসে ঢাকা বহু পুরাতন সমাধি আর এপিটাফ। এই সমাধি স্থাপনাটা সেমেট্রি পার্ক বলেই সবাই জানে। পার্ক তো বলেই। এখানে মৃতের কাছে জীবিতের নিত্য আনাগোনা। দৈনন্দিন হাঁটা, দৌড় ও ভ্রমণ ছাড়াও আসে স্কুলের ছেলেমেয়েরা। তাঁদের শিক্ষক গাছ চেনান, ইতিহাস বলেন আর গাছের নিচের ঝরাপাতা দিয়ে বলেন জীবনের চক্রের গল্প। এমনকি নানান সংগঠনের কবিতা পাঠ ও নানান আয়োজনও হয়। এখানে একদল মানুষ স্বেচ্ছায় মাসে একদিন এর ময়লা পরিষ্কার করেন।ইদানীং আমিও যোগ দিয়েছি। মন খারাপ হলে চলে আসি।

মনে পড়লো কবরে এসে পা ভাঙার কারণে সে হেসেছিল। এমনি এক আর্দ্রদিনে স্কুলের ছেলেমেয়েদের শিক্ষা সফরে নিয়ে এসে হঠাৎ ভেজা ঘাসে পা ফসকে যায়। তারপর মাতিতে শুয়ে শুয়ে অবাক হয়ে উপরে তাকিয়ে দেখি গাছের ফাঁকে ফাঁকে লন্ডন হাসপাতালের হেলিকপ্টার এ্যাম্বুলেন্স ঘুরছে। একেবারে ফিল্মের মতো। মনজুর সে সময় নিউইয়র্কে বক্তৃতা যাবার পথে। লন্ডনের প্রীন স্ট্রিটে ছোটবোন বেবির বসায় যাত্রা বিরতীতে। পায়ে প্লাস্টার নিয়ে বাসায় ফিরে ফোনে হেলিকপ্টারের গল্প ক্রি। সে বলে আরে রাখো ‘ওয়ান ফুট ইন দ্য গ্রেইভেই তো চলে গেছিল!তুমিতো রীতিমত ভিক্টর মেল্ড্রু হয়ে গেছ। আসলে তখন বিবিসি টিভিতে ডেভিড রেইন উইকের লেখা জনপ্রিয় সিটকম ‘ওয়ান ফুট ইন দা গ্রেভ’ চলছিলো। মেজাজি বুড়োর অভিনয় করে ভিক্টর মেল্ড্রু খুব নাম করেছিলেন।ওঁর মতো এত ওয়াকিবহাল আমার কোন বন্ধু ছিল না।

আমার শিল্পযাত্রার সতীর্থ মনজুর বিশ্ববিদ্যালয়ে আমার এক ক্লাস উপরে পড়তেন। ক্ষীণ আত্মীয়তার বন্ধনও ছিলো আর আমরা সিলেটীও।আড্ডায় বসলে অপ্রচলিত সিলেটী শব্দের ব্যঞ্জনা ও বুৎপত্তি নিয়ে হাস্যরসে বিলেতের কত রাত গভীর হয়েছে! সে সময় কোনো না কোনো ভাবে তাঁর হুরু নানা সৈয়দ মুজতবা আলীর গল্প চলে আসতো। হুরু নানার মধুমেহ ছিলো বলেই মনজুরকে বলতেন মিষ্টি কিনে সোজা তাঁর ধানমন্ডির বাড়ির ছাদে গিয়ে অপেক্ষা করতে। কিন্তুপ্রায়শই নানা-নাতি ধরা পড়তেন নানীর কাছে। কখনো এই বেড়াবার স্বল্প সময়েও আমার কবিতা নিয়ে দু’জনে অনুবাদ করেছি।কবিতায় সিলেটী শব্দের ব্যবহার তাঁকে আনন্দিত করতো।

১৯৮৮/৮৯-এ আমেরিকান কবি ক্যারোলাইন রাইট বাংলাদেশের কবি-নারীদের কবিতা অনুবাদ করেন যৌথভাবে। ফাইনাল পর্যায়ে তাঁরা বসেছেন কবির সঙ্গে। আমাদের কী দারুণ আড্ডা হয়েছে রুবী রহমান, দিলারা হাফিজ, তসলিমা নাসরীন, নাসিমা সুলতানার সঙ্গে। ছোট একটা গাড়ি চালিয়ে পরিবাগে পার্ক করেই চলতো ধুম শিল্প আড্ডা। মনজুরের সে সময়ের হৃদয় দিয়ে কাজ করাতেই না আমি এই বিভূঁইয়ে কবি হিসেবে মিডিয়ার নজরেই পড়লাম। অনেকটা বিশ্ব-মানচিত্রে বাংলাদেশের ক্রিকেটে পরিচিতির মতো। তার আগে আমাদের দেশখানা ঝড়জল, দারিদ্র্য আর বন্যার জন্যই ছিল পরিচিত। তেমনি বিলেতে পরিচয়ই ছিল বাংলা টাউন কারি রেস্তোঁরা ও কারি-বাণিজ্য। সেখান থেকেই আমার যুক্ততা ব্যাপ্ত হলো সামার ইউনিভারসিটির কবিতা প্রশিক্ষক হিসেবে।কবিতা নিয়ে এলাম বৈশাখী মেলায়, বইলিট ফেস্টিভ্যালে ও অল্টারনেটিভ আর্টসে। আর আমার রিজার্ভয়ার ছিলো আমার বন্ধু। বাংলা থেকে ইংরাজি কবিতা লেখার প্রেরণাও তারই। বলেছিল, আর কতদিন আমাদের অনুবাদ ফেরী করবে শামীম? তোমারই ক্লাসে, ইংলিশ কারিকুলম পড়ানোর সময় তোমারই হাতেধরে ছেলেমেয়েরা ইংরাজি কবিতা গল্প লিখছে-তুমি শুরু করো তো! সত্যিকার অর্থে সৈয়দ মনজুরুল ইসলামের মতো দ্বিভাষিক সাহিত্যিক এমন একজনই আমাদের ছিলেন। যখন তখন পরামর্শের জন্য ফোন করতাম। কাজে থাকলে মোবাইলে টেক্সট আসতো, আমি ক্লাস শেষে ফোন করছি শামীম।ইংল্যান্ডে আমার কাজের জন্য মনজুর ছিলেন বাংলাদেশের এক অপরিহার্য অনুপান। লন্ডন বারা অব টাওয়ার হ্যামলেটসে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের সার্ধ শতবার্ষিকীর মূল প্রবন্ধ, নজরুল সেন্টারে আলোচনা, সোয়াসে উইলিয়াম রাদিচের সঙ্গে বিদেশিদের বাংলা ভাষা শিক্ষার কার্যক্রম ও কৌশল নিয়ে কথা, সৈয়দ মুজতবা আলী উৎসব পরিকল্পনা, হাসন, লালন যা কিছুই আমরা বিলেতে উদ্যোগ নিয়েছি তাঁকে ছাড়া এগুতে পারিনি। তাঁর মননে পাশ্চাত্যের ভাবধারা ও সংস্কৃতিতে প্রাচ্যের প্রাজ্ঞ প-িত্য ছিলো সমান্তরাল। আমরা তাঁকে এ্যাম্ফিয়ান বলতাম।

তো ১৯৯৭ সালের কথা, ভারত উপমহাদেশের স্বাধীনতার ৫০ বছর পূর্তি উপলক্ষে ইংল্যান্ডে নানান তোড়জোর চলছে। আমিও সে উপলক্ষে লন্ডন ইন্টারন্যাশনাল ফেস্টিভ্যাল অব থিয়েটার (লিফট)-এ দুই বছর মেয়াদি এক আবাসিকত্ব পেয়েছি। দিন ঘনিয়ে আসছে, প্রমেনোদ স্টাইলে টেমসের পাড়ে ডকল্যান্ডে বিশাল উৎসব হবে। কবি ও স্টোরিটেলার হিসেবে প্রশিক্ষকের কাজ করছি।এমন সময় আমেরিকার নিউইয়োর্কার পত্রিকার বিশেষ সংখ্যায় আমার কবিতা নির্বাচিত হয়েছে সে সংবাদ পাই। আর তো আমার মাথা খারাপ হবার দশা। সংখ্যাটিতে সালমান রুশদি, বিক্রম জাব্বালা, অমিতাভ ঘোষ বা চৌধুরী, অরুদ্ধতী রায় এদের মতো সাহিত্যিকদের পাকিস্তানের স্বনামধন্য আরো একজন সঙ্গে বাংলাদেশের শুধু একটি অনুবাদ কবিতা ‘ডই মোস্ট বিউটিফুল সুইট থিং’ ছাপা হয়েছে- আর তা এই নগণ্য কবির! সে এক দারুণ কা-! আমি নিউইয়র্কারের কারের একটি সংখ্যা হাতে তাঁকে নিয়ে গাড়ি চালিয়ে তাঁকে নিয়ে গেলাম হার্ভেস্টারে। সেদিন উজ্জ্বল বিকেলে বাইরে বাগানে একটা ভিমরুল ভোঁ ভোঁ করে উড়ছিল। একপর্যায়ে আবেগে ভরপুর গলায় বললাম, জানো সৈয়দ জাফরি এ কবিতার প্রশস্তি করে আমাকে দোয়া করে দিয়েছেন। এর সবই হয়েছে তোমাদের অসম্ভব সুন্দর ইংরাজি অনুবাদের কারণে! হেসে অভিনন্দন জানিয়ে সিলেটীতে বলে উঠেছিল, আর ভু ভু না। স্টপ! জলদি জলদি দেখাও নিজর নামতা ছাপার অকর্মে ডেকি। তোমার কবিতার দায় নিউইয়োর্কারো আমার নাম ছাপা অইছে!বুঝুন! কে কাকে বলে? এত মহাত্মা আমার বন্ধুর।

সড়ক চিহ্নিত হয় কিলোমিটার ফলকে। মানুষ চিহ্নিত হয় ব্যতিক্রমী আচারে।আর একটি দেশের ছায়া থেকে আরেকটি দেশের ছায়া আলাদা করা যায় তার উচ্চতা কিংবা অধগামিতা চিহ্নায়নে। আমাদের যে স্বল্প ক’জন মানুষ হতভাগা দেশটিকে এক উচ্চতায় নিয়ে যাচ্ছিলেন মনজুরের অকস্মাৎ প্রয়াণে সব ছানবইন হয়ে গেল।অভাগা দেশের কথাই বড়ো বেশি মনে হচ্ছে। সদ্য প্রয়াত এমিরিটাস এ অধ্যাপক ছিলেন জনপ্রিয় শিক্ষক, পরিশীলিত ব্যক্তিত্ব, শিল্প-বিদগ্ধ, খাঁটি দেশপ্রেমিক, বিরল সাহিত্যিক, নিপুণ অনুবাদক, প্রাগ্রসর চিন্তক, পবিত্রাত্মা। এদেশে এমন মানুষ তো দশকে দশকেও জন্মায় না। তাঁর এবং তাঁরই মতো ব্যক্তিত্বের কারণে আমরা বাংলাদেশের শিল্প সাহিত্য শিক্ষা এবং নৈতিকতার ক্ষেত্রে একটা ভরসার জায়গা তৈরি হয়েছিলো। বহুমাত্রিক মনজুর ছিলেন আমাদের শিল্পের শ্বাসে অক্সিজেন। এই একজন মানুষকে দেখেছি যিনি একা একা নয় যূথবদ্ধভাবে বেড়ে ওঠায় বিশ্বাস করতেন। সামগ্রিক উচ্চতা অর্জনে আস্থা রাখতেন। দেশের এই ক্রান্তি কালে শুধু মনে হচ্ছে মনে হচ্ছে আমরা যেন খাটো থেকে আরো খাটো হয়ে গেছি।

আমি এদিক ওদিক তাকাই।মনে পড়ে যায় শঙ্খ ঘোষের হামাগুড়ি কবিতাটা। বিশ্বের কাছে আমাদের ওজন হ্রাস পেয়েছে। এখন যেন আমাদের আমাদের উচ্চতাও যেতে বসেছে।আমি খুঁজছি আমাদের উচ্চতা।

বাইরে মানুষভরা দোতলা লালবাস চলে গেল। ফুটপাত ধরে শিশুর হাত ধরে পার্কে প্রবেশ করছে এক অল্প বয়সী মা। আশ্চর্য, সবই চলছে ঠিকঠাক শুধু মনজুর নেই। আমি আর উঠতে পারছি না। মন ভারি হলে নাকি মানুষ গা ছেড়ে দেয় আর সে মানুষ মৃতদেহের সমান হয়ে যায়। আমি যাবই বা কোথায়? বন্ধু চলে গেলে গন্তব্যও গুলিয়ে যায়।তাকিয়ে দেখি একটি টকটকে লাল পাতা শাখা থেকে টুপ করে পড়ে গেল। সমৃদ্ধ হলে পরে কেউ কি আর থাকে! না, স্থান পাল্টায়!

মানুষ চলে গেলে পালক ফেলে যায়

জ্ঞাতি-চিহ্ন খুঁজে খুঁজে পরশ বুলায়

হে বন্ধু বিদায়...

back to top