alt

পথ ভিন্ন : প্রসঙ্গ লালন

আনোয়ারুল হক

: বৃহস্পতিবার, ০৬ নভেম্বর ২০২৫

সাধন সংগীতের জগতে তিনি লালন সাঁই, লালন ফকির নামে পরিচিত। লালন নামে বিখ্যাত হওয়ার আগে তাঁর পিতৃপ্রদত্ত নাম ছিল, লালমোহন কর। পিতার নাম মাধব কর, মাতার নাম পদ্মাবতী। হিন্দু কায়স্থ পরিবারের একমাত্র সন্তান ছিলেন। শৈশবেই তাঁর পিতার মৃত্যু হয়। জন্মভিটা এলাকায় প্রতিবেশীরা নাকি তাঁকে ‘লালু’ নামেও ডাকত। গড়াই নদীর তীরবর্তী ভাঁড়ারা (চাপড়া গ্রামসংলগ্ন) গ্রামে লালন ১৭৭৪ খ্রিস্টাব্দে জন্মগ্রহণ করেন। ১১৬ বছর বয়সে ১৮৯০ খ্রিস্টাব্দে (১২৯৭ বঙ্গাব্দের ১ কার্তিক) ১৭ অক্টোবর ভোর পাঁচটায় ছেঁউরিয়ার আখড়ায় সজ্ঞানে দেহত্যাগ করেন। মৃত্যুকালে নিঃসন্তান লালন বিশোখা নামে তাঁর স্ত্রী ও পিয়ারী নামে একজন ধর্মকন্যা রেখে যান।

আর্থিক অসংগতির জন্য কোনো প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা লালনের গ্রহণ করা হয়নি। জন্মভিটা ছিল ভাটি অঞ্চল, যেখানে ঘোর বর্ষাকালে নৌকো ছাড়া চলার কোন উপায় নেই। তবে, এলাকা জুড়ে ছিল সাংগীতিক ঐতিহ্য। সেকালের লোক-সংস্কৃতি লালিত আঞ্চলিক পরিবেশ লালনের মানস গঠনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছে। শীত-গ্রীষ্মে পায়ে হাঁটা পথে দেখা পাওয়া যেত যাত্রা দল, লোকসংগীতের মহাজনদের। সেখানে প্রকৃতি ছিল খোলামেলা, আবারিত উদার। উতল হাওয়ায় লাজবনত নারীর গায়ের বসন পতাকার মতো ওড়ে। পুরুষের ধূতি, তবন। শরৎ বিকেলে আকাশে রঙের খেলা লালনের মনের চোখে ঝিমধরা রহস্য সৃষ্টি করতো না-এমন উচ্চারণ অযৌক্তিক।

জ্ঞতি-কুটুম্বদের সঙ্গে বনিবনা না হওয়ায় লালন মা ও স্ত্রীকে নিয়ে ভাঁড়ারা গ্রমের ভিতরেই দাসপাড়ায় সরে এসে আলাদাভাবে বসবাস করতে শুরু করেছিলেন। ভদ্রলোকের সংখ্যা সেখানে খুব একটা ছিল না। তবে, সাংগীতিক আবহাওয়া ছিল- যা কিনা লালনের ভাবুক মনকে ভিতরে ভিতরে নাড়া দিয়েছে। প্রচলিত আছে, যুবক লালুর একমাত্র শখ বা বিনোদন ছিল, গভীর রাতে দাসপাড়ার মাঠে একাকী ঘোড়ার পিঠে চড়ে বেড়ানো। ওর নিজের কোনো ঘোড়া অবশ্য ছিল না। দাসপাড়া গ্রামের কবিরাজ শুদ্ধাচারী কৃষ্ণপ্রসন্ন সেন ছিলেন ঘোড়ার মালিক। নিঝুম রাতে কবিরাজ মশাইয়ের ঘোড়া চুরি করে লালন দাসপাড়ার মাঠে প্রায় রাতে ঘোরাঘুরি করতো। আস্তাবলে একরাতে ঘোড়া ফেরত দিতে গিয়ে বাড়ির চাকদের হাতে লালন ধরা পড়ে। চোর চুরি করে তা আবার ফেরৎ দিতে আসে- এমন আশ্চর্য কথা লালনের মুখে শুনে কবিরাজ কৃষ্ণপ্রসন্ন বুঝতে পেরেছিলেন, ছন্নছাড়া, সাদাসিধে প্রকৃতির নিশাচর এই যুবক আর যাই হোক, ‘চোর’ নয়। দোষীকে সামনে নিয়ে এলে তিনি লালনের লালাটে দুই-এক বছরের মধ্যে বড় একটা ‘ফাঁড়া’ দিব্যচোখে দেখতে পেলেন। যাতে তার মৃত্যুও হতে পারে। জানিয়েও দিলেন। এটি গল্প।

তবে, লালনের জীবনে এই ‘ফাঁড়া’ ফলেছিল। দাসপাড়ারই প্রতিবেশি বাউলদাস ও অন্যান্য সঙ্গীদের সঙ্গে যুবক লালন মুর্শিদাবাদ জেলার বহরমপুরে গঙ্গাস্নানে গিয়েছিলেন। গঙ্গাস্নান সেরে ফিরে আসার পথে প্রাণঘাতী জলবসন্তে আক্রান্ত হয়ে লালন ঘোর অচৈতন্য হয়ে পড়েন। সঙ্গীরা লালনকে মৃত ভেবে কোনোরকম মুখাগ্নি করে কলাগাছের ভেলায় করে নদীতে ভাসিয়ে দেয়। এই দলটি দাসপাড়া গ্রামে ফিরে এসে লালনের মৃত্যুসংবাদ প্রচার করে। লালনের বিধবা মা এবং স্ত্রী এই মৃত্যু সংবাদ দুর্ভাগ্য হিসেবে মেনে নেয়।

অপরদিকে, লালনের অচৈতন্য দেহ নদীতে ভাসতে ভাসতে কুষ্টিয়ার ছেঁউরিয়ার কালীগঙ্গা নদীর কূলে এসে ঠেকে। দৈবক্রমে রাবেয়া নামে এক বিধবা মুসলিম নারী নদীতে ভেলায় ভেসে আসা মৃতপ্রায় লালনকে নদী থেকে অন্যদের সহায়তায় তুলে গৃহে নিয়ে যান। দয়াবতী মুসলিম এই নারীর অক্লান্ত সেবায় লালন জীবন ফিরে পান। কিন্তু বসন্তরোগে তাঁর একটি চোখ নষ্ট ও মুখে গভীর ক্ষতচিহ্ন সৃষ্টি হয়। সুস্থ হয়ে লালন ফিরে গিয়েছিলেন নিজ গ্রামে জন্মদাত্রী মা ও স্ত্রীর কাছে। কিন্তু গ্রামের সমাজপতি ও আত্মীয়স্বজন লালনের এই অভাবনীয় প্রত্যাবর্তনকে অশুভ হিসেবে চিহ্নিত করে। তারা মুসলামানের গৃহে অন্নজল গ্রহণের কারণে এবং পারলৌকিক ক্রিয়া-অনুষ্ঠান শেষে জীবিত লালনকে গ্রহণ করতে অস্বীকৃতি জ্ঞাপন করে। সমাজ ও স্বজন কর্তৃক এভাবে লালন প্রত্যাখ্যাত হলে মনের দুঃখে তিনি চিরতরের জন্য গৃহত্যাগ করেন।

লালনের সমাজ সংসার ত্যাগের এই কাহিনি আমাদের জানা। এর চেয়ে একটু বেশি জানার আগ্রহ আমাদের এই যে, একজন অশিক্ষিত গ্রাম্য যুবক লালমোহন কর কোন প্রেরণায় ‘লালন’ হয়ে ওঠেন! একজন সাধারণ কালী ভক্ত সাধক কী করে পরমত সহিষ্ণু সাধক রামকৃষ্ণ পরমহংসদেব হয়ে ওঠেন! দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুরের ত্রয়োদশ পুত্রসন্তানটি কোন জ্যোতিকে ধারণ করে বিশ্বপ্রতিভা রবীন্দ্রনাথ হয়ে ওঠেন! একজন অবিশ্বাসী নরেন রামকৃষ্ণ পরমহংসদেবের কোন ইশারায় জগৎ বিখ্যাত স্বামী বিবেকানন্দ হয়ে ওঠেন! আধুনিক কলকাতার বর্ধমান জেলার রুরুলিয়া গ্রামের একজন দুখু মিয়া বিস্ময়কর প্রতিভা ধারণ করে আমাদের জাতীয় কবি নজরুল ইসলাম হয়ে ওঠেন! এদিকে ছাতকের দিরাই উপজেলার উজানজল গ্রামের দরিদ্র কৃষক ইব্রাহীম আলীর ছয় সন্তানের মধ্যে একমাত্র পুত্র লালনের উত্তরাধিকার শাহ আবদুল করিমের কেন জন্ম হয়! পথ ভিন্ন হলেও সাধনার জগতে এঁরা পরস্পরের আত্মার আত্মীয়। একই উৎস থেকে এঁদের জন্ম। পৃথিবীতে মহাকাল মানবতার কল্যাণে সঠিক সময় এঁদের যাঞ্চা করেছে।আর স্রষ্টা কর্তৃক প্রদত্ত প্রতিভা, দিব্যজ্ঞান তাঁদের যাঁর যাঁর পথে, গন্তব্যে পৌঁছে দিয়েছে।

দুই.

বলা হয়েছে, যৌবনের মধ্যভাগে লালন গৃহত্যাগ করেছিলেন। সমাজ-সংসার থেকে বিচ্যুত লালনের জীবন এরপর থেকে প্রচলিত ধর্ম ও সমাজের নিয়ম অনুসারে পরিচালিত হয়নি। মৃত্যুর দুয়ার থেকে ফিরে তিক্ত অভিজ্ঞতার মুখোমুখি হয়ে লালন বুঝতে পেরেছিলেন, সমাজ-সংসারে প্রচলিত ধর্মের ভিতরে মানবতাবাদী প্রেমধর্মের কোনো জায়গা নেই। হতাশ এবং ক্ষুব্ধ অন্তরে এর ফলে তাঁর যে জিজ্ঞাসার জন্ম হয়েছিল, তারই সন্ধানে পথ চলতে চলতে সেই পথের দিশা পেলেন সিরাজ সাঁই নামে একজন তত্ত্বজ্ঞ সিদ্ধ-পুরুষ, সাধকের সান্নিধ্যে ও দীক্ষায়।

যাঁরা লালন পাঠ করেছেন, তাঁরা জানেন, মরমী সম্রাট লালনের সংগীতের বাণীতে ও সুরে বিষয়-আসক্তিমুক্ত জীবনের কথা বলা হয়েছে। যে জীবনকে লোভ, লালসা, মোহ, সম্পদ, ধনদৌলত কাবু করতে পারে না। লালনের মতো হৃদয় পাপ-হিংসা দ্বেষমুক্ত একটি মানবিক ভুবনের স্বপ্ন দেখেছেন। মানুষের জীবনের সমস্ত কুকর্মের আকর এই দেহকে তাই প্রথমে আয়ত্তে আনার সাধনা করেছেন। এঁদের কোনো শাস্ত্র নেই। আছে গান এবং গুরু যা বলেন, তাতেই সাধন ভজনের নির্দেশ থাকে। অর্থাৎ গুরুমুখী সাধনা। গুরু মানে শিক্ষক। জগতে এমন কোন্ ধর্মশাস্ত্র, জ্ঞান-বিদ্যা আছে, যা গুরু বিনে আত্মস্থ করা সম্ভব? সাধক লালনের সঙ্গে অন্যদের পার্থক্য হলো, এঁদের সহজিয়া দর্শন। তাঁরা নানা পর্বে তাঁদের চিন্তা ও উপলব্ধিকে ভাগ করে সংগীতের বাণীতে ও সুরে অনুসরণ করেন। এইসব পর্বগুলো যেমন, দেহতত্ত্ব, মানুষতত্ব, গুরুতত্ত্ব, সৃষ্টিতত্ত্ব, আল্লাহ ও নবীতত্ত্ব, কৃষ্ণ ও গেীরতত্ত্ব, সমাজতত্ত্ব ইত্যাদি।

জ্ঞাত যে, বাংলা সাহিত্যের আদি নিদর্শন ‘চর্যাপদ’ও সাধন-সংগীত। সেখানে ভাবে ও ভাষায় (সান্ধ্যভাষা) যে হেঁয়ালি আছে, এই হেঁয়ালির ধরাবাহিকতা লালন সংগীতের গোপন সাধনা-সংকেতেও আছে। তাঁদের গোপন সাধনতত্ত্বের কথা সম্প্রদায়ের বাইরের কাউকে না জানানোর জন্য চর্যার সিদ্ধাচার্যদের মতো লালন, তাঁর অনুসারীদের এই সতর্কতা। ভাব সাধনার সঙ্গে সংগীতের যে নিবিড় যোগাযোগ আদি নিদর্শন থেকে আজও আছে। নবদ্বীপে যে গানের বাণী গৌর নিতাইয়ের উঠোনে সুর তোলে, সেই ভাবের একতারা লালনের আখড়ায়ও আনন্দে নৃত্য করে। এপ্রসঙ্গে দুটি গান পাশাপাশি স্মরণ করা যেতে পারে।

প্রথমটি:

তারে কৈ পেলুম সই, হলাম যার জন্য পাগল।

ব্রহ্মা পাগল, বিষ্ণু পাগল, আর পাগল শিব।।

তিন পাগল, যুক্তি করে ভাঙল নবদ্বীপ।।

আর লালনের গান:

তোরা কেউ যাস নে ও পাগলের কাছে।

তিন পাগলে হল মেলা নদে’ এসে ॥

(দ্রষ্টব্য : আবুল আহসান চৌধুরী : আমার লালন)

লালনকে কেন্দ্র করেই প্রকৃতপক্ষে বাংলার বাউল-সংস্কৃতি লালিত ও বর্ধিত হয়েছে। লালনের সমাধি স্থান আজ ভাব-সাধকের প্রিয় বিশ্বতীর্থ। লালন এবং তাঁর প্রকৃত অনুসারীদের সহজিয়া জীবন-যাপন অমানবিক নয়, যার সর্বশেষ উদাহরণ সিদ্ধপুরুষ শাহ আবদুল করিমসহ অসংখ্য বাউলের সাধনা।

ত্যাগ, নিষ্ঠা, কঠিন সাধনা তাঁদের নিত্য-কর্ম। মানুষকে ঘিরে তাঁদের আবর্তন। ‘মানুষের চেয়ে বড় কিছু নাই’ যে মানুষ লালন ফকির ছিলেন সেই মানুষের ভাব-জগতের মনের রাজা। তাঁর গানের অন্তরে দেহতত্ত্ব আছে বটে, তবে এও আছে যে, এই দেহের মধ্যেই ‘পরম পুরুষ’, ‘মনের মানুষ’, ‘অটল মানুষ’, ‘অধর মানুষ’, ‘ভাবের মানুষ’, রসের মানুষ’, ‘অচিন পাখি’, ‘সাঁই নিরঞ্জন’, ‘অদেখা মানুষ’র উপস্থিতি আছে। লালনের ব্যাকুল সন্ধান তাঁর বিখ্যাত গানে: “আমার এ ঘরখানায় কে বিরাজ করে।/ তারে জনম-ভর একদিন দেখলাম না রে॥/ নড়ে চড়ে ঈশান কোণে/ দেখতে পাইনে এ নয়নে/ হাতের কাছে যার/ ভাবের হাটবাজার/ ধরতে গেলে হাতে পাইনে তারে॥”

অথবা

“আমার ঘরের চাবি পরের হাতে।/ কেমনে খুলিয়ে সে ধন দেখবো চক্ষেতে ॥”

লালনের সাধন-সন্ধান গুরুবাদী লৌকিক ধর্ম। গুরু বিনা যার সাধন-ভজন বৃথা। যেমন : লালনের বিখ্যাত গান:

ভবে মানুষ গুরু নিষ্ঠা যার

সর্ব-সাধন সিদ্ধ হয় তার।...

লালন তাঁর গানে সৃষ্টিকর্তা ও গুরুর অভিন্নরূপ কল্পনা করেছেন। একক সত্তাকে ‘মুরশিদ’ বলেছেন। যেমন: “মুরশিদ বিনে কি ধন আর আছে রে এ জগতে।/ মুরশিদের চরণ-সুধা/ পান করিলে হরে ক্ষুধা/ কোরো না দেলে দ্বিধা/ যেহি মুরশিদ সেহি খোদা/ বোঝ ‘অলিয়ম মুরশেদা’/ আয়েত লেখা কোরানেতে।” (ন র, বাএ, সপ্তম খ-, পৃষ্ঠা : ৯৮)

আমরা লক্ষ্য করেছি, এমন সাধক বিরল, যিনি প্রচলিত সমাজ, জাত-পাত ও অধর্মকে প্রত্যাখ্যান করেননি। লালনও তেমনি। ছুঁতমার্গ আর জাতপাতের অসারতা প্রসঙ্গ লালন বহুবার তাঁর বাণীতে তুলে ধরেছেন। যেমন:

জাত না গেলে পাইনে হরি

কি ছার জাতের গৌরব করি

ছুঁসনে বলিয়ে।

লালন কয় জাত হাতে পেলে

পুড়তাম আগুন দিয়ে।

স্মর্তব্য, নজরুলের ‘জাতের নামে বজ্জাতি’ নামের বিখ্যাত কবিতা অথবা সংগীতের চরণ: “জাতের নামে বজ্জাতি সব জাত-জালিয়াত খেলছে জুয়া / ছুঁলেই তোদের জাত যাবে? জাত ছেলের হাতের নয় তো মোয়া” (বিষের বাঁশী)

মানুষকে পৃথকীকরণের প্রচলিত ধর্মে লালনের আত্মজিজ্ঞাসার সমাধান তিনি নিজেই করেন।

লালনের সংগীত, সাধনা ও দর্শন লৌকিক জীবনের গণ্ডি অতিক্রম করে আজ শিক্ষিত নাগরিক জীবনকেও স্পর্শ করেছে। তিনি কালোত্তীর্ণ হয়েছেন। গত দুই শতাব্দী ধরে লালন-ভাব সংগীত মানুষের অন্তর দখল করে আছে। বাউল-সম্রাটের প্রতি ভাবুকের আগ্রহের পরিধি বাংলাদেশের গণ্ডি ছাড়িয়ে বিশ্ব-ভূগোলে আন্তর্জাতিক মনোযোগ ক্রমশ বৃদ্ধি পাচ্ছে। এক্ষেত্রে জ্যোতিরিন্দ্রনাথ ও রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের নাম উল্লেখ করা হয়। বিখ্যাত চিত্রকর জ্যোতিরিন্দ্রনাথ ঠাকুরের চিত্রপুস্তক ‘টোয়েন্টি-ফাইভ কলোটাইপস ফ্রম দ্য অরিজিনাল ড্রইংস বাই জ্যোতিরিন্দ্রনাথ টেগোর’, যেটি বিলেত থেকে ছাপা হয়, তাতে তাঁর আঁকা লালনের একটি রেখাচিত্র আছে। এই প্রতিকৃতিটি জ্যোতিরিন্দ্রনাথ এঁকেছিলেন ১৮৮৯ সালের ৫ মে, ২৩ বৈশাখ, ১২৯৬ বঙ্গাব্দে শিলাইদহে পদ্মানদীতে হাউসবোটের ওপরে লালন ফকিরকে বসিয়ে। এটিই লালন ফকিরের একমাত্র প্রতিকৃতি যা বর্তমানে ব্যবহৃত হয়ে আসছে।

জাপানী ভাষায় লালনের গানের প্রথম অনুবাদক, রবীন্দ্র-অনুরাগী জিননোৎসুকে সানো’র (সানো সান) মাধ্যমে বিশ শতকের প্রথম দশকেই লালনের গান জাপানে পৌঁছে যায়। এই জাপানী গবেষক ১৯২৪ খ্রিস্টাব্দে নিজ ভাষায় রবীন্দ্রনাথের ‘গোরা’ উপন্যাস অনুবাদ করেন যাতে লালনের ‘খাঁচার ভিতর অচিন পাখি কমনে আসে যায়’ গানটির উল্লেখ আছে। এছাড়া রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর তাঁর অভিভাষণে লালনের উক্ত গানটির ইংরেজি অনুবাদ দেশে-বিদেশে তাঁর বক্তৃতায় লালন স্মরণ করেছেন বিধায় লালন বিশ্বব্যাপী পরিচিতি পেতে শুরু করেন। (আবুল আহসান চৌধুরী : আমার লালন : ঐতিহ্য : ২০২৪ : পৃ. ৪০৭)

লালনের মর্ম-সাধনার পরিচয় আছে তাঁর গানের বাণীতে। সাঁইজির দীর্ঘজীবনের সাধনা তাঁর সংগীতেই নিবেদিত ও সমর্পিত ছিল। গান রচনা করেছেন মুখে মুখে। শিষ্যরা শুনে তা সাথে সাথে আত্মস্থ করেছে। গেয়েছে। সাধক পরম্পরায় এই সংগীত প্রচারিত হয়ে এসেছে। সত্যিকার অর্থে লালনকে জানতে, চিনতে হলে এই সাধকের বিপুল সংখ্যক গানই আমাদের একমাত্র অবলম্বন। দীর্ঘ জীবনের শেষ মুহূর্তেও দেহত্যাগের আগে তিনি পরমপুরুষের দর্শনে মরমী কন্ঠে গেয়েছেন অন্তিম গান। যা তাঁর লোকজীবন থেকে লোকান্তরে যাওয়ার সময়ের অন্তিম প্রার্থনা সংগীত। বলেছেন:

পার কর হে দয়ালচাঁদ আমারে।

ক্ষম হে অপরাধ আমার ভবকারাগারে ॥

ভবকারাগার থেকে মুক্তির আকুতি অথবা জীবন-সংগীত সাধক লালনের সমগ্র সৃষ্টি। অনুভবের বাইরে যা আত্মস্থ করার কোনো বিকল্প পথ নেই। সমাজমনষ্ক সাধক, মানবতাবাদী, ভক্তির গানের লালন, প্রাণের লালন, কালান্তরের পথিক লালন, মনের মানুষ লালনের সিদ্ধ পথের অভিযাত্রা ভাবের সমাজে নিরন্তর চলবে ততদিন, যতদিন মানুষের হৃদয় অচিন-রহস্য সংগীতের সুরে আন্দোলিত হবে, ধুঁকপুঁক করবে।

কার্তিকের স্নান

আমি- শেষ

ছবি

মহিবুল আলমের কবিতায় নদী ও নারী

ছবি

কবি মাহমুদ কামাল ও নিমগ্ন আত্মার সাধক

ছবি

স্পর্শ

ছবি

নুরুন্নাহার মুন্নির গল্প

ছবি

মাটির মমতায় হেমন্ত বিকেল

ছবি

লোরকার দেশে

ছবি

জীবনানন্দ দাশ দূর-সময়ের সার্বভৌম কবি

ছবি

মার্গারেট অ্যাটউড ‘রানিং দ্য ব্যাট’

ছবি

এলোমেলো স্মৃতির সমরেশ মজুমদার

সাময়িকী কবিতা

ছবি

লোরকার দেশে

ছবি

বিমল গুহের কবিতার অন্তর্জগৎ ও শিল্পৈশ্বর্য

ছবি

কবিতার সুনীল সুনীলের কবিতা

ছবি

রূপান্তরের অকথিত গল্পটা

ছবি

মানব সভ্যতার আত্মবিশ্লেষণের আয়না

ছবি

বাইরে একটা কিছু জ্বলছে

ছবি

‘কাফকার মতো হবো বলে আইন পড়েছিলাম’

ছবি

সত্যেন সেনের উপন্যাস: মিথ ও ইতিহাসলগ্ন মানুষ

ছবি

বিস্ময়ের সীমা নাই

ছবি

নগর বাউল ও ত্রিকালদর্শী সন্ত কবি শামসুর রাহমান

সাময়িকী কবিতা

ছবি

ও বন্ধু আমার

ছবি

লোরকার দেশে

ছবি

শামসুর রাহমানের কবিতায় ‘মিথ’

ছবি

বহুমাত্রিক শামসুর রাহমান

ছবি

দূর-সময়ের সার্বভৌম কবি

ছবি

মাহফুজ আল-হোসেন-এর দশটি কবিতা

ছবি

মনোজগতের অন্বেষায়

সাময়িকী কবিতা

ছবি

এক ঘর রোদ

ছবি

দ্রোহের রম্য পঙ্ক্তিমালা

ছবি

সংবেদী রঙে ও রেখায় প্রাণের উন্মোচন

ছবি

অলস দিনের হাওয়া

ছবি

লাসলো ক্রাসনাহোরকাইয়ের মর্মস্পর্শী ও দূরদর্শী সাহিত্যকর্ম

tab

পথ ভিন্ন : প্রসঙ্গ লালন

আনোয়ারুল হক

বৃহস্পতিবার, ০৬ নভেম্বর ২০২৫

সাধন সংগীতের জগতে তিনি লালন সাঁই, লালন ফকির নামে পরিচিত। লালন নামে বিখ্যাত হওয়ার আগে তাঁর পিতৃপ্রদত্ত নাম ছিল, লালমোহন কর। পিতার নাম মাধব কর, মাতার নাম পদ্মাবতী। হিন্দু কায়স্থ পরিবারের একমাত্র সন্তান ছিলেন। শৈশবেই তাঁর পিতার মৃত্যু হয়। জন্মভিটা এলাকায় প্রতিবেশীরা নাকি তাঁকে ‘লালু’ নামেও ডাকত। গড়াই নদীর তীরবর্তী ভাঁড়ারা (চাপড়া গ্রামসংলগ্ন) গ্রামে লালন ১৭৭৪ খ্রিস্টাব্দে জন্মগ্রহণ করেন। ১১৬ বছর বয়সে ১৮৯০ খ্রিস্টাব্দে (১২৯৭ বঙ্গাব্দের ১ কার্তিক) ১৭ অক্টোবর ভোর পাঁচটায় ছেঁউরিয়ার আখড়ায় সজ্ঞানে দেহত্যাগ করেন। মৃত্যুকালে নিঃসন্তান লালন বিশোখা নামে তাঁর স্ত্রী ও পিয়ারী নামে একজন ধর্মকন্যা রেখে যান।

আর্থিক অসংগতির জন্য কোনো প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা লালনের গ্রহণ করা হয়নি। জন্মভিটা ছিল ভাটি অঞ্চল, যেখানে ঘোর বর্ষাকালে নৌকো ছাড়া চলার কোন উপায় নেই। তবে, এলাকা জুড়ে ছিল সাংগীতিক ঐতিহ্য। সেকালের লোক-সংস্কৃতি লালিত আঞ্চলিক পরিবেশ লালনের মানস গঠনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছে। শীত-গ্রীষ্মে পায়ে হাঁটা পথে দেখা পাওয়া যেত যাত্রা দল, লোকসংগীতের মহাজনদের। সেখানে প্রকৃতি ছিল খোলামেলা, আবারিত উদার। উতল হাওয়ায় লাজবনত নারীর গায়ের বসন পতাকার মতো ওড়ে। পুরুষের ধূতি, তবন। শরৎ বিকেলে আকাশে রঙের খেলা লালনের মনের চোখে ঝিমধরা রহস্য সৃষ্টি করতো না-এমন উচ্চারণ অযৌক্তিক।

জ্ঞতি-কুটুম্বদের সঙ্গে বনিবনা না হওয়ায় লালন মা ও স্ত্রীকে নিয়ে ভাঁড়ারা গ্রমের ভিতরেই দাসপাড়ায় সরে এসে আলাদাভাবে বসবাস করতে শুরু করেছিলেন। ভদ্রলোকের সংখ্যা সেখানে খুব একটা ছিল না। তবে, সাংগীতিক আবহাওয়া ছিল- যা কিনা লালনের ভাবুক মনকে ভিতরে ভিতরে নাড়া দিয়েছে। প্রচলিত আছে, যুবক লালুর একমাত্র শখ বা বিনোদন ছিল, গভীর রাতে দাসপাড়ার মাঠে একাকী ঘোড়ার পিঠে চড়ে বেড়ানো। ওর নিজের কোনো ঘোড়া অবশ্য ছিল না। দাসপাড়া গ্রামের কবিরাজ শুদ্ধাচারী কৃষ্ণপ্রসন্ন সেন ছিলেন ঘোড়ার মালিক। নিঝুম রাতে কবিরাজ মশাইয়ের ঘোড়া চুরি করে লালন দাসপাড়ার মাঠে প্রায় রাতে ঘোরাঘুরি করতো। আস্তাবলে একরাতে ঘোড়া ফেরত দিতে গিয়ে বাড়ির চাকদের হাতে লালন ধরা পড়ে। চোর চুরি করে তা আবার ফেরৎ দিতে আসে- এমন আশ্চর্য কথা লালনের মুখে শুনে কবিরাজ কৃষ্ণপ্রসন্ন বুঝতে পেরেছিলেন, ছন্নছাড়া, সাদাসিধে প্রকৃতির নিশাচর এই যুবক আর যাই হোক, ‘চোর’ নয়। দোষীকে সামনে নিয়ে এলে তিনি লালনের লালাটে দুই-এক বছরের মধ্যে বড় একটা ‘ফাঁড়া’ দিব্যচোখে দেখতে পেলেন। যাতে তার মৃত্যুও হতে পারে। জানিয়েও দিলেন। এটি গল্প।

তবে, লালনের জীবনে এই ‘ফাঁড়া’ ফলেছিল। দাসপাড়ারই প্রতিবেশি বাউলদাস ও অন্যান্য সঙ্গীদের সঙ্গে যুবক লালন মুর্শিদাবাদ জেলার বহরমপুরে গঙ্গাস্নানে গিয়েছিলেন। গঙ্গাস্নান সেরে ফিরে আসার পথে প্রাণঘাতী জলবসন্তে আক্রান্ত হয়ে লালন ঘোর অচৈতন্য হয়ে পড়েন। সঙ্গীরা লালনকে মৃত ভেবে কোনোরকম মুখাগ্নি করে কলাগাছের ভেলায় করে নদীতে ভাসিয়ে দেয়। এই দলটি দাসপাড়া গ্রামে ফিরে এসে লালনের মৃত্যুসংবাদ প্রচার করে। লালনের বিধবা মা এবং স্ত্রী এই মৃত্যু সংবাদ দুর্ভাগ্য হিসেবে মেনে নেয়।

অপরদিকে, লালনের অচৈতন্য দেহ নদীতে ভাসতে ভাসতে কুষ্টিয়ার ছেঁউরিয়ার কালীগঙ্গা নদীর কূলে এসে ঠেকে। দৈবক্রমে রাবেয়া নামে এক বিধবা মুসলিম নারী নদীতে ভেলায় ভেসে আসা মৃতপ্রায় লালনকে নদী থেকে অন্যদের সহায়তায় তুলে গৃহে নিয়ে যান। দয়াবতী মুসলিম এই নারীর অক্লান্ত সেবায় লালন জীবন ফিরে পান। কিন্তু বসন্তরোগে তাঁর একটি চোখ নষ্ট ও মুখে গভীর ক্ষতচিহ্ন সৃষ্টি হয়। সুস্থ হয়ে লালন ফিরে গিয়েছিলেন নিজ গ্রামে জন্মদাত্রী মা ও স্ত্রীর কাছে। কিন্তু গ্রামের সমাজপতি ও আত্মীয়স্বজন লালনের এই অভাবনীয় প্রত্যাবর্তনকে অশুভ হিসেবে চিহ্নিত করে। তারা মুসলামানের গৃহে অন্নজল গ্রহণের কারণে এবং পারলৌকিক ক্রিয়া-অনুষ্ঠান শেষে জীবিত লালনকে গ্রহণ করতে অস্বীকৃতি জ্ঞাপন করে। সমাজ ও স্বজন কর্তৃক এভাবে লালন প্রত্যাখ্যাত হলে মনের দুঃখে তিনি চিরতরের জন্য গৃহত্যাগ করেন।

লালনের সমাজ সংসার ত্যাগের এই কাহিনি আমাদের জানা। এর চেয়ে একটু বেশি জানার আগ্রহ আমাদের এই যে, একজন অশিক্ষিত গ্রাম্য যুবক লালমোহন কর কোন প্রেরণায় ‘লালন’ হয়ে ওঠেন! একজন সাধারণ কালী ভক্ত সাধক কী করে পরমত সহিষ্ণু সাধক রামকৃষ্ণ পরমহংসদেব হয়ে ওঠেন! দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুরের ত্রয়োদশ পুত্রসন্তানটি কোন জ্যোতিকে ধারণ করে বিশ্বপ্রতিভা রবীন্দ্রনাথ হয়ে ওঠেন! একজন অবিশ্বাসী নরেন রামকৃষ্ণ পরমহংসদেবের কোন ইশারায় জগৎ বিখ্যাত স্বামী বিবেকানন্দ হয়ে ওঠেন! আধুনিক কলকাতার বর্ধমান জেলার রুরুলিয়া গ্রামের একজন দুখু মিয়া বিস্ময়কর প্রতিভা ধারণ করে আমাদের জাতীয় কবি নজরুল ইসলাম হয়ে ওঠেন! এদিকে ছাতকের দিরাই উপজেলার উজানজল গ্রামের দরিদ্র কৃষক ইব্রাহীম আলীর ছয় সন্তানের মধ্যে একমাত্র পুত্র লালনের উত্তরাধিকার শাহ আবদুল করিমের কেন জন্ম হয়! পথ ভিন্ন হলেও সাধনার জগতে এঁরা পরস্পরের আত্মার আত্মীয়। একই উৎস থেকে এঁদের জন্ম। পৃথিবীতে মহাকাল মানবতার কল্যাণে সঠিক সময় এঁদের যাঞ্চা করেছে।আর স্রষ্টা কর্তৃক প্রদত্ত প্রতিভা, দিব্যজ্ঞান তাঁদের যাঁর যাঁর পথে, গন্তব্যে পৌঁছে দিয়েছে।

দুই.

বলা হয়েছে, যৌবনের মধ্যভাগে লালন গৃহত্যাগ করেছিলেন। সমাজ-সংসার থেকে বিচ্যুত লালনের জীবন এরপর থেকে প্রচলিত ধর্ম ও সমাজের নিয়ম অনুসারে পরিচালিত হয়নি। মৃত্যুর দুয়ার থেকে ফিরে তিক্ত অভিজ্ঞতার মুখোমুখি হয়ে লালন বুঝতে পেরেছিলেন, সমাজ-সংসারে প্রচলিত ধর্মের ভিতরে মানবতাবাদী প্রেমধর্মের কোনো জায়গা নেই। হতাশ এবং ক্ষুব্ধ অন্তরে এর ফলে তাঁর যে জিজ্ঞাসার জন্ম হয়েছিল, তারই সন্ধানে পথ চলতে চলতে সেই পথের দিশা পেলেন সিরাজ সাঁই নামে একজন তত্ত্বজ্ঞ সিদ্ধ-পুরুষ, সাধকের সান্নিধ্যে ও দীক্ষায়।

যাঁরা লালন পাঠ করেছেন, তাঁরা জানেন, মরমী সম্রাট লালনের সংগীতের বাণীতে ও সুরে বিষয়-আসক্তিমুক্ত জীবনের কথা বলা হয়েছে। যে জীবনকে লোভ, লালসা, মোহ, সম্পদ, ধনদৌলত কাবু করতে পারে না। লালনের মতো হৃদয় পাপ-হিংসা দ্বেষমুক্ত একটি মানবিক ভুবনের স্বপ্ন দেখেছেন। মানুষের জীবনের সমস্ত কুকর্মের আকর এই দেহকে তাই প্রথমে আয়ত্তে আনার সাধনা করেছেন। এঁদের কোনো শাস্ত্র নেই। আছে গান এবং গুরু যা বলেন, তাতেই সাধন ভজনের নির্দেশ থাকে। অর্থাৎ গুরুমুখী সাধনা। গুরু মানে শিক্ষক। জগতে এমন কোন্ ধর্মশাস্ত্র, জ্ঞান-বিদ্যা আছে, যা গুরু বিনে আত্মস্থ করা সম্ভব? সাধক লালনের সঙ্গে অন্যদের পার্থক্য হলো, এঁদের সহজিয়া দর্শন। তাঁরা নানা পর্বে তাঁদের চিন্তা ও উপলব্ধিকে ভাগ করে সংগীতের বাণীতে ও সুরে অনুসরণ করেন। এইসব পর্বগুলো যেমন, দেহতত্ত্ব, মানুষতত্ব, গুরুতত্ত্ব, সৃষ্টিতত্ত্ব, আল্লাহ ও নবীতত্ত্ব, কৃষ্ণ ও গেীরতত্ত্ব, সমাজতত্ত্ব ইত্যাদি।

জ্ঞাত যে, বাংলা সাহিত্যের আদি নিদর্শন ‘চর্যাপদ’ও সাধন-সংগীত। সেখানে ভাবে ও ভাষায় (সান্ধ্যভাষা) যে হেঁয়ালি আছে, এই হেঁয়ালির ধরাবাহিকতা লালন সংগীতের গোপন সাধনা-সংকেতেও আছে। তাঁদের গোপন সাধনতত্ত্বের কথা সম্প্রদায়ের বাইরের কাউকে না জানানোর জন্য চর্যার সিদ্ধাচার্যদের মতো লালন, তাঁর অনুসারীদের এই সতর্কতা। ভাব সাধনার সঙ্গে সংগীতের যে নিবিড় যোগাযোগ আদি নিদর্শন থেকে আজও আছে। নবদ্বীপে যে গানের বাণী গৌর নিতাইয়ের উঠোনে সুর তোলে, সেই ভাবের একতারা লালনের আখড়ায়ও আনন্দে নৃত্য করে। এপ্রসঙ্গে দুটি গান পাশাপাশি স্মরণ করা যেতে পারে।

প্রথমটি:

তারে কৈ পেলুম সই, হলাম যার জন্য পাগল।

ব্রহ্মা পাগল, বিষ্ণু পাগল, আর পাগল শিব।।

তিন পাগল, যুক্তি করে ভাঙল নবদ্বীপ।।

আর লালনের গান:

তোরা কেউ যাস নে ও পাগলের কাছে।

তিন পাগলে হল মেলা নদে’ এসে ॥

(দ্রষ্টব্য : আবুল আহসান চৌধুরী : আমার লালন)

লালনকে কেন্দ্র করেই প্রকৃতপক্ষে বাংলার বাউল-সংস্কৃতি লালিত ও বর্ধিত হয়েছে। লালনের সমাধি স্থান আজ ভাব-সাধকের প্রিয় বিশ্বতীর্থ। লালন এবং তাঁর প্রকৃত অনুসারীদের সহজিয়া জীবন-যাপন অমানবিক নয়, যার সর্বশেষ উদাহরণ সিদ্ধপুরুষ শাহ আবদুল করিমসহ অসংখ্য বাউলের সাধনা।

ত্যাগ, নিষ্ঠা, কঠিন সাধনা তাঁদের নিত্য-কর্ম। মানুষকে ঘিরে তাঁদের আবর্তন। ‘মানুষের চেয়ে বড় কিছু নাই’ যে মানুষ লালন ফকির ছিলেন সেই মানুষের ভাব-জগতের মনের রাজা। তাঁর গানের অন্তরে দেহতত্ত্ব আছে বটে, তবে এও আছে যে, এই দেহের মধ্যেই ‘পরম পুরুষ’, ‘মনের মানুষ’, ‘অটল মানুষ’, ‘অধর মানুষ’, ‘ভাবের মানুষ’, রসের মানুষ’, ‘অচিন পাখি’, ‘সাঁই নিরঞ্জন’, ‘অদেখা মানুষ’র উপস্থিতি আছে। লালনের ব্যাকুল সন্ধান তাঁর বিখ্যাত গানে: “আমার এ ঘরখানায় কে বিরাজ করে।/ তারে জনম-ভর একদিন দেখলাম না রে॥/ নড়ে চড়ে ঈশান কোণে/ দেখতে পাইনে এ নয়নে/ হাতের কাছে যার/ ভাবের হাটবাজার/ ধরতে গেলে হাতে পাইনে তারে॥”

অথবা

“আমার ঘরের চাবি পরের হাতে।/ কেমনে খুলিয়ে সে ধন দেখবো চক্ষেতে ॥”

লালনের সাধন-সন্ধান গুরুবাদী লৌকিক ধর্ম। গুরু বিনা যার সাধন-ভজন বৃথা। যেমন : লালনের বিখ্যাত গান:

ভবে মানুষ গুরু নিষ্ঠা যার

সর্ব-সাধন সিদ্ধ হয় তার।...

লালন তাঁর গানে সৃষ্টিকর্তা ও গুরুর অভিন্নরূপ কল্পনা করেছেন। একক সত্তাকে ‘মুরশিদ’ বলেছেন। যেমন: “মুরশিদ বিনে কি ধন আর আছে রে এ জগতে।/ মুরশিদের চরণ-সুধা/ পান করিলে হরে ক্ষুধা/ কোরো না দেলে দ্বিধা/ যেহি মুরশিদ সেহি খোদা/ বোঝ ‘অলিয়ম মুরশেদা’/ আয়েত লেখা কোরানেতে।” (ন র, বাএ, সপ্তম খ-, পৃষ্ঠা : ৯৮)

আমরা লক্ষ্য করেছি, এমন সাধক বিরল, যিনি প্রচলিত সমাজ, জাত-পাত ও অধর্মকে প্রত্যাখ্যান করেননি। লালনও তেমনি। ছুঁতমার্গ আর জাতপাতের অসারতা প্রসঙ্গ লালন বহুবার তাঁর বাণীতে তুলে ধরেছেন। যেমন:

জাত না গেলে পাইনে হরি

কি ছার জাতের গৌরব করি

ছুঁসনে বলিয়ে।

লালন কয় জাত হাতে পেলে

পুড়তাম আগুন দিয়ে।

স্মর্তব্য, নজরুলের ‘জাতের নামে বজ্জাতি’ নামের বিখ্যাত কবিতা অথবা সংগীতের চরণ: “জাতের নামে বজ্জাতি সব জাত-জালিয়াত খেলছে জুয়া / ছুঁলেই তোদের জাত যাবে? জাত ছেলের হাতের নয় তো মোয়া” (বিষের বাঁশী)

মানুষকে পৃথকীকরণের প্রচলিত ধর্মে লালনের আত্মজিজ্ঞাসার সমাধান তিনি নিজেই করেন।

লালনের সংগীত, সাধনা ও দর্শন লৌকিক জীবনের গণ্ডি অতিক্রম করে আজ শিক্ষিত নাগরিক জীবনকেও স্পর্শ করেছে। তিনি কালোত্তীর্ণ হয়েছেন। গত দুই শতাব্দী ধরে লালন-ভাব সংগীত মানুষের অন্তর দখল করে আছে। বাউল-সম্রাটের প্রতি ভাবুকের আগ্রহের পরিধি বাংলাদেশের গণ্ডি ছাড়িয়ে বিশ্ব-ভূগোলে আন্তর্জাতিক মনোযোগ ক্রমশ বৃদ্ধি পাচ্ছে। এক্ষেত্রে জ্যোতিরিন্দ্রনাথ ও রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের নাম উল্লেখ করা হয়। বিখ্যাত চিত্রকর জ্যোতিরিন্দ্রনাথ ঠাকুরের চিত্রপুস্তক ‘টোয়েন্টি-ফাইভ কলোটাইপস ফ্রম দ্য অরিজিনাল ড্রইংস বাই জ্যোতিরিন্দ্রনাথ টেগোর’, যেটি বিলেত থেকে ছাপা হয়, তাতে তাঁর আঁকা লালনের একটি রেখাচিত্র আছে। এই প্রতিকৃতিটি জ্যোতিরিন্দ্রনাথ এঁকেছিলেন ১৮৮৯ সালের ৫ মে, ২৩ বৈশাখ, ১২৯৬ বঙ্গাব্দে শিলাইদহে পদ্মানদীতে হাউসবোটের ওপরে লালন ফকিরকে বসিয়ে। এটিই লালন ফকিরের একমাত্র প্রতিকৃতি যা বর্তমানে ব্যবহৃত হয়ে আসছে।

জাপানী ভাষায় লালনের গানের প্রথম অনুবাদক, রবীন্দ্র-অনুরাগী জিননোৎসুকে সানো’র (সানো সান) মাধ্যমে বিশ শতকের প্রথম দশকেই লালনের গান জাপানে পৌঁছে যায়। এই জাপানী গবেষক ১৯২৪ খ্রিস্টাব্দে নিজ ভাষায় রবীন্দ্রনাথের ‘গোরা’ উপন্যাস অনুবাদ করেন যাতে লালনের ‘খাঁচার ভিতর অচিন পাখি কমনে আসে যায়’ গানটির উল্লেখ আছে। এছাড়া রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর তাঁর অভিভাষণে লালনের উক্ত গানটির ইংরেজি অনুবাদ দেশে-বিদেশে তাঁর বক্তৃতায় লালন স্মরণ করেছেন বিধায় লালন বিশ্বব্যাপী পরিচিতি পেতে শুরু করেন। (আবুল আহসান চৌধুরী : আমার লালন : ঐতিহ্য : ২০২৪ : পৃ. ৪০৭)

লালনের মর্ম-সাধনার পরিচয় আছে তাঁর গানের বাণীতে। সাঁইজির দীর্ঘজীবনের সাধনা তাঁর সংগীতেই নিবেদিত ও সমর্পিত ছিল। গান রচনা করেছেন মুখে মুখে। শিষ্যরা শুনে তা সাথে সাথে আত্মস্থ করেছে। গেয়েছে। সাধক পরম্পরায় এই সংগীত প্রচারিত হয়ে এসেছে। সত্যিকার অর্থে লালনকে জানতে, চিনতে হলে এই সাধকের বিপুল সংখ্যক গানই আমাদের একমাত্র অবলম্বন। দীর্ঘ জীবনের শেষ মুহূর্তেও দেহত্যাগের আগে তিনি পরমপুরুষের দর্শনে মরমী কন্ঠে গেয়েছেন অন্তিম গান। যা তাঁর লোকজীবন থেকে লোকান্তরে যাওয়ার সময়ের অন্তিম প্রার্থনা সংগীত। বলেছেন:

পার কর হে দয়ালচাঁদ আমারে।

ক্ষম হে অপরাধ আমার ভবকারাগারে ॥

ভবকারাগার থেকে মুক্তির আকুতি অথবা জীবন-সংগীত সাধক লালনের সমগ্র সৃষ্টি। অনুভবের বাইরে যা আত্মস্থ করার কোনো বিকল্প পথ নেই। সমাজমনষ্ক সাধক, মানবতাবাদী, ভক্তির গানের লালন, প্রাণের লালন, কালান্তরের পথিক লালন, মনের মানুষ লালনের সিদ্ধ পথের অভিযাত্রা ভাবের সমাজে নিরন্তর চলবে ততদিন, যতদিন মানুষের হৃদয় অচিন-রহস্য সংগীতের সুরে আন্দোলিত হবে, ধুঁকপুঁক করবে।

back to top