শারদুল সজল
মাহমুদ কামাল
বাংলা সাহিত্যের অন্তরভূমিতে সত্তরের দশকের এক দীপ্তিময় নাম কবি মাহমুদ কামাল। টাঙ্গাইলের মাটিতে জন্ম নেয়া যিনি শব্দকে ব্যবহার করেন কেবল অনুভূতির বাহন হিসেবে নয়, বরং চিন্তার এক ল্যাবরেটরি হিসেবে। তাঁর কবিতা পাঠ করলে বোঝা যায়, তিনি ইমোশনের চেয়ে বেশি মনোযোগ দেন পারসেপশনে, অর্থাৎ কীভাবে মানুষ তার চারপাশের জগতকে দেখছে, অনুভব করছে এবং তার ভাষায় অনুবাদ করছে। এই দৃষ্টিকোণ থেকেই বলা যায়-মাহমুদ কামালের কবিতা মূলত একধরনের হিউম্যান এক্সপেরিমেন্ট, যেখানে প্রতিটি শব্দ, প্রতিটি চিত্রকল্প একটি মনস্তাত্ত্বিক প্রতিক্রিয়া তৈরি করে পাঠকের মধ্যে।
কবি মাহমুদ কামাল এর কবিতা পড়লে সমাজ ও মানুষের যাপিতজীবনের দৃশ্য পষ্ট হয়। বাংলা সাহিত্য নিয়ে উচ্চশিক্ষা অর্জনের পাশাপাশি তিনি হয়তো বুঝেছিলে language itself is a living organism, যা সময়ের সঙ্গে সঙ্গে রূপান্তরিত হয়, আর কবি হচ্ছে সেই রূপান্তরের সচেতন রসায়নবিদ। তাই তো তার কবিতাগুলো মানবজীবনের প্রেম ও ক্ষরণের ভেতর দিয়ে উত্তীর্ণ হয়েছে।
তাঁর প্রথম কাব্যগ্রন্থ “পরকীয়া” প্রকাশিত হওয়ার পর থেকেই তিনি নিজেকে আলাদা করে তুলতে শুরু করেন। এই বইয়ের কবিতাগুলোয় যে ভাষা, যে ভাব এবং চিন্তার যে ধারা, তা তাকে জনপ্রিয়তার চেয়ে বেশি দিয়েছে স্বকীয়তার মর্যাদা। তাঁর পরবর্তী গ্রন্থগুলো- বিরামচিহ্ন, কবিতার মতো কিছু কথা-প্রমাণ করে, তিনি কেবল কবি নন, তিনি একজন ভাবুক ও পর্যবেক্ষক, যিনি নিজের ভেতরের এবং বাইরের জগতকে একসাথে বিশ্লেষণ করেন।
মাহমুদ কামালের কবিতার ভাষা deceptively simple, তাতে এক ধরনের গোপনীয় ঘোর রয়েছে। তিনি প্রেম নিয়ে লিখেছেন, কিন্তু তা নিছক রোমান্টিক প্রেম নয়, বরং অস্তিত্ব ও চেতনার এক অনুসন্ধান। তিনি যখন লিখেন, “আমাকে এখন আমিই হত্যা করি/ জীবনের কাছে অনূদিত করি মায়া”, তখন তা কেবল ভালোবাসার বর্ণনা নয়, এটি এক অনুপস্থিতি- যা পরিণত হয় মানসিক উপস্থিতিতে। তাঁর কবিতা পড়লে বোঝা যায়, তিনি মানুষের অন্তর্জগৎকে স্বাভাবিক প্রবৃত্তি দিয়ে বিশ্লেষণ করেছেন।
টাঙ্গাইলের সাহিত্যচর্চায় মাহমুদ কামাল এক প্রতিষ্ঠিত নাম। তাই তিনি শুধু কবিতা লেখেননি; গড়ে তুলেছেন সাহিত্যিক সংগঠন, সম্পাদনা করেছেন পত্রিকা, তৈরি করেছেন তরুণদের জন্য এক সৃজনশীল পরিবেশ। টাঙ্গাইল সাহিত্য সংসদ, অরণি পত্রিকা এবং অসংখ্য সাহিত্য-উদ্যোগে তাঁর নেতৃত্বে জন্ম নিয়েছে এক নতুন সাহিত্য-সংস্কৃতি।
কবি মাহমুদ কামাল নিজেকে কেবল রোমান্টিক বা রেভল্যুশনারি কবি বলে চিহ্নিত করেননি; তিনি একজন “researcher of feelings”, যিনি মানুষের অভ্যন্তরীণ গঠন, আবেগ, ভয় ও আকাক্সক্ষাকে পর্যবেক্ষণ করেন গবেষকের দৃষ্টিতে। তাঁর কবিতা তাই কখনও আত্মস্বীকৃত, কখনও প্রশ্নবিদ্ধ। তিনি লিখেছেন-“পাঠকও প্রস্তুত হয়ে উঠবেন, নাকি কবিই পাঠকের রুচি বুঝে লিখবেন”-এই প্রশ্ন আসলে তাঁর সাহিত্যবোধের কেন্দ্রবিন্দু। তিনি জানেন, পাঠক ও কবির সম্পর্ক একটি জৈবিক বিনিময়- যেখানে উভয়েই একে অপরকে তৈরি করে এবং একে অপরকে স্বাচ্ছন্দ্যে অপহরণ করে। (বাংলা সাহিত্যে আমার এমন উদাহরণটিও সম্ভবত নতুন)
সমসাময়িক কবিতায় যেখানে অনেকেই ভাষার খেলা বা রাজনৈতিক বক্তব্যে জড়িয়ে পড়েন, মাহমুদ কামাল সেখানে থেকেও আলাদা। তিনি রাজনীতি নয়, মানসিকতার কবি। কবি ও কবিতা তৈরিরও কবি, তাঁর কবিতায় সময় ও সমাজ থাকে, কিন্তু সেগুলো কখনও স্লোগানে পরিণত হয় না; বরং রূপ নেয় ভাবনায়, দর্শনে। এক অর্থে বলা যায়, তাঁর কবিতা একধরনের বোধ, যেখানে ব্যক্তি ও সমাজের সংঘাত মানচিত্রের মতো ফুটে ওঠে।
তাঁর ভাষার ভেতর আছে এক ধরনের organic rhythm, যেন হৃদস্পন্দনের মতো। সেই ছন্দই তাঁকে আলাদা করে তোলে প্রজন্মের কবিদের ভিড়ে। তিনি জানেন, সময় বদলায়, পাঠকের রুচি বদলায়, কিন্তু সত্যিকার কবিতার প্রয়োজন কখনও শেষ হয় না।
মাহমুদ কামালের জীবন ও সাহিত্য দুটোই এক সূত্রে বাঁধা- দায়বদ্ধতা ও নীরবতায় । তিনি আলো পেতে চাননি, বরং আলো হয়ে থেকেছেন অন্যদের জন্য। টাঙ্গাইলের সাহিত্যচর্চাকে যেভাবে তিনি জাতীয় পরিসরে তুলেছেন, তা নিঃসন্দেহে এক সাংস্কৃতিক আন্দোলন। তাঁর কবিতা যেমন স্নিগ্ধ, তেমনি সংগঠনমূলক কাজও পরিচ্ছন্ন- যেন তিনি জানতেন- creativity without structure eventually collapses
বাংলা কবিতার ইতিহাসে মাহমুদ কামালকে শুধু এক প্রজন্মের কবি হিসেবে দেখা অন্যায় হবে। তিনি এক সেতু, যিনি স্থানীয়তাকে যুক্ত করেছেন সার্বজনীনতার সঙ্গে।
তিনি ১৫টির অধিক কাব্যগ্রন্থের পাশাপাশি গল্প, উপন্যাস, প্রবন্ধ, ভ্রমণ ও স্মৃতিকথা রচনা করেছেন।
আজকের দ্রুতগামী, তথ্যনির্ভর সময়েও মাহমুদ কামাল অনন্য উজ্জ্বল। তাঁর কবিতা একদিকে আবেগের, অন্যদিকে মেধা ও ছন্দের ... যার ভেতর দিয়ে কবিতার নিমগ্ন সাধক হয়ে মাহমুদ কামাল হয়ে ওঠেন সেই কবি, যিনি সময়কে অতিক্রম করে বেঁচে থাকবেন বাংলার সাহিত্য জগতে...
ইপেপার
জাতীয়
সারাদেশ
আন্তর্জাতিক
নগর-মহানগর
খেলা
বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি
শিক্ষা
অর্থ-বাণিজ্য
সংস্কৃতি
ক্যাম্পাস
মিডিয়া
অপরাধ ও দুর্নীতি
রাজনীতি
শোক ও স্মরন
প্রবাস
নারীর প্রতি সহিংসতা
বিনোদন
সম্পাদকীয়
উপ-সম্পাদকীয়
মুক্ত আলোচনা
চিঠিপত্র
পাঠকের চিঠি
শারদুল সজল
মাহমুদ কামাল
বৃহস্পতিবার, ০৬ নভেম্বর ২০২৫
বাংলা সাহিত্যের অন্তরভূমিতে সত্তরের দশকের এক দীপ্তিময় নাম কবি মাহমুদ কামাল। টাঙ্গাইলের মাটিতে জন্ম নেয়া যিনি শব্দকে ব্যবহার করেন কেবল অনুভূতির বাহন হিসেবে নয়, বরং চিন্তার এক ল্যাবরেটরি হিসেবে। তাঁর কবিতা পাঠ করলে বোঝা যায়, তিনি ইমোশনের চেয়ে বেশি মনোযোগ দেন পারসেপশনে, অর্থাৎ কীভাবে মানুষ তার চারপাশের জগতকে দেখছে, অনুভব করছে এবং তার ভাষায় অনুবাদ করছে। এই দৃষ্টিকোণ থেকেই বলা যায়-মাহমুদ কামালের কবিতা মূলত একধরনের হিউম্যান এক্সপেরিমেন্ট, যেখানে প্রতিটি শব্দ, প্রতিটি চিত্রকল্প একটি মনস্তাত্ত্বিক প্রতিক্রিয়া তৈরি করে পাঠকের মধ্যে।
কবি মাহমুদ কামাল এর কবিতা পড়লে সমাজ ও মানুষের যাপিতজীবনের দৃশ্য পষ্ট হয়। বাংলা সাহিত্য নিয়ে উচ্চশিক্ষা অর্জনের পাশাপাশি তিনি হয়তো বুঝেছিলে language itself is a living organism, যা সময়ের সঙ্গে সঙ্গে রূপান্তরিত হয়, আর কবি হচ্ছে সেই রূপান্তরের সচেতন রসায়নবিদ। তাই তো তার কবিতাগুলো মানবজীবনের প্রেম ও ক্ষরণের ভেতর দিয়ে উত্তীর্ণ হয়েছে।
তাঁর প্রথম কাব্যগ্রন্থ “পরকীয়া” প্রকাশিত হওয়ার পর থেকেই তিনি নিজেকে আলাদা করে তুলতে শুরু করেন। এই বইয়ের কবিতাগুলোয় যে ভাষা, যে ভাব এবং চিন্তার যে ধারা, তা তাকে জনপ্রিয়তার চেয়ে বেশি দিয়েছে স্বকীয়তার মর্যাদা। তাঁর পরবর্তী গ্রন্থগুলো- বিরামচিহ্ন, কবিতার মতো কিছু কথা-প্রমাণ করে, তিনি কেবল কবি নন, তিনি একজন ভাবুক ও পর্যবেক্ষক, যিনি নিজের ভেতরের এবং বাইরের জগতকে একসাথে বিশ্লেষণ করেন।
মাহমুদ কামালের কবিতার ভাষা deceptively simple, তাতে এক ধরনের গোপনীয় ঘোর রয়েছে। তিনি প্রেম নিয়ে লিখেছেন, কিন্তু তা নিছক রোমান্টিক প্রেম নয়, বরং অস্তিত্ব ও চেতনার এক অনুসন্ধান। তিনি যখন লিখেন, “আমাকে এখন আমিই হত্যা করি/ জীবনের কাছে অনূদিত করি মায়া”, তখন তা কেবল ভালোবাসার বর্ণনা নয়, এটি এক অনুপস্থিতি- যা পরিণত হয় মানসিক উপস্থিতিতে। তাঁর কবিতা পড়লে বোঝা যায়, তিনি মানুষের অন্তর্জগৎকে স্বাভাবিক প্রবৃত্তি দিয়ে বিশ্লেষণ করেছেন।
টাঙ্গাইলের সাহিত্যচর্চায় মাহমুদ কামাল এক প্রতিষ্ঠিত নাম। তাই তিনি শুধু কবিতা লেখেননি; গড়ে তুলেছেন সাহিত্যিক সংগঠন, সম্পাদনা করেছেন পত্রিকা, তৈরি করেছেন তরুণদের জন্য এক সৃজনশীল পরিবেশ। টাঙ্গাইল সাহিত্য সংসদ, অরণি পত্রিকা এবং অসংখ্য সাহিত্য-উদ্যোগে তাঁর নেতৃত্বে জন্ম নিয়েছে এক নতুন সাহিত্য-সংস্কৃতি।
কবি মাহমুদ কামাল নিজেকে কেবল রোমান্টিক বা রেভল্যুশনারি কবি বলে চিহ্নিত করেননি; তিনি একজন “researcher of feelings”, যিনি মানুষের অভ্যন্তরীণ গঠন, আবেগ, ভয় ও আকাক্সক্ষাকে পর্যবেক্ষণ করেন গবেষকের দৃষ্টিতে। তাঁর কবিতা তাই কখনও আত্মস্বীকৃত, কখনও প্রশ্নবিদ্ধ। তিনি লিখেছেন-“পাঠকও প্রস্তুত হয়ে উঠবেন, নাকি কবিই পাঠকের রুচি বুঝে লিখবেন”-এই প্রশ্ন আসলে তাঁর সাহিত্যবোধের কেন্দ্রবিন্দু। তিনি জানেন, পাঠক ও কবির সম্পর্ক একটি জৈবিক বিনিময়- যেখানে উভয়েই একে অপরকে তৈরি করে এবং একে অপরকে স্বাচ্ছন্দ্যে অপহরণ করে। (বাংলা সাহিত্যে আমার এমন উদাহরণটিও সম্ভবত নতুন)
সমসাময়িক কবিতায় যেখানে অনেকেই ভাষার খেলা বা রাজনৈতিক বক্তব্যে জড়িয়ে পড়েন, মাহমুদ কামাল সেখানে থেকেও আলাদা। তিনি রাজনীতি নয়, মানসিকতার কবি। কবি ও কবিতা তৈরিরও কবি, তাঁর কবিতায় সময় ও সমাজ থাকে, কিন্তু সেগুলো কখনও স্লোগানে পরিণত হয় না; বরং রূপ নেয় ভাবনায়, দর্শনে। এক অর্থে বলা যায়, তাঁর কবিতা একধরনের বোধ, যেখানে ব্যক্তি ও সমাজের সংঘাত মানচিত্রের মতো ফুটে ওঠে।
তাঁর ভাষার ভেতর আছে এক ধরনের organic rhythm, যেন হৃদস্পন্দনের মতো। সেই ছন্দই তাঁকে আলাদা করে তোলে প্রজন্মের কবিদের ভিড়ে। তিনি জানেন, সময় বদলায়, পাঠকের রুচি বদলায়, কিন্তু সত্যিকার কবিতার প্রয়োজন কখনও শেষ হয় না।
মাহমুদ কামালের জীবন ও সাহিত্য দুটোই এক সূত্রে বাঁধা- দায়বদ্ধতা ও নীরবতায় । তিনি আলো পেতে চাননি, বরং আলো হয়ে থেকেছেন অন্যদের জন্য। টাঙ্গাইলের সাহিত্যচর্চাকে যেভাবে তিনি জাতীয় পরিসরে তুলেছেন, তা নিঃসন্দেহে এক সাংস্কৃতিক আন্দোলন। তাঁর কবিতা যেমন স্নিগ্ধ, তেমনি সংগঠনমূলক কাজও পরিচ্ছন্ন- যেন তিনি জানতেন- creativity without structure eventually collapses
বাংলা কবিতার ইতিহাসে মাহমুদ কামালকে শুধু এক প্রজন্মের কবি হিসেবে দেখা অন্যায় হবে। তিনি এক সেতু, যিনি স্থানীয়তাকে যুক্ত করেছেন সার্বজনীনতার সঙ্গে।
তিনি ১৫টির অধিক কাব্যগ্রন্থের পাশাপাশি গল্প, উপন্যাস, প্রবন্ধ, ভ্রমণ ও স্মৃতিকথা রচনা করেছেন।
আজকের দ্রুতগামী, তথ্যনির্ভর সময়েও মাহমুদ কামাল অনন্য উজ্জ্বল। তাঁর কবিতা একদিকে আবেগের, অন্যদিকে মেধা ও ছন্দের ... যার ভেতর দিয়ে কবিতার নিমগ্ন সাধক হয়ে মাহমুদ কামাল হয়ে ওঠেন সেই কবি, যিনি সময়কে অতিক্রম করে বেঁচে থাকবেন বাংলার সাহিত্য জগতে...