সাদ কামালী
শিল্পী : সঞ্জয় দে রিপন
আজকের বিকেল অন্য রকমের, জাফরানি আলোর ঘ্রাণে শান্তি জড়ানো, ভোরের শান্ত নরম শরীর বিকেলের আলোবাতাসে জড়িয়ে আছে। হাতের ঘড়ি আর বুদ্ধির চতুরতা না থাকলে ভোর আর বিকেলের দেহ-মেজাজের সম্পর্ক নিয়ে মনে কোনো প্রশ্ন প্রশ্রয় পেত না। প্রকৃতির কাছে আমার আরও একটি ঋণ হলো, এমন সুন্দর বিকেলের আয়োজন করে- কত মানুষ জড়ো হয়েছে। সবাই আজ আমার নিকটজন। কাছের অনেকের সাথে কথা হতো না, হলে অন্তরশূন্য ভদ্রতার অভিনয় হতো, আজ তারা আমার কাছের হয়ে উঠেছে। আমাকে তারা অনুভব করছে, স্মৃতিতে জমে থাকা, অথবা কিছুটা বানিয়ে হলেও আমার সম্পর্কে কত মধুর মধুর স্মৃতি তারা একে অপরকে বলছে খুব দরদ দিয়ে। যত শুনি তত ভালো লাগে। আহা সব সুন্দর! আতরাফের মনে আশরাফের আত্মা ভর করেছে। বাম কাঁধের ফেরেশতা ডান কাঁধের ফেরশতার হৃদয় ধার করে নিপুণ চালিয়ে যাচ্ছে। আমার এই কথা ঠিক হলো না, চালিয়ে যাচ্ছে কথার মধ্যে নেতিসূচক মন রয়েছে। আসলে তা নয়। আজ সকল আশরাফ বা ভালো মানুষের সঙ্গে আতরাফের মানে পুরাণ মতে মন্দ মানুষের বিশেষ ঐক্য হয়েছে। কেউ পুরোপুরি আশরাফ নয় বা আতরাফ নয়। সবার মধ্যে দুই গুণের বোধ আছে, হয়তো কম আর বেশি। আমার এই অতিপ্রাকৃত জীবনের আগে যে সামাজিক জীবন ছিল, সেই জীবনে আতরাফদের প্রতি আমার পক্ষপাতিত্ব দেখে বউ খোঁচা দিত। কিন্তু জানেন, পিওর আশরাফ খুব বোরিং, ভাল মানুষের ভাল ভাল কথাবার্তা ব্যবহার, মার্জিত রুচি ভঙ্গির সঙ্গে মনে হতো মিশে আছে কিছু কৃত্রিম ভদ্রতা। রাখঢাকহীন আতরাফের মনের সাফ সাফ খবর যেন অনেক সরল সোজা, অভিনয়ের ভণিতামুক্ত। আতরাফকে আমি বুঝি, আশরাফকে বুঝতে হয়, সতর্ক থাকি। ভালো মানুষের কাছে আমিও ভালো বনে থাকি। এছাড়াও রস, রসিকতা অবাধ প্রাণময়তার উচ্ছ্বাস মানে ব্যাকরণের নিয়ম নীতির প্রতি সেলাম না ঠুকেই মনের কথাটি প্রকাশ করে দেয় সরল ভাষায় আতরাফের এই দিকটি আমার পছন্দ।
এমন একটি মধুর অপরাহ্ণের জন্য বারবার মরা যায়। মানুষ কি একবারই মরে! নতুন নতুন জীবন নতুন করে মরা। এই অভিজ্ঞতা মানুষ মরার পরেই ঘটতে পারে। মরার পর আবার মরার সুযোগ পেলে তবেই অভিজ্ঞতা অন্যের সঙ্গে শেয়ার করা যায়। প্রথমই যদি শেষ ধরা হয়, জীবন তাহলে অভাবিত অভিজ্ঞতার স্বাদ থেকে বঞ্চিত হয়। আমার স্কুলে পড়ত, পরে কলেজেও, কিন্তু বিশ্ববিদ্যালয়ে এসে ভিন্ন বিভাগের কারণে দূরত্ব বেড়েছে। যদিও কাছের কখনোই ছিল না। একই বেঞ্চে বসেও দূরের ছিল বৈকি। সে এখন দারুণ বলছে, ও আমার ভাইয়ের থেকেও বেশি ছিল। কয়েকটি সুগন্ধময় তাজা বেল ফুল আমার ওপর ছুড়ে দিয়ে বলে, প্রিয় বন্ধুটিকে খুব মিস করব। তার চোখের জলের অভিঘাত কণ্ঠে। বুকের ওপর থেকে ফুলগুলি হাতের মুঠোয় নিয়ে গন্ধ শুঁকি, কী মিষ্টি গন্ধ! কতদিন পর ওকে দেখলাম! শেষ দেখেছিলাম আমার বিয়ের আগে। হঠাৎ করে আরিচা-দৌলতদিয়া ফেরিতে ওকে দেখে চট করে চিনতে পারিনি। দুপুরের রোদে কালো ফরম্যাল স্যুট, টাই, চোখে কালো চশমা- ওই আমাকে চিনে নাম ধরে ডাক দিয়েছিল। পাশেই পাজেরো জিপ, হাতের সিগারেটে বিদেশ বিদেশ গন্ধ ছিল। কালো চশমার আড়ালে চোখ, অন্ধকারেই ছিল। আজ কিন্তু তেমন নয়। প্রায় প্রৌঢ় বন্ধু এখন সাদা পোশাকে খোলা চোখে বলা কথাগুলোর সুন্দর ঘ্রাণ, চাপা শোকের চাপে হয়তো কথাগুলো বলছে থেমে থেমে। আমার অনেক কথাই মনে হচ্ছিল। তবু ইচ্ছা হয় শুধু ভালো ভালো স্মৃতিই স্মরণ করার। তেমন স্মৃতি কী ওর সাথে...। হঠাৎ মনে শেফালী এলো। সঙ্গে বেল শিউলী শেফালী ফুলের হালকা গন্ধ বাতাসে ভর করে আমার নাকের কাছে থমকে দাঁড়ায়। আমি নাক থেকে শেফালীকে বুকে আশ্রয় দেই, জানতে ইচ্ছে করে শেফালী কেমন আছে? তোর সঙ্গেই আছে তো! শুনেছিলাম বিয়ে করেছিল- তারপর খবর নিতে চাইনি। খবর পাইওনি। শেফালীকে তুই জোর করে বিয়ে করেছিলি বন্ধু, ওর ভালবাসা ছিল অন্য কোথাও। বন্ধু এবার সত্যিই লালবোটাসহ কিছু শেফালী ফুল আমার সাদা পোশাকে ছুঁড়ে দিল। শেফালীর স্পর্শ আমার বুকে এখন। এভাবেই কি আমাদের মিলন হলো। কোথায় তুমি ছিলে শেফালী।
হঠাৎ করেই শান্ত অপরাহ্ণ জনসমাগমে ভরে উঠল। কলেজের প্রিন্সিপাল কিছু শিক্ষক ছাত্রসহ এলেন অনেকগুলো লাল গোলাপের গুচ্ছ নিয়ে। সাদা সাদা ফুলের গন্ধের ভিতর তখন গোলাপের রঙ ও গন্ধ মিলিয়ে দারুণ উৎসবের রূপ দিল। ছাত্ররা আমাকে ঘিরে দাঁড়িয়ে পড়ল, বেশ কিছু ছাত্রীও আছে। তারপর সকলে একটি একটি গোলাপ হাতে নিয়ে শুরু করল-
পুষ্প দিয়ে মার যারে চিনল না সে মরণকে
তারপর
আলোর অমল কমলখানি কে ফুটালে
তারপর
শেষ নাহি যে শেষ কথা কে বলবে...
গেয়ে তাদের শ্রদ্ধা নিবেদন শেষ হলো। সবাই হাত বেঁধে দাঁড়িয়ে গান শুনল, তাকিয়ে থাকল আমার দিকে। আমি তাদের মিলিত গান শেষে সাধু সাধু বলে উঠে বসি, অধ্যক্ষ সাহেবকে বললাম, স্যার একটি মুক্তির গান করুন না। স্যার নিজেই সঙ্গে সঙ্গে গাইতে শুরু করলেন- আমার মুক্তি আলোয় আলোয়/ আমার মুক্তি ধুলায় ধুলায় ঘাসে ঘাসে... আমিও এই আকাশে... স্যারের সঙ্গে গেয়ে উঠি। কেউ কি আমাকে দেখেনি কথা বলতে, উঠে বসতে! বাহ এই তো ভাল। গান শেষে কলেজের সবাই চলে যাওয়ার পর আমি এবার দাঁড়িয়ে পড়লাম। বন্ধুর কাঁধে হাত রেখে বউকে বলি- এই বেটা শেফালীকে বিয়ে করেছিল। আমার বউ শোকে বিহ্বল নয়, গভীর ও প্রশান্ত। বলে, ভাই শেফালী ভাবিকে আনলেন না? ওর কাছে অনেক শুনেছি...
বন্ধু পরিবেশ-বেমানান হেসে ওঠে। শেফালী ওর মেয়ের সঙ্গে এখন ভিয়েনায় আছে। আমার স্বগতোক্তি, ওর মেয়ে! আমার বউ বুদ্ধিমতি, বলে, আপনাদের মেয়ে এখন ভিয়েনায়...?
হ্যাঁ ভিয়েনায়। মেয়ের বাবা শুনেছি...
মেয়ের বাবা! আমার কণ্ঠ স্ত্রীর কণ্ঠে একই স্কেলে বিস্ময় প্রকাশ করে বন্ধুর দিকে তাকায়। বন্ধু বলে, ভাবি শুনেছি, ওর বাবার পরিচয় শেফালী কাউকে বলেনি। আমার ধারণা ও অন্তঃসত্ত্বা হয়ে পড়ার পর বাইরে চলে যায়। তবে আমরা বন্ধুরা অনুমান করেছিলাম কে শেফালীর একান্ত বন্ধু ছিল। সে সব কথা অনেক পুরনো, এখন আর তার কোনো অর্থ নেই। আমার বউ এবার বলে, তাহলে আপনার পরিবার? হ্যাঁ হ্যাঁ আমার স্ত্রী তিন ছেলেমেয়ে সবাই ঢাকাতেই এখন। ও আচ্ছা। বন্ধু বলে, অনেক দিন আপনাদের সঙ্গে যোগাযোগ নেই, কেউ আর কারও খোঁজখবরও রাখি না।
খোঁজখবরের কোনো দরকারও নেই, আরে ইডিয়েট শেফালীর কথা বল কী আর জানিস। বউ আমার দিকে তাকিয়ে লম্বা একটা শ্বাস ফেলে। চোখের ওপর হয়তো জল ভেসে ওঠে, সাদা কাপড়ের তলায় আমার শরীরের শীতলতা অনুভব করেই হয়তো তার শরীর কেঁেপ ওঠে, অথবা লম্বা শ্বাস ফেলার চাপেও কাঁদতে পারে। বলে, শেফালী, উনি কি আর দেশে ফেরেনি? বন্ধু বলে, আমার ওপর চোখ রেখে বলে, ঠিক বলতে পারব না, ও হয়তো জানত।
কী বলেন, ও জানত! যোগাযোগ ছিল!
কীভাবে বলি বলেন, ওর সঙ্গেই শেফালীর বন্ধুত্ব গভীর ছিল। আমার জন্যই তখন ওদের বিয়ে হলো না।
কেন?
না, মানে আমার মনে খুব জেদ কাজ করছিল, শেফালী মোটেই আমাকে পাত্তা দিত না। একদিন ওকে তুলে নেয়ার কথা ভাবি। আর ভোরেই জানতে পারি শেফালী ইউরোপে চলে গেছে, কোন দেশে কেউ বলতে পারল না। হয়তো বলল না। আর আপনার স্বামী ভেবেছিল, আমি ওকে জোর করে তুলে নিয়ে বিয়ে করে ফেলেছি। তারপর তো কেউ আর কারও মুখ দেখতাম না। কয়েক বছর পরে শুনেছি, ওর একটা মেয়ে হয়েছে, স্বামী কে জানি না। তারপর এও শুনলাম, ও নাকি কখনো বিয়ে করেনি। মেয়েকে নিয়ে জীবনযাপন করছে। আমার বউ বন্ধুর দিকে তাকিয়ে থাকে, তার চোখে তেমন কোনো কৌতূহল নেই। কেউ কথা বলে না, তারপর আমার বউ শান্তভাবে বলল, শেফালীকে পারলে ওর খবরটা জানিয়ে দিবেন। বন্ধু বলল, দিব।
তখন মসজিদ থেকে কয়েকজন দোয়া পড়তে পড়তে আমার পাশে দাঁড়াল। হুজুরদের আরবি দোয়া কিছু বুঝতে না পারলেও মৃতের উদ্দেশ্যে দোয়া, সেটা পরিষ্কার। আমার তখন মন খারাপ হয়ে গেল। এখনই ওদের হাতে পড়তে হবে। আহা আরও কিছুক্ষণ এমন জাফরানি অপরাহ্ণের মিষ্টি আলোতে শেফালীর কথা হোক, গুরুদেবের গান হোক। আমার দু’জন প্রকাশকও সেখানে ছিলেন, তারাই বলল, এখন বডি মসজিদের সামনে নেয়া হবে, ভাবি আপনি এবং অন্য মহিলারা চাইলে স্যারের মুখটা শেষবারের মতো দেখতে পারেন। জানাজার পর তো আর হবে না। আমার বউর চোখের ভাসা ভাসা জল গড়িয়ে পড়ল, কিছু বলল না, সে হয়তো আর মুখ দেখতে চায় না, অন্য কেউ তাই কিছু বলল না। আমার বউ ঘর থেকে আমার দাগাদাগি করা অনেক পুরনো ‘গীতবিতান’ বইটি এনে এগিয়ে ধরে, বইটি তার সিথানে রাখবেন। এ তার ইচ্ছা ছিল। বউর কথায় চোখে বিস্ময় হুজুরদের।
কী বই?
প্রকাশক বলল, গীতবিতান।
গানের বই! হুজুরদের চোখে আপত্তি।
প্রকাশক বলল, এটা শেষ ইচ্ছা, কবরে তার মাথার পাশে বইটি রাখতে হবে।
তাই বলে গানের বই!
আমি তখন উঠে বসি, বিরক্তিতে আমার কপালে রেখা ফোটে, বলি, আরে মূর্খ গানের বই নয়, গুরুদেবের সমস্ত রচনার মধ্যে এই বইটিই বেশি রাবীন্দ্রিক, তার নিজস্ব, এটিই তার স্মারকগ্রন্থ। কিন্তু কেউ আমাকে দেখে না, শোনে না। তারা শুধু নানা দোয়া আওড়ে যায় আমার বডির পরকাল শান্তিপূর্ণ করে তুলতে। হায়, আমি কি বেঁচেও মরে আছি, নাকি আমার মরেও বেঁচে থাকা শুরু হলো। চারজন আমার বডিসহ খাটিয়া কাঁধে তুলে নেয়, দোল খেতে খেতে আমি চলি। আমার বুকের ওপর ওরা রেখে দিয়েছে গীতবিতান। আমার ওই বন্ধুটিও অনেকের সাথে খাটিয়ার সাথে চলতে শুরু করেও থেমে যায়। পিছন ফিরে তাকায়, বউ ঘরের মধ্যে, বন্ধু একটু পিছিয়ে আসে। আমার বউ ঘর থেকে সবার চলে যাওয়া দেখতে তাকায়, দেখে বন্ধুটি দাঁড়িয়ে ঘরের দিকে চেয়ে আছে। এগিয়ে এসে দাঁড়ায়, মুখে কিছু বলে না। বন্ধু বলল, একটা কথা বলব, যদিও সময়টা মনে হয় ঠিক নয় সব জানি।
আপনার কিছু বলতে হবে না , ও বলেছিল...
বউর কণ্ঠে জল আটকে আসে। বিহ্বল ভাব।
বন্ধু বলল, মেয়েটার কথা কি জানতেন। বউ কিছু বলল না।
খাটিয়া একেবারে মসজিদের ভিতরে নিয়ে রাখা হলো। হুজুরের নির্দেশে সবাই সারি বেঁধে দাঁড়ায়, জানাজা শুরু হতে হতে আমি উঠে বসি। আমার বন্ধুটি এখানে নেই। আমার বউ কি এখন কাঁদছে। খাটিয়া থেকে নেমে বাড়ির দিকে চলতে শুরু করি, বন্ধুটি পথেও নেই। এদিকে জানাজা শেষ হয়ে যাবে অল্প সময়ের মধ্যে, বন্ধুটি কি মোনাজাতেও থাকবে না! বাড়ির সামনে ছোট উঠানটিতে আমার বন্ধু দাঁড়িয়ে। বউ বারান্দার সিঁড়িতে বসে আছে কপালে হাত ঠেকিয়ে। পাড়া-প্রতিবেশি আত্মীয়দের কেউ এদিক ওদিক ছড়িয়ে ছিটিয়ে। সবাই হয়তো আমার কথাই বলছে। এসে বউর পাশে দাঁড়াই। আতরের গন্ধে বউ চোখ তোলে, চোখ দুটি লাল, বলি শেফালীর কথা ও আর কী বলল? বউ তখন বন্ধুকে বলে, ভাই আর কিছু বলবেন? বন্ধু বলল, ভাবছি শেফালীকে আমি কী করে জানাব, কোনো যোগাযোগ নেই বহু বছর, ফেসবুকে ও অবশ্য আছে। ভাবি একবার দেখবেন শেফালী দত্ত, নামের একটা সার্চ দিয়ে দেখবেন যদি পান।
শেফালী দত্ত কি একজন! কতজনই তো আছে!
এই শেফালী অধ্যাপক, প্রোফাইলে ওর মেয়ের সঙ্গে ছবি, মেয়ের ছবি দেখলেই চিনতে পারবেন এই আমাদের শেফালী দত্ত। বউ সংক্ষেপে বলল, আচ্ছা। আমার কপালে তখন ভাঁজ গভীর হলো, মেয়ের ছবি দেখে চিনবে মানে!
বউ বলল, মেয়ের ছবি দেখে চিনে ফেলব এই...।
হ্যাঁ হ্যাঁ চিনবেন, চেহারায় মিল আছে।
আমি বলি, মা মেয়ের মিল দেখে বউ কীভাবে চিনবে শেফালী কে?
বউ বলল, আমি ওদের ছবি কখনো দেখিনি, মা মেয়েকে কীভাবে চিনব। আচ্ছা ভাই অনেক্ষণ থেকে একই কথা বলছেন, আমি ঘরে যাচ্ছি।
বন্ধু বলল, ওর খবরটা পেয়ে আমার খুব কষ্ট হচ্ছিল, ও কিছুই জানল না। শুধু আমাকে ভুল বুঝে গেল, আমার বউ একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে, ও ভুলেই গেছিল, বহু বছর কোনো কথাই ওঠেনি।
বন্ধু বলল, ও, তাই হবে, মেয়ের কথাটা বোধ হয় জানত না। আমি বলি, আরে ইডিয়েট ভালোবাসা, সাঁতার, শ্বাস-প্রশ্বাস কেউ কখনো ভোলে না। ভুলে গেলে চিরতরে ভুলে যায়, সর্বভূতে মিলেমিশে হারিয়ে যায়। আমার ভালোবাসা বউর মধ্যে একাকার হয়ে গেছে। শেফালীর অস্তিত্ব, ওর শরীরের গন্ধ, ভালোবাসা সবই আবিষ্কার করি বউর মধ্যে। ওর মধ্যেই শেফালী মিলিয়ে আছে।
আমার বউ ঘরের ভিতর চলে গেল। আমার ঠোঁট ঘিরে হাসি ছড়িয়ে পড়ে, বন্ধুর কাঁধে টোকা দেই। ওর নাকে লাগে প্রথমেই আতরের গন্ধ, ভিতরটা কেঁপে ওঠে, আমি আবার টোকা দেই ওর কাঁধে। এবার ঘাড় ঘুরিয়ে দেখে আমাকে, দেখেই চমকে প্রায় অজ্ঞান হওয়ার অবস্থা। বলি, ভয় নেই, জানাজার মোনাজাত হচ্ছে, আরও ঘণ্টাখানেক লাগবে আমাকে মাটির গর্তে দোয়া-দরুদ পড়ে রাখতে। বন্ধুটি ঠাস করে বসে পড়ে। কপালে ঘাম, হৃদযন্ত্র হয়তো বন্ধ হয়ে যাবার অবস্থা। বলি, বন্ধু, মৃত্যু হলেই শরীর অস্তিত্বহীন হয়ে যায়। ভালোবাসার শরীর নেই, তো তার অস্তিত্বও বিলীন হয়ে যায় না। আমার জীবনবায়ু দেশে বিদেশে ভিয়েনায় শরীর পেয়ে গেছে বেঁচেবর্তে থাকার। চল বন্ধু এবার যাই, আমাকে কবর দিবে না!
ইপেপার
জাতীয়
সারাদেশ
আন্তর্জাতিক
নগর-মহানগর
খেলা
বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি
শিক্ষা
অর্থ-বাণিজ্য
সংস্কৃতি
ক্যাম্পাস
মিডিয়া
অপরাধ ও দুর্নীতি
রাজনীতি
শোক ও স্মরন
প্রবাস
নারীর প্রতি সহিংসতা
বিনোদন
সম্পাদকীয়
উপ-সম্পাদকীয়
মুক্ত আলোচনা
চিঠিপত্র
পাঠকের চিঠি
সাদ কামালী
শিল্পী : সঞ্জয় দে রিপন
বৃহস্পতিবার, ২০ নভেম্বর ২০২৫
আজকের বিকেল অন্য রকমের, জাফরানি আলোর ঘ্রাণে শান্তি জড়ানো, ভোরের শান্ত নরম শরীর বিকেলের আলোবাতাসে জড়িয়ে আছে। হাতের ঘড়ি আর বুদ্ধির চতুরতা না থাকলে ভোর আর বিকেলের দেহ-মেজাজের সম্পর্ক নিয়ে মনে কোনো প্রশ্ন প্রশ্রয় পেত না। প্রকৃতির কাছে আমার আরও একটি ঋণ হলো, এমন সুন্দর বিকেলের আয়োজন করে- কত মানুষ জড়ো হয়েছে। সবাই আজ আমার নিকটজন। কাছের অনেকের সাথে কথা হতো না, হলে অন্তরশূন্য ভদ্রতার অভিনয় হতো, আজ তারা আমার কাছের হয়ে উঠেছে। আমাকে তারা অনুভব করছে, স্মৃতিতে জমে থাকা, অথবা কিছুটা বানিয়ে হলেও আমার সম্পর্কে কত মধুর মধুর স্মৃতি তারা একে অপরকে বলছে খুব দরদ দিয়ে। যত শুনি তত ভালো লাগে। আহা সব সুন্দর! আতরাফের মনে আশরাফের আত্মা ভর করেছে। বাম কাঁধের ফেরেশতা ডান কাঁধের ফেরশতার হৃদয় ধার করে নিপুণ চালিয়ে যাচ্ছে। আমার এই কথা ঠিক হলো না, চালিয়ে যাচ্ছে কথার মধ্যে নেতিসূচক মন রয়েছে। আসলে তা নয়। আজ সকল আশরাফ বা ভালো মানুষের সঙ্গে আতরাফের মানে পুরাণ মতে মন্দ মানুষের বিশেষ ঐক্য হয়েছে। কেউ পুরোপুরি আশরাফ নয় বা আতরাফ নয়। সবার মধ্যে দুই গুণের বোধ আছে, হয়তো কম আর বেশি। আমার এই অতিপ্রাকৃত জীবনের আগে যে সামাজিক জীবন ছিল, সেই জীবনে আতরাফদের প্রতি আমার পক্ষপাতিত্ব দেখে বউ খোঁচা দিত। কিন্তু জানেন, পিওর আশরাফ খুব বোরিং, ভাল মানুষের ভাল ভাল কথাবার্তা ব্যবহার, মার্জিত রুচি ভঙ্গির সঙ্গে মনে হতো মিশে আছে কিছু কৃত্রিম ভদ্রতা। রাখঢাকহীন আতরাফের মনের সাফ সাফ খবর যেন অনেক সরল সোজা, অভিনয়ের ভণিতামুক্ত। আতরাফকে আমি বুঝি, আশরাফকে বুঝতে হয়, সতর্ক থাকি। ভালো মানুষের কাছে আমিও ভালো বনে থাকি। এছাড়াও রস, রসিকতা অবাধ প্রাণময়তার উচ্ছ্বাস মানে ব্যাকরণের নিয়ম নীতির প্রতি সেলাম না ঠুকেই মনের কথাটি প্রকাশ করে দেয় সরল ভাষায় আতরাফের এই দিকটি আমার পছন্দ।
এমন একটি মধুর অপরাহ্ণের জন্য বারবার মরা যায়। মানুষ কি একবারই মরে! নতুন নতুন জীবন নতুন করে মরা। এই অভিজ্ঞতা মানুষ মরার পরেই ঘটতে পারে। মরার পর আবার মরার সুযোগ পেলে তবেই অভিজ্ঞতা অন্যের সঙ্গে শেয়ার করা যায়। প্রথমই যদি শেষ ধরা হয়, জীবন তাহলে অভাবিত অভিজ্ঞতার স্বাদ থেকে বঞ্চিত হয়। আমার স্কুলে পড়ত, পরে কলেজেও, কিন্তু বিশ্ববিদ্যালয়ে এসে ভিন্ন বিভাগের কারণে দূরত্ব বেড়েছে। যদিও কাছের কখনোই ছিল না। একই বেঞ্চে বসেও দূরের ছিল বৈকি। সে এখন দারুণ বলছে, ও আমার ভাইয়ের থেকেও বেশি ছিল। কয়েকটি সুগন্ধময় তাজা বেল ফুল আমার ওপর ছুড়ে দিয়ে বলে, প্রিয় বন্ধুটিকে খুব মিস করব। তার চোখের জলের অভিঘাত কণ্ঠে। বুকের ওপর থেকে ফুলগুলি হাতের মুঠোয় নিয়ে গন্ধ শুঁকি, কী মিষ্টি গন্ধ! কতদিন পর ওকে দেখলাম! শেষ দেখেছিলাম আমার বিয়ের আগে। হঠাৎ করে আরিচা-দৌলতদিয়া ফেরিতে ওকে দেখে চট করে চিনতে পারিনি। দুপুরের রোদে কালো ফরম্যাল স্যুট, টাই, চোখে কালো চশমা- ওই আমাকে চিনে নাম ধরে ডাক দিয়েছিল। পাশেই পাজেরো জিপ, হাতের সিগারেটে বিদেশ বিদেশ গন্ধ ছিল। কালো চশমার আড়ালে চোখ, অন্ধকারেই ছিল। আজ কিন্তু তেমন নয়। প্রায় প্রৌঢ় বন্ধু এখন সাদা পোশাকে খোলা চোখে বলা কথাগুলোর সুন্দর ঘ্রাণ, চাপা শোকের চাপে হয়তো কথাগুলো বলছে থেমে থেমে। আমার অনেক কথাই মনে হচ্ছিল। তবু ইচ্ছা হয় শুধু ভালো ভালো স্মৃতিই স্মরণ করার। তেমন স্মৃতি কী ওর সাথে...। হঠাৎ মনে শেফালী এলো। সঙ্গে বেল শিউলী শেফালী ফুলের হালকা গন্ধ বাতাসে ভর করে আমার নাকের কাছে থমকে দাঁড়ায়। আমি নাক থেকে শেফালীকে বুকে আশ্রয় দেই, জানতে ইচ্ছে করে শেফালী কেমন আছে? তোর সঙ্গেই আছে তো! শুনেছিলাম বিয়ে করেছিল- তারপর খবর নিতে চাইনি। খবর পাইওনি। শেফালীকে তুই জোর করে বিয়ে করেছিলি বন্ধু, ওর ভালবাসা ছিল অন্য কোথাও। বন্ধু এবার সত্যিই লালবোটাসহ কিছু শেফালী ফুল আমার সাদা পোশাকে ছুঁড়ে দিল। শেফালীর স্পর্শ আমার বুকে এখন। এভাবেই কি আমাদের মিলন হলো। কোথায় তুমি ছিলে শেফালী।
হঠাৎ করেই শান্ত অপরাহ্ণ জনসমাগমে ভরে উঠল। কলেজের প্রিন্সিপাল কিছু শিক্ষক ছাত্রসহ এলেন অনেকগুলো লাল গোলাপের গুচ্ছ নিয়ে। সাদা সাদা ফুলের গন্ধের ভিতর তখন গোলাপের রঙ ও গন্ধ মিলিয়ে দারুণ উৎসবের রূপ দিল। ছাত্ররা আমাকে ঘিরে দাঁড়িয়ে পড়ল, বেশ কিছু ছাত্রীও আছে। তারপর সকলে একটি একটি গোলাপ হাতে নিয়ে শুরু করল-
পুষ্প দিয়ে মার যারে চিনল না সে মরণকে
তারপর
আলোর অমল কমলখানি কে ফুটালে
তারপর
শেষ নাহি যে শেষ কথা কে বলবে...
গেয়ে তাদের শ্রদ্ধা নিবেদন শেষ হলো। সবাই হাত বেঁধে দাঁড়িয়ে গান শুনল, তাকিয়ে থাকল আমার দিকে। আমি তাদের মিলিত গান শেষে সাধু সাধু বলে উঠে বসি, অধ্যক্ষ সাহেবকে বললাম, স্যার একটি মুক্তির গান করুন না। স্যার নিজেই সঙ্গে সঙ্গে গাইতে শুরু করলেন- আমার মুক্তি আলোয় আলোয়/ আমার মুক্তি ধুলায় ধুলায় ঘাসে ঘাসে... আমিও এই আকাশে... স্যারের সঙ্গে গেয়ে উঠি। কেউ কি আমাকে দেখেনি কথা বলতে, উঠে বসতে! বাহ এই তো ভাল। গান শেষে কলেজের সবাই চলে যাওয়ার পর আমি এবার দাঁড়িয়ে পড়লাম। বন্ধুর কাঁধে হাত রেখে বউকে বলি- এই বেটা শেফালীকে বিয়ে করেছিল। আমার বউ শোকে বিহ্বল নয়, গভীর ও প্রশান্ত। বলে, ভাই শেফালী ভাবিকে আনলেন না? ওর কাছে অনেক শুনেছি...
বন্ধু পরিবেশ-বেমানান হেসে ওঠে। শেফালী ওর মেয়ের সঙ্গে এখন ভিয়েনায় আছে। আমার স্বগতোক্তি, ওর মেয়ে! আমার বউ বুদ্ধিমতি, বলে, আপনাদের মেয়ে এখন ভিয়েনায়...?
হ্যাঁ ভিয়েনায়। মেয়ের বাবা শুনেছি...
মেয়ের বাবা! আমার কণ্ঠ স্ত্রীর কণ্ঠে একই স্কেলে বিস্ময় প্রকাশ করে বন্ধুর দিকে তাকায়। বন্ধু বলে, ভাবি শুনেছি, ওর বাবার পরিচয় শেফালী কাউকে বলেনি। আমার ধারণা ও অন্তঃসত্ত্বা হয়ে পড়ার পর বাইরে চলে যায়। তবে আমরা বন্ধুরা অনুমান করেছিলাম কে শেফালীর একান্ত বন্ধু ছিল। সে সব কথা অনেক পুরনো, এখন আর তার কোনো অর্থ নেই। আমার বউ এবার বলে, তাহলে আপনার পরিবার? হ্যাঁ হ্যাঁ আমার স্ত্রী তিন ছেলেমেয়ে সবাই ঢাকাতেই এখন। ও আচ্ছা। বন্ধু বলে, অনেক দিন আপনাদের সঙ্গে যোগাযোগ নেই, কেউ আর কারও খোঁজখবরও রাখি না।
খোঁজখবরের কোনো দরকারও নেই, আরে ইডিয়েট শেফালীর কথা বল কী আর জানিস। বউ আমার দিকে তাকিয়ে লম্বা একটা শ্বাস ফেলে। চোখের ওপর হয়তো জল ভেসে ওঠে, সাদা কাপড়ের তলায় আমার শরীরের শীতলতা অনুভব করেই হয়তো তার শরীর কেঁেপ ওঠে, অথবা লম্বা শ্বাস ফেলার চাপেও কাঁদতে পারে। বলে, শেফালী, উনি কি আর দেশে ফেরেনি? বন্ধু বলে, আমার ওপর চোখ রেখে বলে, ঠিক বলতে পারব না, ও হয়তো জানত।
কী বলেন, ও জানত! যোগাযোগ ছিল!
কীভাবে বলি বলেন, ওর সঙ্গেই শেফালীর বন্ধুত্ব গভীর ছিল। আমার জন্যই তখন ওদের বিয়ে হলো না।
কেন?
না, মানে আমার মনে খুব জেদ কাজ করছিল, শেফালী মোটেই আমাকে পাত্তা দিত না। একদিন ওকে তুলে নেয়ার কথা ভাবি। আর ভোরেই জানতে পারি শেফালী ইউরোপে চলে গেছে, কোন দেশে কেউ বলতে পারল না। হয়তো বলল না। আর আপনার স্বামী ভেবেছিল, আমি ওকে জোর করে তুলে নিয়ে বিয়ে করে ফেলেছি। তারপর তো কেউ আর কারও মুখ দেখতাম না। কয়েক বছর পরে শুনেছি, ওর একটা মেয়ে হয়েছে, স্বামী কে জানি না। তারপর এও শুনলাম, ও নাকি কখনো বিয়ে করেনি। মেয়েকে নিয়ে জীবনযাপন করছে। আমার বউ বন্ধুর দিকে তাকিয়ে থাকে, তার চোখে তেমন কোনো কৌতূহল নেই। কেউ কথা বলে না, তারপর আমার বউ শান্তভাবে বলল, শেফালীকে পারলে ওর খবরটা জানিয়ে দিবেন। বন্ধু বলল, দিব।
তখন মসজিদ থেকে কয়েকজন দোয়া পড়তে পড়তে আমার পাশে দাঁড়াল। হুজুরদের আরবি দোয়া কিছু বুঝতে না পারলেও মৃতের উদ্দেশ্যে দোয়া, সেটা পরিষ্কার। আমার তখন মন খারাপ হয়ে গেল। এখনই ওদের হাতে পড়তে হবে। আহা আরও কিছুক্ষণ এমন জাফরানি অপরাহ্ণের মিষ্টি আলোতে শেফালীর কথা হোক, গুরুদেবের গান হোক। আমার দু’জন প্রকাশকও সেখানে ছিলেন, তারাই বলল, এখন বডি মসজিদের সামনে নেয়া হবে, ভাবি আপনি এবং অন্য মহিলারা চাইলে স্যারের মুখটা শেষবারের মতো দেখতে পারেন। জানাজার পর তো আর হবে না। আমার বউর চোখের ভাসা ভাসা জল গড়িয়ে পড়ল, কিছু বলল না, সে হয়তো আর মুখ দেখতে চায় না, অন্য কেউ তাই কিছু বলল না। আমার বউ ঘর থেকে আমার দাগাদাগি করা অনেক পুরনো ‘গীতবিতান’ বইটি এনে এগিয়ে ধরে, বইটি তার সিথানে রাখবেন। এ তার ইচ্ছা ছিল। বউর কথায় চোখে বিস্ময় হুজুরদের।
কী বই?
প্রকাশক বলল, গীতবিতান।
গানের বই! হুজুরদের চোখে আপত্তি।
প্রকাশক বলল, এটা শেষ ইচ্ছা, কবরে তার মাথার পাশে বইটি রাখতে হবে।
তাই বলে গানের বই!
আমি তখন উঠে বসি, বিরক্তিতে আমার কপালে রেখা ফোটে, বলি, আরে মূর্খ গানের বই নয়, গুরুদেবের সমস্ত রচনার মধ্যে এই বইটিই বেশি রাবীন্দ্রিক, তার নিজস্ব, এটিই তার স্মারকগ্রন্থ। কিন্তু কেউ আমাকে দেখে না, শোনে না। তারা শুধু নানা দোয়া আওড়ে যায় আমার বডির পরকাল শান্তিপূর্ণ করে তুলতে। হায়, আমি কি বেঁচেও মরে আছি, নাকি আমার মরেও বেঁচে থাকা শুরু হলো। চারজন আমার বডিসহ খাটিয়া কাঁধে তুলে নেয়, দোল খেতে খেতে আমি চলি। আমার বুকের ওপর ওরা রেখে দিয়েছে গীতবিতান। আমার ওই বন্ধুটিও অনেকের সাথে খাটিয়ার সাথে চলতে শুরু করেও থেমে যায়। পিছন ফিরে তাকায়, বউ ঘরের মধ্যে, বন্ধু একটু পিছিয়ে আসে। আমার বউ ঘর থেকে সবার চলে যাওয়া দেখতে তাকায়, দেখে বন্ধুটি দাঁড়িয়ে ঘরের দিকে চেয়ে আছে। এগিয়ে এসে দাঁড়ায়, মুখে কিছু বলে না। বন্ধু বলল, একটা কথা বলব, যদিও সময়টা মনে হয় ঠিক নয় সব জানি।
আপনার কিছু বলতে হবে না , ও বলেছিল...
বউর কণ্ঠে জল আটকে আসে। বিহ্বল ভাব।
বন্ধু বলল, মেয়েটার কথা কি জানতেন। বউ কিছু বলল না।
খাটিয়া একেবারে মসজিদের ভিতরে নিয়ে রাখা হলো। হুজুরের নির্দেশে সবাই সারি বেঁধে দাঁড়ায়, জানাজা শুরু হতে হতে আমি উঠে বসি। আমার বন্ধুটি এখানে নেই। আমার বউ কি এখন কাঁদছে। খাটিয়া থেকে নেমে বাড়ির দিকে চলতে শুরু করি, বন্ধুটি পথেও নেই। এদিকে জানাজা শেষ হয়ে যাবে অল্প সময়ের মধ্যে, বন্ধুটি কি মোনাজাতেও থাকবে না! বাড়ির সামনে ছোট উঠানটিতে আমার বন্ধু দাঁড়িয়ে। বউ বারান্দার সিঁড়িতে বসে আছে কপালে হাত ঠেকিয়ে। পাড়া-প্রতিবেশি আত্মীয়দের কেউ এদিক ওদিক ছড়িয়ে ছিটিয়ে। সবাই হয়তো আমার কথাই বলছে। এসে বউর পাশে দাঁড়াই। আতরের গন্ধে বউ চোখ তোলে, চোখ দুটি লাল, বলি শেফালীর কথা ও আর কী বলল? বউ তখন বন্ধুকে বলে, ভাই আর কিছু বলবেন? বন্ধু বলল, ভাবছি শেফালীকে আমি কী করে জানাব, কোনো যোগাযোগ নেই বহু বছর, ফেসবুকে ও অবশ্য আছে। ভাবি একবার দেখবেন শেফালী দত্ত, নামের একটা সার্চ দিয়ে দেখবেন যদি পান।
শেফালী দত্ত কি একজন! কতজনই তো আছে!
এই শেফালী অধ্যাপক, প্রোফাইলে ওর মেয়ের সঙ্গে ছবি, মেয়ের ছবি দেখলেই চিনতে পারবেন এই আমাদের শেফালী দত্ত। বউ সংক্ষেপে বলল, আচ্ছা। আমার কপালে তখন ভাঁজ গভীর হলো, মেয়ের ছবি দেখে চিনবে মানে!
বউ বলল, মেয়ের ছবি দেখে চিনে ফেলব এই...।
হ্যাঁ হ্যাঁ চিনবেন, চেহারায় মিল আছে।
আমি বলি, মা মেয়ের মিল দেখে বউ কীভাবে চিনবে শেফালী কে?
বউ বলল, আমি ওদের ছবি কখনো দেখিনি, মা মেয়েকে কীভাবে চিনব। আচ্ছা ভাই অনেক্ষণ থেকে একই কথা বলছেন, আমি ঘরে যাচ্ছি।
বন্ধু বলল, ওর খবরটা পেয়ে আমার খুব কষ্ট হচ্ছিল, ও কিছুই জানল না। শুধু আমাকে ভুল বুঝে গেল, আমার বউ একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে, ও ভুলেই গেছিল, বহু বছর কোনো কথাই ওঠেনি।
বন্ধু বলল, ও, তাই হবে, মেয়ের কথাটা বোধ হয় জানত না। আমি বলি, আরে ইডিয়েট ভালোবাসা, সাঁতার, শ্বাস-প্রশ্বাস কেউ কখনো ভোলে না। ভুলে গেলে চিরতরে ভুলে যায়, সর্বভূতে মিলেমিশে হারিয়ে যায়। আমার ভালোবাসা বউর মধ্যে একাকার হয়ে গেছে। শেফালীর অস্তিত্ব, ওর শরীরের গন্ধ, ভালোবাসা সবই আবিষ্কার করি বউর মধ্যে। ওর মধ্যেই শেফালী মিলিয়ে আছে।
আমার বউ ঘরের ভিতর চলে গেল। আমার ঠোঁট ঘিরে হাসি ছড়িয়ে পড়ে, বন্ধুর কাঁধে টোকা দেই। ওর নাকে লাগে প্রথমেই আতরের গন্ধ, ভিতরটা কেঁপে ওঠে, আমি আবার টোকা দেই ওর কাঁধে। এবার ঘাড় ঘুরিয়ে দেখে আমাকে, দেখেই চমকে প্রায় অজ্ঞান হওয়ার অবস্থা। বলি, ভয় নেই, জানাজার মোনাজাত হচ্ছে, আরও ঘণ্টাখানেক লাগবে আমাকে মাটির গর্তে দোয়া-দরুদ পড়ে রাখতে। বন্ধুটি ঠাস করে বসে পড়ে। কপালে ঘাম, হৃদযন্ত্র হয়তো বন্ধ হয়ে যাবার অবস্থা। বলি, বন্ধু, মৃত্যু হলেই শরীর অস্তিত্বহীন হয়ে যায়। ভালোবাসার শরীর নেই, তো তার অস্তিত্বও বিলীন হয়ে যায় না। আমার জীবনবায়ু দেশে বিদেশে ভিয়েনায় শরীর পেয়ে গেছে বেঁচেবর্তে থাকার। চল বন্ধু এবার যাই, আমাকে কবর দিবে না!