অনন্য দিলারা হাফিজ
মাহফুজ আল-হোসেন
দিলারা হাফিজ / জন্ম : ২০ নভেম্বর ১৯৫৫
মুক্তিযুদ্ধ-পরবর্তী বাংলা কবিতার ঝাঁপি যখনই আমরা খুলে বসি, সেখানে আমরা এক ক্রমবিবর্তিত মনস্তত্ত্বের মুখোমুখি হই- যার একদিকে লক্ষ্য করি ভাষার নতুন আঙ্গিক, অন্যদিকে ব্যক্তিসত্তার গভীর ভাঙাগড়া। বিংশ শতাব্দীর আশির দশক সেই ভাঙাগড়ার কেন্দ্রবিন্দু, যেখানে কবিতা ক্রমশ নিজেকে মুক্ত করে রাজনৈতিক উচ্চারণের কাঠামো থেকে, সামাজিক কর্তৃত্বের টানাপোড়েন থেকে, এমনকি তুমি-আমির একরৈখিক রোম্যান্টিক কাব্য ঐতিহ্যের পরম্পরা থেকেও। এই দশকের কবিতায় তাই ব্যক্তিমানসের এক দুর্দমনীয় উত্থান দেখা যায়- যেখানে নারীর সৃজনশীলতা শুধুমাত্র প্রতিবাদের ভাষা নয়, বরং খুঁজে ফেরে স্বাধীন স্বাতন্ত্র্যিক আইডেনটিটি। এমনই একসময়ে, যখন নারীর কবিতা প্রায়শই পরিচয়ের গ-িতে আবদ্ধ হয়ে পড়ত, ঠিক তখনই আলাদা স্বর, স্বতন্ত্র কাব্যবীক্ষা ও ভাষিক ঔজ্জ্বল্যে শনাক্তযোগ্য আধুনিক কবি হিসেবে বোধের রৌদ্রদগ্ধ প্রখর দীপ্তি ছড়ান কবি দিলারা হাফিজ আমাদের কাব্যাঙ্গনে।
দিলারা হাফিজের কবিতার ভেতর যে ভাষামগ্নতা, তা মূলত জন্ম নেয় তাঁর গভীর প্রকৃতিজ্ঞান, অন্তরের অরণ্যমৈথুন এবং নারীর আত্মদর্শনের নিরবচ্ছিন্ন অনুসন্ধান থেকে- যেখানে মাতৃভূমির শ্যামল সবুজ প্রকৃতি কেবল রূপক বা অলংকার নয়, বরং এমনসব অভাবিতপূর্ব ইমেজারি থাকে, যেন অস্তিত্বের মর্মমূলে প্রবহমান গূঢ় বহতা কালিগঙ্গার অন্তঃপ্রবাহ, আর জন্মভূমি মানিকগঞ্জের নিভৃত পল্লী গড়পাড়ার ‘মাটির মমতা’র সোঁদা গন্ধে উন্মাতাল হয়েকবিতায় জীবনের পরমার্থকে অন্বেষণ করেন অনিত্য অনিশ্চিত আলোছায়ায় কিংবা বৃষ্টির ভেজা আকর্ষক ঐহিক আকাশের গায়ে আঁকা সাতরঙা রামধনুর ভ্রুরেখায়। তাঁর ভাষায়প্রকৃতি এক ধরনের অন্তর্গত স্মৃতি, স্বপ্নময়তা, প্রগাঢ় বেদনাকে আঁকড়ে ধরে দৃঢ়মূলে, আবার অনিবার্যভাবে হয়ে ওঠে এক বিমূর্ত আশ্রয়। যেন দেহ আর ধরিত্রী পরস্পরের অন্তরঙ্গ স্পর্শে জন্ম দেয় আরেক অনির্বচনীয় অনুভূতির। তাঁর কবিতার পঙ্?ক্তির নীরবতার মধ্যেও আমরা শুনতে পাই- নিজেকে হারানোর আকাক্সক্ষা নয়, বরং নিজেকে আবিষ্কারের অদৃশ্য আলো:
০১.
“শরীরে কতটা মাটি মেখে নিলে আমি জমি হবো?/ চাষের ক্ষেতের ঘাস/ অথবা শস্যের মাঠ!/ নয়তো আইলে পড়ে থাকা তুচ্ছ অচেনা সবুজ /আমি সেরকম শব্দবীজের অপেক্ষা করি আজো.../ আমি তো মোটেও হতে চাই না মাটির খানা-দানা/ কেঁচোমাটি নয়-/ ধুলোমাটি নয় /পৃথিবীর অসামান্য আয়ু বয়ে নিয়ে /শব্দশস্যে,নিত্যানন্দে স্বপ্নময় ভোর হতে চাই...” (শরীরে কতটা মাটি)
০২.
“স্নিগ্ধ সবুজ যেটুকু তার বাতাস ছিলো অন্যমনে/ সেই অসীমে এখন ওড়ে, অভিমানী পাখির পালক/ আমিও যে কি!/ স্মৃতি খুঁড়ে দুঃখ আঁকি পবন-মনে;” (এই বাড়িটা)
সেকারণে প্রকৃতিমগ্নতা আবার নিছক রোমান্টিক অনুভব নয়; বরং তাঁর কবিতা প্রকৃতিকে ধারণ করে সামাজিক ও দার্শনিক সত্তার গভীর স্তরে। যেমন নদী তাঁর কাছে শুধু স্বাভাবিক ভৌগোলিক গতিপথ নয়, দেহের অভ্যন্তরের এক প্রবাহ; বনানী শুধু চিত্রকল্প নয়, মানবিক সম্পর্কের ঘন ছায়া; বাতাস কেবল ঋতুচক্র নয়, বরং স্মৃতির দীর্ঘশ্বাস। আর ফুল ও মাটির চিহ্নগুলো কখনও কখনও তাঁর কবিতায় নারীর স্বকীয় দেহ-চেতনার প্রতীক হয়ে ওঠে। এভাবে কবিতা যেন নিজেই এক জীবন্ত পরিবেশব্যবস্থা- একটি ইকো-টেক্সট- যেখানে প্রকৃতি, নারী, মানুষ ও সমাজ মিশে যায় একই নন্দনতাত্ত্বিক অঙ্গে।
সমকালীন কাব্যভাষার প্রেক্ষাপটে তাঁর অবদান আরও স্পষ্ট। ৮০-র দশকের কবিরা যখন ভাষার ভিতরে বিচ্ছিন্নতা, বিদ্রোহ, ব্যঙ্গ এবং দৈনন্দিনতার ভিন্নধর্মী সৌন্দর্য খুঁজছিলেন, তখন দিলারা হাফিজ সুর তুললেন ভাষার আরেক গভীরতর সুরে- যেখানে ভাঙনের ভাঙচুর নেই, আছে ভেতরের শব্দ-কম্পনের সূক্ষ্ম নির্মাণ। তাঁর ভাষা কখনও মসৃণ, কখনও কর্কশ- কিন্তু সবসময়ই সংবেদনশীল। তিনি শব্দে শব্দে নির্মাণ করেছেন নারীর আত্মশব্দ- অপ্রকাশ্য, অন্তর্মুখী এবং প্রগাঢ়। আধুনিকতার কোলাজ-ধর্মী চিত্র, উত্তরাধিকারের ধারার বিচ্ছিন্নতা, সম্পর্কের নীরব পতন- এসব তাঁর কাব্যের ছায়ায় এসে দাঁড়ায়, কিন্তু সেগুলো কখনও তাঁর কবিতাকে শাসন করে না; বরং তাঁর কাব্যসত্তা সেগুলোকে এক অদৃশ্য আলোয় ভাসিয়ে দেয়।
দিলারা হাফিজের কবিতায় উত্তরাধুনিক উচ্চারণও তীব্রভাবে লক্ষণীয়- কিন্তু তা কখনোই অনুকরণমূলক নয়। তাঁর কবিতায় লিনিয়ার ধারাবর্ণনা নেই; আছে ভাঙা বাক্য, ছেঁড়া চিহ্ন, সুরের ছদ্মনীরবতা, একটি বিষয় থেকে অন্যটির হঠাৎ উড়ে যাওয়া- কিন্তু সে সবই আছে যেভাবে পাতার উপর আলো খেলা করে বা বাতাস আচমকা দিক পাল্টে ফেলে। তিনি উত্তরাধুনিকতার কোলাজ-ধর্মী চিত্রকল্পকে গ্রহণ করেছেন স্বতঃস্ফূর্তভাবে, কারণ তাঁর নিজের জীবনবোধই ছিল খ-িত বাস্তবতার গভীর অনুধ্যান- যেখানে স্মৃতি, সম্পর্ক, দুঃখ, আকাক্সক্ষা এবং শারীরিক-মানসিক অভিজ্ঞতা মিলেমিশে তৈরি করে এক জটিল অথচ স্বাভাবিক কাব্যিক চক্র।
নারী-স্বকীয়তা তাঁর কবিতায় কোনো রাজনৈতিক স্লোগান নয়; বরং ব্যক্তিমানসের ভেতর থেকে জন্ম নেওয়া এক সৃষ্টিশীল মুক্তি। তিনি প্রমাণ করেছেন যে, নারী-সত্তা মানেই কেবল নারীবাদী প্রতিবাদের রূপ নয়; বরং নারীর ভেতরের ভাষা, শরীরের ¯্রােত, দুঃখের লঘু ডানা, চেতনার গহিন দৃশ্যপট- সবকিছু মিলে গড়ে ওঠা এক আত্মসমগ্রতা। তিনি কখনও সম্পর্কের ভাঙনকে চিৎকারে প্রকাশ করেন না; বরং একটি নিঃশব্দ ক্ষতের মধ্যেই তার অস্তিত্বের গভীরতা অনুভব করান। কখনোবা প্রেম তাঁর কাছে বিস্ময়ের মতো আসে, কখনো বা বিদ্রোহ তাঁর কাব্যে নেমে আসে অঘোষিত ঝড়ের মতো।
রফিক আজাদের স্ত্রী হওয়ার পরিচয়ের বাইরে নিজের কাব্যিক পরিচয় নির্মাণ- এই যাত্রা তাই সহজ ছিল না। তিনি কাব্যরচনার মানসে সম্পূর্ণ নিজের; ভাষা, স্বর, ছন্দ, ছবি- সবকিছু ছিল তাঁর স্বতন্ত্র। তিনি কারও ছায়া হয়ে ওঠেননি; বরং নিজস্ব অস্তিত্বের আলোকে গড়েছেন নিজের নদী, নিজের দিগন্ত। এই জন্যই সমালোচকেরা তাঁর কবিতাকে বলেন- “নীরবতার ভেতর উচ্চারণের নির্মাণ”; আবার কেউ কেউ বলেন- “নারীর অভ্যন্তরীণ প্রকৃতির ¯্রােত”।
মুক্তিযুদ্ধোত্তর বাংলা কবিতার পরিবর্তনধারায় তাঁর কবিতা একটি বিশেষ বাঁক- যেখানে একইসঙ্গে আছে প্রকৃতি, নারীত্ব, ভাষার অভ্যন্তরীণ মাধুর্য, আধুনিক মনস্তত্ত্ব, এবং উত্তরাধুনিক বিক্ষিপ্ততার সংগীতে গড়ে ওঠা নতুন নির্মাণ। তিনি প্রমাণ করেছেন- একজন কবি কেবল শব্দের কারিগর নন; বরং তিনি সমাজ, ইতিহাস, প্রকৃতি ও সময়ের দৃশ্যপটে নিজস্ব আলো দিয়ে দাঁড়িয়ে থাকা এক সৃষ্টিশীল অভিকর্ষ। কবির অনুচ্চস্বরের স্পষ্টোচ্চারণে উঠে আসে- সমাজ, সংসার ও শাস্ত্রের অনুদার অস্বীকৃতি ও প্রতিবন্ধকতা সত্ত্বেও নারীর জ্ঞানতাত্ত্বিক চর্চার নান্দনিক পরিভ্রমণ সভ্যতার আদিপর্ব থেকে শুরু করে অদ্যাবধি অগ্রসরমান:
“শেষবার আমি সত্য উচ্চারণ করেছি/ খনার কর্তিত জিহ্বায়/ তোমরা কি আমাকে এখন চেনো আর,/ অনেক আগেই আমি ছেড়ে গেছি তোমাদের বিস্ময় ভার... না বিংশ শতাব্দী না একুশ শতক/ উত্তর-আধুনিক সময়ের সাম্পান যখন/ ঐতিহ্যেই ভাসমান/ তখনও আত্মপীড়নের ক্রান্তিকুলায়/ ভিক্ষাপাত্র হাতে কেবলই আমি/ খুঁজে ফিরি ভিক্ষালব্ধ জ্ঞান;/ ভিক্ষালব্ধ জ্ঞান,/ ভিক্ষালব্ধ জ্ঞান...” (খুঁজে ফিরি ভিক্ষালব্ধ জ্ঞান)
দিলারা হাফিজের কাব্যভাষায় রয়েছে ট্যাবু ভাঙার দুরন্ত সাহস। কবি নারীদেহ, যৌনতা, স্পর্শ, আকাক্সক্ষা, প্রতিরোধ- এই সব জটিল অনুভূতিকে কেবল রূপক বা আড়ালে-আবডালে নয়; বরং সত্যের খোলা জানালায় অনায়াসে স্থাপন করেছেন। তিনি নিঃসঙ্কোচে কবিতায় তুলে? এনেছেন- মানবজাতি স্তন্যদাত্রী নারীর কাছে কতোটা ঋণী। সেক্ষেত্রে নারীবাদকে তিনি মানববাদে উন্নীত করেছেন অনন্য শৈল্পিকতায়।
এটি বললে অত্যুক্তি হবে না যে, স্বভাষায় ও সমকালীন প্রেক্ষাপটে মানবতাবাদী কবি দিলারা হাফিজ আমাদের কবিতায় ক্রমশ অপরিহার্য ও প্রাসঙ্গিক হয়ে উঠেছেন তাঁর নিরন্তর সাধনা ও আকাশস্পর্শী সৃষ্টিশীলতা দিয়ে অনন্য কাব্যিক শক্তিমত্তা অর্জনের জন্য, নিজের সত্তার স্বীকৃতি অর্জনের সাহসের জন্য; আর সবচেয়ে বড় কথা- নারীবাদী কবিতা কীভাবে একইসঙ্গে কোমল, দগ্ধ, পরিশীলিত অথচ প্রতিবাদী হয়ে উঠতে পারে- অনুগামীদের জন্য সেটির এক অত্যুজ্জ্বল উদাহরণ হয়ে থাকবার জন্য।
কবি দিলারা হাফিজ ১৯৫৫ সালের ২০ নভেম্বর মানিকগঞ্জের কালিগঙ্গা নদীবিধৌত গড়পাড়া গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। পিতা-বখশী হাফিজ উদ্দিন আহমেদ এবং মাতা রহিমা হাফিজ। তিনি একজন প্রথিতযশা শিক্ষাবিদ। ৩৭ বছরের শিক্ষকতা জীবনে দেশের বেশ কয়েকটি ঐতিহ্যবাহী ও বৃহৎ কলেজের অধ্যক্ষের দায়িত্ব অত্যন্ত দক্ষতার ও সফলতার সাথে পালন করছেন। সর্বশেষ মাধ্যমিক ও উচ্চমাধ্যমিক শিক্ষাবোর্ড ঢাকা-এর চেয়ারম্যান হিসেবে কর্মজীবন থেকে অবসর নিয়েছেন। তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বাংলা ভাষা ও সাহিত্যে বিএ (অনার্স) ও এম এ করেছেন। তিনি ১৯৯৮ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীনে ইউজিসির স্কলারশীপে পিএইচ.ডি ডিগ্রি লাভ করেন। অধ্যাপনার পাশাপাশি টেলিভিশনে গণশিক্ষা ও শিক্ষা গবেষণামূলক প্রোগ্রামে ২২ বছর যাবত গবেষণা, গ্রন্থনা ও উপস্থাপনার কাজে দায়িত্ব পালন করেছেন। নিজ অঞ্চলের পশ্চাৎপদ শিশুদের প্রতিভা বিকাশ? ও সার্বিক উন্নয়নে কাজ করে গেছেন। তাঁর প্রকাশিত কাব্যগ্রন্থ : ভালোবাসার কবিতা (১৯৮২), পিতা কিংবা পুত্র অথবা প্রেমিক(১৯৮৩), প্রেমের কবিতা (১৯৯৮), কে নেবে দায় (২০০১), খুঁজে ফিরি ভিক্ষালব্ধ জ্ঞান (২০১২), নির্বাচিত কবিতা ( ২০০৫), অবিনশ্বর আয়না (২০১৮), নারী সংহিতা (২০১৯), কবিতা সমগ্র (২০২১), স্তনের অহংকার (২০২২), একগুচ্ছ দিলারা হাফিজ (২০২৫) , গবেষয়ণা গ্রন্থ : বাংলাদেশের কবিতায় ব্যক্তি ও সমাজ (১৯৪৭-৭১) এবং এ ছাড়াও রয়েছে স্মৃতি গদ্য : আনন্দ বেদনা যজ্ঞে রফিক আজাদ ( ২০১৮), স্মৃতি উপন্যাস: কে প্রথম কাছে এসেছি (২০২০)সহ শিশুতোষ ও সম্পাদিত বেশ কিছু গ্রন্থ। মার্কিন কবি ক্যারোলিন রাইট ও ভারতীয় বহু ভাষাবিদ প-িত শ্যাম সিং শশী নারী অধিকার সম্পর্কিত তাঁর অনেক কবিতার অনুবাদ করেছেন। ১৯৮৩ সালে কবি কবিতার জন্য পেয়েছেন লা ফর্তিনা সম্মাননা ও ২০১২ সালে নোবেলজয়ী অর্থনীতিবিদ অমর্ত্য সেন-এর হাত থেকে গ্রহণ করেন মানিকগঞ্জ সাহিত্য ও সাংস্কৃতিক পরিষদ সম্মাননা এবং অন্যান্য সম্মাননা। তবে তাঁর জীবনের সবচেয়ে বড় সম্মাননা ও পুরস্কার হলো দেশে ও প্রবাসে অসংখ্য কবি, লেখক, পাঠক ও গুণগ্রাহীর ভালবাসা, সর্বোপরি কর্ম ও মর্মসহচরী হিসেবে বাংলা কবিতার অন্যতম প্রধান কবি রফিক আজাদ (প্রয়াত)-এর সাথে প্রেমময় জীবন ও কবিতাযাপন এবং সেসবের অক্ষয় অমূল্য স্মৃতিসত্তা। দুই পুত্র অভিন্ন আজাদ? ও অব্যয় আজাদ-এর? মমতাময়ী মা তিনি।
সমসাময়িক বাংলা আধুনিক কবিতার অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ ও প্রতিভাদীপ্ত কবি দিলারা হাফিজের কাব্যভাষার বহুকৌণিক আলো প্রতিনিয়ত ছড়িয়ে পড়েছে স্বদেশ ও কবিতাবিশ্বে। সময় গড়ায়, প্রজন্ম এগিয়ে যায়- তবু তাঁর প্রসাধিত শব্দের সৌগন্ধ ও সৌন্দর্য, তার অন্তরঙ্গ স্পর্শ, নারীসত্তার স্বতন্ত্র দিগন্ত সর্বোপরি ভাষার মায়াবিস্তারী গভীর সুর- সবকিছু মিলেই স্থায়ী আবেদন তৈরি করে চলেছে আমাদের সাহিত্যমানসে, প্রজন্ম থেকে প্রজন্মান্তরে। চলচ্চিত্রের মতো ফ্ল্যাশব্যাকে একের পর এক ভেসে নয়ানাভিরামপ্রাকৃতিক দৃশ্য- শান্ত নদী, বাতাস বয়ে যায়, আলো খেলা করে- কিন্তু তার ভেতর লুকিয়ে থাকা রুদ্ররূপটিও যেন অনুভব করি মানবীয় সত্তায়, আমাদের অন্তরাত্মায়। তাঁর কবিতা তাই রূপকল্পের অরণ্য, শব্দের মৃদু নদী এবং মাটির সঙ্গে দেহের স্পর্শে জন্ম নেওয়া এক দীর্ঘ, নীরব, অথচ প্রবল উচ্চারণ। আজ ২০ নভেম্বর ২০২৫- কবির ৭১তম শুভ জন্মদিন। সুস্বাস্থ্য নিয়ে শতায়ু হোন প্রিয় কবি। আমাদের সমুগ্ধ শ্রদ্ধা, ভালবাসা ও অভিবাদন গ্রহণ করুন।
ইপেপার
জাতীয়
সারাদেশ
আন্তর্জাতিক
নগর-মহানগর
খেলা
বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি
শিক্ষা
অর্থ-বাণিজ্য
সংস্কৃতি
ক্যাম্পাস
মিডিয়া
অপরাধ ও দুর্নীতি
রাজনীতি
শোক ও স্মরন
প্রবাস
নারীর প্রতি সহিংসতা
বিনোদন
সম্পাদকীয়
উপ-সম্পাদকীয়
মুক্ত আলোচনা
চিঠিপত্র
পাঠকের চিঠি
অনন্য দিলারা হাফিজ
মাহফুজ আল-হোসেন
দিলারা হাফিজ / জন্ম : ২০ নভেম্বর ১৯৫৫
বৃহস্পতিবার, ২০ নভেম্বর ২০২৫
মুক্তিযুদ্ধ-পরবর্তী বাংলা কবিতার ঝাঁপি যখনই আমরা খুলে বসি, সেখানে আমরা এক ক্রমবিবর্তিত মনস্তত্ত্বের মুখোমুখি হই- যার একদিকে লক্ষ্য করি ভাষার নতুন আঙ্গিক, অন্যদিকে ব্যক্তিসত্তার গভীর ভাঙাগড়া। বিংশ শতাব্দীর আশির দশক সেই ভাঙাগড়ার কেন্দ্রবিন্দু, যেখানে কবিতা ক্রমশ নিজেকে মুক্ত করে রাজনৈতিক উচ্চারণের কাঠামো থেকে, সামাজিক কর্তৃত্বের টানাপোড়েন থেকে, এমনকি তুমি-আমির একরৈখিক রোম্যান্টিক কাব্য ঐতিহ্যের পরম্পরা থেকেও। এই দশকের কবিতায় তাই ব্যক্তিমানসের এক দুর্দমনীয় উত্থান দেখা যায়- যেখানে নারীর সৃজনশীলতা শুধুমাত্র প্রতিবাদের ভাষা নয়, বরং খুঁজে ফেরে স্বাধীন স্বাতন্ত্র্যিক আইডেনটিটি। এমনই একসময়ে, যখন নারীর কবিতা প্রায়শই পরিচয়ের গ-িতে আবদ্ধ হয়ে পড়ত, ঠিক তখনই আলাদা স্বর, স্বতন্ত্র কাব্যবীক্ষা ও ভাষিক ঔজ্জ্বল্যে শনাক্তযোগ্য আধুনিক কবি হিসেবে বোধের রৌদ্রদগ্ধ প্রখর দীপ্তি ছড়ান কবি দিলারা হাফিজ আমাদের কাব্যাঙ্গনে।
দিলারা হাফিজের কবিতার ভেতর যে ভাষামগ্নতা, তা মূলত জন্ম নেয় তাঁর গভীর প্রকৃতিজ্ঞান, অন্তরের অরণ্যমৈথুন এবং নারীর আত্মদর্শনের নিরবচ্ছিন্ন অনুসন্ধান থেকে- যেখানে মাতৃভূমির শ্যামল সবুজ প্রকৃতি কেবল রূপক বা অলংকার নয়, বরং এমনসব অভাবিতপূর্ব ইমেজারি থাকে, যেন অস্তিত্বের মর্মমূলে প্রবহমান গূঢ় বহতা কালিগঙ্গার অন্তঃপ্রবাহ, আর জন্মভূমি মানিকগঞ্জের নিভৃত পল্লী গড়পাড়ার ‘মাটির মমতা’র সোঁদা গন্ধে উন্মাতাল হয়েকবিতায় জীবনের পরমার্থকে অন্বেষণ করেন অনিত্য অনিশ্চিত আলোছায়ায় কিংবা বৃষ্টির ভেজা আকর্ষক ঐহিক আকাশের গায়ে আঁকা সাতরঙা রামধনুর ভ্রুরেখায়। তাঁর ভাষায়প্রকৃতি এক ধরনের অন্তর্গত স্মৃতি, স্বপ্নময়তা, প্রগাঢ় বেদনাকে আঁকড়ে ধরে দৃঢ়মূলে, আবার অনিবার্যভাবে হয়ে ওঠে এক বিমূর্ত আশ্রয়। যেন দেহ আর ধরিত্রী পরস্পরের অন্তরঙ্গ স্পর্শে জন্ম দেয় আরেক অনির্বচনীয় অনুভূতির। তাঁর কবিতার পঙ্?ক্তির নীরবতার মধ্যেও আমরা শুনতে পাই- নিজেকে হারানোর আকাক্সক্ষা নয়, বরং নিজেকে আবিষ্কারের অদৃশ্য আলো:
০১.
“শরীরে কতটা মাটি মেখে নিলে আমি জমি হবো?/ চাষের ক্ষেতের ঘাস/ অথবা শস্যের মাঠ!/ নয়তো আইলে পড়ে থাকা তুচ্ছ অচেনা সবুজ /আমি সেরকম শব্দবীজের অপেক্ষা করি আজো.../ আমি তো মোটেও হতে চাই না মাটির খানা-দানা/ কেঁচোমাটি নয়-/ ধুলোমাটি নয় /পৃথিবীর অসামান্য আয়ু বয়ে নিয়ে /শব্দশস্যে,নিত্যানন্দে স্বপ্নময় ভোর হতে চাই...” (শরীরে কতটা মাটি)
০২.
“স্নিগ্ধ সবুজ যেটুকু তার বাতাস ছিলো অন্যমনে/ সেই অসীমে এখন ওড়ে, অভিমানী পাখির পালক/ আমিও যে কি!/ স্মৃতি খুঁড়ে দুঃখ আঁকি পবন-মনে;” (এই বাড়িটা)
সেকারণে প্রকৃতিমগ্নতা আবার নিছক রোমান্টিক অনুভব নয়; বরং তাঁর কবিতা প্রকৃতিকে ধারণ করে সামাজিক ও দার্শনিক সত্তার গভীর স্তরে। যেমন নদী তাঁর কাছে শুধু স্বাভাবিক ভৌগোলিক গতিপথ নয়, দেহের অভ্যন্তরের এক প্রবাহ; বনানী শুধু চিত্রকল্প নয়, মানবিক সম্পর্কের ঘন ছায়া; বাতাস কেবল ঋতুচক্র নয়, বরং স্মৃতির দীর্ঘশ্বাস। আর ফুল ও মাটির চিহ্নগুলো কখনও কখনও তাঁর কবিতায় নারীর স্বকীয় দেহ-চেতনার প্রতীক হয়ে ওঠে। এভাবে কবিতা যেন নিজেই এক জীবন্ত পরিবেশব্যবস্থা- একটি ইকো-টেক্সট- যেখানে প্রকৃতি, নারী, মানুষ ও সমাজ মিশে যায় একই নন্দনতাত্ত্বিক অঙ্গে।
সমকালীন কাব্যভাষার প্রেক্ষাপটে তাঁর অবদান আরও স্পষ্ট। ৮০-র দশকের কবিরা যখন ভাষার ভিতরে বিচ্ছিন্নতা, বিদ্রোহ, ব্যঙ্গ এবং দৈনন্দিনতার ভিন্নধর্মী সৌন্দর্য খুঁজছিলেন, তখন দিলারা হাফিজ সুর তুললেন ভাষার আরেক গভীরতর সুরে- যেখানে ভাঙনের ভাঙচুর নেই, আছে ভেতরের শব্দ-কম্পনের সূক্ষ্ম নির্মাণ। তাঁর ভাষা কখনও মসৃণ, কখনও কর্কশ- কিন্তু সবসময়ই সংবেদনশীল। তিনি শব্দে শব্দে নির্মাণ করেছেন নারীর আত্মশব্দ- অপ্রকাশ্য, অন্তর্মুখী এবং প্রগাঢ়। আধুনিকতার কোলাজ-ধর্মী চিত্র, উত্তরাধিকারের ধারার বিচ্ছিন্নতা, সম্পর্কের নীরব পতন- এসব তাঁর কাব্যের ছায়ায় এসে দাঁড়ায়, কিন্তু সেগুলো কখনও তাঁর কবিতাকে শাসন করে না; বরং তাঁর কাব্যসত্তা সেগুলোকে এক অদৃশ্য আলোয় ভাসিয়ে দেয়।
দিলারা হাফিজের কবিতায় উত্তরাধুনিক উচ্চারণও তীব্রভাবে লক্ষণীয়- কিন্তু তা কখনোই অনুকরণমূলক নয়। তাঁর কবিতায় লিনিয়ার ধারাবর্ণনা নেই; আছে ভাঙা বাক্য, ছেঁড়া চিহ্ন, সুরের ছদ্মনীরবতা, একটি বিষয় থেকে অন্যটির হঠাৎ উড়ে যাওয়া- কিন্তু সে সবই আছে যেভাবে পাতার উপর আলো খেলা করে বা বাতাস আচমকা দিক পাল্টে ফেলে। তিনি উত্তরাধুনিকতার কোলাজ-ধর্মী চিত্রকল্পকে গ্রহণ করেছেন স্বতঃস্ফূর্তভাবে, কারণ তাঁর নিজের জীবনবোধই ছিল খ-িত বাস্তবতার গভীর অনুধ্যান- যেখানে স্মৃতি, সম্পর্ক, দুঃখ, আকাক্সক্ষা এবং শারীরিক-মানসিক অভিজ্ঞতা মিলেমিশে তৈরি করে এক জটিল অথচ স্বাভাবিক কাব্যিক চক্র।
নারী-স্বকীয়তা তাঁর কবিতায় কোনো রাজনৈতিক স্লোগান নয়; বরং ব্যক্তিমানসের ভেতর থেকে জন্ম নেওয়া এক সৃষ্টিশীল মুক্তি। তিনি প্রমাণ করেছেন যে, নারী-সত্তা মানেই কেবল নারীবাদী প্রতিবাদের রূপ নয়; বরং নারীর ভেতরের ভাষা, শরীরের ¯্রােত, দুঃখের লঘু ডানা, চেতনার গহিন দৃশ্যপট- সবকিছু মিলে গড়ে ওঠা এক আত্মসমগ্রতা। তিনি কখনও সম্পর্কের ভাঙনকে চিৎকারে প্রকাশ করেন না; বরং একটি নিঃশব্দ ক্ষতের মধ্যেই তার অস্তিত্বের গভীরতা অনুভব করান। কখনোবা প্রেম তাঁর কাছে বিস্ময়ের মতো আসে, কখনো বা বিদ্রোহ তাঁর কাব্যে নেমে আসে অঘোষিত ঝড়ের মতো।
রফিক আজাদের স্ত্রী হওয়ার পরিচয়ের বাইরে নিজের কাব্যিক পরিচয় নির্মাণ- এই যাত্রা তাই সহজ ছিল না। তিনি কাব্যরচনার মানসে সম্পূর্ণ নিজের; ভাষা, স্বর, ছন্দ, ছবি- সবকিছু ছিল তাঁর স্বতন্ত্র। তিনি কারও ছায়া হয়ে ওঠেননি; বরং নিজস্ব অস্তিত্বের আলোকে গড়েছেন নিজের নদী, নিজের দিগন্ত। এই জন্যই সমালোচকেরা তাঁর কবিতাকে বলেন- “নীরবতার ভেতর উচ্চারণের নির্মাণ”; আবার কেউ কেউ বলেন- “নারীর অভ্যন্তরীণ প্রকৃতির ¯্রােত”।
মুক্তিযুদ্ধোত্তর বাংলা কবিতার পরিবর্তনধারায় তাঁর কবিতা একটি বিশেষ বাঁক- যেখানে একইসঙ্গে আছে প্রকৃতি, নারীত্ব, ভাষার অভ্যন্তরীণ মাধুর্য, আধুনিক মনস্তত্ত্ব, এবং উত্তরাধুনিক বিক্ষিপ্ততার সংগীতে গড়ে ওঠা নতুন নির্মাণ। তিনি প্রমাণ করেছেন- একজন কবি কেবল শব্দের কারিগর নন; বরং তিনি সমাজ, ইতিহাস, প্রকৃতি ও সময়ের দৃশ্যপটে নিজস্ব আলো দিয়ে দাঁড়িয়ে থাকা এক সৃষ্টিশীল অভিকর্ষ। কবির অনুচ্চস্বরের স্পষ্টোচ্চারণে উঠে আসে- সমাজ, সংসার ও শাস্ত্রের অনুদার অস্বীকৃতি ও প্রতিবন্ধকতা সত্ত্বেও নারীর জ্ঞানতাত্ত্বিক চর্চার নান্দনিক পরিভ্রমণ সভ্যতার আদিপর্ব থেকে শুরু করে অদ্যাবধি অগ্রসরমান:
“শেষবার আমি সত্য উচ্চারণ করেছি/ খনার কর্তিত জিহ্বায়/ তোমরা কি আমাকে এখন চেনো আর,/ অনেক আগেই আমি ছেড়ে গেছি তোমাদের বিস্ময় ভার... না বিংশ শতাব্দী না একুশ শতক/ উত্তর-আধুনিক সময়ের সাম্পান যখন/ ঐতিহ্যেই ভাসমান/ তখনও আত্মপীড়নের ক্রান্তিকুলায়/ ভিক্ষাপাত্র হাতে কেবলই আমি/ খুঁজে ফিরি ভিক্ষালব্ধ জ্ঞান;/ ভিক্ষালব্ধ জ্ঞান,/ ভিক্ষালব্ধ জ্ঞান...” (খুঁজে ফিরি ভিক্ষালব্ধ জ্ঞান)
দিলারা হাফিজের কাব্যভাষায় রয়েছে ট্যাবু ভাঙার দুরন্ত সাহস। কবি নারীদেহ, যৌনতা, স্পর্শ, আকাক্সক্ষা, প্রতিরোধ- এই সব জটিল অনুভূতিকে কেবল রূপক বা আড়ালে-আবডালে নয়; বরং সত্যের খোলা জানালায় অনায়াসে স্থাপন করেছেন। তিনি নিঃসঙ্কোচে কবিতায় তুলে? এনেছেন- মানবজাতি স্তন্যদাত্রী নারীর কাছে কতোটা ঋণী। সেক্ষেত্রে নারীবাদকে তিনি মানববাদে উন্নীত করেছেন অনন্য শৈল্পিকতায়।
এটি বললে অত্যুক্তি হবে না যে, স্বভাষায় ও সমকালীন প্রেক্ষাপটে মানবতাবাদী কবি দিলারা হাফিজ আমাদের কবিতায় ক্রমশ অপরিহার্য ও প্রাসঙ্গিক হয়ে উঠেছেন তাঁর নিরন্তর সাধনা ও আকাশস্পর্শী সৃষ্টিশীলতা দিয়ে অনন্য কাব্যিক শক্তিমত্তা অর্জনের জন্য, নিজের সত্তার স্বীকৃতি অর্জনের সাহসের জন্য; আর সবচেয়ে বড় কথা- নারীবাদী কবিতা কীভাবে একইসঙ্গে কোমল, দগ্ধ, পরিশীলিত অথচ প্রতিবাদী হয়ে উঠতে পারে- অনুগামীদের জন্য সেটির এক অত্যুজ্জ্বল উদাহরণ হয়ে থাকবার জন্য।
কবি দিলারা হাফিজ ১৯৫৫ সালের ২০ নভেম্বর মানিকগঞ্জের কালিগঙ্গা নদীবিধৌত গড়পাড়া গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। পিতা-বখশী হাফিজ উদ্দিন আহমেদ এবং মাতা রহিমা হাফিজ। তিনি একজন প্রথিতযশা শিক্ষাবিদ। ৩৭ বছরের শিক্ষকতা জীবনে দেশের বেশ কয়েকটি ঐতিহ্যবাহী ও বৃহৎ কলেজের অধ্যক্ষের দায়িত্ব অত্যন্ত দক্ষতার ও সফলতার সাথে পালন করছেন। সর্বশেষ মাধ্যমিক ও উচ্চমাধ্যমিক শিক্ষাবোর্ড ঢাকা-এর চেয়ারম্যান হিসেবে কর্মজীবন থেকে অবসর নিয়েছেন। তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বাংলা ভাষা ও সাহিত্যে বিএ (অনার্স) ও এম এ করেছেন। তিনি ১৯৯৮ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীনে ইউজিসির স্কলারশীপে পিএইচ.ডি ডিগ্রি লাভ করেন। অধ্যাপনার পাশাপাশি টেলিভিশনে গণশিক্ষা ও শিক্ষা গবেষণামূলক প্রোগ্রামে ২২ বছর যাবত গবেষণা, গ্রন্থনা ও উপস্থাপনার কাজে দায়িত্ব পালন করেছেন। নিজ অঞ্চলের পশ্চাৎপদ শিশুদের প্রতিভা বিকাশ? ও সার্বিক উন্নয়নে কাজ করে গেছেন। তাঁর প্রকাশিত কাব্যগ্রন্থ : ভালোবাসার কবিতা (১৯৮২), পিতা কিংবা পুত্র অথবা প্রেমিক(১৯৮৩), প্রেমের কবিতা (১৯৯৮), কে নেবে দায় (২০০১), খুঁজে ফিরি ভিক্ষালব্ধ জ্ঞান (২০১২), নির্বাচিত কবিতা ( ২০০৫), অবিনশ্বর আয়না (২০১৮), নারী সংহিতা (২০১৯), কবিতা সমগ্র (২০২১), স্তনের অহংকার (২০২২), একগুচ্ছ দিলারা হাফিজ (২০২৫) , গবেষয়ণা গ্রন্থ : বাংলাদেশের কবিতায় ব্যক্তি ও সমাজ (১৯৪৭-৭১) এবং এ ছাড়াও রয়েছে স্মৃতি গদ্য : আনন্দ বেদনা যজ্ঞে রফিক আজাদ ( ২০১৮), স্মৃতি উপন্যাস: কে প্রথম কাছে এসেছি (২০২০)সহ শিশুতোষ ও সম্পাদিত বেশ কিছু গ্রন্থ। মার্কিন কবি ক্যারোলিন রাইট ও ভারতীয় বহু ভাষাবিদ প-িত শ্যাম সিং শশী নারী অধিকার সম্পর্কিত তাঁর অনেক কবিতার অনুবাদ করেছেন। ১৯৮৩ সালে কবি কবিতার জন্য পেয়েছেন লা ফর্তিনা সম্মাননা ও ২০১২ সালে নোবেলজয়ী অর্থনীতিবিদ অমর্ত্য সেন-এর হাত থেকে গ্রহণ করেন মানিকগঞ্জ সাহিত্য ও সাংস্কৃতিক পরিষদ সম্মাননা এবং অন্যান্য সম্মাননা। তবে তাঁর জীবনের সবচেয়ে বড় সম্মাননা ও পুরস্কার হলো দেশে ও প্রবাসে অসংখ্য কবি, লেখক, পাঠক ও গুণগ্রাহীর ভালবাসা, সর্বোপরি কর্ম ও মর্মসহচরী হিসেবে বাংলা কবিতার অন্যতম প্রধান কবি রফিক আজাদ (প্রয়াত)-এর সাথে প্রেমময় জীবন ও কবিতাযাপন এবং সেসবের অক্ষয় অমূল্য স্মৃতিসত্তা। দুই পুত্র অভিন্ন আজাদ? ও অব্যয় আজাদ-এর? মমতাময়ী মা তিনি।
সমসাময়িক বাংলা আধুনিক কবিতার অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ ও প্রতিভাদীপ্ত কবি দিলারা হাফিজের কাব্যভাষার বহুকৌণিক আলো প্রতিনিয়ত ছড়িয়ে পড়েছে স্বদেশ ও কবিতাবিশ্বে। সময় গড়ায়, প্রজন্ম এগিয়ে যায়- তবু তাঁর প্রসাধিত শব্দের সৌগন্ধ ও সৌন্দর্য, তার অন্তরঙ্গ স্পর্শ, নারীসত্তার স্বতন্ত্র দিগন্ত সর্বোপরি ভাষার মায়াবিস্তারী গভীর সুর- সবকিছু মিলেই স্থায়ী আবেদন তৈরি করে চলেছে আমাদের সাহিত্যমানসে, প্রজন্ম থেকে প্রজন্মান্তরে। চলচ্চিত্রের মতো ফ্ল্যাশব্যাকে একের পর এক ভেসে নয়ানাভিরামপ্রাকৃতিক দৃশ্য- শান্ত নদী, বাতাস বয়ে যায়, আলো খেলা করে- কিন্তু তার ভেতর লুকিয়ে থাকা রুদ্ররূপটিও যেন অনুভব করি মানবীয় সত্তায়, আমাদের অন্তরাত্মায়। তাঁর কবিতা তাই রূপকল্পের অরণ্য, শব্দের মৃদু নদী এবং মাটির সঙ্গে দেহের স্পর্শে জন্ম নেওয়া এক দীর্ঘ, নীরব, অথচ প্রবল উচ্চারণ। আজ ২০ নভেম্বর ২০২৫- কবির ৭১তম শুভ জন্মদিন। সুস্বাস্থ্য নিয়ে শতায়ু হোন প্রিয় কবি। আমাদের সমুগ্ধ শ্রদ্ধা, ভালবাসা ও অভিবাদন গ্রহণ করুন।