নোবেল বিজয়ী লাসলো ক্রাসনাহোরকাইেয়র গল্প
বাংলায় অনুবাদ : অশোক কর
শিল্পী : সঞ্জয় দে রিপন
গাড়ির চাবিটা কোনোভাবেই ইগনিশনে ঢুকছিলো না, এই প্রথমবারের মতো অমন তিক্ত অভিজ্ঞতার মুখোমুখি হতে হলো, অবশেষে জোর খাটিয়েই চাবিটা ইগনিশনে ঢোকাতে হলো, জবরদস্তি করা ছাড়া আর কোনো বিকল্প সমাধান তার সামনে ছিলো না, এরপর যখন ইগনিশনে চাবি ঘোরানো হলো- ইঞ্জিনটি কয়েকবার ঝাঁকি দিয়ে জীবন্ত হয়ে উঠে তৎক্ষণাৎ ব্যাকগিয়ারে পাহাড়ের ঢাল বেয়ে নিচে নামতে শুরু করলো গাড়িটা, সুতরাং মুহূর্তের মধ্যেই গাড়ির সাম্প্রতিক সমস্যার তিক্ততা মন থেকে ঝেড়ে ফেলে, পর্যায়ক্রমে সঠিকভাবে গাড়ির গিয়ার বদলানোই মুখ্য হয়ে উঠলো, এর মাঝেই এক বিস্ময়বোধ কাজ করছিলো তার মনে, প্রায়-নতুন গাড়ির ক্ষেত্রে ইগনিশনে চাবি ঢোকানোর তো সমস্যা হবার কথা নয়- কিন্তু গাড়িটা নিজেই যখন পাহাড়ের ঢাল বেয়ে নামাতে শুরু করেছে, বিস্ময়বোধও সহসাই মন থেকে উধাও হয়ে গেছে কণামাত্র অবশেষ না রেখে, এমুহূর্তে ঢাল বেয়ে নিচে নামা গাড়ির গিয়ার দ্বিতীয় থেকে তৃতীয় গিয়ারে পরিবর্তনে মনেপ্রাণে মনোযোগী হলো সে, অতঃপর দ্বিতীয় গিয়ার থেকে তৃতীয় গিয়ারে বদলে গাড়ির নিয়ন্ত্রণ যখন হাতে এলো- তখন বনের রাস্তার চড়াই পথ ধরে উপরে উঠে গ্রামের ওপর দিয়ে ছুটে যাওয়া হাইওয়েতে পৌঁছানোর জন্য গাড়ি ছোটালো, ভাবলো, এসময়ে হাইওয়ে সম্ভবত ফাঁকাই থাকবে, কারণ তখন ঘড়ির কাঁটা সবে সাড়ে-আটটা পেরিয়েছে, পর্যটকদের জন্য সাড়ে-আটটায় হাইওয়েতে ভিড় করা বোধকরি একটু তাড়াতাড়িই মনে হতে পারে, কিন্তু স্থানীয় ড্রাইভারদের ক্ষেত্রে সেটাকে দেরি হয়ে গেছে বলা যায়, কিছুক্ষণ আগ পর্যন্ত কেনো ধারণা ছিল না ঠিক ক’টা বাজে, গাড়ির ঘড়িতে যখন দেখলো আটটা সাতান্ন মিনিট, সে মনে মনে ভাবল, ‘বেশ, গাড়িটা এবার একটু জোরে চালিয়েই যাওয়া যাক!’- এমন ভেবেই অ্যাক্সিলারেটরে হালকা করে চাপ বাড়িয়ে দিলো ও, দুপাশের গাছের ডালপালাগুলো আঁকাবাঁকা পথটির ওপর নুয়ে পড়ে সবুজের সামিয়ানা টানিয়ে দিয়েছে, সেই প্রাকৃতিক দৃশ্যের সৌন্দর্য আরো উদ্ভাসিত হয়ে উঠেলো তখন- নুয়ে পড়া ডালপাতা গলে সূর্যরশ্মি আলোকিত করে রেখেছে সিমেন্টে বাঁধানো পাকা রাস্তা, আলোছায়ার অদ্ভুত কাঁপন-মাতন দূরে ছুটে যাওয়া রাস্তার সবখানে, একটু অনুভূতিপ্রবণ বোধহয় হয়ে উঠেছিল মনটা, হাইওয়ে আর সবুজ পরিপাশর্^ অদ্ভুত মাধূর্যম-িত মায়াবী মনে হলো ওর- তখনো ভোরের শিশিরে ভেজা সবুজ পাতাগুলো চুয়ে ঝরে পড়া অদ্ভুত গন্ধ অনুভব করতে পারছিলো সে! তার গাড়ি ছুটে চলেছে চওড়া দীর্ঘ টানা রাস্তা ধরে, প্রায় তিনশো মিটার একটানা সোজা রাস্তা ধরে এগিয়ে যেতে হবে, এরকম রাস্তা ধরে গাড়ি চালিয়ে যাবার প্রাক্কালে সবাই সাধারণত গাড়ির গতি বাড়িয়ে দেয়, “এখন একটু গান-বাজনা শুনলে মন্দ হয় না”, এমনটি মনে হতেই যেই মাত্র গাড়ির রেডিও চালু করার জন্য হাত বাড়িয়েছে, তখনি হঠাৎ ওর চোখ পড়লো- ওর গাড়ি থেকে প্রায় একশো থেকে দেড়শো মিটার দূরে, অনুমানে ধরে নেয়া যেতে পারে টানা হাইওয়ের অর্ধেক অথবা দুই-তৃতীয়াংশ দূরে- রাস্তার মাঝখানে কী একটা জিনিস পড়ে আছে, অজান্তেই ওর ভ্রু কুঁচকে গেল, ভাল করে উঁকি দিয়ে দেখে অনুমান করার চেষ্টা করলো- “কী হতে পারে জিনিসটা? এটা কি কারো অসাবধানতাবশত ফেলে যাওয়া কাপড়ের পুঁটলি, নাকি গাড়ির ভাঙা কোনো যন্ত্রাংশ, অথবা অন?্য কোনো কিছু?”- কিন্তু প্রায় নিশ্চিত এক সম্ভাবনা ওর মনে এলো- “এটাকে দেখে তো কোনো জন্তু বলেই মনে হচ্ছে, তবে হতে পারে ওটা কারো লোটাকম্বলের টুকরো অংশ, ট্রাক থেকে ছিটকে পড়েছে অথবা কারো ফেলে দেয়া ছেঁড়া ন্যাকড়া, জড়িয়ে পেঁচিয়ে জবরজং হয়ে রাস্তায় পড়ে আছে!” কিন্তু যখন ওর চোখে পড়লো- রাস্তায় মাঝখানে থাকা বস্তুটির সদৃশ আরো একটি বস্তু রাস্তার ডানপাশে পড়ে রয়েছে, তখন গাড়ির স্টিয়ারিং হুইলের ওপর ভর দিয়ে সে ঝুঁকে পড়ে আরো ভালোভাবে পরখ করার চেষ্টা করলো, কিন্তু ঐ দুটো বস্তুর মধ্যকার পার্থক্য অনুমান করা দুরূহ মনে হলো ওর, তাই সতর্কতাবশত গাড়ির গতি কমিয়ে দিয়ে নিশ্চিত হতে চাইলো যে দুটো বস্তু ওখানে রাস্তার উপরে পড়ে আছে- তার কোনোটাকেই ভুলক্রমে গাড়িচাপা দিতে চায় না সে, এবার তাই প্রথমবারের মতো কাছে পড়ে থাকা জিনিসটার কাছে যেয়ে চিনতে পারলো ওটাকে- নিজের চোখকেও সে বিশ্বাস করতে পারছিলো না, অবাক বিস্ময়ে নিজের অজান্তেই গাড়ির ব্রেক প্যাডেলে জোড়ে চাপ দিয়ে ধরে রইলো, এই বস্তুটি ওর কাছে শুধুমাত্র একটি জন্তুই নয়, অবিশ্বাস্য মনে হলেও- ওটা একটা জীবন্ত কুকুরছানা- রাস্তার মাঝের সাদা দাগের উপর স্থির বসে রয়েছে, কালো ছোপ ছোপ লোমওলা নিতান্ত সরল কৃশকায় জন্তুটি, হাইওয়ের মাঝের সাদা দাগের উপর নিশ্চিন্তে শরীরের পিছনের নিতম্বে ভর করে বসে থাকা অবস্থায়, ভিতরে বসা গাড়ির চালককে দেখবার চেষ্টা করছিলো নিষ্পাপ দৃষ্টিতে, বাস্তব প্রেক্ষিতের বিবেচনায় যানবাহন চলমান ব্যস্ত রাস্তার উল্টো দিক মুখ করে বসা কুকুরছানাটির বিপজ্জনক অবস্থানের কারণে ভয়ানক আশঙ্কার মধ্যেও- সবিশেষ লক্ষ?্যণীয় মনে ছিলো ওর কুকুর ছানাটির চোখের করুণ চাহনি- রাস্তার মাঝখানে আশঙ্কাজনক অনড় অবস্থান, অনধিগম্য অজ্ঞেয় কারণে ছুটন্ত যন্ত্রযানগুলোকে উপেক্ষা করে, ওইভাবে বিপজ্জনক অবস্থানে বসে থাকার কারণ মোটেই বোধগম্য হয়নি তার, কী করে গাড়ি যাচ্ছে- এটা দেখতে, মূর্খতাবশত কুকুরছানাটি ওখানে বসেছিলো, বাস্তবিক অর্থেই- ও নিজে, কিম্বা রাস্তায় ছুটন্ত গাড়িগুলোর কোনো একটি প্রায় চাপা দিতে যাচ্ছিল কুকুরটিকে, বেশ বোঝা যাচ্ছিলো নির্বোধ কুকুরটি ওর অবস্থান থেকে একচুলও নড়বে না, গাড়িচাপা পড়ার মতো বিপজ্জনক দূরত্ব বিষয়ে কুকুরটির কোনো আগ্রহ আছে বলে হয় না, আর ঠিক তখনই ওর চোখে পড়লো- রাস্তার মাঝখানের ছোট্ট কুকুর ছানাটির বাম দিকের রাস্তার পাশে, আরেকটি কুকুরের লাশ পড়ে আছে, দৃশ্যত কোনো একটি গাড়ির নিচে চাপা পড়ে কুকুরটির শরীর চিড়েচ্যাপ্টা হয়ে গেছে, পেট চিরে ভেতরের অঙ্গপ্রত্যঙ্গ রাস্তায় ছড়িয়ে পড়েছে, মৃত কুকুরটির সাথে জীবন্ত কুকুরছানাটির সম্পর্কটা কী? তারা কি সঙ্গী ছিল? গাড়ি ঘুরিয়ে কুকুরছানাটির কাছাকাছি পৌঁছালেও কুকুরটি কিন্তু এক ইঞ্চিও নড়লো না, তাই বাধ্য হয়েই সে গাড়ি আস্তে আস্তে ডানদিকে ঘুরিয়ে নিয়ে এলো, তার ডান পাশের চাকা রাস্তা থেকে সামান্য সরিয়ে মাটিতে নামালো, যাতে কয়েক সেন্টিমিটার মতো জায়গা করে নিয়ে দুর্ঘটনা এড়িয়ে জায়গা মতো পার্ক করতে পারে- কুকুরটি তখনও পিছন দিক করে সোজা হয়ে বসেছিলো, তাই এবার সে সরাসরি কুকুরটির মুখ দেখতে পারলো, যদিও কুকুরছানাটির দিকে না তাকানোই বোধকরি ভালো হতো, কারণ বেশ সাবধানে সেটিকে পাশ কাটিয়ে যাবার প্রক্কালে কুকুরটির চোখ ওকে অনুসরণ করছিলো- সেই বিষণ্ন দৃষ্টিতে কোনো রকম আতঙ্ক, বন্য রাগ, বা শোকার্ত বিপর্যয়ের চিহ্ন ছিল না, সেই শূন্যদৃষ্টি বোধের অগম্য, কেবলই বিষণ্নতামুখর- বনের রাস্তার মাঝের সেই সাদা দাগের ওপর এখনো স্থির বসে, ছুটে যাওয়া গাড়ির চালকদের করুণ দৃষ্টিতে তাকিয়ে দেখছিলো শুধু,
এমুহূর্তে এটা কোনোভাবেই বিবেচনার বিষয় নয়, এই জায়গাটা লস-অ্যাঞ্জেলেস থেকে পনেরো মাইল দূরে, নাকি কিয়োটো থেকে আঠারো মাইল দূরে, অথবা বুদাপেস্টের উত্তরে বিশ মাইল দূরে- এই কুকুরছানাটি সারাক্ষণ ওখানেই বসে থেকে, বিষণ্ন দৃষ্টিতে সঙ্গীর দেহটি দেখছিলো, হতে পারে মনে মনে ও অপেক্ষা করছিলো- হয়তো সহানুভূতিশীল কেউ একজন এসে ওকে বোঝাতে পারতো- তাঁর সঙ্গীর কী পরিণতি ঘটেছে, অথবা শুধুই এক দুরাশা নিয়ে রাস্তার মাঝখানে অপেক্ষা করছিলো- হয়তো তার সঙ্গীটি অবশেষে উঠে দাঁড়াবে, নড়েচড়ে এসে ওকে সাথে নিয়ে এই অবোধগম্য স্থান ছেড়ে দু’জনে মিলে দূরে কোথাও চলে যেতে পারবে,- কুকুরদের পিছনে ফেলে মাত্র কয়েক মিটার এগিয়ে গিয়ে সাথে সাথেই আবার গাড়ি থামালো সে, ভাবলো- “আমি কুকুর দু’টাকে এভাবে রাস্তায় ফেলে রেখে চলে যেতে পারি না”- ও মনে মনে যা করতে চাইছিলো কিন্তু কোনো অজানা কারণে তার পা দুটো সেটা করতে সায় দিচ্ছিলো না, তাই ওর গাড়ি না থেমে, ফের চলতে শুরু করলো, আর সে গাড়ির পেছনে দেখায় আয়নাতে কুকুর দু’টোকে দেখতে থাকলো- মৃত কুকুরটি আধা-কাত হয়ে পড়ে ছিলো রাস্তায়, তার চারটি পা সমান্তরালভাবে শূন্যে প্রসারিত আর পেটের ভেতরের অঙ্গপ্রতঙ্গগুলো ছড়িয়ে ছিটিয়ে পড়েছে রাস্তায়, কিন্তু কুকুর ছানাটির পিঠটাই শুধুমাত্র দেখা যাচ্ছিলো আয়নায়, কুকুর ছানাটির পিঠটা ভঙ্গুর- কিন্তু লাঠির মতো সোজা, এখনও রাস্তার মাঝখানে বসে আছে, ঘণ্টার পর ঘণ্টা যেন ওখানে বসে অপেক্ষা করতে পারবে, তার মনে ভয় দানা বাঁধতে শুরু করলো, চিন্তার ছাপ পড়লো মনে, হয়তো এই কুকুর ছানাটিও গাড়ির ধাক্কা খেয়ে অন্য কুকুরটির মতো একই করুণ পরিণতি বরণ করবে! ‘আমার থামা উচিত’, নিজেকে সে বোঝাতে চাইলো, কিন্তু কেন জানি উদ্দেশ্যহীনভাবেই গাড়ি চালিয়ে যেতে থাকলো, ঘড়ি দেখলো, এখন ন’টা বেজে দু’মিনিট,- ‘কী করবো আমি? আমার তো দেরি হয়ে যাচ্ছে,’- উদ্বিগ্ন মনে, নিজের অজান্তেই তার পা গ্যাস প্যাডেল চাপ দিয়ে ধরে থাকলো- ‘আর দু’মিনিটের মধ্যে আমি শহরে পৌঁছাতে পারবো!’ তার যাত্রাপথে একটার পর একটা বাঁক আসতে থাকলো, অভিজ্ঞতাবশত আঁকাবাঁকা রাস্তা কোনো সমস্যা ব্যাতিরেকেই পার হয়ে এলো সে, মনে আছে ঘড়িতে সময় ন’টা বেজে দু’মিনিট হতে দেখেছিলো কয়েক মুহূর্ত আগে, তাই সে অ্যাক্সিলারেটরে আরও জোরে চাপ দিয়ে গাড়ির গতি বাড়িয়ে নিলো, এক মুহূর্তের জন্য আবার সেই কুকুরছানাটিকে মনে পড়ল তার, কল্পনায় দেখতে পেলো কী অসহায়ভাবে কুকুরছানাটি তার সঙ্গীর দিকে তাকিয়ে ছিলো, কিন্তু সেই ছবি আবার দ্রুতই হারিয়ে গেলো, আর পরের এক মিনিটে গাড়ির গতি প্রায় ষাট কিলোমিটারে তুলে গাড়ি চালানোয় মনোযোগ দিলো, তার সামনে একটি ধীর গতির গাড়ি ছাড়া রাস্তায় আর কেউ ছিল না, গাড়িটির কাছাকাছি গিয়ে চিনতে পারলো, ওটা একটা পুরাতন ধক্কর মার্কা ‘স্কোডা’ গাড়ি, বেশ বিরক্ত বোধ করলো সে, কারণ যেভাবে স্কোডাটি চালাচ্ছিলো সেটার চালক, তাতে ওভারটেক করার বদলে ও’কে তার নিজের গাড়ির গতিই কমাতে হচ্ছিলো, যতই সে স্কোডার কাছাকাছি হচ্ছিল, ওভারটেক করার সম্ভাবনা ততই কমছিলো- ‘আমি আর অপেক্ষা করব না,’ সে রাগান্বিতভাবে ভাবল, ‘এই পুরোনো স্কোডার পেছনে আর নয়, সামনের বাঁকে পৌঁছানোর আগেই ওটাকে ওভারটেক করতে হবে,’ রাস্তাটি ওর খুবই পরিচিত, হাজারবার এ রাস্তায় গাড়ি চালিয়েছে সে, সে জানে শহরের সীমানা নির্দেশক সাইনবোর্ডে পৌঁছানোর আগপর্যন্ত পর্যন্ত স্কোডাটিকে টপকে যাওয়ার কোনো সুযোগ ওর থাকবে না, তাই বাঁক আসার আগেই স্কোডাটিকে ওভারটেক করার জন্য অ্যাক্সিলারেটরে জোরে পা দাবিয়ে দিলো, আর ঠিক তখনই- স্কোডাটি ওর ঠিক সামনে ধীরে ধীরে বাঁক নিতে শুরু করলো, ঘটনা দু’টি যুগপৎ ঘটলো প্রায় একই মুহূর্তের মধ্যে, বিষয়টি রেয়ার ভিউ মিররে দেখামাত্র সে স্কোডাটিকে ওভারটেক করার সংকেত দিলো, সেই সাথে ওভারটেক স্টিয়ারিং হুইল বাম দিকে টেনে পাশের লেন দিয়ে ওভারটেক করার চেষ্টা নিলো, কিন্তু স্কোডার চালক সম্ভবত তার গাড়ির গতিপথ পরিবর্তন লক্ষ্য করতে পারেনি এবং কোনো সংকেত ছাড়াই, কে জানে কেন, স্কোডাটিকে বাম দিকের মোড়ে ঘুরিয়ে দিলো- সম্ভবত কারণ সে হয়তো স্কোডাকে যেকোনো দিকে ঘোরাতে অথবা পুরোপুরি ঘুরিয়ে নিতে চাইছিলো, হয়তো স্কোডার বাম ইন্ডিকেটর সেই মুহূর্তে জ্বলা শুরু করেছিলো- কিন্তু ততক্ষণে অনেক দেরি হয়ে গেছে- সজোরে ব্রেক কষেও গাড়ি থামাবার অবকাশ আর অবশিষ্ট ছিলো না, কারণ স্কোডাটি খুব ধীর গতিতে রাস্তার বাঁয়ে মোড় নিচ্ছিলো বিধায়- গাড়িটি বাস্তবিক অর্থেই আড়াআড়িভাবে পুরো রাস্তা দখল করে নিয়েছিলো- মুহূর্তেই দৃশ্যটি যেন চলচ্চিত্রের বিলম্বিত-দৃশে?্যর মতো হিমায়িত হয়ে গেলো, ব্রেক করে গাড়ি থামাবার পরিস্থিতি তখন ওদের নিয়ন্ত্রণের বাইরে- এক কথায় মারাত্মক দুর্ঘটনা এড়ানো একেবারেই অসম্ভব, অন্যভাবে বলতে গেলে- গাড়ি থামাবার সম্ভাব?্য কোনো উপান্তর না থাকার পরিণতিতে- ওর গাড়ি বিপজ্জনক গতিতে স্কোডা’কে আঘাত করলো... বিপর্যয় সূচনার ইঙ্গিত- অন্ধকারে ডুবে যাবার অনুভূতি থেকে শুরু হয়ে আকস্মিক মৃত্যুর পরিশেষের ধারাবাহিকতা থেকে সৃষ্টি হয় না: বাস্তবজীবনের সমস্ত কিছু, এমনকি কোনো বিপর্যয়- তারও থাকে মুহূর্ত থেকে মুহূর্ত পর্যায়ক্রমের ধারাবাহিক পরম্পরা- থাকে ধারাবাহিক কাঠামো, যা অপরিমেয়, বোধের অতীত, মারাত্মক জটিল, যা ভিন্নতর পরিপ্রেক্ষিতে অনুধাবন করতে হয়, সেই জটিলতার মাত্রাকে রূপক চিত্রকল্পের মাধ্যমে প্রকাশ করা সম্ভব, যদিও সম্ভাবনা খুবই দুরূহ- কারণ চিত্রকল্পের প্রবাহ তখনই দৃশ?্যমান হয়ে ওঠে- যখন সময়ের বিলম্বিত গতি এক সুনির্দিষ্ট পর্যায়ে পৌঁছায়, তখন নির্বিকার উদাসীন দৃষ্টিতে আমরা বুঝতে চেষ্টা করি- আমাদের পরিপাশির্^ক পরিস্থিতি এবং এর নিয়তি-নির্ধারিত পূর্বশর্তগুলোকে, আমরা খুঁজে পাই একান্ত সর্বজনীন সিদ্ধান্ত, যেগুলো নির্ধারিত হয়েছে ব্যক্তিগত অভিপ্রায় থেকে- কেন না এ সব অতিপ্রাকৃত বিলম্বিত মুহূর্তগুলো অপরিকল্পিত, অসচেতন সিদ্ধান্তের ফল, গাড়ির চাবি ঠিক মতো ইগনিশনে না ঢোকাতে পারার কারণে, গাড়ি তৃতীয় গিয়ারে চালু না হয়ে দ্বিতীয় গিয়ারে নেমে যায়, সেক্ষেত্রে ওর মতো আমরাও দ্বিতীয় গিয়ারে চালু হওয়া গাড়ি- তৃতীয় গিয়ারে বদলে নিই- ইতিমধ্যেই পাহাড়ী ঢাল বেয়ে দ্রুত নিচে নামতে শুরু করে গাড়ি, তারপর গ্রামের রাস্তার উপরের হাইওয়েতে পৌঁছায়- হাইওয়ের কিছুটা দূরত্ব পর্যন্ত আমাদের সামনের দৃষ্টিপথ ছিলো একটি টানেলের ভেতর দিয়ে দেখার মতো, কারণ রাস্তার উপরে ঢলে পড়া বনানীর সবুজ ডালপালাগুলো থেকে তখনও সকালের শিশিরের গন্ধ ছড়িয়ে পড়ছিলো, একটি কুকুরের মৃত্যু এবং একজন গাড়ি চালকের অবিবেচক সিদ্ধান্তে বাম দিকে মোড় নেওয়ার ভুল- অর্থাৎ, এক বা অন্য কোনো ভুল সিদ্ধান্তের বিপরীতে আরও বিবিধ সিদ্ধান্তের সৃষ্টি এবং সংক্ষিপ্ত সময়ে নেয়া ভুল সিদ্ধান্তের অবিরাম চলমান বিশৃঙ্খলা, আর মস্তিষ্ককে পাগল করে তোলা ‘যদি-কিন্তু’ ধরনের সম্ভাবনা বা সিদ্ধান্তগুলো অনুধাবন করা সেক্ষেত্রে যখন একেবারেই অসম্ভব- কারণ যে অরাজক পরিস্থিতিতে আমরা নিজেদেরকে নিরন্ত্রকের ভূমিকায় আবিষ্কার করি, তা ভয়ংকর জটিল, যা ঈশ্বর বা শয়তান কর্তৃক নির্ধারিত নয়, এগুলো এমন কিছু- যা নিয়ন্ত্রণ আমাদের অগম?্য এবং বিপর্যয়ের মধ্যে দিয়ে আমরা যেতে বাধ্য, কারণ “সম্ভাব?্যতা” কেবল মাত্র নির্বাচনের বিষয় নয়, কিন্তু সম্ভবনার ফল হিসাবে নির্ধারিত পরিণতিই নিয়তির মতো আমাদের মধ্যে নেমে আসতে বাধ্য।
ইপেপার
জাতীয়
সারাদেশ
আন্তর্জাতিক
নগর-মহানগর
খেলা
বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি
শিক্ষা
অর্থ-বাণিজ্য
সংস্কৃতি
ক্যাম্পাস
মিডিয়া
অপরাধ ও দুর্নীতি
রাজনীতি
শোক ও স্মরন
প্রবাস
নারীর প্রতি সহিংসতা
বিনোদন
সম্পাদকীয়
উপ-সম্পাদকীয়
মুক্ত আলোচনা
চিঠিপত্র
পাঠকের চিঠি
নোবেল বিজয়ী লাসলো ক্রাসনাহোরকাইেয়র গল্প
বাংলায় অনুবাদ : অশোক কর
শিল্পী : সঞ্জয় দে রিপন
বৃহস্পতিবার, ২০ নভেম্বর ২০২৫
গাড়ির চাবিটা কোনোভাবেই ইগনিশনে ঢুকছিলো না, এই প্রথমবারের মতো অমন তিক্ত অভিজ্ঞতার মুখোমুখি হতে হলো, অবশেষে জোর খাটিয়েই চাবিটা ইগনিশনে ঢোকাতে হলো, জবরদস্তি করা ছাড়া আর কোনো বিকল্প সমাধান তার সামনে ছিলো না, এরপর যখন ইগনিশনে চাবি ঘোরানো হলো- ইঞ্জিনটি কয়েকবার ঝাঁকি দিয়ে জীবন্ত হয়ে উঠে তৎক্ষণাৎ ব্যাকগিয়ারে পাহাড়ের ঢাল বেয়ে নিচে নামতে শুরু করলো গাড়িটা, সুতরাং মুহূর্তের মধ্যেই গাড়ির সাম্প্রতিক সমস্যার তিক্ততা মন থেকে ঝেড়ে ফেলে, পর্যায়ক্রমে সঠিকভাবে গাড়ির গিয়ার বদলানোই মুখ্য হয়ে উঠলো, এর মাঝেই এক বিস্ময়বোধ কাজ করছিলো তার মনে, প্রায়-নতুন গাড়ির ক্ষেত্রে ইগনিশনে চাবি ঢোকানোর তো সমস্যা হবার কথা নয়- কিন্তু গাড়িটা নিজেই যখন পাহাড়ের ঢাল বেয়ে নামাতে শুরু করেছে, বিস্ময়বোধও সহসাই মন থেকে উধাও হয়ে গেছে কণামাত্র অবশেষ না রেখে, এমুহূর্তে ঢাল বেয়ে নিচে নামা গাড়ির গিয়ার দ্বিতীয় থেকে তৃতীয় গিয়ারে পরিবর্তনে মনেপ্রাণে মনোযোগী হলো সে, অতঃপর দ্বিতীয় গিয়ার থেকে তৃতীয় গিয়ারে বদলে গাড়ির নিয়ন্ত্রণ যখন হাতে এলো- তখন বনের রাস্তার চড়াই পথ ধরে উপরে উঠে গ্রামের ওপর দিয়ে ছুটে যাওয়া হাইওয়েতে পৌঁছানোর জন্য গাড়ি ছোটালো, ভাবলো, এসময়ে হাইওয়ে সম্ভবত ফাঁকাই থাকবে, কারণ তখন ঘড়ির কাঁটা সবে সাড়ে-আটটা পেরিয়েছে, পর্যটকদের জন্য সাড়ে-আটটায় হাইওয়েতে ভিড় করা বোধকরি একটু তাড়াতাড়িই মনে হতে পারে, কিন্তু স্থানীয় ড্রাইভারদের ক্ষেত্রে সেটাকে দেরি হয়ে গেছে বলা যায়, কিছুক্ষণ আগ পর্যন্ত কেনো ধারণা ছিল না ঠিক ক’টা বাজে, গাড়ির ঘড়িতে যখন দেখলো আটটা সাতান্ন মিনিট, সে মনে মনে ভাবল, ‘বেশ, গাড়িটা এবার একটু জোরে চালিয়েই যাওয়া যাক!’- এমন ভেবেই অ্যাক্সিলারেটরে হালকা করে চাপ বাড়িয়ে দিলো ও, দুপাশের গাছের ডালপালাগুলো আঁকাবাঁকা পথটির ওপর নুয়ে পড়ে সবুজের সামিয়ানা টানিয়ে দিয়েছে, সেই প্রাকৃতিক দৃশ্যের সৌন্দর্য আরো উদ্ভাসিত হয়ে উঠেলো তখন- নুয়ে পড়া ডালপাতা গলে সূর্যরশ্মি আলোকিত করে রেখেছে সিমেন্টে বাঁধানো পাকা রাস্তা, আলোছায়ার অদ্ভুত কাঁপন-মাতন দূরে ছুটে যাওয়া রাস্তার সবখানে, একটু অনুভূতিপ্রবণ বোধহয় হয়ে উঠেছিল মনটা, হাইওয়ে আর সবুজ পরিপাশর্^ অদ্ভুত মাধূর্যম-িত মায়াবী মনে হলো ওর- তখনো ভোরের শিশিরে ভেজা সবুজ পাতাগুলো চুয়ে ঝরে পড়া অদ্ভুত গন্ধ অনুভব করতে পারছিলো সে! তার গাড়ি ছুটে চলেছে চওড়া দীর্ঘ টানা রাস্তা ধরে, প্রায় তিনশো মিটার একটানা সোজা রাস্তা ধরে এগিয়ে যেতে হবে, এরকম রাস্তা ধরে গাড়ি চালিয়ে যাবার প্রাক্কালে সবাই সাধারণত গাড়ির গতি বাড়িয়ে দেয়, “এখন একটু গান-বাজনা শুনলে মন্দ হয় না”, এমনটি মনে হতেই যেই মাত্র গাড়ির রেডিও চালু করার জন্য হাত বাড়িয়েছে, তখনি হঠাৎ ওর চোখ পড়লো- ওর গাড়ি থেকে প্রায় একশো থেকে দেড়শো মিটার দূরে, অনুমানে ধরে নেয়া যেতে পারে টানা হাইওয়ের অর্ধেক অথবা দুই-তৃতীয়াংশ দূরে- রাস্তার মাঝখানে কী একটা জিনিস পড়ে আছে, অজান্তেই ওর ভ্রু কুঁচকে গেল, ভাল করে উঁকি দিয়ে দেখে অনুমান করার চেষ্টা করলো- “কী হতে পারে জিনিসটা? এটা কি কারো অসাবধানতাবশত ফেলে যাওয়া কাপড়ের পুঁটলি, নাকি গাড়ির ভাঙা কোনো যন্ত্রাংশ, অথবা অন?্য কোনো কিছু?”- কিন্তু প্রায় নিশ্চিত এক সম্ভাবনা ওর মনে এলো- “এটাকে দেখে তো কোনো জন্তু বলেই মনে হচ্ছে, তবে হতে পারে ওটা কারো লোটাকম্বলের টুকরো অংশ, ট্রাক থেকে ছিটকে পড়েছে অথবা কারো ফেলে দেয়া ছেঁড়া ন্যাকড়া, জড়িয়ে পেঁচিয়ে জবরজং হয়ে রাস্তায় পড়ে আছে!” কিন্তু যখন ওর চোখে পড়লো- রাস্তায় মাঝখানে থাকা বস্তুটির সদৃশ আরো একটি বস্তু রাস্তার ডানপাশে পড়ে রয়েছে, তখন গাড়ির স্টিয়ারিং হুইলের ওপর ভর দিয়ে সে ঝুঁকে পড়ে আরো ভালোভাবে পরখ করার চেষ্টা করলো, কিন্তু ঐ দুটো বস্তুর মধ্যকার পার্থক্য অনুমান করা দুরূহ মনে হলো ওর, তাই সতর্কতাবশত গাড়ির গতি কমিয়ে দিয়ে নিশ্চিত হতে চাইলো যে দুটো বস্তু ওখানে রাস্তার উপরে পড়ে আছে- তার কোনোটাকেই ভুলক্রমে গাড়িচাপা দিতে চায় না সে, এবার তাই প্রথমবারের মতো কাছে পড়ে থাকা জিনিসটার কাছে যেয়ে চিনতে পারলো ওটাকে- নিজের চোখকেও সে বিশ্বাস করতে পারছিলো না, অবাক বিস্ময়ে নিজের অজান্তেই গাড়ির ব্রেক প্যাডেলে জোড়ে চাপ দিয়ে ধরে রইলো, এই বস্তুটি ওর কাছে শুধুমাত্র একটি জন্তুই নয়, অবিশ্বাস্য মনে হলেও- ওটা একটা জীবন্ত কুকুরছানা- রাস্তার মাঝের সাদা দাগের উপর স্থির বসে রয়েছে, কালো ছোপ ছোপ লোমওলা নিতান্ত সরল কৃশকায় জন্তুটি, হাইওয়ের মাঝের সাদা দাগের উপর নিশ্চিন্তে শরীরের পিছনের নিতম্বে ভর করে বসে থাকা অবস্থায়, ভিতরে বসা গাড়ির চালককে দেখবার চেষ্টা করছিলো নিষ্পাপ দৃষ্টিতে, বাস্তব প্রেক্ষিতের বিবেচনায় যানবাহন চলমান ব্যস্ত রাস্তার উল্টো দিক মুখ করে বসা কুকুরছানাটির বিপজ্জনক অবস্থানের কারণে ভয়ানক আশঙ্কার মধ্যেও- সবিশেষ লক্ষ?্যণীয় মনে ছিলো ওর কুকুর ছানাটির চোখের করুণ চাহনি- রাস্তার মাঝখানে আশঙ্কাজনক অনড় অবস্থান, অনধিগম্য অজ্ঞেয় কারণে ছুটন্ত যন্ত্রযানগুলোকে উপেক্ষা করে, ওইভাবে বিপজ্জনক অবস্থানে বসে থাকার কারণ মোটেই বোধগম্য হয়নি তার, কী করে গাড়ি যাচ্ছে- এটা দেখতে, মূর্খতাবশত কুকুরছানাটি ওখানে বসেছিলো, বাস্তবিক অর্থেই- ও নিজে, কিম্বা রাস্তায় ছুটন্ত গাড়িগুলোর কোনো একটি প্রায় চাপা দিতে যাচ্ছিল কুকুরটিকে, বেশ বোঝা যাচ্ছিলো নির্বোধ কুকুরটি ওর অবস্থান থেকে একচুলও নড়বে না, গাড়িচাপা পড়ার মতো বিপজ্জনক দূরত্ব বিষয়ে কুকুরটির কোনো আগ্রহ আছে বলে হয় না, আর ঠিক তখনই ওর চোখে পড়লো- রাস্তার মাঝখানের ছোট্ট কুকুর ছানাটির বাম দিকের রাস্তার পাশে, আরেকটি কুকুরের লাশ পড়ে আছে, দৃশ্যত কোনো একটি গাড়ির নিচে চাপা পড়ে কুকুরটির শরীর চিড়েচ্যাপ্টা হয়ে গেছে, পেট চিরে ভেতরের অঙ্গপ্রত্যঙ্গ রাস্তায় ছড়িয়ে পড়েছে, মৃত কুকুরটির সাথে জীবন্ত কুকুরছানাটির সম্পর্কটা কী? তারা কি সঙ্গী ছিল? গাড়ি ঘুরিয়ে কুকুরছানাটির কাছাকাছি পৌঁছালেও কুকুরটি কিন্তু এক ইঞ্চিও নড়লো না, তাই বাধ্য হয়েই সে গাড়ি আস্তে আস্তে ডানদিকে ঘুরিয়ে নিয়ে এলো, তার ডান পাশের চাকা রাস্তা থেকে সামান্য সরিয়ে মাটিতে নামালো, যাতে কয়েক সেন্টিমিটার মতো জায়গা করে নিয়ে দুর্ঘটনা এড়িয়ে জায়গা মতো পার্ক করতে পারে- কুকুরটি তখনও পিছন দিক করে সোজা হয়ে বসেছিলো, তাই এবার সে সরাসরি কুকুরটির মুখ দেখতে পারলো, যদিও কুকুরছানাটির দিকে না তাকানোই বোধকরি ভালো হতো, কারণ বেশ সাবধানে সেটিকে পাশ কাটিয়ে যাবার প্রক্কালে কুকুরটির চোখ ওকে অনুসরণ করছিলো- সেই বিষণ্ন দৃষ্টিতে কোনো রকম আতঙ্ক, বন্য রাগ, বা শোকার্ত বিপর্যয়ের চিহ্ন ছিল না, সেই শূন্যদৃষ্টি বোধের অগম্য, কেবলই বিষণ্নতামুখর- বনের রাস্তার মাঝের সেই সাদা দাগের ওপর এখনো স্থির বসে, ছুটে যাওয়া গাড়ির চালকদের করুণ দৃষ্টিতে তাকিয়ে দেখছিলো শুধু,
এমুহূর্তে এটা কোনোভাবেই বিবেচনার বিষয় নয়, এই জায়গাটা লস-অ্যাঞ্জেলেস থেকে পনেরো মাইল দূরে, নাকি কিয়োটো থেকে আঠারো মাইল দূরে, অথবা বুদাপেস্টের উত্তরে বিশ মাইল দূরে- এই কুকুরছানাটি সারাক্ষণ ওখানেই বসে থেকে, বিষণ্ন দৃষ্টিতে সঙ্গীর দেহটি দেখছিলো, হতে পারে মনে মনে ও অপেক্ষা করছিলো- হয়তো সহানুভূতিশীল কেউ একজন এসে ওকে বোঝাতে পারতো- তাঁর সঙ্গীর কী পরিণতি ঘটেছে, অথবা শুধুই এক দুরাশা নিয়ে রাস্তার মাঝখানে অপেক্ষা করছিলো- হয়তো তার সঙ্গীটি অবশেষে উঠে দাঁড়াবে, নড়েচড়ে এসে ওকে সাথে নিয়ে এই অবোধগম্য স্থান ছেড়ে দু’জনে মিলে দূরে কোথাও চলে যেতে পারবে,- কুকুরদের পিছনে ফেলে মাত্র কয়েক মিটার এগিয়ে গিয়ে সাথে সাথেই আবার গাড়ি থামালো সে, ভাবলো- “আমি কুকুর দু’টাকে এভাবে রাস্তায় ফেলে রেখে চলে যেতে পারি না”- ও মনে মনে যা করতে চাইছিলো কিন্তু কোনো অজানা কারণে তার পা দুটো সেটা করতে সায় দিচ্ছিলো না, তাই ওর গাড়ি না থেমে, ফের চলতে শুরু করলো, আর সে গাড়ির পেছনে দেখায় আয়নাতে কুকুর দু’টোকে দেখতে থাকলো- মৃত কুকুরটি আধা-কাত হয়ে পড়ে ছিলো রাস্তায়, তার চারটি পা সমান্তরালভাবে শূন্যে প্রসারিত আর পেটের ভেতরের অঙ্গপ্রতঙ্গগুলো ছড়িয়ে ছিটিয়ে পড়েছে রাস্তায়, কিন্তু কুকুর ছানাটির পিঠটাই শুধুমাত্র দেখা যাচ্ছিলো আয়নায়, কুকুর ছানাটির পিঠটা ভঙ্গুর- কিন্তু লাঠির মতো সোজা, এখনও রাস্তার মাঝখানে বসে আছে, ঘণ্টার পর ঘণ্টা যেন ওখানে বসে অপেক্ষা করতে পারবে, তার মনে ভয় দানা বাঁধতে শুরু করলো, চিন্তার ছাপ পড়লো মনে, হয়তো এই কুকুর ছানাটিও গাড়ির ধাক্কা খেয়ে অন্য কুকুরটির মতো একই করুণ পরিণতি বরণ করবে! ‘আমার থামা উচিত’, নিজেকে সে বোঝাতে চাইলো, কিন্তু কেন জানি উদ্দেশ্যহীনভাবেই গাড়ি চালিয়ে যেতে থাকলো, ঘড়ি দেখলো, এখন ন’টা বেজে দু’মিনিট,- ‘কী করবো আমি? আমার তো দেরি হয়ে যাচ্ছে,’- উদ্বিগ্ন মনে, নিজের অজান্তেই তার পা গ্যাস প্যাডেল চাপ দিয়ে ধরে থাকলো- ‘আর দু’মিনিটের মধ্যে আমি শহরে পৌঁছাতে পারবো!’ তার যাত্রাপথে একটার পর একটা বাঁক আসতে থাকলো, অভিজ্ঞতাবশত আঁকাবাঁকা রাস্তা কোনো সমস্যা ব্যাতিরেকেই পার হয়ে এলো সে, মনে আছে ঘড়িতে সময় ন’টা বেজে দু’মিনিট হতে দেখেছিলো কয়েক মুহূর্ত আগে, তাই সে অ্যাক্সিলারেটরে আরও জোরে চাপ দিয়ে গাড়ির গতি বাড়িয়ে নিলো, এক মুহূর্তের জন্য আবার সেই কুকুরছানাটিকে মনে পড়ল তার, কল্পনায় দেখতে পেলো কী অসহায়ভাবে কুকুরছানাটি তার সঙ্গীর দিকে তাকিয়ে ছিলো, কিন্তু সেই ছবি আবার দ্রুতই হারিয়ে গেলো, আর পরের এক মিনিটে গাড়ির গতি প্রায় ষাট কিলোমিটারে তুলে গাড়ি চালানোয় মনোযোগ দিলো, তার সামনে একটি ধীর গতির গাড়ি ছাড়া রাস্তায় আর কেউ ছিল না, গাড়িটির কাছাকাছি গিয়ে চিনতে পারলো, ওটা একটা পুরাতন ধক্কর মার্কা ‘স্কোডা’ গাড়ি, বেশ বিরক্ত বোধ করলো সে, কারণ যেভাবে স্কোডাটি চালাচ্ছিলো সেটার চালক, তাতে ওভারটেক করার বদলে ও’কে তার নিজের গাড়ির গতিই কমাতে হচ্ছিলো, যতই সে স্কোডার কাছাকাছি হচ্ছিল, ওভারটেক করার সম্ভাবনা ততই কমছিলো- ‘আমি আর অপেক্ষা করব না,’ সে রাগান্বিতভাবে ভাবল, ‘এই পুরোনো স্কোডার পেছনে আর নয়, সামনের বাঁকে পৌঁছানোর আগেই ওটাকে ওভারটেক করতে হবে,’ রাস্তাটি ওর খুবই পরিচিত, হাজারবার এ রাস্তায় গাড়ি চালিয়েছে সে, সে জানে শহরের সীমানা নির্দেশক সাইনবোর্ডে পৌঁছানোর আগপর্যন্ত পর্যন্ত স্কোডাটিকে টপকে যাওয়ার কোনো সুযোগ ওর থাকবে না, তাই বাঁক আসার আগেই স্কোডাটিকে ওভারটেক করার জন্য অ্যাক্সিলারেটরে জোরে পা দাবিয়ে দিলো, আর ঠিক তখনই- স্কোডাটি ওর ঠিক সামনে ধীরে ধীরে বাঁক নিতে শুরু করলো, ঘটনা দু’টি যুগপৎ ঘটলো প্রায় একই মুহূর্তের মধ্যে, বিষয়টি রেয়ার ভিউ মিররে দেখামাত্র সে স্কোডাটিকে ওভারটেক করার সংকেত দিলো, সেই সাথে ওভারটেক স্টিয়ারিং হুইল বাম দিকে টেনে পাশের লেন দিয়ে ওভারটেক করার চেষ্টা নিলো, কিন্তু স্কোডার চালক সম্ভবত তার গাড়ির গতিপথ পরিবর্তন লক্ষ্য করতে পারেনি এবং কোনো সংকেত ছাড়াই, কে জানে কেন, স্কোডাটিকে বাম দিকের মোড়ে ঘুরিয়ে দিলো- সম্ভবত কারণ সে হয়তো স্কোডাকে যেকোনো দিকে ঘোরাতে অথবা পুরোপুরি ঘুরিয়ে নিতে চাইছিলো, হয়তো স্কোডার বাম ইন্ডিকেটর সেই মুহূর্তে জ্বলা শুরু করেছিলো- কিন্তু ততক্ষণে অনেক দেরি হয়ে গেছে- সজোরে ব্রেক কষেও গাড়ি থামাবার অবকাশ আর অবশিষ্ট ছিলো না, কারণ স্কোডাটি খুব ধীর গতিতে রাস্তার বাঁয়ে মোড় নিচ্ছিলো বিধায়- গাড়িটি বাস্তবিক অর্থেই আড়াআড়িভাবে পুরো রাস্তা দখল করে নিয়েছিলো- মুহূর্তেই দৃশ্যটি যেন চলচ্চিত্রের বিলম্বিত-দৃশে?্যর মতো হিমায়িত হয়ে গেলো, ব্রেক করে গাড়ি থামাবার পরিস্থিতি তখন ওদের নিয়ন্ত্রণের বাইরে- এক কথায় মারাত্মক দুর্ঘটনা এড়ানো একেবারেই অসম্ভব, অন্যভাবে বলতে গেলে- গাড়ি থামাবার সম্ভাব?্য কোনো উপান্তর না থাকার পরিণতিতে- ওর গাড়ি বিপজ্জনক গতিতে স্কোডা’কে আঘাত করলো... বিপর্যয় সূচনার ইঙ্গিত- অন্ধকারে ডুবে যাবার অনুভূতি থেকে শুরু হয়ে আকস্মিক মৃত্যুর পরিশেষের ধারাবাহিকতা থেকে সৃষ্টি হয় না: বাস্তবজীবনের সমস্ত কিছু, এমনকি কোনো বিপর্যয়- তারও থাকে মুহূর্ত থেকে মুহূর্ত পর্যায়ক্রমের ধারাবাহিক পরম্পরা- থাকে ধারাবাহিক কাঠামো, যা অপরিমেয়, বোধের অতীত, মারাত্মক জটিল, যা ভিন্নতর পরিপ্রেক্ষিতে অনুধাবন করতে হয়, সেই জটিলতার মাত্রাকে রূপক চিত্রকল্পের মাধ্যমে প্রকাশ করা সম্ভব, যদিও সম্ভাবনা খুবই দুরূহ- কারণ চিত্রকল্পের প্রবাহ তখনই দৃশ?্যমান হয়ে ওঠে- যখন সময়ের বিলম্বিত গতি এক সুনির্দিষ্ট পর্যায়ে পৌঁছায়, তখন নির্বিকার উদাসীন দৃষ্টিতে আমরা বুঝতে চেষ্টা করি- আমাদের পরিপাশির্^ক পরিস্থিতি এবং এর নিয়তি-নির্ধারিত পূর্বশর্তগুলোকে, আমরা খুঁজে পাই একান্ত সর্বজনীন সিদ্ধান্ত, যেগুলো নির্ধারিত হয়েছে ব্যক্তিগত অভিপ্রায় থেকে- কেন না এ সব অতিপ্রাকৃত বিলম্বিত মুহূর্তগুলো অপরিকল্পিত, অসচেতন সিদ্ধান্তের ফল, গাড়ির চাবি ঠিক মতো ইগনিশনে না ঢোকাতে পারার কারণে, গাড়ি তৃতীয় গিয়ারে চালু না হয়ে দ্বিতীয় গিয়ারে নেমে যায়, সেক্ষেত্রে ওর মতো আমরাও দ্বিতীয় গিয়ারে চালু হওয়া গাড়ি- তৃতীয় গিয়ারে বদলে নিই- ইতিমধ্যেই পাহাড়ী ঢাল বেয়ে দ্রুত নিচে নামতে শুরু করে গাড়ি, তারপর গ্রামের রাস্তার উপরের হাইওয়েতে পৌঁছায়- হাইওয়ের কিছুটা দূরত্ব পর্যন্ত আমাদের সামনের দৃষ্টিপথ ছিলো একটি টানেলের ভেতর দিয়ে দেখার মতো, কারণ রাস্তার উপরে ঢলে পড়া বনানীর সবুজ ডালপালাগুলো থেকে তখনও সকালের শিশিরের গন্ধ ছড়িয়ে পড়ছিলো, একটি কুকুরের মৃত্যু এবং একজন গাড়ি চালকের অবিবেচক সিদ্ধান্তে বাম দিকে মোড় নেওয়ার ভুল- অর্থাৎ, এক বা অন্য কোনো ভুল সিদ্ধান্তের বিপরীতে আরও বিবিধ সিদ্ধান্তের সৃষ্টি এবং সংক্ষিপ্ত সময়ে নেয়া ভুল সিদ্ধান্তের অবিরাম চলমান বিশৃঙ্খলা, আর মস্তিষ্ককে পাগল করে তোলা ‘যদি-কিন্তু’ ধরনের সম্ভাবনা বা সিদ্ধান্তগুলো অনুধাবন করা সেক্ষেত্রে যখন একেবারেই অসম্ভব- কারণ যে অরাজক পরিস্থিতিতে আমরা নিজেদেরকে নিরন্ত্রকের ভূমিকায় আবিষ্কার করি, তা ভয়ংকর জটিল, যা ঈশ্বর বা শয়তান কর্তৃক নির্ধারিত নয়, এগুলো এমন কিছু- যা নিয়ন্ত্রণ আমাদের অগম?্য এবং বিপর্যয়ের মধ্যে দিয়ে আমরা যেতে বাধ্য, কারণ “সম্ভাব?্যতা” কেবল মাত্র নির্বাচনের বিষয় নয়, কিন্তু সম্ভবনার ফল হিসাবে নির্ধারিত পরিণতিই নিয়তির মতো আমাদের মধ্যে নেমে আসতে বাধ্য।