সিকদার আমিনুল হকের ‘সতত ডানার মানুষ’
আনোয়ার মল্লিক
সিকদার আমিনুল হক / জন্ম : ৬ ডিসেম্বর ১৯৪২; মৃত্যু : ১৭ মে ২০০৩
সিকদার আমিনুল হককে বিবেচনা করা হয় ষাটের দশকের কবি হিসেবে। এই দশকে বাংলা সাহিত্যে বেশ কয়েকজন মেধাবী কবির আবির্ভাব হয়েছে। যেমন: আব্দুল মান্নান সৈয়দ, নির্মলেন্দু গুণ,আবুল হাসান, রফিক আজাদ, মোহাম্মদ রফিক, হেলাল হাফিজ, মহাদেব সাহা প্রমুখ। এঁদের মধ্যে আব্দুল মান্নান সৈয়দ বাদে অন্য সবাই তুমুল পাঠক প্রিয়তা লাভ করেছিলেন। সিকদার আমিনুল হক ষাটের একজন গুরুত্বপূর্ণ কবি। শুধু ষাট বললে ভুল হবে; আধুনিক বাংলা কবিতা আকাশেরই এক উজ্জ্বল জ্যোতিষ্ক তিনি। কিন্তুকবি হিসেবে তাঁর যে অনন্যতা, আমরা লক্ষ্য করি, সেই তুলনায় তাঁকে নিয়ে আলোচনা, চর্চা বেশি হয়নি। এমনকি পাঠক প্রিয়তায়ও তিনি পিছিয়ে। পাঠক খামতির একটা কারণ হয়তো দাঁড় করানো সম্ভব, যেমনটা কবি-প্রাবন্ধিক মিনার মনসুর বলেছিলেন, “সিকদার আমিনুল হকের কবিতা পাঠের জন্য ব্যাপক প্রস্তুতির প্রয়োজন আছে। কেউ যদি মনে করেন এ-কালের সস্তা উপন্যাসের মতো এক নিঃশ্বাসে পড়ে ফেলবেন কিংবা একবার পড়েই সব বুঝে ফেলবেন তাহলে তাকে নিশ্চিতভাবে হতাশ হতে হবে।”(ভূমিকা, সিকদার আমিনুল হক রচনা সমগ্র-১)।
পাঠক প্রিয়তার ব্যাপারটা দূরে সরিয়ে রেখেও বলা যায়, আমাদের বিশেষজ্ঞ-সমালোকেরাও তাঁর প্রতি কাক্সিক্ষত মনোযোগ দেননি। সিকদার আমিনুল হক প্রখর ব্যক্তিত্বের অধিকারী ছিলেন; ছিলেন পরিশীলিত রুচির মানুষ। প্রচারবিমুখ, শুদ্ধাচারী এই কবির কবিতাও ছিলো তাঁর ব্যক্তিত্বের মতই বিশুদ্ধ এবং অন্তর্মুখী। ষাটের যে সামাজিক ও রাজনৈতিক ডামাডোল, তিনি অত্যন্ত সচেতনভাবেই তার থেকে নিজেকে আড়ালে রাখেন। গতানুগতিক কোনো কিছুতে তিনি গা ভাসাননি। বিশুদ্ধ মনন এবং অনন্য কাব্যভাষা তাঁর কবিতাকে একটা স্বাতন্ত্র্য দান করেছে। রোমান্টিকতা ও মৃত্যু চিন্তা তাঁর কবিতার প্রধান অন্বিষ্ট দুটি বিষয়। যে প্রেমের বন্দনা তিনি করেছেন তা নিষ্কাম প্লেটোনিক প্রেম নয়, একেবারে রক্ত-মাংসের দেহজ প্রেম। এছাড়া নগর চেতনা, বিচ্ছিন্নতা, গ্রামীণ ও লোকজ উপাদান, নিসর্গ তাঁর কবিতায় ঘুরেফিরে আসে।
সিকদার আমিনুল হকের প্রথম কাব্যগ্রন্থ ‘দূরের কার্নিশ’ প্রকাশিত হয় ১৯৭৫ সালে।এই গ্রন্থেই শুধু নয়, তাঁর সব কবিতাই মূলত অক্ষরবৃত্ত এবং মুক্ত ছন্দে লেখা। কিন্তু এই কাব্যগ্রন্থে টানা গদ্য ছন্দে লেখা ২২ টি কবিতার দেখা মেলে। এই গদ্য ঢঙকে ছন্দ বলা যায় কিনা, তা নিয়ে বিতর্ক থাকতে পারে। তবে এই সব গদ্য কবিতায় ভাষার কারুকার্য, কাব্যময়তা এবং ভাবের গভীরতা পাঠককে মুগ্ধ করে।
একটি উদাহরণ দিলে বিষয়টা পরিষ্কার হবে: আমি অভিভূত হলে উচ্ছ্বাসের সমস্ত আলোই জ্বলে উঠবে কিন্তু আমি এরকম আচ্ছন্নতার মধ্যে যেতে চাই না। আমি যখন জলের কথা বলি, তা যেন আমার ধমনির ভঙ্গিতেও ফুটে ওঠে। অন্তত প্রত্যাশার হাতের মুঠোতেও যেন শীতলতার স্পর্শ এসে লাগে।” (উত্তাপের বাইরে,দূরের কার্নিশ)। পরবর্তী কালের ‘তিন পাপড়ির ফুল’, ‘পারাবত এই প্রাচীরের শেষ কবিতা’ কাব্যগ্রন্থে এরকম টানা গদ্যে লেখা কবিতার দেখা পাওয়া যায়। ১৯৯১ সালে প্রকাশিত হয় কাব্যগ্রন্থ, ‘সতত ডানার মানুষ’। এই গ্রন্থের সকল কবিতা টানা গদ্যে লেখা। অনেকের মতে, এটাসিকদার আমিনুল হকের সবচেয়ে প্রশংসিত এবং নন্দিত কাজ; যেখানে গদ্য ভঙ্গির সঙ্গে কবিত্ব শক্তির অভূতপূর্ব সংযোগ লক্ষ করা যায়।
এই গ্রন্থের কবিতাগুলোকে তিনটি পর্বে বিন্যস্ত করা হয়েছে: ‘শৈশব আমাকে পরিয়ে দিয়েছিল প্রেমের দস্তানা’, ‘মৃত্যু অন্য এক শীতল শৈশব’ ও ‘প্রতিভা এক বিশাল বৃত্ত’। আমাদের আলোচনা মূলত প্রথম পর্বে সীমাবদ্ধ থাকবে। এখানে দেখা যায়, একজন কথক আত্মউন্মোচনের ভঙ্গিতে নিজের উপলব্ধি, অভিজ্ঞতা এবং কল্পনার বর্ণনা দিয়ে যাচ্ছেন। কাদের উদ্দেশ্যে কবির এই দৃঢ়, সুষমাময় আত্মকথন, স্পষ্ট করে না বললেও বোঝা যায়, কবির নিজের সঙ্গেই নিজের এই কথোপকথন। এই কথনে উল্লিখিত নারী, পাঠক, কবিতা, প্রহরী, মৃত্যু, তুমি-সবই আসলে হয়ে উঠেছে এক একটা মুখোশ। এই মুখোশ মূলত কবির আত্মসৃষ্টিরই একটা অংশ অর্থাৎ কবির নিজেরই অংশ। সুতরাং কবি এখানে নিজের সঙ্গে নিজে এই বাক্যালাপ চালিয়ে যাচ্ছেন।
সিকদার আমিনুল হকের এই পর্বের টানা গদ্য কবিতার কেন্দ্রে রয়েছে নারী ও প্রেম। নারী বিষয়ে কবি খুব অভিজ্ঞ। এর প্রধান কারণ কবির বয়স। বয়সের অভিজ্ঞতাকে কখনও উপেক্ষা করা যায় না। কাব্যগ্রন্থের শুরুতেই কবি বলেন, “কালো অন্তর্বাস, বগলের ক্ষার আর বেদেনীর মতো এক সারি ঝিলিক দেয়া দাঁত- আজ আমি প্রসঙ্গত নারীর কথাই বলবো।... আমার অনেক অভিজ্ঞতা হয়েছে;এখন আমি মানুষের লালসা নিয়েও ঠাট্টা করতে পারি। বয়স হলো সেই উট, বালুর অন্ধকার ঝড়ের মধ্যেও যে তার মালিকের পাগড়ীর রং ঠিকঠাক চিনতে পারে; অথচ উটকে কেউ দেখতে পায় না।” (শৈশব আমাকে পরিয়ে দিয়েছিল প্রেমের দস্তানা, সতত ডানার মানুষ)।
সিকদার আমিনুল হকের কবিতায় নগরের আলো-অন্ধকার জীবনের বিষণœ চিত্র ফুটে ওঠে। নগরের এই বিষণœতার মধ্যেও কবি সৌন্দর্যের অনুসন্ধান করেছেন। কবি গভীরভাবে নগরের রাতের জীবনকে প্রত্যক্ষ করেন। দিনের আলো নিভে গেলে নগরের নিষিদ্ধ জীবনের নারীরা সাজিয়ে গুছিয়ে ঝলমলে রূপের পসরা সাজায়। রাতের আলো আধারিতে তারা লুকাতে চায় জীবনের অন্তহীন বেদনার ছাপ। কিন্তু কবিরুদ্ধ ঘরের দরোজা খুলে উন্মোচন করেছেন এই সব নারীদের অতলস্পর্শী দুঃখের কাহিনী। রাতের ভিন্ন পোশাকে নতুন ভূমিকায় শুরু হয় তাদের ভিন্নতর জীবন: “মেয়েরা যখন তাদের বাসি পোশাকগুলি শরীর থেকে একে একে খুলে ফেলে দ্যায়, হাঁ, তখুনি ভোর।... দিনের, কর্মঠ দিনের পোশাকগুলি সব ধবধবে সাদা। কিন্তু রাতের পোশাক বলি এমন ছিল না। (প্রাগুক্ত)
নারীর যৌবনই পুরুষের একমাত্র আরাধ্য। এই যৌবনের টানে পতঙ্গের মতো পুরুষ নারীর কাছে ছুটে আসে। যৌবন নারীর জীবনে প্রেম আনে। অতিক্রান্ত যৌবনে প্রেম মরে যায়। বসন্তের মাতাল আবাহন নারীর শরীরকে পুনরায় জাগিয়ে তোলে। শরীরের বাঁকে বাঁকে প্রেম দোলা দিয়ে যায়। যৌবন চলে গেলে বিষাদে ছেয়ে জীবন। কবিতায় এই সত্যই উঠে এসেছে নিপুণ শৈলীতে:
“সব নারী আমাদের ভাবনায় ফেলে না; কেউ কেউ ফেলে। আর যারা অপেক্ষা করে, তারা শীতের সবুজ পতঙ্গের মতো। -অনেকে চাঁদ আর ঝুল বারান্দার নিচে পরাধীন! অনিশ্চিত তাদের টলমলে সুঠাম পা; বালিকা বয়স থেকেই নিদ্রিত স্তন হয়ে ওঠে ওদের নৈরাশ্য এবং সম্পদের ভার! তারা বাঁচে বসন্ত আর প্রেমের কয়েকটা দিন... বাতাস আর পাতাও যখন তাদের ইশারায় কাঁদায়, সেই সরল কয়েকটা দিনই ওদের নির্ভুল আয়ু।” (শৈশব আমাকে পরিয়ে দিয়েছিল প্রেমের দস্তানা, সতত ডানার মানুষ)
নারী-প্রেমে কামই কবির আরাধ্য। কাম ছাড়া প্রেম মূল্যহীন। যুগে যুগে নারী পুরুষের কামের সঙ্গী হয়েছে। নারীর এই কামকলাই মানব প্রজাতিকে রক্ষা করেছে, এগিয়ে নিয়েছে। কবির মনোজগতে যে নারীর বসবাস, সেই নারী তার কাম-সঙ্গী, কবিরআনন্দ-বেদনার সহচর। কাক্সিক্ষত নারীর সঙ্গে অবিচ্ছেদ্য বন্ধনে কবি বাঁধা পড়ে আছেন। এই বন্ধন ছিন্ন হলে কবির সুস্থতা হারিয়ে যায়। কবির বেঁচে থাকা হয়ে পড়ে অর্থহীন। কবি বলেন, “আকাক্সিক্ষত নারীর ওষ্ঠ থেকে যখন আমার রস সিক্ত জিভ সরিয়ে নিচ্ছি, তখন পৃথিবীর কোনো দুরারোগ্য রোগীর মুখ থেকে এই মাত্র নার্স বিবেকহীন প্রশান্তিতে সরিয়ে নিলো ওষুধের দাগে বিবর্ণ জরুরি গ্লাসটি।” (প্রাগুক্ত)
কবি তাঁর দুরন্ত শৈশব স্মৃতির দৃশ্যাবলি নিপাট বুননে তুলে এনেছেন কবিতায়। প্রখর রৌদ্রের কথা, ভোরের বাতাসের চাঞ্চল্য, রাতের নিদ্রিত মাছের শরীরের আঁশটে গন্ধ, আর স্থির জলের নরম বাষ্পের কথা বলতে চেয়েছেন। তাঁর একাকীশৈশবঅথবা বয়ঃসন্ধিকালের যন্ত্রণাআজও ভুলতে পারেননি কবি। মাঝ রাতের তারাগুলো নীলিমার মধ্যস্থতায় কবির সঙ্গেকথা বলতো। তাঁর স্মৃতির কোটরে এখনো অম্লান ঘাস ওপতঙ্গের গতিবিধি, সাবানের ফেনায় তৈরি হওয়া রামধনুর সাত রং। ভোর হলেকমলা আর জাফরান রঙের পাল তুলে হাওয়ার দিকে মুখ করে গন্তব্যের পানে ছুটে চলা নৌকার বহরের কথা এখনো কবির মনে দোলা দেয়। অতীতের এইসব মধুর স্মৃতির অনুষঙ্গকবি নিজের জীবনে এখনো ধারণকরে আছেন। একদা এদেশের নদী ছেয়ে থাকতো শাদা ইলিশে। মাথার উপরে প্রখর সূর্য নিয়ে ভাড়া করা ছাতার নিচে কবি সমুদ্রের বিশাল গর্জনের শব্দ শুনেছেন। প্রতিটি বর্ষার রাতে, বৃষ্টির প্রবল তোড়ে এখনো কবি প্রিয় মানুষের বুকের স্পন্দন শুনতে পান। কোনো এক স্বপ্নময় মদির রাত্রির কথা কবি চিত্রিতকরেছেন এভাবে : “রাত্রির চর্বি-রং চাঁদ উঠলে দেখবে আমার ব্রোঞ্জের মতো গলানো সক্রিয় শরীর। তারইবা কী এমন প্রয়োজন আছে! এর চেয়ে ভালো হতো- যদি থাকতো রাত্রির বাতাস;একটি বারান্দার গ্রিল দেওয়া খাঁচায় আমরা বসতাম মুখোমুখি। রাত্রি অন্য প্রান্তে আমাদের বয়ঃসন্ধির ঝাঁঝালো গন্ধ আর সেই সঙ্গে টেলিফোনের তারের ওপর দিয়ে যেতো আফ্রিকার মতো অন্ধকার...” (শৈশব আমাকে পরিয়ে দিয়েছিল প্রেমের দস্তানা,সতত ডানার মানুষ)
‘সততা ডানার মানুষ’ কাব্যগ্রন্থে কবি সিকদার আমিনুল হকের কাব্য প্রতিভার সর্বোচ্চ স্ফুরণঘটেছে।ভাষার সৌন্দর্যময়তা, কল্পনার বিস্তার এবং চিত্রকল্পের ঐশ্বর্য এই গ্রন্থের কবিতাগুলোকে কালোত্তীর্ণ করেছে। কবিতার ছত্রে ছত্রে কবির স্বপ্ন ওসৌন্দর্যের প্রকাশ ঘটেছে। সুদূর শৈশব, কৈশোরের ফেলে আসা আনন্দ ও বিষাদময়জীবনে অবগাহন করে কবি সুখ খুঁজেতে চেয়েছেন।কবির জীবনের নারীরা অন্তর্গতভাবে সব দুঃখী।বিষাদেরকালো চাদরে ঢাকা তাদের জীবন। কিন্তু বহিরঙ্গে তারা ঝলমলে, আনন্দমুখর। প্রেমের ক্ষেত্রে কবি ফ্রয়েডীয় তত্ত্বের অনুসারী হলেও তাঁর কাব্যস্বর কোমল ও মাধুর্যময়। কবি প্রেমের বন্দনা করেন কামের অনুষঙ্গে। কবি বলেন, “স্বপ্নের মুঠোর মধ্যে রাখা যায়, এমন নারী পৃথিবীতে এখনো পৌঁছয়নি;যারা চুম্বনে ধরা দেবে, তারাও নয়! লুকনো সংগমের মধ্য দিয়ে ওরা বাইরে আসছে। সম্ভব হলে ওরা তুঙ্গ কালে উচ্চারণ করে অশ্লীল শব্দ।” (প্রাগুক্ত)
তবেএই সব দুঃখী নারীর প্রতি কবির অসীম মমত্ববোধ স্পষ্ট হয় যখন কবি বলেন, “মরা আলোর নিচে যারা অনুমোদন নিয়ে আগন্তুকেরজন্য দাঁড়িয়ে থাকে, তারাও নারী। তাছাড়া আজ পর্যন্ত কেউ জঙ্ঘার ওপর কাপড় তোলেনি। এমনকি বণিকের কাছেও নয়।...” (প্রাগুক্ত)।
‘সতত ডানার মানুষ’ কাব্যগ্রন্থে সিকদার আমিনুল হক টানা গদ্য ভঙ্গিতে কবিতার যে নিরীক্ষা করেছেন তা বোদ্ধা সমালোচক ও পাঠকের কাছেগ্রহণযোগ্যতা পেয়েছে। এবং তাঁর পরবর্তী প্রজন্মের কবিগণও এই কাব্যভাষা সাদরে গ্রহণ করেছেন।
ইপেপার
জাতীয়
সারাদেশ
আন্তর্জাতিক
নগর-মহানগর
খেলা
বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি
শিক্ষা
অর্থ-বাণিজ্য
সংস্কৃতি
ক্যাম্পাস
মিডিয়া
অপরাধ ও দুর্নীতি
রাজনীতি
শোক ও স্মরন
প্রবাস
নারীর প্রতি সহিংসতা
বিনোদন
সম্পাদকীয়
উপ-সম্পাদকীয়
মুক্ত আলোচনা
চিঠিপত্র
পাঠকের চিঠি
সিকদার আমিনুল হকের ‘সতত ডানার মানুষ’
আনোয়ার মল্লিক
সিকদার আমিনুল হক / জন্ম : ৬ ডিসেম্বর ১৯৪২; মৃত্যু : ১৭ মে ২০০৩
বৃহস্পতিবার, ০৪ ডিসেম্বর ২০২৫
সিকদার আমিনুল হককে বিবেচনা করা হয় ষাটের দশকের কবি হিসেবে। এই দশকে বাংলা সাহিত্যে বেশ কয়েকজন মেধাবী কবির আবির্ভাব হয়েছে। যেমন: আব্দুল মান্নান সৈয়দ, নির্মলেন্দু গুণ,আবুল হাসান, রফিক আজাদ, মোহাম্মদ রফিক, হেলাল হাফিজ, মহাদেব সাহা প্রমুখ। এঁদের মধ্যে আব্দুল মান্নান সৈয়দ বাদে অন্য সবাই তুমুল পাঠক প্রিয়তা লাভ করেছিলেন। সিকদার আমিনুল হক ষাটের একজন গুরুত্বপূর্ণ কবি। শুধু ষাট বললে ভুল হবে; আধুনিক বাংলা কবিতা আকাশেরই এক উজ্জ্বল জ্যোতিষ্ক তিনি। কিন্তুকবি হিসেবে তাঁর যে অনন্যতা, আমরা লক্ষ্য করি, সেই তুলনায় তাঁকে নিয়ে আলোচনা, চর্চা বেশি হয়নি। এমনকি পাঠক প্রিয়তায়ও তিনি পিছিয়ে। পাঠক খামতির একটা কারণ হয়তো দাঁড় করানো সম্ভব, যেমনটা কবি-প্রাবন্ধিক মিনার মনসুর বলেছিলেন, “সিকদার আমিনুল হকের কবিতা পাঠের জন্য ব্যাপক প্রস্তুতির প্রয়োজন আছে। কেউ যদি মনে করেন এ-কালের সস্তা উপন্যাসের মতো এক নিঃশ্বাসে পড়ে ফেলবেন কিংবা একবার পড়েই সব বুঝে ফেলবেন তাহলে তাকে নিশ্চিতভাবে হতাশ হতে হবে।”(ভূমিকা, সিকদার আমিনুল হক রচনা সমগ্র-১)।
পাঠক প্রিয়তার ব্যাপারটা দূরে সরিয়ে রেখেও বলা যায়, আমাদের বিশেষজ্ঞ-সমালোকেরাও তাঁর প্রতি কাক্সিক্ষত মনোযোগ দেননি। সিকদার আমিনুল হক প্রখর ব্যক্তিত্বের অধিকারী ছিলেন; ছিলেন পরিশীলিত রুচির মানুষ। প্রচারবিমুখ, শুদ্ধাচারী এই কবির কবিতাও ছিলো তাঁর ব্যক্তিত্বের মতই বিশুদ্ধ এবং অন্তর্মুখী। ষাটের যে সামাজিক ও রাজনৈতিক ডামাডোল, তিনি অত্যন্ত সচেতনভাবেই তার থেকে নিজেকে আড়ালে রাখেন। গতানুগতিক কোনো কিছুতে তিনি গা ভাসাননি। বিশুদ্ধ মনন এবং অনন্য কাব্যভাষা তাঁর কবিতাকে একটা স্বাতন্ত্র্য দান করেছে। রোমান্টিকতা ও মৃত্যু চিন্তা তাঁর কবিতার প্রধান অন্বিষ্ট দুটি বিষয়। যে প্রেমের বন্দনা তিনি করেছেন তা নিষ্কাম প্লেটোনিক প্রেম নয়, একেবারে রক্ত-মাংসের দেহজ প্রেম। এছাড়া নগর চেতনা, বিচ্ছিন্নতা, গ্রামীণ ও লোকজ উপাদান, নিসর্গ তাঁর কবিতায় ঘুরেফিরে আসে।
সিকদার আমিনুল হকের প্রথম কাব্যগ্রন্থ ‘দূরের কার্নিশ’ প্রকাশিত হয় ১৯৭৫ সালে।এই গ্রন্থেই শুধু নয়, তাঁর সব কবিতাই মূলত অক্ষরবৃত্ত এবং মুক্ত ছন্দে লেখা। কিন্তু এই কাব্যগ্রন্থে টানা গদ্য ছন্দে লেখা ২২ টি কবিতার দেখা মেলে। এই গদ্য ঢঙকে ছন্দ বলা যায় কিনা, তা নিয়ে বিতর্ক থাকতে পারে। তবে এই সব গদ্য কবিতায় ভাষার কারুকার্য, কাব্যময়তা এবং ভাবের গভীরতা পাঠককে মুগ্ধ করে।
একটি উদাহরণ দিলে বিষয়টা পরিষ্কার হবে: আমি অভিভূত হলে উচ্ছ্বাসের সমস্ত আলোই জ্বলে উঠবে কিন্তু আমি এরকম আচ্ছন্নতার মধ্যে যেতে চাই না। আমি যখন জলের কথা বলি, তা যেন আমার ধমনির ভঙ্গিতেও ফুটে ওঠে। অন্তত প্রত্যাশার হাতের মুঠোতেও যেন শীতলতার স্পর্শ এসে লাগে।” (উত্তাপের বাইরে,দূরের কার্নিশ)। পরবর্তী কালের ‘তিন পাপড়ির ফুল’, ‘পারাবত এই প্রাচীরের শেষ কবিতা’ কাব্যগ্রন্থে এরকম টানা গদ্যে লেখা কবিতার দেখা পাওয়া যায়। ১৯৯১ সালে প্রকাশিত হয় কাব্যগ্রন্থ, ‘সতত ডানার মানুষ’। এই গ্রন্থের সকল কবিতা টানা গদ্যে লেখা। অনেকের মতে, এটাসিকদার আমিনুল হকের সবচেয়ে প্রশংসিত এবং নন্দিত কাজ; যেখানে গদ্য ভঙ্গির সঙ্গে কবিত্ব শক্তির অভূতপূর্ব সংযোগ লক্ষ করা যায়।
এই গ্রন্থের কবিতাগুলোকে তিনটি পর্বে বিন্যস্ত করা হয়েছে: ‘শৈশব আমাকে পরিয়ে দিয়েছিল প্রেমের দস্তানা’, ‘মৃত্যু অন্য এক শীতল শৈশব’ ও ‘প্রতিভা এক বিশাল বৃত্ত’। আমাদের আলোচনা মূলত প্রথম পর্বে সীমাবদ্ধ থাকবে। এখানে দেখা যায়, একজন কথক আত্মউন্মোচনের ভঙ্গিতে নিজের উপলব্ধি, অভিজ্ঞতা এবং কল্পনার বর্ণনা দিয়ে যাচ্ছেন। কাদের উদ্দেশ্যে কবির এই দৃঢ়, সুষমাময় আত্মকথন, স্পষ্ট করে না বললেও বোঝা যায়, কবির নিজের সঙ্গেই নিজের এই কথোপকথন। এই কথনে উল্লিখিত নারী, পাঠক, কবিতা, প্রহরী, মৃত্যু, তুমি-সবই আসলে হয়ে উঠেছে এক একটা মুখোশ। এই মুখোশ মূলত কবির আত্মসৃষ্টিরই একটা অংশ অর্থাৎ কবির নিজেরই অংশ। সুতরাং কবি এখানে নিজের সঙ্গে নিজে এই বাক্যালাপ চালিয়ে যাচ্ছেন।
সিকদার আমিনুল হকের এই পর্বের টানা গদ্য কবিতার কেন্দ্রে রয়েছে নারী ও প্রেম। নারী বিষয়ে কবি খুব অভিজ্ঞ। এর প্রধান কারণ কবির বয়স। বয়সের অভিজ্ঞতাকে কখনও উপেক্ষা করা যায় না। কাব্যগ্রন্থের শুরুতেই কবি বলেন, “কালো অন্তর্বাস, বগলের ক্ষার আর বেদেনীর মতো এক সারি ঝিলিক দেয়া দাঁত- আজ আমি প্রসঙ্গত নারীর কথাই বলবো।... আমার অনেক অভিজ্ঞতা হয়েছে;এখন আমি মানুষের লালসা নিয়েও ঠাট্টা করতে পারি। বয়স হলো সেই উট, বালুর অন্ধকার ঝড়ের মধ্যেও যে তার মালিকের পাগড়ীর রং ঠিকঠাক চিনতে পারে; অথচ উটকে কেউ দেখতে পায় না।” (শৈশব আমাকে পরিয়ে দিয়েছিল প্রেমের দস্তানা, সতত ডানার মানুষ)।
সিকদার আমিনুল হকের কবিতায় নগরের আলো-অন্ধকার জীবনের বিষণœ চিত্র ফুটে ওঠে। নগরের এই বিষণœতার মধ্যেও কবি সৌন্দর্যের অনুসন্ধান করেছেন। কবি গভীরভাবে নগরের রাতের জীবনকে প্রত্যক্ষ করেন। দিনের আলো নিভে গেলে নগরের নিষিদ্ধ জীবনের নারীরা সাজিয়ে গুছিয়ে ঝলমলে রূপের পসরা সাজায়। রাতের আলো আধারিতে তারা লুকাতে চায় জীবনের অন্তহীন বেদনার ছাপ। কিন্তু কবিরুদ্ধ ঘরের দরোজা খুলে উন্মোচন করেছেন এই সব নারীদের অতলস্পর্শী দুঃখের কাহিনী। রাতের ভিন্ন পোশাকে নতুন ভূমিকায় শুরু হয় তাদের ভিন্নতর জীবন: “মেয়েরা যখন তাদের বাসি পোশাকগুলি শরীর থেকে একে একে খুলে ফেলে দ্যায়, হাঁ, তখুনি ভোর।... দিনের, কর্মঠ দিনের পোশাকগুলি সব ধবধবে সাদা। কিন্তু রাতের পোশাক বলি এমন ছিল না। (প্রাগুক্ত)
নারীর যৌবনই পুরুষের একমাত্র আরাধ্য। এই যৌবনের টানে পতঙ্গের মতো পুরুষ নারীর কাছে ছুটে আসে। যৌবন নারীর জীবনে প্রেম আনে। অতিক্রান্ত যৌবনে প্রেম মরে যায়। বসন্তের মাতাল আবাহন নারীর শরীরকে পুনরায় জাগিয়ে তোলে। শরীরের বাঁকে বাঁকে প্রেম দোলা দিয়ে যায়। যৌবন চলে গেলে বিষাদে ছেয়ে জীবন। কবিতায় এই সত্যই উঠে এসেছে নিপুণ শৈলীতে:
“সব নারী আমাদের ভাবনায় ফেলে না; কেউ কেউ ফেলে। আর যারা অপেক্ষা করে, তারা শীতের সবুজ পতঙ্গের মতো। -অনেকে চাঁদ আর ঝুল বারান্দার নিচে পরাধীন! অনিশ্চিত তাদের টলমলে সুঠাম পা; বালিকা বয়স থেকেই নিদ্রিত স্তন হয়ে ওঠে ওদের নৈরাশ্য এবং সম্পদের ভার! তারা বাঁচে বসন্ত আর প্রেমের কয়েকটা দিন... বাতাস আর পাতাও যখন তাদের ইশারায় কাঁদায়, সেই সরল কয়েকটা দিনই ওদের নির্ভুল আয়ু।” (শৈশব আমাকে পরিয়ে দিয়েছিল প্রেমের দস্তানা, সতত ডানার মানুষ)
নারী-প্রেমে কামই কবির আরাধ্য। কাম ছাড়া প্রেম মূল্যহীন। যুগে যুগে নারী পুরুষের কামের সঙ্গী হয়েছে। নারীর এই কামকলাই মানব প্রজাতিকে রক্ষা করেছে, এগিয়ে নিয়েছে। কবির মনোজগতে যে নারীর বসবাস, সেই নারী তার কাম-সঙ্গী, কবিরআনন্দ-বেদনার সহচর। কাক্সিক্ষত নারীর সঙ্গে অবিচ্ছেদ্য বন্ধনে কবি বাঁধা পড়ে আছেন। এই বন্ধন ছিন্ন হলে কবির সুস্থতা হারিয়ে যায়। কবির বেঁচে থাকা হয়ে পড়ে অর্থহীন। কবি বলেন, “আকাক্সিক্ষত নারীর ওষ্ঠ থেকে যখন আমার রস সিক্ত জিভ সরিয়ে নিচ্ছি, তখন পৃথিবীর কোনো দুরারোগ্য রোগীর মুখ থেকে এই মাত্র নার্স বিবেকহীন প্রশান্তিতে সরিয়ে নিলো ওষুধের দাগে বিবর্ণ জরুরি গ্লাসটি।” (প্রাগুক্ত)
কবি তাঁর দুরন্ত শৈশব স্মৃতির দৃশ্যাবলি নিপাট বুননে তুলে এনেছেন কবিতায়। প্রখর রৌদ্রের কথা, ভোরের বাতাসের চাঞ্চল্য, রাতের নিদ্রিত মাছের শরীরের আঁশটে গন্ধ, আর স্থির জলের নরম বাষ্পের কথা বলতে চেয়েছেন। তাঁর একাকীশৈশবঅথবা বয়ঃসন্ধিকালের যন্ত্রণাআজও ভুলতে পারেননি কবি। মাঝ রাতের তারাগুলো নীলিমার মধ্যস্থতায় কবির সঙ্গেকথা বলতো। তাঁর স্মৃতির কোটরে এখনো অম্লান ঘাস ওপতঙ্গের গতিবিধি, সাবানের ফেনায় তৈরি হওয়া রামধনুর সাত রং। ভোর হলেকমলা আর জাফরান রঙের পাল তুলে হাওয়ার দিকে মুখ করে গন্তব্যের পানে ছুটে চলা নৌকার বহরের কথা এখনো কবির মনে দোলা দেয়। অতীতের এইসব মধুর স্মৃতির অনুষঙ্গকবি নিজের জীবনে এখনো ধারণকরে আছেন। একদা এদেশের নদী ছেয়ে থাকতো শাদা ইলিশে। মাথার উপরে প্রখর সূর্য নিয়ে ভাড়া করা ছাতার নিচে কবি সমুদ্রের বিশাল গর্জনের শব্দ শুনেছেন। প্রতিটি বর্ষার রাতে, বৃষ্টির প্রবল তোড়ে এখনো কবি প্রিয় মানুষের বুকের স্পন্দন শুনতে পান। কোনো এক স্বপ্নময় মদির রাত্রির কথা কবি চিত্রিতকরেছেন এভাবে : “রাত্রির চর্বি-রং চাঁদ উঠলে দেখবে আমার ব্রোঞ্জের মতো গলানো সক্রিয় শরীর। তারইবা কী এমন প্রয়োজন আছে! এর চেয়ে ভালো হতো- যদি থাকতো রাত্রির বাতাস;একটি বারান্দার গ্রিল দেওয়া খাঁচায় আমরা বসতাম মুখোমুখি। রাত্রি অন্য প্রান্তে আমাদের বয়ঃসন্ধির ঝাঁঝালো গন্ধ আর সেই সঙ্গে টেলিফোনের তারের ওপর দিয়ে যেতো আফ্রিকার মতো অন্ধকার...” (শৈশব আমাকে পরিয়ে দিয়েছিল প্রেমের দস্তানা,সতত ডানার মানুষ)
‘সততা ডানার মানুষ’ কাব্যগ্রন্থে কবি সিকদার আমিনুল হকের কাব্য প্রতিভার সর্বোচ্চ স্ফুরণঘটেছে।ভাষার সৌন্দর্যময়তা, কল্পনার বিস্তার এবং চিত্রকল্পের ঐশ্বর্য এই গ্রন্থের কবিতাগুলোকে কালোত্তীর্ণ করেছে। কবিতার ছত্রে ছত্রে কবির স্বপ্ন ওসৌন্দর্যের প্রকাশ ঘটেছে। সুদূর শৈশব, কৈশোরের ফেলে আসা আনন্দ ও বিষাদময়জীবনে অবগাহন করে কবি সুখ খুঁজেতে চেয়েছেন।কবির জীবনের নারীরা অন্তর্গতভাবে সব দুঃখী।বিষাদেরকালো চাদরে ঢাকা তাদের জীবন। কিন্তু বহিরঙ্গে তারা ঝলমলে, আনন্দমুখর। প্রেমের ক্ষেত্রে কবি ফ্রয়েডীয় তত্ত্বের অনুসারী হলেও তাঁর কাব্যস্বর কোমল ও মাধুর্যময়। কবি প্রেমের বন্দনা করেন কামের অনুষঙ্গে। কবি বলেন, “স্বপ্নের মুঠোর মধ্যে রাখা যায়, এমন নারী পৃথিবীতে এখনো পৌঁছয়নি;যারা চুম্বনে ধরা দেবে, তারাও নয়! লুকনো সংগমের মধ্য দিয়ে ওরা বাইরে আসছে। সম্ভব হলে ওরা তুঙ্গ কালে উচ্চারণ করে অশ্লীল শব্দ।” (প্রাগুক্ত)
তবেএই সব দুঃখী নারীর প্রতি কবির অসীম মমত্ববোধ স্পষ্ট হয় যখন কবি বলেন, “মরা আলোর নিচে যারা অনুমোদন নিয়ে আগন্তুকেরজন্য দাঁড়িয়ে থাকে, তারাও নারী। তাছাড়া আজ পর্যন্ত কেউ জঙ্ঘার ওপর কাপড় তোলেনি। এমনকি বণিকের কাছেও নয়।...” (প্রাগুক্ত)।
‘সতত ডানার মানুষ’ কাব্যগ্রন্থে সিকদার আমিনুল হক টানা গদ্য ভঙ্গিতে কবিতার যে নিরীক্ষা করেছেন তা বোদ্ধা সমালোচক ও পাঠকের কাছেগ্রহণযোগ্যতা পেয়েছে। এবং তাঁর পরবর্তী প্রজন্মের কবিগণও এই কাব্যভাষা সাদরে গ্রহণ করেছেন।