ধারাবাহিক ভ্রমণ কাহিনী-২০
চৌধুরী সালাহউদ্দীন মাহমুদ
(পূর্ব প্রকাশের পর)
পড়ন্ত বিকেলের বিষণœতায় সেভিয়া ছেড়ে চললাম আন্দালুসিয়া ত্রিভুজের শেষ শীর্ষবিন্দুর পথে।
‘আপনাদের যাত্রা শুভ হোক! বাসটি দুই ঘণ্টার মধ্যে করদোবা পৌঁছবে। মাঝখানে থামবে ১৫ মিনিটের জন্য এক রেস্তোরাঁয়। আশা করছি, এ বাস ভ্রমণটি রোমাঞ্চকর হবে।’ এই বলে বাসের সহকারী অরতিজ মৃদু হেসে সবাইকে অভিবাদন করল।
শহর পাড়ি দিতেই শুরু হলো সেই পরিচিত ছবি- জলপাই ও কমলা বাগান, পরে যোগ দিল সূর্যমুখী ফুলের বাগান। ঢেউ খেলানো ভূমিকে রাঙিয়ে দিয়েছে পাকা ফসলের ধূসর, কমলা ও হলুদ রঙ- এ যেন তাদের বিদায়বেলার নিবেদন, যেমন বলেছেন কবিগুরু: ‘রাঙিয়ে দিয়ে যাও গো এবার যাবার আগে’। ‘লা কেমপানিয়া’ নামে পরিচিত উঁচু-নিচু মায়াবী সুন্দর এ পথটুকু দেখতে দেখতে আমরা চললাম।
ভাবি, ‘এ পথ যদি না শেষ হয়’। দুই ঘণ্টার পথ, দেখতে দেখতে পার হয়ে যাবে। তবে এ পথটি যে তাড়াতাড়ি শেষ হবে না, তা ভাবতেই পারিনি।
ঘণ্টাখানেক চলার পর এক বিকট শব্দ করে বাস থেমে গেল আস্তে আস্তে। ড্রাইভার বলল, ‘চিন্তার কিছু নেই, এ তেমন কিছু নয়, একটি চাকা ফেটে গেছে। আমাদের দফতরে ফোন করে দিচ্ছি, যাতে তারা বিকল্প ব্যবস্থা করতে পারে।’
স্পেন ভ্রমণে কোনো অসুবিধের মুখোমুখি হলাম এই প্রথম। জীবন এ রকমই, যে কোনো পরিস্থিতি হতে পারে যে কোনো জায়গায়, যে কোনো সময়। দেখা যাক কী হয়।
ড্রাইভার দেখি ফোনে কথা বলছে তো বলছেই, শেষ হচ্ছে না। পরে বলল, ‘তোমাদের অসুবিধের জন্য দুঃখিত। চাকাটি এখানে মেরামত করা যাবে না। সেভিয়া থেকে ঘণ্টাখানেকের মধ্যে আরেকটি বাস আসবে সবাইকে করদোবা নিয়ে যেতে।’
চারিদিকে বিষণœতার ভাব বাড়িয়ে নেমে এল সন্ধ্যা। একটা উদ্বেগ ভর করেছে মনে, যেন নীল আকাশের ওপর ভেসে থাকা এক ধূসর মেঘ। এ জায়গাটি লোকালয় থেকে দূরে, আশেপাশে কমলা বাগান ছাড়া আর কিছু নেই। নিজের জন্য ভাবনা হচ্ছে না, জীবনে এর চেয়েও খারাপ পরিস্থিতির মাঝে পড়েছি অনেকবার। ভাবনা শুধু নাবিল ও নাতাশাকে নিয়ে। তবে মনে হলো তারা পুরো ব্যাপারটি বেশ উপভোগ করছে।
বারবার ফোনের দিকে তাকাচ্ছি সময় দেখার জন্য। ড্রাইভার ঘণ্টাখানেকের কথা বললেও সে সময়টি পার হয়ে গেছে অনেক আগেই। জানিনা কতটা সময় অপেক্ষা করতে হবে। আদৌ কি আমরা করদোবা যেতে পারব?
মনে পড়ে গেল লোরকার এ কবিতাটি:
করদোবা, একাকিনী দূর।
কালো ঘোড়া, পূর্ণবৃত্ত চাঁদ
আর জলপাইয়ে ভরেছি পকেট
যদিও পথের দিশা জানি
জানি যেতে পারব না করদোবা।
সমতলভূমি আর বাতাসের চাই
কালো এক ঘোড়া আর রক্তিম চাঁদ
আর মৃত্যু নজরে রেখেছে বরাবর
সে রয়েছে করদোবা দুর্গের গায়ে।
হায়রে, দীর্ঘ এই পথ
হায়রে, আমার তেজি ঘোড়া
আর মৃত্যুও পথ চেয়ে আছে
সে আগে পৌঁছে যাবে করদোবা,
করদোবা, একাকিনী দূর
দূর একাকিনী করদোবা।১
মৃত্যু-ভাবনা এভাবে এসেছে লোরকার চেতনায় বারবার, আর ধরা পড়েছে তাঁর বহু কবিতায়। মনে ঘুরপাক খাচ্ছে লোরকার কবিতার পংক্তি: ‘জানি যেতে পারব না করদোবা’। সামনে যেতে পারব না করদোবা, তাহলে পেছনে ফিরে সেভিয়া যেতে পারব? নাবিল ও নাতাশা ফিরে যেতে চায় না। তাহলে একমাত্র পথ সামনে যাওয়ার, আর তার জন্য করতে হবে অপেক্ষা, জানিনা কতক্ষণ।
অপেক্ষার সময়টি মনে হয় দুঃসহ, আর তখন মনে ভিড় করে দুশ্চিন্তা। মনে পড়ল লোরকার কবিতাটির আরেকটি পংক্তি: ‘আর মৃত্যুও পথ চেয়ে আছে/ সে আগে পৌঁছে যাবে করদোবা’।
ঠিক এ সময় যেন জীবনের বার্তা নিয়ে এল একটি বাস, আমাদের নিয়ে যাবে করদোবা। সবাই চিৎকার করে উঠল ‘ওলে ওলে’ ধ্বনিতে, সাথে হাততালি। আগত বাসটিতে সবাই একে একে উঠলে তা যাত্রা শুরু করল, অবশ্যই করদোবার পথে। আমরা লোরকার অশনি সংকেত পেয়েও সত্যিই কি সেখানে যেতে পারব?
বাসে যেতে যেতে ভাবতে লাগলাম, করদোবাকে নিয়ে লোরকা কেন এমন দুর্ভাবনা করলেন? সেখানে পৌঁছেই হয়তো তার উত্তর পাব।
এ সব ভাবতে ভাবতেই কখন যে পৌঁছে গেলাম করদোবা, মিনারের আলো চোখে পড়তেই তা বুঝতে পারলাম।
রাত হয়ে এসেছে। তাই পাশের রেস্তোরাঁয় খেয়ে হোটেলে চেক ইন করে বিশ্রাম নিতে গেলাম। নাবিল ও নাতাশা বলল, ‘এখনো অনেক সময় আছে। আমরা একটু রাতের শহর দেখে আসি।’
একটু হাঁটতেই চোখের সামনে উজ্জ্বল হয়ে উঠল করদোবার বড় মসজিদ। বিশাল এলাকা, রাস্তা ও ভবনের আলোয় তার চারদিক আলোকিত। সহস্র বছর আগেও কি এ রকম আলোয় আলোকিত ছিল করদোবার রাস্তা? মনে পড়ে গেল লরেন্স অফ অ্যারাবিয়া ছায়াছবির এক দৃশ্যের কথোপকথন:
যুবরাজ ফয়সাল তাঁর ব্রিটিশ সামরিক উপদেষ্টা লরেন্সকে বলছেন: ‘You know, Lieutenant, in the Arab city of Cordoba were two miles of public lighting in the streets when London was a village.’ লরেন্স উত্তর দিলেন, ‘Yes, you were great.’যুবরাজ যোগ করলেন, ‘Nine centuries ago.’
করদোবা ও লন্ডনের রাস্তার বাতির আরেক অর্থ আছে। করদোবা যখন জ্ঞান-বিজ্ঞানের আলো ছড়াচ্ছে, তখন বাকি ইউরোপ ঢাকা পড়ে ছিল অজ্ঞানতার অন্ধকারে। দশম শতাব্দীর স্পেনে তখন চলছে ইউরোপে মুসলিম সভ্যতার স্বর্ণযুগ। সে সময় ইউরোপের বৃহত্তম ও সমৃদ্ধতম নগরী ছিল করদোবা। জ্ঞান-চর্চার অন্যতম সূচক লাইব্রেরি, আর এ নগরীর লাইব্রেরিগুলিতে সংগৃহীত বইয়ের সংখ্যা ছিল প্রায় ৪
সে সময়ের করদোবার কথা ভাবতে ভাবতে বড় মসজিদ এর দেয়ালের চার পাশে ঘুরলাম। ৬০০ ফুট দৈর্ঘ্য ও ৪০০ ফুট প্রস্থের কী বিশাল এলাকা জুড়ে আছে এ ঐতিহাসিক স্থাপনা। পরে সবাই হোটেলে ফিরে গেলাম একটি নাটকীয় দিনের শেষে বিশ্রামের প্রত্যাশায়।
সকালের প্রথম গন্তব্য করদোবার মূল আকর্ষণ এর বড় মসজিদ-‘গ্রেট মস্ক অফ করদোবা’।
সবুজ ছাতা নিয়ে গাইড হোসুয়ে আমাদের জন্য অপেক্ষা করছিল কাছের এক চত্বরে। আমরা যোগ দিতেই ১২ জনের দল নিয়ে বড় মসজিদ এর দিকে চলল। চিরাচরিত নিয়মে তারা ট্যুর শুরু করে ইতিহাস দিয়ে, যা আমার খারাপ না লাগলেও নাবিল ও নাতাশার তা খুব অপছন্দ।
হোসুয়ে শুরু করল, ‘এই সুন্দর স্থাপত্যকে আমরা বলি ‘মেছকিথা’২, বাইরের লোকজন বলে ‘গ্রেট মস্ক অফ করদোবা’, আর এরা বলে ‘মেছকিথা কাথেদ্রাল দে করদোবা’।নামের এই ভিন্নতা তুলে ধরে এর ইতিহাসের বিভিন্ন দৃষ্টিকোণকে, যা আমি সংক্ষেপে বলব।’
একটু থেমে হোসুয়ে আবার বলতে লাগল, ‘করদোবার ইতিহাসের সাথে জড়িয়ে আছে এই মসজিদের ইতিহাস। ৭১১ সালে মুসলিমদের আন্দালুসিয়া বিজয়ের পরে করদোবার সেন্ট ভিনসেন্ট গির্জার অর্ধেক অংশে একটি মসজিদ স্থাপিত হয়। ফলে একই ভবনে খ্রিস্টানরা গির্জায় ও মুসলিমরা মসজিদে প্রার্থনা করতে থাকে। ৭৫৬ সালে প্রথম আবদুর রহমান নিজেকে আমির ঘোষণা করে করদোবাকে তাঁর রাজধানী নির্বাচিত করেন। এ সময় মসজিদে স্থান সংকুলান না হওয়ায় তিনি গির্জার অংশ কিনে নেন। এরপর তা পরিবর্তন করে একটি বড় মসজিদ নির্মাণের কাজ শুরু করেন। ৭৮৬ সালে মসজিদটি নির্মাণের কাজ শেষ হয়। এরপরও হয়েছে এ মসজিদের অনেক পরিবর্তন ও পরিবর্ধন। তবে বাকি ইতিহাস পরে বলব।’
মুডেহার৩ স্থাপত্যের তোরণ পুয়ের্তা দেল পেরতন দিয়ে এরপর পৌঁছলাম বিশাল এক চত্বরে-পেতিও দে লস নারানহোস, অর্থাৎ কমলা বাগানে- অগণন কমলা গাছ, সাথে পাম গাছ ও সাইপ্রেস গাছের সারি। এর মাঝে দুটি ফোয়ারার জল-প্রবাহের নরম শব্দ, কমলা ফুলের মিষ্টি গন্ধ, গাছ ও রোদের আলো-ছায়া- পুরো চত্বরে নিয়ে এসেছে এক ¯িœগ্ধ পবিত্রতা। হোসুয়ে জানাল, ‘মুসলিম যুগে এটি সত্যিই ছিল পবিত্র হবার এক স্থান- মসজিদের প্রবেশ পথে অজু করার জায়গা।’
চত্বর পেরিয়ে এরপর প্রবেশ করলাম দুই খিলান-যুক্ত এক তোরণ ‘পুয়ের্তো দে লা পালমাস’-এ, ভেতরের খিলানটি৮ম শতাব্দীর মূল মসজিদের সময়ের, বাইরেরটি ১০ম শতাব্দীতে নির্মিত।
অবশেষে আসল অনন্য সে স্থাপত্য- কারুকাজ করা খিলান ও থাম-এর অগণন সারি- মনে হয় আদিগন্ত বিস্তৃত। এ ছবি কতবার কত জায়গায় দেখেছি। রিক স্টিভসের স্পেন সফরের গাইড বই কিনেছিলাম, তার প্রচ্ছদে করদোবা মসজিদের এই ছবি। আজ ছবি নয়, তার সামনেই দাঁড়িয়ে, দেখছি চোখ দিয়ে, মন ভরে।
মসজিদের বাইরের জাঁকজমকহীন অবয়ব দেখে বোঝার উপায় ছিল না যে, ভেতরে এত সূক্ষ্ম কারুকাজ দেখতে পাব। এখানে সুন্দরভাবে মিশেছে কয়েকটি স্থাপত্যশৈলী- রোমান, গথিক, বাইজেন্টাইন ও উমায়েদ। অশ্বখুরাকৃতির ছোট খিলানের ওপর গোলাকার বড় খিলান বসানো- তা সবই পরপর লাল ইট ও সাদা পাথর দিয়ে সাজানো। লাল-নীল রঙের থামের ওপর খিলানগুলি ভর করে আছে। মার্বেল, গ্রানাইট, জেসপার ও অনিক্স পাথরে তৈরী এ রকম থাম রয়েছে ৮৫০টি, দেখে মনে হবে এগুলো গুণে শেষ করা যাবে না।
হঠাৎ যেন ছন্দপতন হলো। দুইটি ছোট দেয়ালের মাঝে এক কাঁচের মেঝে, তা দেখিয়ে হোসুয়ে বলল, ‘এখানে নিচে কিছু মোজাইক আছে, যা ভিজিগথদের মূল গির্জার অংশ হিসেবে সংরক্ষিত আছে। সাথে আছে ৬ষ্ট শতাব্দীর সে গির্জার কয়েকটি পাথরখ-। এখানে ইতিহাস বাঁক নিয়েছে বিভিন্ন সময়ে, আর সবকিছু নিজ নিজ ছাপ রেখে গেছে।’
এরপর হলো আরো বড় ছন্দপতন। মসজিদের ঠিক মাঝখানে শুরু হলো গির্জা। এর সাথেও জড়িয়ে আছে করদোবার ইতিহাস। ১২৩৬ সালে রিকনকিস্তার৪ সময় ক্রিস্টানরা করদোবা অধিকার করে নিলে মসজিদটি ক্যাথেড্রালে রূপান্তরিত করা হয়। দু’পাশে মসজিদ অপরিবর্তিত রেখে মাঝখানের অংশে রেনেসাঁ স্থাপত্যের আদলে একটি নতুন গির্জা নির্মাণ করা হয়।
গির্জার কয়েকটি অংশের মধ্যে এর প্রধান বেদি সবার দৃষ্টি আকর্ষণ করল এর অবস্থান, শৈলী ও আয়তনের জন্য। থামের ভিড়ের মাঝে উঠে এসেছে সোনার কাজ করা অপূর্ব এই বেদি। ১৩০ ফিট উঁচু এর সিলিংয়ে সংযোজিত হয়েছে জমকালো সজ্জা এবং উজ্জ্বল আলো।
অনেক পরে, ১৭৫০ সালে,যোগ করা হয়েছে এ গির্জার কয়ার৫- যা নিউ ওয়ার্ল্ড থেকে আনা মেহগনি কাঠ দিয়ে সুদৃশ্যভাবে নির্মিত। এটি ১৮শ’ শতাব্দীর আন্দালুসীয় বারোক৬স্থাপত্যের এক অনন্য নিদর্শন। এর ১০৮টি স্টলের প্রত্যেকটিতে তুলে ধরা হয়েছে বাইবেলের এক একটি দৃশ্য।
এরপর আসল এ মসজিদের সবচেয়ে সুন্দর অংশ মিহরাব।৭১০ম শতাব্দীর মাঝামাঝি সময়ে দ্বিতীয় আল হাকাম এটি নির্মাণ করেন। মোজাইক ও সোনা দিয়ে করা হয়েছে আরবীয় ক্যালিগ্রাফি, রেখাবলি, ফুল-লতা-পাতা ও জ্যামিতিক নকশার কারুকাজ। দেয়াল ও গম্বুজকে সুশোভিত করে আছে রঙ-বেরঙের কাঁচ-এনামেল এর হাজারো টুকরো। ওপরে শোভা পাচ্ছে একটি অপূর্ব নকশাকৃত গম্বুজ, যার ওপর পরস্পরকে খচিত করেছে খিলান, মাঝে মাঝে আছে স্কাইলাইট।
মিহরাব দেখা শেষ হলে হোসুয়ে বলল, ‘এরপর আমরা ফিরে যাব শুরুতে- তোরণ পুয়ের্তা দেল পেরতন ফটকে। ঢুকতেই তোমরা দেখেছ এক মিনার। সবাই এখন তার সামনে যাব।’ সবাই সেখানে জড়ো হলে হোসুয়ে বলল, ‘৯৫৮ সালে তৃতীয় আবদুর রহমান এখানে নির্মাণ করেছিলেন মসজিদের এক মিনার। পরে তার ভিত্তির ওপর নির্মাণ করা হয়েছে গির্জার বেল টাওয়ার। ৫৪ মিটার উঁচু এ টাওয়ারটি করদোবা নগরীর সবচেয়ে উঁচু স্থাপনা, যাতে মিশেছে ইসলামী ও রেনেসাঁ স্থাপত্য শৈলী। করদোবায় রোমান, ভিজগথ, মুসলিম, ইতালীয় রেনেসাঁ, স্পেনীয় রেনেসাঁ৮- এসব ইতিহাস ও স্থাপত্য পরস্পরের সাথে মিশে আছে। এর বড় নিদর্শন ‘গ্রেট মস্ক অফ করদোবা’ তোমরা দেখা শেষ করেছ, এরপরও আরো অনেক কিছু আছে। আশা করি তা তোমরা দেখবে। গুড লাক!’
হোসুয়েকে ধন্যবাদ দিয়ে গ্রেট মস্ক অফ করদোবা-এর ঢালুতে আমরা হেঁটে চলেছি। একটু পরেই পৌঁছি গুয়াদালকিবির নদীর পাড়ে- অনেকক্ষণ হাঁটাহাঁটি করলাম এখানে, নিসর্গের ছোঁয়ায় ইতিহাসের ভার মন থেকে যাতে নেমে যায়।
নাতাশা জিজ্ঞেস করল, ‘এটি কি সেভিয়া-র সেই নদী যার ওপর আমরা রিভার ক্রুজে ছিলাম?’ বললাম, ‘হ্যাঁ, এটিই আমাদের সেই পরিচিত গুয়াদালকিবির নদী।’ নাতাশা কিছুক্ষণ গুগলে দেখল এ নদীর গতিগথ ও তার ইতিহাস, আমাদের জানাল সারাংশ, ‘৪০৮ মাইল লম্বা গুয়াদালকিবির নদীটি বয়ে গেছে শুধু আন্দালুসিয়া অঞ্চলে, নদীটি এখান থেকে সেভিয়া হয়ে গালফ অফ কাদিজে আটলান্টিকে গিয়ে পড়েছে। একসময় করদোবা শহর থেকে নৌ-যানে করে সেভিয়া যাওয়া যেত। এখন সে নাব্য নেই, পলিমাটি তা বিনষ্ট করে দিয়েছে। এখন আটলান্টিক থেকে সেভিয়া পর্যন্ত শুধুমাত্র ৫০ মাইল জলপথে নৌ চলাচল সম্ভব। নদীটির নামের ইতিহাস বেশ মজার। এর উৎপত্তি আরবি শব্দ ‘ওয়াদি আল-কবির’ থেকে, যার অর্থ বড় নদী।’ চমৎকার এক তথ্য, তার জন্য নাতাশাকে ধন্যবাদ দিয়ে অগ্রসর হলাম।
পুয়েন্তে রোমানো দিয়ে পার হলাম গুয়াদালকিবির নদী। এটি এ নদীর ওপর তৈরি প্রথম সেতু, ১ম শতাব্দীতে যার ভিত্তি স্থাপন করে রোমানরা, পরে মুসলিমরা ১৬টি তোরণ-শ্রেণি দিয়ে একে করে সুশোভিত, সুরক্ষিত। বিভিন্ন সময়ে এর হয়েছে বহু সংস্কার ও পরিবর্তন।
গুয়াদালকিবির নদীর ওপার থেকে দেখলাম গ্রেট মস্ক অফ করদোবা, আর করদোবার প্রাচীন শহরকে। সাথে দেখলাম গুয়াদালকিবির নদী ও এর জলে পড়া পুয়েন্তে রোমানোর ছায়া। মনে হলো ইতিহাসের পেছনের কোনো এক সময়ে চলে গেছি। অপূর্ব এক ছবি, নিগূঢ় এক অনুভূতি। এই ছবি দেখতে ও নদীর হাওয়া খেতে এখানে হাজারো মানুষের ভিড়।
এরপর ঠিক করলাম ‘আলকাছার’দুর্গ দেখতে যাব। নাবিল বলে উঠল, “আলকাছার দেখেছি গ্রানাদা, মালাগা, তরিফা ও সেভিয়া-য়। সবই দেখতে একই রকম বোরিং। এটি আর দেখতে চাই না।” বললাম, ‘ঠিক আছে, ‘আলকাছার’-এ আর যাব না। তবে যেতে চাই একটি বিশেষ স্থানে, তা হলো-‘মুজেও ভিভো দে আল-আন্দালুস’- আন্দালুসিয়া-র ইতিহাস ও ঐতিহ্যের অন্যতম সেরা যাদুঘর।’ এবার নাতাশা বলল, ‘মিউজিয়মে যেয়ে আন্দালুসিয়া দেখার আর কি দরকার আছে? আমরা দু’সপ্তাহ ধরে আন্দালুসিয়া ঘুরছি, গ্রানাদা ও সেভিয়া দেখে এখন এর তিনটি শীর্ষের শেষ বিন্দু করদোবা দেখছি। মনে হচ্ছে যুগ যুগ ধরে আন্দালুসিয়ার ভেতরে ঘুরপাক খাচ্ছি, এখান থেকে বের হওয়া যাবে না, এটি এক গোলকধাঁধা।’
মনে পড়ল লোরকার কবিতা, যেখানে ফুটে উঠেছে আন্দালুসিয়ার জীবনের কষ্ট, জটিলতা ও অনিশ্চয়তা এবং তা থেকে মুক্তি পেতে মানুষের চিরন্তন সংগ্রামের কথা:
পথ ধরে নিচু কমলাবীথির
দিকসীমায়,
শোকার্ত শত ঘোড়সওয়ারেরা
যাবে কোথায়?
যেতে পারবে না তারা সেভিয়ায়
কর্দোবায়,
গ্রানাদায়ও নয় সিন্ধুকাতর
যে দিনমান।
ক্রুশচিহ্নের গোলকধাঁধায়
যেখানে গান
কেঁপে কেঁপে ওঠে, তন্দ্রাবিধুর
ঘোড়ারা তাদের নেবে তত দূর।
কমলাবীথির আন্দালুসীয়
শত ঘোড়ায়
কাঁটাগাঁথা সাত শোক নিয়ে তারা
যাবে কোথায়?৯
আন্দালুসিয়ার জন্য আমাদের রয়েছে শোক নয়, সহমর্মিতা।
Ref:
Cancion de jinete, ঘোড়সওয়ারের গান,অনুবাদ: আব্দুল্লাহ আল মুক্তাদির
স্পেনীয় শব্দ ‘মেছকিথা ’ অর্থ হলো ‘মসজিদ’।
মুদেহার স্থাপত্য হচ্ছে ইসলামী ও খ্রিস্টান শৈলীর মিশ্রণে স্পেনে বিকশিত এক স্থাপত্যশৈলী।
রিকনকিস্তাদ্বারা ইবেরীয় উপদ্বীপে ৭১১ সালে মুসলিমদের স্পেন জয় থেকে শুরু করে ১৪৯২ সালে গ্রানাদা-র পতন পর্যন্ত ৭৮১ বছরের সময়কালকে বোঝানো হয়।
কয়ার হচ্ছে গির্জার ঐকতান সঙ্গীতের গায়কদলের জন্য নির্ধারিত স্থান।
বারোক হলো শিল্পকলা, স্থাপত্য ও সঙ্গীতে ব্যবহৃত এক অলংকৃত ও বিস্তৃত শৈলী।
মিহরাব, মসজিদের অগ্রভাগে একটি খিলানযুক্ত অংশ, যা কিবলা, অর্থাৎ মক্কার কাবার দিক নির্দেশ করে।
স্পেনীয় রেনেসাঁছিল ১৪শ শতাব্দীতে ইতালিতে শুরু হওয়া একটি ইতালীয় রেনেসাঁর সম্প্রসারণ, যা ১৫শ’ ও ১৬শ’ শতাব্দীতে স্পেনে ছড়িয়ে পড়ে। এটি স্পেনের স্বর্ণযুগ (Siglo de Oro) নামেও পরিচিত। সে সময়ে স্পেনের শিল্পকলা, সাহিত্য এবং সংস্কৃতির ব্যাপক বিকাশ ঘটে।
Camino, পথ,অনুবাদ: সাজ্জাদ শরিফ
ইপেপার
জাতীয়
সারাদেশ
আন্তর্জাতিক
নগর-মহানগর
খেলা
বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি
শিক্ষা
অর্থ-বাণিজ্য
সংস্কৃতি
ক্যাম্পাস
মিডিয়া
অপরাধ ও দুর্নীতি
রাজনীতি
শোক ও স্মরন
প্রবাস
নারীর প্রতি সহিংসতা
বিনোদন
সম্পাদকীয়
উপ-সম্পাদকীয়
মুক্ত আলোচনা
চিঠিপত্র
পাঠকের চিঠি
ধারাবাহিক ভ্রমণ কাহিনী-২০
চৌধুরী সালাহউদ্দীন মাহমুদ
বৃহস্পতিবার, ০৪ ডিসেম্বর ২০২৫
(পূর্ব প্রকাশের পর)
পড়ন্ত বিকেলের বিষণœতায় সেভিয়া ছেড়ে চললাম আন্দালুসিয়া ত্রিভুজের শেষ শীর্ষবিন্দুর পথে।
‘আপনাদের যাত্রা শুভ হোক! বাসটি দুই ঘণ্টার মধ্যে করদোবা পৌঁছবে। মাঝখানে থামবে ১৫ মিনিটের জন্য এক রেস্তোরাঁয়। আশা করছি, এ বাস ভ্রমণটি রোমাঞ্চকর হবে।’ এই বলে বাসের সহকারী অরতিজ মৃদু হেসে সবাইকে অভিবাদন করল।
শহর পাড়ি দিতেই শুরু হলো সেই পরিচিত ছবি- জলপাই ও কমলা বাগান, পরে যোগ দিল সূর্যমুখী ফুলের বাগান। ঢেউ খেলানো ভূমিকে রাঙিয়ে দিয়েছে পাকা ফসলের ধূসর, কমলা ও হলুদ রঙ- এ যেন তাদের বিদায়বেলার নিবেদন, যেমন বলেছেন কবিগুরু: ‘রাঙিয়ে দিয়ে যাও গো এবার যাবার আগে’। ‘লা কেমপানিয়া’ নামে পরিচিত উঁচু-নিচু মায়াবী সুন্দর এ পথটুকু দেখতে দেখতে আমরা চললাম।
ভাবি, ‘এ পথ যদি না শেষ হয়’। দুই ঘণ্টার পথ, দেখতে দেখতে পার হয়ে যাবে। তবে এ পথটি যে তাড়াতাড়ি শেষ হবে না, তা ভাবতেই পারিনি।
ঘণ্টাখানেক চলার পর এক বিকট শব্দ করে বাস থেমে গেল আস্তে আস্তে। ড্রাইভার বলল, ‘চিন্তার কিছু নেই, এ তেমন কিছু নয়, একটি চাকা ফেটে গেছে। আমাদের দফতরে ফোন করে দিচ্ছি, যাতে তারা বিকল্প ব্যবস্থা করতে পারে।’
স্পেন ভ্রমণে কোনো অসুবিধের মুখোমুখি হলাম এই প্রথম। জীবন এ রকমই, যে কোনো পরিস্থিতি হতে পারে যে কোনো জায়গায়, যে কোনো সময়। দেখা যাক কী হয়।
ড্রাইভার দেখি ফোনে কথা বলছে তো বলছেই, শেষ হচ্ছে না। পরে বলল, ‘তোমাদের অসুবিধের জন্য দুঃখিত। চাকাটি এখানে মেরামত করা যাবে না। সেভিয়া থেকে ঘণ্টাখানেকের মধ্যে আরেকটি বাস আসবে সবাইকে করদোবা নিয়ে যেতে।’
চারিদিকে বিষণœতার ভাব বাড়িয়ে নেমে এল সন্ধ্যা। একটা উদ্বেগ ভর করেছে মনে, যেন নীল আকাশের ওপর ভেসে থাকা এক ধূসর মেঘ। এ জায়গাটি লোকালয় থেকে দূরে, আশেপাশে কমলা বাগান ছাড়া আর কিছু নেই। নিজের জন্য ভাবনা হচ্ছে না, জীবনে এর চেয়েও খারাপ পরিস্থিতির মাঝে পড়েছি অনেকবার। ভাবনা শুধু নাবিল ও নাতাশাকে নিয়ে। তবে মনে হলো তারা পুরো ব্যাপারটি বেশ উপভোগ করছে।
বারবার ফোনের দিকে তাকাচ্ছি সময় দেখার জন্য। ড্রাইভার ঘণ্টাখানেকের কথা বললেও সে সময়টি পার হয়ে গেছে অনেক আগেই। জানিনা কতটা সময় অপেক্ষা করতে হবে। আদৌ কি আমরা করদোবা যেতে পারব?
মনে পড়ে গেল লোরকার এ কবিতাটি:
করদোবা, একাকিনী দূর।
কালো ঘোড়া, পূর্ণবৃত্ত চাঁদ
আর জলপাইয়ে ভরেছি পকেট
যদিও পথের দিশা জানি
জানি যেতে পারব না করদোবা।
সমতলভূমি আর বাতাসের চাই
কালো এক ঘোড়া আর রক্তিম চাঁদ
আর মৃত্যু নজরে রেখেছে বরাবর
সে রয়েছে করদোবা দুর্গের গায়ে।
হায়রে, দীর্ঘ এই পথ
হায়রে, আমার তেজি ঘোড়া
আর মৃত্যুও পথ চেয়ে আছে
সে আগে পৌঁছে যাবে করদোবা,
করদোবা, একাকিনী দূর
দূর একাকিনী করদোবা।১
মৃত্যু-ভাবনা এভাবে এসেছে লোরকার চেতনায় বারবার, আর ধরা পড়েছে তাঁর বহু কবিতায়। মনে ঘুরপাক খাচ্ছে লোরকার কবিতার পংক্তি: ‘জানি যেতে পারব না করদোবা’। সামনে যেতে পারব না করদোবা, তাহলে পেছনে ফিরে সেভিয়া যেতে পারব? নাবিল ও নাতাশা ফিরে যেতে চায় না। তাহলে একমাত্র পথ সামনে যাওয়ার, আর তার জন্য করতে হবে অপেক্ষা, জানিনা কতক্ষণ।
অপেক্ষার সময়টি মনে হয় দুঃসহ, আর তখন মনে ভিড় করে দুশ্চিন্তা। মনে পড়ল লোরকার কবিতাটির আরেকটি পংক্তি: ‘আর মৃত্যুও পথ চেয়ে আছে/ সে আগে পৌঁছে যাবে করদোবা’।
ঠিক এ সময় যেন জীবনের বার্তা নিয়ে এল একটি বাস, আমাদের নিয়ে যাবে করদোবা। সবাই চিৎকার করে উঠল ‘ওলে ওলে’ ধ্বনিতে, সাথে হাততালি। আগত বাসটিতে সবাই একে একে উঠলে তা যাত্রা শুরু করল, অবশ্যই করদোবার পথে। আমরা লোরকার অশনি সংকেত পেয়েও সত্যিই কি সেখানে যেতে পারব?
বাসে যেতে যেতে ভাবতে লাগলাম, করদোবাকে নিয়ে লোরকা কেন এমন দুর্ভাবনা করলেন? সেখানে পৌঁছেই হয়তো তার উত্তর পাব।
এ সব ভাবতে ভাবতেই কখন যে পৌঁছে গেলাম করদোবা, মিনারের আলো চোখে পড়তেই তা বুঝতে পারলাম।
রাত হয়ে এসেছে। তাই পাশের রেস্তোরাঁয় খেয়ে হোটেলে চেক ইন করে বিশ্রাম নিতে গেলাম। নাবিল ও নাতাশা বলল, ‘এখনো অনেক সময় আছে। আমরা একটু রাতের শহর দেখে আসি।’
একটু হাঁটতেই চোখের সামনে উজ্জ্বল হয়ে উঠল করদোবার বড় মসজিদ। বিশাল এলাকা, রাস্তা ও ভবনের আলোয় তার চারদিক আলোকিত। সহস্র বছর আগেও কি এ রকম আলোয় আলোকিত ছিল করদোবার রাস্তা? মনে পড়ে গেল লরেন্স অফ অ্যারাবিয়া ছায়াছবির এক দৃশ্যের কথোপকথন:
যুবরাজ ফয়সাল তাঁর ব্রিটিশ সামরিক উপদেষ্টা লরেন্সকে বলছেন: ‘You know, Lieutenant, in the Arab city of Cordoba were two miles of public lighting in the streets when London was a village.’ লরেন্স উত্তর দিলেন, ‘Yes, you were great.’যুবরাজ যোগ করলেন, ‘Nine centuries ago.’
করদোবা ও লন্ডনের রাস্তার বাতির আরেক অর্থ আছে। করদোবা যখন জ্ঞান-বিজ্ঞানের আলো ছড়াচ্ছে, তখন বাকি ইউরোপ ঢাকা পড়ে ছিল অজ্ঞানতার অন্ধকারে। দশম শতাব্দীর স্পেনে তখন চলছে ইউরোপে মুসলিম সভ্যতার স্বর্ণযুগ। সে সময় ইউরোপের বৃহত্তম ও সমৃদ্ধতম নগরী ছিল করদোবা। জ্ঞান-চর্চার অন্যতম সূচক লাইব্রেরি, আর এ নগরীর লাইব্রেরিগুলিতে সংগৃহীত বইয়ের সংখ্যা ছিল প্রায় ৪
সে সময়ের করদোবার কথা ভাবতে ভাবতে বড় মসজিদ এর দেয়ালের চার পাশে ঘুরলাম। ৬০০ ফুট দৈর্ঘ্য ও ৪০০ ফুট প্রস্থের কী বিশাল এলাকা জুড়ে আছে এ ঐতিহাসিক স্থাপনা। পরে সবাই হোটেলে ফিরে গেলাম একটি নাটকীয় দিনের শেষে বিশ্রামের প্রত্যাশায়।
সকালের প্রথম গন্তব্য করদোবার মূল আকর্ষণ এর বড় মসজিদ-‘গ্রেট মস্ক অফ করদোবা’।
সবুজ ছাতা নিয়ে গাইড হোসুয়ে আমাদের জন্য অপেক্ষা করছিল কাছের এক চত্বরে। আমরা যোগ দিতেই ১২ জনের দল নিয়ে বড় মসজিদ এর দিকে চলল। চিরাচরিত নিয়মে তারা ট্যুর শুরু করে ইতিহাস দিয়ে, যা আমার খারাপ না লাগলেও নাবিল ও নাতাশার তা খুব অপছন্দ।
হোসুয়ে শুরু করল, ‘এই সুন্দর স্থাপত্যকে আমরা বলি ‘মেছকিথা’২, বাইরের লোকজন বলে ‘গ্রেট মস্ক অফ করদোবা’, আর এরা বলে ‘মেছকিথা কাথেদ্রাল দে করদোবা’।নামের এই ভিন্নতা তুলে ধরে এর ইতিহাসের বিভিন্ন দৃষ্টিকোণকে, যা আমি সংক্ষেপে বলব।’
একটু থেমে হোসুয়ে আবার বলতে লাগল, ‘করদোবার ইতিহাসের সাথে জড়িয়ে আছে এই মসজিদের ইতিহাস। ৭১১ সালে মুসলিমদের আন্দালুসিয়া বিজয়ের পরে করদোবার সেন্ট ভিনসেন্ট গির্জার অর্ধেক অংশে একটি মসজিদ স্থাপিত হয়। ফলে একই ভবনে খ্রিস্টানরা গির্জায় ও মুসলিমরা মসজিদে প্রার্থনা করতে থাকে। ৭৫৬ সালে প্রথম আবদুর রহমান নিজেকে আমির ঘোষণা করে করদোবাকে তাঁর রাজধানী নির্বাচিত করেন। এ সময় মসজিদে স্থান সংকুলান না হওয়ায় তিনি গির্জার অংশ কিনে নেন। এরপর তা পরিবর্তন করে একটি বড় মসজিদ নির্মাণের কাজ শুরু করেন। ৭৮৬ সালে মসজিদটি নির্মাণের কাজ শেষ হয়। এরপরও হয়েছে এ মসজিদের অনেক পরিবর্তন ও পরিবর্ধন। তবে বাকি ইতিহাস পরে বলব।’
মুডেহার৩ স্থাপত্যের তোরণ পুয়ের্তা দেল পেরতন দিয়ে এরপর পৌঁছলাম বিশাল এক চত্বরে-পেতিও দে লস নারানহোস, অর্থাৎ কমলা বাগানে- অগণন কমলা গাছ, সাথে পাম গাছ ও সাইপ্রেস গাছের সারি। এর মাঝে দুটি ফোয়ারার জল-প্রবাহের নরম শব্দ, কমলা ফুলের মিষ্টি গন্ধ, গাছ ও রোদের আলো-ছায়া- পুরো চত্বরে নিয়ে এসেছে এক ¯িœগ্ধ পবিত্রতা। হোসুয়ে জানাল, ‘মুসলিম যুগে এটি সত্যিই ছিল পবিত্র হবার এক স্থান- মসজিদের প্রবেশ পথে অজু করার জায়গা।’
চত্বর পেরিয়ে এরপর প্রবেশ করলাম দুই খিলান-যুক্ত এক তোরণ ‘পুয়ের্তো দে লা পালমাস’-এ, ভেতরের খিলানটি৮ম শতাব্দীর মূল মসজিদের সময়ের, বাইরেরটি ১০ম শতাব্দীতে নির্মিত।
অবশেষে আসল অনন্য সে স্থাপত্য- কারুকাজ করা খিলান ও থাম-এর অগণন সারি- মনে হয় আদিগন্ত বিস্তৃত। এ ছবি কতবার কত জায়গায় দেখেছি। রিক স্টিভসের স্পেন সফরের গাইড বই কিনেছিলাম, তার প্রচ্ছদে করদোবা মসজিদের এই ছবি। আজ ছবি নয়, তার সামনেই দাঁড়িয়ে, দেখছি চোখ দিয়ে, মন ভরে।
মসজিদের বাইরের জাঁকজমকহীন অবয়ব দেখে বোঝার উপায় ছিল না যে, ভেতরে এত সূক্ষ্ম কারুকাজ দেখতে পাব। এখানে সুন্দরভাবে মিশেছে কয়েকটি স্থাপত্যশৈলী- রোমান, গথিক, বাইজেন্টাইন ও উমায়েদ। অশ্বখুরাকৃতির ছোট খিলানের ওপর গোলাকার বড় খিলান বসানো- তা সবই পরপর লাল ইট ও সাদা পাথর দিয়ে সাজানো। লাল-নীল রঙের থামের ওপর খিলানগুলি ভর করে আছে। মার্বেল, গ্রানাইট, জেসপার ও অনিক্স পাথরে তৈরী এ রকম থাম রয়েছে ৮৫০টি, দেখে মনে হবে এগুলো গুণে শেষ করা যাবে না।
হঠাৎ যেন ছন্দপতন হলো। দুইটি ছোট দেয়ালের মাঝে এক কাঁচের মেঝে, তা দেখিয়ে হোসুয়ে বলল, ‘এখানে নিচে কিছু মোজাইক আছে, যা ভিজিগথদের মূল গির্জার অংশ হিসেবে সংরক্ষিত আছে। সাথে আছে ৬ষ্ট শতাব্দীর সে গির্জার কয়েকটি পাথরখ-। এখানে ইতিহাস বাঁক নিয়েছে বিভিন্ন সময়ে, আর সবকিছু নিজ নিজ ছাপ রেখে গেছে।’
এরপর হলো আরো বড় ছন্দপতন। মসজিদের ঠিক মাঝখানে শুরু হলো গির্জা। এর সাথেও জড়িয়ে আছে করদোবার ইতিহাস। ১২৩৬ সালে রিকনকিস্তার৪ সময় ক্রিস্টানরা করদোবা অধিকার করে নিলে মসজিদটি ক্যাথেড্রালে রূপান্তরিত করা হয়। দু’পাশে মসজিদ অপরিবর্তিত রেখে মাঝখানের অংশে রেনেসাঁ স্থাপত্যের আদলে একটি নতুন গির্জা নির্মাণ করা হয়।
গির্জার কয়েকটি অংশের মধ্যে এর প্রধান বেদি সবার দৃষ্টি আকর্ষণ করল এর অবস্থান, শৈলী ও আয়তনের জন্য। থামের ভিড়ের মাঝে উঠে এসেছে সোনার কাজ করা অপূর্ব এই বেদি। ১৩০ ফিট উঁচু এর সিলিংয়ে সংযোজিত হয়েছে জমকালো সজ্জা এবং উজ্জ্বল আলো।
অনেক পরে, ১৭৫০ সালে,যোগ করা হয়েছে এ গির্জার কয়ার৫- যা নিউ ওয়ার্ল্ড থেকে আনা মেহগনি কাঠ দিয়ে সুদৃশ্যভাবে নির্মিত। এটি ১৮শ’ শতাব্দীর আন্দালুসীয় বারোক৬স্থাপত্যের এক অনন্য নিদর্শন। এর ১০৮টি স্টলের প্রত্যেকটিতে তুলে ধরা হয়েছে বাইবেলের এক একটি দৃশ্য।
এরপর আসল এ মসজিদের সবচেয়ে সুন্দর অংশ মিহরাব।৭১০ম শতাব্দীর মাঝামাঝি সময়ে দ্বিতীয় আল হাকাম এটি নির্মাণ করেন। মোজাইক ও সোনা দিয়ে করা হয়েছে আরবীয় ক্যালিগ্রাফি, রেখাবলি, ফুল-লতা-পাতা ও জ্যামিতিক নকশার কারুকাজ। দেয়াল ও গম্বুজকে সুশোভিত করে আছে রঙ-বেরঙের কাঁচ-এনামেল এর হাজারো টুকরো। ওপরে শোভা পাচ্ছে একটি অপূর্ব নকশাকৃত গম্বুজ, যার ওপর পরস্পরকে খচিত করেছে খিলান, মাঝে মাঝে আছে স্কাইলাইট।
মিহরাব দেখা শেষ হলে হোসুয়ে বলল, ‘এরপর আমরা ফিরে যাব শুরুতে- তোরণ পুয়ের্তা দেল পেরতন ফটকে। ঢুকতেই তোমরা দেখেছ এক মিনার। সবাই এখন তার সামনে যাব।’ সবাই সেখানে জড়ো হলে হোসুয়ে বলল, ‘৯৫৮ সালে তৃতীয় আবদুর রহমান এখানে নির্মাণ করেছিলেন মসজিদের এক মিনার। পরে তার ভিত্তির ওপর নির্মাণ করা হয়েছে গির্জার বেল টাওয়ার। ৫৪ মিটার উঁচু এ টাওয়ারটি করদোবা নগরীর সবচেয়ে উঁচু স্থাপনা, যাতে মিশেছে ইসলামী ও রেনেসাঁ স্থাপত্য শৈলী। করদোবায় রোমান, ভিজগথ, মুসলিম, ইতালীয় রেনেসাঁ, স্পেনীয় রেনেসাঁ৮- এসব ইতিহাস ও স্থাপত্য পরস্পরের সাথে মিশে আছে। এর বড় নিদর্শন ‘গ্রেট মস্ক অফ করদোবা’ তোমরা দেখা শেষ করেছ, এরপরও আরো অনেক কিছু আছে। আশা করি তা তোমরা দেখবে। গুড লাক!’
হোসুয়েকে ধন্যবাদ দিয়ে গ্রেট মস্ক অফ করদোবা-এর ঢালুতে আমরা হেঁটে চলেছি। একটু পরেই পৌঁছি গুয়াদালকিবির নদীর পাড়ে- অনেকক্ষণ হাঁটাহাঁটি করলাম এখানে, নিসর্গের ছোঁয়ায় ইতিহাসের ভার মন থেকে যাতে নেমে যায়।
নাতাশা জিজ্ঞেস করল, ‘এটি কি সেভিয়া-র সেই নদী যার ওপর আমরা রিভার ক্রুজে ছিলাম?’ বললাম, ‘হ্যাঁ, এটিই আমাদের সেই পরিচিত গুয়াদালকিবির নদী।’ নাতাশা কিছুক্ষণ গুগলে দেখল এ নদীর গতিগথ ও তার ইতিহাস, আমাদের জানাল সারাংশ, ‘৪০৮ মাইল লম্বা গুয়াদালকিবির নদীটি বয়ে গেছে শুধু আন্দালুসিয়া অঞ্চলে, নদীটি এখান থেকে সেভিয়া হয়ে গালফ অফ কাদিজে আটলান্টিকে গিয়ে পড়েছে। একসময় করদোবা শহর থেকে নৌ-যানে করে সেভিয়া যাওয়া যেত। এখন সে নাব্য নেই, পলিমাটি তা বিনষ্ট করে দিয়েছে। এখন আটলান্টিক থেকে সেভিয়া পর্যন্ত শুধুমাত্র ৫০ মাইল জলপথে নৌ চলাচল সম্ভব। নদীটির নামের ইতিহাস বেশ মজার। এর উৎপত্তি আরবি শব্দ ‘ওয়াদি আল-কবির’ থেকে, যার অর্থ বড় নদী।’ চমৎকার এক তথ্য, তার জন্য নাতাশাকে ধন্যবাদ দিয়ে অগ্রসর হলাম।
পুয়েন্তে রোমানো দিয়ে পার হলাম গুয়াদালকিবির নদী। এটি এ নদীর ওপর তৈরি প্রথম সেতু, ১ম শতাব্দীতে যার ভিত্তি স্থাপন করে রোমানরা, পরে মুসলিমরা ১৬টি তোরণ-শ্রেণি দিয়ে একে করে সুশোভিত, সুরক্ষিত। বিভিন্ন সময়ে এর হয়েছে বহু সংস্কার ও পরিবর্তন।
গুয়াদালকিবির নদীর ওপার থেকে দেখলাম গ্রেট মস্ক অফ করদোবা, আর করদোবার প্রাচীন শহরকে। সাথে দেখলাম গুয়াদালকিবির নদী ও এর জলে পড়া পুয়েন্তে রোমানোর ছায়া। মনে হলো ইতিহাসের পেছনের কোনো এক সময়ে চলে গেছি। অপূর্ব এক ছবি, নিগূঢ় এক অনুভূতি। এই ছবি দেখতে ও নদীর হাওয়া খেতে এখানে হাজারো মানুষের ভিড়।
এরপর ঠিক করলাম ‘আলকাছার’দুর্গ দেখতে যাব। নাবিল বলে উঠল, “আলকাছার দেখেছি গ্রানাদা, মালাগা, তরিফা ও সেভিয়া-য়। সবই দেখতে একই রকম বোরিং। এটি আর দেখতে চাই না।” বললাম, ‘ঠিক আছে, ‘আলকাছার’-এ আর যাব না। তবে যেতে চাই একটি বিশেষ স্থানে, তা হলো-‘মুজেও ভিভো দে আল-আন্দালুস’- আন্দালুসিয়া-র ইতিহাস ও ঐতিহ্যের অন্যতম সেরা যাদুঘর।’ এবার নাতাশা বলল, ‘মিউজিয়মে যেয়ে আন্দালুসিয়া দেখার আর কি দরকার আছে? আমরা দু’সপ্তাহ ধরে আন্দালুসিয়া ঘুরছি, গ্রানাদা ও সেভিয়া দেখে এখন এর তিনটি শীর্ষের শেষ বিন্দু করদোবা দেখছি। মনে হচ্ছে যুগ যুগ ধরে আন্দালুসিয়ার ভেতরে ঘুরপাক খাচ্ছি, এখান থেকে বের হওয়া যাবে না, এটি এক গোলকধাঁধা।’
মনে পড়ল লোরকার কবিতা, যেখানে ফুটে উঠেছে আন্দালুসিয়ার জীবনের কষ্ট, জটিলতা ও অনিশ্চয়তা এবং তা থেকে মুক্তি পেতে মানুষের চিরন্তন সংগ্রামের কথা:
পথ ধরে নিচু কমলাবীথির
দিকসীমায়,
শোকার্ত শত ঘোড়সওয়ারেরা
যাবে কোথায়?
যেতে পারবে না তারা সেভিয়ায়
কর্দোবায়,
গ্রানাদায়ও নয় সিন্ধুকাতর
যে দিনমান।
ক্রুশচিহ্নের গোলকধাঁধায়
যেখানে গান
কেঁপে কেঁপে ওঠে, তন্দ্রাবিধুর
ঘোড়ারা তাদের নেবে তত দূর।
কমলাবীথির আন্দালুসীয়
শত ঘোড়ায়
কাঁটাগাঁথা সাত শোক নিয়ে তারা
যাবে কোথায়?৯
আন্দালুসিয়ার জন্য আমাদের রয়েছে শোক নয়, সহমর্মিতা।
Ref:
Cancion de jinete, ঘোড়সওয়ারের গান,অনুবাদ: আব্দুল্লাহ আল মুক্তাদির
স্পেনীয় শব্দ ‘মেছকিথা ’ অর্থ হলো ‘মসজিদ’।
মুদেহার স্থাপত্য হচ্ছে ইসলামী ও খ্রিস্টান শৈলীর মিশ্রণে স্পেনে বিকশিত এক স্থাপত্যশৈলী।
রিকনকিস্তাদ্বারা ইবেরীয় উপদ্বীপে ৭১১ সালে মুসলিমদের স্পেন জয় থেকে শুরু করে ১৪৯২ সালে গ্রানাদা-র পতন পর্যন্ত ৭৮১ বছরের সময়কালকে বোঝানো হয়।
কয়ার হচ্ছে গির্জার ঐকতান সঙ্গীতের গায়কদলের জন্য নির্ধারিত স্থান।
বারোক হলো শিল্পকলা, স্থাপত্য ও সঙ্গীতে ব্যবহৃত এক অলংকৃত ও বিস্তৃত শৈলী।
মিহরাব, মসজিদের অগ্রভাগে একটি খিলানযুক্ত অংশ, যা কিবলা, অর্থাৎ মক্কার কাবার দিক নির্দেশ করে।
স্পেনীয় রেনেসাঁছিল ১৪শ শতাব্দীতে ইতালিতে শুরু হওয়া একটি ইতালীয় রেনেসাঁর সম্প্রসারণ, যা ১৫শ’ ও ১৬শ’ শতাব্দীতে স্পেনে ছড়িয়ে পড়ে। এটি স্পেনের স্বর্ণযুগ (Siglo de Oro) নামেও পরিচিত। সে সময়ে স্পেনের শিল্পকলা, সাহিত্য এবং সংস্কৃতির ব্যাপক বিকাশ ঘটে।
Camino, পথ,অনুবাদ: সাজ্জাদ শরিফ