হোসেন আবদুল মান্নান
শিল্পী : সঞ্জয় দে রিপন
ঘটনাটা একদিনের নয়। অন্তত বছর দুই ধরে জাওয়াদের মাথার ভেতরে নাগরদোলার মতন উপরে নিচে করে ঘুরছিল। তার আচার-আচরণ, চলাফেরা, কথাবার্তা কেমন যেনো উল্টাপাল্টা মনে হয়েছিল। তবে বেশি বোঝা যেত, যখন কয়েকজন একত্রে বসে আড্ডা বা গল্পগুজব করতো। তখনই চোখে পড়তো তার ভেতরের অস্থিরতা আর যন্ত্রণার বহিঃপ্রকাশ। সিরিয়াস কোনো আলোচনা কালেও সে এমন সব উদ্ভট কথা বলে বসত, শুনে সবাই হা করে থাকতো। সবচেয়ে আজগুবি লাগত তার সন্দেহের তালিকা দেখে- যা ক্রমাগত প্রলম্বিত হতেই থাকে। দিনদিন চেনা-জানা স্বজন, শুভাকাক্সক্ষী, বন্ধু, সহপাঠী এমনকি পিতা-মাতা, ভাইবোন সকলকেই সে সন্দেহের তালিকাভুক্ত করেছিল। একেকজন পরিচিত মানুষ মাত্রই যেনো তারা একজন আততায়ী। হঠাৎ করে রাস্তায় পরিচিত কারও সঙ্গে দেখা হলে, জাওয়াদ বিচলিতবোধ করতো, অপ্রস্তুত হয়ে জিজ্ঞেস করতো, আপনার কাজ যেনো কী? ব্যাগে কিছু আছে? ছোরা বা ডেগার জাতীয়? আমাকে মারবেন? আপনার চোখ এত লাল যে! ইত্যাদি উদ্ভট সব প্রশ্ন। তখন কেউ কেউ কিছু মনে না করলেও, দু’একজন ভাবত- ছেলেটা তো আগে এমন ছিল না! তার কী হলো? উচ্চ শিক্ষিত, ভদ্র, অমায়িক মানুষটার হঠাৎ এ কী পরিণতি হলো?
জাওয়াদ করিম খান। এটাই ভালো নাম। সার্টিফিকেট মতে পারিবারিক নাম যেমন হয়। স্কুল কলেজে বৃত্তিধারী, মেধাবী ছাত্র, গ্রামে নামডাক আছে। সে একদিন মধ্যবিত্তের শ্রেণিচরিত্র ধারণ করে পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের সর্বোচ্চ ডিগ্রি গ্রহণ করে। সেখানেই বাম ঘরানার ছাত্র রাজনীতিতে ওতোপ্রোত জড়িয়ে যায়। মাথাভরা বিপ্লব, সমাজতন্ত্র, সর্বহারার পক্ষে কর্মযোগ ইত্যাদি করে শেষে মফস্বল শহরের বেসরকারি কলেজের চাকরিতে সাময়িক থিতু হওয়া; শ্রেণিকক্ষে রাজনীতির অনুপ্রবেশ ঘটে, লবিং গ্রুপিং, দলবাজি নানাবিধ অভিযোগ মাথায় নিয়ে বারবার চাকরিচ্যুতি, একসময় আসে না চাকরি না রাজনীতি; এমন একটা ছন্নছাড়া দুঃসময়ের মুখোমুখি হয়েছিল জাওয়াদ করিম। বড়ো লোক আত্মীয়-স্বজন, সুজনের অভাব ছিলনা তার। ভেতরের চাপা অহংকার আর আত্মসম্মান বোধের প্রবল জাঁতাকলে পড়ে সে মুষড়ে গিয়েছিল। অব্যক্ত কষ্ট, অদৃশ্য অপ্রাপ্তি তাকে তুষের আগুনের মতো নিভৃতে পুড়িয়ে ফেলেছিল।
দুই.
একদিন ভোরবেলায় দিনের প্রথম ট্রেনে চড়ে ব্রাহ্মণবাড়িয়া থেকে সোজা ঢাকায় চলে আসে অধ্যাপক জাওয়াদ করিম খান। কাউকে না জানিয়ে অনেকটা পালিয়ে আসার মতন ব্যাপার। আজকাল সে পলায়নপর জীবনে অভ্যস্ত হয়ে গেছে। আগের দিন তাকে নিয়ে সেখানকার কলেজে প্রচ- হট্টগোল বেঁধে যায়। কলেজের সমবয়সী বা জ্যেষ্ঠ কলিগরা ক্রমাগত তার শত্রু হতে থাকে। শুরুতে যাঁরা বন্ধু হয়েছিল তারাও এখন প্রকাশ্যে বৈরিতা করছে। তাকে যথাসম্ভব এড়িয়ে চলছে। যদিও এই পরিস্থিতির জন্য অন্যদের চেয়ে তার অপরাধই অধিক। তার প্রধানতম অপরাধ হলো, সকলকে সন্দেহের চোখে দেখা। সবাই নাকি তাকে হত্যা করতে চায়, এই সন্দেহটাই এক নম্বর। দেখা গেল, টেবিলের ওপর রাখা একটা কাঁচের জগ থেকে এক গ্লাস পানি নিয়ে সকলেই পান করছে, সমস্যা নেই। সে ভাবছে, পানিতে বিষ বা অজ্ঞান করার ট্যাবলেট দেওয়া আছে। তাই সে খাবে না। শ্রেণি কক্ষে একজন ছাত্রী স্বতঃস্ফূর্ত হয়ে হাসিমুখে প্রশ্ন করছে, জাওয়াদ করিম ভাবছে অধ্যক্ষ মেয়েটিকে তার পেছনে লেলিয়ে দিয়েছে। সে ব্যাচেলর এবং তরুণ প্রভাষক বিধায় এমনটা করছে। তারা সকলে মিলে পরিকল্পনা করেই তাকে ফাঁসাতে চায়। এমন সব অবাস্তব, আজগুবি মনস্তাত্ত্বিক অসুস্থতা নিয়েই সেদিন সে ট্রেনে উঠেছে।
কমলাপুর রেলস্টেশনে নেমে সরাসরি মতিঝিলের ব্যাংক পাড়ায় এসে বিশ্ববিদ্যালয়ের এক ঘনিষ্ঠ বন্ধুর অফিসে হাজির হলো জাওয়াদ করিম। তার নিদ্রাহীন দেহ, বিপন্ন চেহারা, মলিন পোশাক, চোখের নিচটায় কালো ছায়া জমে আছে। মাথার চুল এলোমেলো, রুক্ষ। তার দিকে তাকিয়ে বন্ধু আকরাম বিস্ময় নিয়ে বললো,
-কী জাওয়াদ কোথায় ছিলে? কোনো সমস্যা? টেনশনে আছিস নাকি?
-না কিছু না। আমাকে একটু সাহায্য করতে হবে দোস্ত। আমাকে কিছু মানুষ সারাক্ষণ ফলো করছে, তারা ট্রেনেও আমার সঙ্গে ছিল। মনে হয় এখনো নিচে দাঁড়িয়ে। ভাবত পারো?
আকরাম মুচকি হাসে, একটা সিগারেট ঠোঁটে লাগিয়ে বলে,
-তুমি চা খাও বন্ধু। নাস্তা করেছ? যাও, ওয়াশরুমে ঢুকে হাতমুখ ধুয়ে নাও।
জাওয়াদ তা-ই করে। চা খায়, এটা-ওটা আলাপ করে, তার কলেজের অবস্থা, সহকর্মীদের অসহযোগিতা, মেয়ে মানুষের উৎপাত, চাকরি ছেড়ে ঢাকায় ফিরে আসার কথা,অগত্যা সাংবাদিকতায় আসবে ইত্যাদি ইত্যাদি।
আকরাম তার প্রতি ভালোবাসার দুর্বলতা নিয়েই বললো, দোস্ত, তুমি স্থির হয়ে সিদ্ধান্ত নিয়ো। সবাইকে শত্রু বানিয়ে কোথাও টিকতে পারবে না। সেটা দেশ হোক আর বিদেশ। কথা বলতে বলতেই সে ওয়াশ রুমে প্রবেশ করে। ঠিক তখনই টেবিল থাকা দুটো গোলাকার ক্রিস্টাল পেপারওয়েট থেকে একটা পকেটে ঢুকিয়ে নিল জাওয়াদ। এটা তার রাস্তার নিরাপত্তার প্রয়োজনে।
- দোস্ত আকরাম, অনেক ধন্যবাদ। আসি। আজ রাতটা পল্টনের পার্টি অফিসে কাটাব। নেতাদের সঙ্গে সাক্ষাৎ করবো। হয়তো আমাদেরআবার দেখা হবে।
তিনতলা থেকে সিঁড়ি বেয়ে রাস্তায় নেমে একটা রিকশায় চেপে বসলো জাওয়াদ করিম। দেশজুড়ে ভ্যাপসা গরমের সাথে দমকা হাওয়া বইছে। দুপুরের রোদে তাপমাত্রা বৃদ্ধি পেয়েছে মাত্রাতিরিক্ত। রিকশাওয়ালা হুটটা তুলে দিতে বললে সে সঙ্গে সঙ্গে সম্মতি দেয়। মতিঝিল থেকে পল্টন সে আর কত সময়? তবুও জাওয়াদ চলন্ত রিকশা থেকে বারবার পেছনে ফিরে তাকাচ্ছিল, ট্রেনের একই কম্পার্টমেন্টে থাকা লম্বাচুলের ফর্সা ছেলে দুটো এখনো তার পিছু নিল কিনা!
তিন.
পরপর দুই রাত তোপখানা রোডের চারতলা অফিসের গণরুমে ঘুমানোর পরে জাওয়াদ ভাবছে সে তার বড় ভাইয়ের বাসায় যাবে। পরিবেশ থাকলে সেখানেই দু’চার দিন কাটাবে।
পুরান ঢাকার কাছাকাছি লালবাগের এক গলির মুখে দোতলায় ছোট্ট একটা বাসায় সপরিবারে ভাড়া থাকে ভাই আনোয়ার খান। মাত্র দুই রুমের বাসা। এক সন্তান নিয়ে তাদের অনায়াসে হয়ে যায়। জাওয়াদ যখন বাসায় পৌঁছে তখন সন্ধ্যা হয়ে আসছে। মাগরিবের আজান শুরু হয়েছে চারদিকে, কারও বাড়িতে যাওয়ার এটা উপযুক্ত সময় নয়। সে দরজায় কড়া নাড়তেই বড়োভাই বেরিয়ে এসে জিজ্ঞেস করলো,
- কিরে, কোত্থেকে আসলে? কোথায় থাকিস, আব্বা আম্মা কারও সাথেই যোগাযোগ নাই কেন? চাকরিটা আছে? নাকি দল নিয়েই আছিস?
জাওয়াদ জবাব দেয় না। চুপ করে থাকে। ভেতর থেকে ভাবির কণ্ঠ, ‘আমরা তো রেডি কখন বের হব’?
অর্থাৎ এদের পূর্ব নির্ধারিত বাইরে দাওয়াত আছে। এখনই বের হতে হবে।
জাওয়াদ বললো,
- ভাইয়া, এখানে দুয়েক রাতে থাকা যাবে?
ভাইয়া কিছু বলার আগেই, তার ভাবি মিসেস রওশন আরা ভেতর থেকে জবাব দিল,
- দ্যাখো, এত ছোট্ট বাসা আমাদেরই কষ্ট হচ্ছে। আচ্ছা তাহলে তুমি ঘুরে আস। আমরা রাত ১০টার ভেতরে ফিরে আসব। ভাইয়াও তা-ই বললো।
জাওয়াদ করিম কোনো শব্দ না করে হাতে থাকা একটা ছোট্ট ব্যাগ কাঁধে ফেলে নেমে গেল। ভাই এবং ভাবীর ধারণা হলো সে নিশ্চয়ই ঘুরে আসবে।
কিন্তু সে রাস্তায় উঠে আগের চেয়ে দ্রুত গতিতে হাঁটছিল। ভাবছে এ বাসায় নিরাপত্তা নেই, ভাবী স্থানীয় কেজি স্কুলের শিক্ষিকা হলেও মহিলা নিষ্ঠুর ধরনের। রাতে খাবারে বিষ মিশিয়ে মেরে ফেলতে পারে। তার চাহনিতে এমনই ঈঙ্গিত পাওয়া যায়।
ইদানীং জাওয়াদ প্রায়ই বলে দুনিয়ার কোথাও যখন নিরাপত্তা নেই, সবাই যখন শত্রু, মূল্যহীন এ জীবন রাখার প্রয়োজনীয়তা কী। এর চেয়ে চলে যাওয়াই শ্রেয়। প্রতিদিন তার মধ্যে আত্মহননের প্রবল ইচ্ছা জাগ্রত হয়ে উঠেছে। কথায় কথায় যে কাউকে বলা শুরু করেছে,
- প্লিজ, আমার ক্ষতি করবেন না, বেশি দিন নেই, আমি অবিলম্বেই চলে যাচ্ছি। এত মানুষ পিছনে লাগলে বাঁচা যায় বলুন?
সে ফিরে আসে তোপখানা রোডের সেই পুরানো ঠিকানায়; যা কোনো আত্মীয়, বন্ধু-বান্ধব জানে না। ঢাকা এলে এটাই তার মাথাগোঁজার ঠাঁই। এখানে তার মতন আরও কতিপয় সার্বক্ষণিক নিবেদিতপ্রাণ, ছিন্নমূল, উদ্বাস্তু দলীয় কর্মী প্রায় শূন্য পাকস্থলী নিয়ে মেঝেতে ঘুমিয়ে থাকে। এরা নাকি গরিব মানুষের জন্য রাজনীতি করে। তারা অনেকেই পার্থিব সুখ-শান্তি, ভোগ বিলাস, পরিবারকে চিরতরে পেছনে ফেলে, নিজের মেধা মনন, উচ্চ শিক্ষা সবকিছুকে তাচ্ছিল্য জ্ঞান করে নিজেকেই সমর্পণ করে দিয়েছেন দলের কল্যাণে। এদেরঅনেক চিরকুমার কমরেডের সঙ্গে জাওয়াদের সখ্য ছিল, মত ও পথের বিনিময় ছিল, সুখ-দুঃখের ভাগাভাগির জীবন ছিল। একদিন সমাজতন্ত্রের পতাকা হাতে নিয়ে গোটা রাষ্ট্রযন্ত্রের হয়ে গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব পালন করার নিবিড় স্বপ্ন ছিল তাদের। আজকাল
এ-সব অতীতচারিতাউ™£ান্ত জাওয়াদকে ভাবায়, কখনো আকুল করে, চোখে আনন্দাশ্রু এনে দেয়।
চার.
রোববার। সপ্তাহের প্রথম দিন। ছাত্রশিক্ষকের উপস্থিতিতে ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় তার কলেজ ক্যাম্পাসটি মুখরিত হয়ে উঠেছে। অধ্যক্ষ বেলাল চৌধুরীররুমে একটা অনির্ধারিত সভা বসেছে।
অর্থনীতির প্রভাষক জাওয়াদ করিম খানের বিরুদ্ধে নানা অভিযোগ উঠেছে- যা গর্হিত ও অনভিপ্রেত। বিশেষ করে যত্রতত্র রাজনৈতিক আলোচনা, শ্রেণি সংগ্রামের মন্ত্র বিতরণ, খামখেয়ালি আচরণ, সন্দেহবাতিকতা আর বিনা অনুমতিতে যখন তখন কর্মস্থল ত্যাগ ইত্যাদি। কলেজের সভাপতি একজন প্রভাবশালী রাজনীতিক ও সাবেক এমপি। যিনি নিজেই একটা সশস্ত্র ক্যাডার বাহিনীকে প্রশ্রয় দিয়ে থাকেন। তিনি সবকিছু শুনলেন, দেখলেন এবং সিদ্ধান্ত দিলেন। প্রভাষক জাওয়াদ করিম খান বরখাস্ত। যদিও তার অনুপস্থিতিতে এবং তাকে আত্মপক্ষ সমর্থনের সুযোগ না দিয়েই তা করা হয়েছে। এতে কারও কিছু যায় আসে না। তখন কে কার কথা শুনে? কে কার জন্য বলে? যেখানে কমিটির সিদ্ধান্তই চূড়ান্ত। জাওয়াদ করিম কিছু জানে না, এমনকি শোনেনি যে, তার চাকরি চলে গেছে। চাকরির আগ্রহ সে আগেই হারিয়েছে। এখন তার মাথার ভেতরে চব্বিশ ঘণ্টা ভনভন করে ঘুরছে শুধু একটা কথা, ‘এই পৃথিবীকে লাল সালাম জানাতে হবে’।
পাচ.
পড়ন্ত বিকাল নেমেছে। খানিক পরেই সূর্যাস্ত হবে। আজ সারাদিন তোপখানা রোডের স্যাঁতসেঁতে অস্বাস্থ্যকর রুমটায় বিশ্রামেই ছিল জাওয়াদ করিম। আজ অফিস থেকে নেমে গিয়ে বিনাকারণে সে অনেকগুলি জায়গায় ঢুঁ মারে। সচিবালয়ের গেইট, প্রেসক্লাব চত্বর, নূরহোসেন স্কোয়ার, বায়তুল মোকাররম, কমিউনিস্ট পার্টির কেন্দ্রীয় কার্যালয় ইত্যাদি স্থানে আনমনা হয়ে ঘুরছিল সে। অবশেষে যায় একটা কফি শপে, এটা এলিফ্যান্ট রোডের ডানদিকে শেষপ্রান্তে অবস্থিত। এখন অনেক রাত, মনের আনন্দে, নিঃসঙ্গ একা হয়ে কফির কাপে চুমুক দিচ্ছে জাওয়াদ করিম খান। এর আগে সে অনেকবার কফি খেয়েছে তবে সেটা সদলবলে। আজ কেউ নেই তার পাশে। এমন একটা দিনই তার প্রত্যাশা ছিল। কফির মূল্য পরিশোধ করার সময় সে হঠাৎ সতর্ক হয়ে পকেটের প্রতি দৃষ্টিপাত করলো। আজকের পরে পকেটে আর একটি টাকা না থাকলেও কিছু আসে যায় না। শুধু চিরনিদ্রার জন্য পিল কেনার টাকাটা অবশিষ্ট থাকলে চলবে।
জাওয়াদ কফি শপ ছেড়ে যায় তখন প্রায় মধ্যরাত। সম্ভবত সেদিন সে-ই ছিল রাতের শেষ কাস্টমার। সে নির্ভার হয়ে রিকশায় চড়ে চলে আসে শাহবাগের অনেকগুলো ওষুধের দোকানের লাইনে। জাওয়াদ বুদ্ধিমান, শিক্ষিত মানুষ। সে একাধিক দোকান থেকে কিনে নেয় অনেকগুলো ট্যাবলেট। এখন তার পকেটভর্তি ঘুমের ওষুধ আর হাতে এক বোতল পানি।
জাওয়াদ করিম রিকশাকে নির্দেশ দেয়, ‘আমাকে কার্জন হলের গেইট বরাবর নামিয়ে দাও। তোমাকে ভাড়া বেশি করে দিয়ে দেব।’
রাত তখন ১২টা বাজে। সুনসান চারদিক। দোয়েল চত্বর পার হয়ে সে নেমে গেল পশ্চিম পাশের গেইটে। তালাবদ্ধ গেইটের একটা চোরাই ফাঁক দিয়ে ভেতরে প্রবেশ করলো। এবং সোজা হেঁটে প্রধান ফটকে গিয়ে হাজির হলো সে। সিঁড়িতে একটু আয়েশ করে বসে পড়ল জাওয়াদ।
সে দেখলো আকাশে পূর্ণিমার চাঁদ উঠেছে। ঝলমলে আলো পড়ছে লাল কারুকার্য শোভিত ভবনের গায়ে। তার নিজের শরীরের ছায়াকে সে দেখছে।সামনে দেবদারুর ঝোপঝাড় থাকায় স্থানটা আরও নিরাপদ মনে হলো তার কাছে। কী অদ্ভুত, একেবারে জনমানবশূন্য নির্জন অথচ একটা ঐতিহাসিক জায়গা। জাওয়াদ করিম খান মনে মনে নিজেকে ভাগ্যবান মনে করছে এই ভেবে যে, তাঁর মহাপ্রস্থান হবে দেশের সবচেয়ে আলোকিত শিক্ষাঙ্গন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অঙ্গনে। রাত পোহালে শতশত ছাত্রছাত্রী এসে তার নিথর দেহটা প্রবেশ সিঁড়িতে পড়ে থাকতে দেখবে, তারা একজন আরেকজনের সঙ্গে আলাপ করবে, কেউ বা বিষণœ হবে, আফসোস করবে এর চেয়ে বেশি আর কী চাই? এই নিষ্ঠুর দেশ আর কী দিতে পারবে? এমন ভাবনার মধ্যে দীর্ঘ সময় ধরে অপলক আকাশের দিকে তাকিয়ে থাকে জাওয়াদ।
ইপেপার
জাতীয়
সারাদেশ
আন্তর্জাতিক
নগর-মহানগর
খেলা
বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি
শিক্ষা
অর্থ-বাণিজ্য
সংস্কৃতি
ক্যাম্পাস
মিডিয়া
অপরাধ ও দুর্নীতি
রাজনীতি
শোক ও স্মরন
প্রবাস
নারীর প্রতি সহিংসতা
বিনোদন
সম্পাদকীয়
উপ-সম্পাদকীয়
মুক্ত আলোচনা
চিঠিপত্র
পাঠকের চিঠি
হোসেন আবদুল মান্নান
শিল্পী : সঞ্জয় দে রিপন
বৃহস্পতিবার, ০৪ ডিসেম্বর ২০২৫
ঘটনাটা একদিনের নয়। অন্তত বছর দুই ধরে জাওয়াদের মাথার ভেতরে নাগরদোলার মতন উপরে নিচে করে ঘুরছিল। তার আচার-আচরণ, চলাফেরা, কথাবার্তা কেমন যেনো উল্টাপাল্টা মনে হয়েছিল। তবে বেশি বোঝা যেত, যখন কয়েকজন একত্রে বসে আড্ডা বা গল্পগুজব করতো। তখনই চোখে পড়তো তার ভেতরের অস্থিরতা আর যন্ত্রণার বহিঃপ্রকাশ। সিরিয়াস কোনো আলোচনা কালেও সে এমন সব উদ্ভট কথা বলে বসত, শুনে সবাই হা করে থাকতো। সবচেয়ে আজগুবি লাগত তার সন্দেহের তালিকা দেখে- যা ক্রমাগত প্রলম্বিত হতেই থাকে। দিনদিন চেনা-জানা স্বজন, শুভাকাক্সক্ষী, বন্ধু, সহপাঠী এমনকি পিতা-মাতা, ভাইবোন সকলকেই সে সন্দেহের তালিকাভুক্ত করেছিল। একেকজন পরিচিত মানুষ মাত্রই যেনো তারা একজন আততায়ী। হঠাৎ করে রাস্তায় পরিচিত কারও সঙ্গে দেখা হলে, জাওয়াদ বিচলিতবোধ করতো, অপ্রস্তুত হয়ে জিজ্ঞেস করতো, আপনার কাজ যেনো কী? ব্যাগে কিছু আছে? ছোরা বা ডেগার জাতীয়? আমাকে মারবেন? আপনার চোখ এত লাল যে! ইত্যাদি উদ্ভট সব প্রশ্ন। তখন কেউ কেউ কিছু মনে না করলেও, দু’একজন ভাবত- ছেলেটা তো আগে এমন ছিল না! তার কী হলো? উচ্চ শিক্ষিত, ভদ্র, অমায়িক মানুষটার হঠাৎ এ কী পরিণতি হলো?
জাওয়াদ করিম খান। এটাই ভালো নাম। সার্টিফিকেট মতে পারিবারিক নাম যেমন হয়। স্কুল কলেজে বৃত্তিধারী, মেধাবী ছাত্র, গ্রামে নামডাক আছে। সে একদিন মধ্যবিত্তের শ্রেণিচরিত্র ধারণ করে পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের সর্বোচ্চ ডিগ্রি গ্রহণ করে। সেখানেই বাম ঘরানার ছাত্র রাজনীতিতে ওতোপ্রোত জড়িয়ে যায়। মাথাভরা বিপ্লব, সমাজতন্ত্র, সর্বহারার পক্ষে কর্মযোগ ইত্যাদি করে শেষে মফস্বল শহরের বেসরকারি কলেজের চাকরিতে সাময়িক থিতু হওয়া; শ্রেণিকক্ষে রাজনীতির অনুপ্রবেশ ঘটে, লবিং গ্রুপিং, দলবাজি নানাবিধ অভিযোগ মাথায় নিয়ে বারবার চাকরিচ্যুতি, একসময় আসে না চাকরি না রাজনীতি; এমন একটা ছন্নছাড়া দুঃসময়ের মুখোমুখি হয়েছিল জাওয়াদ করিম। বড়ো লোক আত্মীয়-স্বজন, সুজনের অভাব ছিলনা তার। ভেতরের চাপা অহংকার আর আত্মসম্মান বোধের প্রবল জাঁতাকলে পড়ে সে মুষড়ে গিয়েছিল। অব্যক্ত কষ্ট, অদৃশ্য অপ্রাপ্তি তাকে তুষের আগুনের মতো নিভৃতে পুড়িয়ে ফেলেছিল।
দুই.
একদিন ভোরবেলায় দিনের প্রথম ট্রেনে চড়ে ব্রাহ্মণবাড়িয়া থেকে সোজা ঢাকায় চলে আসে অধ্যাপক জাওয়াদ করিম খান। কাউকে না জানিয়ে অনেকটা পালিয়ে আসার মতন ব্যাপার। আজকাল সে পলায়নপর জীবনে অভ্যস্ত হয়ে গেছে। আগের দিন তাকে নিয়ে সেখানকার কলেজে প্রচ- হট্টগোল বেঁধে যায়। কলেজের সমবয়সী বা জ্যেষ্ঠ কলিগরা ক্রমাগত তার শত্রু হতে থাকে। শুরুতে যাঁরা বন্ধু হয়েছিল তারাও এখন প্রকাশ্যে বৈরিতা করছে। তাকে যথাসম্ভব এড়িয়ে চলছে। যদিও এই পরিস্থিতির জন্য অন্যদের চেয়ে তার অপরাধই অধিক। তার প্রধানতম অপরাধ হলো, সকলকে সন্দেহের চোখে দেখা। সবাই নাকি তাকে হত্যা করতে চায়, এই সন্দেহটাই এক নম্বর। দেখা গেল, টেবিলের ওপর রাখা একটা কাঁচের জগ থেকে এক গ্লাস পানি নিয়ে সকলেই পান করছে, সমস্যা নেই। সে ভাবছে, পানিতে বিষ বা অজ্ঞান করার ট্যাবলেট দেওয়া আছে। তাই সে খাবে না। শ্রেণি কক্ষে একজন ছাত্রী স্বতঃস্ফূর্ত হয়ে হাসিমুখে প্রশ্ন করছে, জাওয়াদ করিম ভাবছে অধ্যক্ষ মেয়েটিকে তার পেছনে লেলিয়ে দিয়েছে। সে ব্যাচেলর এবং তরুণ প্রভাষক বিধায় এমনটা করছে। তারা সকলে মিলে পরিকল্পনা করেই তাকে ফাঁসাতে চায়। এমন সব অবাস্তব, আজগুবি মনস্তাত্ত্বিক অসুস্থতা নিয়েই সেদিন সে ট্রেনে উঠেছে।
কমলাপুর রেলস্টেশনে নেমে সরাসরি মতিঝিলের ব্যাংক পাড়ায় এসে বিশ্ববিদ্যালয়ের এক ঘনিষ্ঠ বন্ধুর অফিসে হাজির হলো জাওয়াদ করিম। তার নিদ্রাহীন দেহ, বিপন্ন চেহারা, মলিন পোশাক, চোখের নিচটায় কালো ছায়া জমে আছে। মাথার চুল এলোমেলো, রুক্ষ। তার দিকে তাকিয়ে বন্ধু আকরাম বিস্ময় নিয়ে বললো,
-কী জাওয়াদ কোথায় ছিলে? কোনো সমস্যা? টেনশনে আছিস নাকি?
-না কিছু না। আমাকে একটু সাহায্য করতে হবে দোস্ত। আমাকে কিছু মানুষ সারাক্ষণ ফলো করছে, তারা ট্রেনেও আমার সঙ্গে ছিল। মনে হয় এখনো নিচে দাঁড়িয়ে। ভাবত পারো?
আকরাম মুচকি হাসে, একটা সিগারেট ঠোঁটে লাগিয়ে বলে,
-তুমি চা খাও বন্ধু। নাস্তা করেছ? যাও, ওয়াশরুমে ঢুকে হাতমুখ ধুয়ে নাও।
জাওয়াদ তা-ই করে। চা খায়, এটা-ওটা আলাপ করে, তার কলেজের অবস্থা, সহকর্মীদের অসহযোগিতা, মেয়ে মানুষের উৎপাত, চাকরি ছেড়ে ঢাকায় ফিরে আসার কথা,অগত্যা সাংবাদিকতায় আসবে ইত্যাদি ইত্যাদি।
আকরাম তার প্রতি ভালোবাসার দুর্বলতা নিয়েই বললো, দোস্ত, তুমি স্থির হয়ে সিদ্ধান্ত নিয়ো। সবাইকে শত্রু বানিয়ে কোথাও টিকতে পারবে না। সেটা দেশ হোক আর বিদেশ। কথা বলতে বলতেই সে ওয়াশ রুমে প্রবেশ করে। ঠিক তখনই টেবিল থাকা দুটো গোলাকার ক্রিস্টাল পেপারওয়েট থেকে একটা পকেটে ঢুকিয়ে নিল জাওয়াদ। এটা তার রাস্তার নিরাপত্তার প্রয়োজনে।
- দোস্ত আকরাম, অনেক ধন্যবাদ। আসি। আজ রাতটা পল্টনের পার্টি অফিসে কাটাব। নেতাদের সঙ্গে সাক্ষাৎ করবো। হয়তো আমাদেরআবার দেখা হবে।
তিনতলা থেকে সিঁড়ি বেয়ে রাস্তায় নেমে একটা রিকশায় চেপে বসলো জাওয়াদ করিম। দেশজুড়ে ভ্যাপসা গরমের সাথে দমকা হাওয়া বইছে। দুপুরের রোদে তাপমাত্রা বৃদ্ধি পেয়েছে মাত্রাতিরিক্ত। রিকশাওয়ালা হুটটা তুলে দিতে বললে সে সঙ্গে সঙ্গে সম্মতি দেয়। মতিঝিল থেকে পল্টন সে আর কত সময়? তবুও জাওয়াদ চলন্ত রিকশা থেকে বারবার পেছনে ফিরে তাকাচ্ছিল, ট্রেনের একই কম্পার্টমেন্টে থাকা লম্বাচুলের ফর্সা ছেলে দুটো এখনো তার পিছু নিল কিনা!
তিন.
পরপর দুই রাত তোপখানা রোডের চারতলা অফিসের গণরুমে ঘুমানোর পরে জাওয়াদ ভাবছে সে তার বড় ভাইয়ের বাসায় যাবে। পরিবেশ থাকলে সেখানেই দু’চার দিন কাটাবে।
পুরান ঢাকার কাছাকাছি লালবাগের এক গলির মুখে দোতলায় ছোট্ট একটা বাসায় সপরিবারে ভাড়া থাকে ভাই আনোয়ার খান। মাত্র দুই রুমের বাসা। এক সন্তান নিয়ে তাদের অনায়াসে হয়ে যায়। জাওয়াদ যখন বাসায় পৌঁছে তখন সন্ধ্যা হয়ে আসছে। মাগরিবের আজান শুরু হয়েছে চারদিকে, কারও বাড়িতে যাওয়ার এটা উপযুক্ত সময় নয়। সে দরজায় কড়া নাড়তেই বড়োভাই বেরিয়ে এসে জিজ্ঞেস করলো,
- কিরে, কোত্থেকে আসলে? কোথায় থাকিস, আব্বা আম্মা কারও সাথেই যোগাযোগ নাই কেন? চাকরিটা আছে? নাকি দল নিয়েই আছিস?
জাওয়াদ জবাব দেয় না। চুপ করে থাকে। ভেতর থেকে ভাবির কণ্ঠ, ‘আমরা তো রেডি কখন বের হব’?
অর্থাৎ এদের পূর্ব নির্ধারিত বাইরে দাওয়াত আছে। এখনই বের হতে হবে।
জাওয়াদ বললো,
- ভাইয়া, এখানে দুয়েক রাতে থাকা যাবে?
ভাইয়া কিছু বলার আগেই, তার ভাবি মিসেস রওশন আরা ভেতর থেকে জবাব দিল,
- দ্যাখো, এত ছোট্ট বাসা আমাদেরই কষ্ট হচ্ছে। আচ্ছা তাহলে তুমি ঘুরে আস। আমরা রাত ১০টার ভেতরে ফিরে আসব। ভাইয়াও তা-ই বললো।
জাওয়াদ করিম কোনো শব্দ না করে হাতে থাকা একটা ছোট্ট ব্যাগ কাঁধে ফেলে নেমে গেল। ভাই এবং ভাবীর ধারণা হলো সে নিশ্চয়ই ঘুরে আসবে।
কিন্তু সে রাস্তায় উঠে আগের চেয়ে দ্রুত গতিতে হাঁটছিল। ভাবছে এ বাসায় নিরাপত্তা নেই, ভাবী স্থানীয় কেজি স্কুলের শিক্ষিকা হলেও মহিলা নিষ্ঠুর ধরনের। রাতে খাবারে বিষ মিশিয়ে মেরে ফেলতে পারে। তার চাহনিতে এমনই ঈঙ্গিত পাওয়া যায়।
ইদানীং জাওয়াদ প্রায়ই বলে দুনিয়ার কোথাও যখন নিরাপত্তা নেই, সবাই যখন শত্রু, মূল্যহীন এ জীবন রাখার প্রয়োজনীয়তা কী। এর চেয়ে চলে যাওয়াই শ্রেয়। প্রতিদিন তার মধ্যে আত্মহননের প্রবল ইচ্ছা জাগ্রত হয়ে উঠেছে। কথায় কথায় যে কাউকে বলা শুরু করেছে,
- প্লিজ, আমার ক্ষতি করবেন না, বেশি দিন নেই, আমি অবিলম্বেই চলে যাচ্ছি। এত মানুষ পিছনে লাগলে বাঁচা যায় বলুন?
সে ফিরে আসে তোপখানা রোডের সেই পুরানো ঠিকানায়; যা কোনো আত্মীয়, বন্ধু-বান্ধব জানে না। ঢাকা এলে এটাই তার মাথাগোঁজার ঠাঁই। এখানে তার মতন আরও কতিপয় সার্বক্ষণিক নিবেদিতপ্রাণ, ছিন্নমূল, উদ্বাস্তু দলীয় কর্মী প্রায় শূন্য পাকস্থলী নিয়ে মেঝেতে ঘুমিয়ে থাকে। এরা নাকি গরিব মানুষের জন্য রাজনীতি করে। তারা অনেকেই পার্থিব সুখ-শান্তি, ভোগ বিলাস, পরিবারকে চিরতরে পেছনে ফেলে, নিজের মেধা মনন, উচ্চ শিক্ষা সবকিছুকে তাচ্ছিল্য জ্ঞান করে নিজেকেই সমর্পণ করে দিয়েছেন দলের কল্যাণে। এদেরঅনেক চিরকুমার কমরেডের সঙ্গে জাওয়াদের সখ্য ছিল, মত ও পথের বিনিময় ছিল, সুখ-দুঃখের ভাগাভাগির জীবন ছিল। একদিন সমাজতন্ত্রের পতাকা হাতে নিয়ে গোটা রাষ্ট্রযন্ত্রের হয়ে গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব পালন করার নিবিড় স্বপ্ন ছিল তাদের। আজকাল
এ-সব অতীতচারিতাউ™£ান্ত জাওয়াদকে ভাবায়, কখনো আকুল করে, চোখে আনন্দাশ্রু এনে দেয়।
চার.
রোববার। সপ্তাহের প্রথম দিন। ছাত্রশিক্ষকের উপস্থিতিতে ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় তার কলেজ ক্যাম্পাসটি মুখরিত হয়ে উঠেছে। অধ্যক্ষ বেলাল চৌধুরীররুমে একটা অনির্ধারিত সভা বসেছে।
অর্থনীতির প্রভাষক জাওয়াদ করিম খানের বিরুদ্ধে নানা অভিযোগ উঠেছে- যা গর্হিত ও অনভিপ্রেত। বিশেষ করে যত্রতত্র রাজনৈতিক আলোচনা, শ্রেণি সংগ্রামের মন্ত্র বিতরণ, খামখেয়ালি আচরণ, সন্দেহবাতিকতা আর বিনা অনুমতিতে যখন তখন কর্মস্থল ত্যাগ ইত্যাদি। কলেজের সভাপতি একজন প্রভাবশালী রাজনীতিক ও সাবেক এমপি। যিনি নিজেই একটা সশস্ত্র ক্যাডার বাহিনীকে প্রশ্রয় দিয়ে থাকেন। তিনি সবকিছু শুনলেন, দেখলেন এবং সিদ্ধান্ত দিলেন। প্রভাষক জাওয়াদ করিম খান বরখাস্ত। যদিও তার অনুপস্থিতিতে এবং তাকে আত্মপক্ষ সমর্থনের সুযোগ না দিয়েই তা করা হয়েছে। এতে কারও কিছু যায় আসে না। তখন কে কার কথা শুনে? কে কার জন্য বলে? যেখানে কমিটির সিদ্ধান্তই চূড়ান্ত। জাওয়াদ করিম কিছু জানে না, এমনকি শোনেনি যে, তার চাকরি চলে গেছে। চাকরির আগ্রহ সে আগেই হারিয়েছে। এখন তার মাথার ভেতরে চব্বিশ ঘণ্টা ভনভন করে ঘুরছে শুধু একটা কথা, ‘এই পৃথিবীকে লাল সালাম জানাতে হবে’।
পাচ.
পড়ন্ত বিকাল নেমেছে। খানিক পরেই সূর্যাস্ত হবে। আজ সারাদিন তোপখানা রোডের স্যাঁতসেঁতে অস্বাস্থ্যকর রুমটায় বিশ্রামেই ছিল জাওয়াদ করিম। আজ অফিস থেকে নেমে গিয়ে বিনাকারণে সে অনেকগুলি জায়গায় ঢুঁ মারে। সচিবালয়ের গেইট, প্রেসক্লাব চত্বর, নূরহোসেন স্কোয়ার, বায়তুল মোকাররম, কমিউনিস্ট পার্টির কেন্দ্রীয় কার্যালয় ইত্যাদি স্থানে আনমনা হয়ে ঘুরছিল সে। অবশেষে যায় একটা কফি শপে, এটা এলিফ্যান্ট রোডের ডানদিকে শেষপ্রান্তে অবস্থিত। এখন অনেক রাত, মনের আনন্দে, নিঃসঙ্গ একা হয়ে কফির কাপে চুমুক দিচ্ছে জাওয়াদ করিম খান। এর আগে সে অনেকবার কফি খেয়েছে তবে সেটা সদলবলে। আজ কেউ নেই তার পাশে। এমন একটা দিনই তার প্রত্যাশা ছিল। কফির মূল্য পরিশোধ করার সময় সে হঠাৎ সতর্ক হয়ে পকেটের প্রতি দৃষ্টিপাত করলো। আজকের পরে পকেটে আর একটি টাকা না থাকলেও কিছু আসে যায় না। শুধু চিরনিদ্রার জন্য পিল কেনার টাকাটা অবশিষ্ট থাকলে চলবে।
জাওয়াদ কফি শপ ছেড়ে যায় তখন প্রায় মধ্যরাত। সম্ভবত সেদিন সে-ই ছিল রাতের শেষ কাস্টমার। সে নির্ভার হয়ে রিকশায় চড়ে চলে আসে শাহবাগের অনেকগুলো ওষুধের দোকানের লাইনে। জাওয়াদ বুদ্ধিমান, শিক্ষিত মানুষ। সে একাধিক দোকান থেকে কিনে নেয় অনেকগুলো ট্যাবলেট। এখন তার পকেটভর্তি ঘুমের ওষুধ আর হাতে এক বোতল পানি।
জাওয়াদ করিম রিকশাকে নির্দেশ দেয়, ‘আমাকে কার্জন হলের গেইট বরাবর নামিয়ে দাও। তোমাকে ভাড়া বেশি করে দিয়ে দেব।’
রাত তখন ১২টা বাজে। সুনসান চারদিক। দোয়েল চত্বর পার হয়ে সে নেমে গেল পশ্চিম পাশের গেইটে। তালাবদ্ধ গেইটের একটা চোরাই ফাঁক দিয়ে ভেতরে প্রবেশ করলো। এবং সোজা হেঁটে প্রধান ফটকে গিয়ে হাজির হলো সে। সিঁড়িতে একটু আয়েশ করে বসে পড়ল জাওয়াদ।
সে দেখলো আকাশে পূর্ণিমার চাঁদ উঠেছে। ঝলমলে আলো পড়ছে লাল কারুকার্য শোভিত ভবনের গায়ে। তার নিজের শরীরের ছায়াকে সে দেখছে।সামনে দেবদারুর ঝোপঝাড় থাকায় স্থানটা আরও নিরাপদ মনে হলো তার কাছে। কী অদ্ভুত, একেবারে জনমানবশূন্য নির্জন অথচ একটা ঐতিহাসিক জায়গা। জাওয়াদ করিম খান মনে মনে নিজেকে ভাগ্যবান মনে করছে এই ভেবে যে, তাঁর মহাপ্রস্থান হবে দেশের সবচেয়ে আলোকিত শিক্ষাঙ্গন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অঙ্গনে। রাত পোহালে শতশত ছাত্রছাত্রী এসে তার নিথর দেহটা প্রবেশ সিঁড়িতে পড়ে থাকতে দেখবে, তারা একজন আরেকজনের সঙ্গে আলাপ করবে, কেউ বা বিষণœ হবে, আফসোস করবে এর চেয়ে বেশি আর কী চাই? এই নিষ্ঠুর দেশ আর কী দিতে পারবে? এমন ভাবনার মধ্যে দীর্ঘ সময় ধরে অপলক আকাশের দিকে তাকিয়ে থাকে জাওয়াদ।