ধারাবাহিক ভ্রমণ কাহিনী-২১
চৌধুরী সালাহউদ্দীন মাহমুদ
(পূর্ব প্রকাশের পর)
দ্রুতগতির ট্রেনে আন্দালুসিয়ার করদোবা থেকে ৫ ঘণ্টায় পৌঁছে গেলাম কাতালুনিয়ার বার্সেলোনা। বার্সা মাঝে মধ্যে বার্সেলোনাকে মনে করিয়ে দেয় বটে, তবে কাতালুনিয়া নামটি প্রথম শোনা তাদের স্বাধীনতার গণভোটে, এরপর নামটি ভুলতে বসেছিলাম।
কাতালুনিয়ার রাজধানী বার্সেলোনা- একই সাথে ঐতিহাসিক ও আধুনিক। অবশ্য এ অভিধা স্পেনের সব বড় শহরকেই দেয়া যায়।
হোটেল নিয়েছি শহর কেন্দ্র ‘লা রাম্বলা’ এলাকায়। নাতাশা থাকতে চায় শহরের বাইরে নিরিবিলি এলাকায়। তাকে বুঝিয়ে বললাম যে ‘লা রাম্বলা’ হবে গাছ-গাছালি ভরা এক কুঞ্জবন। সেজন্য এলাকাটি ছিল লোরকার খুব প্রিয়। আমার এ হোটেল নেয়ার এটি সবচেয়ে বড় কারণ। তাছাড়া শহর কেন্দ্রে থাকলে সব কিছু দেখা সহজ হয়, সময়ের ভাল ব্যবহার হয়।
সবাইকে মনে করিয়ে দিলাম ‘লা রাম্বলা’ নিয়ে লোরকার কথা: ‘পৃথিবীর সবচেয়ে সুখী সড়ক, যেখানে বছরের চারটি ঋতু এক সাথে একই সময়ে বসবাস করে। এটি পৃথিবীর একমাত্র সড়ক, যা শেষ হোক তা আমি চাই না। তা শব্দে ভরপুর, বাতাসে মাতোয়ারা, জমায়েতে সুন্দর, ঐতিহ্যে প্রাচীন: বার্সেলোনার ‘লা রাম্বলা’।’
ট্যাক্সি ড্রাইভার ‘লা রাম্বলা’সড়কের হোটেলে আমাদের নামিয়ে দিতে দিতে বলল, ‘এ এলাকায় আগে আসতাম সকালে, বিকেলে, রাতে- পরিবারের সবার সাথে হাঁটতে, খেলতে, খেতে। এখন আর আসি না।’ বললাম, ‘ব্যস্ততা বেড়ে গেছে নিশ্চয়ই, তাই আসতে পার না?’ সে বলল, ‘না, জায়গাটি এখন দোকানদার আর ট্যুরিস্টরা দখল করে নিয়েছে। হাঁটার জায়গা নেই, নিঃশ্বাস ফেলতে পারি না।’ কথাটি শুনে নাতাশা একটু হতাশা প্রকাশ করতেই বললাম, “এটি এখন শুধু ‘লা রাম্বলা’বা বার্সেলোনার নয়, পুরো স্পেনেরই ছবি। অনেক শহরে ট্যুরিস্টদের বিরুদ্ধে মিটিং মিছিল হচ্ছে। ট্যুরিস্টরা এদের অর্থনীতিকে সাহায্য করছে, আবার তাদের জন্য কিছু সমস্যাও তৈরি করছে। এটিই পৃথিবীর নিয়ম। প্রত্যেক কিছুর ভাল খারাপ দুটি দিকই আছে।”
হোটেলে চেক ইন করে তাড়াতাড়ি সবাই হালকা নাশতা সেরে বেরিয়ে গেলাম। কারণ, ঘণ্টাখানেকের মধ্যে ‘লা রাম্বলা’ গাইডেড ট্যুর শুরু হবে, টিকিট কেটে রেখেছি আগেই। বেলা গড়িয়ে এলো সন্ধ্যের দিকে, স্ট্রীট ল্যাম্পগুলো জ্বলে উঠেছে।
ট্যুর শুরুর স্থান প্লাছা দে কাতালুনিয়া, হোটেল থেকে দশ মিনিট হেঁটে সেখানে পৌঁছলাম। দেখা হলো আমাদের ট্যুর গাইড সান্টিয়াগো ও দলের বাকি ৮ জনের সাথে।
চারদিকে ফোয়ারা, মনুমেন্ট-ভাস্কর্য ও গগনচুম্বী দালানে শোভিত ‘প্লাসা দে কাতালুনিয়া’- বার্সেলোনার হৃৎপি-। শহরের বাস, মেট্রো, ট্যুরিস্ট বাস, এয়ারপোর্ট শাটল- সবকিছুর কেন্দ্র এই স্কয়ার। শহরের পুরনো ও নতুন অংশের এ হলো মিলনস্থল। তাছাড়া সমগ্র কাতালুনিয়ার এ হলো আত্মিক কেন্দ্র। কতবার টিভিতে দেখেছি, কাতালুনিয়ার স্বাধীনতার দাবিতে হাজারো মানুষের মিছিলে প্রকম্পিত এই ‘প্লাসা দে কাতালুনিয়া’। আজ মিছিল হচ্ছে না এখানে, তবুও মনে হচ্ছে মানুষের মিছিল- কবুতরদের সাথে পাল্লা দিয়ে এখানে জমায়েত হয়েছে হাজারো মানুষ। তাই তো ট্যুর গাইড সান্টিয়াগো বলল,‘এই ‘প্লাসা দে কাতালুনিয়া’হলো বার্সেলোনার টাইমস স্কোয়ার।’
এই প্লাজাতে ৪টি বড় সড়ক মিলিত হয়েছে। তার একটি হল ‘লা রাম্বলা’- যেখানে হবে আমাদের আজকের ট্যুর।
সব জায়গায় দেখি রাস্তার দুপাশে পাশে হাঁটার জায়গা, মাঝখানে গাড়ি চলার রাস্তা। প্রায় এক মাইল লম্বা এক সড়ক ‘লা রাম্বলা’-এখানে মাঝখানে হাঁটার চওড়া চত্বর। দুপাশে গাড়ি চালানো যায় খুব সীমিত কয়েকটি জায়গায়। এটি মূলত পথচারীদের হেঁটে বেড়ানো ও বিশ্রামের একটি চত্বর বা প্রমনেড।
এটি স্পেন যখন, ইতিহাস এখানে আসবেই। তবে আমাদের ট্যুর গাইড সান্টিয়াগো শুরু করল গাছেদের ইতিহাস দিয়ে। তাও ভালো, অন্তত রাজা-বাদশাহদের ইতিহাস থেকে। অবশ্য লা রাম্বলা-য় সবার আগে গাছই চোখে পড়ে, তাই তাদের ইতিহাস দিয়ে শুরু করাটা যৌক্তিক। সামনের বড় বড় গাছের দিকে আঙ্গুল তুলে সান্টিয়াগো বলতে শুরু করল,‘দেখ, লা রাম্বলাকে ঢেকে রেখেছে হাজারো গাছ, বেশিরভাগ ‘লন্ডন প্লেন ট্রি’, এগুলি লাগানো হয়েছে ১৮৫১ সালে। এ জাতের গাছ তাদের বড় বড় পাতা ও বিশাল ডাল-পালা নিয়ে ছায়ার জন্য বিখ্যাত। একটু পেছনে ফিরে যাই। ১৭০৩ সালে ২৮০টি বার্চ দিয়ে এ সড়কে গাছ লাগানোর হয় শুভ সূচনা।’ লন্ডন প্লেন ট্রি-গুলিকে দেখতে অনেকটা ম্যাপেল গাছের মতো মনে হয়। ১ মাইল লম্বা লা রাম্বলার দুপাশে দাঁড়িয়ে সারি সারি প্লেন ট্রি হাত মেলে পুরো এলাকাকে শামিয়ানার মতো ঢেকে রেখেছে।
সান্টিয়াগো এরপর যোগ করল,‘আরো একবার পেছনে ফিরতে হবে। প্রায় দুই হাজার বছর আগে খ্রিস্টীয় ২০ সালে রোমানরা প্রতিষ্ঠা করে জনপদ ‘বারসিনো’, যা কালক্রমে এক বিশাল নগরী, বার্সেলোনা হিসেবে গড়ে ওঠে। তখন দুটি রাম্বলা বা জলপ্রবাহ শহরের পানি নিষ্কাশন করে বয়ে নিত সমুদ্রে, তার একটি ছিল এই রাম্বলা। পরে তা বিভিন্ন সময়ের উন্নয়নে হয়ে উঠে বার্সেলোনার প্রাণ-কেন্দ্র‘লা রাম্বলা’। আজকাল কোনো পর্যটক অন্তত একবার এখানে না ঘুরে ফিরে যান না।’
লা রাম্বলা চত্বরের মাঝামাঝি সবাই হেঁটে চলেছি, আর দেখছি চারপাশের জীবনপ্রবাহ। এখানে যেন চলছে মানুষের মিছিল, যা চলছে তো চলছেই অবিরত। তার মাঝেও স্ট্রীট ল্যাম্পগুলোর নিচে আলো-আঁধারিতে বেঞ্চে বসে গল্প-আড্ডায় মেতে আছে অনেকে। এক বেঞ্চে তার প্রিয় কুকুরকে নিয়ে বসে আছেন এক বৃদ্ধা। আরেক বেঞ্চে একজন পড়ছেন একটি বই। কাছেই কাপড় পেতে পসরা সাজিয়ে বসে আছে কজন হকার। পাশে ফুলের দোকানে গোলাপ, লিলি, চন্দ্রমল্লিকা ও জেসমিন থরে থরে সাজানো, শুধু পাচ্ছি জেসমিনের তীব্র গন্ধ। ফলের দোকানে সাজানো কমলা, ডালিম, আপেল, নাশপাতি- তাদের হালকা গন্ধ বয়ে আনছে বইয়ে যাওয়া ঝিরি ঝিরি বাতাস। দুপাশের সারি সারি ক্যাফে থেকে ভেসে আসছে স্পেনীয়দের প্রিয় চুরো ও হট চকোলেটের মিষ্টি ঘ্রাণ। ফুল-ফল-চকোলেটের গন্ধ মিলেমিশে তৈরি করেছে এক অনন্য সুবাস। কানে আসছে গিটারের বাজনা ও গান- স্ট্রিট পারফর্মারদের ঘিরে লোকজনের জটলা। গানের তালে তালে চলছে ফ্লেমেনকো নাচ, সাথে ওলে ওলে ধ্বনির মূর্ছনা। নাচ-গানের পাশেই একজন শিল্পী খুব নিবিড়ভাবে তুলি টানছেন তার ইজেলের বোর্ডে, দেখি ফুটে উঠেছে লা রাম্বলা- প্লেন ট্রি-এর সবুজ সারি ও তার ছায়ায় জীবনের কোলাহল। অনেকগুলি ছবি আঁকা হয়ে বিক্রির অপেক্ষায়, পাশেই ঝোলানো আছে। আছে অনেক দোকান- নতুন ও পুরনো বইয়ের, সাথে সংবাদপত্র। আর ছড়িয়েছিটিয়ে আছে স্যুভেনির শপ, তার কোনো হিসেব নেই। মানুষের ঢলের মাঝেও হঠাৎ দুএকটি সাইকেল ঝটিকা বেগে ছুটছে। আবার কেউ দৌড়াচ্ছে একাকি, আবার অনেকে দল বেঁধে। এর মাঝে প্লেন ট্রি গাছের পাতা ঝরছে, নীরবে। সব মিলিয়ে লা রাম্বলা রঙধনুর মতো তুলে ধরেছে জীবনের বিচিত্র সব রঙ।
এতে বিমোহিত হয়ে বললাম,‘লা রাম্বলা-য় মনে হচ্ছে এক উৎসব চলছে।’ সান্টিয়াগো বলল,‘ঠিকই। তবে তোমরা আজ একদিন দেখছ, আমরা এ উৎসব দেখি বছরের প্রতিটি দিন।’
সান্টিয়াগো যোগ করল, ‘শুরু হলো মাত্র, লা রাম্বলায় দেখার আরো অনেক কিছু আছে। সব কিছু তো এত অল্প সময়ে দেখা সম্ভব নয়। তবে আমরা এখন যাব বিশেষ কয়েকটি স্থানে, যা তুলে ধরেছে এ এলাকার ঐতিহ্য।’
একটু হেঁটেই চলে এলাম এক মার্কেটে, নাম লা বোকেরিয়া। সান্টিয়াগো শুরু করল তার বর্ণনা,‘এটি বার্সেলোনার সবচেয়ে নামকরা মার্কেট। এটি চালু হয় ১৮৫৩ সালে, যদিও লা রাম্বলায় বেচাকেনা শুরু হয় ১৩শ শতাব্দী থেকে। এটি মূলত খাবারের বাজার, যেখানে প্রতিদিন ৩০০-এর ওপর স্টল খোলা হয় তাজা খাবার নিয়ে। চল ভেতরে যাই, বর্ণনা শোনার চেয়ে চোখে দেখা অনেক ভালো।’ এই বলে মৃদু হেসে সান্টিয়াগো আমাদের নিয়ে গেল ‘লা বোকেরিয়া’র ভেতরে।
ঢুকতেই এক তীব্র ঘ্রাণ- ফল-ফুল-মাছ-মাংস পনির-সবজি-হুইস্কি-কফি চা-মসলা-মিস্টি-অলিভ অয়েল বাদাম-চকোলেট- সব মিলিয়ে এক অনন্য সুবাস দিয়ে লা বোকেরিয়া আমাদের স্বাগত জানাল। মানুষের খাবারের কত আয়োজন, এর যেন চলছে এক প্রদর্শনী। প্রত্যেকটি খাবারের আলাদা স্টল। খাওয়া তো পরের কথা, তা দেখাটাই আনন্দের। বাজারটি খাবারের যেন এক স্বর্গ। সান্টিয়াগো বলল,‘পুরো মার্কেট ঘুরতে গেলে অনেক সময় লাগবে। কেউ কিছু খেতে চাইলে খেতে পার, এখানে ঝটপট খাবারের দোকান আছে। তাছাড়া অনেক দোকানে খাবার দেয়া হচ্ছে নমুনা হিসেবে খেতে। তোমরা স্বাদ নিয়ে দেখতে পার।’ আমরা অনেকে নমুনা খাবার খেতে খেতে বের হয়ে আসলাম। ঢোকার সময় খেয়াল করিনি, বের হতে দেখলাম বাজারের ভবনটি ১৯১৪ সালে তৈরি মডার্নিস্ট স্থাপত্যের এক অনুপম নিদর্শন।
একটু হেঁটেই সামনে দেখি রাস্তায় এক জটলা, কি যেন দেখছে সবাই। কাছে যেতেই সান্টিয়াগো বলল,‘এ হচ্ছে এক বিখ্যাত মোজাইক, যা ১৯৭৬ সালে সৃষ্টি করেন কাতালুনিয়ার প্রখ্যাত শিল্পী জোয়ান মিরো।’ রাস্তার ওপরে বসানো বৃত্তাকার সুন্দর মোজাইকটিতে ব্যবহার করা হয়েছে শুধুমাত্র ৩টি রঙ- লাল, হলুদ, নীল। নাতাশা বলল, ‘এ রঙ ৩টি হলো মৌলিক রঙ- যা দিয়ে অন্যান্য সব রঙ তৈরি করা যায়।’ উজ্জ্বল রঙের মোজাইকটি লাগছে খুবই সজীব, সাথে মিশেছে চারপাশের মানুষের প্রাণচাঞ্চল্য। সব মিলিয়ে এক সুন্দর, প্রাণবন্ত পরিবেশ।
এরপর আসল, এক সুন্দর ভবন ‘কাসা ব্রুনো কোয়াদ্রুস, যার রয়েছে মডার্নিস্ট স্থাপত্যের এক সম্মুখ তোরণ, তা শোভিত- লণ্ঠন হাতে এক ড্রাগন, চিত্রিত রঙিন কাঁচ এবং সুদৃশ্য নকশায়। এ শিল্পকর্মটি বার্সেলোনায় প্রাচ্যের প্রভাবের একটি নিদর্শন।
একটু এগুতেই দেখি, লোহার কারুকার্যময় চার মুখের এক ফোয়ারা-ফন দে কানালেতেস- তার ওপরে চার-বাহুবিশিষ্ট এক ল্যাম্পপোস্ট। সান্টিয়াগো আবার শুরু করল তার বর্ণনা, ‘তোমরা নিশ্চয়ই জান, চার বাহু হলো এফ সি বার্সেলোনা ক্লাবের ক্রেস্টের প্রতীক। এই ফোয়ারা, ও ল্যাম্পপোস্ট দিয়ে বার্সা ক্লাবের প্রতীককে তুলে ধরা হয়েছে। এ ক্লাবের সমর্থকরা এখানে তাদের বিজয় উদযাপন করতে আসে। ১৯৩০ সাল থেকে সে ঐতিহ্য শুরু হয়। তখন ফুটবল খেলার ফলাফল পাশের লা রাম্বলা পত্রিকার বোর্ডে দেখানো হতো। সমর্থকরা এখানে আসত দূরে হওয়া খেলার ফলাফল জানতে, এবং জয়ের ক্ষেত্রে তা উদযাপন করতে।’ এ রাতেও দেখি এখানে অনেকে বার্সার জার্সি গায়ে দিয়ে দল বেঁধে আছে। কোথাও হয়তো তাদের দলের খেলা হচ্ছে। তার ফলাফল জানা ও তা উদযাপনের জন্য তারা নিশ্চয়ই অপেক্ষা করছে।
এরপর দেখলাম সুরম্য এক ভবনের সামনে বিরাট এক লাইন। আসন্ন কোন শো এর জন্য লোকজন অপেক্ষা করছে। সান্টিয়াগো মজা করে বলল, ‘দেখি তোমরা বলতে পার কিনা, এটি কি থিয়েটার হলো, না অপেরা হাউস?’ আমি ভবনের সামনের নাম দেখলাম ‘গ্রান থ্রিয়াথ্রা দেল লিসেউ’। নিশ্চিন্তে বললাম,‘নামে যখন থ্রিয়াথ্রা আছে, থিয়েটার তো হবেই।’ নাতাশা আমাকে সমর্থন করে বলল, থিয়েটার হল। নাবিল ও ফারজানা বলল, অপেরা হাউস; তারাই জিতল। সান্টিয়াগো পরিস্কার করে দিল: ‘এ হলো এক অপেরা হাউস। ১৮৪৭ সালে শুরু হওয়া এ অপেরা হাউসটি বার্সেলোনার বৃহত্তম ও প্রাচীনতম। ২৩০০ জন ধারণ ক্ষমতার হলটি ১৯৮৯ সাল পর্যন্ত ছিল ইউরোপের বৃহত্তম অপেরা হাউস। এটি অনন্য সুন্দর এক অপেরা হাউস, অসাধারণ তার স্থাপত্য ও অলংকরণ- কাতালান সংস্কৃতির কেন্দ্র, এবং তার এক গর্ব। এখন শো এর সময়, তাই ভেতরে যাবার উপায় নেই। ’
একটু হেঁটেই দেখতে পেলাম চমৎকার এক প্রাসাদ-‘পালাও গোয়ে’। এটি বিখ্যাত স্থপতি আন্তনি গাউদির প্রথমদিকের এক বিখ্যাত সৃষ্টি। ফ্লোরেন্স শহরে যেমন মিকেলেঞ্জেলো, তেমনি বার্সালোনা শহরে আন্তনি গাউদি। এ শহরেরই ‘পার্ক গোয়ে’ নামের এক বিখ্যাত পার্কের সাথে ‘গোয়ে’নামটি বেশি শুনি। নামটি এসেছে ‘আউজেবি গোয়ে’থেকে যিনি ছিলেন এক শিল্পপতি এবং গাউদির একজন বড় পৃষ্ঠপোষক। ‘পার্ক গোয়ে ও পালাও গোয়ে’- এ দুটি অনন্য স্থাপত্য আন্তনি গাউদি সৃষ্টি করেছেন ‘আউজেবি গোয়ে’-র জন্য।
এ প্রাসাদ পেরিয়ে সামনে এগুতেই চোখে পড়ল এক বিশাল এক মনুমেন্ট। বুঝতে আর বাকি রইল না এটি কার ভাস্কর্য। তবে কাছে যাওয়া পর্যন্ত অপেক্ষা করি।
যা ভেবেছিলাম তাই! ক্রিস্টোফার কলম্বাস দাঁড়িয়ে আছেন ২০০ ফিট উঁচু এক করিন্থীয়১ স্তম্ভের ওপর, এখানেই তিনি ফিরেছিলেন ১৫ই এপ্রিল ১৪৯৩ তারিখে, তাঁর আমেরিকা আবিষ্কারের পর। তার ডান হাতটি পাশের সমুদ্রের দিকে নির্দেশ করা, আর বাম হাতে ধরা নৌ-মানচিত্র। এখানে বিশাল এক চত্বরে শেষ হয়েছে লা রাম্বলা ও আরো কটি সড়ক, ডানপাশে বার্সেলোনা বন্দর। পাশের সমুদ্রের সাথে যেন পাল্লা দিয়ে এক জনসমুদ্র জমায়েত হয়েছে এ চত্বরে।
সান্টিয়াগো শুরু করল ইতিহাস, ‘আামেরিকা আবিষ্কারের পরে বার্সেলোনা ফেরার পর কলম্বাসকে আনুষ্ঠানিকভাবে অভ্যর্থনা জানান রাজা ফার্দিনান্দ ও রানি ইসাবেয়া। তাঁর আবিষ্কার ও ফেরাকে স্মরণ করে এই মনুমেন্টটি ১৮৮৮ সালের বার্সেলোনা ইউনিভার্সেল এক্সপোজিশনের জন্য বসানো হয়। ‘কাতালান’ ভাষায় কলম্বাস-কে ডাকা হয় ‘কলম’বলে। তাই এই মনুমেন্টের নাম ‘মনুমেন্থ আ কলম’। স্তম্ভের ওপরে কলম্বাস এর ভাস্কর্যটি ২৫ ফিট লম্বা, আর স্তম্ভের গোড়ায় চিত্রলিপিতে শোভিত আছে তাঁর বর্ণিল জীবনের কাহিনী। এখানে একটি লিফট আছে, তোমরা ওপরে উঠে শহর ও সমুদ্রের দৃশ্য দেখতে পার।’
নাবিল ও নাতাশা আর দেরি করল না, ওপরে উঠে গেল। আমরাও তাদেরকে অনুসরণ করলাম। কী বিশাল আর কী সুন্দর এক দৃশ্য! পাশে অগণন বাতির আলো, সৈকতে ঘুরে বেড়ানো মানুষের ঢল, পাশে বন্দর ও পোতাশ্রয়, মাঝখানে ‘মনুমেন্থ আ কলম’ এ দাঁড়ানো কলম্বাস, সাথে লা রাম্বলার শেষ প্রান্তের দৃশ্য।
সান্টিয়াগো কিছুটা দার্শনিকতার সুরে বলল,“কাতালানদের পীঠস্থ’ান ‘প্লাসা দে কাতালুনিয়া’দিয়ে লা রাম্বলা দেখা শুরু করেছি, আর স্পেনের গর্ব ‘মনুমেন্থ আ কলম’দিয়ে তা শেষ করেছি। কাতালুনিয়া ও স্পেনকে ধরে রেখেছে যেন দুহাত দিয়ে ‘লা রাম্বলা’।”
সবশেষে সান্টিয়াগো বলল, ‘বার্সেলোনা-র প্রতিটি সড়ক, প্রতিটি গলি, প্রতিটি পাড়ায় ছড়িয়ে আছে এ রকম অনেক ইতিহাস, বহু ঐতিহ্য। এর অংশমাত্র দেখেছ আজ একটিমাত্র সড়ক লা রাম্বলা-য়। বাকিগুলি তোমরা খুঁজে খুঁজে বের কর। গুড লাক।’ এখানেই আমাদের লা রাম্বলা ট্যুর শেষ হলো।
নাবিল বলল, ‘লা রাম্বলা দেখা শেষ। এখন কোথায় যাব?’ বললাম, ‘না, লা রাম্বলা এখনো শেষ হয়নি, যেমন লোরকা চেয়েছেন এ সড়ক যাতে শেষ না হয়। আমরা এখন বিশেষ একটি স্থানে যাব।’ দুজনেই একসাথে চিৎকার করে উঠল, কোথায়? বললাম, ‘এখন বলব না। গেলে অবশ্যই ভাল লাগবে।’
আমরা লা রাম্বলার ফিরতি পথে হাঁটতে শুরু করলাম। আগের দেখা স্থানগুলোই আসছে পর পর। শুধু বেড়েছে মানুষের ঢল। ‘পালাও গোয়ে’পার হয়ে এ সড়কের প্রায় মাঝামাঝি আসলাম। এরপর ‘গ্রান থ্রিয়াথ্রা দেল লিসেউ’এর ঠিক উল্টো দিকে এক রেস্তোরাঁর সামনে দাঁড়িয়ে নাবিল, নাতাশা ও ফারজানাকে বললাম, ‘এই আমার গন্তব্যস্থল। আজ এখানে আমরা ডিনার করব। কারণটি ভেতরে যেয়ে বলব।’ তারা কিছু একটা অনুমান করে রাজি হয়ে গেল।
ফটকে বড় করে লেখা ‘ক্যাফে দে লা অপেরা’। ওপরে লোহার ফ্রেমেও কারুকাজ করে নামটি লেখা। ঢুকতেই চোখে পড়ল কাঠের দরজায় ফুল-লতাপাতার সূক্ষ্ম সর্পিল কাজ। আর মার্বেলের পার্শ্বকাঠামোও একই নকশায় শোভিত।
ভেতরে ঢুকে আরো মুগ্ধ হয়ে গেলাম। চিত্রকর্ম দিয়ে সবদিকে ফুটিয়ে তোলা হয়েছে অপরূপ সব দৃশ্য। কাপড়ের প্যানেলে ৩টি নকশা দেয়ালে লাগানো আছে। এর দুটিতে অঙ্কিত আছে কিশোরীদের হাতে ধরা ফুল ও ঝুড়ি, আর একটিতে ফুলদানিতে রঙ বেরঙের ফুল। কাপড়ের প্যানেলগুলো ঘন সবুজ রঙের প্লাস্টারের ছাঁচ দিয়ে ঘেরা। এ নকশাগুলো সিলিংয়েও দেখা গেল। কাপড়ের এ চিত্রকর্মের পাশে দেয়ালে পর্যায়ক্রমে লাগানো আছে চিত্র খোদিত আয়না, যেখানে আছে বিভিন্ন অপেরার দৃশ্য। রাস্তার অপর পারের অপেরার যেন প্রতিফলন পড়েছে এ পারের ক্যাফেতে।
এ এক ক্লাসিক বিউটি, তবে তা দেখার উদ্দেশ্যে এখানে আসিনি। আসার মূল উদ্দেশ্য লোরকার স্মৃতি বিজড়িত এ স্থানটি দেখা। নাবিল ও নাতাশাকে বলতেই তারা বলল যে, আমার এ রকম অভিপ্রায় তারাও অনুমান করেছে।
খাবার অর্ডার দিয়ে ম্যানেজার হোজে মার্তিনেজকে জিজ্ঞেস করলাম লোরকার ছবি বা স্মৃতি বিজড়িত কিছু এখানে আছে কিনা। সোজা উত্তর না দিয়ে তিনি ইতিহাস বলা শুরু করলেন।
বার্সেলোনা থাকাকালীন লোরকা এই ক্যাফেতে প্রায় আসতেন, আড্ডা দিতেন, খেতেন। লোরকা ছাড়াও এখানে এসেছেন রাজা ত্রয়োদশ আলফনসো, হান্স ক্রিশ্চিয়ান অ্যান্ডারসন, আন্তনি গাউদি এবং আরো অনেকে। এ স্থাপনার ইতিহাস ২০০ বছরেরও অধিক। তবে মডার্নিস্টা২ শৈলীতে পুনর্গঠিত করে বর্তমান ক্যাফেটি চালু করা হয় ১৯২৯ সালে। সে সময় থেকে এটি স্পেন এবং বাইরের শিল্পী ও সাহিত্যিকদের একটি মেলা মেশার কেন্দ্র হয়ে ওঠে। তা ছাড়া স্পেনের গৃহযুদ্ধে অংশ নেয়া আন্তর্জাতিক ব্রিগেডের সদস্যদের কাছেও এটি বেশ জনপ্রিয় ছিল। এখনো স্পেনের শিল্পী-সাহিত্যিকরা এ ক্যাফেকে খুব পছন্দ করেন। উপরের তলার কক্ষগুলোতে প্রায়ই বিভিন্ন সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান, পুস্তক প্রদর্শনী ও সাহিত্য সভা অনুষ্ঠিত হয়ে থাকে। ইতিহাস ও আভিজাত্যে বার্সেলোনায় ‘ক্যাফে দে লা অপেরা’-এর স্থান অরেক উপরে।
সবদিকে ঘুরে ঘুরে দেখালেন হোজে। দুঃখ করে বললেন যে লোরকার কোন ছবি এখানে নেই।
‘গ্রান থ্রিয়াথ্রা দেল লিসেউ’-এর কোনো শো শেষ হয়েছে মাত্র। দেখি একদল অপেরা শিল্পী এসে ঢুকল ডিনার করতে। হোজে বললেন, ‘এটি অপেরা শিল্পী ও কলাকুশলীদের একটি জনপ্রিয় মিলন ক্ষেত্র। সেজন্যই হয়তো নাম রাখা হয়েছিল ক্যাফে দে লা অপেরা।’
লোরকার প্রিয় ‘লা রাম্বলা’য় দেখলাম তাঁর প্রিয় রেস্তোরাঁ ক্যাফে দে লা অপেরা। একদিনে তাঁর স্মৃতি-বিজড়িত দুটি স্থান দেখা কম প্রাপ্তি নয়।
ফেরার পথে ‘লা রাম্বলা’র এক ফুলের দোকানের সামনে আসতেই এক তোড়ায় চোখ আটকে গেল। অজ¯্র ফুল দিয়ে তৈরি করা হয়েছে হৃদয়-আকৃতির এক নকশা- কেউ হয়তো তার প্রিয় কারো জন্য তা নিয়ে যাবে। এরকম এক অনন্য তোড়া লোরকার হাতে তুলে দিয়েছিল ‘লা রাম্বলা’র পুষ্পজীবীরা। সে ছিল ১৯৩৫ সালে লোরকার নাটক ‘দনিয়া রসিতা লা সলতেরা’-র বার্সেলোনায় শুভ মহরতের দিন। তিনি নাটকটি লিখেছিলেন পুষ্পজীবীদের জীবন কাহিনী নিয়ে। তাই তারা ভালবাসত লোরকাকে, যে রকম তিনি ভালবাসতেন তাদের, তাঁর ভাষায় তাদের ‘অকপট হাসি ও ভেজা হাত’কে।
‘লা রাম্বলা’ সড়কটি এখানেই ষেন হয়ে গেল, যদিও লোরকার ইচ্ছে ছিল এটি যেন শেষ না হয়: ‘এটি পৃথিবীর একমাত্র সড়ক, যা শেষ হোক তা আমি চাই না। ’ লোরকার কথাই ঠিক, ‘লা রাম্বলা’ এখনো শেষ হয়নি, এ সড়ক চলমান থাকবে আমাদের কল্পনা ও স্মৃতিতে। ক্রমশ...
Ref:
করিন্থীয় স্তম্ভ বা করিন্থীয় কলাম হচ্ছে প্রাচীন গ্রিক স্থাপত্যের একটি অলঙ্কৃত শৈলীর স্তম্ভ, যার চূড়াটি অ্যাকান্থাস পাতা দিয়ে সাজানো থাকে এবং এটি অত্যন্ত জমকালো ও সুসজ্জিত হয়।
মডার্নিস্টা বলতে সাধারণত স্পেনের কাতালান অঞ্চলের Modernisme নামক একটি শিল্প ও স্থাপত্য আন্দোলনকে বোঝানো হয়, যা Art Nouveau এর কাতালান সংস্করণ, যেখানে আন্তনি গাউদির মতো স্থপতিরা অসাধারণ কারুকাজ ও বাঁকানো রেখা দিয়ে বার্সেলোনায় অনেক বিখ্যাত ভবন, যেমন সাগ্রাদা ফামিলিয়া নির্মাণ করেছেন। এর সময়কাল হচ্ছে ১৯ শতকের শেষ থেকে ২০ শতকের শুরুর দিন পর্যন্ত।