image
শিল্পী : সঞ্জয় দে রিপন

গণেশ উপাখ্যান

মঈনুল হাসান

শ্রী শ্রী গোপাল জিউর আখড়ার পেছনে অপ্রশস্ত মন্দির উঠান। তারই গা ঘেঁষে হেলেপড়া অশ^ত্থের ছায়ায় গণেশ পোদ্দারের শতবর্ষী বাড়ি। বাড়ি বলতে বাবা-ঠাকুরদার রেখে যাওয়া আদি পৈতৃক ভিটার ওপর হাড় বের করা ক্ষয়ে যাওয়া রুগ্ণ চিহ্ন। এদিকে দক্ষিণের বড় রাস্তার দিকে মুখ করে উত্তরের উঠানের দিকে পাছা ঠেকিয়ে মন্দির লাগোয়া তার বিচিত্র মনোহারী বিতান। জংধরা টিনের ওপর সাদা অক্ষরে লেখা শখের ‘গণেশ শঙ্খ ভা-ার’। পূজা-আর্চার নানা উপকরণ ও সাথে বিবাহের প্রয়োজনীয় সামগ্রী বেচা-বিক্রির অপরিসর দোকানটি। লোকে অবশ্য গণেশবাবুর দোকান বলে থাকে।

ঠাকুরদা বিমল পোদ্দার একসময় নাকি জাঁদরেল শাঁখারি ছিলেন। শাঁখের নিপুণ কারিগর হিসেবে বাবা জয়তন পোদ্দারেরও বেশ নামডাক শোনা যেত। ছোটো দোকানখানার ঝাপতাড়ার ওপরে আদি নামটি অর্থাৎ ‘জয়তন শঙ্খ ভা-ার’ বেশ জ্বলজ্বল করেই লেখা ছিল আগে। তারও আগে হয়তো বিমল। কিন্তু, পিতা স্বর্গবাসী হবার পর গণেশ পোদ্দার ভাবলেন, তিনি তো আর শাঁখারি নন; যোগ্য কারিগরইবা পাবেন কোথায়? তাছাড়া তিন যুগ পার হয়ে এখন চলছে কলি যুগ। কলি যুগের ব্যাপার স্যাপারই অন্যরকম। সবকিছুতেই কলির সন্ধ্যা ভর করেছে আজকাল। চটকদার সস্তা জিনিসের ওপর সকলেরই যেন নজর! তাই তিনি হঠাৎ শাঁখের কারিগর নিয়ে চিন্তা নয় বরং দোকান নিয়ে শাঁখের করাতের মধ্যেই পড়লেন।

শেষে সব দ্বিধাদ্বন্দ্ব ঝেড়ে ফেললেন একদিন। বড় বাজার থেকে পাইকারি মাল কিনে এনে সেসব দিয়ে দোকানের তিন দিকের দেওয়ালের কাচের তাকে সাজাতে লাগলেন থরে থরে। বাবা-ঠাকুরদার ব্যবসা দিয়েই ‘ব্যবসা নতুন করে সাজাবেন’। আর সেই চিন্তা থেকে একদিন দেবতা গণেশের পূজা সেরে ধূপ-ধুনুচি জ্বালিয়ে পবিত্র জল ছিটিয়ে ‘জয়তন’ মুছে দিয়ে ‘গণেশ’ বসিয়ে দিলেন দোকানের ওপর। কপাল ভালো হলে নামে নামে কল্যাণই বয়ে আনবে, নামকরণের জুতসই কিস্সায় গণেশবাবুর মতো এ কথাই ভাবতে লাগলেন সকলে। সেই থেকে ‘গণেশ শঙ্খ ভা-ার’।

গণেশ পোদ্দারের মুখ থেকেই শোনা যায়, পিতা জয়তন পোদ্দারের কোনোকালে জোতদারি ছিল না। তাই পরের ধনে পোদ্দারি কাকে বলে তা তার মোটেও জানা নেই। তবু ‘পোদ্দার’ লেজটুকু বংশের নামের সাথে সাতপুরুষ ধরে কীভাবে যে জুড়ে গেল তার কোনো লেখাজোখা তার কাছে নেই। অবস্থাদৃষ্টে মনে হয়, এ লেজটুকু না হলে এখন আসলে তার নামের সাথে অন্য কোনো পদবি ঠিক মানানসই হতোও না। ওদিকে দেবতা গণেশের নাম ধার করায় দুর্গা মন্দিরের কাছে তার ব্যবসা প্রতিষ্ঠানটি ততদিনে দাঁড়িয়ে গেছে অক্ষয় বটের মতো। সেই বটের ছায়ায় অন্তত আর কিছু না হোক পোদ্দারি নাম নিয়ে গণেশবাবু তার ছোট্ট দোকানটিতে বেশ জেঁকে বসেছেন। নিজ বুদ্ধিতে ব্যবসাপাতি সাজিয়ে খাইখোরাকে বেশ ভালোমতোই টিকে আছেন আজকাল। ওটাই এখন তার জীবিকার একমাত্র সহায় এবং পঞ্চাষোর্ধ্ব গিন্নি নীহারিকা দেবীর আপাতত বেঁচে-বর্তে থাকার প্রধানতম অবলম্বন।

দুর্গা মন্দিরের দিকে যাওয়ার পরে শহরের রাস্তাটা ধরমপুর কোর্টস্টেশন হয়ে চলে গেছে দু’ভাগ হয়ে। একটা লতিয়ে পেঁচিয়ে শহরের ব্যস্ততাসহ বড় নদীটার কাছে ঠেকেছে। ওখানে পথের শেষ- রেলের বড় ইস্টিশন, বড় নদী জংশনের সীমানা। আর ডানের পথটা শহরের বড়ো-মাঝারি-ছোটো এমন হাজারটা গলিঘুঁজি অতিক্রম করে অবশেষে গিয়ে ঠেকেছে মহাসড়কের গায়ে। তবে আর যাই হোক দুর্গা মন্দির থেকে কোর্ট স্টেশন ধরে নাতিবিস্তৃত এ জায়গাটা মোটামুটি শহরের মূল কেন্দ্র হওয়ায় সারা বছর ধরেই জমজমাট থাকে। ঈদ-পূজা-উৎসব-পার্বণের সময়ে লোকের থাকে মস্ত আনাগোনা।আর সে কারণেই গণেশ পোদ্দারের মুখে সারা বছর হাসি লেপ্টে থাকে আর তেরো পার্বণ জুড়ে লেগে থাকে স্বস্তি। শহরের ভূগোল আর মানুষগুলো সম্পর্কে মোটামুটি বলা হয়ে গেছে- গল্পের পাট ভাঙলে বাকিটা জানা যাবে ধীরে ধীরে।

দুই

ভেবেছিলাম অন্যভাবে কাহিনির দিকে এগোব। কিন্তু, তা আর হলো না। যাই হোক, কথা বলছিলাম গণেশ পোদ্দার ও তার দোকানটিকে নিয়ে। সকাল হয়েছে অনেকক্ষণ। বিশেষ তাড়া না থাকায় দোকানের ঝাপতাড়া সবেমাত্র খোলা হয়েছে। স্বভাবমতো রোদের নরম আলো প্রবেশ করতেই কুলুঙ্গির গণেশ হেসে উঠেছেন গণেশবাবুর সঙ্গে। ঢোলা বাদামি ফতুয়া আর চিকন চেকের সাদা লুঙ্গিতে থলথলে শরীরের মানুষটাকে গণেশের মতোই লাগে। জন্ম থেকেই নামের প্রতি তিনি সুবিচার করে আসছিলেন এ কথা সকলেই জানে। এদিকে দেবতার সামনের ধূপদানির ভেতরে গোঁজা কয়েকটা ধূপকাঠি থেকে তখনও ধোঁয়া উঠছিল। দোকান পাহারার জন্য পরিমল নাম করে ছেলেটা রাতে দোকানের ভেতরেই ঘুমায়। সেই জ্বালিয়েছে হয়তো। ধোঁয়াওঠা ধূপ-আগরের গন্ধে চারদিকে কেমন পবিত্রভাব বিরাজ করছে।

গণেশবাবু পূজা সেরে রোজকার মতো শরীর এলিয়ে হেলান দিয়ে বসেন গদিতে। নানান বাহারি সামগ্রীতে দোকান ঠাসা। ধুলোপড়া কাচের তাকের ওপর বিভিন্ন আকার ও রঙের শঙ্খ সাজানো, থরে থরে গোছানো সব। সেই শঙ্খ হতে সূক্ষ্ম কারুকাজে বানানো বিয়েতে কনের ব্যবহারের সাদা শাঁখা, পলার লাল চুড়ি, নোয়া, সিঁদুরের কৌটো, আলতার বোতল, তিলক-চন্দনের ডিবে, মাথার জরির মুকুট; বরের জন্য শোলার টোপর, পৈতা, ধুতি, পাঞ্জাবি, গামছা এমন নানান জিনিসে চারদিক উপচে পড়ছে যেন। গণেশবাবু যেখানে আসন পেতে বসেছেন তার সামনে একেবারে রাস্তার দিকে একটা ডালায় সাজানো আছে শুভ দৃষ্টির জন্য পান, কাঁচা ফুলের মালা, ফল আর কলাগাছের সজ্জা।

বিয়েতে ব্যবহার্য যাবতীয় দ্রব্যাদি ছাড়াওমন্দিরে পূজারীদের জন্য ঠাকুরের আসন ও ছোটো বিগ্রহ, কাঠের ফ্রেমে বাঁধানো দেবতাগণের ছবি, মোমবাতি, ধূপকাঠি, কর্পুর, গোলাপজলসহ হালকা প্রসাধনী এমন কী নেই সেখানে! বারোয়ারি জিনিসে আপাদমস্তক ঠাসা দোকানের ভেতর ও বহিরঙ্গ। কোথাও দম ফেলার জো নেই। না জিনিসপত্রের, না স্বয়ং গণেশবাবুর। অদ্ভুত এক হাঁসফাঁস অবস্থা সমস্ত গণেশ ভা-ার জুড়ে।

ভাদ্র মাস শেষ হতে চলল। সামনে দুর্গা পূজা। আর সেই পূজা সারা হলেই আসবেন দেবী লক্ষ্মী আর শ্যামা। পূজার কি আর শেষ আছে? আরও কত কী? এমন ভাবনা মাথায় টেনে নিতে নিতে আনমনে ড্রয়ার খুললেন গণেশবাবু। গতকালের হিসাবপত্র মিলিয়ে নিতে খাতা টেনে বের করতেই বিস্ফারিত চোখ লাফিয়ে উঠল কপালে। এ কী হাল? কে করল এমন লক্ষ্মীছাড়া কা-? গণেশবাবু কপাল কুঁচকে অসহায়ের মতো চেয়ে রইলেন শঙ্খ সাজানো তাকের দিকে। তবে কি আবার...

একটু বিস্তারিতই বলি। বিষয়টা কদিন ধরেই বেশ আঁচ করছিলেন তিনি। এখানে ওখানে কাঠের ড্রয়ার টেনে খুলতেই কাগজের কুচি, সাথে বিশ্রী রকমের ঝাঁঝালো গন্ধের ঝাপটা। দোকানে টিকে থাকা দায়। যদিও প্রতিদিন সকালে দোকান খুলে ধূপ-ধুনুচ জ্বালিয়ে পবিত্র জল ছিটিয়ে দিত দোকানের ছেলেটা। এখানে গঙ্গাজল পাবেনইবা কোথায়? তবু সেদিনের ঘটনার পর থেকে আর কোনো ছাড় দিচ্ছেন না গণেশবাবু। পৈতৃক পেশার মান রক্ষা বলে কথা। তাই মন্ত্র পড়ে গোলাপজল ছিটিয়ে... নমঃ নমঃ নমঃ...

মাতৃপীঠ গভর্নমেন্ট গার্লস হাই স্কুলের হেড স্যার উত্তম সাহা গত সপ্তাহে তাঁর ছেলের আশীর্বাদের জন্য বেশ কিছু জিনিস কিনতে এসেছিলেন গণেশবাবুর দোকানে। পুরানো ভাঙাচোরা কুঁজো বুড়োর মতো দোকান হলেও প্রাচীন ঐতিহ্য রক্ষা বলে কথা। ঘণ্টাখানেক সময় নিয়ে বিবাহের লম্বা ফর্দ ধরে জিনিসপত্র কিনলেন উত্তমবাবু। শেষে গুছিয়ে নিতে গিয়ে বিরক্তস্বরে বললেন, এ কী দিলেন গণেশবাবু?

কেন, কী হয়েছে?

বরের টোপরের এ কী হাল, একবার দেখুন দেখি। জরি-পুঁতির কাজ নষ্ট হয়ে এমন ছিঁড়ে গেল কেমন করে? আর অমন কটু গন্ধইবা আসছে কেন? না না, এ আপনি ফিরিয়ে নিন।

আরে মশাই এত অস্থির হচ্ছেন কেন? আমি ভেতর থেকে ভালো দেখে আনিয়ে দিচ্ছি। বোঁচকা ভরা মাল পড়ে আছে পেছনের ঘরে।

বলেই অস্থির হয়ে ডাকতে থাকেন দু হাতে কাজ করা দোকানের ছোকরাটাকে। পরিমল, ও পরিমল... আরে গেলি কোথায়? একবার শুনে যা এদিকে।

আজ্ঞে কর্তা, এখুনি আসছি। দৌড়ে এসে বলল, ডাকছিলেন আমায়?

হাঁ, ডাকলাম তো।

সপ্তাহখানেক আগে বড় বাজার থেকে ঠাকুরের জিনিসপত্রসহ বিবাহের মালবোঝাই যে গাঁট দু’খানা এনেছিলাম ভেতর থেকে নিয়ে আয় সব। তারপর গণেশ পোদ্দার উত্তমবাবুর দিকে চেয়ে বললেন, আপনাকে ভালোটাই দেওয়া হবে স্যার। তারপর ভুঁড়ি নাচিয়ে উঠে বসতে বসতে চোখ দুটো যথাসম্ভব সরু করে বললেন, সামনের দোকান থেকে গরম গরম চা-সিঙ্গারা আনিয়ে দিচ্ছি। সুস্থির হয়ে বসুন। ওগুলো খেতে খেতে জিনিস চলে আসবে।

যথাজ্ঞা শুনে পরিমল মিলিয়ে গেল ভেতরের অন্ধকার ঘরে। আর কিছুক্ষণ বাদে ‘গণেশ ভা-ারের’ ভেতর থেকে সে বের হয়ে এলো বিশাল এক বোঁচকা টানতে টানতে। পাটভাঙা শাড়ির মতো ঘটনার বাকিটুকু ঘটতে লাগল একে একে যা দেখলে বা বললে পাঠক আমার সাথে নির্ঘাৎ আঁতকে উঠবেন এবার।

আরে...এখানে টোপরের গাঁট কোথায়? বোঁচকা ভর্তি খয়েরি-সোনালি জরি-পুঁতির কাপড়ের ভাঁজে ভাঁজে এ যে স্বয়ং গণেশ ঠাকুরের বাহনের ছড়াছড়ি। বিভিন্ন আকৃতি ও স্বভাবের সেই বাহন নিরিবিলি ওম নিচ্ছিলেন সেখানে। বিষয়টা এমন হতে পারে গণেশ পোদ্দারকে স্বয়ং দেবতা ঠাওর করে মর্ত্যলোকের ইঁদুরকুল তার সান্নিধ্য লাভের আশায় ব্যাকুল হয়ে উঠেছিল। কিংবা সেদিন পাইকারি বাজার থেকে জিনিসপত্র কিনে বাড়ি ফেরার পথে গণেশ পোদ্দার হ্যামিলনের বংশীবাদকের মতো শহরের সমস্ত ইঁদুরকে ডেকে এনেছিলেন তার এই ভা-ার ঘরে, যা তিনি এখন বেমালুম ভুলে গেছেন।

পরিমল টোপরের গাঁট খুলতেই সন্তান-সন্ততিসহ ইঁদুরকুলের পরিবার একে একে লাফিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়তে লাগল চারদিকে। গণেশ পোদ্দারের তখন তার লালিত পালিত আয়েশি বিশাল বপুখানা সরিয়ে উঠে দাঁড়াতে বেগ পেতে হলো বেশ। এদিকে উত্তমবাবু বসে ছিলেন তিন ঠ্যাঙা গোলমতো কাঠের উঁচু টুলের ওপর। সেটা সরিয়ে উঠতে যেতেই টাল সামলাতে না পেরে কাত হয়ে পড়ে একেবারে গণেশ উল্টালেন। একেবারে হুমড়ি খেয়ে পড়ে গেলেন গণেশবাবুর মস্ত তুলতুলে ভুঁড়িখানার ওপর।

তিন

দুর্গা পূজার তখনও কয়েক সপ্তাহ দেরি। নয়তো সকলে দেবতার সঠিক আগমন ভেবে বিষয়টিকে আখ্যা দিতে পারতেন। গণেশ মনোহারী বিতান সত্যিই সেদিন বাহারি সব ইঁদুরের কবলে ছিল সয়লাব। উত্তমবাবুকে আপ্যায়নের জন্যে উল্টোদিকের দোকান থেকে এনে রাখা আদা চা আর গরম সিঙ্গারার মাখামাখি হলো গদিতে। পূজার পণ্য সামগ্রীতে ঠাসা তাকগুলোতে লাফিয়ে লাফিয়ে ধেড়ে ইঁদুর, নেংটি ইঁদুর, বাচ্চা ইঁদুর, মা ইঁদুর, বাবা ইঁদুর এমন হাজারো ইঁদুরের আত্মীয়-স্বজন এবং তাদের বংশলতিকার সবাই লাফিয়ে ঝাঁপিয়ে পালাতে লাগল। কোনোটা দৌড়ে পালাতে লাগল গদির ভেতরে তোশকের নিচে, কোনোটা আবার চেয়ারের তলায়, কাঠের ড্রয়ারের ফাঁকে ফাঁকে।

উত্তমবাবু যথাসম্ভব নিজেকে সামলালেন। চোখে-মুখে প্রচ- বিরক্তি এনে বললেন, এখানে বসে আর কাজ নেই গণেশবাবু। আপনি বেশ ইঁদুরের পরিবার-পরিজন সাজিয়ে মহাসুখে গদিতে বসেছেন। বিয়ের কেনাকাটারও সাধ মিটে গেছে। আজ তবে চলি।

পুরো ব্যাপারটি হজম করে ততক্ষণে উঠে বসেছেন গণেশ পোদ্দার। বোকার মতো চেয়ে রইলেন উত্তমবাবুর দিকে। চোখ-মুখের ভ্যাবাচেকা ভাব দেখে মনে হচ্ছে, যে বিতিকিচ্ছি কা- ঘটে গেল এতক্ষণ এতে তিনি দারুণভাবে লজ্জিত হয়েছেন। ‘গণেশ শঙ্খ ভা-ার’ অনেক পুরাতন ব্যবসাঘর। সে হিসেবে একটু আধটু না হয় ইঁদুরের বংশবৃদ্ধি হয়েছে তবে ব্যাপারটা একেবারেই তার অনিচ্ছাকৃত এবং এতে তিনি ভীষণ মর্মাহতও হয়েছেন। তাই বলে কেনাকাটা বাদ দিয়ে...

না না, ঠিক আছে। গণেশের বাহন তো তার হাতের নাগালেই থাকবে। এ তো অস্বাভাবিক কিছু নয়। বরং এটাই তো সহজ স্বাভাবিক কা-।

আর লজ্জা দেবেন না উত্তমবাবু। যা পছন্দ হয় বেছে নিন।

পরিমল এবার টোপরের গাঁটভরা ইঁদুরবাহিনী নিয়ে মহাব্যস্ত হয়ে পড়ল। এখনও যেসব সামগ্রী ভালো আছে তা থেকে কুচি কুচি কাগজের টুকরো সাফ সুতরো করে অন্যান্য জিনিসপত্র আলাদা করে গুছিয়ে রেখে দাঁড়িয়েছে। একটা ধেড়ে ইঁদুর বোধহয় এদের ঠাকুরদা গোছের ছিল কিংবা পালিয়ে যাওয়া দলবলের সাথে ঠিক কুলিয়ে উঠতে পারেনি। পরিমল তার লেজ ধরে গণেশ পোদ্দারের মুখের সামনে এনে জিজ্ঞেস করল, কর্তা বাবু, এটা কী করব? মারব নাকি?

গণেশবাবুর সাজানো মনোহারী বিতানের কা--কীর্তি দেখে ঠিক তখনই পায়ে চটি গলিয়ে দোকান থেকে বেরোবার উপক্রম করছিলেন উত্তমবাবু। গণেশবাবুর দিকে তাকিয়ে বেরিয়ে যেতে যেতে পরিমলকে বলছিলেন, না না মারবে কেন? ও তো তোমার গণেশ ঠাকুরের বাহন। খাইয়ে দাইয়ে মোটা-তাজা করে বাঁচিয়ে রাখো পূজোর শেষ পর্যন্ত। দেখছ না গণেশবাবু উল্টে গিয়ে কেমন ব্যথা পেয়েছেন। তার চলতে ফিরতে প্রয়োজন হবে।

গণেশ পোদ্দারের গোলগাল ফর্সা মুখ থেকে কোনো কথা সরছিল না। পানচিবানো লাল ঠোঁটের আভা ধীরে ধীরে ছড়িয়ে পড়ছিল তার সারা মুখম-লে। জিভের আগা দিয়ে শুকনো ঠোঁট দুটো একবার ভিজিয়ে নিলেন; হয়তো মনে মনে ভাবছিলেন, এ বুড়ো বাহন কি আর বহুদিন বেঁচে থাকবে? তারপর বোকার মতো নির্লিপ্ত চোখজোড়া নিয়ে চেয়ে রইলেন তার ঝুলন্ত বুড়ো বাহনের দিকে।

সম্প্রতি