ইকবাল তাজওলী
বুবুন নদীর পাড়ে সকাল থেকে দাঁড়িয়ে আছে তো দাঁড়িয়েই আছে। বেলা ক্রমান্বয়ে গড়িয়ে গড়িয়ে এখন দুপুর হয়েছে। একটু আগে খোজারখলা মসজিদের মাইক থেকে আজানও শোনা গেছে। বুবুনের কিন্তু সেদিকে ভ্রুক্ষেপ নেই। সে ওপারে গোদারাঘাটের দিকে চেয়ে আছে তো চেয়ে আছে।
বর্ষায় নদী ভরাট থাকায় নৌকাগুলো উজানে গিয়ে কাজিরবাজার মাদ্রাসার কাছ থেকে ছেড়ে দিচ্ছে যাতে এপারে ঘাটে সহজেই ভেড়ানো যায়। কিন্তু দৃষ্টিসীমার বাইরে থাকায় এপার থেকে ওপারের মানুষজনকে চিহ্নিত করা যাচ্ছে না।
মোটা, লম্বা মাথায় চুলহীন একজনকে নৌকায় উঠতে দেখে বুবুনের চোখে-মুখে আনন্দের একটা ঝিলিক খেলে গেল। বাবা এই এলেন। বুবুনের আর তর সইছে না। বাবা এলে সে খেয়েদেয়ে আজ আর ঘুমাবে না। নতুন সেন্ডো গেঞ্জি পরে বেরিয়ে যাবে। মোশতাক, সেলিম, নাকচুকা স্টেটবাসকে দেখাতে হবে। মোশতাকটা গতকাল নতুন একটা সেন্ডো গেঞ্জি পরে ভাব নিয়েছে। সন্ধেবেলায় মাকে ঘটনা বর্ণনা করে সে বলেছে,‘মুশতাকোর মতো একটা গেঞ্জি কিনি দেও। হুবহু মুশতাকোর মতো। তুমার কুশিকাটা দিয়া বানাইল গেঞ্জি আমি পরতাম না।’ মা উত্তরে বলেছেন,‘তোর বাফরে কইস।’
বুবুন বাবাকে বলার সাহস পায় না। বাবাকে সে ভীষণ ভয় করে।
একবার হলো কী! বুবুনরা তখন বগুড়ায় থাকে। থাকে মানে বসবাস করে। এবং পুলিশ লাইন স্কুলে ক্লাস থ্রিতে পড়ে। স্কুলে যাওয়ার সময় ‘বাজান পইসা দেও। বাজান, পইসা দেও’ বলে বাবাকে ব্যতিব্যস্ত করে তুলল। বাবা ভীষণ রেগে গিয়ে বুবুনকে একটু জোরে ছুঁইয়ে দিলেন। বুবুন মাটিতে পড়ে গেল। এবং সঙ্গে সঙ্গে কপাল ফেটে রক্ত ঝরালো। বাবা কী করবেন! তাড়াতাড়ি তাকে ফার্মেসিতে নিয়ে গিয়ে বেন্ডিস করিয়ে এটিএস পুশ করে নিয়ে এলেন।
এই তো গতবারের আরেকটি ঘটনা। বাবা করলেন কী! বুবুনকে নিয়ে পড়তে বসলেন। বাবার ফেভারিট সাবজেক্ট ইংলিশ। অনর্গল তিনি ইংলিশ বলেন। ছেলেকে তিনি ইংরেজি জিজ্ঞেস করতে লাগলেন। বুবুন গেল ঘাবড়ে। ‘সে যায়, সে গিয়েছিল, যাবে, যেতে থাকবে’ জিজ্ঞেস করায় বুবুন ভুল উত্তর করল। তিনি শুধরিয়ে দিলেন। কিন্তু যেইমাত্র বুবুন পুটকে পাট উচ্চারণ করল, বাবা গেলেন বিগড়ে। বিগড়ে গিয়ে অভিনব শাস্তি দিলেন। বললেন,‘সারাদিন কার লগে আসলে?’ বুবুন নির্দ্বিধায় বিএসসি ফেল জুবের ভাইয়ের কথা বলে গেল। বাবা বললেন,‘যা, জুবেরোর কাছ তাকি হিকি আয়।’ বুবুন কেঁদেকেটে তার জুবের ভাইয়ের কাছে গিয়ে সেদিনের ইংরেজি পড়া মুখস্থ করে এলো।
বুবুনের যত আব্দার সব তার মায়ের সঙ্গে। মাকে সে ভীষণ ভালোবাসে। স্কুলে যাওয়ার প্রাক্কালে মাকে আদর দিয়ে যে কতবার বলে ওঠে, ‘আম্মা যাই। আম্মা যাই।’ তার কোনো ইয়ত্তা নেই।
মা কথা দেন বাবাকে বলবেন।
পশ্চিম দিক থেকে ভেঁপু বাজিয়ে মাল বোঝাই একটা কার্গো আর লঞ্চ আসতে দেখা গেল। কে একজন বুবুনকে জিজ্ঞেস করল,‘এই খোকা, লঞ্চ কোত্থেকে আসছে, জানো?’ ইঁচড়ে পাকা বুবুন সব জানে। সে শুনেও শুনল না। লোকটি আবার জিজ্ঞেস করায় সে নদীর দিকে তাকিয়ে উত্তর করল,‘লঞ্চ এসেছে সুনামগঞ্জ থেকে, আর কার্গো এসেছে ছাতক থেকে।’ সে ভালো ক্যালকেশিয়ান জানে। তার নদীয়া রানাঘাটের বন্ধুর কাছ থেকে সে শিখে নিয়েছে। লোকটি অবাক দৃষ্টি মেলে তাকিয়ে যেদিক থেকে এসেছিল, সেদিকেই চলে গেল।
খেয়ানৌকা এপারে ঘাটে ভিড়তেই বুবুনকে হতাশ করে দিয়ে মধ্যবয়সী লোকটি তাঁর গন্তব্যের দিকে রওয়ানা হয়ে গেল।
বুবুন গেল না। একমনে দাঁড়িয়ে থেকে অপেক্ষা করতে লাগল।
অবশেষে, বাবা এলেন। বুবুন আর দাঁড়ালো না। বাবাকে দেখে দৌড়ে গিয়ে বাসায় ঢুকে গেল।
২
বুবুন নতুন গেঞ্জি পরে আছে। এখন বিকেল। মিনিট পনেরো হয় আজান হয়েছে। বুবুন দেয়াল ঘড়িটার দিকে একবার দেখে নিল। পাঁচটা বাজে। আর পনেরো মিনিট বাদে সোয়া পাঁচটার দিকে সে বেরিয়ে যেতে পারবে। আজে খেয়েদেয়ে দুপুর বেলা বেরিয়ে যেতে চেয়েছিল। বাবার চোখের দিকে তাকিয়ে সে আর অনুমতি পায়নি।
জানালা দিয়ে উকি মেরে তেঁতুল গাছটির দিকে তাকাতেই বুবুন কেইচুর বাবুটাকে দেখতে পেল। কেইচুর বাবু দাঁড়িয়ে তার অপেক্ষায় রয়েছে। বুবুনের মুখাবয়বে আনন্দের একটা ঝিলিক খেলে গেল। সে মুষ্টিবদ্ধ করে চাল নিয়ে বারান্দায় যেতেই মুরগিটা দৌড়ে এসে লাফিয়ে লাফিয়ে চাল খেতে লাগল। চাল খাওয়া শেষ হলে বুবুন মুরগিটাকে কোলে নিয়ে আদর করতে করতে তেঁতুলতলায় ছেড়ে দিয়ে হেঁটে হেঁটে নিউসাইডে চলে গেল।
কেইচুর বাবুর সঙ্গে বুবুনের এ সম্পর্ক মা মুরগিটার বাচ্চা ফোটানোর পর থেকেই। বাচ্চাটি ক্রমান্বয়ে বড় হয়ে মুরগি হতে হতে পোষ মেনে নিয়েছে।
এই তো সেদিন দুপুরবেলার ঘটনা। বুবুনের মা কেবল গোসল সেরে বেরিয়েছেন, দরজায় নক করার শব্দ শুনে এগিয়ে গিয়ে দরজা খুলে তাজ্জব বনে গেলেন। দেখেন, মুরগিটি দাঁড়িয়ে ঠোঁট দিয়ে দরজা ঠোকরাচ্ছে। বুবুনের মা চাল নিয়ে এসে খেতে দিলেন। খেয়ে মুরগিটা চলে গেল।
৩
বুবুন মাঠে দাঁড়িয়ে আছে। সেলিম বুবুনের গেঞ্জি প্রশংসায় পঞ্চমুখ।
‘এই কত দিয়ে কিনলি রে?’
‘জানি না। বাবা এনেছেন।’
‘বাবা এনেছেন তাই বলে কি দাম জিজ্ঞেস করবি না!’
বুবুন কোনো উত্তর করল না। চুপ করে থাকল।
‘এই তুই তোর বাবাকে এত ভয় করিস কেন রে!’
মোটরসাইকেলের শব্দে বুবুনের কথা বোঝা গেল না। বুবুন পেছনে ফিরে তাকাতেই মোশতাককে দেখতে পেল। মোশতাক বাইক চালিয়ে এসেছে। এইটুকুন ছেলের বাইক চালানো সকলেই হা করে দেখছে! বুবুন আশ্চর্য হলো না। মোশতাক তো ক্লাস ফোর থেকে বাইক চালায়। বাইকটি অবশ্য ওর না। ওর শামিম ভাইয়ের। ওর শামিম ভাই বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বাড়ি এসে ফিফটি সিসি নিয়ে মাসে মাসে ওদের ওখানে আসেন। আর মোশতাক সুযোগ পেয়ে ওঁর ফিফটি নিয়ে এদিক-ওদিক ঘুরে। শামিম ভাই তো আসেন ওর বোনকে দেখতে!
মোশতাক বাইক থেকে নেমে বুবুনকে দেখে এগিয়ে যেতেই পেছনে কুকুর দেখে বুবুন ভয়ে সরে গেল। কুকুর দেখলেই আতঙ্কে নীল হয়ে যায় বুবুন।
মোশতাক কুকুরটিকে সরিয়ে দিয়ে বুবুনের দিকে তাকিয়ে মাঠে নেমে গেল।
ফুটবল খেলা শুরু হলো। বুবুন, মোশতাক, শাহেদ একপক্ষে, আর সেলিম, নাকচুকা স্টেটবাস, সুয়েদ অপরপক্ষে। খেলা শুরু হওয়ার মিনিট কুড়ির মধ্যে বুবুন দুজনকে কাটিয়ে ডজ দিয়ে সম্মুখে এগিয়ে গিয়ে গোল করতেই অফসাইড নিয়ে প্রথমে হট্টগোল, তারপর মারামারি শুরু হলে সেলিম কোত্থেকে একটা লাঠি নিয়ে এসে বিপক্ষের সকলকে দৌড়ে তাড়িয়ে দিল।
৪
বুবুন স্কুল থেকে ফিরছে। সে গিরিশ চন্দ্র হাই স্কুলের ষষ্ঠ শ্রেণির ছাত্র। আজ সে হেঁটে হেঁটে কিন ব্রিজ দিয়ে ফিরছে। সে একেকদিন একেক পথ দিয়ে স্কুলে যায় আর ফেরে ভিন্ন পথ দিয়ে।
সে ব্রিজের উপরে উঠে একটা মেয়েকে আত্মহত্যার চেষ্টা করতে দেখে বিস্ময়ে বিস্মিত হয়ে গেল! সে ভেবে পেল না, মেয়েটি কেন এমনটি করছে! মেয়েটি নদীতে ঝাপ দেয়ার আগ মুহূর্তে রেলিংয়ে উঠবার চেষ্টাচরিত্র করতেই লোকজন তাকে ধরে নিবৃত্ত করতে সক্ষম হলো। সে কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে থেকে ব্যাপারটি বোঝার চেষ্টা করতেই মোশতাককে বাইসাইকেল চালিয়ে আসতে দেখে তার ক্যারিয়ারে বসে নদী পার হয়ে ডানদিকে মোড় নিয়ে বাবনা হয়ে সোজা বাসার সম্মুখে নামতেই কেইচুর বাবু তেঁতুলতলা থেকে দৌড়ে এসে তার কোলে উঠে গেল।
এই তো বুবুন গতবার ঢাকার মালিবাগে তার ফুফাতো ভাইয়ের বাসায় সপ্তাহ খানেক থেকে এসে মায়ের কাছে শুনে কেইচুর বাবু প্রতিদিন বিছানায় উঠে কুটকুট করে ডেকে তাকে খুঁজেছে। তখন বুবুন আর নিজেকে ধরে রাখতে পারেনি। অঝোরে কেঁদেছে।
বুবুন ঘরে ঢুকে মুখহাত ধুঁয়ে খেয়েদেয়ে আর দেরি করে না। বেরিয়ে যায়। খেলতে হবে। তারপর সন্ধের পর পলিটেকনিক অডিটরিয়ামে নাটক দেখতে হবে। এসব ব্যাপারে বুবুনের বাবার কোনো বাঁধা নেই। বরং তিনি উৎসাহ দেন। এই তো গতবার বার্ষিক পরীক্ষা শেষ হলে বুবুন বাবাকে বলল সে সিনেমা দেখবে। বাবা তাঁর পিয়নকে দিয়ে সিনেমা হলে মেটিনি শোতে পাঠিয়ে দিলেন। পিওন করল কী, আমরা প্রথমে বসে দেখব বলে থার্ড ক্লাসে বসিয়ে লালকুঠি সিনেমা হলে রোজিনার রাজমহল ছবিটি দেখিয়ে নিয়ে এলো।
বুবুন আজ খেলতে গেল না। কোত্থেকে একটা লাঠি যোগাড় করে মেঠো রাস্তার উপর বসে পড়ল। আজ সেলিম এই রাস্তা দিয়ে যাবে। বদলা নিতে হবে। ভাবতে ভাবতেই সেলিম এসে বুবুনের সম্মুখ দিয়ে যেতে লাগল। বুবুন লাঠি দিয়ে এক ঘা মেরে সেলিমকে দৌড়াতে দৌড়াতে নিউসাইডে তাদের এলাকায় পাঠিয়ে দিয়ে এলো।
এবং সন্ধের পর বুবুন বাবাকে বলে অডিটরিয়ামে নাটক দেখতে চলে গেল। বৌদির বিয়ে নাটক শুরু হওয়ার কিছুক্ষণের মধ্যে কী একটা ঘটনা নিয়ে হৈ-হুল্লোড় শুরু হতে না হতেই মুহূর্তের মধ্যে বিদ্যুৎ চলে গেলে উত্তেজনা চরমে উঠল। উত্তেজনা কিছুটা প্রশমিত হয়ে বিদ্যুৎ চলে আসতেই পুনরায় নাটক শুরু হলে একদল যুবক ‘এই সুইস অফ করলে কেন?’ বলে স্টেজে পচা ডিম নিক্ষেপ করতে থাকলে মারামারি লেগে নাটক প- হয়ে গেল।
বুবুনের আর নাটক দেখা হলো না।
সে দৌড়ে বাসায় চলে এলো।
৫
বুবুন ক্লাসে বসে আছে। ফার্স্ট পিরিয়ড সবেমাত্র শেষ হয়েছে। সুবুধ, দবির, লক্ষ্মণ রবিদাস দরজার সম্মুখে বারান্দায় দাঁড়িয়ে হৈ-হুল্লোড় করছে। স্যারকে আসতে দেখে ভেতরে ঢুকে সুবুধ‘পাগলা রাজা স্যার আইরা, পাগলা রাজা স্যার আইরা। কিপ সাইলেন্ট। কিপ সাইলেন্ট।’ বলে ইশারা দিয়ে সুবোধ হয়ে গেল।
ইংরেজির এই স্যারকে সকলে যমের মতো ভয় করে। প্রশ্ন করে কোনো উত্তর না পেলে তিনি মারতে মারতে উম্মাদের মতো হয়ে যান।
পাগলা রাজা স্যার মিনিট পনেরো মতো পড়িয়েই বুবুনকে বললেন,‘ইউ স্ট্যান্ড আপ।’ বুবুন দাঁড়াল কিন্তু ভড়কে গেল না। পুরো ক্লাস জুড়ে তখন পিনপতন নীরবতা বিরাজ করছে। বুবুনের পাশে বসা বিহারি কিশোর আনজুম ইকবালের ঠোঁট ভয়ে কাপতে লাগল।
স্যার বললেন, ‘তুমি আসিরায় (হাসছো) কেনে!’
‘স্যার আফনারে দেকিয়া সবে ভয় পাইয়া ভড়কে গেছে। ওতারলাগি আসিয়ার স্যার।’
উত্তর পেয়ে স্যার বুবুনকে আর কিছু বললেন না। ‘বও’ বলে পড়াতে মনোযোগ দিলেন। সকলেই হাঁফ ছেড়ে বাঁচল।
ছুটি শেষে সে কিপ সাইলেন্টের অর্থ ভাবতে ভাবতে সারদা হলের সম্মুখ দিয়ে হাঁটতে হাঁটতে পূর্ব কাজিরবাজার গোদারঘাট পার হয়ে বাসায় পৌঁছল। কেইচুর বাবু পূর্বের মতো দৌড়ে এসে কোলে উঠে বুবুনের সঙ্গে বাসায় প্রবেশ করল।
৬
কদিন ভ্যাপসা গরম চলার পর সকাল থেকে আজ মুষলধারে বৃষ্টি হচ্ছে। আষাঢ়ের বৃষ্টি। কোলা ব্যাঙগুলো তারস্বরে দিগি¦দিক কাঁপিয়ে ডাকতে শুরু করেছে।
বুবুনের মন খারাপ হয়ে আছে। মা তাকে আজ স্কুলে যেতে দেননি। বরং মেরেছেন। ভীষণ মেরেছেন। ঘটনা হলো, বুবুন তার আপার সঙ্গে মারামারি করে আপাকে কিলিয়ে তারপর মুখে থুতু ছিটিয়ে দিয়েছে। আপা বুবুনের সঙ্গে না পেরে খামচি দিয়ে বুবুনের মুখ থেকে রক্ত বের করে ফেলেছে। এই ঘটনা নিয়ে মা বুবুনকে ভীষণ মেরেছেন, আর শুচিকে বকেছেন। ব্যস। বুবুন নিজেকে আর ধরে রাখতে পারেনি। হাউমাউ করে কেঁদেছে। বুবুনের কান্না আর বৃষ্টির কান্না এক হয়ে করুণ সুরের অনুরণন উঠেছে ঘরময়।
বিকেল বেলা বাবা তার আপিস থেকে ফিরে সব শুনে নিশ্চুপ হয়ে গেছেন। বৃষ্টি একটু ছাড়তেই বুবুন বাইরে গিয়ে বাসার ভাব বুঝে তাড়াতাড়ি ফিরে এসে সন্ধে মিলিয়ে যেতেই হাতমুখ ধুঁয়ে পড়তে বসে গেল।
বাবা আর কিছু বললেন না। তাঁর রাগ পড়ে গেছে।
তিনি নিজের লেখা ও সুর করা ‘ওমন ভাইবা দেখো কলিতে মন ভাইবা দেখো কলিতে, মনের মানুষ নাই জগতে’ বলে গেয়ে উঠলেন। বুবুন আনন্দে আস্তে হাততালি দিয়ে উঠল।
৭
বর্ষার তা-বে মাঠঘাট ডুবে বন্যা হয়ে গেছে। চারদিকে পানি থই থই করছে। সপ্তাহ দিন জুড়ে বৃষ্টি হওয়ায় এমন পরিস্থিতির উদ্ভব হয়েছে। আর কদিন বৃষ্টি হলে পুরো শহর ডুবে যাবে। সুরমার পানি বুবুনদের বাসার সম্মুখে চলে এসেছে। মোশতাক এসে জানিয়েছে তাদের বাসা কোমর সমান পানিতে তলিয়ে গেছে। তারা ধরাধরপুর গ্রামের বাড়ি চলে যাচ্ছে।
বৃষ্টি একটু ধরতেই বুবুন বেরিয়ে পড়ল। স্টাফ কোয়াটার্স থেকে মাইল দুয়েক দূরে নয়াবাজারে বন্যা নিয়ন্ত্রণ বাঁধ চুইয়ে আউশ ক্ষেতে পানি ঢুকতে শুরু করেছে। বুবুন নয়াবাজারে গিয়ে স্বচক্ষে সবকিছু প্রত্যক্ষ করে তারপর কলাপাড়া ঘাট হয়ে ওপারে গিয়ে লক্ষ্মণ রবিদাসের বাড়ি হয়ে হাঁটু পানি ডিঙ্গিয়ে কাজিরবাজারে এসে নদী পার হয়ে বাসায় ফিরে এলো।
বাবা জিজ্ঞেস করলেন,‘কিতারে সাংবাদিক! কিতা খবর আনলে?’
বুবুন স্ববিস্তারে সবকিছু বর্ণনা করে বলল,‘মার্শাল্লা অ্যাডমিনিস্টার নয়াবাজার ঘুরে গেসইন। সেখঘাট, কলাপাড়া সব ডুবি গেছে।’
বাবা আর কিছু জিজ্ঞেস করলেন না। ভরা বর্ষায় এভাবে নদী পাড়ি দিয়ে যাওয়া-আসা সামান্যতম হলেও তাঁর মনে আতঙ্ক সৃষ্টি করল। কিন্তু তিনি কিছু বললেন না। সাহসী হওয়া দরকার আছে।
৮
শরৎ এসে গেছে। সকালে ঘাসগুলো শিশির গায়ে মেখে যেন ¯œান সারছে। নিউসাইডের মাঠের কাঁশবন সাদায় সাদা হয়ে আছে যেন আকাশ থেকে সাদা মেঘ দিগন্তে নেমে এসেছে।
বুবুনের পরীক্ষার আর মাস দুয়েক বাকি। সবকিছু ঝেরে ফেলে দিয়ে বুবুন ক্লোজ ডোর ননস্টপ রিডিং শুরু করতে না করতেই তার বাবা অসুস্থ হয়ে পড়লেন। বুকের প্রচ- ব্যথায় কুঁকড়ে উঠে সদ্য স্থানান্তরিত কাজল শাহ এলাকায় মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে একনাগাড়ে মাসাধিকাল কাটিয়ে সুস্থ হয়ে ফিরে এলেন।
তার পড়াশোনায় দারুণ ব্যাঘাত ঘটে গেল।
বাবা একদিন অফিস থেকে তাঁর মেজো মেয়ের চিঠি নিয়ে ফিরলেন। ইনভেলারের উপর লেখা দেখে বুবুন বুঝে গেল রাঙাদির চিঠি। চিঠি পড়ে জানা গেল, রাঙাদি আগামী জানুয়ারি মাসে আসছেন।
বুবুনের আনন্দ আর ধরে না। সে চিৎকার করে ‘রাঙাদি আইরা, রাঙাদি আইরা’ বলতে বলতে বেরিয়ে গেল।
৯
জানুয়ারি মাস। বুবুন ক্লাস সেভেনে উঠেছে। সকল বিষয়ে ভালো করে শুধু ইংরেজির জন্যে রেগুলার পাস করা হয়নি তার।
কদিন থেকে বুবুন স্কুলে যাচ্ছে না। প্রথম কয়েকদিন গিয়েছিল। স্যারেরা তেমন ক্লাস নিচ্ছেন না। একদিন সে তার ক্লাসটিচারকে এ ব্যাপারে প্রশ্ন করায় তিনি ধমক দিয়ে বললেন,‘এই বেটা বিদ্যাসাগর। কয়দিন পর আয়।’ বুবুন লজ্জায় গুটিয়ে গেল।
কেইচুর বাবুকে নিয়ে বুবুনের এখন সময় কেটে যাচ্ছে। সারাদিন সে একটি নির্দিষ্ট সময়ে পালাক্রমে কেইচুর বাবুকে চাল খাওয়াচ্ছে। গোসল করাচ্ছে। চাল ছাড়া কেইচুর বাবু আর কিছুই খায় না।
একদিন সকালবেলা ঘুম থেকে উঠে বুবুন রাঙাদিকে দেখতে পেয়ে আনন্দে আত্মহারা হয়ে গেল। ভাগ্নে রানাকে কোলে নিয়ে কিছুক্ষণ খেলে তারপর দৌড়ে মোশতাকের বাসায় গেল। আহা কী আনন্দ আকাশে-বাতাসে। কিন্তু বুবুনের এই আনন্দ বেশিদিন স্থায়ী হলো না। রাঙাদি আসার দিন সাতেক পরে একদুপুরে সকলের অলক্ষ্যে রানাকে নিয়ে তিনতলা বিল্ডিংয়ের পেছনে যে পুকুর রয়েছে সেখানে আজিজ চাচার ছিপ দিয়ে মাছ ধরা দেখতে গিয়ে সেলিমকে পেয়ে রানাকে বসিয়ে রেখে দুজনে গোসলে নেমে লাই খেলতে লাগল। মামা গোসলে নামতেই শিশু রানা হেঁটে সম্মুখে গিয়ে পুকুরের দিকে উকি মারতেই পা পিছলে গড়িয়ে পুকুরে পড়ে গেল। মিনিট পনেরো লাই খেলে বুবুন যখন উঠল তখন আর রানা নেই। হৈ-হুল্লোড়, চিৎকার-চেঁচামেচির মধ্যে খবর পেয়ে সকলেই দৌড়ে এলেন। বাবা-মায়ের বুকফাটা আর্তনাদে আকাশ-বাতাস ভারি হয়ে গেল। কিন্তু রানাকে আর খুঁজে পাওয়া গেল না।
বিকেলের দিকে লাশ ভেসে উঠল।
রাঙাদি দু’মাস থেকে কেঁদেকেটে বাড়ি ফিরে গেলেন।
বুবুনের মন থেকে অপরাধবোধটা গেল না। তার মন ভেঙ্গে গেল।
একসময়ে প্রকৃতির নিয়মে সবকিছু স্বাভাবিক হয়ে এলো।
বুবুন এখর রীতিমত স্কুলে যায়। বিকেল বেলা এসে কেইচুর বাবুকে কোলে নিয়ে চালও খাওয়ায়।
কিন্তু বুবুনের আনন্দ বেশিদিন হলো না। একদিন রাতের বেলা বুবুনের বাবা আবার বুকের ব্যথায় কুঁকড়ে উঠলেন। সারারাত এভাবেই চলল। সকালবেলায় আরামবোধ করলেন। রাতে আবার ব্যথা উঠল। এভাবে মাসাধিকাল কাটল। ডাক্তার-কবিরাজে কোনো কাজ হলো না।
অবশেষে, একদিন ভোররাতে তিনি শান্ত হলেন। তাঁর দেউটি নিভে গেল।
কিশোর বুবুন অসহায় হয়ে পড়ল। মা আর বোনেরা ছাড়া তার আর কেউ রইল না। আর্থিক সংকট তীব্রভাবে ধেয়ে আসার সঙ্গে সঙ্গে পড়াশোনায়ও বিপর্যয় নেমে এলো। শেষমেশ, স্কুল কর্তৃপক্ষের বদান্যতায় ফুল ফ্রি স্টুডেন্টশিপ পাওয়ায় পড়াশোনায় আর তেমন গ-গোল হলো না।
কদিন পর মা তার কেইচুর বাবুকে হঠাৎ সদগা দিয়ে দিলেন।
বুবুন মুচড়ে পড়ল।
বুবুন এখন স্কুলে যায়। আসে। কারো সঙ্গে তেমন একটা কথা বলে না। একদিন পাগলা রাজা স্যার উদোরপি-ি বুদোর ঘাড়ে চাপিয়ে বুবুনকে সকলের সম্মুখে জিজ্ঞেস করে বসলেন, ‘এই তুই পুয়োর ফান্ড থেকে ফুল ফ্রী স্টুডেন্টশিপ নিয়ে পড়িস না! তাইলে বেয়াদবি করিস কেন!’
আমাদের বুবুন একেবারে ভেঙ্গে পড়ল। তারপর সে লক্ষ্মণ রবিদাসকে পেয়ে একটি কথাই বলল,‘গরিব হওয়া অপরাধ না রে লক্ষ্মণ। অপরাধ না।’
তারপর কাঁদতে কাঁদতে বাসার উদ্দেশে রওয়ানা হয়ে গেল।