অলস দিনের হাওয়া
মতিয়ার রহমান পাটোয়ারী
১৮ অক্টোবর ধানমন্ডির ২৭ নম্বর রোডে বেঙ্গল শিল্পালয়ে গিয়েছিলাম ছেলেসহ সৈয়দ মনজুরুল ইসলামের স্মরণ সভায়। বক্তার সংখ্যা ছিলেন সীমিত। সেদিন সন্ধ্যায় বক্তারা তাঁর নানা দিক তুলেছেন। সবগুলো আকর্ষনীয় দিক। পত্রপত্রিকায় তার ওপর দুটি লেখাও পড়েছি। ফেরার পথে ভাবলাম, তাকে নিয়ে সামান্য হলেও কিছু তো লিখতে হয়।
আমি তার একনিষ্ঠ গুণগ্রাহী যে ছিলাম তা হয়ত তিনি জানতেন না। তাকে প্রথম দেখেছি জাতীয় প্রেসক্লাবে। তিনি মাঝেমাঝে আসতেন কবি হেলাল হাফিজের কাছে। তার সঙ্গে কথা বলে চলে যেতেন। আজ থেকে প্রায় চব্বিশ-পঁচিশ বছর আগে তার সঙ্গে কথা হয়েছিল বাংলা একাডেমির পুকুরের উত্তর পাশে। হাঁটতে হাঁটতে কথা হয়েছিল। এর পর ২০২৪ সালে বেঙ্গল শিল্পালয়ে কথা হয়েছিল। দু’বারই
খুবই সংক্ষিপ্ত কথা। এ কথার বিষয়ে পরে আসছি।
সৈয়দ মনজুরুল ইসলাম ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইংরেজি সাহিত্যের প্রণোজ্জ্বল শিক্ষক ছিলেন। কিন্তু তিনি শুধু ইংরেজি সাহিত্যের ছাত্রদের কাছে প্রিয় শিক্ষক ছিলেন না। তিনি বাংলা সাহিত্যের অনেক ছাত্রছাত্রীর কাছে অতীব প্রিয় শিক্ষক ছিলেন। সাহিত্যের ছাত্রছাত্রী ছাড়াও সাহিত্য অনুরাগীদের কাছে ভালবাসার লোক ছিলেন। কারণ অনেকে তার লেখা পড়ে বিশ্বসাহিত্যে প্রবেশ করতে সক্ষম হয়েছিলেন। বিশ্বসাহিত্য সম্পর্কে জানা বা বোঝার এবং অনুভব করা সহজ বিষয় নয়। বিশ্বসাহিত্যের ভেতরে অনুপ্রবেশ করতে হলে অনুশীলনের দরকার। এমনকি বাংলা সাহিত্যে লেখাপড়া করলেও কারো কারো পক্ষে বিশ্বসাহিত্যে সম্পর্কে জানা সম্ভব হয় না। কারণ বাংলা সাহিত্যের পাঠ্যসূচিতে বিশ্বসাহিত্যের খুব কমসংখ্যক বই থাকে। যেমন, আমাদের সময় অনার্স কোর্সে পাঠ্যসূচির মধ্যে বিশ্ব সাহিত্য ছিল সফোক্লিসের ইডিপাস, ওমর খৈয়ামের রুবায়েৎ ও কালিদাসের শকুন্তলা। একটি ইংরেজি, একটি ফার্সি এবং একটি সংস্কৃত থেকে বাংলায় অনুবাদ পড়ানো হয়েছিল। মাস্টার্সে পাঠ্যসূচিতে বিশ্বসাহিত্য ছিল না। এই তিনটি বই পড়ে কি বিশ্বসাহিত্য সম্পর্কে জানা সম্ভব? না, সম্ভব নয়।
খোলাসা করে বলি, আমাদের রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগের শিক্ষকদের দু’একজন শিক্ষক ছাড়া টিএস এলিয়ট,ডব্লিউ বি ইয়েটস বা সিলভিয়া প্লাথের নামই জানতেন না। তাদের কাছ থেকে ইংরেজি, আফ্রিকান এবং ল্যাটিন আমেরিকান লেখক-কবিদের নাম জানার কথা নয়। এমনকি ভারতীয় বংশোদ্ভূত ইংরেজি ভাষার লেখক সালমান রুশদি সম্পকের্ও তারা জানতেন না। আর শিল্পকলা সম্পর্কে তারা অন্ধকারের বাসিন্দা। হয়তবা জানলেও জানতে পারেন বঙ্গসন্তান শিল্পী জয়নুল আবেদিনের কথা। আর সেখানকার ছাত্ররা তাদের কাছ থেকে শিল্পকলা সম্পর্কে কী-বা জানবে। আগ্রহ থাকলেও জানার সুযোগ কম। (পরবর্তীতে সেখানে শিল্পকলা বিভাগ খোলা হয়)। যাদের শিল্পের বিভিন্ন শাখা সম্পর্কে জানার অদম্য ইচ্ছে থাকে তারা নানাভাবে সে ইচ্ছে পূরণ করে। ছাত্রাবস্থায় আমাদের মতো সাহিত্য অনুরাগীরা যা আহরণ করতে পারিনি তা পরবর্তীতে দৈনিক সংবাদে সৈয়দ মনজুরুল ইসলামের ধারাবাহিক লেখা ‘অলস দিনের হাওয়া’ পূরণ করতে পেরেছে। তিনি বিশ্বসাহিত্যের ধারণা, উপলদ্ধি ও সৌন্দর্য বোধ মুখের সামনে এনে দিয়েছেন। তাই উনি আমাদের বাংলা বিভাগের শিক্ষক না হয়েও বাংলা বিভাগের অনেকের কাছে শিক্ষক হিসেবে রয়ে গেলেন।
অনেকের মতো আমাকেও ‘অলস দিনের হাওয়া’ এক ঘোরের মধ্যে ফেলে দিয়েছিল। প্রতি বৃহস্পতিবার সংবাদের সাহিত্য সাময়িকীর পাতায় প্রকাশ হতো। লেখাটি একটা পড়ার পর আরেকটা লেখা পড়ার জন্য অপেক্ষায় থাকতাম। বৃহস্পতিবার যদি পড়ার সুযোগ না হতো তাহলে পরে চলে যেতাম বন্ধু মুহম্মদ রবীউল আলমের সাপ্তাহিক মুক্তিবাণী পত্রিকার অফিসে। সেখানে দৈনিক সংবাদের ফাইল থাকত। তার লেখার মধ্যে শুধু সাহিত্য সম্পর্কিত ছিল না, থাকত শিল্পকলা, উত্তর আধুনিকতা, ঔপনিবেশিক সাহিত্য তত্ত্ব, সাহিত্য রীতি, প্রয়োগ, পদ্ধতি এবং ম্যাজিক রিয়েলিটি। এ সবের কতকটা বুঝি এবং আরও বুঝতে চেষ্টা করছি। কারণ এসব সম্পর্কে আমার ধারণা সীমিত। বাড়িতে ইংরেজি সাহিত্যের অনেক বই ছিল। কিন্তু সেগুলো পড়ার যোগ্যতা ছিল না। গোর্কির অনূদিত তিনটি, মলিয়েরের নাটক ছাড়া বাংলায় বিশ্বসাহিত্য পড়ার মতো বই ছিল না। পরে মোবাশ্বের আলীর বিশ্বসাহিত্য (তখন সীমিত পরিসরে ছিল) শেক্সপিয়রের কয়েকটি নাটক স্ট্রিনবার্গের মিস জুলি নাটক এবং সৈয়দ আলী আহসানের অনুবাদ জার্মান সাহিত্য- এই পর্যন্ত বিশ্বসাহিত্য জগতে আমার দৌঁড়। অলস দিনের হাওয়া বিশ্বসাহিত্যের ধারণা এগিয়ে দিয়েছে।
সৈয়দ মনজুরুল ইসলামের সঙ্গে বাংলা একাডেমিতে প্রথম কথা হয়েছিল তারই এক লেখা নিয়ে। এক লেখক একজন কাঠমিস্ত্রির জীবন কাহিনী নিয়ে একটি উপন্যাস লিখেছিলেন। উপন্যাসটি বেস্ট সেলারে পরিণত হয় এবং একটি বড় পুরস্কারও পায়। লেখক পুরস্কারের টাকা কাঠমিস্ত্রির সঙ্গে ভাগাভাগি করে নেন। সৈয়দ মনজুরুল ইসলাম এই লেখাটি ছাপার কিছুদিন পর টাইম ম্যাগাজিনের এক রিপোর্টেরে ভিত্তিতে কলকাতার দেশ পত্রিকা একটি সম্পাদকীয় লেখে। সম্পাদকীয়র বিষয় হলো মানুষের অমরত্ব লাভের বাসনা। এই অমরত্ব লাভের আকাক্সক্ষা কোনো ব্যক্তির কৃতকর্মের জন্য নয়। শুধু তার নামটি ব্যবহার করে তিনি অমরত্ব লাভ করতে চান। ব্যক্তি তার শুধু নাম ব্যবহার করে স্মরণীয়-বরণীয় করতে চাইলে লেখকের শরণাপন্ন হতে হয়। হ্যাঁ বিষয়টা তাই ঘটেছে। ইংলন্ডে ইংরেজি ভাষায় যারা উপন্যাস লিখেন তাদের কাছে কয়েকজন পুরুষ ও মহিলা শরণাপন্ন হন। লেখকের লেখা উপন্যাসে যেন তাদের নামটি ব্যবহার করা হয়। এ জন্য তারা অর্থ ব্যয় করতেও রাজি। কোনো কোনো লেখকের কাছে গিয়েছিল অমরত্ব লাভের পিয়াসিরা।যারা গিয়েছিল সে সব লেখকের নামও প্রকাশ করা হয় দেশ পত্রিকায় সম্পাদকীয়তে। আমি বইমেলায় সৈয়দ মনজুরুল ইসলামকে কাঠমিস্ত্রির জীবন কাহিনী নিয়ে লেখা ঔপন্যাসিকের নাম জিজ্ঞাসা করেছিলাম, লেখকের নামটি কী? তিনি একটু চিন্তা করলেন। তারপর বললেন, নামটি মনে পড়ছে না। ভাবলাম উনি এত বই নিয়ে ঘাঁটাঘাটি করেন, তার কি সব নাম মনে থাকে? আমি যে তাকে নামটি জিজ্ঞাসা করেছিলামতা কিউরিসিটির জন্য নয়,প্রয়োজনে। দেশের সম্পাদকীয়টি পড়ার পর আমি একটি লেখার জন্য উদ্বুদ্ধ হয়েছিলাম। (স্বীকার করছি দেশ পত্রিকার তখন দাম ছিল বিশ টাকা। আমার কাছে টাকা ছিল না। কিন্তু পত্রিকাটি আমার দরকার, একথা বাংলাদেশ ফেডারেল সাংবাদিক ইউনিয়নের একাংশের বর্তমান সভাপতি ওমর ফারুক জানার পর পত্রিকাটি আমাকে কিনে দেন।) আমি ‘আকাশের দিকে’ নামের একটি গল্প লিখে দৈনিক জনকণ্ঠে পাঠিয়ে দেই। তারা লেখাটি একটি বিশেষ সংখ্যায় ছাপেন।
পরের বার তার সঙ্গে দেখা হয়েছিল কালি ও কলমে আমার লেখা ‘সতীশবাবুর অন্তর্ধান’ ছাপা হওয়ার পর। বিষয়টা আত্মশ্লাঘার মতো লাগলেও তবু বলছি। আমি এই গল্পটি লিখি আমার মেয়ে মালবিকা নাহারের জন্মের সময়। আর গল্পটি যখন ছাপা হয় তখন আমার মেয়ে ভারতেশ্বরী হোমসে এইচএসসি পরীক্ষা দিচ্ছে। লেখাটি দীর্ঘদিন ছাপা না হওয়ার কারণ রয়েছে। সেটি হলো লেখাটি আমি কোথাও ছাপতে দেইনি। গল্পটি ছাপবে না মিথগত কারণে, তা বোঝার পরও মাঝখানে গল্পটি দেশ পত্রিকায় পাঠিয়ে দিয়েছিলাম। তারা ছাপেননি। আর লেখাটি আমাদের দেশের পত্রপত্রিকায় পাঠাতে ইতস্তত বোধ করেছিলাম, যদি তারা না ছাপেন। এ বোধ আসার দুটি কারণ ছিল। আমি ‘বিলাপ’ নামের একটি গল্প বছরের পর বিভিন্ন পত্রপত্রিকায় (সংবাদ বাদে) পাঠিয়ে দেওয়ার পরও কেউ ছাপছেন না। এতে অবাক হচ্ছি এবং হোঁচট খাচ্ছি। এর ওপর যদি ‘সতীশবাবুর অন্তর্ধান’ নামের গল্পটি বিভিন্ন জায়গায় পাঠিয়ে দেই যদি তারা না ছাপেন,তাহলে আমি না লেখাটি অপমানিত হবে! আরো একটি কারণ ছিল লেখাটি না পাঠানোর, সেটা কথাশিল্পী নাসরিন জাহানের আচরণের জন্য। ফোনে তাকে একদিন বললাম,আমি অন্যদিনের ঈদসংখ্যায় ‘গন্ধবর্ণ’ নামের (উনি ঈদসংখ্যার দায়িত প্রাপ্ত) একটি বড় গল্প ছাপানোর জন্য দিতে চাই। উনি না করলেন না। বললেন না, লেখা সিলেক্ট হয়েছে আর সম্ভব নয়। উনি একটা মোবাইল নম্বর দিয়ে বললেন, ওই নাম্বারে যোগাযোগ করুন।
‘সতীশবাবুর অন্তর্ধান’ ছাপা হওয়ার পর দেখলাম, কালি ও কলমের অন লাইন পেজে সৈয়দ মনজুরুল ইসলাম তার নামের সঙ্গে গল্পটি ট্যাগ করেছেন। এর কিছুদিন পর বেঙ্গল শিল্পালয়ে এক অনুষ্ঠানে তার সঙ্গে দেখা হলে আমি তার দিকে হাত বাড়িয়ে আমার নামের কথা বললাম। উনি হাত মিলিয়ে বললেন, আমি আপনার লেখা পড়ি।
সবশেষে, সবাই জানেন, তিনি বিশ্বসাহিত্য, শিল্পকলা নিয়ে পা-িত্যপূর্ণ লেখা লিখেছেন। এবং পাঠককুলকে ঋদ্ধ করে গেছেন। শুধু কি তাই? রবীন্দ্রনাথের ‘ছিন্নপত্র’ নিয়ে এপার বাংলায়, ওপার বাংলার লেখক ও গবেষকরা নানাভাবে বিচার বিশ্লেষণ করেছেন। কিন্তু অলস দিনের হাওয়ায় সৈয়দ মনজুরুল ইসলাম যেভাবে ব্যাখা ও তাত্ত্বিক আলোচনা করেছেন তা অন্যদের থেকে আলাদা। ছিন্নপত্রের ওপর তার লেখাটি পড়লে মনে হয়, ছিন্নপত্র বিশ্বসাহিত্যের একটি অংশ।