image
উপন্যাস জুড়ে ছায়া, চুপচাপ পথচলা, চোখে চোখ রেখে চুপ থাকা- এসব অনুষঙ্গ বারবার আসে। এই ছায়া বলে দেয় সমাজ কীভাবে সত্যকে ঢাকে এবং মানুষ কীভাবে নিজের আবেগ, ভয় ও বিবেককে চেপে রাখে

সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহর ‘চাঁদের অমাবস্যা’

অন্ধকারের প্রতীকী ভাষার ব্যঞ্জনা ও অন্তর্লৌকিক সমাজবিশ্লেষণ

খাতুনে জান্নাত

শিল্প যখন জীবনের বোধকে ভাষার গভীর দ্যোতনা, অলঙ্কার ও বর্ণনার মাধুর্যে কাহিনিকে দার্শনিক জ্ঞানে ঋদ্ধ করে চিত্তকে থমকে দেয়, সেখানেই সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহর পরিচয় মেলে। বাংলা উপন্যাসে আধুনিকতা, মনস্তত্ত্ব এবং সমাজ-রাজনীতির সংমিশ্রণ ঘটিয়ে যে ক’জন লেখক সাহিত্যচর্চাকে গভীরতর ও নান্দনিক উচ্চতার উৎকর্ষে পৌঁছে দিয়েছেন, তাঁদের মধ্যে সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহ অন্যতম। তাঁর প্রথম উপন্যাস “লালসালু” যেমন ধর্মান্ধতার মুখোশ উন্মোচন করে, তেমনি “চাঁদের অমাবস্যা” একধরনের আত্মসমীক্ষণমূলক সাহিত্য, যেখানে সমাজ, নৈতিকতা, ব্যক্তিগত দুর্বলতা এবং ধর্মীয় কপটতার দ্বন্দ্ব উঠে আসে অনুপম প্রতীকী ভাষায়। উপন্যাসটি সমাজের উপরে চাপানো চাঁদের আলোকচ্ছটা সরিয়ে নিয়ে যায় সেই গভীর অমাবস্যায়, যেখানে মানুষ মুখোমুখি হয় নিজস্ব আঁধারের।

পটভূমি ও ন্যারেটিভ কাঠামো:

“চাঁদের অমাবস্যা”র ঘটনাপ্রবাহ আবর্তিত হয় একটি গ্রামীণ মুসলিম সমাজকে ঘিরে, যেখানে একটি নারীর মৃত্যু কেন্দ্রীয় ঘটনা হিসেবে দাঁড়ায়। এই মৃত্যুকে কেন্দ্র করে উঠে আসে সমাজের নানা অন্তর্দ্বন্দ্ব, গোপন পাপ, অপরাধবোধ এবং নৈতিক মূর্ছনা।

মূল ঘটনার সারাংশে দেখা যায়- দরবেশ কাদের, যে নারীর সঙ্গে কামজ প্রেমের সম্পর্ক ছিল, সে নারী বর্তমানে করিম মাঝির স্ত্রী। তারা বাঁশঝাড়ে গোপন শরীরবৃত্তীয় কাজের সময় কারও পায়ের আওয়াজ শুনতে পেয়ে কাদের তাকে চুপ করাতে গিয়ে শ্বাসরোধ করে ফেলে। কাদেরের কথা। ‘কেন মুখ না চেপে গলায় চাপ দিলাম?’ এ আক্ষেপ কাদেরের গভীর ভালোবাসা প্রসূত নয়, এ আক্ষেপ কামজ লালসার পরিসমাপ্তিই হতে পারে। দরবেশ কাদের দাদা সাহেব আলফাজ উদ্দিনের ভাই। যে বাড়িতে লজিং থাকে যুবক শিক্ষক আরেফ আলী। পরে আত্মরক্ষায় যুবক শিক্ষক আরেফ আলীর সাহায্যে লাশটি নদীতে ফেলে দেয়। কিন্তু সে লাশ গ্রামবাসীরা পেয়ে যায়। থানায় পোস্টমর্টেম করে ও নিয়মানুগ দাফন সম্পন্ন করে। ঘটনাটি যুবক শিক্ষককে গভীর ঘোরে ফেলে দেয়। গ্রামের লোক করিম মাঝিকেই অপরাধী ভাবে। মূলত যুবক শিক্ষকই এ উপন্যাসের কেন্দ্রীয় চরিত্র। তিনি অন্তর্মুখী, নিরীহ মানুষ। কষ্ট ও গভীর অন্তর্দ্বন্ধে নিজের সাথে নিজের ক্রমাগত দ্বন্ধযুদ্ধে লিপ্ত হন। তার বিবেক তাকে কষাঘাত করতে থাকে। মানুষের পারস্পরিক সম্পর্ক, সততা, বহিদৃশ্য এক আর আভ্যন্তরীণ আভরণ খুলে গেলে তা অন্যরূপে প্রকট হয়ে ধরা পড়ে। সাধারণত মানুষ ঢেকে রাখে। দরবেশ কাদেরও খুনী। অথচ তার পরিবারের বেশভূষা আভরণ ঝকঝকে। সম্মানিত পরিজন। প্রথম অবস্থায় তবুও যুবক শিক্ষক কাদেরকে ক্ষমা করে। কাদের প্রেমিক। খুন করা তার উদ্দেশ্য ছিল না। তবে কি সে নিজেও অপরাধী নয়?

আরেফ আলী এক গভীরভাবে বিভক্ত মানুষ। বাইরে থেকে একজন শিক্ষিত, শালীন, ধর্মবিশ্বাসী শিক্ষক। কিন্তু অন্তরে আছে ভয়, গ্লানি, অপরাধবোধ এবং দমনকৃত কামনা। নারীর মৃতদেহটি তাকে শারীরিকভাবে বিদ্বেষপূর্ণ মনে হলেও, একইসঙ্গে তার মধ্যে এক আকর্ষণ ও আতঙ্ক জন্মায়। সে নিজেই বুঝতে পারে না সে যা করল, তা নৈতিক না অনৈতিক।

সে প্রশ্ন তোলে:

“আমি কি পাপ করেছি?”

“আমি কি শুধু সমাজের ভয়ে সত্য গোপন করলাম?”

“নারীর শরীর কি ঘৃণার, না মোহের?”

এই প্রশ্নগুলোর উত্তর সে খুঁজতে খুঁজতে নিজের ভিতরে অসংখ্য ও উত্তরের দোলাচলে হাবুডুবু খেতে থাকে। যখন জানতে পারে তাদের প্রেমিক নয় কাম চরিতার্থ করতে এ কাজ করেছে কাদের দুটো অপরাধ করেছে একসঙ্গে। তখন যুবক শিক্ষক অন্তর্দহন থেকে মুক্তি পেতে দাদা সাহেবকে ও থানায় জানায়। কিন্তু ক্ষমতাশীলের হাতে দুর্বলের পরাজয় হয়। খুনের অপরাধী হয়ে যায় সৎ, বিবেকবান, নিরপরাধী যুবক শিক্ষক।

ওয়ালীউল্লাহ এই একটি ঘটনায় সমাজের নৈতিক ও শ্রেণিভিত্তিক জটিলতাকে বিশ্লেষণ করেছেন। এটি কেবল একটি অপরাধ কাহিনি নয়, বরং সমাজের প্রতিটি স্তরে জমে থাকা অস্পষ্ট, অপ্রকাশ্য, অথচ সর্বনাশা অন্ধকারের প্রকাশ। লোকদেখানো ধর্ম পালন ও অভিজাত্যের আড়ালে লুকিয়ে থাকা মিথ্যা, কপটতা ও স্বার্থপরতা কোন সমাজকে ভেতরে ভেতরে ক্ষয় করতে থাকে যা অপ্রতিরোধ্য।

প্রতীক ও চিত্রকল্পের ব্যঞ্জনা:

১. চাঁদের অমাবস্যা:

এই শিরোনামই উপন্যাসটির মূল চাবিকাঠি। চাঁদ যদি জ্যোতির প্রতীক হয়, তবে অমাবস্যা তার অনুপস্থিতি- অন্ধকারের প্রতীক। উপন্যাসের প্রতিটি চরিত্র একেকটি অমাবস্যায় আচ্ছন্ন সত্তা। আলোহীন, ভয়, অপরাধবোধ ও চেপে রাখা সত্যের গুমোট। চাঁদের অমাবস্যা তাই ব্যক্তি ও সমাজের আত্মিক দুর্বিসহতার রূপক।

২. নদী ও লাশ:

নদী এখানে পাপের গহ্বর, সমাজের চোখের আড়ালে সত্যকে গুম করে ফেলার প্রতীক। লাশ নদীতে ফেলে দেওয়া মানে সমাজ যা মেনে নিতে পারে না, তাকে আড়াল করে দেওয়া। কিন্তু সেই লাশ ভেসে ওঠে, মানে- সত্য একসময় নিজের পথ খুঁজে নেয়।

৩. ছায়া ও নিঃশব্দতা:

উপন্যাস জুড়ে ছায়া, চুপচাপ পথচলা, চোখে চোখ রেখে চুপ থাকা- এসব অনুষঙ্গ বারবার আসে। এই ছায়া বলে দেয় সমাজ কীভাবে সত্যকে ঢাকে এবং মানুষ কীভাবে নিজের আবেগ, ভয় ও বিবেককে চেপে রাখে।

ভাষা ও গদ্যশৈলী:

ওয়ালীউল্লাহর গদ্য মিতবাক, গভীর, ও বহুস্তরবিশিষ্ট। সংলাপে সংযম, বর্ণনায় নিসর্গের রহস্যময়তা এবং ভেতরের ভয়-আবেগের স্পন্দন একত্রে ধরা দেয়। উপন্যাসটি আবেগের উচ্ছ্বাসে নয়, বরং মলিন বিষণœতার চিত্রপট। তাঁর লেখনীতে সিনেম্যাটিক চিত্রকল্পের সঙ্গে থাকে দার্শনিক বোধ- যা এই উপন্যাসকে কেবল গল্প না রেখে একধরনের অস্তিত্ববাদী আলাপচারিতায় রূপ পরিগ্রহ হয়।

দার্শনিক পাঠ ও রাজনৈতিক ব্যঞ্জনা:

উপন্যাসের মূল প্রশ্নটি হলো- ‘কারা অপরাধী?’ খুনি দরবেশ কাদের? নাকি নীরব সাক্ষী যুবক শিক্ষক আরেফ আলী? নাকি সমাজ, যে নিজের দায় অন্যের ঘাড়ে চাপিয়ে দেয়? এই প্রশ্নগুলো রাজনৈতিক ও দার্শনিক স্তরে পৌঁছে। ওয়ালীউল্লাহ এখানে এক ধরনের এক্সিস্টেনশিয়াল সংকটের চিত্র আঁকেন, যেখানে মানুষ নিজেই নিজের শত্রু, নিজেই নিজের ভয়। সমাজ এই ভয়কে পুঁজি করে নিয়ন্ত্রণ করে, চাপিয়ে দেয় ‘ধর্ম’, ‘নৈতিকতা’, ‘ইজ্জত’ ইত্যাদির নামে এক ধরনের মৌনতা- যা আসলে সত্য থেকে মুখ ফিরিয়ে নেওয়ার আরেক রূপ।

পরিশেষে বলা যায়, “চাঁদের অমাবস্যা” ঔপন্যাসিক সৈয়দ ওয়ালীউল্লার এক গভীর সাহিত্যকীর্তি- যা অপরাধ ও রহস্যকে কেন্দ্র করে, কিন্তু তার প্রেক্ষিতে উন্মোচন করে সমাজের ভেতরের অন্ধকার, নৈতিক দ্বিধা, এবং মানুষের অন্তর্জাগতিক ভয়। সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহ এই উপন্যাসে কেবল একটি গল্প বলেননি; তিনি একটি সমাজচিত্র এঁকেছেন, যেখানে চাঁদের অমাবস্যা আসলে মানুষের বিবেকহীনতা, দায়সারা ধর্মচর্চা এবং নীরব নির্যাতনের অন্ধকার রাত। এই উপন্যাস পাঠকের চোখকে অভ্যস্ত করে তোলে সেই অন্ধকারকে বুঝতে শেখার সাহসে।

সম্প্রতি