আলম মাহবুব
কবি নাসির আহমেদের কাব্যগ্রন্থ “বৃক্ষমঙ্গল” আধুনিক বাংলা কবিতার জগতে একটি উল্লেখযোগ্য সংযোজন। ১৯৯৬ সালে প্রকাশিত এই গ্রন্থে মোট ষাটটি কবিতা রয়েছে, এর মধ্যে চব্বিশটি বৃক্ষমঙ্গল সিরিজের, যা ক্রমিক সংখ্যা করে প্রকাশিত হয়েছে। বৃক্ষমঙ্গল কবিতা সিরিজে কবি প্রকৃতি, মানবিক আবেগ, সমাজ ও রাজনৈতিক বাস্তবতা- সবকিছুকে একত্রিত করেছেন। শামসুর রাহমান যথার্থ লিখেছিলেন- বৃক্ষমঙ্গলে নাসির বৃক্ষকে মানব সত্তায় উত্তীর্ণ করেছে। আলোচনা শুরুতেই মনে রাখতে হচ্ছে বৃক্ষ যে শুধু বৃক্ষ, বন বা প্রাকৃতিক দৃশ্যের কবিতাবলি নয়; বরং এটি মানুষের অভ্যন্তরীণ অনুভূতি, সামাজিক চেতনশীলতা এবং রাজনৈতিক অধিকার সম্পর্কিত এক গভীর চিত্রায়নেই কবির মনোনিবেশ। তা প্রতীকী হয়েও পাঠকের বোধগম্য। কবি এখানে নিখাদ সৃজনশীলতা দিয়ে, প্রতীক এবং রহস্যময় চিত্রকল্পের মাধ্যমে পাঠককে প্রকৃতির গভীরে নিয়ে যান।
নাসির আহমেদ সমসাময়িক কালের সেই কবি, যিনি প্রাকৃতিক পরিবেশ এবং শহুরে জীবন দুই সত্তাই অস্তিত্বে লালন করেন এবং কবিতায় প্রয়োগে তীক্ষè দৃষ্টি রাখেন। তার কবিতায় দেখা যায়, পূর্ববর্তী বাঙালি কবিদের মানবিকতা এবং প্রকৃতির সঙ্গে সংযোগের চেতনা আজও জীবন্ত। বৃক্ষমঙ্গল কবিতা সিরিজে নাসির আহমেদ পুরনো প্রজন্মের অভ্যন্তরীণ চেতনা ও মানবিক অনুভূতিকে আধুনিক জীবন ও কাব্যের বাস্তবতায় রাজনৈতিক নিপীড়ন ও সামাজিক বিচ্যুতির সঙ্গে মিশিয়েছেন। শহরের বিশৃঙ্খলা, রাজনৈতিক নিপীড়ন, সামাজিক বিচ্যুতি- সবই কবির দৃষ্টিতে প্রকৃতির স্থিতিশীলতা ও মানবিক আশ্রয়ের সঙ্গে সম্পর্কযুক্ত- এ কথা নিঃসংশয়ে বলা যায়।
এ কাব্যগ্রন্থের প্রথম দিককার কবিতাগুলোতে দেখা যায়, কবি দীর্ঘ যাত্রার শেষে জোনাক-বাগানে পৌঁছে স্বাগত জানাচ্ছেন। বৃক্ষ, লতা, জোনাকি, ছায়া- সবই এক আধ্যাত্মিকতার প্রতীক হয়ে উঠেছে। (বৃক্ষমঙ্গল ১, ২) এখানে প্রকৃতি কেবল দৃশ্য নয়, বরং মানবিক আবেগ ও শান্তির প্রতীক হিসাবে বিরাজিত রয়েছে। কবির ভাষায় ছায়াহীন রৌদ্রদগ্ধ, ক্ষয়ক্ষতি, লতাগুল্মের মখমল- সমস্তকিছুই মানুষের অভ্যন্তরীণ মানসিক অবস্থা প্রতিফলিত করে।
বৃক্ষমঙ্গল ১ কবিতার কয়েকটি চরণ: “বহুদূর থেকে আজ এসেছি এখানে/ এই জোনাক-বাগানে / দীর্ঘ
ধু ধু পথে সুরকি-কাঁকরে/ বিক্ষত পায়ের চিহ্নে পথের দূরত্ব লেখা আছে।/ ছায়াহীন রৌদ্রের থাবায় পোড়া ক্ষয়ক্ষতি নিয়ে/ এতদিনে এসেছি তোমার কাছে/ও অরণ্য! জ্যোৎস্নাস্নাত রাত্রির প্রতিমা/ আমাকে আবৃত করো রাশিরাশি পাতার মখমলে। / পোড়াপিঠে মেখে দাও মমতার সবুজ ভেষজ / ধুয়ে যাক দীর্ঘশ্বাসগুলো।”
বিশেষ করে বৃক্ষমঙ্গল ১, ২ কবিতায় প্রকৃতি ও আধ্যাত্মিকতার সংমিশ্রণ লক্ষণীয়। কবি দীর্ঘ যাত্রা শেষে জোনাক-বাগানে পৌঁছে ছায়া, লতা, পাতার মখমল- সবকিছুকে আধ্যাত্মিক আশ্রয় হিসেবে দেখেন, দগ্ধ জীবনে প্রশান্তির মলম হিসাবে দেখেছেন প্রকৃতিকে।
বৃক্ষমঙ্গল ২ কবিতায় বলেন- “ও পাতাবাহার! তুমি কত সুখী / বুকে জমে আছে স্নিগ্ধ জল / মেঘের মমতা নিয়ে বেশ আছো বটে / আমার বুকের মধ্যে এতো ঝড়, সমুদ্র-কল্লোল/ তবু পিপাসায় পুড়ি! জলের সংকট ঘটে / একমাত্র মানুষের কৃপণ সংসারে।”
বৃক্ষমঙ্গল ৪, ৫, ৮-এ দেখা যায় প্রেম, মায়া, স্মৃতি এবং দীর্ঘনিদ্রার প্রতীক্ষা কাব্যিকভাবে প্রতিফলিত হয়েছে। কবি বনভূমি, লতা, ফল এবং পাখির সঙ্গে মানুষের প্রেম ও বন্ধনের সমান্তরাল টান তৈরি করেছেন। এই অংশে কবির হৃদয়াবেগ স্পষ্ট- কিন্তু তা কখনও সরাসরি নয়; সবই প্রতীকী, রহস্যময় এবং স্বপ্নময় চিত্রায়নে প্রস্ফুটিত।
বৃক্ষমঙ্গল: ১৬, ২১, ২৪-এ দেখা যায় সমাজ ও রাজনৈতিক বাস্তবতার স্পষ্ট প্রতিফলন। প্রিজনভ্যানের যুবক, হন্তারক, কারাগার- এসব বাস্তব রাজনৈতিক নিপীড়নের প্রতীক। শহরের হিং¯্রতা বনভূমির আশ্রয় ও শান্তির সঙ্গে তুলনা করা হয়েছে। একজন অপরাধী খুনিও প্রকৃতির কাছে গেলে তার মনোভাব বদলে যেতে পারে,এই বিজ্ঞানসম্মত সত্যও নাসির আহমেদ তুলে ধরেছেন একটি কবিতায়। কবি প্রাচীন বট, ঝোপঝাড় এবং ছায়া ব্যবহার করে দেখিয়েছেন কিভাবে প্রকৃতি মানুষের জন্য আশ্রয় ও পুনর্জীবনের প্রতীক হতে পারে।
আবার বৃক্ষমঙ্গল ২১ কবিতাটিতে অস্থির সময়ের এক সকরুণ চিত্র। যাতে ধরা পড়েছে সময়েরই এক রাজনৈতিক দেউলিয়াত্ব। এখানেও কবি আশ্রয় নিয়েছেন প্রকৃতির কাছে। অর্থাৎ বৃক্ষের কাছেই-“প্রিজনভ্যানের ক্ষুদ্র জানালায় চোখ রেখে / বন্দি যুবকেরা রাজপথে জন¯্রােত দেখতে দেখতে যায় / গন্তব্য কেন্দ্রীয় কারাগার।/ প্রাচীন বটের এই আকুতি হারিয়ে যায় / যন্ত্রদানবের গোঁ গোঁ ক্লান্ত আর্তস্বরে।”
বৃক্ষমঙ্গল ২৪ নং কবিতায় পুরোপুরি নস্টালজিয়ায় আচ্ছন্ন হয়ে পড়েন কবি, তুলে আনেন মিষ্টি-মধুর কাজলা দিদির কথা। বাঁশবাগান, জোনাকি, চাঁদ সে সমস্ত স্মৃতিময় দিনের কথা। আজ যেসব বিস্মৃতির অন্তরালে হারিয়ে গেছে। পুরো সমাজ বদলে যাওয়ারই প্রতিকী চিত্র এটি। কবির কথায়- “একদিন আমাদের বাঁশবাগানের মাথার ওপরে চাঁদ ছিলো;/ আজ চাঁদ নেই, শ্লোক নেই, কাজলাদিদিও নেই / ভয়াল আঁধারে শুধু প্রেতিনীরা শিশুদের গল্প বলে যায় / মাইল মাইলব্যাপী শালপিয়ালের ঢেউ / থরে থরে ফুটে থাকা অজ¯্র ফ্রলের হাসি বনভূমি ছিলো /মায়ের শ্লোকের মতো চাঁদের কপাল ছুঁয়ে চাঁদ টিপ দিয়ে / যেতো।
অতীতের কাজলা দিদি নেই,আছে প্রেতিনীরা বাস্তবতা এভাবেই কবি তুলে ধরেন: “এখন বৃক্ষের দিন রক্তপাতে ভারসাম্যহীন; / চাঁদের কপাল ছোঁয় হিমঠা-া পিস্তলের নল।”
কবি নস্টালজিয়ায় আচ্ছন্ন হলেও তাতে মগ্নতায় বিভোর হয়ে থাকেন না। তিনি তীব্র গর্জন করে বলে ওঠেন : “এইভাবে দুঃসময়ে সহসা বালকবেলা ফিরে এলে / অথচ ধিক্কার ওঠে নিজের ভেতরে আজ / একদিন বকশীবাড়ির ওই বাঁশঝাড় পার হয়ে যেতে / ডানা ঝাপটানো কোনো পাখির শব্দ শুনে / মনে হতো সন্ধ্যার অন্ধকারে ওই বাঁশঝাড় তার / ঘনছায়া নিয়ে ভৌতিক ঘাতক, যেন / ছিঁড়েখুঁড়ে নেবে ঊর্ধ্বশ্বাস বালকের জ্যোতির লাবণ্য।”
কবি ইতিহাস ও ঐতিহ্যের দিকে ভীষণভাবে সজাগ থেকে বলেন- “এইসব অর্থহীন ক্ষণস্থায়ী কোলাহল চিরে / নন্দনলোকের দিকে চলে গেছে পথ, ভেতরে তাকাও / দেখো: দিন ও রাত্রির আলো-অন্ধকার একাকার অনন্তের সেই পথে / পাহাড়ি নির্জন ঝর্না, বনভূমি, সমুদ্র সৈকতে / দ্য ভিঞ্চির উত্তরাধিকারী চেতনার পটে আঁকে একটি শাশ্বত তৈলচিত্র / প্রাত্যহিক রমণীর অতিরিক্ত সৌন্দর্যে নিগূঢ় এক নারী / মোরগফুলের মতো লাল একজোড়া ঠোঁট বাড়িয়ে রেখেছে।”
কবি নাসির আহমেদের কবিতা প্রতীকের মাধ্যমে গভীর অর্থ বহন করে। বৃক্ষ শুধু বৃক্ষ নয়; তা স্থিতিশীলতা, মা-প্রতীক, সমাজের প্রতিরোধ, এবং মানবিক আশ্রয়ের রূপক হিসাবে দেখা দেয়। পাখি প্রেম ও স্বাধীনতার প্রতীক, বনভূমি মানবজীবনের নিরাপদ আশ্রয় হয়ে ওঠে। কবির চিত্রকল্প নানাবিধ- জোনাকি, লতা, ছায়া, ঝর্না, জলপথ, শহর- সবই পাঠকের অনুভূতিকে জাগ্রত করে।
ভাষা-শৈলী সরল অথচ গভীর ব্যঞ্জনাময়। প্রতীকের ব্যবহার সংলাপের মতো। দৃশ্যমান ও অবচেতন স্তরে আবেগময়তার নিবিড় প্রভাব পরিস্ফুট হয়েছে। আধুনিক শহর, প্রকৃতি এবং মানবিক আবেগ চমৎকারভাবে একত্রিত হয়েছে।