image
চিত্রকর্ম : ইন্টারনেট

পার্বত্য আদিবাসী কবি ও কবিতা ‘ফুলটি তার মতো করেই ফুটুক’

হাফিজ রশিদ খান

বাংলাদেশের পার্বত্য চট্টগ্রাম অঞ্চলে সর্বজনস্বীকৃত এগারোটিসহ আরও কয়েকটি আদিবাসী জাতির বৈচিত্র্যময় ভাষা, সেসব ভাষায় রচিত ও লোকপ্রচলিত প্রবাদ-প্রবচন, কাহিনি-কিংবদন্তি ও জনপ্রিয় গাথাকাব্য রয়েছে। এখানকার সুপরিচিত আদিবাসী জাতিগুলো হলো : ম্রো, খুমি, বম, খিয়াং, চাক, লুসাই, তঞ্চঙ্গ্যা, পাংখোয়া, ত্রিপুরা, মারমা ও চাকমা। এছাড়া এখানে রাখাইন, সান্তাল (সাঁওতাল), অহমিয়া বা আসামী, গুর্খা বা নেপালি জনগোষ্ঠীর কিছু সদস্যও সম্প্রীতিময় জীবনের ধারা বয়ে চলেছেন আদিকাল থেকে। এই জাতিগুলোর বহুল চর্চিত প্রাচীন ভাষাগুলো বা লব্জসমূহ তাদের জীবনধারার সকল আচরিত ও চিন্ময় আবেগ-অনুভূতি ধারণ ও প্রকাশে সুসক্ষম। জনধারা, ধর্মবিশ^াস ও ভাষার স্বতন্ত্রতার দিক থেকে তারা সমতলী বৃহত্তর বাংলা ভাষাভাষি থেকে আলাদা হলেও রাষ্ট্রিক পরিচয়ে বাংলাদেশের অধিবাসী এবং এদেশেরই ধুলোয় গড়া সন্তান। এখানে বসবাসরত আদিবাসী জাতিগুলোর এতদিন আড়ালে থাকা সৃজনশীলতার একটি প্রকরণ কবিতাচর্চচার দিকটি নিয়ে কিছুটা আলোকপাতের চেষ্টা করা হয়েছে এ গদ্যের শরীরে। নিরালা স্বভাবী, প্রচারকুণ্ঠ আদিবাসী মানুষগুলোর নানাবিধ কর্মকৃতি ও সৃজনকৃতীর ওপর দায়িত্বশীল অবলোকন ও তার বিস্তারে বাংলাদেশের একটি প্রকৃত অন্তর্ভুক্তিমূলক নতুন সাংস্কৃতিক আর্কেডিয়া প্রণীত হবার উজ্জ্বল সম্ভাবনা রয়েছে। এই সামান্য গদ্যটির মূল অভিমুখ ব্যক্তিগত জানাশোনা ও সেই সূত্র ধরে আদিবাসী সাহিত্যের একটি প্রাণবন্ত দিক, তাদের কবিতার অন্তঃশায়ী সুবেদী কাহন উপস্থাপন। আমার অনুধাবিত সংবেদনের সপক্ষে এখানে আশ্রয় নিতে হচ্ছে নি¤œবর্গের ইতিহাসের তাত্ত্বিক রণজিৎ গুহ (১৯২৩-২০২৩)-এর একটি অমিয়বচনের। তিনি বলছেন, ‘ঐতিহাসিকতার স্বাদ পেতে গেলে রাষ্ট্রিক ইতিহাসের বাইরে সাহিত্য ও ভাষার মধ্যে তা সন্ধান করতে হবে’। বর্তমান লেখকের মতি সেদিকেই কিছুটা কাত হয়ে থাকার কারণে এখানে অতীব স্বল্প পরিসরে অন্তর্ভুক্ত হয়েছে ওই অঞ্চলে যারা জন্মগ্রহণ করেন, সেখানেই বসবাস করেন বংশ পরম্পরায়, যারা আজও একপ্রকারের ‘রাষ্ট্রিক ইতিহাসের বাইরে’- প্রধানত নিজেদের ভাষা ও সাহিত্যের ভেতরে নিজেদের মতোই বাঁচতে চান- এ রকম তিনজন কবির কবিতা ও সে বিষয়ে কিছু কথা।

আবহমানকালের বাংলাদেশের বৃহত্তর সাধারণ বাঙালি সমাজের অনেকের কাছে ‘আদিবাসী’ শব্দটা হয়তো কিছুটা নতুন বা বিরোধাত্মক শোনায়। এবং অনেকেই তা ভূমিজ বাসিন্দার দাবিতে নিজেদের ক্ষেত্রেই একমাত্র প্রযোজ্য বলে মনে করেন বা দাবি তোলেন। আদতে আগে যেকোনো বৃহত্তর জনসমাজ থেকে সুস্পষ্ট আলাদা বৈশিষ্ট্যের কারণে যাদের ‘আদিম অধিবাসী’ (Adivasi) বলা হতো, সমকালীন সমাজতাত্ত্বিক পরিভাষায় তারাই এখন ‘আদিবাসী’ (aborigines) নামে অভিহিত হচ্ছেন। বাংলাদেশের নদীবিধৌত শস্যশ্যামল ভূমিতে আদিবাসীদের খুব একটা দেখা যায় না। পর্বতময় অরণ্য অঞ্চলের নিভৃত কোলে তারা নিবাস গড়েছেন। সেই বিবেচনায় বাংলাদেশ ভূখ-ভুক্ত পার্বত্য অঞ্চলে বসবাসরত আদিবাসীরা বাংলাদেশের বৃহত্তর জনসমাজ থেকে ভাষাগত, ধর্মীয়, নৃতাত্ত্বিক ও সাংস্কৃতিকভাবে আলাদা বৈশিষ্ট্যে বিরাজমান। এদেশের সাধারণ মানুষের সঙ্গে তাদের প্রধানতম অভিন্নতার দিকটি হলো- তারাও এদেশেরই মাটির সন্তান। আর্য আগমনের বহু আগে ওদের পূর্বগামীরা ভারতবর্ষে প্রস্তর সভ্যতার প্রথম বেদি রচনা করেছিলেন। নৃতাত্ত্বিক এবং ভাষাতাত্ত্বিকেরাও এ কথা সমর্থন করেন। অধুনা আরও একটি মনোনিবেশযোগ্য পর্যবেক্ষণ এখানে যুক্ত হয়েছে, তা হলো : যে-সমস্ত সংখ্যাস্বল্প জাতিসত্তা মূল পরাক্রমশালী বৃহত্তর জাতিসত্তার বেষ্টনীর ভেতরে থেকেও নিজেদের সমাজের প্রণম্য পূর্বগামীদের আচরিত রীতিনীতি, ভাষা, বস্তুগত জীবনাচরণ, ভুবনদৃষ্টি তথা ধর্মীয় আধ্যাত্মিকতাকে আঁকড়ে থাকতে ভালোবাসেন, তারা ‘আদিবাসী’ অভিধা পাবার যোগ্য। সুতরাং ‘আদিবাসী’ বলতে বনেদি অথচ বিজ্ঞানসম্মত সমকালীন রাষ্ট্রচেতনা ও প্রযুক্তিগত সুবিধাবঞ্চিত মানবম-লীকেই বোঝানো হচ্ছে।

এখানে যে-তিনজন পার্বত্য আদিবাসী কবি আলোচনার সূত্রে গ্রথিত হচ্ছেন, বয়োক্রম অনুসারে তারা হলেন :বান্দরবান পার্বত্য জেলারমারমা সন্তান মংক্যশোয়েনু নেভী (জ. ১৯৫৮), রাঙামাটি জেলার সজীব চাকমা (জ. ১৯৬৯) ও খাগড়াছড়ি জেলার মথুরা বিকাশ ত্রিপুরা (জ. ১৯৭৪)।

মংক্যশোয়েনু নেভী : মারমা পাহাড়ের মাটি
পাহাড়ের কবি ও প্রাবন্ধিক মংক্যশোয়েনু নেভী মনখারাপ করা নানা অভিঘাতে হতাশার চোরাবালিতে ডুবে যাওয়া আমাকে আবার ফেরালেন পার্বত্যসংস্কৃতির বৈচিত্র্যের দিকে। বান্দরবান ডনবসকো ইশকুলে শিক্ষকতাকালের একটা পর্যায়ে অভাবিত পারিবারিক বিপর্যয়ে পড়ি। ১৯৯১ সালের ২৯ এপ্রিল প্রলয়ংকরী ঘূর্ণিঝড়ে চট্টগ্রামের বাঁশখালী উপজেলায় আমাদের পৈতৃক বাড়িটি সম্পূর্ণ ধ্বস্ত ও বিলুপ্ত হয়ে গেল। আমার এক ভাইপো সেই ঘূর্ণিঝড়ের জলোচ্ছ্বাসে চিরতরে হারিয়ে গেল সমুদ্রের অজানা গর্ভে। আমাদের শহরবাড়ির সামনের খাবড়ার ছাউনি দেয়া নান্দনিক বেড়ার দহলিজটি ও পার্শ্ববর্তী ভাড়াঘরসমূহ সম্পূর্ণ ভূমিসাৎ হয়ে পারিবারিক আয়ের উৎস বন্ধ হয়ে গেল। একই বছরে ১৯৭১ সালের নভেম্বর মাসে পাকিস্তানি নৌসেনাদের বর্বর নির্যাতনের শিকার আমার পিঠোপিঠি অগ্রজ, অকৃতদার মুক্তিযোদ্ধা নাসির উদ্দীন খান দীর্ঘ রোগভাগের পর মৃত্যুবরণ করেন (১৩ জুন ১৯৯১)। চট্টগ্রাম শহরের টাইগারপাস নৌদপ্তরে ঘূর্ণায়মান বৈদ্যুতিক পাখার সঙ্গে পা বেঁধে তাকে অমানুষিক নির্যাতন করা হয়। এতে তার মস্তিষ্কের গুরুতর ক্ষতিসাধিত হলে তিনি স্বাভাবিক জীবনের স্বস্তি ও যাপনের আনন্দ থেকে চিরবঞ্চিত হন। তারও কিছুদিন আগে ১৯৮৯ সালের ১ ফেব্রুয়ারি আমার পিতা, ব্রিটিশ মনীষী বারট্রান্ড রাসেল-এর ‘ম্যারিজ এন্ড মরালস’-এর প্রথম বাংলাদেশি অনুবাদক নুরুল আনোয়ার খান (১৯২০-১৯৮৯) ইন্তেকাল করেন। তার অনুবাদে বইটির নাম ছিল ‘বিবাহ ও নৈতিকতা’, প্রকাশকাল ১৯৮৪। অন্যদিকে বেসরকারি ইশকুলে বেতন-ভাতা উত্তোলনে ঔপনিবেশিক প্রক্রিয়ার নিস্পৃহ, শম্বুকগতি দেখে খুব দিশেহারা হয়ে পড়ি। একই সময়ে বান্দরবানে আদিবাসীবান্ধব আমার সাংস্কৃতিক ঝোঁকটিকে কিছু বদলোকের প্ররোচনায় বান্দরবান জেলা প্রশাসন ও অন্য সরকারি সংস্থার কর্তাব্যক্তিগণ কেমন জানি বাঁকা চোখে দেখতে লাগলেন। বিভিন্ন সময়ে আমার মারমা বাজারস্থ বকর মাস্টারের ভাড়াঘর ও চলাফেরার স্থানগুলোতে কিছু গোয়েন্দা কিসিমের লোকজনের উদ্ধত, বিসদৃশ চাহনি ও দেহভঙ্গি আমার সজাগসত্তাকে উৎপীড়িত, ক্ষুব্ধ ও হতোদ্যম করে তোলে। এ রকম অবস্থায় সংক্ষুব্ধ মন নিয়ে ডনবসকো ইশকুলের অগণিত, স্নেহভাজন আদিবাসী সরলমনা ছেলেমেয়ের মায়াভরা মুখের পিছুটান উপেক্ষা করে একদিন ধলপহরে শুধু শার্টপেন্ট ও একটি হাতব্যাগ নিয়ে কাউকে কিছু না-জানিয়ে শূন্যহাতে চট্টগ্রাম শহরে আমার বাড়ি এসে পৌঁছাই আর ফিরবো না- এমন পাকা সিদ্ধান্ত নিয়ে। ওই বান্দরবান শহরে একসময় যে-সকল সুহৃদের সাহচর্য পেয়েছিলাম, তাদের অন্যতম ছিলেন মংক্যশোয়েনু নেভী। তিনি তখন চট্টগ্রাম শহরে একটি সরকারি ব্যাংকে কর্মরত। চট্টগ্রাম শহরের সবুজ হোটেলের পুরোনো আড্ডায় আবার আমার সংযোগ সাধিত হলে নেভীও এসে যুক্ত হলেন আমার অছিলায়। সাহিত্যচর্চা, লিটলম্যাগ প্রকাশ, দর্শন ও রাজনীতির তর্কযুদ্ধের সেইদিনগুলো বেশ স্বর্ণময় ও প্রদীপ্ত হয়ে উঠলো আবার।

ঠিক এই সময়েই লেখালেখিতে নেভীরও গভীর জোয়ার আসে। মারমা আদিবাসী জীবনধারা ও সংস্কৃতিবিষয়ে তার আন্তরিক গদ্য ও কবিতা আমাকে আনন্দ দিতে থাকে। সবুজ হোটেলের আড্ডাকেন্দ্রিক লিটলম্যাগগুলোতে নেভীর কিছু লেখা ছাপা হতে থাকলো। এতে শহর চাটগাঁবাসী যেন একঘেয়ে জীবনে আদিবাসীরন্ধনের খুশবু পেয়ে উদ্বেল হয়ে উঠলো প্রবল বুভুক্ষায়। পেয়ে হারানো ও না-পাওয়ার হাজারো বঞ্চনাবোধ মুছে ফেলে আমিও ‘অলৌকিক আনন্দের ভার’ কবিতাযাপনে ‘সুদূরের পিয়াসী’ মরালের মতো ভেসে চলছি যেন দিগন্ত থেকে দিগন্ত পেরিয়ে।

বান্দরবানে বছর শেষে ঐতিহ্যবাহী ‘রাজপুণ্যাহ’ আসে। আকাশদীপ ফানুস ওড়ানোর ‘ওয়াগ্যোপোয়ে’ (প্রবারণা পূর্ণিমা) আসে। তরুণ পাহাড়িবন্ধুদের, আমার ছাত্রছাত্রীদের শুভ শাদি মোবারকের দিন আসে। নেভী ও অন্য মারমা সুজনদের ডাকে ওসবে অংশগ্রহণও হয় মাঝেমধ্যে। সবুজ আড্ডারুদের কাউকে সঙ্গে নিয়ে, কখনওবা একাই যোগ দিই ওসব অনুষ্ঠানে। দেখি-শিখি পাহাড়ি সহবতের অনেক কিছুই। ওসবের কত কিছু নাচতে-নাচতে চলে আসে কবিতায়, গদ্যের করিডরে। আমার সম্পাদিত পার্বত্য লিটল ম্যাগাজিন ‘সমুজ্জ্বল সুবাতাস’-এর পাতায় বিশেষ ক্রোড়পত্র হয়ে আসে পাহাড়িজীবন ও সংস্কৃতি, আলোময় সম্প্রীতি ও সাহচর্যে হাসতে-হাসতে। এই জানা-বোঝা আর নৈকট্যের আনন্দ জোগাতে নেভীর উদ্দাম প্রেরণা থাকে। ওদের বাড়িতে অন্নধ্বংস আর রাতযাপনের শয্যা থাকে। নেভীর চৌকস, হৃৎছোঁয়া অভিপ্রায় ওই শহরের বহু মারমা সজ্জনের সঙ্গে আমার হৃদ্যতার সেতু তৈরি করে। মারমা পাড়ার কোনো-কোনো ঘরের দাওয়ায় নেভী তার পাহাড়ি কাপড়ের ঝোলা থেকে বের করে আনেন মারমা ভাষায় লেখা কাগজের ভাঁজ। ওখান থেকে উচ্চারিত হতে থাকে মারমা ভাষায় তার রচিত কবিতা, গান। বড় আগ্রহে, ওকে খুঁচিয়ে-খুঁচিয়ে সেসবের দুর্বল তরজমাও খাড়া করি। ওর সদাশয় আদিবাসী সত্তা ওসবে সহাস্য অনুমোদন দেয়। তার ও-সব কবিতার একটির বাংলায়ন এ রকম : “চাঁদের আলোর মতো / মায়ের সোহাগ ঝরে পড়ে / আমাদের নীল পর্বতগুলোর / অনধিগম্য কন্দরে / প্রকৃতির সন্তানেরা বেড়ে ওঠে / সবুজের অকৃত্রিম মহিমায় / প্রসন্ন দেবতার বরাভয় / নিশ্চল বোমাং থং/ অকস্মাৎ / কেঁপে ওঠে বারুদের গন্ধে।” :: বোমাং থং (ঐতিহ্যবাহী বোমাং সার্কেল) : মারমা শব্দ :: বান্দরবান পার্বত্য জেলা।

মংক্যশোয়েনু নেভী আমার কাছে এক ব্যতিক্রমী হৃদয়সংবেদী মানুষের নাম। তার সৌজন্যে যেমন পাহাড়ি মারমা রেওয়াজের উজ্জ্বল প্রকাশ থাকে, তেমনি থাকে ভাবাবেগ প্রকাশের অসাধারণ সৌন্দর্য। যত মিশেছি ওর সঙ্গে, পেয়েছি তত ওর অন্তরের প্রস্ফুটিত গোলাপের রূপ ও ঘ্রাণ। নগর ও পাহাড়ের সাংস্কৃতিক বারামখানায় নেভীর হাসিমুখ সদা আনন্দ বিতরণ করে। ওর লগে হাঁটতে গিয়ে বুকে গেঁথে গেছে কত বিটপী ঢাকা, উঁচুনিচু পার্বত্যপথের ঘরগুলোর ভেতরের মানুষগুলোর দুঃখসুখের গোপনগাথা। ওরা থাকে মহান গৌতমের পরম বরে, অমলিন প্রমিত আশার অনির্বাণ পিদিম জ¦ালিয়ে। ওরা তবু ক্ষুধার্ত, তৃষ্ণার্ত পথিককে ধোয়া ঝকঝকে গেলাসে জল এনে দেয় অতিথিসেবার গৌরবে দায়িকা সুজাতার মতো। পাহাড়ের কঠিন, রুক্ষ পাথরের তলদেশে অমন মমতাময় সর্বক্ষণ ঝিরঝির, কলজে জুড়ানো স্বচ্ছ, শীতল জলস্রাতের কলতান শোনায় কোন্ দেশ? সে তো এই বাংলাদেশ, সে তো এই সাংগুনদী বিধৌত নিসর্গের অকৃপণ দান বান্দরবান।

আমার চোখে নেভী মানে মারমা পাহাড়ের আদত মৃত্তিকার গুণ, অতুল প্রাণশক্তি। যেখানে বনস্পতির ঝকঝকে হরিৎ পাতা ও ভিন্ন-ভিন্ন রঙ থরেথরে হাওয়ায় মৃদুমন্দ নড়েচড়ে। অপার্থিব আনন্দে শরীরে এসে জড়িয়ে থাকে অনেকক্ষণ। লুটিয়ে পড়ে মমতায়। আবার এ মাটিতেই ফলে যৌথশ্রমের জুমফসল। ঘামে ভিজে ওঠে জুমিয়াচাষার গতর। সেই নোনাজলেই সিক্ত হয় হলুদাভ ধরণির এই ত্বক। নেভীর গীতিকবিতা ও গদ্যের ভাঁজে-ভাঁজে মারমা জীবনধারা ও সংস্কৃতির আদি ও অকৃত্রিম ‘খ্রেখ্রঙ’ বাজে ভারি মন্ময় সুরে। তাই মানুষ নামের সারাদেশের সারস-সারসীরা সান্নিধ্যের আশায় তার ও মারমা সন্তানদের নিকটে উড়ে যায়। জাতি, ভাষা ও ধর্মের অর্গল পেরিয়ে কবিতা ও সুন্দরের ‘পইদাঙ’-এ গোল হয়ে বসে গাইবে আর খানিকক্ষণ জিরোবে বলে।

(খ্রেখ্রঙ :: মারমা শব্দ : সুতো ও বাঁশের টুকরো দিয়ে তৈরি একধরনের মাউথ অর্গানবিশেষ। পইদাঙ :: ঘরের মেঝে থেকে অল্প উঁচুতে পাতা প্রধানত খাবার টেবিল)।

সজীব চাকমা : ‘ফুল্ল তা ধগে তে ফুদি যোক’

সজীব চাকমা তার মাতৃভাষা চাকমা ও বাংলা উভয় ভাষাতেই স্বচ্ছন্দে লেখেন কবিতা, প্রবন্ধ, গল্প ও রাজনৈতিক কথকতা। তার মনোজগতের সংবেদনশীলতা ও তার ব্যাপ্তি আমাকে বেশ স্পর্শ করে পাঠক হিশেবে। রাঙামাটি শহরের বিভিন্ন স্থানে তার শান্ত, আতিথ্যম-িত সান্নিধ্য পাওয়ার মাধ্যমে এ আমি তা সহজে অনুভব করতে পেরেছি। এর সবই বিগত শতকের নব্বই দশকের বিভিন্ন ছিন্নপর্বের কথা। তার আপনসত্তার আদিবাসী জীবন ও সেই জীবনের প্রতি তার জন্মগত অনুরাগ বা পক্ষপাতিত্ব অতি স্বাভাবিক ব্যাপার হলেও সে বিষয়ে তাকে সবিশেষ উদ্বেগের সঙ্গে ভাবতে দেখেছি তখনও। তবে তিনি যেন তা খুব একটা খোলসা করতে চান না। পাছে আমাদের কাব্য ও গানময় সচ্চিদানন্দের ভুবনটা চোট পায় ওতে! এই একটু বাড়তি উদ্বেগতাড়িত ভাবনাটি নিঃসন্দেহে আদিবাসীদের সামাজিক ও রাজনৈতিক সচেতনতাজাত। তার এই অবস্থানটি মালুম করতে আমার সামান্যও বেগ পেতে হয়নি। আবার ওই সচেতনতার কাঁটা সংশ্লিষ্টজনের কাঁধে যে বাড়তি দায়-দায়িত্ব চাপিয়ে রাখে সর্বক্ষণ, এও বুঝতে অসুবিধে হয় না কারো। একেই বুঝি সামাজিক দায়বদ্ধতা বলে। ফলে আদিতে একজন কবি ও ভাবুক মানুষ হয়েও তাকে ওই বড় ভারে নুয়ে থাকতে হয় মাটিবর্তী মানুষের কাছাকাছি। তবে এও বলা থাক অকপটে, আমি এই বস্তুসংরাগময় সজীব চাকমার চেয়ে সেই সজীব চাকমা অর্থাৎ কবি সজীব চাকমাকেই যেন বেশি জানি, বুঝি। সেই জানায় উষ্ণতা অনুভব করি বলেই হয়তোবা। কেননা তিনি প্রথমত এবং প্রধানত কবিতার নন্দনলোকেরই অভিযাত্রী। মনে পড়ে, পার্বত্য অঞ্চলে খুব ধুন্ধুমার রাজনৈতিক ঘনঘটাময় উত্তাল সময়েও আমরা নিভৃতে কবিতার কথা বলতে পেরেছি হৃদয় ও চৈতন্যের সকল দুয়ার হাট করে খুলে দিয়ে। আমাদের মিথোজীবিতাই তা অকপটে বলিয়ে নিয়েছে। দেশের দুঃখে, দেশের মানুষের দমবদ্ধ কষ্টে আমাদের কাব্যিক উচ্চারণ চোস্ত রাজনৈতিক ভাষণকেও ছাড়িয়ে যেতে পেরেছে বা অনায়াসে তাকে প্রজ্ঞার পরিপাকে আনতে সক্ষম হয়েছে নিজেদের মতো করেই। কবিতার পথে হাঁটবো বলে আমাদের যে-আরক্ত চেহারা, সেখানে সমাজ-সংসারের জ্বালা-যাতনার ছায়া বা ছাপ ছিল না বা থাকে না কোথাও- তা কি হয়, কখনও হয়েছে? কবিতার মতো সংক্রামক শিল্পবোধ জীবনের কোন্ অবস্থানকে তার প্রভাব বলয় বা পক্ষপুটের বাইরে রেখেছিল, বা বাইরে রাখতে পারে? আমরা তো হলাহলাপায়ী সেই নীলকণ্ঠই। যারা ‘জীবনমন্থন বিষ’ নিজেই পান করে আগে এবং অমৃত যা ওঠে তা দান করে যায় সমাজে, অখিল মানবের হিতৈষণায়।

নব্বই দশকের দিকে সজীব চাকমা ‘দৈনিক রাঙামাটি’র নির্বাহী সম্পাদক থাকাকালে তার সঙ্গে আমার প্রাগুক্ত যোগাযোগ বা সম্পর্কটি গড়ে ওঠে। ওই কাগজে আমার বেশ কিছু কবিতাও ছাপেন তিনি। বর্তমানে সক্রিয় রাজনৈতিক কর্মী সজীব চাকমা আদিবাসী ও আদিবাসী অধিকার বিষয়ে নিয়মিত লেখালেখি করেন। অধ্যাপক নন্দলাল শর্মা সম্পাদিত ‘চাকমা কবিতা’ সংকলন, হেমল দেওয়ান, পল্লব চাকমা ও হিরনমিত্র চাকমা সম্পাদিত ‘চাঙমা শ্রেষ্ঠকবিতা’য় স্বনামধন্য চাকমা কবিগণের সঙ্গে সজীব চাকমার কবিতার অন্তর্ভুক্ত হয়েছে। পাশাপাশি সাহিত্য ও সংস্কৃতিচর্চায় সনিষ্ঠ সজীব চাকমা ‘নিউহিল’, ‘হিলগার্ড’, ‘রিঝি’, ‘তারুণ্যের চোখে এমএন লারমা’ নামের লিটল ম্যাগাজিন ও সাময়িকপত্র সম্পাদনা করেছেন। দীর্ঘদিন ধরে রাঙামাটির ঐতিহ্যসচেতন সংগঠন ‘জুম ঈসথেটিকস কাউন্সিল’-এ সক্রিয়ভাবে যুক্ত ছিলেন।

২০১৯ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে রাঙামাটির রেগা প্রকাশনী থেকে তার প্রথম দ্বিভাষিক কাব্যগ্রন্থ ‘ফুল্ল তা ধগে তে ফুদি যোক’ (ফুলটি তার মতো করেই ফুটুক) বের হয়। ৪৮টি কবিতায় সজ্জিত কাব্যটি দ্বিভাষিকতার কারণে পরিসর বেড়ে ১২২ পৃষ্ঠায় রূপ নিয়েছে। এখানে বৃহত্তর বাংলাভাষি পাঠকসমাজের কাছে তার অনুভূতিসঞ্জাত চাকমা ভাষার কাব্যিক উচ্চারণমালা বাংলা ভাষার মাধ্যমে পৌঁছে দেবার প্রয়াসটি খুবই ইতিবাচক, দায়িত্বপ্রবণ এবং যোগাযোগপ্রত্যাশী বলে স্পষ্টতই প্রতীয়মান হয়। বস্তুতই বর্তমান লেখকও তার কবিতার মাধ্যমে চাকমা ভাষা, সেই সমাজের নিভৃত জীবনের আশা-নিরাশা ও দ্বন্দ্ব-সংঘাতের পরিচয় পেয়ে উপকৃত, উদ্বেলিত ও আন্দোলিত হয়েছি। কাব্যটিতে মূলভাবরূপে পরিকীর্তিত হয়েছে বাগানে বা অরণ্যজাত বিভিন্ন প্রজাতির রঙদার ফুলের স্ব স্ব অবস্থান নিয়ে ফুটে থাকা ও সৌরভ বিলিয়ে যাওয়ার স্বভাবধর্মের কথা। এ যেন পার্বত্য জনপদের জনবৈচিত্র্যের মধ্যে কাক্সিক্ষত সংগতি প্রতিপাদনের আবেদন ও আকাক্সক্ষা। সেই সঙ্গে তাতে সৌন্দর্যবোধের একটা নিবিড় সম্পর্ক যে গাঁথা রয়েছে অলক্ষে, তাও বোঝায়। এ কাব্যে কবি সজীব চাকমা এই বিশে^ মানবের টিকে থাকা তথা তাদের অস্তিত্বরক্ষার পক্ষে জোরালো নান্দানক বয়ান নির্মাণ করেছেন। বলাবাহুল্য, এই কাব্যিক বয়ানে মানবিক জীবনধারার প্রবহমানতাকে কবি কী চোখে দেখে থাকেন এবং সেই সঙ্গে নিজ পরিপাশের প্রতি দায়বদ্ধতা তার ভেতরে কেমন সংবেদনায় কাজ করে চলে প্রতিনিয়ত, সেই পরম্পরাজ্ঞানও ফুটে ওঠেছে প্রত্যেক পংক্তিতে।

কাব্যটি থেকে একটি কবিতার অংশ পাঠ করি চাকমা ভাষায়:

এ পিত্তিমি আমার

এ পিত্তিমি তমার

ও ভেই লক

ও বোন লক;

অজল এই মুরো কার

হ্লে এই বেক ঝার

এই জুম এই কলক

এই ছাবা এই ছদক?

এই দেবা এই মাদি

চোগ মেলি চোগ হাদি

যিদু থেই যিদু যেই

এই ছড়া এই গাঙ

এই বিজক এই নাঙ

লিগি যেই লিগি যেই।

আমি মানেই

পিত্তিমি সাজেই

স্ববনে কামে ঘামে;

জিংকানী বাজেই

মানেই উচ রাঘেই

উজন্দি যেন থামে।

কোচপেই কোচপেই

এই ফুল এই পেক এই মানেই

যিয়ান সত্য যিয়ান দোল,

কোচপানা থোক

লাঙ মেয়্যা থোক

মিছে আর অদোলত নহোনেই হোল। (এই পিত্তিমি আমার, পৃ. ৪১)।

কবিতাটির বাংলায়ন:

এই পৃথিবী আমাদের

এই পৃথিবী তোমাদের

হ্য্যঁ ভাইয়েরা

হ্যাঁ বোনেরা

উঁচু এই পাহাড় কার

সবুজ এই বনবাদাড়

এই জুম এই উপত্যকা

এই ছায়া এই আলোকচ্ছটা?

এই আকাশ এই মাটি

চোখ মেলি চোখ বুজি

যেখানেই থাকি যেখানেই যাই

এই ছড়া এই গাঙ

এই ইতিহাস এই নাম

লিখে যাই লিখে যাই আমি মানুষ

পৃথিবীকে সাজাই

স্বপ্নে কর্মে আর শ্রমে

জীবনবাজি রাখি

মনুষ্যত্ব বজায় রাখি

এগিয়ে চলা যেন না যায় থেমে

ভালোবাসি ভালোবাসি

এই ফুল এই পাখি এই মানুষ

যা কিছু সত্য যা কিছু সুন্দর

ভালোবাসা বেঁচে থাকুক

প্রেম বেঁচে থাকুক

মিথ্যে আর অসুন্দর যেন না হয় বিভ্রান্তিকর। (এই পৃথিবী আমাদের, পৃ. ৪২)। সজীব চাকমার আরেকটি ছোট্ট কবিতার উদ্ধৃতি দিচ্ছি। চাকমা ভাষায় যার শিরোনাম ‘উল্ল’: “আমি দ ন’চেই / উল্ল অহ্বার / জনমান চেয়েই / ফুল্ল লবার।” (পৃ. ১১)।

বাংলায়ন : “আমরা তো চাইনি / বৈরী হতে / আজীবন চেয়েছি / ফুলটিই নিতে।” (বৈরী, ওই)।

এই ছোট্ট কবিতাটি তার অন্তর্দেশে যে-উজ্জ্বল বারতা ধরে আছে, সেখানে সমগ্র পৃথিবীর দেশে-দেশে বসবাসরত আদিবাসী মানুষের শত শতাব্দীর লালিত আর্তি ও আকাক্সক্ষাগুলো যেন গ্রীবা বাড়িয়ে দিয়েছে স্বতঃস্ফূর্তভাবে। তাদের সম্প্রীতিময় সহাবস্থানের এমন অব্যর্থ ও নান্দনিক উচ্চারণ পাঠকের চিত্তকে প্রবলভাবে দ্রবীভূত ও চঞ্চল করে তোলে। জোর ও শক্তি-সন্ত্রাসের ভেতরের খল চেহারাগুলো এখানে এই ছোট্ট, মন্ত্রপ্রতিম উচ্চারণে বিপুলভাবে নগ্ন হয়ে ওঠে। এ কবিতা স্মরণ করিয়ে দেয় সাম্প্রতিক কালের মার্কিন ভিন্নধারার বুদ্ধিজীবী নোয়াম চসস্কিকে (জ. ১৯২৮)। ২০০১ সালের ৯/ ১১ তারিখে ‘টুইন টাওয়ার’ ধ্বংসপ্রাপ্ত হলে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ‘সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে’- চমস্কির ভাষায়- ‘তথাকথিত অনিঃশেষ যুদ্ধ শুরু করে’। চমস্কি বলেন, ‘প্রকৃতপক্ষে এই যুদ্ধ শুরু হয় ১৭৮৩ সালে, যখন সদ্য স্বাধীন মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ‘মুক্তি’ ও ‘সভ্যতার’ নামে আমেরিকার আদিবাসীদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ শুরু করেছিল।’ চমস্কি আরও স্মরণ করিয়ে দেন, ‘প্রথম ৯/ ১১, ২০০১ সালে ঘটেনি। ঘটেছিল ১৯৭৩ সালেও, যেদিন মার্কিন সহায়তায় চিলিতে বামপন্থী আলেন্দে সরকারকে সরিয়ে একটি সামরিক সরকারকে ক্ষমতায় বসানো হয়েছিল।’

উল্লিখিত কবিতাটি পাঠের পর মনশ্চক্ষে বিশ^ব্যাপী আদিবাসী তথা প্রান্তিক মানুষগুলোর ওপর আগ্রাসী ক্ষমতামদমত্তদের কালো অবয়বগুলো ভয়ংকরভাবে ভেসে ওঠে রক্তলোলুপতার লকলকে জিহ্বা নিয়ে। শান্তিপ্রিয় মানুষগুলোর ওপর দাম্ভিক, স্বার্থ-কলুষ মনোবৃত্তির সেই আগবাড়ানো ফেসাদে ধিক্কারের অনল লাগিয়ে দেয়। এ কবিতা ‘অনেক কথা যাও যে বলে কোনো কথা না বলি’র অফুরান শক্তি ঢেলে দেয় অন্তরতলে। প্রসঙ্গত আরও মনে পড়ে, আরব ঔপন্যাসিক আবদ-আলরহমান মুনিফ (১৯৩৩-২০০৪)-এর ‘এখন এখানে’ (১৯৯২) উপন্যাসের নায়কের উক্তি : ‘হতে পারে আমাদের দেশ পৃথিবীর সবচাইতে সুন্দর দেশ নয়। আরও সুন্দরও জায়গা নিশ্চয়ই আছে। কিন্তু সেসব জায়গায় তুমি বিচ্ছিন্ন, অসংলগ্ন। আর এখানে যাই তুমি করো তা আসে তোমার অন্তর থেকে এবং সঞ্চারিত হয় অন্যদের অন্তরে। আর এর ফলেই তোমার সঙ্গে চারপাশের যা কিছু তার সঙ্গে সম্পর্ক গড়ে ওঠে তোমার। এখানে সবকিছু তোমার জন্যে। এটা হচ্ছে সেই আয়না যেখানে তুমি নিজেকে দেখতে পাও এবং যেখানে অন্যরা দেখতে পায় তোমাকে। যে-শেকড় থেকে উত্থিত হয়েছ তুমি এবং যে-মাত্রিকতায় তুমি বিস্তৃত করো তোমার সত্তাকে এবং এর মধ্য দিয়ে জীবনকে জাগিয়ে রাখো নিরন্তর। শত-সহ¯্র খুঁটিনাটি বিষয় তোমার মধ্যে এই অনুভব জাগিয়ে দেয় যে, তোমার রয়েছে একটা অবলম্বনের বোধ, সংশ্লিষ্টতার বোধ, বিরামহীনতার বোধ।’

২০০২ সালের ২০ মে সজীব চাকমা দৈনিক রাঙামাটির পক্ষ থেকে আমার কিছু কবিতা চেয়ে চিঠি লেখেন, তিনি তখন ওই কাগজের নির্বাহী সম্পাদক। তার ডাকে সাড়া দিলে তিনি আমাকে ফিরতি জবাবে একটি চিঠিতে জানান:

হাফিজ রশিদ খান, শ্রদ্ধাস্পদেষু

গত ২৯ মে ও ১২ জুন পরপর আপনার দু-খানা চিঠি (একগুচ্ছ কবিতাসহ) পেলাম। আপনার আন্তরিক ও হৃদয়স্পর্শী চিঠিতে আমি পুলকিত। এই চিঠি ও দৈনিক রাঙামাটিতে কবিতা পাঠানোর জন্য আপনাকে জানাই আন্তরিক কৃতজ্ঞতা। পাশাপাশি যথাসময়ে ও যথাযথভাবে আমি চিঠির উত্তর দিতে পারিনি বলে ক্ষমাপ্রার্থনা ও দুঃখপ্রকাশ করছি। আসলে লিখব-লিখব করেও নানা টানাপোড়েনে লেখা হয়ে উঠছিল না। তাছাড়া আমার মনে হয়, একটি ভালো চিঠি লেখা একটি ভালো কবিতা বা ছোটগল্প লেখার মতোই। আপনি লেখালেখির কথা বলেছেন। পাহাড়িবন্ধুদের নিয়ে লিটলম্যাগে সাহিত্য তৎপরতার কথা জানিয়েছেন। এ আপনার মহত্ত্বের তাগিদ। আসলে আপনার প্রবন্ধগ্রন্থটি (আমাদের কবিতা ও আদিবাসী প্রসঙ্গ, ২০০১। এ-বইটি তার কাছে প্রেরিত হয়েছিল) পাওয়ার আগেই আমি আপনাকে চিনতাম বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন পত্রপত্রিকার বদৌলতে। মংক্যশোয়েনু নেভীকেও জানি, তিনিও লেখেন বলে। পার্বত্য চট্টগ্রামে বা পাহাড়িদের খরাপীড়িত লেখালেখির জগতে তিনি লেখেন বলে তার ব্যাপারেও আগ্রহ আমার কিছুদিনের। বছর দুয়েক আগে অনিয়মিত একটি ম্যাগাজিন ‘হিলগার্ড’ বের করার সময় তার ঠিকানা আমি খুঁজেছি। এখনও তার সাথে পরিচয় বা যোগাযোগ গড়ে ওঠেনি।

শুভকামনায়- সজীব চাকমা। (২১ জুন ২০০২)।

এসব স্মৃতিময় অতীতের গর্ভে সাঁতরাতে গিয়ে দেখি কবি সজীব চাকমাকে নিয়ে লিখেছিলাম নিচের কবিতাটি, তার সম্পাদিত ছোটোকাগজ ‘রিঝি’ হাতে পাবার পর, তাকে উৎসর্গ করা:

খোঁপায় গেঁথেছ সুলক্ষণা রিঝি

ভাবছ আমাকে প্রেমিক- নিতান্ত হিজিবিজি

এই চোখ সম্পূর্ণ আকাশ

তোমার নিকটে গেলে কোমলতর সে- অনুগত ঘাস

বনের গভীরে গড়া মন-জুমঘরে

তুমি রাঙাবি দ্রৌপদী হয়ে এসো স্বয়ম্বরে

হৃদয়ের জব্দ ও মলিন সুতো যতো

রিঝির মনস্ক টানে মুক্তি দিয়ো এলানো চুলের মতো ...

(‘রিঝি’ : চাকমা শব্দ : দুর্লভ পার্বত্য অর্কিড, দেখতে অনেকটা চিরুনির মতো)।

মথুরা বিকাশ ত্রিপুরা : কৃতীময় আদিবাসী মুখ

মথুরা বিকাশ ত্রিপুরা খাগড়াছড়ি পার্বত্য জেলার মাটিরাঙা উপজেলার একটি আলোকিত ত্রিপুরা পরিবারের সন্তান। বৃহত্তর পার্বত্য চট্টগ্রামের তৃতীয় সংখ্যাগরিষ্ঠ আদিবাসী ত্রিপুরা জাতির মূল আবাসস্থল ছিল অবিভক্ত ভারত রাষ্ট্রের ত্রিপুরা রাজ্যে। প্রায় ১৪০০ বছর (৫৮৫-১৯৪৯) পর্যন্ত স্বাধীন রাজ্য ছিল এটি। ১৯৪৯ সালে ভারত ইউনিয়নে যোগদানের মাধ্যমে ত্রিপুরা রাজ্যের স্বাধীন অস্তিত্ব লোপ পায়। তারও আগে থেকে ত্রিপুরা জাতির কিয়দংশ বর্তমান বাংলাদেশ ভূখ-ের পার্বত্য ও সংলগ্ন সমতলভূমিতে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে বসবাস করে আসছে। বাংলাদেশে এদের সংখ্যা প্রায় ৩ লক্ষাধিক বলে জানা যায়। সমৃদ্ধ ও বৈচিত্র্যপূর্ণ সংস্কৃতির অধিকারী ত্রিপুরাদের মাতৃভাষার নাম ‘ককবরক’, যার অর্থ ‘মানুষের ভাষা’। ‘ককবরক’ ভাষায় এককালে রচিত হয় পৌরাণিক কাব্য, জীবনচরিত, বিস্তর লোককাহিনি ও ইতিহাসগ্রন্থ। বিখ্যাত ‘শ্রীরাজমালা’ গ্রন্থে ত্রিপুরা ও তার রাজন্যবর্গের ইতিহাস বিধৃত রয়েছে। বিভিন্ন সময়ে চট্টগ্রাম, কুমিল্লা, নোয়াখালী ও শ্রীহট্ট (সিলেট) ত্রিপুরা রাজাদের অধীনে থাকায় ‘রাজমালা’য় এসব জায়গার ইতিহাসও লিপিবদ্ধ আছে। রাজা প্রথম ধর্মমাণিক্যের রাজত্বকালে ১৪৩১ খ্রিস্টাব্দে বাংলা পদ্যে ‘রাজমালা’ প্রথম রচিত হয়। পরে বিভিন্ন সময়ে নতুন-নতুন তথ্য সম্বলিত হবার মাধ্যমে এটির হালনাগাদ রূপ পাওয়া যায়। গ্রন্থটি কৃষ্ণদাস কবিরাজ গোস্বামী রচিত শ্রীচৈতন্য মহাপ্রভুর (১৪৭৮-১৫৩৩) জীবনী ‘শ্রীচৈতন্যচরিতামৃত’ এবং কৃত্তিবাস ওঝা কর্তৃক ১৪-১৫ শতকে রচিত ‘কৃত্তিবাসী রামায়ণ’ (পূর্ণনাম : ‘শ্রীরামপাঁচালী’) থেকেও প্রাচীন। মূল ‘রাজমালা’ ছয়টি খ- বা লহরে রচিত। কালীপ্রসন্ন সেন বিদ্যাভূষণ, কৈলাসচন্দ্র সিংহ,ভূপেন্দ্রচন্দ্র চক্রবর্তী প্রমুখ ইতিহাসবিদের হাতে এটি পদ্যে ও গদ্যে রচিত হয়। স্বাধীন ত্রিপুরা রাজ্যের শেষদিককার দুই মহারাজা রাধাকিশোর মাণিক্য (১৮৯৬-১৯০৯) ও বীরেন্দ্রকিশোর মাণিক্য (১৯০৯-১৯২৩) কবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর (১৮৬১-১৯৪১)-এর সবিশেষ সমঝদার ও পৃষ্ঠপোষক ছিলেন।

পার্বত্য চট্টগ্রামের ত্রিপুরা জীবনধারা গড়ে ওঠেছে পুরাকালীন যাযাবর জুমিয়া সংস্কৃতির উত্তরাধিকার থেকে। বাংলাদেশি ত্রিপুরাদের একটি অংশ সমকালীন শিক্ষাদীক্ষা, রাজনৈতিক সচেতনতা ও সাংস্কৃতিক সেতুবন্ধনের মাধ্যমে বাংলাদেশে নিজেদের জন্যে একটি সম্মানজনক পাটাতন নিশ্চিত করেছেন। মথুরা বিকাশ ত্রিপুরা এই অংশেরই একটি উজ্জ্বল মুখ। বর্তমান শতকের প্রথম দিকে কাব্যচর্চার সুবাদে এবং বিভিন্ন সাময়িকপত্র প্রকাশের মাধ্যমে সাহিত্য সমঝদার মহলে সবিশেষ পরিচিতমুখ হয়ে ওঠেন মথুরা। সেই সূত্রে তার একটি কবিতা আমি চয়ন করি ‘অরণ্যের সুবাসিত ফুল’ (২০০৯) নামে আমার সংগৃহীত, সম্পাদিত ও দীর্ঘ ভূমিকা এবং ক্ষেত্রবিশেষে প্রয়োজনীয় টীকা সম্বলিত আদিবাসীদের রচিত কবিতার নির্বাচিত সংকলনে। কবিতাটির শিরোনাম ছিল ‘উদ্বাস্তু স্বপ্ন’:

স্বপ্নের জুমখেত ঢেকে যায়

সন্ত্রাসের কালো ছায়ায়

দ্বন্দ্ব-সংঘাতের ধুলোয় ধূসরিত সবুজ প্রান্তর

ভালোবাসার বুক চিরে রচিত কাঁটাতারের বেষ্টনী।

বৈরী বাতাসে কেমন করে যেন

বেঁচে আছি!

তবুও পাহারা দিয়ে যাই একাকী

নিরাকার স্বপ্নের পাহাড়।

সযতনে লালিত এ স্বপ্ন

সন্ত্রাসের হেফাজতে চলে যাবে না তো!

:: অরণ্যের সুবাসিত ফুল ॥ পৃ. ৪৮।

মথুরা বিকাশ ত্রিপুরা একক ও যৌথভাবে কয়েকটি কবিতা, গল্প, পাঠ্যপুস্তক ও সমাজভাবনামূলক গ্রন্থ রচনা ও সম্পাদনা করেছেন, যেমন : ‘ককবরক কককলব খল’ (ককবরক কবিতা সংকলন, ১৯৯৪), ‘ককবরকনি ককথাইহ্ খুত্রুক’ (ককবরক শব্দভান্ডার : ককবরক-ইংরেজি-বাংলা অভিধান, ২০০২), ‘পাহাড়িয়া কাব্য’ (২০০৫), ‘স্থায়িত্বশীল পদ্ধতিতে জুমচাষ’ (২০০৫), ‘ভাষা, শিক্ষা ও সাহিত্য’ (২০০৭), ‘Dudu Karabo’ (ককবরক গল্পবই, ২০০৮), Nokhai Raja (২০০৮), ‘গিরিপাঠ’ (২০০৮),‘প্রকৃতি’ (২০০৯), ‘থাইপাং চেনাই’ (ককবরক গল্প, ২০০৯), ‘আমাদের ক্ষুদ্র জাতিসত্তা, আদিবাসী জীবনসংস্কৃতি’ (২০০৯), ‘রিচুম’ (ককবরক গল্প, ২০০৯) ‘সমাজ পরিবর্তনের জন্য প্রতিশ্রুতিশীল যুবনেতৃত্ব, পার্বত্য চট্টগ্রামের অভিজ্ঞতা’ (২০০৯), ‘Nokha Kusum Ongkha’ (২০১০), Moni Malaini Kok’ (২০১০), ‘Lekhamwng Bijap’ (২০১১), ‘পাঠ্যপুস্তকে জাতিসত্তা পরিচয়, আমাদের দৃষ্টিভঙ্গি’ (২০১২), ‘AniKok’ (২০১৩), ‘উংবালে এ হু হু হু (কাব্য, ২০১৮) প্রভৃতি। মথুরা ত্রিপুরা তৃণমূল পর্যায়ে দেশের বিভিন্ন স্থানের আদিবাসী জাতির মাতৃভাষায় শিক্ষা কার্যক্রম বাস্তবায়নে ২০০২ সাল থেকে নিরন্তর কাজ করছেন। আদিবাসী অঞ্চলে শিক্ষার চিত্র, মাতৃভাষায় শিক্ষালাভে আদিবাসীদের অবস্থান ও অধিকার, মাতৃভাষাভিত্তিক বহুভাষিক শিক্ষা নিয়ে গবেষণা করার পাশাপাশি জাতীয় পর্যায় ও বহির্বিশে^র বিভিন্ন সেমিনারে তিনি প্রবন্ধ উপস্থাপন করেছেন। ইউএনডিপি, ইউএনএইচসিআর, ইউনিসেফসহ জাতিসংঘের বিভিন্ন সংস্থার আমন্ত্রণে বহুভাষিক শিক্ষাবিষয়ক আন্তর্জাতিক সম্মেলনে অংশগ্রহণ করেছেন। উল্লিখিত বিষয়ে দেশের বিভিন্ন বিশ^বিদ্যালয় এবং ভারতের ত্রিপুরা, ফিলিপাইনের ইউপিবাগিও, ইন্দোনেশিয়ার গানেশ ও উদায়ানা বিশ^বিদ্যালয়ে বিশেষ বক্তৃতা প্রদান করার অভিজ্ঞতা রয়েছে তার।

জাতীয় পরিসরে বিভিন্ন বেসরকারি সংস্থার পাশাপাশি আন্তর্জাতিক ভাষা ইনস্টিটিউট, পার্বত্য জেলা পরিষদ, জাতীয় শিক্ষাক্রম ও পাঠ্যপুস্তক বোর্ড, ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীর সাংস্কৃতিক ইনস্টিটিউটসহ বিভিন্ন সংস্থার আয়োজিত সেমিনারে উল্লেখযোগ্য সংখ্যক প্রবন্ধ উপস্থাপন করার অভিজ্ঞতায় সমৃদ্ধ মথুরা বিকাশ ত্রিপুরার মনোজগত। তিনি ২০১২ সালে বাংলাদেশ সরকারের প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয়ের অধীনে বিভিন্ন ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীর মাতৃভাষায় এমএলই (মালটিলিংগুয়েল এডুকেশন) কার্যক্রম পরিচালনার জন্যে গঠিত জাতীয় স্টিয়ারিং কমিটিতে সদস্য মনোনীত হন। ২০১৪ সালে জাতীয় স্টিয়ারিং কমিটি কর্তৃক গঠিত ত্রিপুরা ভাষাভিত্তিক লেখক প্যানেলে দলনেতার দায়িত্ব পালন করেন। ২০১৫-২০২০ পর্যন্ত বিভিন্ন কর্মশালার মাধ্যমে ‘ককবরকে’ প্রাক-প্রাথমিক, প্রথম, দ্বিতীয় ও তৃতীয় শ্রেণির শিখন-শেখানোর উপকরণ প্রণয়নে নেতৃত্ব দেন। ২০১৭-২০১৮ সালে জাতীয় ইউনেসকো কমিশনের অধীনে চাকমা, মারমা ও ত্রিপুরা (ককবরক) ভাষার শিক্ষক প্রশিক্ষণ ম্যানুয়েল প্রণয়নেও তার অবদান রয়েছে। মথুরা বিকাশ ত্রিপুরা সরকারি-বেসরকারি বিভিন্ন উদ্যোগে আদিবাসী শিক্ষার্থীদের জন্যে প্রাক-প্রাথমিক, প্রথম, দ্বিতীয় ও তৃতীয় শ্রেণির পাঠ্যপুস্তক, সহপাঠ্যসহ প্রায় ৬২টি পুস্তক এককভাবে রচনা করেছেন। মথুরা ত্রিপুরা মুজিববর্ষ (২০২০) উপলক্ষে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান-এর ৭ মার্চ ১৯৭১ সালে প্রদত্ত ঐতিহাসিক ভাষণটি দেশের আদিবাসীদের মাতৃভাষায় অনুবাদে গুরুদায়িত্ব পালন করেন।

২০২০ সালের আগস্টে সরকার কর্তৃক দেশের আদিবাসী জাতিসমূহের মাতৃভাষায় শিক্ষা কার্যক্রম জোরদার করার লক্ষে এমএলই অনলাইন কার্যক্রম চালু হলে এ কার্যক্রমের অন্যতম উদ্যোক্তার ভূমিকায় ছিলেন মথুরা। ২০২১ সাল থেকে আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা ইনস্টিটিউট ‘আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা পদক’ প্রবর্তন করে। মাতৃভাষার বিকাশ ও প্রসারে অনন্যসাধারণ অবদানের জন্যে ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠানকে এ পদক জাতীয় পর্যায়ে দুটি ও অন্য দুটি আন্তর্জাতিক পরিম-লে প্রদানের সিদ্ধান্ত হয়। এ পদক প্রবর্তনের প্রথম বছরে জাতীয় অধ্যাপক ও নজরুল গবেষক ড. রফিকুল ইসলাম-এর সাথে মথুরা বিকাশ ত্রিপুরাকে প্রদান করা হয়। আন্তর্জাতিক পর্যায়ে লাতিন আমেরিকার প্রতিষ্ঠান ‘একটিভিসমো লিংকুয়াস’ এবং ব্যক্তিপর্যায়ে উজবেকিস্তানের ভাষা গবেষক ইসমাইলভ গুলম মিরজায়েভিচ এই পদক পান। মথুরা ‘খাগড়াছড়ি জেলা সাহিত্য পরিষদ’-এর অন্যতম নেতৃস্থানীয় ব্যক্তি।এছাড়া শিক্ষা ও মাতৃভাষা, সংস্কৃতি ও সমাজ ইত্যাদি বিষয়েও মথুরা বিকাশ ত্রিপুরা একক ও যৌথভাবে কয়েকটি গ্রন্থের রচক। তার মধ্যে উল্লেখযোগ্য কয়েকটি হলো, ত্রিপুরা ভাষা ককবরকে লেখা প্রথম শ্রেণির জন্যে মাতৃভাষার বই- ‘আমানি কক’ (প্রথমপর্ব, ২০০৭), Society and Culture : The indigenouspeoples in Bangladesh’ (২০০০), Land, Culture and indigenouspeoples’ (২০০২), Indigenouspeoples : Life and Livelihood’(২০০৪), Mother Tongue and Culture : indigenouspeoples of Bangladesh’ (২০০৭), ‘ভাষা, শিক্ষা ও সাহিত্য : বাংলাদেশের আদিবাসী’ (২০০৭), Ruang’(প্রতিধ্বনি, প্রবন্ধ সংকলন, ২০০৭) ইত্যাি

সম্প্রতি