image
টি এস এলিয়ট

আধুনিক ইংরেজি কবিতা

একটি পর্যালোচনা

মাসুদুল হক

বিশ শতকের প্রথমার্ধে ইংরেজি কাব্য জগতে এক মৌলিক ও সৃনশীল বিপ্লব সূচিত হয়, যা কেবল শৈলী ও ভাষার পরিবর্তনই নয়, বরং চিন্তাভাবনার একটি রূপান্তরকেও নির্দেশ করে। এই সময়ের কবিরা তাঁদের পূর্বসূরি রোম্যান্টিক ও ভিক্টোরিয়ান কবিদের আবেগপ্রবণতা, আড়ম্বর ও অতিমূল্যায়িত ভাবাবেগ থেকে সরে এসে এক নতুন দৃষ্টিভঙ্গি গ্রহণ করেন। কাব্যে ব্যক্তিগত অনুভূতির চেয়ে বাস্তবতা, স্পষ্টতা, বিশ্লেষণাত্মক বোধ এবং নান্দনিক সংহতির প্রতি তাঁদের মনোযোগ নিবদ্ধ হয়। ফলে গানধর্মী, হৃদয়মথিত কবিতার জায়গায় জটিলতা, সূক্ষ্মতা ও চিন্তাসমৃদ্ধ শৈলীর কাব্যিক রূপ পরিলক্ষিত হতে থাকে।

এই রূপান্তরের অন্যতম প্রাথমিক ও তাৎপর্যপূর্ণ ধারা ছিল ‘ইম্যাজিজম’ আন্দোলন, যা আনুষ্ঠানিকভাবে শুরু হয় ১৯১২ সালে এবং ১৯১৭ সাল পর্যন্ত এর সুস্পষ্ট প্রভাব লক্ষ্য করা যায়। এই আন্দোলনের প্রবর্তক ও অনুসারীরা বিশ্বাস করতেন- একটি কবিতার প্রধান শক্তি হলো তার সংক্ষিপ্ততা, বস্তুনিষ্ঠতা ও সুনির্দিষ্ট ভাষার ব্যবহারে। অপ্রয়োজনীয় অলঙ্কার, আবেগপ্রবণ উক্তি বা অস্পষ্ট বিমূর্ততার পরিবর্তে তাঁরা বেছে নেন নির্যাসময় বর্ণনা ও নির্ভুল চিত্রকল্প। তাঁদের মতে, কবিতা এমন এক শিল্পরূপ, যা অনাবশ্যক শব্দ বা ভাব-স্ফীতিকে একেবারেই প্রশ্রয় দেয় না; বরং একটি নির্দিষ্ট অনুভব বা দৃশ্যকে নিখুঁত ভাষায় এমনভাবে উপস্থাপন করে, যেন তা পাঠকের মনে তাৎক্ষণিকভাবে এক তীব্র অভিজ্ঞতা সৃষ্টি করে।

এই নতুন কাব্যচেতনার কেন্দ্রে ছিল লন্ডন, যা অচিরেই ইউরোপীয় আধুনিকতাবাদের এক গুরুত্বপূর্ণ কেন্দ্রবিন্দুতে পরিণত হয়। তৎকালীন কবি ও সাহিত্যিকরা লন্ডনের বুদ্ধিবৃত্তিক ও সাংস্কৃতিক পরিবেশে জড়ো হয়ে একে অপরের কাজকে প্রভাবিত ও অনুপ্রাণিত করেন। এরই মধ্যে ১৯১৬ সালে এথেল সিটওয়েল সম্পাদিত Wheels পত্রিকার প্রকাশনা এই নবীন আধুনিকতাবাদী কাব্যচর্চার এক প্রাতিষ্ঠানিক রূপ দেয়। পত্রিকাটির মাধ্যমে এমন এক সাহিত্যিক মহলের আবির্ভাব ঘটে, যারা ঐতিহ্যবাহী কাঠামো ও বিষয়ে সীমাবদ্ধ না থেকে, কবিতাকে এক স্বাধীন ও বিকশমান শিল্পমাধ্যম হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করার লক্ষ্য নিয়ে এগিয়ে যান।

এই আন্দোলন এবং এর সূতিকাগারসম কাব্যধারা পরবর্তীকালে টিএস এলিয়ট, এজরা পাউন্ড, এইচ.ডি. (হিল্ডা ডুলিটল) প্রমুখ আধুনিকতাবাদী কবিদের মাধ্যমে আরো পরিণত ও প্রভাবশালী হয়ে ওঠে। তাঁদের রচনার মধ্য দিয়ে বোঝা যায়, কাব্য এখন আর কেবল আবেগের ভাষ্য নয়- এটি চিন্তার, অভিজ্ঞতার এবং সাংস্কৃতিক অন্তর্দৃষ্টির এক ঘনীভূত রূপ। অতএব, বিশ শতকের এই শুরুটা শুধু একটি কবিতা ধারার পরিবর্তন নয়, বরং আধুনিক কাব্যচর্চার জন্মকাল, যেখানে কবিতা হয়ে ওঠে এক নীরব অথচ প্রচ- শব্দহীন বিস্ফোরণ।

বাস্তবতা ও চেতনার প্রতিফলন:

আধুনিক কবিতায় “বাস্তবতা” যে প্রধান অনুষঙ্গ হিসেবে প্রতিষ্ঠা পেয়েছে, তা বিশ্লেষণ করতে গিয়ে F.R. Leavis-এর বক্তব্য একটি শক্তিশালী নির্দেশনা দেয়। তিনি বলেন, আধুনিক কবিতা আর কল্পলোকের স্মৃতি ও স্বপ্নে আবদ্ধ নয়; বরং এটি নির্ভর করে কঠোর বাস্তবতার ওপর- যেখানে মানুষ তার অস্তিত্ব, বোধ এবং চেতনার প্রেক্ষিতে জীবনকে নতুন করে অনুধাবন করে। এই বাস্তবতা প্রাচীন ও রোমান্টিক কাব্যধারার বিপরীতে দাঁড়িয়ে থাকে, যেখানে নায়কের অগ্রযাত্রা কিংবা আদর্শবাদের জয়গান প্রাধান্য পেত। আধুনিক কবিতা যেন নিজেকে এক আত্মজিজ্ঞাসার যাত্রায় নিয়ে যায়- যেখানে স্বপ্ন নয়, বরং নিস্তরঙ্গ জীবনের প্রশ্ন, দ্বন্দ্ব ও ক্লান্তির প্রকাশ ঘটে।

টি.এস. এলিয়টের Gerontion এবং আলফ্রেড লর্ড টেনিসনের ইউলিসিস- এই দুটি কবিতা আধুনিক ও রোমান্টিক দৃষ্টিভঙ্গির মাঝখানে এক স্পষ্ট ও মৌলিক ‘মহাবিভাজন’-এর সূচনা করে। টেনিসনের ইউলিসিস একটি আত্মপ্রত্যয়ী, প্রতিজ্ঞাবদ্ধ, সংগ্রামী চেতনার কাব্যিক অবয়ব। এখানে একটি বার্ধক্যের প্রান্তে পৌঁছানো চরিত্র, যিনি ক্লান্ত হলেও পরাজিত নন; বরং এখনো অজানাকে জানার, অন্বেষণের এক নিরন্তর আকাক্সক্ষায় উন্মুখ। কবিতায় আছে জীবনপিপাসা, আছে অদম্য ইচ্ছা, “To strive, to seek, to find, and not to yield”- এই পঙক্তির মধ্য দিয়ে ইউলিসিসএক আত্মমগ্ন বীরের প্রতীক হয়ে ওঠে, যে মৃত্যু পর্যন্ত থেমে থাকতে চায় না। টেনিসনের চেতনাজগৎ তাই পরিপূর্ণ হয় দৃপ্ত সাহসিকতা, অতীতের গৌরবের স্মৃতি, এবং ভবিষ্যতের আশাবাদী আকাক্সক্ষায়।

অপরদিকে, Gerontion একেবারে বিপরীত মেরুতে অবস্থান করে। এলিয়ট-এর এই কবিতায় এক বৃদ্ধ মানুষের কণ্ঠস্বর যেন সময়, ইতিহাস ও ব্যক্তিগত জীবনের ক্লান্তিকর পুনরাবৃত্তির মধ্যে মুখর হয়ে ওঠে। এখানে নেই কোনো কীর্তির স্মৃতি, নেই ভবিষ্যতের আশাবাদ; আছে কেবল সংশয়ের শূন্যতা, ধ্বংসের প্রতিধ্বনি এবং ইতিহাসের মুখরতা যা ব্যক্তির অস্তিত্বকে অকার্যকর ও মূল্যহীন করে তোলে। Gerontion-এর ভাষা শুষ্ক, চেতনা পরাজিত, সময় এখানে অনির্দিষ্ট ও চাপাচাপিতে ভরা। কবিতার এমন এক অভ্যন্তরীণ কাঠামো গড়ে ওঠে, যেখানে জীবন আর জীবনের অর্থ- উভয়ই প্রশ্নবিদ্ধ।

এই দুই কবিতার তুলনামূলক বিশ্লেষণ আমাদের সামনে আধুনিক কাব্যের দর্শন ও চেতনার একটি স্পষ্ট রেখাচিত্র নির্মাণ করে। যেখানে টেনিসনের কবিতা এক ধরনের রোমান্টিক পরিক্ষেত্র নির্মাণ করে, এলিয়ট সেখানে রোমান্টিকতার মৃত্যু ঘোষণা করে। আধুনিক কবিতা জীবনের অমোঘ সত্য, অস্তিত্বের ভার ও অন্তর্দ্বন্দ্বকে স্বীকার করে নেয়; এবং এই বাস্তবতা তাকে গভীরতর, আত্মসন্ধানী ও দার্শনিক রূপ দেয়। ফলে, লেভিস-এর মন্তব্যে যে বাস্তবতাভিত্তিক কবিতার কথা বলা হয়েছে, তা এলিয়টের Gerontion-এর মধ্য দিয়ে নিখুঁতভাবে প্রতিফলিত হয়। আর সেই প্রেক্ষিতে ইউলিসিস হয়ে ওঠে অতীত ঐতিহ্যের প্রতিনিধিত্বকারী, এক আশাবাদী কিন্তু কালোত্তীর্ণ কণ্ঠস্বর। এভাবেই ‘বাস্তবতা ও চেতনার প্রতিফলন’ আধুনিক ও প্রথাগত কবিতার সীমারেখায় এক গভীর বৈপরীত্য সৃষ্টি করে, যা সাহিত্যের বিবর্তনের ইতিহাসে একটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ পর্ব।

ভারতীয়/আন্তর্জাতিক প্রেক্ষাপটে:
ডব্লিউ.বি. ইয়েটস-এর কবিতা মানবজীবনের একটি পরিবর্তিত দৃষ্টিভঙ্গিকে প্রতিফলিত করে, যেখানে রোম্যান্টিকতাবাদ তার প্রাথমিক আবেশ হারিয়ে এক নির্মম বাস্তবতার মুখোমুখি দাঁড়ায়। ঊনবিংশ শতাব্দীর শেষভাগ এবং বিংশ শতাব্দীর সূচনালগ্নে ইয়েটসের কাব্যভাষা ও ভাবনা নাটকীয় রূপান্তরের মধ্য দিয়ে অগ্রসর হয়। প্রারম্ভিক পর্যায়ে তাঁর কবিতায় আইরিশ পুরাণ, কল্পলোক ও স্বপ্নময়তা প্রবল ছিল- যেখানে প্রেম, প্রকৃতি এবং আধ্যাত্মিকতা মিলেমিশে এক গভীর রোম্যান্টিক সৌন্দর্য সৃষ্টি করেছিল। কিন্তু সময়ের পরিক্রমায়, বিশেষ করে প্রথম বিশ্বযুদ্ধ, আইরিশ বিপ্লব এবং ব্যক্তিজীবনের নানা হতাশা ও চেতনার সংঘর্ষে তাঁর কবিতার কণ্ঠস্বর পাল্টে যায়। তিনি অনুভব করেন, রূপকথার সময় পেরিয়ে গেছে; এখন কবিতাকে ধারণ করতে হবে পৃথিবীর রূঢ় বাস্তবতা, মৃত্যু, রাজনৈতিক অস্থিরতা এবং মানবচরিত্রের দুর্বলতাকে।

এই প্রেক্ষাপটে LeRoi Jones—পরবর্তীতে যিনি Amiri Baraka নামে পরিচিত- তাঁর একটি বিখ্যাত উক্তি উচ্চারণ করেন: “We want poems that kill.” এই উক্তি শুধু একটি সাহিত্যিক আহ্বান নয়, বরং একটি সাংস্কৃতিক ও রাজনৈতিক চেতনার বিস্ফোরণ। আফ্রো-আমেরিকান বাস্তবতার পটভূমিতে দাঁড়িয়ে বারাকার এই উক্তি প্রতিবাদ, প্রতিরোধ এবং আত্মপরিচয়প্রতিষ্ঠার এক প্রত্যয়ী কণ্ঠস্বর হয়ে ওঠে। কবিতা আর নিছক সৌন্দর্যের জন্য নয়; এটি হয়ে ওঠে অস্ত্র, হয়ে ওঠে শক্তি, হয়ে ওঠে বেঁচে থাকার এবং সমাজ বদলের হাতিয়ার। তাঁর কবিতা চায় সমাজের হৃৎপিণ্ডে আঘাত হানতে, নির্জীব সৌন্দর্যের আবরণ ছিঁড়ে বাস্তবের কণ্টকাকীর্ণ রূপটিকে সামনে আনতে।

আধুনিক কবিতার এই তীব্রতা, প্রথাবিরোধিতা এবং রাজনৈতিক চেতনা কেবল পাশ্চাত্য সাহিত্যেই সীমাবদ্ধ থাকেনি। ঔপনিবেশিক অভিজ্ঞতা থেকে মুক্তি পেতে চাওয়া ভারত ও বাংলাদেশের সাহিত্যেও এর অভিঘাত দেখা যায়। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের পরে, বিশেষত জীবনানন্দ দাশ, সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়, শঙ্খ ঘোষ, শামসুর রাহমান, রফিক আজাদ, আবুল হাসান বা মল্লিকা সেনগুপ্ত প্রমুখ কবির কাব্যে, সামাজিক প্রশ্ন, ব্যক্তি-অস্তিত্বের সংকট এবং রাষ্ট্রিক নিপীড়নের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ স্পষ্ট হয়ে ওঠে। জীবনানন্দ যেমন বলেন, “এই পৃথিবীর কোথাও শান্তি নেই,” তেমনি সত্তরের দশকের বাংলা কবিতাও হয়ে ওঠে একরকম “poetry that kills”- এমন কবিতা যা নিপীড়কের মুখোশ খুলে দেয়, যা পাঠককে অস্বস্তিকর সত্যের মুখোমুখি দাঁড় করায়।

সার্বিকভাবে দেখা যায়, বিশ্বসাহিত্যের পরিপ্রেক্ষিতে আধুনিক কবিতা এক রূপান্তরের ফলশ্রুতি- যেখানে কল্পনার বদলে যুক্তি, বিমূর্ততার বদলে বাস্তবতা, আর সৌন্দর্যের বদলে তীব্র সত্যপ্রকাশ হয়ে ওঠে মূল চালিকাশক্তি। ইয়েটস ও বারাকার মধ্যবর্তী পার্থক্য যেমন সাংস্কৃতিক, তেমনি তা যুগচেতনার প্রতিফলন। কিন্তু দুজনেই কবিতাকে যুগ-চেতনার এক ধারালো প্রতিফলক করে তোলেন, যেখানে শব্দ হয়ে ওঠে শক্তি, কল্পনা হয়ে ওঠে প্রতিরোধ এবং সৌন্দর্য ছাড়িয়ে কবিতা প্রবেশ করে সত্য ও সংগ্রামের কঠিন ভূগোলে।

অন্ধকার, বিষণ্ণতা ও একাকীত্ব:
অন্ধকার, বিষন্নতা ও একাকীত্ব- এই তিনটি অভিব্যক্তি আধুনিক কবিতার অন্তর্নিহিত সুর হয়ে ওঠে, বিশেষত ২০শ শতকের ইংরেজি সাহিত্যে, যেখানে মনুষ্য অস্তিত্বের অন্তঃস্থ বেদনা ও উদ্বেগ ঘনীভূতভাবে প্রতিফলিত হয়েছে। আধুনিকতার দ্বন্দ্বময় প্রেক্ষাপটে যে বৌদ্ধিক ও আধ্যাত্মিক অনিশ্চয়তার সঞ্চার ঘটেছিল, তা এসব কবির রচনায় বিশেষভাবে প্রগাঢ় হয়ে উঠেছে। টি এস এলিয়ট-এর ‘দ্য ওয়েস্ট ল্যান্ড’আধুনিক মননের সেই ছিন্নমূল অবস্থার এক প্রতীকী ও প্রতিক্রিয়াশীল চিত্র, যেখানে সভ্যতার ভগ্নস্তূপের ওপর দাঁড়িয়ে কবি মানুষের অস্তিত্ব ও ইতিহাসের অর্থহীনতা অনুসন্ধান করেন। এলিয়টের ভাষা নির্লিপ্ত, অলঙ্কারমুক্ত অথচ অপ্রতিরোধ্য- এক ধ্বস্ত ও ক্লান্ত বিশ্বের আর্তনাদ। তিনি পৌরাণিক ইঙ্গিত ও আধুনিক নগরজীবনের ছায়া মিলিয়ে এক নিরাসক্ত দৃষ্টিভঙ্গিতে বলেন, “I will show you fear in a handful of dust”- এই বাক্যে আতঙ্ক, শূন্যতা ও অস্তিত্বের অনিশ্চয়তা গভীরভাবে জড়িয়ে আছে।

ডব্লিউএইচ অডেন-এর ‘দ্য এজ অব এ্যাংজাইটি’ এই নামেই যেন সমগ্র যুগের চেতনাকে সংজ্ঞায়িত করে। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ-পরবর্তী এক বিক্ষুব্ধ মানসিক অবস্থার প্রতিচ্ছবি এখানে ধরা পড়ে। চারজন চরিত্রের মধ্য দিয়ে যে আত্মপরিচয়ের খোঁজ, তা নিছক ব্যক্তিগত নয়- তা সমগ্র মানবজাতির অস্তিত্ব সংকট ও মানসিক নিঃসঙ্গতার মূর্ত প্রতিচ্ছবি। মানুষের অন্তঃস্থ শূন্যতা, তার আত্মবিচ্ছিন্নতা এবং সম্পর্কের অস্থায়িত্ব এক বেদনাময় মৌন প্রতিধ্বনি তোলে কবিতার পংক্তিতে পংক্তিতে।

টি এস এলিয়ট-এরই আরেক রচনায়- The Love Song of J. Alfred Prufrock- মানুষের আত্মগ্লানি ও অনিশ্চয়তা ঘনীভূতভাবে উপস্থাপিত হয়েছে। Prufrock-এর সেই চিরস্মরণীয় প্রশ্ন- “Do I dare?”- এ যেন আধুনিক মানুষের মানসিক বিভ্রান্তি, সংশয় এবং আত্মপ্রকাশে ব্যর্থতার সারাংশ ধরা আছে। এই প্রশ্ন শুধু সামাজিক ভয় কিংবা আত্মগ্লানির নয়, এটি ব্যক্তিসত্তার স্বরূপ সন্ধানে এক অসহায় উচ্চারণ। Eliot এখানে কাব্যিক চমৎকারিত্বকে তথ্যবহুল বৌদ্ধিক মননের সঙ্গে জুড়ে দিয়ে নির্মাণ করেছেন এক আত্মদংশনের প্রান্তসীমা।

Philip Larkin-এর কবিতায় এই বিষণ্ণতা আরও বাস্তব, আরও নিরাবরণ। তাঁর রচনায় অতীতের রোমান্টিক প্রতিশ্রুতি ভেঙে পড়ে এক ক্লান্তিকর দৈনন্দিনতার মধ্যে। অঁনধফব, Aubade, This Be The Verse, কিংবা Dockery and Son- প্রত্যেকটিতে তিনি অনাবিল সত্যনিষ্ঠতার সঙ্গে তুলে ধরেছেন মৃত্যু, বয়স, সম্পর্ক ও শূন্যতার অন্তর্নিহিত যন্ত্রণা। Larkin-এর দৃষ্টিভঙ্গি নির্লিপ্ত, কিন্তু নির্মম; যেন মানবজীবনের কোনো সৌন্দর্যময় অভিলাষই শেষ পর্যন্ত টেকে না।

Louis MacNeice-এর কাব্যভাষাও হতাশা ও বিষণ্ণতার নিঃসঙ্গ রূপায়ন। আধুনিক বিশ্বের কৃত্রিমতা, ব্যক্তির সামাজিক নিস্তেজতা ও অস্তিত্বের খোঁজ তাঁর কাব্যচিন্তায়প্রাধান্য পায়। Autumn Journal তাঁর এক ব্যতিক্রমী স্বীকারোক্তিমূলক কবিতা, যেখানে সময়, রাজনীতি, ব্যক্তিগত জীবন ও চেতনার দ্বন্দ্ব একে অন্যকে প্রতিধ্বনিত করে। তাঁর লেখনীতে শহরজীবনের নিঃসঙ্গতা যেমন প্রতিফলিত, তেমনি মানবিক সংবেদনশীলতার এক অবক্ষয়িত রূপও দৃশ্যমান।

Edwin Muir-এর ক্ষেত্রে এই অস্তিত্বচিন্তার সঙ্গে মিথ ও ঐতিহাসিক গভীরতা যুক্ত হয়েছে। তাঁর দ্য হর্সেসকিংবা দ্য জার্নি কবিতাগুলিতে সময় ও ইতিহাসের ধ্বংসস্তূপের মধ্যেও একধরনের অস্তিত্বমুলক সংকট ও পুনর্জন্মের আকাঙ্ক্ষা ফুটে ওঠে। তিনি বাস্তবতা ও কল্পনার মধ্যবর্তী এক আধ্যাত্মিক পরিসরে মনুষ্যসত্তার দ্বিধা ও বিচ্ছিন্নতাকে চিহ্নিত করেন।

এইসব কবির কাব্যভাষায় ব্যক্তিগত দ্বিধা, সামাজিক অস্থিরতা ও বৌদ্ধিক নিরাশা মিলেমিশে এক সাংগঠনিক সত্তা তৈরি করেছে, যা আধুনিক মানবতার শূন্যতা ও সংবেদনহীনতার এক নির্মোহ দলিল। অন্ধকার, বিষণœতা ও একাকীত্ব কেবল বিষয়বস্তু নয়, বরং আধুনিক কবিতার বৌদ্ধিক ভিত্তি এবং নান্দনিক কাঠামো হিসেবে আত্মপ্রকাশ করেছে। এই কাব্যধারা আমাদের স্মরণ করিয়ে দেয় যে, মানুষের যাত্রা কেবল বাইরের নয়, বরং অন্তর্মুখী, যেখানে প্রত্যেকটি প্রশ্নের ভেতরেই লুকিয়ে থাকে অপ্রকাশিত যন্ত্রণার এক দীর্ঘ প্রতিধ্বনি। (আগামী সংখ্যায় পড়ুন)

সম্প্রতি