image

ধারাবাহিক ভ্রমণ কাহিনী-২২

লোরকার দেশে

চৌধুরী সালাহউদ্দীন মাহমুদ

এখনো চোখে লেগে আছে কাল রাতে দেখা আন্তনি গাউদির স্থাপত্য শিল্প ‘পালাও গোয়ে’। সেটি দেখে তাঁর আরো সৃষ্টি দেখার তৃঞ্চা বেড়ে গেল। তবে তার সুযোগও অবারিত। বার্সেলোনাতে ছড়িয়ে আছে গাউদির অনেক শিল্প-কর্ম, যা দিয়ে তিনি প্রাচীনতা থেকে আধুনিকতায় নিয়ে এসেছেন এ শহরটিকে। এখানে তাঁর এত সৃষ্টি, কোনটি দিয়ে শুরু করব?

কোন শিল্পীর মাস্টারপিস দিয়ে শুরু করাটা মনে হয় সবচেয়ে লোভনীয়। আন্তনি গাউদির মাস্টারপিস দিয়েই আজকের সকালটি শুরু করা যাক।

অচিরেই বুঝতে পারলাম এ মাস্টারপিসটি বার্সেলোনার এক আইকন হয়ে আছে, যেরকম আলহাম্বরা গ্রানাদার, আইফেল টাওয়ার প্যারিসের। একজন বলল যে, গুস্তাভ আইফেল তাঁর বিখ্যাত টাওয়ারটি বার্সেলোনায় নির্মাণ করার কথা ভেবেছিলেন, পরে তা করেছেন প্যারিসে। তার প্রাথমিক চিন্তা বাস্তব রূপ লাভ করলে তো সাগ্রাদা ফ্যামিলিয়ার সাথে আইফেল টাওয়ার এর প্রতিযোগিতা লেগে যেত, কে হবে প্রথম। তবে শিল্পের বেলায় প্রথম দ্বিতীয় বলে কিছু নেই। এ যেন বিশাল অরণ্যের মাঝে শতবর্ষী বহু গাছের পাশাপাশি দাঁড়ানো, সবাইর মাথা উঁচু হয়ে থাকে সূর্যের দিকে।

সাগ্রাদা ফ্যামিলিয়া দেখতে আসলাম। গির্জার বাইরে, ভেতরে, আশেপাশে মানুষের ঢল। টিকেট কাটার লম্বা লাইন, অপেক্ষার সময়ও অনেক। সবাই টিকিট পাবে কিনা তাও নিশ্চিত নয়। তবে গাইডেড ট্যুরের টিকিট আগে কেটে রাখাতে আমাদের অপেক্ষা করতে হবে না।

হুয়ারেস থরেস হাতে ক্রুশ আঁকা পতাকা নিয়ে আমাদের স্বাগত জানালো। এরকম এক স্থাপত্য, আর ইতিহাস বলা হবে না, তাতো হয় না। আমি নাবিল ও নাতাশাকে সান্ত¡না দিয়ে বললাম, ‘১০-১৫ মিনিট সময় একটু ধৈর্য ধর, দেখতে দেখতে সময় কেটে যাবে। আর তোমরা এসব ইতিহাস না শুনলেও পার। আমি স্যুভেনির শপ থেকে সাগ্রাদা ফ্যামিলিয়ার এক বই কিনব। তোমরা পরে তা দেখে নিতে পার।’ দুজনেই বলল, ‘এর দরকার হবে না।’ আমি ভাবতে লাগলাম, কিসের দরকার হবে না- ইতিহাসের, না বইয়ের?

হুয়ারেস শুরু করল তার বর্ণনা, ‘সাগ্রাদা ফ্যামিলিয়া প্রকল্প শুরু হয় ১৯ মার্চ, ১৮৮২ সালে, স্থপতি ছিলেন ফ্রান্সেস দে পউলা দেল ভিয়ার। তিনি পদত্যাগ করলে ১৮৮৩ সালে দায়িত্ব নেন স্থপতি আন্তনি গাউদি। তখন তিনি নিজের পরিকল্পনা ও নকশা তৈরি করে জীবনের শেষ ৪৩ বছর এর জন্য কাজ করেন। আন্তনি গাউদি ১০ জুন, ১৯২৬ সালে এক ট্রাম দুর্ঘটনায় গুরুতর আহত হন। তাঁকে অনুরোধ করা হয়েছিল আরো ভাল হাসপাতালে যেতে, তিনি রাজী হননি। তিন দিন পরই তিনি চিরবিদায় নেন তাঁর স্বপ্ন সাগ্রাদা ফ্যামিলিয়াকে অসম্পূর্ণ রেখে। তবে বড় কোনো স্বপ্ন থেমে থাকে না, তা এগিয়ে যায় পাহাড়ি ঝর্নার মতো। গাউদির এক শিষ্য সাগ্রাদা ফ্যামিলিয়া প্রকল্পের দায়িত্ব নেন। এরপর আরো কয়েকজন স্থপতি কাজটি তদারক করেছেন, অনেকে এখনো করছেন। শুরু থেকে এখন পর্যন্ত প্রায় ১৪৩ বছর, এখনো এর কাজ চলছে। তা শেষ করে ২০২৬ সালে আন্তনি গাউদি-র মৃত্যু শতবার্ষিকীতে এর আনুষ্ঠানিক উদ্বোধন করার পরিকল্পনা আছে।’

ট্রাম দুর্ঘটনার কথায় মনে পড়ে গেল আমাদের প্রিয় কবি জীবনানন্দ দাশ এর কথা। পৃথিবীর দুই বিখ্যাত ব্যক্তি ট্রাম দুর্ঘটনায় মারা গেছেন। কে জানে ট্রাম ধাক্কা দেয়ার সময় গাউদি ভাবছিলেন সাগ্রাদা ফ্যামিলিয়া-র কোন নকশা নিয়ে, আর জীবনানন্দ কল্পনা করছিলেন কোন কবিতার ভাব ও পংক্তি। তাঁরা চলে গেছেন, তবে রেখে গেছেন তাঁদের অনুপম সৃষ্টি। এ দুই মহান ব্যক্তির জন্য বেদনায় মন ভরে গেল।

নাবিল জিজ্ঞেস করল, ‘১৪৩ বছরেও সাগ্রাদা ফ্যামিলিয়ার কাজ শেষ হয়নি। কারণ কী?’

হুয়ারেস হেসে বলল, ‘দেরি হওয়ার কয়েকটি কারণ আছে। মূল কারণটি হলো এটি বিশাল ও জটিল এক প্রকল্প। আন্তনি গাউদি অনেক নতুন ভাবনা ও স্থাপত্য শৈলী এখানে নিয়ে এসেছেন, তার সবকিছু একসাথে যোগ করা সময়ের ব্যাপার। আন্তনি গাউদিও কোন তাড়াহুড়া করেননি, উনি বলতেন, My client (God) is in no hurry । দেরি হওয়ার আরো একটি কারণ স্পেনের দুঃখজনক ইতিহাসের সাথে জড়িত। স্পেনের গৃহযুদ্ধের সময় জুলাই ১৯৩৬ সালে বিপ্লবীরা এ গির্জায় আগুন লাগিয়ে দেয়। এতে এর কিছু অংশ, আন্তনি গাউদির মূল পরিকল্পনা, স্থাপত্য নকশা ও অনেক প্লাস্টার মডেল পুড়ে যায়। এসব পুনরুদ্ধার করতে লাগে দীর্ঘ ১৬ বছর। কাজটির এ দীর্ঘ সময় নেয়ার আরেক কারণ হলো, এর নির্মাণের ব্যয়ভার মেটানো হয় জনগণের চাঁদা ও টিকিট বিক্রির অর্থ থেকে। সরকার বা কোন চার্চ থেকে সাহায্য নেয়া হয় না।’

নাতাশা বলল, ‘এখন তো টেকনোলজির যুগ। তার সাহায্য নিয়ে কাজটি ত্বরান্বিত করা যায়।’ হুয়ারেস বলল, ‘হ্যাঁ, এখন টেকনোলজির সাহায্য নেয়া হচ্ছে। তাতে কাজটি দ্রততর হচ্ছে।’

ভাবলাম- এত জটিল প্রকল্প, দীর্ঘ করুণ ইতিহাস, অনেক উচ্চ ধারণা- এটি দেখে হতাশ হবো নাতো? ইতিহাস থেকে এখন গেলাম শিল্পে। হুয়ারেস বলল, ‘এখন তোমরা শুনবে কম, দেখবে বেশি।’ ভালই।

সাগ্রাদা ফ্যামিলিয়া এখন আমাদের সামনেই। চমকে উঠি এর বিশালত্ব, আর সাথে মানুষের কল্পনাশক্তি ও সৃষ্টিশীলতার বিস্তার দেখে। ৩৩০ ফিটের ৮টি বিশাল টাওয়ার প্রথমেই চোখে পড়ে। সম্পূর্ণ হয়ে গেলে এর মোট টাওয়ার হবে ১৮টি আর এটি হবে বিশ্বের সবচেয়ে উঁচু গির্জা। হুয়ারেস বলল, ‘কেন্দ্রীয় টাওয়ারটি হবে ৫৬০ ফিট উচ্চ, এটি বার্সেলোনার উচ্চতম বিন্দু মন্টজুয়িক পাহাড় থেকে ১ মিটার নিচে রাখা হয়েছে। কারণ, আন্তনি গাউদি বিশ্বাস করতেন, মানুষের নির্মিত কোনকিছু ¯্রষ্টার সৃষ্টির ওপরে যেতে পারে না।’

নেটিভিটি ফসাদ-এর সামনে দাঁড়িয়ে সবাই এর ৪টি টাওয়ারের অপূর্ব কারুকাজ দেখছি। এইটিই একমাত্র অংশ যা গাউদির জীবনকালে শেষ হয়েছিল। এতে তিনি ‘কাতালান মদারনিসমা’? শৈলীর সৃষ্টিশীল প্রয়োগ করেছেন। ফসাদটির রয়েছে তিনটি সুদৃশ্য প্রবেশ পথ, যার সম্মুখভাগে ভাস্কর্য ও কারুশিল্প দিয়ে যীশু খ্রিস্ট্রের জন্ম চিত্রিত করা হয়েছে। গাউদির অনুপ্রেরণার অন্যতম উৎস হলো প্রকৃতির জৈব রূপ, যার প্রয়োগ তিনি করেছেন এই ফসাদে। সম্মুখভাগের স্তম্ভগুলি গাছের গুঁড়ির শৈলীতে নির্মিত। তার চারপাশে যোগ করা হয়েছে রঙিন কীটপতঙ্গ ও লতাপাতার নকশা, যাতে এটি হয়ে উঠেছে প্রাণবন্ত। তার ওপরে প্রতিদিন সরাসরি পড়ে ভোরের উদিত সূর্যের আলো।

ভেতরে প্রবেশ করতেই প্রথমে চোখে পড়ল আলোর বর্ণিল প্রবাহ। দৃষ্টিনন্দন সব শিল্পকর্ম দিয়ে জানালার রঙিন কাচগুলো শোভিত। গাছ-আকৃতির স্তম্ভগুলি শাখা-প্রশাখা ও পাতা নিয়ে স্পর্শ করেছে উঁচু সিলিংকে, সব মিলিয়ে মনে হচ্ছে যেন পাথরের এক অরণ্য। সূর্যের আলো নানা রঙের কাচের জানালা ভেদ করে পড়েছে তাদের ওপর। সূর্যের অবস্থানের পরিবর্তনের সাথে সাথে এ আলোর রঙ ও প্রবাহও ধীরে ধীরে বদলাচ্ছে। তৈরি হয়েছে এক অপার্থিব পরিবেশ। এর মাঝে চ্যাপেলে অনেকে প্রার্থনা করছে, কেউ কেউ কান্নাও করছে। মনে পড়ে গেল সাগ্রাদা ফ্যামিলিয়ার ভেতরের দৃশ্য দেখে লোরকার অভিমত, ‘আমি শুনতে পাই স্বর্গের প্রতি কান্নার আওয়াজ, যা তীব্র হতে হতে দেবদূতদের ভেঁপুর সাথে মিশে যায়; এ এক কলরব যা আমি সহ্য করতে পারি কয়েক মুহূর্ত মাত্র।’১ তবে আমরা ছিলাম অনেকক্ষণ, আর মন ভরে উঠল প্রশান্তিতে।

সবশেষে হুয়ারেস বলল, ‘এখন গাউদিকে শ্রদ্ধা নিবেদনের পালা। সে সুযোগ তোমাদের আছে। গির্জার নি¤œ কক্ষে সমাধিগৃহে তাঁকে সমাহিত করা হয়েছিল। চল, আমরা এখন সেখানে যাই।’ সবাই আন্তনি গাউদির সমাধির সামনে দাঁড়িয়ে তাঁর স্মৃতির প্রতি শ্রদ্ধা জানালাম। শেষে রমিরেজ চমৎকার করে বলল, ‘এ বিশাল সাগ্রাদা ফ্যামিলিয়াই আন্তনি গাউদি-র স্মৃতি-স্তম্ভ।’

অবশ্য আন্তনি গাউদি-র এ রকম স্মৃতি-স্তম্ভ সারা বার্সেলোনা জুড়ে, যার আরেকটির দিকে একটু পরে আমরা চললাম।

‘লা পেদরেরা’-এর সামনে গাইড মার্তিনেস গার্সিয়া আমাদের স্বাগত জানালো। মোট ৮ জনের ছোট একটি দল। মার্তিনেস শুরু করল, ‘বার্সেলোনা-র ধনী ব্যক্তি পেরা মিলা ছিলেন আন্তনি গাউদির বন্ধু ও পৃষ্ঠপোষক, তাঁর জন্যই তিনি এ বিখ্যাত ভবনটি ডিজাইন করেন। সেজন্য এর আদি নাম ‘কাসা মিলা’, অর্থাৎ মিলার বাসা। শুধু ভবন দুটি নয়, এর প্রতিটি খুটিনাটি বস্তু- আসবাবপত্র, বাতি, ফুলের টব, দরজা-জানালা-ব্যালকনি, মেঝে- গাউদি ডিজাইন করেছেন। তাঁর সরাসরি তত্ত্বাবধানে সে সময়ের সেরা কারুশিল্পীরা কাজ করেছেন, হাতের নৈপুণ্য ও দক্ষতায় তারা পাথর, ঢালাই লোহা ও কাঠকে পরিণত করেছেন এক একটি শিল্পবস্তুতে। এখন আমরা তার কিছু নমুনা দেখব।’

‘লা পেদরেরা’ দেখেই চোখে লাগল এক ধাক্কা, কারণ এ রকম ভবন এর আগে দেখিনি। ভবনের ডিজাইন যে এরকম হতে পারে তারও কোন ধারণা ছিল না। এ একেবারে অন্যরকম, যা ‘কাতালান মদারনিসমা’?-এর এক রূপ। পুরো ভবন জুড়ে ঢেউ খেলানো রেখা, সরল রেখা নেই বললেই চলে। ১৯০৬-১৯১২ সালে এ ভবন নির্মাণ করার পরে আন্তনি গাউদি অনেক আলোচনা সমালোচনার সম্মুখীন হয়েছিলেন। ‘লা পেদরেরা’ একটি কাতালান শব্দ, যার মানে ‘পাথরের খনি’। এ ভবনের সারা অঙ্গ জুড়ে আছে অমসৃণভাবে কাঁটা পাথর ও তার বাঁক, সে জন্যই ব্যঙ্গ করে তাকে ডাকা হতো ‘লা পেদরেরা’ বলে। তবে এ নামটিই জনপ্রিয় হলো, কাসা মিলা নয়।

এর আগে সাগ্রাদা ফ্যামিলিয়াতে দেখেছি, প্রকৃতিই হচ্ছে আন্তনি গাউদি-র স্থাপত্য চিন্তার উৎস ও অনুপ্রেরণা, আর তার সাথে তিনি একতা করেছেন স্থান ও আলোর। এবার তা দেখলাম ‘লা পেদরেরা’তে।

লতা-পাতা-ফুলের ম্যুরাল দিয়ে সজ্জিত দুটি প্রবেশ তোরণ ও একটি চত্বর। বৃত্তাকার ও অর্ধ-বৃত্তাকার বহু খিলান দিয়ে নির্মিত হয়েছে উজ্জ্বল আলোর হলঘর; তার দরজা, জানালা সব হাতের কারুকাজে সজ্জিত। ঢালাই লোহার তৈরি ব্যালকনিকে দেয়া হয়েছে ভাস্কর্যের রূপ। স্থাপত্য ও ভাস্কর্যের এ এক আশ্চর্য মেলবন্ধন।

মার্তিনেস এবার নিয়ে গেল ছাদে, বলল, ‘এটি হচ্ছে বার্সেলোনার সবচেয়ে সুন্দর ছাদ।’ এখানে সবকিছুই অভিনব। দেখলাম শৈল্পিকভাবে নির্মিত ২৮টি চিমনি, যাদের দেয়া হয়েছে ভাস্কর্যের আদল, তাই মনে হচ্ছে তারা জীবন্ত। আছে ৬টি স্কাইলাইট, মৃৎপাত্রের টুকরো দিয়ে এর ৪টিকে শোভিত করা হয়েছে। একটি চিমনির ওপরে বসানো আছে ভাঙ্গা কাঁচের টুকরো। ছাদের ওপর দাঁড়িয়ে দেখলাম সাগ্রাদা ফ্যামিলিয়া সহ বার্সেলোনা শহরের অপূর্ব এক প্যানোরামিক ভিউ।

সাগ্রাদা ফ্যামিলিয়া ও লা পেদরেরা স্থাপত্য দুটির বিপুল প্রাচুর্য ও অভিনবত্ব আমাদের অভিভূত করে রাখল। ভাবলাম তা কাটাতে এখন নিসর্গের ছায়া দরকার। যেখানে গেলাম সেটিও গাউদির আরেক সৃষ্টি। গাউদি নামক বটবৃক্ষের শাখা প্রশাখা পুরো বার্সেলোনা জুড়ে বিস্তৃত। তার এক শাখা এই ‘পার্কে গোয়ে’ পর্যন্ত চলে এসেছে। সুন্দর ও বিশাল এক পার্ক, তার প্রতিটি প্রাঙ্গণে গাউদির বিশেষ শৈলীর ছাপ। এটি কি নিসর্গের মাঝে স্থাপত্য, না স্থাপত্যের মাঝে নিসর্গ? হয়তো দুটিই!

যা ভেবেছিলাম সেরকম পার্ক নয় এটি। বরং বলা যায় মডার্নিস্ট স্থাপত্য ও শিল্পকর্মের এক প্রদর্শনী ‘পার্কে গোয়ে’। তবে আন্তনি গাউদির শিল্প-ভাবনার মূল খুঁজতে গেলে এ পার্ক থেকে শুরু করতে হবে।

প্রথমে মনে হলো কোন রূপকথার রাজ্যে প্রবেশ করছি। নাবিল ও নাতাশা খুশি হয়ে বলে উঠল, এ যে দেখি ডিজনিল্যান্ড। ঢুকতে দু’পাশের রহস্যময় বাড়ি দুটি দেখে অনেকটা তাই মনে হলো। আমাদের স্বাগত জানাল এল ড্র্যাক- দীপ্তিমান রঙের মোজাইকে তৈরি এক গিরগিটির ফোয়ারা। আন্তনি গাউদি-র মদারনিসমাশৈলীর এ এক বড় উদাহরণ। পরিত্যক্ত সিরামিক টাইলস ও ভাঙ্গা কাঁচ জোড়া লাগিয়ে তিনি গিরগিটির এ মোজাইক স্থাপত্য সৃষ্টি করেছেন। কালত্রমে ‘এল ড্র্যাক’ হয়ে ওঠে ‘পার্কে গোয়ে’-র সবচেয়ে জনপ্রিয় আইকন। গিরগিটির সাথে ছবি তুলে পাশের সিড়ি বেয়ে পার্কের ভেতরে ঢুকলাম।

এখানেও গাউদির পরিচিত শিল্প-চিহ্ন- প্রকৃতির সাথে একতা, বাঁকা ও ঢেউ খেলানো নকশা, আর ঝলমলে রঙ। আছে পাথরের স্তম্ভ, যা গাছের নকশায় বানানো, দেয়ালের সাথে পাথরের তৈরি পাখির বাসার সারি, মাঝে মাঝে সবুজ গাছপালা। সাথে আছে পাম গাছের আদলে তৈরি পাথরের তোরণ-শ্রেণি।

সামনেই হাইপোস্টাইল হল-৮৬টি ডোরিক২স্তম্ভ এবং রঙিন সিরামিক টুকরার মোজাইকের সিলিং ঘেরা এক বিশাল হল।

মাঝখানে সুন্দর গোলাপি রঙের ভবন ‘কাসা মুজে গাউদি’। এখানে স্থপতি বাস করেছেন ১৯০৬-১৯২৫ সালে, এখন এটি একটি জাদুঘর। এখানে দেখা যায় ব্যক্তি গাউদিকে, স্থপতি গাউদিকে নয়। ভেতরে যেয়ে নাবিল ও নাতাশা বেশ আগ্রহ নিয়ে দেখল আন্তনি গাউদির শয়নকক্ষ, ও তাঁর ব্যবহৃত বিভিন্ন জিনিষপত্র। তাছাড়া গাউদির নকশাকৃত বহু আসবাবপত্র ও শিল্পকর্ম বিভিন্ন স্থান থেকে সংগ্রহ করে এখানে রাখা আছে।

এরপর ওপরের বড় চত্বর ‘প্লাসা দে লা নাতুরা’ পৌঁছে দেখি মানুষের এক ঢল। বলা যায় এটি ‘পার্কে গোয়ে’-র কেন্দ্রস্থল। একে ঘিরে রেখেছে বহু রঙের মোজাইকের কাজ করা এক বেঞ্চ, যা সর্পিল আকারে চলে গেছে পুরো চত্বরে। সবাই দেখছে এক প্যানোরামিক ভিউ- সাগ্রাদা ফ্যামিলিয়া,বার্সেলোনা বন্দর, মন্টজুয়িক পাহাড়সহ বৃহত্তর বার্সেলোনা শহরের অপূর্ব দৃশ্য। আমরাও যোগ দিলাম, অনেকক্ষণ দেখলাম মানুষের গড়া ও প্রাকৃতিক সব দৃশ্য। পাশের একজন বলল, তোমরা আরো ওপরে যেতে পার, পার্কের সবচেয়ে উঁচু জায়গা ‘থুরো দে লেস ক্রেউস’-এ, সেখান থেকে আরো পরিষ্কার দৃশ্য দেখবে। তা শুনেই নাবিল ও নাতাশা লাফ দিয়ে উঠে সেদিকে যাত্রা করল।

‘পার্কে গোয়ে’ ছড়িয়ে আছে ‘থুরো দেল কারমেল’ নামক পাহাড়ের ঢালুতে, তা বেয়ে আমরা উঠতে লাগলাম ওপরে। এখন আর পাথরের বা মোজাইকের গাছপালা-লতাপাতা-প্রাণি নয়, আছে শুধু প্রকৃতির অকৃত্রিম শোভা। সরু পথে হাঁটতে লাগলাম। মাঝে মধ্যে যাত্রা সহজ করার জন্য আছে সিঁড়ি। যতই ওপরে উঠছি রাস্তাটি ততই খাড়া হয়ে যাচ্ছে। থেমে কিছুক্ষণ বিশ্রাম নিলাম। নাতাশা থামতে রাজি নয়, কারণ সূর্যাস্তের আর মাত্র আছে ২৫ মিনিট, সে এত উঁচু থেকে সূর্যাস্তের দৃশ্য দেখার সুযোগ হারাতে চায় না। আমিও দেখার জন্য আগ্রহী। উঁচু থেকে আমরা আরেকবার সূর্যাস্ত দেখেছি। সে একই সাগর-ভূমধ্যসাগর, তবে ভিন্ন শহর ও বন্দর-জিব্রাল্টার। রক অফ জিব্রাল্টার থেকে দেখা সেদিনের সূর্যাস্তের প্রেক্ষাপটের সাথে আজকেরটির বেশ মিল আছে।

যতই উঠছি ততই কষ্ট বেড়ে যাচ্ছে। তবে সান্তনা যে কাছাকাছি চলে এসেছি। এত উঁচুতে জিপিএস কাজ করে না, আমরা সময়ের হিসেবে দূরত্ব অনুমান করছি। ‘প্লাসা দে লা নাতুরা’ থেকে মোট ৪০/৪৫ মিনিট লাগার কথা। ৩০ মিনিট পার হয়ে গেছে। আশা করছি সূর্যাস্তের ১০ মিনিট আগেই পৌঁছে যেতে পারব।

মনে হচ্ছিল আমরা হিমালয়ের দুর্গম পথে এভারেস্ট চূড়ার দিকে উঠছি। সেটি ভাবতেই একটু অনুপ্রেরণা পেলাম। নাবিলতে কথাটি বলতেই সে বলল, ‘এ দুটির কোনো তুলনাই হয় না। এভারেস্টের চূড়ার উচ্চতা ২৯,০০০ ফিট , আর ‘থুরো দে লাস থ্রেস ক্রেউস’এর উচ্চতা ৬০০ ফিট।’ বললাম, ‘এর লিটারেল মিনিং ভাবলে হবে না। এটি আমি বলেছি প্রতীকী অর্থে, তোমাদের উৎসাহ দেয়ার জন্য।’

শেষ পর্যন্ত ছুঁতে পারলাম সে উচ্চ শৃঙ্গ ‘থুরো দে লাস থ্রেস ক্রেউস’। আনন্দে নাবিল ও নাতাশা আমাদের জড়িয়ে ধরল।

এখানেও জড়ো হয়েছে বহু লোক। সবাই সূর্যের বিদায়ের অপেক্ষায়। আমরাও যোগ দিলাম সে বিদায়ী অনুষ্ঠানে।

একটু পরে আসল সেই লগন। ভূমধ্যসাগর, মন্টজুয়িক পাহাড়, সাগ্রাদা ফ্যামিলিয়া, বার্সেলোনা শহর ও বন্দর, পার্ক গোয়ে- সবাইকে সামনে রেখে সূর্য আস্তে আস্তে বিদায় নিল, আর সবদিক রাঙিয়ে দিয়ে গেল সোনালি-কমলা আভায়।

সে আভায় নীল আকাশের নিচে গাছগুলোকে লাগছে পরাবাস্তব ছবির মতো, যেন এক মায়াবী বন। তাদেরকে কেউ যেন বাইরে থেকে এসে এ পাহাড়ের ওপর বসিয়ে দিয়ে গেছে। এ গাছগুলোর কথাই যেন বলেছেন লোরকা তাঁর কবিতায়:

গাছ!

তোমরা কি কোনোদিন আকাশের নীল থেকে

মাটিতে বিদ্ধ হয়েছিলে?

কার সেই প্রবল গাণ্ডিব

তোমাদের গেঁথে দিয়ে গেল? আকাশের তারা?

যে-সুর উৎসারিত তোমার গভীরে সেই ধ্বনি পাখি-আত্মার,

সে সুর আসলে দৃষ্টি ঈশ্বরের,

সেই সুর অমলিন কামনার।

গাছ!

রুক্ষ শিকড় জানবে কি কোনদিন

মাটির কতটা নীচে প্রোথিত রেখেছি হৃদয় আমার?’৩

মায়াবনের গাছগুলোর মায়া ছেড়ে সবাই নিচে নামতে লাগলাম, নীরবে। ক্রমশ...

Ref:

১. Interview by Philipe Thiebant, Geberal Curator at the Musee d’Orsay in Paris with Pedro Uhart in his book `Gaudi Builder’.

২. কাতালান মদারনিসমা: স্পেনের কাতালান অঞ্চলের Modernisme নামক একটি শিল্প ও স্থাপত্য আন্দোলন, যা ইউরোপের Art Nouveau-এর সমান্তরালে চলেছিল। এর প্রধান বৈশিষ্ট্য হচ্ছে: এটি প্রকৃতি-অনুপ্রাণিত, আলংকারিক, রঙিন টাইলস, লোহার কাজ ও রঙিন কাঁচের ব্যবহার এবং সরলরেখার বদলে বক্ররেখা ও জটিল নকশার প্রয়োগ। এটি কাতালান সংস্কৃতি ও পরিচয়ের এক নতুন ও আধুনিক রূপ তুলে ধরে, যা স্পেনের বৃহত্তর সংস্কৃতি থেকে আলাদা।একে বলা যায় কাতালান জাতীয়তাবাদী চেতনার বহিঃপ্রকাশ। আন্তনি গাউদির মতো স্থপতিরা বার্সেলোনায় অনেক বিখ্যাত ভবন, যেমন সাগ্রাদা ফামিলিয়া নির্মাণ করেছেন। এর সময়কাল হচ্ছে ১৯ শতকের শেষ থেকে ২০ শতকের শুরুর দিন পর্যন্ত। এ আন্দোলন বার্সেলোনাকে বিশ্বের এক বড় স্থাপত্যের শহর হিসেবে গড়ে তুলতে সাহায্য করে।

৩. ডোরিক কলাম: প্রচীন গ্রিক স্থাপত্যের একটি বিশেষ স্তম্ভ, যা তার সরলতা ও দৃঢ়তার জন্য সুপরিচিত।

৪. Arboles 1919: গাছ ১৯১৯: অনুবাদ: স্বপন ভট্টাচার্য।

সম্প্রতি