image
শিল্পী : নরোত্তম দুবে

জলনৃত্য

মহিবুল আলম

(পূর্ব প্রকাশের পর)

তিন

দুপুর গড়িয়ে বিকেল হয়ে এল। নিজু মাস্টারের অনুরোধে আবেদুর রহমান বিকেলের মধ্যে ঢাকা ফিরে যাওয়ার সিদ্ধান্ত বাতিল করলেন। তিনি ভাবলেন, তিনি বাংলাদেশে এসেছেন তো তাঁর জন্ম-গ্রাম দড়িকান্দি দেখতেই। ঢাকা ফিরে কী করবেন? কংক্রিটের শহরে গতকালই তিনি শহীদ মিনারটি দেখে এসেছেন। ঢাকায় ফিরে সাভার স্মৃতিসৌধটি দেখতে যাবেন। তাঁর নিজের জগন্নাথ কলেজে একবার ঘুরে আসবেন। যদিও জগন্নাথ কলেজ এখন জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয় হয়েছে।

নিজু মাস্টার এখন ঘরের ভেতরে ব্যস্ত। দুপুরে ডিম ভাজি করে ভাত খাইয়েছেন। রাতের খাবারের জন্য একটা মুরগি জবাই করেছেন। পাশের বাড়ির কোনো বউ-ঝিয়ারিকে ডেকে এনে রান্না করাচ্ছেন। আবেদুর রহমান এসব রান্না-বান্না করতে না করেছিলেন। তেলের খাবার তিনি খেতে পারেন না। আলসারের সমস্যা আছে। কিন্তু নিজু মাস্টার কোনো কথাই শোনেননি।

বাড়িতে নিজু মাস্টার একাই থাকেন। তিনি বিপতœীক। বউটা মারা গেছে বছর দশেক হলো। নিঃসন্তান ছিলেন। একটা ছেলেকে পালক নিয়েছিলেন। কিন্তু ছেলেটা বড় হয়ে চট্টগ্রাম পোর্টে চাকরি নিয়ে পালিত বাবার আর খবর নেয় না।

আবেদুর রহমান বসে আছেন একটা বেতের চেয়ারে, নিজু মাস্টারের বাড়ির উঠোনের পুবপাশে, একটি আম গাছের ছায়ায়। তাঁর দৃষ্টি ডেপার বিলের দিকে। আগের সেই দিগন্ত বিস্তৃত ডেপার বিলটা এখন আর এত বিস্তৃত মনে হচ্ছে না। এই ডেপার বিল ও ডোবা বিলে তাঁর কত স্মৃতি! বেশি স্মৃতি এই নিজু মাস্টারের সঙ্গেই। সেই ছোটবেলা থেকেই নৌকা তাঁদের একমাত্র বাহন। একসঙ্গে বড় হয়েছেন। একই স্কুলে লেখাপড়া করেছেন। একই সঙ্গে বাঞ্চারামপুর কলেজ থেকে আই.এ. পাস করেছেন। আই.এ. পাস করার পর নিজামুদ্দিন প্রাথমিক বিদ্যালয়ে চাকরি নিয়ে নিজু মাস্টার হন, আর তিনি চলে যান ঢাকা। কিন্তু পরে আবার একাত্তরে মুক্তিযুদ্ধের টেনিং নিতে আখাউরা হয়ে আগরতলা যান একসঙ্গে। দেশ স্বাধীনের যুদ্ধটাও একসঙ্গে করেন।

ডেপার বিলের যুদ্ধটা আবেদুর রহমানের এখনও চোখে ভাসে। সেই কতদিন আগের কথা! চুয়ান্ন বছর। পাকবাহিনী তখন বাঞ্ছারামপুর হাইস্কুলে ঘাঁটি গেড়েছে। তাদেরকে সর্বাত্মক সহযোগিতা করছে দড়িকান্দির মল্লিক বাড়ির সবাই। সোলায়মান মল্লিক ও মুস্তাক মল্লিক ডেপার বিলের আশেপাশের গ্রামগুলো থেকে কিছু তরুণ নিয়ে একটি রাজাকার বাহিনী গড়ে তুলেছে। সেই তাদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করতে এসেছে দশজনের একটি মুক্তিযোদ্ধার দল। সেই মুক্তিযোদ্ধাদের দলে ছিলেন নিজু মাস্টার ও আবেদুর রহমান।

তখন জুলাই মাস ছিল। উজানের জল বাড়তে বাড়তে ডেপার বিলে ছিল থৈথৈ জল। তাঁদের বাহন ছিল শুধুমাত্র দুটো ছইতোলা নৌকা। সঙ্গে ছিল একটি মর্টার এলএমজি ও দুটো এসএমজি। আর কিছু থ্রি নট থ্রি রাইফেল। অন্যদিকে পাকিবাহিনীর ছিল বেশ কয়েকটি ইঞ্জিনচালিত বোট ও একজন মেজরের অধীনে পাঁচ স্কোয়াড সেনা। সঙ্গে মল্লিক বাড়ির নেতৃত্বে রাজাকার বাহিনী তো ছিলই।

মুক্তিযোদ্ধাদের কম্যান্ডার ছিলেন তালেব উদ্দিন আখন্দ, ছড়িয়াকান্দির লোক। সহ-কম্যান্ডার ছিলেন নিজু মাস্টার। মুক্তিযোদ্ধারা সবাই আশ্রয় নেয় পাহাড়িয়াকান্দি গ্রামে। তাদের পরিকল্পনা ছিল, গেরিলা কায়দায় বাঞ্ছারামপুর হাইস্কুলের পাকিস্তান ক্যাম্পে অতর্কিত হানা দিয়ে সরে যাওয়া। এ নিয়ে ওরা পরপর দুইদিন বাঞ্ছারামপুর বাজার ও আশেপাশে রেকি করেন। রেকি করার দায়িত্ব ছিল আবেদুর রহমান, নিজু মাস্টার ও খাল্লার রহিম মিয়ার ওপর। কিন্তু তৃতীয়দিন ওরা সকালে রেকি করার প্রস্তুতি নিতে গিয়ে দূরে হঠাৎ ইঞ্জিনচালিত বোটের শব্দ শোনেন। কিছুক্ষণ পরদেখে ইঞ্জিনচালিত বোট একটা নয়, কয়েকটা। ওরা তখনই বুঝতে পারেন, যেভাবে হোক পাকবাহিনী ও রাজাকার বাহিনী পাহাড়িয়াকান্দি গ্রামে তাদের উপস্থিতির খবর পেয়ে গেছে।

মুক্তিযোদ্ধা ছিল মাত্র দশজন। এদের মধ্যে দুইজন আবার শুধু নৌকাচালক, কোনোমতে হাতিয়ার ধরতে পারে। অন্যদিকে পাকবাহিনীর সৈন্য ছিল অনেক। ওদের সঙ্গে রাজাকার বাহিনী। তারপরও মুক্তিযোদ্ধারা সারাদিন মরণপণ যুদ্ধ চালিয়ে যায়। কিন্তু সন্ধ্যার দিকে ওরা বুঝতে পারে, তাদের হাতের থ্রি নট থ্রি’র গুলি ও এলএমজি-এসএমজি’র গোলা একেবারে কমে এসেছে। তাদের পিছু হটা ছাড়া কোনো উপায় নেই। তারা সিদ্ধান্ত নেয়, যা করার তা রাতের মধ্যেই করতে হবে।

রাত খানিকটা বাড়তেই মুক্তিযোদ্ধারা পাহাড়িয়াকান্দির পুব দিক দিয়ে নৌকা ছাড়াই বিলের জলে নেমে যায়। ডেপার বিলে তখন কোথাও গলা অব্দি, কোথাও কোমর অব্দি জল। জ্যোৎস্নার রাত ছিল। জ্যোৎস্নার আলোতে বিলের চারিপাশের প্রতিটি গ্রাম ও পাড়াকে মনে হচ্ছিল একেকটা বিচ্ছিন্ন দ্বীপ। পাকবাহিনীর গুলি তখনও চলছিল। মুক্তিযোদ্ধাদের ভাগ্য ভালো ছিল, সারাদিন পাকবাহিনী ও রাজাকার বাহিনীর সেই বিশাল বহরের সঙ্গে যুদ্ধ করে একজন মুক্তিযোদ্ধাও আহত হয়নি। অন্যদিকে আটজন রাজাকারবাহিনীর সদস্য ও পাকসেনা হতাহত হয়, যা ওরা পরে শুনেছিল।

মুক্তিযোদ্ধারা সেরাতে এক কিলোমিটারের মতো বিলের জল পেরিয়ে কলাকান্দি গ্রামে গিয়ে ওঠে। সেখানে একটা মসজিদে আশ্রয় নেয়। মসজিদের ঈমাম তাদেরকে দেখে প্রথমে খুব চমকে যায়। পরে অবশ্য বাড়ি থেকে খিচুড়ি রান্না করে এনে তাদেরকে খাওয়ায়।

আবেদুর রহমান স্মৃতিতে ক্ষয়ে গিয়ে এমনভাবে ডেপার বিলটা দেখছিলেন, নিজু মাস্টার কখন তাঁর পাশে এসে দাঁড়িয়েছেন তিনি তা খেয়াল করেননি।

নিজু মাস্টার জিজ্ঞেস করলেন, কী ভাবছ, আবেদ?

আবেদুর রহমান কিছুটা চমকে উঠে বললেন, আমাদের যুদ্ধের কথা ভাবছি, নিজামুদ্দিন। ডেপার বিলে আমরা কী যুদ্ধটাই না করেছিলাম।

নিজু মাস্টার হতাশামিশ্রিত গলায় বললেন, সেই গল্প এখন আর কি কেউ করে?

চার

নিজু মাস্টারকে নিয়ে আবেদুর রহমান গ্রামটা দেখতে বের হলেন। গ্রামের পিছদোর-আগদোর ধরে সেই সরুপথ এখন আর নেই। পাড়ার পুবপাশ ধরে একটা দিঘল পথ এগিয়ে গেছে দক্ষিণ থেকে উত্তরে। উত্তর পাড়ার শেষ সীমানা শেষ বাড়িটা আবেদুর রহমানদের ছিল।

আবেদুর রহমান ও নিজু মাস্টার সরাসরি উত্তর পাড়ার শেষ সীমানাতেই চলে এলেন।

এখন অবশ্য উত্তর পাড়ার সীমানা বলতে কিছু নেই। আগে উত্তর পাড়ার শেষে মরডাঙ্গি খাল দিয়ে মল্লিক বাড়ির সঙ্গে একটা দূরত্ব ছিল। এখন মরডাঙ্গি খাল ভরাট হয়ে উত্তর পাড়া ও মল্লিক পাড়া এক হয়ে গেছে।

আবেদুর রহমান বাড়িতে পা দিয়ে ভিটের কোনো হদিস খুঁজে পেলেন না। তাঁদের ভিটে ও পেছনের মরডাঙ্গি খালটা ভরাট করে একটা দিঘল দোতলা দালান উঠেছে। এমনকি খালের পাড়ে ছোট্ট গোপাটে তাঁর বাবা-মাকে যে কবর দেওয়া হয়েছিল, সেটার অস্তিত্ব পর্যন্ত নেই।

আবেদুর রহমান জিজ্ঞেস করলেন, ‘নিজামুদ্দিন, এটা কার বিল্ডিং?’

নিজু মাস্টার বলেন, ‘মুস্তাক মল্লিকের ছেলে জুনায়েদ মল্লিকের। বাঞ্ছারামপুর বাজারে জুনায়েদ মল্লিকের রড-সিমেন্টের বড় দোকান আছে’।

‘আমাদের বাড়িটা অন্যায়ভাবে কিনে নিয়ে বিল্ডিং করেছে, ভালো কথা। আমার বাবা-মার কবরের জায়গাটা পর্যন্ত নিস্তার দেয়নি!’

‘মল্লিক বাড়ির মানুষদের নিয়ে এসব কথা বলে লাভ আছে? ওরাই এখন দড়িকান্দি ইউনিয়নে রাজত্ব করছে। বারবার এদের বাড়ি থেকেই ইউনিয়ন বোর্ডে চেয়ারম্যান হচ্ছে’।

‘তাই বলে কবরের ওপর বিল্ডিং তোলা?’

‘ওরা পারলে দড়িকান্দি কবরস্থানটাই তোলে দেয়। আর এটা তো ছিল তোমার বাবা-মার করবের ছোট্ট অংশ’।

আবেদুর রহমান মাথা ঝাঁকিয়ে বললেন, ‘মল্লিকদের সবাই আসলেই একেকটা দেশদ্রোহী’।

নিজু মাস্টার একটা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বললেন, ‘সেটা কি আর বলার অপেক্ষা রাখে, আবেদ! কিন্তু এখন দেশদ্রোহী-মুক্তিযোদ্ধা, এসব নিয়ে কে মাথা ঘামায়, বলো?’

আবেদুর রহমান বললেন, ‘মাথা ঘামায়, নিজামুদ্দিন, মাথা ঘামায়। এজন্যই দেশটা এখনও টিকে আছে। আচ্ছা, বাদ দাও ওসব কথা। আমাকে একটা কথা বলো, আমি তো আশেপাশে আমাদের জ্ঞাতিগোষ্ঠীর কাউকে দেখছি না?’

নিজু মাস্টার বললেন, ‘ওরা সবাই ওদের বাড়িঘর মল্লিকদের কাছে বিক্রি করে দিয়ে গকুলনগর চলে গেছে। ওখানে গিয়ে বিলে বাড়ি করছে’।

আবেদুর রহমান বুঝতে না পেরে জিজ্ঞেস করলেন, ‘কেন?’

নিজু মাস্টার বললেন, ‘টাকার লোভে। মল্লিকরা টাকার লোভ দেখিয়েছিল’।

‘তাই বলে নিজের বাপদাদার বসতভিটে বিক্রি করে দিবে?

‘তুমি দীর্ঘদিন বিদেশে থেকে এখানকার বাস্তবতাটা ভুলে গেছ, আবেদ’।

আবেদুর রহমান সায় দিয়ে বললেন, ‘হয়তো’।

নিজু মাস্টার বললেন, ‘চলো, যাই। ওদিকে বাড়িতে রান্নাবান্নার কী হলো দেখি গিয়ে। গ্রামে আর কিছু দেখবে?’

আবেদুর রহমান একটু লজ্জামিশ্রিত গলায় বললেন, ‘একটু রমেন স্যারের বাড়ির দিকে যেতে চাই’।

নিজু মাস্টার হেসে ফেললেন। জিজ্ঞেস করলেন, ‘কী, এখনও অপর্ণা দি’কে ভুলতে পারোনি?’

আবেদুর রহমান মাথা নেড়ে বললেন, ‘না’।

‘এই বুড়া বয়সেও না?’

‘স্মৃতির আবার বুড়া-জোয়ান বয়স আছে নাকি?’

‘তা অবশ্য ঠিক। আচ্ছা, চলো’।

আবেদুর রহমান জিজ্ঞেস করলেন, ‘ওখানে কি হেঁটে যাওয়া যায়?’

নিজু মাস্টার পান খাওয়া দাঁতহীন মাড়ি কেলিয়ে হো হো করে হেসে বললেন, ‘তুমি কি সেই নৌকার যুগে আছ যে নৌকা দিয়ে গিয়ে অপর্ণা দি’র বাড়ির পেছন থেকে লুকিয়ে লুকিয়ে তাঁকে দেখবে? আর মাঝখান থেকে আমাকে নৌকায় পাশে বসিয়ে শাস্তি দিবে? এখন হেঁটে গ্রামের এপাশ থেকে ওপাশ, সব জায়গায়ই যাওয়া যায়। সব জায়গায় রাস্তা হয়েছে’।

পাঁচ

দড়িকান্দির পুবপাড়ার পুরোটা নিয়ে সাহা বাড়ি ছিল। রমেন সাহার বাড়িটা ছিল পুবপাড়ার একেবারে প্রথমে। পুব দিকে মুখ করে ডেপার বিলের এক প্রশস্ত বায়ু ভেদ করে উত্তর পাড়ার যেকোনো স্থানে দাঁড়ালে অপর্ণা দির ঘরটা স্পষ্ট দেখা যেত।

অপর্ণা দির আটষট্টি সালে বিয়ে হওয়ার পর আবেদুর রহমান তাকে আর কোনোদিন দেখেননি। মুক্তিযুদ্ধের প্রথম দিকেই মে মাসে অপর্ণা দি নাকি ব্রাহ্মণবাড়িয়া ছেড়ে দড়িকান্দি গ্রামে চলে এসেছিলেন। এই আসার পেছনে অন্যতম কারণ, ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় অপর্ণা দি’র স্বামীর যে মিষ্টান্নভা-ার ছিল, সেখান থেকে পাকবাহিনী তার স্বামীকে ধরে অন্য মিষ্টান্নভা-ারের মালিকদের সঙ্গে ক্যাম্পে নিয়ে গুলি করে মেরে ফেলে। অপর্ণা দি উপায়ান্ত না দেখে দড়িকান্দি চলে আসেন। ভেবেছিলেন, জলের দেশ, ডোবা অঞ্চল, এখানে কে আসবে? কিন্তু জুলাই মাসে সোলায়মান মল্লিকের নেতৃত্বে কয়েকজন রাজাকার ও দুইজন পাকসেনা এসে রমেন সাহাকে মেরে অপর্ণা দিকে বাঞ্ছারামপুর হাইস্কুল ক্যাম্পে নিয়ে যায়। তারপর আর তার হদিস কেউ পায়নি। দেশ স্বাধীন হওয়ার পর আবেদুর রহমান তাকে অনেক স্থানে খুঁজেছেন। এমনও শুনেছেন, অপর্ণা দি কোলকাতা চলে গেছেন। কিন্তু এ তথ্য কতটুকু সত্য, এর কোনো প্রমাণ পাননি।

আবেদুর রহমান একটা দীর্ঘশ্বাস ছাড়লেন। ভাবলেন, সেই অপর্ণা দি। তাঁর এক বছরের বড় ছিলেন। কিন্তু পড়তেন একই ক্লাসে। একই নৌকায় করে বাঞ্ছারামপুর হাইস্কুলে যেতেন। বাঞ্ছারামপুর কলেজে আই.এ. পর্যন্ত পড়েছিলেন। রমেন সাহা ছিলেন দড়িকান্দি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষক। দড়িকান্দি গ্রামে যখন অপর্ণা দি’র সমবয়সী মেয়েরা পঞ্চম শ্রেণী পর্যন্ত পড়লেই বিয়ের জন্য প্রস্তুত হয়ে যেত, তখন রমেন সাহা মেয়েকে কলেজ পর্যন্ত পড়িয়েছিলেন। কিন্তু তাঁর সঙ্গে অপর্ণা দি’র এত মেলামেশা গ্রামের মানুষ ভালোভাবে নেয়নি বলে রমেন সাহা বদনাম থেকে বাঁচার জন্য মেয়েকে আই.এ. পরীক্ষা দেওয়ার আগেই বিয়ে দিয়ে দেন।

রমেন সাহার বাড়ির উঠোনে পা দিতেই আবেদুর রহমানের বুকটা ধ্বক করে উঠল। কত বছর পর তিনি এই উঠোনে পা দিলেন! কত স্মৃতি এই উঠোন ঘিরে! প্রতিটি জ্যোৎস্নার রাত। অমাবস্যার রাতে জানালা গলা হারিকেনের ছোট্ট আলো। ডেপার বিলের ভরাট জলের ওপর নৌকা ভাসিয়ে অপর্ণা দি’কে দেখা। কী অদ্ভুত সুন্দর ছিলেন অপর্ণা দি!

আবেদুর রহমান উঠোনের এদিকওদিক তাকালেন। উঠোনের পুবপাশে যে অপর্ণা দি’র ঘর ছিল, সেখানে এখন শূন্য ভিটে। এমনকি উত্তর পাশের অপর্ণা দি’র ছোট কাকার ঘর ছিল, সেই ভিটেও ফাঁকা। কিন্তু অবাক ব্যাপার হলো, ভিটের উঁচু মাটি, এমনকি মাটির পাড় এখনও স্পষ্ট। ভিটের ওপর কয়েকটি গাছ বেশ বড় হয়ে উঠেছে। আগাছাও জমেছে বেশ।

আবেদুর রহমান জিজ্ঞেস করলেন, ‘বাড়িটা এ অবস্থায় পড়ে আছে, কেউ নেয়নি?’

নিজু মাস্টার বললেন, ‘না’।

‘মল্লিক বাড়ির মানুষেরাও না?’

‘চেষ্টা করেছিল, কিন্তু পারেনি। অপর্ণা দি বেঁচে আছেন না মরে গেছেন, কেউ জানে না। মল্লিক বাড়ির আশেপাশে হলে হয়তো দখল করে নিত। এছাড়া সাহাবাড়ির অন্য লোকজন তো এখনও বেঁচে আছে।

‘তোমার কি মনে হয় অপর্ণা দি এখনও বেঁচে আছেন, নিজামুদ্দিন? আমার তো মনে হয় তিনি বেঁচে নেই’।

‘আমারও তাই মনে হয়। তবে গ্রামের কেউ কেউ বলে, অপর্ণা দি নাকি অদৃশ্য আত্মা হয়ে আসেন। কেউ কেউ তাকে সন্ধ্যাবেলায় এই উঠোনে হাঁটতে দেখে। ভোরবেলায় পুকুরের ঘাটে আনমনা হয়ে বসে থাকতে দেখে’।

আবেদুর রহমান অবিশ্বাসের গলায় বললেন, ধুর, কী বলো?

নিজু মাস্টার বলেন, ‘হ্যাঁ, ঠিকই বলছি। কেউ কেউ তো বলে, তোমার প্রেমের টানে নাকি অপর্ণা দি পরজগত থেকে ইহজগতে আসেন। তোমার অপেক্ষায় পুকুর ঘাটে বসে থাকেন’।

‘কে এই কথা বলে?’

‘আমাদের বয়সী যারা আছে’।

‘কী যা তা বলছ?’

‘হ্যাঁ, আমি ঠিকই বলছি। গ্রামের মানুষের মধ্যে এখনও তোমাদের দুইজনের কথা চর্চা হয়’।

আবেদুর রহমান মাথা ঝাঁকালেন। একটু ম্লান হাসলেন। এক মুহূর্তের জন্য চুপ হয়ে গেলেন। তারপর কী ভেবে বললেন, নিজামুদ্দিন, ‘চলো, একটু পুকুর ঘাটে যাই’।

নিজু মাস্টার অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করলেন, এখন?

‘কেন, ভয় পাচ্ছো নাকি?’

‘ধুর, এ বয়সে আমাদের আবার কিসের ভয়?’

আবেদুর রহমান বললেন, তাহলে চলো’।

নিজু মাস্টার মাথা ঝাঁকিয়ে সায় দিলেন।

উঠোনের ঠিক উত্তর দিকেই পুকুরটা। পূর্ব-পশ্চিমে দিঘালো। পুকুরের দক্ষিণ পাড়ে সারি করা সাহাবাড়ির প্রতিটি ঘর। পুব দিকে বড় একটি বাঁশঝাড় ও বেশ কয়েকটা আমগাছ। উত্তরে খোলা। জোয়ারের মওসুমে ডেপার বিল জলে ফেঁপে উঠলে পুকুরের উত্তর দিকের আইলের এক অংশ কেটে দেওয়া হয়। তখন পুকুরে বিলের প্রচুর মাছ এসে ভরে যায়। সুদিন শুরু হওয়ার আগেই আইলটা আবার ভরাট করে দেওয়া হয়।

ইটের পাকা ঘাটলাটা ঠিক অপর্ণা দি’র বাড়ি পেছন লাগোয়া। ওরা ঘাটলার মাঝ বরাবর এসে দাঁড়ালেন। ঘাটলার সর্বত্র পেট বের করা ইট তাকিয়ে আছে। কোথাও কোথাও ইট সরে গিয়ে ছোট ছোট গর্তের সৃষ্টি হয়েছে। এদিকে সবে সন্ধ্যা হয়ে এসেছে। সন্ধ্যার হাল্কা ছায়া প্রতিটি গাছের নিচে সবুজাভ নীল হয়ে দাঁড়িয়ে আছে। পুকুরের কালো জলে এক ধরনের নিস্তব্ধতা। পশ্চিম আকাশে তখনও গোধূলির খানিকটা আভা। পুকুর পাড়ের গাছগুলোতে তখনও পাখির ডাক থামেনি।

ঘাটলায় দাঁড়িয়ে আবেদুর রহমান পুকুরের পশ্চিমে তাকালেন। পুকুরের পশ্চিম পাড়ে একসময় দুটো হিজল গাছ ছিল। বৈশাখ-জ্যৈষ্ঠ মাসে লতানো রঙিন ফুলগুলো যখন ঝুলে থাকত, কী সুন্দর অবয়বই না ফুটে উঠত! মাঝেমধ্যে অপর্ণা দি লতানো হিজল ফুল গলায় প্যাঁচিয়ে দাঁড়িয়ে থাকতেন। জলে তখন ভাসত অসংখ্য হিজল ফুল। মনে হতো যেন পুকুরের জলে হিজল ফুলের বিছানা পাতা হয়েছে।

আবেদুর রহমান ঠিক বুঝতে পারলেন না, পুকুরের পশ্চিম পাড়ে হিজলগাছ দুটো এখনও আছে কি না। সন্ধ্যার আবছা আলোতে সেখানটায় মাথা উঁচু করা অনেকগুলো গাছ দেখলেন। আর দূর থেকে বাতাসের শনশন ধ্বনি শুনলেন।

আবেদুর রহমানের একটা স্মৃতি মনে পড়ে গেল। এক বিকেলে তিনি ছোট্ট নৌকা বেয়ে সাহা বাড়ির পাশ দিয়ে যাচ্ছিলেন। নৌকায় তিনি একাই ছিলেন। সাহা বাড়ির পাশ দিয়ে তাঁর নৌকা বেয়ে যাওয়ার একটাই কারণ ছিল, যদি তিনি অপর্ণা দি’কে এক নজর দেখতে পান।

সেদিন নৌকা থেকে আবেদুর রহমানের চোখ ছিল অপর্ণা দি’র পুব ভিটের ঘরের দিকে। কিন্তু নৌকা ঘোরাতেই তিনি দেখেন, অপর্ণা দি পুকুরের ঘাটলায় আপন ভঙ্গিতে একা গান গাইছেন ও গানের তালে তালে নাচছেন। তাঁর পরনে একটি হলুদ সুতি শাড়ি। বিকেলের হলুদ রোদে তাঁর হলুদ সুতি শাড়িটা অদ্ভুত সুন্দর লাগছে। মনে হচ্ছিল যেন হলুদ পরি। অপর্ণা দি এমনিতে হলুদাভ-ফর্সা সুন্দর ছিলেন।

অপর্ণা দি সেদিন নেচে নেচে গাইছিলেন, ‘মম চিত্তে নিতি নৃত্যে কে যে নাচে, তাতা থৈথৈ, তাতা থৈথৈ, তাতা থৈথৈ...’।

সেই স্মৃতিটা মনে মনে রোমন্থন করতে করতে আবেদুর রহমান ঘাটলার একপাশে পাটাতনে বসে গেলেন।

নিজু মাস্টার আঁতকে ওঠার গলায় বললেন, ‘এই আবেদ, কী করছো, কী করছো! ভাঙা ঘাটলা, ইটের ফাঁকে সাপ থাকতে পারে। এই জায়গাটা ভালো না’।

আবেদুর রহমান কোনো জবাব দিলেন না।

সন্ধ্যাটা আরেকটু ভারি হয়ে এল। পুকুরের জলে সবুজাভ-কালো রংটা আরও গাঢ় হয়ে এল। গাছগুলো থেকে পাখির ডাক থেমে গেল। পুকুরের জল থেকে সরু সরু রেখা করে ধোঁয়া উঠতে শুরু করল। পরিবেশটা একেবারে স্তব্ধ হয়ে গেল।

আবেদুর রহমান অবাক দৃষ্টিতে দেখলেন, পুকুরের জল থেকে ওঠা সরু সরু ধোঁয়া কু-লী পাকিয়ে একটি মানুষের অবয়ব নিচ্ছে। মানুষের অবয়ব নিতে নিতে আস্ত একটা মানুষ হয়ে যাচ্ছে। এই অবয়বটা আর কারও নয়, অপর্ণা দি’র। অপর্ণা দি’র সেই দীর্ঘ তনু। ধোঁয়াশা ছায়ায় একটি অপূর্ব সুন্দর মুখ। অপর্ণা দি জলের ওপর নাচছেন। জলে তখন কোথায় থেকে যেন অসংখ্য হিজলফুল ভেসে উঠল। আর তখনই মিহিসুর কানে এসে বাজল, ‘নাচে জন্ম নাচে মৃত্যু পাছে পাছে, তাতা থৈথৈ, তাতা থৈথৈ, তাতা থৈথৈ...’।

আবেদুর রহমান সম্মোহনের গলায় বলে উঠলেন, ‘নিজামুদ্দিন, দেখো, দেখো, অপর্ণা দি!’

নিজু মাস্টার একটু ভয়ার্ত গলায় বললেন, ‘কী যা তা বলছো!’

আবেদুর রহমান বললেন, ‘আমি সত্যি বলছি। ওই দেখ। ওই দেখ। অপর্ণা দি নাচছেন’।

নিজু মাস্টার ঘাটলার সিঁড়ি থেকে ওপরের দিকে উঠতে উঠতে বললেন, ‘আবেদ, চলো, চলো। তুমি পাগলের মতো কথা বলছো’।

আবেদুর রহমান জড়ানো গলায় বললেন, ‘আমি এখন কোথাও যাবো না। আমি এখানেই থাকবো!’

সমাপ্ত

সম্প্রতি