অন্তরাল
মহাদেব সাহা
মানুষের ভিড়ে মানুষ লুকিয়ে থাকে
গাছের আড়ালে গাছ,
আকাশ লুকায় ছোট্ট নদীর বাঁকে
জলের গভীরে মাছ;
পাতার আড়ালে লুকায় বনের ফুল
ফুলের আড়ালে কাঁটা,
মেঘের আড়ালে চাঁদের হুলস্থুল
সাগরে জোয়ার ভাটা।
চোখের আড়ালে স্বপ্ন লুকিয়ে থাকে
তোমার আড়ালে আমি,
দিনের বক্ষে রাত্রিকে ধরে রাখে
এভাবে দিবসযামী।
পাকা ধানের উল্লাস
রবীন্দ্র গোপ
সন্ন্যাসী দুপুর নাড়ার আগুনে উদাসী বাংলা
আলোথালু পাকা ধানের উল্লাসে উড়ে আসে পাখি
সোনালী চিলের ঠোঁটে জ্যান্ত মাছ নড়েচড়ে ওঠে
আমন ক্ষেতের আলে ডিম পাড়ে কচ্ছপ দম্পতি।
ধানের ঘ্রাণেই লোভি ইঁদুর আটক হয় ফাঁদে
কাঁদে মা সন্তান গেছে যুদ্ধে আর ফিরেনি সে ঘরে
এমন দিনেই বাংলায় ছিল ঘরে ঘরে দুর্গ
হেমন্তে বাউল বাতাস শীতের আগমনী গান।
প্রিয় দুখ দিনেও কাকেযে শুধু মনে পড়ে যায়
যেদিন গেছে যেজন গেছে জানি আসবে না আর
তবু তার জন্য অপেক্ষায় হেমন্তের পিঠা পার্বণে
ছলাৎ ছলাৎ জলের উপর নৌকা চলে দুলে
হেমন্তের ঘ্রাণে উৎসব আয়োজনে মনে পড়ে
মাধবীকে যে ছিল পরম ভালোবাসার বন্ধনে।
দুটি কবিতা
প্রাণজি বসাক
জীবন মৃত
আজ বিকেলে আমি কুটিকুটি ছিঁড়তে থাকি শরীর
উড়িয়ে দিই উচ্ছ্বসিত বাতাসে কুটিকুটি ছায়াদেরও
ছায়ারা উড়তে শেখেনি ধপ করে পড়ে যায় মাটিতে
কী আর করা মাটি তখন ধীরে ধীরে আঁকড়ে ধরে
শরীর নেই উড়ছে অঙ্গপ্রত্যঙ্গ ধরাধামে নেই অঙ্ক
কত লীলা সাঙ্গ হলো যতসব ভূতপ্রেত বন্ধুবান্ধবে
মাটিতে পা পড়ে না দেখে কপাটে রাখি তন্ময় রোদ
হেমন্তে জুড়ায় প্রাণ আর তুমি ছুঁয়ে দাও মোহন দাগ
কুয়াশা ভেসে আসে আর দূরে সরে যায় নদীর ¯্রােত
আমিও ভেসে যাই শরীর থেকে ছায়া থেকে মরুপ্রান্তে
মানচিত্রের ভাঁজে
ভাঁজ করে রাখি মানচিত্র ধুলোমাখা ক্যালেন্ডার
হঠাৎ তুমি ওড়াও টিয়াপাখি ঝাঁক সবুজ কথনে
হারিয়ে ফেলি দিনমাসতারিখ তীব্র এক মেজাজে
আগুনের তাপ বুঝে তুলে নিই পবিত্র পোড়াকাঠ
যেতে হবে বলে মন ফেরাই অথচ ধ্যান তোমাতে
আরো বহুদূর যেতে হবে অপর্ণা- অন্তহীন অনন্তে
রাফখাতার গল্পগুলো পড়ে থাকে অক্ষরশব্দে ঠাসা
তাড়াহুড়ো গুছিয়ে রাখলে ভোররাতের শিশিরকণা
হাত কাঁপছে ঠিকানাহীন ডোরবেল আজ বাজে না
মানচিত্রের ভাঁজে লুকিয়ে রাখা প্রশ্ন প্রশ্নই রয়ে গেল
ষাঁড়
শফিক ইমতিয়াজ
চারদিকে ফিসফাস ভয়ার্ত চাপাস্বর
এক বিশাল দেহের ষাঁড়
বিশ^বিন্দু থেকে পরিধি পর্যন্ত অনড় দাঁড়িয়ে!
আমি আমার নিজস্ব গ্রাম দেখতে চাই
ওই বিকট দেহের কারণে সম্ভব নয়
দেখতে চাচ্ছি প্রিয় শহর আমাদের
জীবন যেখানে সত্যের কঠিন পাঠ নিয়ে অপেক্ষায়;
মাঝখানে ষাঁড়
বহুতল অট্টালিকার মতোই ফুঁসে ওঠা প্রতিবন্ধ।
আমি আমার আশেপাশের কিছু বৃক্ষ চিনতে চাই
এই বুকের গহনে যাদের শেকড় ব্যাপ্ত
যাদের ছায়ার প্র¯্রবনে বসে নিজেকে ঠোকরাব ভাবি
কী বিস্ময়, দীর্ঘ জিভ দিয়ে
প্রতিদিন ষাঁড় সাবাড় করছে সে গাছের পাতা!
আমি কি বুঝে ওঠার বহু আগে
এক হিং¯্রচতুর ষাঁড়ের সঙ্গেই যুদ্ধে জড়িয়ে!
টলায়মান অস্তিত্ব, কথা বলো-
ভগ্ন গ্রাম, ইঁদুরটোকা শহর আর নিষ্পত্র বৃক্ষাদি
কেন ওই ন্যাবাচোখে করুণ তাকিয়ে?
মনের দুর্মতি
আতাউর রহমান মিলাদ
এতো রং লাগেনা ভালো।
উড়নচ-ী হাওয়া
এই তারকাঁটা দিন
কেটে ফেলা সময়ের অর্জিত ঋণ
ফিরে দেখা মুখগুলো মায়ার ঘুঙুর
মনের মৌচাক
হাসি ফোটে মোরগের ঠোঁটে
সন্ধ্যার খামে সুপ্রভাত জেগে ওঠে
কী যে অভাব আমার,চায় খ?্যাতির মোহর!
চারপাশে মাছির মঙ্গল
কাকতাড়–য়া হাত নাড়ে
শব্দরা বেসাতি করে মুদ্রণ স্বাক্ষরে
কফির কৈফিয়ত নেই,স্মৃতিরা অতীত নির্ভর
দাবার ঘোড়া চলে হিসেবের আড়াই ঘর...
তুমি একরকম হতে পারতে
দুলাল সরকার
তুমি এরকম হতে পারতে-
মেন্তের শস্য মাঠ, কাপালিক অনুভূতি
যা ছুঁয়ে যায় মজদুর আর কৃষককে,
আলো হাতে অন্ধকারে যে সুদূর পিয়াসী তুমি
হতে পারতে কথা ও গানের সম্পর্ক,
নিঃশব্দ গোলাপের অগণিত কথা
কাঁটা ভরা গায়ে ফুল হয়ে
কাদা পাও কিষাণের হয়ে ফুটতে,
তুমি এমনও তো হতে পারতে যে নৈতিক স্পষ্টতা
মানব শৈলী হয়ে অরুন্ধতী-
আকাশের নক্ষত্র হয়ে জ্বলতে।
তর্পণ কর মেঘ, জলের সরল
নজরুল হায়াত
তর্পণ করো মেঘ তর্পণ করো জল
তর্পণ করো ফুল তর্পণ করো ফল
তর্পণ করো হাওয়া জলের সরল
ধাতব সংঘাত বহুদূরে চলে যাক,
এই যে আছি নগরে কিম্বা গৈগেরামে
সর্বত্র ধাওয়া করে আসে সংঘাত
প্রাচীন অশ্বারোহীর নিখুঁত মসৃণ খুর
অহোরাত্র কোষমুক্ত রাখে তলোয়ার
বারোমাস কারারুদ্ধ রাখে ভালোবাসার সোনার প্রতিমা
সর্বত্র ঘোরাফেরা করে খলের অসরল
জলস্থল অন্তরীক্ষ নিদাঘ শীতপ্রাতে ছলনার প্রবল প্রতাপ
অহোরাত্র ছিন্নভিন্ন কাটে বোধ ও বোধাতীত স্বপ্ন বাহার,
তবে মুখর বৃষ্টি দাও হে নিটোল মেঘমালা
ঘনঘোর বর্ষা প্লাবন দাও, নিবিড় সবুজ দাও
মাখন সদৃশ রোদের আবেশ দাও
ধাতব সংঘাত বহুদূরে চলে যাক
উষ্ণ দুপুরে হৃদয় পড়ে পড়ে নিশ্চিন্ত ঘুমাক।
অসময়ের সিনেমা
রফিকুল ইসলাম আধার
রাত এখন
স্বপ্নের কোনো দায় কাধে নেয় না-
আকাশও ভুলে গেছে নক্ষত্রের ভাষা।
গোধূলি?
সে তো রক্তমাখা ক্যানভাস,
যেখানে প্রতিটি রঙ
জীবন হারানো মানুষের আর্তনাদ।
জল নেই।
শুধু হাড়
পাথরের মতো জড়ো হয়ে
তাদের গল্প বলে-
একটা মৃতপ্রায় সময়ের প্রেমকাহিনি।
রাস্তায় হাঁটে একটা মুখোশ...
নাম তার সাহসের নাভীমূল-
পায়ের নিচে পিষে ফেলে শব্দ, প্রেম, প্রতিবাদ।
সময় এখন
জোছনার কব্জিতে তালা লাগায়,
সূর্যকেও শেখায়
কীভাবে চোখ বেঁধে রাখতে হয়।
আর আমরা?
আমরা দাঁড়িয়ে দেখি
একটা অসময়ের সিনেমা-
বন্ধু, এতে ইন্টারমিশন নেই।
কাছের মানুষ
তাহমিনা কোরাইশী
একলা একলাই যে পথ প্রান্তরে মরীচিকা বলয়ে
মন বলে চলছি কারো পিছু পিছু!
নেই তো কেউ কাছে পিঠে
আমার মত আমি একলাই তবে,
দ্বৈত সত্তায় বেঁচে থাকা এ জীবন
কথা নিয়ে বাড়াবাড়ি খুনসুটি
একলাতে লাগে না খালি খালি
গল্প বা উপন্যাসের পাতাদের সংসারে
হারিয়ে কি খুঁজি বারে বারে!
গন্তব্য নাই হলো জানা, অজানারে হাতড়ে
সাঁতরে কত আশা বুকে নিয়ে ফিরি!
কেউ ডেকে বলেনি আজও- চলো
আমাদের নিঃসঙ্গতা দূর করি
আনন্দে হাতে হাত ধরি...
বিশ্বাস আজ সুদূর প্রবাসী
অন্ধ, কালা, বোবারা করে না দলবাজি
নিজের মঝে নিজেই একনিষ্ঠ একা
স্পর্ধা কতটা আমার দেখো!
নিজেকে নিয়ে এমনই এক শাসনে বাঁচি।
হেমন্ত জীবনানন্দময়
হাদিউল ইসলাম
এই দেশে হেমন্ত আসে জীবনানন্দময়
নুয়ানো ধানের শীষে আবছায়া শিহরন
সরিয়ে কুয়াশা যতনে দেখালে চাঁদ
অকস্মাৎ রহস্যে মঞ্জুল বিমুগ্ধ আরাম
চতুর্দিকে কৌমার্যের কীর্তনের শেষে
কম্পিত মথুরা পায়ের তলায়
হেমন্ত বিস্তর সবজির গান, আঙুলের
আলতো ছোঁয়ায় ভাঙা শিশিরের খলবল
এখনও মনোগ্যামি ঘুড়ি হেমন্ত আকাশে
এখনও ষোলকলা জোছনায় ভিজে-
বেহাগ-ভৈরবীর কাক, একান্ত শালিক তার
সরু সরু পায়ে নাচে মাঠময় আনন্দে তুমুল
এই দেশে হেমন্ত এলেই, দেখি-
পাতা কপির মতোন হেসে ওঠা অলীক পৃথিবী
প্রস্তর কথা
চন্দনকৃষ্ণ পাল
অপরাজিতার নীল কতো দিন দেখা হয় না।
মেঘালয়ে মেঘমালা জমে থাকে স্থির
জল¯্রােত যদিও অস্থির
প্রস্তরেরা গড়ায় ঢালুতে
সমুদ্রের লোনা স্বাদ ছুঁতে
মাঝপথে শিকারী মানব
অদৃশ্য দানব
হয়ে শুষে নেয় প্রাণরস তার
আর
বিবিধ মিশ্রণে তার স্বপ্ন বিলোপ
গিরিশ্রেণি, বনরাজি, সমভূমে কত ভাঁট ঝোপ
সাদা সাদা ফুল স্বপ্ন অনন্তে মিলায়
মানুষেরা স্মরণীয় বাণীই বিলায়!
বোঝে না তো প্রস্তরের জীবনদর্শন
অপূর্ব মেঘমালার স্নেহ স্পর্শ।
অন্তর্গত স্বপ্নের মিল ও অমিল
কতোদিন দেখা হয় না,অপরাজিতার নীল।
প্রকৃতির ঘরে
নিলয় রফিক
কে যেন আসবে শুনে সমুদ্রপ্রস্তুত
ঝরাপাতা উড়ে যাচ্ছে বৃক্ষের সবুজ
হেমন্তের নুনারোদ উষ্ণতা আরাম
সুড়ঙ্গপথে নজর কারুকাজে সাজ
দেখতে-দেখতে সন্ধ্যা রথের মিছিল
ফুলের গন্ধে আবার নয়নাভিরাম
শব্দের বীজতলায় সুরের জিকির
প্রমত্ত যুগলডানা মণি-চোখে প্রেম
নদের জলের ঢেউ মোহনা পাগল
আনন্দচিত্ত পাড়ায় প্রকৃতির ঘরে
উড়াল দেবো শহরে সুন্দর মুহূর্তে
প্রাচীন মরুর কূপে যুগল সাঁতারে
ছাতিমের গন্ধে
এমরান কবির
অন্য পাশে ফিরবো না
এই পাশ থেকে থেকে
সাপ হয়ে যাব ঠিকঠিক
পূূর্ণিমা বাাগানে
ছাতিমের গন্ধে
উড়তে থাকবে
আমার সকলবেলা
আমরা সকল পাশফেরা ভুলে
খেলতে থাকব মেঘ মেঘ খেলা
হেমন্তের রঙ
রাকিবুল রকি
দূরের ঘাস কি সত্যি সবুজ সতেজ লাগে?
নইলে এতো ভালো লাগলো কেন তার হাসি?
শিশির শিশির পথ পাড়ি দিয়ে এসে
আজ মনে হয় বসি একটু মাটির বুকে
পা ছড়িয়ে। বসি, দুই দ- তার পাশে।
জীবন ভরে উঠছে কেবল হলুদ পাতায়।
দুই চোখ ভরে খেলা করে শুধু হেমন্তের রঙ
বিবর্ণ সন্ধ্যার আয়োজনে এ মন যতটা হয় উচাটন
ততটা সুদূর নয় স্বপ্নলোক ঘন কুয়াশায়।
মনে বাগান-বিলাস-স্মৃতি, হলদেটে কার্নিশে
ওম নিচ্ছে কুমারীর আদুরে বিড়াল;
প্রজাপতির প্রজনন কালেও একাকিত্ব জমে থাকে
অন্ধকারের মতো-
বিকেলের শেষ আলো বেহালার ছড়ে
কারো হাসি হয়ে কাঁদছে অবিরত।
হেমন্তের হাত
বাবুল আনোয়ার
বারান্দা থেকে নির্জন ছাদের কিনারে
উড়ে যাচ্ছে ঘুম
মৃত্তিকা গন্ধে পূর্ণতার গানে
ছুটে আসে হেমন্তের হাওয়া
জেগে উঠে আধুলি বিকেল
উষ্ণতা আর মৃদু হিমের হাত ধরে
হেঁটে চলে অবিরাম
চন্দনের রাত বির্বণ চারুকলা।
আঁচড়
তৃণা চক্রবর্তী
এখানে যে সিঁড়িগুলো দেখা যায়
সেগুলো দিয়ে খুব বেশি দূর যাওয়া যায় না
খুব বেশি দূর যেতে হলে তোমাকে নদীর পিছু নিতে হবে
নরম জলের ভিতর দিয়ে পেরিয়ে যেতে হবে বাঁক
হাঁটতে হাঁটতে পাথরে পা পিছলে যাবে হয়ত
হয়ত শামুকের খোলে কেটে যাবে আঙ্গুল
হয়ত কোথাওই সঠিকভাবে পৌঁছতে পারবে না তুমি
সকলে ভুল বুঝবে তোমাকে, প্রায় সকলেই
ভাববে অসফলতার ভয়ে তুমি এই পথ বেছে নিয়েছ
এভাবে আলাদা হাঁটতে গিয়ে একা হয়ে যাবে তুমি
এমনকি হাঁটতে হাঁটতে দেখবে কখন
সেই নদীও ছেড়ে গিয়েছে তোমাকে
পরিচিত দৃশ্যগুলো ছেড়ে গিয়েছে,
চেনা কণ্ঠস্বর ছেড়ে গিয়েছে কখন
আগের মতো নেই প্রায় কোনো কিছুই আর
যারা সিঁড়ির পরিবর্তে নদীর পথে হাঁটে
বার বার বাঁক বদল করতে করতে তাদের
পায়ে তখন শুধুই বালির আঁচড়
হিমদেশে হেমন্ত
অহ নওরোজ
ঘন উত্তরে এখন অক্টোবর, বাংলায় হয়ত আশ্বিনের রোদ
প্রায় খুলে পড়ছে নরম হেমন্ত হাওয়ার ভেতর কোলাহলে,
খুলছে ধানের ফুল- ইঁদুরদের জমানো ভিড় পথের বিন্যাসে
ধরা পড়ার সময় যেন এসে গেছে, যেন সব জল সরে গিয়ে
কৃষক পায়ের শব্দ দাগ হয়ে যাওয়ার হিম এসে গেছে মাঠে-
ঝিঁঝিঁ কিংবা ঘুঘরোপোকার গোধূলিকালীন কোরাস কাঁপছে আর
যেন ধানের শরীরে ভেঙে প’ড়ে পালটে ফেলছে দিনান্তের ভাষা,
যেন নিরেট হেমন্ত আর দূরে নেই, মোরগের মতো গজরিয়ে
ঘরের ভেতর ঢুকে পড়বে সহসা। কিন্তু এই ঘন উত্তরের
হিমদেশে সেপ্টেম্বরের শেষেই হেমন্তের লাল সন্ধ্যা গায়ে মেখে
অনায়াসে জুতোর ভেতর ঢুকে পড়তে চায় শীতের গাঢ় রাত-
হিমদেশে হেমন্ত মানেই পথে পথে হাওয়ার স্রোতের ভেতর
বৃষ্টির ধারালো নখ আর উড়ে যাওয়ার মতো করে পাতাদের
অবিরাম ঝরে পড়া- পথে পথে কাস্তানিয়া, আইষে অথবা
বুখে গাছগুলো হরিৎ শ্বাস ভুলে গিয়ে অগোছালো দুপুরের রোদে
কেবল পুড়ছে অথবা তাদের গায়ে কমলা আগুনে জমে গেছে
যাবতীয় ওম। আমি দেখি, ঝরা পাতাদের ভেতরে ভেতরে শুধু
বর্ণ বিভ্রমের দাগ, পতনের কম্বুরেখার ভেতরে ঠা-া ছায়া
দীর্ঘ হতে হতে ঢিবি করা পাতাদের কাছে পথ করে পৃথিবীর
কাঁটাচুয়াদের ডেকে আনে- দূরে দেখি প্রান্তরের বুকের ভেতর
পাকানো খড়ের পেছনে তাড়াহুড়ো করে সন্ধ্যা নামার পথ ধরে
শিশুদের দল লাল নীল আলো হাতে করে মার্টিন উৎসবে যাচ্ছে।
সে যাবে
শ্যামল নাথ
সে যাবে- এখনই- কোথায় যাবে সে-
হয়তো বাতাসে ভেসে বেড়াবে নয়তো হিমে ঢাকা
উল্লাস শেষে হারিয়ে যাবে ডানায় ধরা সবুজ আলোয়;
মেঘের কোমল বিদায়ের দিন, কোথায় যাবে সে?
সে যাবে- এখনই- এখনই সে যাবে-
নদীর ধারে নড়বড়ে ছায়ায় মুখ লুকিয়ে
সে কি বসে আছে আনমনে?
দু’পা ভিজে আছে তার?
চোখে মুখে কি মায়া পড়েছে?
কী চলছে তার বুকে, একাকী গোপনে?
সে যাবে- তবু ফিরে এসে ছুঁয়ে দেবে- ভেজা কোনো ভোর,
অনামি কোন সন্ধ্যা হয়তো তাকে চিনবে-
দূরের ট্রেনের শব্দের মতো ম্লান হয়ে যাওয়া এক অব্যক্ত যাত্রা ভেবে।
সে যাবে- এখনই- যাবে-
হয়তো সন্ধ্যা তাকে চিনবে- মানবে দূরপথের যাত্রী ভেবে,
কিংবা কোনো ছায়ামুখ তাকে জড়িয়ে রাখবে,
অবেলার দুধে-ঢাকা নৈঃশব্দ্যে ভেজা নরম শালের মতো।
সে যাবে- তবু থেকে যাবে রঙের হালকা রেখা, এই মাটির টান,
অঘ্রান শেষে যে মানুষ বাতাসে ভেসে মুছে যায়-
তারই মনে পড়া সুর হয়ে বাজবে কোনো অনামা গান।
কখন তুমি আসবে
মিয়া ইব্রাহিম
ভালো করে অর্থ বোঝার আগেই তোমার
ঘুম ভাঙা দাওয়ায় পুঁতে রেখেছিলাম
মনপ্রাণ, হৃদয় কঙ্কাল
তুমি টের পাওনি ঘুণারেও
এটাকে ভালোবাসা বলে কিনা জানি না।
এখন নীল চাষ হয় সেখানে
ফসলের দানা দানা প্রার্থনা
আমার বুকে শিহরন জাগায়
কখন তুমি আসবে ভোরের কুয়াশা
মাড়িয়ে অদৃশ্য অন্তরে;
ভালোবাসা এমনি করেই বুঝি
অজান্তে হারায় অনাদরে, অবহেলায়
চোখের কাজল হতে পারিনি
তি কী-
পথের ধুলো হয়েই
বেঁচে থাকবো তোমার ঘুম ভাঙা দাওয়ায়
শুধু একবার চুপিচুপি বলে যেও
আমি তোমার আপনজন ছিলাম।
অস্পৃশ্য পুস্তক
অনন্য কামরুল
অস্পৃশ্য পুস্তক আমি- পড়ে আছি অন্ধ পাঠাগারে।
কালিঝুলি পৃষ্ঠাজুড়ে...ছত্রাকের সাথে হয় ভাব...
‘তোমাকেই ছুঁলে শেষে সহসায় হয়ে যাব নাব’
কিছু পাঠক ভ্রান্তিতে হাতে নিয়ে বলে ঠারেঠোরে।
বলে কেউ, ‘পাল্টে গেলে কালচক্র পড়ব তোমাকে
যতই হও না তুমি উপাদেয় অথবা নির্গুণ;
শীতকাতুরেও তোকে খুশি মনে দেবে না আগুন!
তাছাড়া অনর্থ ছুঁয়ে সর্দি কেন বাঁধাব এ নাকে?’
বসে থাকি চাপা শ্বাসে, বুকে জ্বলে রক্তিম অক্ষর
এত দিন পাঠ করে যারা পরে ফিরাল ও মুখ
একি তবে মায়াজাল? জারিজুরি? নাকি এ নির্মোক?
তীব্র তিক্ত ভাবরসে মনে কোনো লাগেনি আঁচড়?
বুক-মাঝে জমে থাকে ছাইচাপা আত্মদগ্ধ রোখ
পাতাগুলোর কোষে কোষে বয় ভারি দুর্বহ ঝড়!
অনন্ত অক্ষমতার প্রতি
মাসুদ চয়ন
শূন্য ও আকাশ মৃত-থিকথিকে ভেজা কাতরতা বুকে পাজরে... গুলিবিদ্ধ প্রকৃতিও- প্রকৃতির রক্তে ভিজে গেছে কবিতার বুক- আমি দাঁড়িয়ে আছি কবিতাকে বাঁচাতে- আমি দাঁড়িয়ে আছি রক্তশূন্য মমি হয়ে- যদি একবিন্দু রক্তের যোগান দিতে তুমিও!!
শূন্য ও আকাশ চোখ খুলে তাকাতো, ঘুরে দাঁড়াতো গুলিবিদ্ধ স্বরূপ প্রকৃতি।
পিছপা হতো রেজিমেন্ট রুল, অথৈ সৈন্য সামন্ত।
চেতনায় বিজয় ধ্বনি
মেজবাহ উদ্দিন
মাটি ঘেঁষে আছি
জীবন ও মরণে একই গানের
ধ্বনি-প্রতিধ্বনি, বিজয়-বিজয়-বিজয়।
আমি মাটি ও মেঘের অদ্ভুত বিজয় ধ্বনি
যে মাটি ও মেঘ আমাকে বহন করে
রক্ত-বৃষ্টিস্রোত শান্ত করে
পোড়ানো ঘর-বাড়ি আবার তৈরি করে
নদীর বহতায় নাব্যতা আনে
পাখি ও বৃক্ষের প্রত্যাশায় ফুল ফোটায়।
আমি জীবন ও যুদ্ধের বিজয় ধ্বনি
গৌরব চেতনার, মুক্তির ধ্বনি
¯িœগ্ধ-লাল গোলাপের সৌরব।