image
মুনীর চৌধুরী / জন্ম: ২৭ নভেম্বর ১৯২৫; মৃত্যু: ১৪ ডিসেম্বর ১৯৭১ : প্রতিকৃতি: মাসুক হেলাল

অনন্য প্রতিভাধর মুনীর চৌধুরী

আনিসুজ্জামান

আমাদের নাট্যসাহিত্যে যাঁরা বিষয় ও প্রকরণ দুই দিকেই আধুনিকতার প্রবর্তন করেছিলেন, মুনীর চৌধুরী তাঁদের অগ্রগণ্য। তিনি রেখে গেছেন দুটি নাটক এবং তিনটি সংকলনে বারোটি একাঙ্কিকা। নাটকের অনুবাদেও তিনি পারদর্শিতার পরিচয় রেখে গেছেন। তাঁর কাছ থেকে আমরা পেয়েছি তিনটি অনুবাদ-নাটক, পাঁচটি একাঙ্কিকার অনুবাদ-সংগ্রহ একটি এবং একাধিক নাটকের অসম্পূর্ণ অনুবাদ।

মুনীর চৌধুরীর পূর্ণাঙ্গ মৌলিক নাটক দুটি: রক্তাক্ত প্রান্তর (১৯৬২) ও চিঠি (১৯৬৬)। তাঁর নাট্যস্বভাবের দুই বিপরীতমুখী প্রবণতার পরিচয় রয়েছে তাতে। প্রথমটি ট্র্যাজেডি, তার পটভূমি ১৭৬১ সালের পানিপথ-প্রান্তর; দ্বিতীয়টি কমেডি, তার পটভূমি ১৯৬২ সালের ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়। ইতিহাসের পটে নাটক লিখলেও বর্ণিত যুগের জীবনযাত্রা প্রকটিত করার কোনো প্রয়াস তাঁর মধ্যে নেই। বরঞ্চ চরিত্রসমূহকে আধুনিক জীবনচেতনা দান করে তিনি আমাদের কালের দ্বন্দ্ব ও বিক্ষোভকে প্রকাশ করেছেন। কাহিনির সারাংশ তিনি চয়ন করেছেন কায়কোবাদের মহাশ্মশান কাব্য থেকে। কিন্তু যা কায়কোবাদে নেই, তা হলো মুখ্য পাত্রপাত্রীর হৃদয়দ্বন্দ্বের প্রাবল্য আর এর অন্তর্নিহিত যুদ্ধবিরোধী চেতনা। কর্তব্যবোধ ও হৃদয়াবেগের দ্বন্দ্ব এবং প্রেম ও স্বদেশানুরাগের সংঘাত-চিত্রণে নাট্যকারের যদি কোনো ঋণ থেকে থাকে, তা মধুসূদন ও রবীন্দ্রনাথের কাছে। আর যুদ্ধবিরোধী চেতনা তাঁর নিজস্ব। এ-নাটকে সংলাপের ভাষা পুষ্পিত, উচ্ছ্বসিত, অলংকৃত। তার একটা বিশেষ আবেদন আছে।

চিঠি মুনীর চৌধুরীর নাট্যপ্রতিভার উৎকৃষ্ট পরিচয়স্থল। নির্দিষ্ট সময়ে পরীক্ষাদানে অধিকাংশ ছাত্রের অসম্মতি ও পরীক্ষা পিছিয়ে দেওয়ার দাবি এর মুখ্য বিষয়। তারই মধ্যে ভিন্নমতপোষণকারী ছাত্রদের প্রতি বলপ্রয়োগ, ছাত্রছাত্রীর প্রণয়ঘটিত দ্বন্দ্ব, বিশ্ববিদ্যালয়-প্রশাসনের তৎপরতা এবং আকস্মিকভাবে পুলিশের আবির্ভাব এর হাস্যরসের মাত্রাকে তীব্র করেছে। পরীক্ষা পিছিয়ে দেওয়ার দাবি যে রীতিমতো একটা আন্দোলনে পরিণত হতে পারে এবং তাতে যে আদর্শিক সংগ্রামের তীব্রতা আরোপিত হতে পারে, এই অসংগতিকেই শাণিত ব্যঙ্গে তিনি বিদ্ধ করেছেন- ছাত্র-আন্দোলনকে হেয় প্রতিপন্ন করা তাঁর উদ্দেশ্য নয়। চরিত্রাঙ্কন, ঘটনাসংস্থান ও সংলাপ রচনার কৌশলে এ-নাটক বিশিষ্ট। এর ভাষাও অলংকৃত, তবে আগের নাটকটির মতো ঘননিবদ্ধ নয়, সুরও যথোচিত হালকা।

তাঁর একাঙ্কিকাগুলোতেও তাঁর নাট্যস্বভাবের দুই বিপরীতমুখী প্রবণতা লক্ষ্য করা যায়। একটিকে তিনি চিহ্নিত করেছিলেন ‘ক্ষোভপূর্ণ, অভিযোগাশ্রয়ী ও রক্তাক্ত’ বলে। তাঁর রাজনৈতিক চেতনা ও অভিজ্ঞতার স্বাক্ষর এগুলোতেই পূর্ণমাত্রায় দেদীপ্যমান। এই দলে পড়ে কবর (১৯৬৬) গ্রন্থের অন্তর্ভুক্ত ‘মানুষ’, ‘নষ্ট ছেলে’ ও ‘কবর’ এবং পলাশী ব্যারাক ও অন্যান্য (১৯৬৯) গ্রন্থের অন্তর্ভুক্ত ‘পলাশী ব্যারাক’। এগুলোর রচনা গত শতকের চল্লিশের দশকের শেষে এবং পঞ্চাশের দশকের প্রথমে। ‘পলাশী ব্যারাকে’ নিম্নশ্রেণির সরকারি কর্মচারীর দুর্বিসহ জীবনসংগ্রামের পরিচয় তুলে ধরা হয়েছে অনেকখানি রঙ্গব্যঙ্গের আড়ালে। ‘নষ্ট ছেলে’তে ভালোমন্দ সম্পর্কে আমাদের প্রচলিত মূল্যবোধকে প্রশ্নবিদ্ধ করা হয়েছে। ‘কবর’- সবাই জানেন- রাষ্ট্রভাষা-আন্দোলনের পটভূমিকায় রচিত। রাজনৈতিক চেতনার এমন কলাম-িত রূপ আমাদের সাহিত্যে কমই দেখা যায়। কারাগারে গোপনে অভিনয়ের অভিপ্রায়ে এটি রচিত হয়, কাজেই মঞ্চ উপকরণের শোচনীয় সীমাবদ্ধতা মেনে নিয়ে তাঁকে নাটকটি লিখতে হয়েছিল। পরিহাসতরল আবহাওয়ায় ছদ্মাবরণের সাহায্যে দুটি দৃশ্যের সাঙ্গীকরণ এর প্রকরণগত বিশেষ গুণ। সেখানে এবং মুর্দা ফকিরের বৃত্তান্তে মুনীর চৌধুরী রাষ্ট্রভাষা-আন্দোলনকে অতিক্রম করে আমাদের সামাজিক জীবনের বৃহত্তর দ্বন্দ্বের দিকে অঙ্গুলি-সংকেত করেছেন। সংলাপের সরসতা ও নাটকীয়তা খুবই উদ্দীপক।

নিজের আরেক ধরনের প্রয়াসকে মুনীর চৌধুরী অভিহিত করেছিলেন ‘কৌতুকাবহ, অন্তরাশ্রয়ী এবং অদ্ভুতরসাত্মক’ বলে। এর সূচনা হয় চল্লিশের ও পঞ্চাশের দশকে রচিত ‘ফিটকলাম’ ও ‘মিলিটারী’তে। ‘ফিট কলামে’ পলাতক রাজনৈতিক কর্মী সন্দেহে কোনো বোরকা-পরিহিতার কাছাকাছি যাওয়ার পুলিশি প্রয়াস নিয়ে দ্বন্দ্বের সূচনা। রাস্তায় নানাধরনের লোকের সমাগমে ও কথাবার্তায় ঘটনা জমে ওঠে। ভিড়ের মধ্যে বোরকা-পরিহিতা অন্তর্ধান করলে সে আদৌ রাজনৈতিক ব্যক্তি কি না, সে-প্রশ্ন অমীমাংসিত থেকে যায়, বরঞ্চ সে নারী না পুরুষ, সে-সম্পর্কেও সন্দেহ রয়ে যায়। ‘মিলিটারী’তে দাঙ্গার সময়ে কারফিউর মধ্যে একদিকে তরুণ-তরুণীর হৃদয়-বিনিময় এবং অন্যদিকে গু-াদের অগ্নিসংযোগের চেষ্টা আর মিলিটারির সে-উদ্যোগ ব্যর্থ করার প্রয়াস বর্ণিত হয়েছে। সংলাপ তীক্ষè ও বিদগ্ধ, বাক্য প্রায়ই কাটাকাটা ও অন্তর্ভেদী। এ-দুটি একাঙ্কিকায়ই আঞ্চলিক ভাষার সিদ্ধপ্রয়োগ আছে।

পঞ্চাশের দশকের শেষদিকে লেখা ‘আপনি কে?’ একাঙ্কিকায় বনভোজনে গমনকারী ছাত্রছাত্রীদের সঙ্গে তাদের অনুগামী গোয়েন্দা পুলিশের সংযোগ প্রহসনের মূল বিষয়। বাকি একাঙ্কিকাগুলো ষাট দশকে রচিত। ‘একতলা-দোতলা’ ঢাকায় টেলিভিশনের সূচনা-সন্ধ্যায় অভিনীত হয়েছিল। ওপরতলা-নিচতলার বাসিন্দার প্রেম এবং তার আনুষঙ্গিক জটিলতা এর মুখ্য বিষয়। ‘বংশধরে’র বিষয়ও পাত্রপাত্রীর প্রেম, তবে পাত্রীর পিতামাতার উপভোগ্য সংলাপ তাতে বাড়তি মাত্রা জোগায়। দ-কারণ্যের (১৯৬৬) অন্তর্ভুক্ত তিনটি একাঙ্কিকা- ‘দ-’, ‘দ-ধর’ ও ‘দ-কারণ্য’ ষাট দশকে রচিত হয়। ‘দ-ে’ স্বামী-স্ত্রীর পারস্পরিক সন্দেহ- সত্য বা কল্পিত- অসাধারণ সংলাপ এবং আকস্মিক নাটকীয় ঘটনার যোগে উপভোগ্য হয়ে ওঠে। ‘দ-ধরে’ ছাত্রছাত্রীরা নাটকের মহড়া দেয় এবং তার আড়ালে তাদের জীবননাট্যের পটও উন্মোচিত হয়। এখানেও ঘটনার চেয়ে গুরুত্বলাভ করে তীক্ষè সংলাপ। ‘দ-কারণ্যে’ রামায়ণ-কাহিনির অংশবিশেষের নবতর প্রয়োগ ঘটেছে, তবে তার রূপায়ণ অন্য দুটি একাঙ্কিকার মতো তৃপ্তিদায়ক নয়। এখানে যে-পাঁচটি একাঙ্কিকার উল্লেখ করা হলো, তার বিষয়বস্তু জটিলতামুক্ত, কিন্তু রীতি মনোহারী। সংলাপের নবতর ভঙ্গি এবং ঘটনার সামান্য জটিলতাসৃষ্টিতে নাট্যকারের প্রতিভা স্ফূর্তিলাভ করেছে।

অনুবাদ-নাটকের মধ্যেও আমরা মুনীর চৌধুরীর দুই প্রবণতার পরিচয় পাই। গল্সওয়ার্দির ‘দি সিলভার বক্স’-এর রূপান্তর ‘রূপার কৌটা’ (১৯৬৯) পরে প্রকাশিত হলেও আগে রচিত। শ্রেণিস্বার্থবিভক্ত এই সমাজে বিচার যে প্রহসনের নামান্তর এবং মানবিক মূল্যবোধ যে ব্যর্থতায় পর্যবসিত, এই নাটকে সে-কথাই বলা হয়েছে। এর রূপান্তরে দেশীয় পরিবেশ এবং উপযুক্ত চরিত্র সৃষ্টিতে অনুবাদক সহজেই সমর্থ হয়েছেন। অন্যদিকে বার্নার্ড শ-এর ‘ইউ নেভার ক্যান টেল’ নাটকটিতে একই সঙ্গে আছে সমাজ-সমালোচনা, তার চেয়ে বেশি আছে কৌতুকসৃষ্টি। এ-নাটকটি দেশি সাজে ঢালা সহজ ছিল না। কিন্তু শ-এর নাটক তাঁর এতই অন্তরঙ্গ যে রূপান্তরে তিনি কোনো বাধা অনুভব করেননি।

তবে তাঁর পক্ষে গুরুতর পরীক্ষা ছিল শেক্সপিয়রের অনুবাদকর্ম। রিচার্ড বারটন ও এলিজাবেথ টেলর-অভিনীত ‘টেমিং অব দ্য শ্রু’ দেখে এর অনুবাদে মুনীর চৌধুরী প্রণোদিত হয়েছিলেন। আগের দুটি অনুবাদেই তিনি ব্যবহার করেছেন প্রচলিত সমাজজীবনের ভাষা, কখনো কখনো আঞ্চলিক ভাষাও। কিন্তু শেক্সপিয়রের কাব্যসৌন্দর্য রক্ষা এবং আমাদের সঙ্গে নাটকের কুশীলবদের কালগত ব্যবধান বোঝাতে তাঁকে যে-ভাষার আশ্রয় নিতে হয়েছে, তা অপেক্ষাকৃত কৃত্রিম ও নিপুণ। অনুবাদক যে বলেছেন, এই নাটকের প্রায় তিন হাজার চরণের মধ্যে সর্বমোট পনেরো লাইনের বেশি তিনি মূলের পরিবর্তন করেননি, সে-দাবি সত্য। এ-অনুবাদ সর্বতোভাবে সার্থক।

কয়েকটি একাঙ্কিকার অনুবাদ তাঁর মৃত্যুর পরে রামেন্দু মজুমদারের সম্পাদনায় বৈদেশী (১৯৭৭) নামে প্রকাশিত হয়েছে। এগুলো বিচিত্র রসের আকর এবং উপভোগ্য।

রসে এবং রূপে মুনীর চৌধুরীর নাটক বিচিত্র এবং মনোগ্রাহী। এসব রচনা নাটকের ভাষা ও অঙ্গসৌষ্ঠব সম্পর্কে আমাদের নতুন ধারণা দিয়েছে। বক্তব্য কেমন করে শিল্পসম্মত উপায়ে প্রকাশ করা যায়, তার শিক্ষাও এখানে আমরা পাই। বাংলা নাটকের ঐতিহ্যের সঙ্গে সম্পর্কচ্যুত না হয়ে কীভাবে তাকে অগ্রসর করা যায়, মুনীর চৌধুরী তা আমাদের দেখিয়েছেন। (পুনর্মুদ্রণ)

সম্প্রতি