খায়রুল আলম সবুজ
‘আমার মাতৃভাষা কি?’
বাংলা ভাষা। সমগ্র বাংলা ভাষা। আমার মাতৃভাষার ষোলোশত রূপ। তারা সব পদ্মিনীর সহচরী। আমার মাতৃভাষা তিব্বতের গুহাচারী, মনসার দর্পচূর্ণকারী, আরাকানের রাজসভায় মনিময় অলঙ্কার, বরেন্দ্রভূমির বাউলের উদাস আহবান।
মাইকেল, রবীন্দ্রনাথ, নজরুল ইসলাম আমার মাতৃভাষা। আমার মাতৃভাষা বাংলা ভাষা।’ বাংলা ভাষায় যিনি ‘কবর’-এর মতো নাটক রচনা করেছেন এ কথা তাঁর।
আবু নঈম মোহাম্মদ মুনীর চৌধুরী। আ ন ম মুনীর চৌধুরী। মুনীর চৌধুরী।
এভাবেই একজন মানুষের নাম জনপ্রিয়তার নিরিখে একটু একটু করে সংক্ষিপ্ত হয়েছে। তাঁর বাবার নাম আবদুল হালিম চৌধুরী। মায়ের নাম আফিয়া বেগম। চৌদ্দ ভাইবোনের মধ্যে তিনি দ্বিতীয়। তিনি ছিলেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইংরেজি ও বাংলা উভয় বিভাগের শিক্ষক। শুনেছি, তার ক্লাসে শুধু তাঁর বিভাগের ছাত্ররাই থাকতেন না অন্য বিভাগ থেকে ভিড় করে এসে পঞ্চাশ ষাট দশকের জনপ্রিয় এই শিক্ষকের অতুল্য বক্তৃতা শুনতেন। তিনি ছিলেন একাধারে শিক্ষক, শিক্ষাবিদ, নাট্যকার, অভিনেতা, নাট্য নির্দেশক, কবি, অনুবাদক, গল্পকার, সমালোচক, ভাষাতাত্বিক। মায়ের ভাষাকে তিনি বুকে ধারই করেছিলেন অপার আন্তরিকতায়। ভালোবেসেছিলেন দেশ, দেশের মাটি, দেশের মানুষ- যা কিছু বাংলার- সব। যে পথ পার হয়ে এসে আজ সারাজগৎ একটি দিনকে মাতৃভাষা দিয়ে চিহ্নিত করেছে, সেই পথে তাঁর চিহ্ন আছে।
২
মায়ের ভাষা কেড়ে নিয়ে আমাদের নিঃস্ব করার যে চক্রান্ত একদিন পশ্চিম পাকিস্তানিরা করেছিল তার প্রতিবাদের ভাষায় তাঁর কঠোর কণ্ঠের আওয়াজ আছে। একদিন বাংলার ঘরে ঘরে টাইপরাইটার ‘অপটিমা মুনীর’ ঘটঘট শব্দ করে বেজে উঠেছিল, সে শব্দ এখনো বাঙালির কানে আছে। তিনি ছিলেন ন্যায়নিষ্ঠ প্রতিবাদী যুক্তিনির্ভর মানুষ। আবার সৃজনশীল। ভাবপ্রবণও যে ছিলেন না তা নয়। যে ঘরে জন্মেছিলেন সেখানে থেকে নির্বিবাদে এক জীবন যাপন করা ব্যক্তি মুনীর চৌধুরীর জন্য মোটেও অসম্ভব ছিল না। কিন্তু ‘অন্তর্গত রক্তের ভিতরে’ কোন ‘বিপন্ন বিস্ময়’ খেলা করেছিল সে কি আর সবাই জানে? নাকি সবাই বোঝে? কে কাকে কতটুকু বুঝতে পারে? ভেবে দেখার জন্য এ প্রশ্ন প্রতিটি মানুষের সামনেই রাখা যেতে পারে। একজন মানুষ অন্যের কাছে কতটুকু উন্মোচিত সেটা বুঝুক আর না বুঝুক মানুষ মানুষের আলোচনা সমালোচনা করবেই- এটাই যেন স্বাভাবিক। কিন্তু কাজটা সঠিক হলো কি হলো না সে নিয়ে খুব কম মানুষই ভাবেন। বোধ করি এ দুর্ভাগ্য মানুষের কোনোদিনই কাটবে না। দুর্ভাগ্যের এ জটাজাল মুনীর চৌধুরীর মতো মানুষকেও রেহাই দেয়নি। আজহারউদ্দীন খান লিখেছেন-
“কখনও তিনি নিন্দিত, কখনও তিনি নন্দিত। কখনও তিনি তিরষ্কৃত, কখনও তিনি পুরস্কৃত। কখনও তিনি প্রগতিশীল, কখনও তিনি প্রতিক্রিয়াশীল। তিনি যা নন বিভিন্ন জনের চোখে তিনি তাই হয়েছেন- যা হতে চাননি তাই তাঁকে বানানো হয়েছে, যা তিনি হতে চেয়েছিলেন বিভিন্ন ঘটনাস্রোত তা তাকে হতে দেয়নি। সৃষ্টিসুখের উল্লাসে তিনি মত্ত থাকতে চেয়েছেন সেজন্য নিস্তরঙ্গ জীবনযাপন করতে চেয়েছিলেন- শান্ত নিরুদ্বেগ চিত্ত তাঁকে দেওয়া হয়নি, পরিবর্তে নানা সময় তাঁকে আঘাত করা হয়েছে, লাঞ্ছিত করা হয়েছে। শেষ পর্যন্ত তাঁকে জীবন দিয়ে বোঝাতে হয়েছে- লোকে যা ভাবে তা তিনি ছিলেন না। বাংলা সাহিত্যের বহু ট্রাজিক চরিত্রের মতো তাঁর জীবনপাত্রটিও বেদনায় ভরে গিয়েছে। বেদনায় ভরা সে পাত্র বুকে নিয়ে নিঃশব্দে সারাজীবন বহন করেছেন। কথা প্রসঙ্গে নিজের জ্বালার কথা ছাত্র আনিসুজ্জামানকে একবার বলেছিলেন, ‘যারা দেশের জন্য কষ্ট স্বীকার করেছেন, বিপ্লবী রাজনীতির সঙ্গে যাঁরা যুক্ত তাঁদের অভিযোগ আমি বুঝতে পারি। কিন্তু যাঁরা দিব্যি আরামে থাকার নীতিতে বিশ্বাসী তারা কেন শুধু আমার কাছেই আত্মত্যাগ দাবি করছেন, তা আমি বুঝতে পারি না। বাংলাদেশের নাটকের ক্ষেত্রে তিনি ছিলেন প্রধান পুরুষ যাঁকে কেন্দ্র করে বাংলাদেশে নাট্যশিল্প গড়ে উঠেছে, গুটিকয় গল্প লিখেই শ্রেষ্ঠ গল্পকারের সম্মান তিনি পেয়েছেন, সমালোচনামূলক প্রবন্ধ সাহিত্যে তিনি এক নবদিগন্ত আবিষ্কার করেছেন, আধুনিক ভাষাবিজ্ঞানে তাঁর অবদান প্রশ্নাতীত। সর্বোপরি তাঁর ছিল অসামান্য বক্তৃতা প্রতিভা। বছরের পর বছর ধরে দেশব্যাপী অসংখ্য সভা সমিতি আলোচনাসভায় তাঁর অনন্য বাচনভঙ্গি দীপ্ত ভাষা কৌশলে শ্রোতারা অভিভূত হয়েছেন। সবচেয়ে প্রতিভাবান বক্তা হিসাবে তিনি খ্যাতি পেয়েছেন। মোটকথা বাংলাদেশের শিক্ষা সাহিত্য ও সংস্কৃতির জীবনবোধে আজ যে নবচেতনার জোয়ার এসেছে তার মূলে যাঁরা আছেন মুনীর চৌধুরী তাঁদের মধ্যে শুধু অন্যতম নন, বিশিষ্টতম।” [মুনীর চৌধুরী: সতত স্বাগত, পৃ. ১৯৪]
৩
মুনীর চৌধুরী কারাভোগ করেন মোট তিনবার। প্রথম ১৯৪৯ সালের মার্চ মাসে সত্যাশ্রয়ী প্রগতিবাদী হবার অপরাধে। দ্বিতীয়বার ১৯৫২ সালের ২৬ ফেব্রুয়ারি ছাত্রদের উপর গুলি বর্ষণের প্রতিবাদে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে যে প্রতিবাদসভা হয়েছিল সেখান থেকে।
সেদিন প্রতিবাদসভার যাঁরা আয়োজন করেছিলেন তাঁদের মধ্যে মুনীর চৌধুরী ছিলেন প্রধানতম ব্যাক্তি। পুলিশের বেষ্টনী ভেদ করে তিনি বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রবেশ করেছিলেন, প্রতিবাদ সভায় জোরালো ভাষায় সরকারের গুলি বর্ষণের তীব্র নিন্দা করেছিলেন এবং তারই চেষ্টায় সেই সভায় হত্যাকা-ের বিরুদ্ধে নিন্দাসূচক প্রস্তাব গৃহীত হয়েছিল’।
ফলাফল, জননিরাপত্তা আইনে গ্রেফতার। আর তৃতীয়বার যুক্তফ্রন্ট সরকার ভেঙ্গে দিয়ে গবর্নর জেনারেলের শাসন জারির সময়। কেন্দ্রীয় শাসন প্রবর্তিত হবার সঙ্গে সঙ্গে বহু সন্দেহভাজন ব্যক্তির সঙ্গে তৃতীয়বারের মতো তাঁকেও গ্রেফতার করা হয় ১৯৫৪ সালে।
৪
জেলেই লেখা হয় কালজয়ী নাটক ‘কবর’। ‘কবর’ মুনীর চৌধুরীর অনন্য কীর্তি। ১৯৫৩ সালের ১৭ জানুয়ারি ঢাকার কেন্দ্রীয় কারাগারে বসে মুনীর চৌধুরী এ নাটিকা লিখেছিলেন। তাঁর অনুবাদ ও মৌলিক নাটকের সংখ্যা কম নয়, কিন্তু কবর নাটিকাই তাঁর নাট্যকার খ্যাতির মূল। ১৯৫৩ সালের ২১ ফেব্রুয়ারি ঢাকা সেন্ট্রাল জেলে মঞ্চস্থ হয় ‘কবর’। যা কিছু হাতের কাছে পাওয়া গেছে তাই দিয়েই তৈরি হয়েছে মঞ্চ। অতি সাধারণ সেট সাজসজ্জা অনুজ্জ্বল আলো। হেরিকেন দেশলাই মোমবাতির আলো দিয়েই নাটকের মাঝে প্রাণ সঞ্চার করা গেছে। প্রথম মঞ্চায়নে নেতার চরিত্রে অজয় রায়, মুর্দা ফকিরের চরিত্রে নলিনী দাস ইনসপেক্টর হাফিজের চরিত্রে ধনঞ্জয় দাশ অভিনয় করেছিলেন। জেলখানার বাইরে কবরের প্রথম মঞ্চায়ন হয়েছিল কার্জন হলে ১৯৬৫ সালে। আর আজাদী সংখ্যা সংবাদে নাটিকাটি প্রথম মুদ্রিত হয় ১৯৫৫ সালে। সম্পাদনা করেছিলেন সৈয়দ নুরুদ্দিন ও শহিদ সাবের।
ভাষা আন্দোলনের চূড়ান্ত পর্যায় যেভাবে কবর নাটিকায় উপস্থাপিত হয়েছে সে এক অবিস্মরণীয় অসাধারণ ব্যাপার। মাত্র দু’তিনটি চরিত্রের মাধ্যমে একটি পূর্ণাঙ্গ ইতিহাসকে দর্শকের সামনে তুলে ধরা হয়েছে। একদিকে রাজনৈতিক নেতা সঙ্গে হুকুম তালিম করার পুলিশ ইনস্পেক্টর হাফিজ। অন্যদিকে পাগলা মুর্দা ফকির। অন্যায় একদিকে অন্যদিকে তার প্রতিবাদ। মুর্দা ফকিরের কেউ নেই। গোরস্থানেই সে থাকে। পঞ্চাশের মন্বন্তরে ছেলে মেয়ে বৌ সবাইকে সে হারিয়েছে। তাদের কারও কবর হয়নি। সে জন্য সে কবরস্থান থেকে সে নড়তে চায় না। মরার সময় হলে কবরে ঢুকে পড়বে। মুর্দা ফকির কবর নাটিকায় এক অনবদ্য চরিত্র। এই চরিত্র সৃষ্টির সময় হতে পারে একটা ঘটনা নাট্যকারের মনে এসে থাকবে। একুশে ফেব্রুয়ারি যেখানে ছাত্ররা গুলিতে নিহত হয় সেখানে ছাত্ররাই রাতারাতি শহিদ মিনার তৈরি করেছিল, সেই শহিদ মিনার ভোর হবার আগেই পুলিশ ভেঙ্গে ফেলে। ডক্টর মুহম্মদ শহীদুল্লাহ ভোরের নামাজ পড়েই বাড়ি থেকে বেরিয়ে সোজা ভাঙ্গা শহিদ মিনারে উপস্থিত হন। পরনে ছিল তাঁর কালো আচকান আর মাথায় ছিল কালো টুপি। তিনি ডাক দেন কে কোথায় আছ বেরিয়ে এসো আবার মিনার গড়ার কাজ শুরু করতে হবে। মাতৃভাষার মর্যাদা রক্ষায় যাঁরা প্রাণ দিয়েছে তাঁরা মরেনি, তাঁরা শহিদ হয়ে বেঁচে আছেন। ‘সেদিন ভাষা আন্দোলনের জাগ্রত বিবেক ছিলেন ডক্টর মুহম্মদ শহীদুল্লাহ।’ কবর নাটকের মুর্দা ফকিরই সেই বিবেক। ফকির গর্জে উঠে বলে, “জিন্দা-মুর্দা কেউ না। জিন্দা আর মুর্দার পার্থক্য বোঝো? দেখলে চিনতে পারবে?... আমি ওদের ভালো করে দেখেছি ওরা মুর্দা নয়। মরে নি। মরবে না। কবরের নিচে ওরা কেউ থাকবে না। উঠে চলে আসবে। বিশ পঁচিশ হাত যত নিচেই মাটি চাপা দাও না কেন- এ মুর্দা থাকবে না। কবর ভেঙ্গে বেরিয়ে চলে আসবে। উঠে আসবে।’ এ যেন শক্তির পুনরুত্থানের কথা- নির্দিষ্ট করে বলা। দৃষ্টিটা সোজাসুজি চূড়ান্ত মুক্তির দিকে তাক করা।
৫
অনেকে যেমন বলেন মার্কিন নাট্যকার আরউইন শ’র ‘ইঁৎৎু ঃযব উবধফ’ [১৯৩৬] এর ছায়া মুনীর চৌধুরীর ‘কবরে’র উপর পড়েছে। পড়তেই পারে, তাতে কবরের মৌলিকত্বে ব্যাঘাত ঘটেনি। এই মাটিতে যে অবাঞ্ছিত কবর রচিত হয়েছিল ১৯৫২ সালের ২১ ফেব্রুয়ারি, এ নাটকে শুধু তারই ছায়া পড়েছে, তাকেই ধরে রাখার চেষ্টা হয়েছে। এ কোনো গল্প নয়, আমাদের জীবনের কথা- আর তাই মুনীর চৌধুরীর ‘কবর’ আমাদের জীবনের দলিল- বাঙালির ভাষা আন্দোলনের এক নিখুঁত ছবি।
অর্থ-বাণিজ্য: নির্বাচনের প্রার্থীদের জন্য শনিবার সব ব্যাংক খোলা থাকবে