image
ফ্রান্জ ফ্যানোঁ / জন্ম: ২০ জুলাই ১৯২৫; মৃত্যু: ৬ ডিসেম্বর ১৯৬১

ফ্রান্জ ফ্যানোঁর জাতীয় সংস্কৃতির ধারণা : জন্মশতবর্ষে ফিরে দেখা

শরীফ আতিক-উজ-জামান

এ বছর ফ্রান্সের উপনিবেশবাদ-বিরোধী তাত্ত্বিক ফ্রান্জ ফ্যানোঁর জন্মশতবর্ষ। বিশ্বের বিভিন্ন দেশে সভা, সমাবেশ, সেমিনার ও তথ্যচিত্র প্রদর্শনের মধ্য দিয়ে মার্তিনিকে জন্মগ্রহণকারী এই বিরলপ্রজ তাত্ত্বিকের জন্মদিন উদযাপনের খবর পাওয়া যাচ্ছে। উত্তর-ঔপনিবেশিক পঠন-পাঠন ও বিভিন্ন দেশের সমসাময়িক রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটে তাঁর তত্ত্বের প্রভাব ও প্রাসঙ্গিকতা আগামী দিনগুলোতে কেমন দাঁড়াবে তা গবেষণার বিষয় বটে, কিন্তু তাঁকে খারিজ করা যাবে না তা নিশ্চিত। বিশ্বের প্রচলিত রাজনৈতিক তত্ত্বের ভিত নাড়িয়ে দেওয়া গ্রন্থ The Wretched of the Earth-এ তিনি যে ৫টি বিষয়ের ওপর গুরুত্বপূর্ণ মতামত রেখেছেন, ঔপনিবেশিক শাসন-শোষণ থেকে স্বাধীনতা লাভকারী দেশগুলোর পরিস্থিতির সাথে তার সাদৃশ্য খুঁজে পাওয়া যায়। এর মধ্যে তিনি ‘জাতীয় সংস্কৃতি’ সম্পর্কিত পূর্বতন ভাবনার খোল-নলচেই বদলে দিয়েছেন। সাধারণত ঔপনিবেশিক শাসকরা উপনিবেশিত জনগণকে ক্রমাগত বোঝতে থাকে যে তাদের সংস্কৃতি অত্যন্ত মর্যাদাহীন। কিন্তু, স্থানীয়দের প্রতি অবজ্ঞা ও অসম্মানই একসময় শোষিত মানুষের বড় অস্ত্র হয়ে ওঠে। উপনিবেশের বুদ্ধিজীবীরা ঔপনিবেশিক শাসকদের দ্বারা শিক্ষা লাভ করলেও তাদের প্রতিক্রিয়ার ভিন্নতা লক্ষ্য করা যায়। প্রথমত, এক শ্রেণির বুদ্ধিজীবী ঔপনিবেশিক শাসকদের অনুকরণ করে এবং তাদের রুচি ও পছন্দের অনুগামী হয়। এটা প্রাথমিকভাবে উপনিবেশ স্থাপনকারীদের প্রতি স্থানীয়দের তোষামোদির পর্যায়, যারা বুঝে না বুঝে ওদের সংস্কৃতি নিয়ে ভাব গদগদ হয়ে ওঠে। বাংলাদেশে ইংরেজ ও পাকিস্তান- দুই আমলেই ব্যাপকভাবে এই বিষয়টি ঘটেছে। তবে এই বিদেশি সংস্কৃতির আগ্রাসন রুখে দেওয়ার প্রত্যয় নিয়ে সংগঠিত হয় আরেকদল বুদ্ধিজীবী যাকে ফ্যানোঁ দ্বিতীয় পর্যায় মনে করেন। আর নিজস্ব সংস্কৃতির প্রতি গভীর ভালোবাসাই তাদের স্বাধীনতা সংগ্রামে ঝাঁপিয়ে পড়তে উদ্বুদ্ধ করে। ফ্যানোঁ মনে করতেন, এখান থেকেই নতুন জাতি গঠনের লক্ষ্যে নতুন সংস্কৃতির যাত্রা শুরু হয়। তবে এও সত্য যে তাঁর জাতীয় সংস্কৃতি তত্ত্বের মধ্যে অসংলগ্নতা আছে। যখন তিনি বলেন যে বিপ্লবী কর্মকা- সংস্কৃতি তৈরি করে, সংস্কৃতি বিপ্লব ঘটায় না, তখন বিভ্রান্তি তৈরি হয়, কারণ সংস্কৃতি সমষ্টির ক্ষোভ ও চর্চিত আদর্শ থেকে বিপ্লবের আগুন জ্বালাতে পারে। অনুন্নত দেশে জাতীয় সংস্কৃতি স্বাধীনতা সংগ্রামের একেবারে কেন্দ্রে থাকে।

The Wretched of the Earth-এর ৪র্থ প্রবন্ধ On National Culture ১৯৫৯ সালে রোমে অনুষ্ঠিত কৃষ্ণাঙ্গ লেখক-শিল্পীদের দ্বিতীয় সম্মেলনে পঠিত হয়েছিল। কীভাবে স্বাধীনতা অর্জনের পর একটি জাতি রাজনৈতিকভাবে ঔপনিবেশিক শাসকদের শূন্যস্থান পূরণ করতে পারে, কীভাবে একটি জাতীয় সংস্কৃতি তৈরি হতে পারে এই অধ্যায়ে বারংবার সেই প্রশ্ন আলোচিত হয়েছে। যেহেতু নিজেদের শাসনকালে ঔপনিবেশিক শাসকরা শোষিতদের সংস্কৃতিকে বিকৃত ও ধ্বংস করার পাশাপাশি মর্যাদাহানির কাজটি নিরন্তর চালিয়ে যায়, সেই কারণে তার প্রভাব খুবই নেতিবাচক ও স্থায়ী হয়। ফলে স্বাধীনতার সাথে সাথে ঔপনিবেশিক সংস্কৃতির কুপ্রভাব মুক্ত হয়ে ও বিকৃতি ঝেড়ে ফেলে দ্রুত পূর্বাবস্থায় ফিরে আসাটা সহজ হয় না। তখন সংস্কৃতি পুনঃর্নিমাণে ঔপনিবেশিক শাসনমুক্ত জনগণ কী ভূমিকা রাখতে পারে সে বিষয়ে তিনি মতামত রেখেছেন।

ফ্যানোঁ ‘উপনিবেশিত বুদ্ধিজীবীদের প্রসঙ্গ দিয়ে শুরু করেছেন। এরা ঔপনিবেশিকদের দ্বারা শিক্ষা লাভ করেও তাদের বিরুদ্ধে দাঁড়ায়। তাঁদের কৌশল হলো, উপনিবেশিত সংস্কৃতির অবমাননাকারী শক্তির বিরুদ্ধে দাঁড়াতে প্রথমে একটি ‘বর্ণবাদী সংস্কৃতি’কে সংগঠিত করা, যেমন- নিগ্রোসাহিত্য বা নিগ্রোশিল্প- যা সমগ্র আফ্রিকাকে একসূত্রে গাঁথতে পারে। এক্ষেত্রে ‘নেগ্রিচিউড আন্দোলন’-এর কথা উল্লেখ করা যেতে পারে, কিন্তু ফ্যানোঁর মতে তা একটি প্রতিক্রিয়াশীল পদ্ধতি, এটা নিজস্ব শর্তে ঔপনিবেশিকদের সাথে বিরোধিতায় মেতে ওঠার শামিল। ঔপনিবেশিকরা সমগ্র আফ্রিকাকে এক দলে ফেলে দেয়; তাদের ভিন্ন জাতিসত্তা, নৃতাত্ত্বিক বৈশিষ্ট্য ও সমৃদ্ধ ভিন্ন স্থানিক ইতিহাসকে ধর্তব্যের মধ্যে নেয় না। আফ্রিকা তাদের কাছে এক ও অভিন্ন এবং তা নেতিবাচক অর্থে। সমসাময়িক বুদ্ধিজীবীরা আবার ঠিক উল্টোটা করেন। তারাও মনে করেন, সমগ্র আফ্রিকা এক এবং তা ইতিবাচক অর্থে।

কিন্তু উপনিবেশ-শাসিত বুদ্ধিজীবীদের জীবনের পর্যায় একটি নয়। ফ্যানোঁ তাদের সাংস্কৃতিক গতিপথের ৩টি পর্যায়ের বর্ণনা দিয়েছেন- যা আগেই উল্লেখ করা হয়েছে। তিনি বিশ্বাস করতেন যে, সংস্কৃতি ভবিষ্যতের লড়াইয়ের জন্য প্রয়োজন এবং তা কোনো সংগ্রাম থেকেই বিচ্ছিন্ন থাকতে পারে না। বিপ্লবের জন্য জাতির ইতিহাস-নির্ভর সাহিত্য প্রয়োজন। বুদ্ধিজীবীরা সংগ্রাম থেকে দূরে থাকতে পারেন না, বরং তা থেকে তারা উপকরণ সংগ্রহ করেন। কিন্তু আমাদের দেশের বুদ্ধিজীবীরা দূরে থাকেন এবং পরে তারাই সেই সংগ্রামের ইতিহাস লেখেন এবং যারা সম্পৃক্ত থেকে সবকিছু লিপিবদ্ধ করেন তাদেরটা খারিজ করে দেন।

ফ্যানোঁ এখানে রাষ্ট্রাতিগ বা জাতীয় সীমানা অতিক্রান্ত (Supra national) সংস্কৃতির কথা বলেছেন। এই সম্পর্কিত আহ্বান নিয়ে তাঁর বক্তব্য হলো, কেউ কেউ বলে থাকেন মানবতা জাতীয়তাবাদী দাবির স্তর অতিক্রম করেছে, বৃহত্তর রাজনৈতিক ঐক্য গড়ে তোলা এবং প্রাচীনপন্থী জাতীয়তাবাদীদের ভুলগুলো সংশোধনের সময় হয়েছে। তবে এই আহ্বানের মধ্যেও গলদ ছিল বলে ফ্যানোঁর ধারণা। সংস্কৃতি মূলত কী সে সম্পর্কে তাদের সঠিক ধারণা ছিল না। তিনি যুক্তি দেখাচ্ছেন যে সংস্কৃতির উদ্ভব হয় জাতীয় চেতনা থেকে। এমন কোনো সংস্কৃতি হতে পারে না যা জাতীয় চেতনা সম্পৃক্ত নয়। জাতীয় সংস্কৃতি হলো সংস্কৃতির সর্বোচ্চ রূপ এবং যে কোনো আন্তর্জাতিক বা বৈশ্বিক সংস্কৃতি কোনো না কোনো জাতীয় সংস্কৃতির ওপর ভিত্তি করে নির্মিত হয়।

ঔপনিবেশিক শাসন থেকে স্বাধীনতা অর্জনের পর জাতীয় ইতিহাস ও সংস্কৃতি পুনরুদ্ধারের সমস্যা নিয়ে আলোচনা করতে গিয়ে ফ্যানোঁ ঔপনিবেশিক ব্যবস্থায় আদিবাসী সংস্কৃতির রূপগুলোকে মুছে ফেলার প্রসঙ্গের অবতারণা করেছেন। ইউরোপীয়রা কেবল আফ্রিকার সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যের অমর্যাদা করেই ক্ষান্ত হয়নি, তারা আদিবাসী ও ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীর পরিচয় ও সংস্কৃতিকে ধ্বংস করতে চেয়েছে। উপনিবেশ-পরবর্তী শাসকরাও সেই একই পথে পরিক্রমণের মাধ্যমে ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীর আত্মপরিচয় নির্মাণ ও সাংস্কৃতিক স্বাতন্ত্র্য রক্ষার ক্ষেত্রে বড় রকমের প্রতিবন্ধকতা তৈরি করেছে। বাংলাদেশের স্বাধীনতার পর প্রথমে ‘বাঙালি জাতীয়তাবাদ’ ও পরে ‘বাংলাদেশী জাতীয়তাবাদ’-এর কোথাও আদিবাসী ও ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীর পরিচয় ও সংস্কৃতিকে স্বীকৃতি দেওয়া হয়নি- যা ঔপনিবেশিক চেতনার ধারাবাহিক লালন ছাড়া আর কিছুই নয়।

স্থানীয় মনীষীদের পা-িত্যপূর্ণ রচনার ওপর তীক্ষ্ণ নজর রেখে ফ্যানোঁ তাদের আত্মপরিচয় রূপান্তরের ধরনটি উপলব্ধি করেন। এই বিশ্লেষণটি তথাকথিত কালো থেকে কৃষ্ণাঙ্গ পরিচয়ে রূপান্তরের সমান্তরাল বলে মনে করা হয়। এই পর্যায়ে ব্যক্তি অযাচিতভাবে ঔপনিবেশিক ধ্যান-ধারণা, বিশ্বাস, মনোভাব, আচরণ ইত্যাদির সাথে মিশে যেতে থাকে এবং আত্তীকৃত হয়। পরবর্তীতে সংস্কৃতি উদ্ধারে উঠেপড়ে লাগে। এরপরের লড়াইয়ে সে ‘জনগণের জাগরণকারী হিসেবে আবির্ভূত হয়, ফলে একটি লড়াইয়ের সাহিত্য, বিপ্লবের সাহিত্য ও জাতীয় সাহিত্যের জন্ম হয়’। ফ্যানোঁ আরো মনে করেন, ‘জাতীয় সংস্কৃতির জন্য লড়াই করার অর্থ হলো, সর্বপ্রথম জাতীয় মুক্তির জন্য লড়াই করা, সেই বস্তুগত মূলনীতি যা একটি সংস্কৃতির নির্মাণকে সম্ভব করে তোলে। জনপ্রিয় সংগ্রাম ছাড়া সংস্কৃতির জন্য আর কোনো লড়াই নেই- যা বিকশিত হতে পারে।’

এইভাবেই ফ্যানোঁ সাংস্কৃতিক জাতীয়তাবাদকে জাতীয় মুক্তির পূর্বশর্ত এবং জাতির মুক্তিকে সংস্কৃতি নবায়নের জন্য অতিপ্রয়োজনীয় হিসেবে বিবেচনা করেন। জাতীয় মুক্তির মতো সংগ্রাম হলো জাতীয় সংস্কৃতির প্রকাশ। এখানে ফ্যানোঁ আসলে কোনো বিকল্প রাখেননি। আমাদের সর্বজনীন মূল্যবোধ আবিষ্কার ও উৎসাহ জোগানোর মধ্য দিয়ে লক্ষ্য পূরণ করতে হবে, নয়তো বিশ্বাস নষ্ট করতে হবে।

পূর্বেই উল্লেখ করা হয়েছে যে, এই অধ্যায়টি একটি বক্তৃতা হিসেবে শুরু হয়েছিল, তবে এটা ভাবার সুযোগ নেই যে পূর্ববর্তী ও পরবর্তী অধ্যায়গুলো বিচ্ছিন্ন বা একটি থেকে আরেকটি প্রসঙ্গসূত্রে খুবই আলাদা। প্রথম ৩টি অধ্যায়ে মোটামুটি কালানুক্রমিকভাবে উপনিবেশ থেকে উত্তর-উপনিবেশ পর্বে জাতিগঠন সম্পর্কিত তত্ত্ব আলোচিত হয়েছে। পরবর্তী অধ্যায় ২টিতে সংস্কৃতি ও মনোবিজ্ঞান নিয়ে আলোকপাত করলেও গ্রন্থের সবটা জুড়ে ঔপনিবেশিক সময়কালে উপনিবেশিত বুদ্ধিজীবী শ্রেণির মনস্তত্ত্বকে ধরার একটি প্রয়াস লক্ষ্য করা যায়। প্রথম অধ্যায়ে সহিংসতা সম্পর্কে বলতে গিয়ে তিনি ঔপনিবেশিক বুর্জোয়া শ্রেণি ও উপনিবেশবাসীর মনের গভীরের আকাক্সক্ষা অনুধাবন করতে চেয়েছেন। ‘ঔপনিবেশিক বুর্জোয়ারা উপনিবেশবাসীর মনে এমন একটি সমাজের ধারণা ঢুকিয়ে দেন যেখানে সবকিছুই ব্যক্তিস্বার্থ ও সম্পদচিন্তায় নিবদ্ধ। কিন্তু স্বাধীনতা সংগ্রামে যে বুদ্ধিজীবীরা জনগণের সাথে প্রতিকূল পরিস্থিতি মোকাবেলায় শামিল হওয়ার সৌভাগ্য লাভ করেন, তিনি দ্রুতই এই তত্ত্বের অসারতা উপলব্ধি করতে পারেন’। ফ্যানোঁ খুব স্পষ্টভাবেই বলেছেন যে যুদ্ধে যোগদান ?বুদ্ধিজীবীদের মুক্তি দিতে পারে- যারা এই যুদ্ধ থেকে সংস্কৃতি অর্জন করেন।

এই ঔপনিবেশিক দখলদারিত্বের সাথে সুপরিকল্পিতভাবে আফ্রিকানদের আত্মমর্যাদা, ইতিহাস ও সংস্কৃতির মনস্তাত্বিক অবমূল্যায়নের যোগসূত্র ছিল। ইউরোপীয় আদর্শে আফ্রিকানদের নির্গুণের আধার ও মন্দের অবতার হিসেবে দেখা হতো। এভাবেই তাদের ওপর শারীরিক-মানসিক নির্যাতনের স্বরূপটি উন্মোচিত হয়। তবে সংগ্রামের ভিতর দিয়েই মানুষ একত্রিত হয়, আর তার মাধ্যমে নতুন সাংস্কৃতিক বৈশিষ্ট্যের জাগরণ ঘটে যাকে ফ্যানোঁ সোয়াহিলি ভাষায় ‘হারামবি’ বলছেন যার অর্থ হলো, ‘সকলে একসাথে টানো’।

এখানে একটি সুস্পষ্ট বার্তা রয়েছে। আফ্রিকায় দুর্ভিক্ষ এবং আমেরিকা ও সোভিয়েত ইউনিয়নের যুদ্ধ ক্ষমতার অভূতপূর্ব বিকাশ একইসাথে লক্ষ্য করা গেছে। সহিংসতার আন্তর্জাতিক প্রেক্ষাপট বর্ণনা করতে গিয়ে তিনি সুস্পষ্টভাবে দাবি করেছেন যে ইউরোপের বিশাল সম্পদ এশিয়া ও আফ্রিকা থেকে চুরি করা, সেই কারণে তৃতীয় বিশ্বের নব্য-স্বাধীন দেশগুলোর পশ্চিমা সমাজের ক্ষয়িষ্ণু ঐতিহ্যের অনুকরণ না করে নিজেদের সংস্কৃতি পুনরুদ্ধারের মাধ্যমে মানুষের মাঝে সম্পর্কের নতুন ধারা সৃষ্টি করা উচিৎ। তিনি সম্পদের পুনর্বণ্টনের আহ্বান জানিয়েছেন এবং ইউরোপের ক্ষয়িষ্ণু আধিপত্যের দিকে ইঙ্গিত করে বলেছেন, ‘উপনিবেশ ও সাম্রাজ্যবাদীরা আমাদের অঞ্চল থেকে পুলিশ ও তাদের পতাকা প্রত্যাহার করলেও ক্ষতিপূরণ দেয়নি। পুঁজিতান্ত্রিক দেশগুলো শতাব্দীর পর শতাব্দী অনুন্নত বিশ্বের সাথে যুদ্ধাপরাধীর মতো আচরণ করে আসছে। সোনা, হীরাসহ অন্যান্য সম্পদ বাড়াতে এবং নিজেদের ক্ষমতা পোক্ত করতে পুঁজিবাদীরা নির্বাসন, গণহত্যা, বলপূর্বক শ্রমের ব্যবহার ও দাসত্বকেই ব্যবহার করে আসছে’।

ঔপনিবেশিক ব্যবস্থাগুলো জাতীয়তাবাদী বুর্জোয়াদের মানসিকতাকে বেশিমাত্রায় ঔপনিবেশিক করে গড়ার লক্ষ্যে জোরালো প্রচেষ্টা চালায় যাতে তাদের যথেচ্ছ ব্যবহার করা যায়। তাই জাতীয়তাবাদী বুর্জোয়া যারা বিপ্লবের পর দেশের নেতৃত্ব গ্রহণ করেন তারা এক ধরনের ‘দৃষ্টিভঙ্গি পরিহারের দ্বন্দ্বে’ (অঢ়ঢ়ৎড়ধপয আড়রফধহপব ঈড়হভষরপঃ) ভুগতে থাকেন। তারা ঔপনিবেশিক পদ্ধতি থেকে মুক্ত হতে চান, কিন্তু ভেতরে ভেতরে তার সাথে বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক বজায় রাখেন।

কিন্তু মধ্যবিত্ত ও সাধারণ জনগণের সম্পর্কের স্বরূপটি কেমন? মধ্যবিত্ত শ্রেণিও ঔপনিবেশিক ধ্যান-ধারণা আঁকড়ে ধরে থাকতে চায়। বিলাসবহুল গাড়ি-বাড়ি অর্জন ও প্রদর্শনের প্রবল ইচ্ছা দ্বারা তারা তাড়িত হন। ঔপনিবেশিক ব্যবস্থার বৃত্তাবদ্ধ ধারণায় তাদের অভ্যাস আটকে যায়, এর থেকে বেরুতে পারে না। ফ্যানোঁ মধ্যবিত্ত শ্রেণির তীব্র সমালোচনা করেন, কারণ প্রথাগত বুর্জোয়ারা যে লক্ষ্য, উদ্দেশ্য ও পদ্ধতি নিয়ে চলত, এরাও সেই পথ অনুসরণ করে। শুধু তাই নয়, ধীরে ধীরে তারা পশ্চিমা বুর্জোয়া শ্রেণির ব্যবসায়িক এজেন্ট হয়ে ওঠে। ফ্যানোঁর এ বিষয়ে পর্যবেক্ষণ হলো, পশ্চিমা বুর্জোয়াদের এই ব্যবসায়িক এজেন্টরা প্রায়শই জাতীয় উন্নয়নকে উপেক্ষা করে পর্যটন শিল্প বিকাশের পক্ষে আগ্রহ দেখায় যাকে তিনি ‘ইউরোপের পতিতালয়’ বলে উল্লেখ করেছেন।

এই প্রবন্ধে ফ্যানোঁর ‘সাংস্কৃতিক সহিংসতা’ সম্পর্কিত ধারণাসমূহ উল্লেখযোগ্য। বর্ণবাদী জনশ্রুতি ও এ সম্পর্কিত গড়ে ওঠা বিশ্বাসের কারণে আফ্রিকানরা হীনম্মন্যতায় ভোগে। জাতীয় বুর্জোয়ারা এই বিশ্বাসকে আরো গভীরে টেনে নিয়ে যায়, তারপর কৃষকদের দিক থেকে মুখ ফিরিয়ে নেয় এবং ঔপনিবেশিক শক্তির অনুকরণ করতে শুরু করে। এই অনুকরণপ্রিয়তা ও অকার্যকারিতা ধীরে ধীরে রাষ্ট্রের রাজনৈতিক দলগুলোর মাঝে সংক্রমিত হয়, কিন্তু সরকারের উচিৎ ধর্মগুরু ও সুবিধাপ্রাপ্ত শ্রেণির কব্জা থেকে সবকিছু বের করে এনে বিকেন্দ্রিকরণ করা।

অধস্তনতা অনেক সামাজিক ও ব্যক্তিগত সমস্যার জন্ম দেয়। কিন্তু উপসংহারে ফ্যানোঁ বিশ্বকে পুনর্গঠনকল্পে সমমনা ব্যক্তিদের কাছে আবেদন জানিয়েছেন যে তারা যেন নিজেদের বদলে নেন। একটি ইউরোপীয় মডেলকে তিনি প্রত্যাখ্যানের দাবি জানান। পশ্চিমা বিশ্বকে অনুকরণ না করে নতুন পথ উন্মোচনের আহ্বান জানান। প্রকৃতপক্ষে ফ্যানোঁ তৃতীয় বিশ্বের কাছে উদাত্ত কণ্ঠে আহ্বান জানাচ্ছেন যে মানুষের যে সমস্যা ইউরোপ সমাধান করতে পারেনি, তারা যেন তা করে দেখায়। বিশ্বজয়ের প্রচেষ্টায় ইউরোপ যেসব অপরাধ করেছে সেসব এড়িয়ে তৃতীয় বিশ্ব নতুন ইতিহাস রচনা করবে এমন প্রত্যাশা তিনি ব্যক্ত করেছেন। ‘মানবতা আমাদের কাছে নতুন কিছু প্রত্যাশা করে, কারণ একই জিনিসের অনুকরণ অশ্লীল ব্যঙ্গচিত্রের মতো মনে হবে’। নতুন মানুষকে পথ দেখানোর আহ্বান জানিয়েছেন। উপনিবেশ থেকে মুক্তি লাভ করা মানুষদের দায়িত্ব হলো মানবতার জন্য নতুন পথ উদ্ভাবন ও নতুন রূপরেখা প্রণয়ন। তবে একটা প্রশ্ন অবশ্যই গুরুত্বপূর্ণ এবং ?ঘুরেফিরেই তা সামনে আসছে, আর তা হলো, তৃতীয় বিশ্ব মানুষের নতুন ইতিহাস লিখবে বলে ফ্যানোঁ যে প্রত্যাশার কথা বলছেন তাকি সত্যিই সম্ভব হবে? কারণ অসম্ভাব্যতার অজ¯্র কারণ তিনি নিজেই উল্লেখ করেছেন এবং তার অনেক কিছুই আজ সত্য প্রমাণিত হচ্ছে। তাহলে পথ কোন দিকে?

সম্প্রতি