image
সৈয়দ শামসুল হক / জন্ম : ২৭ ডিসেম্বর ১৯৩৫; মৃত্যু : ২৭ সেপ্টেম্বর ২০১৬

সৈয়দ শামসুল হকের সাহিত্যে ‘জলেশ্বরী’

দেওয়ান বাদল

সৈয়দ শামসুল হক (১৯৩৫-২০১৬) বাংলাদেশের একজন প্রখ্যাত সাহিত্যিক। বাংলা সাহিত্যের সকল শাখায় তাঁর সাবলীল ও সফল বিচরণের জন্য তাঁকে সব্যসাচী লেখক বলা হয়। এক্ষেত্রে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ও বুদ্ধদেব বসুর পরে তিনিই সবচেয়ে শক্তিমান লেখক। এছাড়া তিনি একই সঙ্গে সিরিয়াস ও জনপ্রিয় উভয় ধারায় সমান সাফল্যের পরিচয় দিয়েছেন। তাঁর সাহিত্যে বিশেষ করে গল্প ও উপন্যাসের অধিকাংশই জলেশ্বরীর প্রেক্ষাপটে লেখা হয়েছে।

জলেশ্বরী হলো সৈয়দ শামসুল হকের সৃষ্ট একটি কাল্পনিক অঞ্চল তথা ফিকশনাল লোকেশন। বাস্তবে জলেশ্বরী বলে কোনো শহর নেই। কিন্তু তাঁর সাহিত্যের মানচিত্রে তা ভীষণ বাস্তব হয়ে আবির্ভূত হয়েছে, যা মূলত তাঁর জন্মস্থান কুড়িগ্রাম এবং বৃহত্তর উত্তরবঙ্গকে প্রতিনিধিত্ব করে। এটি তাঁর সাহিত্যেকর্মের একটি গুরুত্বপূর্ণ ভৌগোলিক পটভূমি হিসেবে বিবেচিত, যেখানে তিনি এই অঞ্চলের সাধারণ মানুষ, তাদের জীবনযাত্রা, আর্থ-সামাজিক বাস্তবতা, রাজনৈতিক অসঙ্গতি এবং লোকায়ত সংস্কৃতিকে তুলে ধরেছেন। এ-ধরনের কাল্পনিক অঞ্চল নির্মাণ করে তিনি বাংলা সাহিত্যে একটা উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছেন। তিনি এরকম আরও বেশ কিছু কাল্পনিক অঞ্চল সৃষ্টি করেছেন। যেমন- বুড়িরচর, নবগ্রাম, শুকুনমারী, বলধারচর, মান্দারবাড়ি, হরিসার, হস্তিবাড়ি। তিনি আধকোষা নামে একটি কাল্পনিক নদীও তৈরি করেছেন। এই নদীর তীরবর্তী শহর হলো জলেশ্বরী। জলেশ্বরীতে আছে একটি ট্রেন স্টেশন, যার কথা বারবার এসেছে তাঁর বিভিন্ন গল্প-উপন্যাসে। বাংলা সাহিত্যে তিনি ছাড়া আর কেউই সার্থকভাবে কাল্পনিক অঞ্চল বা ফিকশনাল লোকেশন নির্মাণ করেননি। তবে কাল্পনিক চরিত্র তথা ফিকশনাল ক্যারেক্টারকে গল্প-উপন্যাসের প্রধান চরিত্র হিসেবে বাস্তবের চরিত্রের মতোই প্রতিষ্ঠা করেছেন অনেক লেখকই। যেমন- হুমায়ূন আহমেদের হিমু, মিশির আলি, রোমেনা আফাজের দস্যু বনহুর, কাজী আনোয়ার হোসেনের মাসুদ রানা, নীহাররঞ্জন গুপ্তের কিরীটি রায়, শরবিন্দু বন্দ্যোপাধ্যায়ের ব্যোমকেশ বকসী প্রমুখ।

কিন্তু বিশ্বসাহিত্যে অনেক লেখকই কাল্পনিক অঞ্চল তথা ফিকশনাল লোকেশন নির্মাণ করেছেন। যেমন- ভারতের আর কে নারায়ণের কাল্পনিক অঞ্চল মালগুডি শহর, যা তাঁর জন্মশহর মাদ্রাজ থেকে কল্পনদী বা ফিকশনাল রিভার সারায়ুর তীরবর্তী মফস্বল শহর। আর কে নারায়ণের বেশিরভাগ উপন্যাস ও গল্পে এই মালগুডি শহরের অনুষঙ্গ ব্যবহার করা হয়েছে। নোবেল জয়ী মার্কিন কথাসাহিত্যিক উইলিয়াম ফকনারের কাল্পনিক অঞ্চল ইয়োকনাপাতাওফা, এটি তিনি মিসিসিপির একটি গ্রামদেশের আদলে সৃষ্টি করেছেন। তাঁর বিখ্যাত উপন্যাস ‘অনংধষড়স, অনংধষড়স’-এ ইয়োকনাপাতাওফা অঞ্চলের ম্যাপও ব্যবহার করা হয়েছে। জনপ্রিয় কথাসাহিত্যিক স্টিফেন কিংয়ের কল্পশহর ক্যাসেল রক, যা তাঁর বেশ কিছু উপন্যাস ও গল্পে ব্যবহৃত হয়েছে। ভৌগোলিকভাবে ক্যাসেল রক নিউ ইংল্যান্ডের উত্তর-পূর্ব অঞ্চল হিসেবে পরিচিত। মার্কিন কথাসাহিত্যিক কার্ট ভনগার্টের কাল্পনিক অঞ্চল ইলুয়াম, এর পটভূমি তাঁর বেশ কিছু উপন্যাসে উঠে এসেছে। আরেক মার্কিন কথাসাহিত্যিক জন গ্রিশাম সৃষ্টি করেছেন কল্পঅঞ্চল ক্লান মিসিসিপি শহর। জে কে রাওলিংয়ের উপন্যাস হ্যারিপটার সিরিজে কল্পশহর হিসেবে উঠে এসেছে বেশকিছু স্থানের নাম। এর মধ্যে সবচেয়ে বেশি উল্লেখযোগ্য হলো হগসমিড গ্রাম। এখানে আশ্চর্য জাদুকর, জাদুর বিচিত্র জীবজন্তু ও পেতœীদের বাস। গাব্রিয়েল গার্সিয়া মার্কেজের কল্প অঞ্চল হলো মাকন্দ গ্রাম, যা তাঁর বিখ্যাত উপন্যাস ওয়ান হান্ড্রেড ইয়ার্স অব সলিটিউড-এর পটভূমি। এভাবে সাহিত্যে কাল্পনিক স্থানের ব্যবহারের ক্ষেত্রে সৈয়দ শামসুল হকের জলেশ্বরীকে উল্লিখিত উপন্যাসগুলোর স্থানের সঙ্গে তুলনা করা যায়। এই কাল্পনিক ভৌগোলিক কাঠামো লেখককে তাঁর অঞ্চলের গভীরতার দিকগুলো উন্মোচন করতে সাহায্য করেছে।

সৈয়দ শামসুল হক তাঁর নিজের সৃষ্টি কাল্পনিক শহর বা ফিকশনাল টাউন নিয়ে এক সাক্ষাৎকারে বলেন-

“যারা বিশাল বাংলায় থাকেন (আমি মফস্বল শব্দটি পছন্দ করি না), তাদের নিয়ে যখন গল্প, কবিতা, নাটক লিখতে যাই, তো প্রতিবারই একটি নতুন শহর বা গ্রামের কথা ভাবাটা প-শ্রম। সেজন্য আমি একটি কল্পনার ভূগোল জগৎ তৈরি করে নিয়েছি। এটির শুরু ১৯৭৪ সালে, যখন আমি ‘দ্বিতীয় দিনের কাহিনি’ নামে উপন্যাসটি লিখি। আারেকটি কথা এখানে বলা দরকার, বিশেষ করে জলেশ্বরীর পটভূমিতে যেমন গল্প-উপন্যাস লিখেছি, তার কোনো কোনো চরিত্র এ-গল্প থেকে ও-গল্পে এসেছে। এ গল্পে যখন অপ্রধান চরিত্রটি আরেক গল্পে প্রধান চরিত্র হয়েছে; কিংবা কোনো উপন্যাসে আগের চার-পাঁচটি গল্পের তিন-চারটি চরিত্র এখানে প্রবেশ করেছে। অর্থাৎ আমি একটি পরিম-ল গড়ে তুলতে চেয়েছি। সমালোচনার ভাষায় যাকে এপিক বলে শনাক্ত করা হচ্ছে।”

এই কাল্পনিক ভৌগোলিক কাঠামো লেখককে তাঁর অঞ্চলের গভীরতর দিকগুলি উন্মোচন করতে সাহায্য করেছে। সৈয়দ শামসুল হকের যে সকল গল্প-উপন্যাসে জলেশ্বরীর সরাসরি উল্লেখ পাওয়া যায় তার মধ্যে উল্লেখযোগ্য কয়েকটি হলো- ‘দ্বিতীয় দিনের কাহিনি’, ‘নিষিদ্ধ লোবান’, ‘বৃষ্টি ও বিদ্রোহীগণ’ এবং ২৩টি গল্প নিয়ে ‘জলেশ্বরীর গল্পগুলো’ নামে একটি গল্প সংকলন। এ সকল গল্প-উপন্যাসে লেখকের নিজের অঞ্চলের পরিবেশ, ভাষা ও মানুষের উপস্থিতি লক্ষ্য করা যায়। তিনি সেগুলোতে সচেতনভাবে বৃহত্তর উত্তরবঙ্গের আঞ্চলিক ভাষাকে দৃঢ় অবস্থান দিয়েছেন, যা এই জনপদের মানুষের জীবনকে আরও বাস্তবসম্মত করেছে। এই পর্যায়ের গল্পগুলিতে অনেক সময় একক কোনো কেন্দ্রীয় চরিত্রের পরিবর্তে ‘আমরা’ নামক সামূহিক জনগোষ্ঠীর স্মৃতিচারণ, কথকতা বা বর্ণনায় কাহিনি বিধৃত হয়েছে। এখানে প্রায়শই প্রান্তিক চরিত্রগুলোই ঘটনা নিয়ন্ত্রণ করেছে।

বলা যায় সৈয়দ শামসুল হকের সাহিত্যে জলেশ্বরী শুধু একটি কাল্পনিক শহরের নাম নয়, এটি হলো তাঁর সৃজনশীল সত্তার এক নিজস্ব ভুবন, যার মাধ্যমে তিনি তাঁর প্রিয় জন্মস্থান কুড়িগ্রামসহ সমগ্র উত্তরবঙ্গের হৃদয়স্পর্শী ছবি বিশ্বসাহিত্যের দরবারে তুলে ধরেছেন।

সম্প্রতি