মাসুদুল হক
(পূর্ব প্রকাশের পর)
৫. আধ্যাত্মিক এবং মিথ-চিন্তন:
টি এস এলিয়ট আধুনিক কাব্যচিন্তায় যে গম্ভীর ও বহুমাত্রিক দৃষ্টিভঙ্গির সূচনা করেন, তা তার রচনাশৈলীতে যেমন প্রতিফলিত হয়েছে, তেমনি তার সাহিত্যতত্ত্বেও। ‘Four Quartets’ কাব্যগ্রন্থে এলিয়ট যে আধ্যাত্মিক ও মিথ-চিন্তার সম্মিলন ঘটিয়েছেন, তা কেবল ধর্মীয় অনুরণন নয়, বরং এক গভীর দার্শনিক অনুসন্ধান। এই কাব্যকর্মে হিন্দু দর্শনের পুনর্জন্ম, কাল-চক্র এবং আত্মার মুক্তির ধারণা যেমন প্রতিভাত হয়েছে, তেমনি খ্রিস্টান ধর্মতত্ত্বের পাপ, ত্যাগ এবং ঈশ্বরমুখিতা বিষয়গুলিও ব্যতিক্রমধর্মী কাব্যভাষায় ধরা পড়েছে। উদাহরণস্বরূপ, ‘Little Gidding’-এ এলিয়ট যেভাবে পাপ ও পরিশুদ্ধির মধ্য দিয়ে চূড়ান্ত সত্যে পৌঁছনোর কথা বলেন, তা খ্রিস্টান রেনেসাঁস ভাবনার ধারাবাহিকতা। অন্যদিকে, ‘The Dry Salvages’-এ তিনি হিন্দু দর্শনের পুনর্জন্ম ও মোক্ষ-চিন্তার দিকেও ইঙ্গিত করেন- বিশেষত কৃষ্ণের বাণী উদ্ধৃত করে গীতার অনুষঙ্গকে সামনে আনেন।
এই দ্বিমুখী ধর্ম-আধ্যাত্মিক প্রক্ষিপ্তির পেছনে এলিয়টের ভাবজগতে যে ঐতিহ্যচেতনার প্রভাব কাজ করে, তা তার বিখ্যাত প্রবন্ধ ‘Tradition and the Individual Talent’-এ সুস্পষ্টভাবে ব্যক্ত হয়েছে। সেখানে তিনি বলেন, একটি কবিতা কবির আবেগ বা ব্যক্তিত্বের সরাসরি প্রকাশ নয়; বরং তা ব্যক্তিত্ব থেকে উত্তরণ বা নিঃসরণ- একটি বিশুদ্ধ ও অনৈকান্তিক অভিজ্ঞতা রূপে গড়ে ওঠা শিল্পসত্তা। এলিয়টের মতে, সত্যিকারের কবি তার ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতাকে কাব্যিক ঐতিহ্যের বৃহত্তর ধারায় একরূপে মিলিয়ে দেন, যেন একটি রাসায়নিক বিক্রিয়ার মতো, যেখানে কবির মন কাজ করে প্ল্যাটিনামের মতো- যা প্রতিক্রিয়ায় অংশ নিলেও নিজে অপরিবর্তিত থেকে যায়।
এই দৃষ্টিভঙ্গিরই এক দৃষ্টান্ত ‘Objective Correlative’ ধারণা। এলিয়ট বিশ্বাস করতেন, একটি আবেগ বা অনুভূতিকে সার্থকভাবে প্রকাশ করতে হলে তা কিছু নির্দিষ্ট বস্তু, ঘটনা বা দৃশ্যের মাধ্যমে উপস্থাপন করতে হবে- যার মাধ্যমে পাঠকের মনে সেই নির্দিষ্ট অনুভূতির উদ্রেক হবে। আবেগ এখানে বিমূর্ত নয়, বরং একটি বস্তুনির্ভর সমান্তরাল বাস্তবতার মাধ্যমে রূপান্তরিত। এইভাবেই এলিয়ট আধুনিক কবিতাকে আবেগের কুয়াশাচ্ছন্নতা থেকে মুক্ত করে এক দার্শনিক সংহতির দিকে পরিচালিত করেন।
এইসব দিক থেকে বলা যায়, এলিয়টের কবিতা এবং সমালোচনা উভয়ই একটি বৃহত্তর বোধিসত্ত্বের অন্বেষণ, যেখানে পূর্ব ও পশ্চিমের ভাবধারা এক আত্মিক ব্যঞ্জনায় মিলিত হয়েছে। তার আধ্যাত্মিকতা মিথ ও ইতিহাসের আলোকে প্রতিফলিত হলেও তা কখনো নির্দিষ্ট ধর্মীয় বৃত্তে আবদ্ধ নয়; বরং এক সার্বজনীন বোধের দিকে প্রবাহিত। এই বোধকে রূপ দিতে গিয়ে তিনি ‘Four Quartets’ কবিতায় সময় ও অনন্ত, জন্ম ও মৃত্যু, শব্দ ও নীরবতার দ্বন্দ্বময় সুরে এক গভীর কাব্যিক ধ্যানচর্চা রচনা করেছেন। এবং এই অনন্য কাব্যভাষা ও তত্ত্বচিন্তার মাধ্যমে এলিয়ট আধুনিকতার কেন্দ্রে দাঁড়িয়ে কাব্যিক আধ্যাত্মিকতার এক নতুন দিগন্ত উন্মোচন করেন।
৬. রূপক ও মিথের ব্যবহার:টি. এস. এলিয়ট-এর The Waste Land আধুনিক ইংরেজি কবিতার অন্যতম জটিল ও প্রতীকসমৃদ্ধ রচনা, যেখানে তিনি রূপক ও মিথের সুবিন্যস্ত ব্যবহারের মাধ্যমে আধুনিক সমাজের গভীর সংকট ও আত্মিক শূন্যতাকে তুলে ধরেছেন। এই কবিতায় এলিয়ট ‘mythical method’-এর যে প্রয়োগ করেছেন, তা কেবল অলংকার নয়, বরং এক ধরনের নান্দনিক ও বৌদ্ধিক পন্থা- যার মাধ্যমে সমকালীন বিশৃঙ্খলা ও বিচ্ছিন্নতার মধ্যে একটি ঐতিহাসিক ও সাংস্কৃতিক ধারাবাহিকতা রচিত হয়।
কবিতায় বর্ণ বা রঙের উপমা গভীর প্রতীক হিসেবে ব্যবহৃত হয়েছে। যেমন, ‘a heap of broken images’- এই চিত্রকল্পে ধ্বংসপ্রাপ্ত চেতনার একটি ধূসর রঙিন ব্যঞ্জনা লক্ষ্য করা যায়। শুষ্ক ও রিক্ত পৃথিবীর বিপরীতে পানির প্রতীক হয়ে ওঠে প্রাণ ও পুনর্জন্মের প্রতিশ্রুতি, আবার কখনো তা হয় ভয়াবহতার ইঙ্গিত। “Here is no water but only rock”- এই পঙ্ক্তিতে পানির অনুপস্থিতি এক ধরনের আধ্যাত্মিক খরার সংকেত দেয়, যা আধুনিক মানুষের অন্তঃসারশূন্য জীবনের রূপক।
Fisher King-এর মিথ এই কবিতার কেন্দ্রীয় রূপক, যার মাধ্যমে এলিয়ট একাধারে ব্যক্তিগত এবং সভ্যতার পতনের চিত্র অঙ্কন করেছেন। এই রাজা শারীরিকভাবে বিকলাঙ্গ, আর তার রাজ্য শুষ্ক ও অনুর্বর। মিথ অনুযায়ী, রাজা সুস্থ হলে তবেই রাজ্য পুনরুজ্জীবিত হয়। এই কিংবদন্তি এলিয়ট ব্যবহার করেছেন একটি সাংস্কৃতিক কাঠামো হিসেবে, যেখানে আধুনিক পশ্চিমা সভ্যতা- বিশেষত প্রথম বিশ্বযুদ্ধোত্তর ইউরোপ- একটি অসুস্থ রাজ্যের রূপে উপস্থাপিত, আর মানুষের আত্মিক দুর্দশা ফিশার কিং-এর দেহগত যন্ত্রণার প্রতিফলন।
এলিয়টের নিজের ভাষায়, ‘mythical method’ হলো একটি সংগঠিত পদ্ধতি, যা আধুনিকতার বিশৃঙ্খলার ভেতরে একটি ঐতিহাসিক ও নৈতিক কাঠামো গঠনের চেষ্টা। জেমস জয়েস-এর ইউলিসিস-এর অনুরূপভাবে এলিয়টও পুরাণ ও ইতিহাসকে বর্তমানের বীক্ষণে যুক্ত করেছেন, যেন পুরাতন আর নতুনের একটি সংলাপ সৃষ্টি হয়। এই মিথগত পরিকাঠামো কেবল অতীত স্মরণ নয়, বরং বর্তমানকে বোঝার এক জটিল রীতিও বটে।
The Waste Land-এ মিথ, রূপক ও প্রতীকের নিপুণ মিশ্রণ এলিয়টের কাব্যিক দক্ষতার পরিচয় দেয়। এভাবে তিনি আধুনিক জীবনের বেদনাকে এক মহাকাব্যিক ব্যঞ্জনায় রূপ দেন, যেখানে প্রতিটি প্রতীক ও মিথ আমাদের স্মরণ করিয়ে দেয় যে বর্তমানের হতাশার গভীরে লুকিয়ে আছে অতীতের একটি প্রতিধ্বনি- এবং সম্ভবত ভবিষ্যতের জন্য একটি মুক্তির সংকেতও।
৭.ঐতিহাসিক ধাপ:জর্জিয়ান কবিদের যুগ (আনুমানিক ১৯০০ থেকে ১৯২০ সাল পর্যন্ত)ছিল ইংরেজি কবিতার ইতিহাসে এক অন্তর্বর্তী ও গুরুত্বপূর্ণ অধ্যায়। এই সময়ে ইংল্যান্ডের কবিতার ধারায় যে পরিবর্তন সূচিত হয়, তা প্রধানত দুইটি পরস্পরবিরোধী প্রেরণার সম্মিলনে গঠিত: একদিকে প্রাক-প্রথম বিশ্বযুদ্ধের শান্ত, প্রকৃতিপ্রেমী, গীতধর্মী কাব্যধারা; অন্যদিকে যুদ্ধের বিভীষিকা থেকে উৎসারিত গভীর মানসিক ও বাস্তব অভিজ্ঞতার প্রতিফলন।
জর্জিয়ান কবিরা, যেমন রূপার্ট ব্রুক, উইলফ্রেড গিবসন ও জন মেসফিল্ড, প্রাক-যুদ্ধকালে এক ধরনের রোমান্টিকতা ও গ্রাম্য নিসর্গচেতনার প্রতিভূ ছিলেন। তারা স্বতঃস্ফূর্ততা, সরলতা এবং প্রকৃতির সৌন্দর্যের প্রতি এক অন্তর্মুখী আকর্ষণ নিয়ে লিখতেন। তাদের কবিতায়গ্রামীণ জীবনের নিস্তরঙ্গতা, ঋতুচক্রের আবর্তন এবং মানব অনুভূতির শান্ত রূপকে তুলে ধরা হতো। এই ধারার একটি বৈশিষ্ট্য ছিল যুদ্ধপূর্ব ইংল্যান্ডের এক আদর্শায়িত ছবি, যা অনেকাংশে ছিল বাস্তব থেকে বিচ্ছিন্ন।
কিন্তু প্রথম বিশ্বযুদ্ধ শুরু হলে, সেই আদর্শিক ও শান্তিময় কাব্যচিন্তা এক গভীর সংকটের মুখোমুখি হয়। ফ্রন্টলাইনে সরাসরি অংশগ্রহণকারী কিছু কবি, বিশেষ করে সিগফ্রিড স্যাসুন ও উইলফ্রেড ওয়েন, যুদ্ধের নিষ্ঠুর বাস্তবতা তাদের লেখায়তুলে ধরেন। তারা দেখিয়েছেন কীভাবে রক্তক্ষয়, মৃত্যুভয়, এবং যুদ্ধের নিরর্থকতা মানুষের আত্মাকে ক্ষতবিক্ষত করে। ওয়েন-এর কবিতায় “dulce et decorum est pro patria mori”-এর মতো প্রচলিত দেশপ্রেমবাদী আদর্শকে নির্মমভাবে ভেঙে চুরমার করা হয়। অন্যদিকে স্যাসুনের রচনায় স্পষ্ট হয়ে ওঠে রাষ্ট্রীয় কর্তৃত্ব ও সামরিক আদর্শের প্রতি বিদ্রোহ, যেখানে যুদ্ধকে নৈতিক বিভ্রান্তি ও বুদ্ধিবৃত্তিক প্রতারণা হিসেবে চিত্রিত করা হয়েছে।
ফলে, জর্জিয়ান যুগের কবিতার মধ্যে দেখা যায় একটি দ্বৈততা- প্রথমদিকে প্রাক-যুদ্ধকালীন এক নান্দনিকতায় আবিষ্ট রোমান্টিকতা, আর পরবর্তীকালে যুদ্ধের অভিজ্ঞতা থেকে উৎসারিত বাস্তবধর্মী ও প্রখর সামাজিক সচেতনতা। এই রূপান্তর কেবল জর্জিয়ান কবিদের মধ্যেই সীমাবদ্ধ ছিল না, বরং তা ইংরেজি সাহিত্যের পরবর্তী আধুনিকতাবাদী ধারা গঠনে এক গুরুত্বপূর্ণ ভিত্তি স্থাপন করেছিল। যুদ্ধ-পরবর্তী কবিতায় ভাষার নির্মোহতা, অনুভবের তীব্রতা এবং বাস্তবতার প্রতি এক গভীর অনুরাগ দেখা যায়, যা পরবর্তীকালে টি. এস. এলিয়ট, অ্যাজরা পাউন্ড প্রমুখ আধুনিক কবিদের লেখায় নতুন রূপে বিস্তার লাভ করে।
এইভাবে, জর্জিয়ান কবিদের কবিতা এক ঐতিহাসিক ধাপে দুই বিপরীত চেতনার- নান্দনিক রোমান্টিকতা ও নির্মম বাস্তবতার এক প্রগাঢ় মিথস্ক্রিয়া হিসেবে বিবেচিত হয়। তাদের রচনাগুলি কেবল একটি যুগের সাহিত্যিক প্রবণতার পরিচয় বহন করে না, বরং একটি জাতির ঐতিহাসিক চেতনাপরিবর্তনের সাক্ষ্যও রেখে যায়।
৮. ইম্যাজিজম-এর চপলতা: ইম্যাজিজম-এর চপলতা তার সংক্ষিপ্ততা ও তীক্ষè চিত্রভাষার মধ্যে নিহিত, যা এক ঝলকে পাঠকের সামনে জীবন্ত দৃশ্য তুলে ধরে। এই কাব্য আন্দোলনের কেন্দ্রীয় চরিত্রদের মধ্যে অন্যতম ছিলেন এজরা পাউন্ড, যিনি তাঁর “In a Station of the Metro” কবিতায় ইম্যাজিজমের চূড়ান্ত প্রকাশ ঘটান। এই কবিতা মাত্র দুটি লাইনের, তবুও এতে একটি সম্পূর্ণ অনুভব, মুহূর্ত এবং দৃশ্যের এক নিখুঁত সংমিশ্রণ ঘটেছে:
“The apparition of these faces in the crowd; / Petals on a wet, black bough.”
এই লাইন দু’টির মধ্য দিয়ে আমরা বুঝতে পারি কীভাবে ইম্যাজিজম শব্দকে ব্যয় না করে অনুভব প্রকাশের পথে এগোয়। “Apparition” শব্দটি ব্যবহার করে পাউন্ড কেবল ভিড়ের মধ্যে কিছু মুখ নয়, বরং একরকম অতিলৌকিক বা ক্ষণিক জাগরণীয় উপস্থিতির ইঙ্গিত দেন। এই মুখগুলো যেন হঠাৎ আবির্ভূত হয় এবং আবার মিলিয়ে যায়- ঠিক যেমন স্বপ্নের মাঝে দেখা কোনো ক্ষণিক দৃশ্য।
এরপর তিনি এই মুখগুলোর তুলনা করেন “পাঁপড়ির” সঙ্গে, যা রয়েছে “ভেজা, কালো ডালে”। এই তুলনাটির মাধ্যমে একটি নগরজীবনের ঠা-া, স্যাঁতসেঁতে পরিবেশ এবং সেই পরিবেশে মানুষের অস্তিত্বের ক্ষণিক সৌন্দর্য অত্যন্ত সূক্ষ্মভাবে প্রতিফলিত হয়। মুখগুলোর কোনো আলাদা বৈশিষ্ট্য নেই, কিন্তু তাদের একত্র উপস্থিতি একটি নান্দনিক গঠন তৈরি করে- যেভাবে ডালের ওপর জমে থাকা পাঁপড়িগুলিও স্বতন্ত্র নয়, কিন্তু সম্মিলিতভাবে এক চিত্ররূপ গঠন করে।
এই কবিতাটি কেবল দৃশ্যের নয়, সময়েরও এক রূপায়ণ। এটি একটি চিত্রকল্প, যা পাঠককে স্থির করে দেয় এক মুহূর্তে। আর এখানেই ইম্যাজিজম-এর “চপলতা” বা fleeting nature-এর সৌন্দর্য নিহিত। এটি চায় না ব্যাখ্যা করতে, চায় দেখাতে; এটি পাঠকের উপর বিশ্বাস রাখে যে, সে নিজেই এই ক্ষণিক চিত্র থেকে ব্যঞ্জনা ও অনুভূতির অর্থ অনুধাবন করতে পারবে।
পাউন্ড নিজে বলেছিলেন, “Go in fear of abstractions” অর্থাৎ বিমূর্ততার ভয় করো। এই কাব্যদৃষ্টিভঙ্গি অনুসারে শব্দ নয়, চিত্রই মূল। এই চিত্রকে তিনি গঠন করেন ধ্বনি, রূপক, এবং ছাঁটছাঁট করে কাটা বাক্য গঠনের মধ্য দিয়ে। তিনি কাব্যকে একধরনের রূপহীন সংগীত বা চিন্তার প্রবাহ থেকে ফিরিয়ে এনে এক নিখুঁত দৃশ্যকলায় রূপ দিতে চেয়েছিলেন, যেখানে প্রতিটি শব্দের অবস্থান জরুরি, প্রতিটি অনুপস্থিত শব্দেরও তাৎপর্য রয়েছে।
“In a Station of the Metro” আধুনিকতাবাদী কবিতার একটি মাইলফলক, যেখানে নগর জীবনের বিশৃঙ্খলার মধ্যে থেকে খুঁজে নেওয়া হয় একরকম শান্ত, সূক্ষ্ম এবং গূঢ় সৌন্দর্য। এটি ইম্যাজিজমের স্বরূপকেই সংজ্ঞায়িত করে: সংক্ষিপ্ত অথচ গভীর; চপল অথচ স্থায়ী; দৃশ্যমান অথচ অনুভবযোগ্য।
৯. বিশেষ আলোচ্য কবিগোষ্ঠী: টিএস এলিয়ট, ডব্লিউবি ইয়েটস-আধুনিক কবিতার দুই অনন্য পুরুষ, যাদের সৃজনশীল কাব্যভাষা ও দার্শনিক অভিসরণ আধুনিকতাবাদের ভিত্তিকে সুসংহত করেছে। তাঁদের কাব্যকর্ম শুধু সময়ের নিরিখে প্রগতিশীল নয়, বরং ঐতিহ্য, ইতিহাস, সংস্কৃতি এবং আত্মপরিচয়ের অনুসন্ধানে ব্যাপৃত এক গভীর মননের প্রতিফলন। এই দুই কবির কবিতায় আমরা মেটাফিজিকাল কবিতার এক নবতর রূপ দেখতে পাই—যা ১৭শ শতকে John Donne, George Herbert প্রমুখ কবির হাতে গঠিত হলেও আধুনিক যুগে এলিয়ট ও ইয়েটসের হাতে পুনর্জন্ম লাভ করে।
এলিয়ট-এর “The Waste Land” বা “Four Quartets” কাব্যগ্রন্থে আমরা মানব অস্তিত্বের মৌলিক প্রশ্ন, সময়ের রহস্য এবং ঈশ্বর ও চেতনার দ্বান্দ্বিক অনুসন্ধান প্রত্যক্ষ করি। তাঁর কবিতায় একদিকে যেমন ক্লাসিক্যাল ও বাইবেলীয় অলংকার রয়েছে, তেমনি রয়েছে আধুনিক মানুষের সংকট, ভগ্নতা ও নৈরাশ্য- যা আধুনিকতাবাদের অন্যতম বৈশিষ্ট্য। Eliot-এর কবিতায় যে ঐতিহাসিক চেতনা, তা শুধু পা-িত্যপ্রসূত নয়, বরং মানব সভ্যতার চলমান ধারা ও তাৎক্ষণিক অভিজ্ঞতার মধ্যে যোগসূত্র স্থাপন করে। তার ভাষা দার্শনিক, অলঙ্কারিক এবং টেক্সচুয়াল অনুষঙ্গে ভারসাম্যপূর্ণ- যা মেটাফিজিকাল কবিতার ঐতিহ্যকে নতুন মাত্রায় উপস্থাপন করে।
অপরদিকে, Yeats ছিলেন প্রাক-আধুনিক কবিতা থেকে আধুনিকতার দিকে যাত্রার সেতুবন্ধন। তাঁর প্রাথমিক কবিতায় আইরিশ পৌরাণিক কাহিনি ও রোমান্টিক কল্পনার ছায়া থাকলেও পরবর্তীকালে তাঁর কাব্যে দার্শনিক ও প্রতীকপ্রবণ চেতনার অনুপ্রবেশ ঘটে। “The Second ComingÓ, ÒSailing to Byzantium” বা “Among School Children”-এর মতো কবিতায় ইয়েটসএমন এক বোধধর্মী বিশ্বচিন্তার অবতারণা করেন, যেখানে মানবজীবন, শিল্প, রাজনীতি ও চিরন্তন সত্যের অন্বেষণ একসূত্রে গাঁথা থাকে। তাঁর কবিতা একদিকে যেমন রূপক ও প্রতীক ব্যবহারে কাব্যালঙ্কৃত, তেমনি অন্যদিকে আত্মদর্শন ও মেটাফিজিক্স-এর গূঢ় অনুসন্ধানে নিবিষ্ট।
এই দুই কবির কাজেই মেটাফিজিকাল কবিতার পুনরুজ্জীবন ঘটেছে, তবে তা কেবল ছন্দ ও অলংকারের পুনরাবৃত্তি নয়- বরং আত্মজিজ্ঞাসা, সময়চেতনা ও ঐতিহ্যের পুনর্বিন্যাসের মাধ্যমে। তাঁরা আধুনিক কবিতাকে শুধু রূপে নয়, ভাবেও গূঢ়তা ও গভীরতায় সমৃদ্ধ করেছেন। এলিয়ট ও ইয়েটস-এর কাব্যভুবন সেই অর্থে হয়ে উঠেছে এক অন্তর্জগতে প্রবেশের দ্বার, যেখানে প্রশ্ন থাকে, উত্তর থাকে না; ব্যাখ্যা থাকে, তবু রহস্য থেকেই যায়- আর এটাই মেটাফিজিকাল কবিতার মূল অনুষঙ্গ। তাই বলা যায়, এই দুই কবি আধুনিক কবিতার নির্মাতা-পুরুষ হয়েও সময়ের অতীত, বর্তমান ও ভবিষ্যতের মধ্যে এক নান্দনিক, দার্শনিক ও চেতনাগত সেতুবন্ধন তৈরি করেছেন, যা বিশ্বসাহিত্যে তাঁদের স্থায়ী আসন নিশ্চিত করেছে।
(বাকি অংশ আগামী সংখ্যায়)
অর্থ-বাণিজ্য: নির্বাচনের প্রার্থীদের জন্য শনিবার সব ব্যাংক খোলা থাকবে