ধারাবাহিক ভ্রমণ কাহিনী-২৩
চৌধুরী সালাহউদ্দীন মাহমুদ
(পূর্ব প্রকাশের পর)
শিল্প-সাহিত্যের চার নক্ষত্রের আবর্তন একই সাথে হচ্ছিল বার্সেলোনার কক্ষপথে। এর মধ্যে লোরকা ও গাউদিকে কিছুটা জানার সুযোগ পেয়েছি। আজ দেখব পিকাসোকে, সময় হলে দালিকেও।
তবে পিকাসোকে দেখার শুরু তাঁর জন্মস্থান মালাগা থেকে। তখন শুনেছিলাম তাঁর সেরা কাজগুলি আছে বার্সেলোনায়। ভাবলাম এখানে তাঁর মিউজিয়মে যাব।
নাতাশার ইচ্ছে, যাওয়ার পথে ‘সারদানা’ দেখবে, যা অনুষ্ঠিত হবে বার্সেলোনা ক্যাথেড্রালে সকাল ১১ টায়। বললাম, ‘সারদানা ব্যাপারটি কী? এটি দেখার আগে অন্তত তা জানতে হবে।’ সে বলল,‘এটি হলো কাতালানদের ঐতিহ্যবাহী জাতীয় নৃত্য। সারদানা দেখা ছাড়া আমাদের কাতালুনিয়া সফর পূর্ণ হবে না।’
ঠিক আছে, এটি আর অপূর্ণ থাকবে কেন?
বার্সেলোনার পুরনো এলাকা বারি গথিকে বার্সেলোনা ক্যাথেড্রাল; লা রাম্বলায় আমাদের হোটেল থেকে হেঁটে যেতে ১৫ মিনিটের মতো লাগবে। তাই হেঁটেই রওয়ানা দিলাম।
বারি গথিক হলো বার্সেলোনার জন্মস্থান। রোমানরা এখানে শহরটির পত্তন করে। এরপর ক্রিষ্টান ও ইহুদীরা এখানে তাদের বসতি স্থাপন করে, উপসনালয় নির্মাণ করে। নিজেদের নিরাপদ করতে তারা এর চারপাশে দেয় প্রতিরক্ষা দেয়াল। ১৮৫০ সাল পর্যন্ত বার্সেলোনাবাসী এ দেয়ালের মধ্যেই বাস করছিল। এরপর ঘটে শহরের বিস্তার।
বারি গথিক এলাকার সরু ও সর্পিল রাস্তা এবং পুরনো ঘরবাড়ি দেখতে দেখতে আমরা বার্সেলোনা ক্যাথেড্রাল পৌঁছে গেলাম। এর সামনের চত্বরে সারদানা নৃত্যের প্রস্তুতি শুরু হয়েছে। অনেক লোকজনও জমেছে, বেশিরভাগ নাচতে, কেউ কেউ দেখতে। দর্শকদের মাঝে দাঁড়াতেই নৃত্য দলের একজন আমাদেরকে বলল তাদের নাচে যোগ দিতে। এটি নারী-পুরুষ-শিশু-বৃদ্ধ সবাইর জন্য উম্মুক্ত। নাতাশা যেহেতু নাচতে পারে, সে সানন্দেই তাদের সাথে যোগ দিল। এরপর নাবিলও তাকে অনুসরণ করল।
ক্যাথেড্রাল এর বিরাট খোলা চত্বর। তার মাঝখানে ‘কবলা’ নামে পরিচিত ১১ জনের এক অর্কেষ্টা দল শুরু করল তাদের বাজনা। সে বাজনার সাথে তাল মিলিয়ে চারপাশে সবাই হাতে হাত রেখে একটি বলয়ে নাচতে লাগল- আস্তে আস্তে, দুলে দুলে, ঘুরে ঘুরে। নাচ ও বাজনায় সবদিকে সৃষ্টি হলো এক আনন্দের আবহ। থেমে থেমে তা চলল দুই ঘন্টার কাছাকাছি।
‘সারদানা’শেষ হতেই পরিচিত হলাম এ অর্কেষ্টা দলের প্রধান এলিজা হেরাদা-র সাথে। তিনি এত সুন্দরী ও প্রাণবন্ত যে বয়স বোঝার কোনো উপায় নেই। বললেন,‘সঙ্গীতের অধ্যাপনা থেকে অবসর নিয়ে প্রতি রোববার এ অর্কেস্টা পরিচালনা করি আনন্দ, আর কাতালান সংস্কৃতিকে বাঁচিয়ে রাখার জন্য। ‘সারদানা’ নাচ কাতালান জনগণের ঐক্যের প্রতীক।’ জনগণ ও ঐক্য- এ শব্দ দুটি রাজনীতিবিদদের প্রিয় শব্দ- তাই এতে রাজনীতির গন্ধ পেলাম। ভেবেছিলাম এ প্রসঙ্গ তুলব না। তবে বাঙালি হয়ে রাজনীতি আলাপ করব না, তাতো হয় না। তাই জিজ্ঞেস করেই ফেললাম, ‘তোমরা স্পেন হতে কি সত্যিই আলাদা হতে চাও?’ উনি অকপটে বললেন,‘হ্যাঁ, অবশ্যই। দেখ, রাজনীতির চেয়েও এর বড় কারণ সংস্কৃতি। কাতালান ভাষা, সংস্কৃতি, ঐতিহ্য সব বাকি স্পেন থেকে আলাদা। তাছাড়া এখানে রাজনীতিও চলে আসে।’ একটু থেমে আবার বলা শুরু করলেন,‘বার্সেলোনা সবসময় খুবই উদার ও মানবিক। তাই স্পেনের গৃহযুদ্ধের সময় এ শহরবাসীর সমর্থন ছিল প্রজাতন্ত্রীদের প্রতি। বিপরীত পক্ষ ফ্রানকোর বাহিনি বার্সেলোনা ও কাতালুনিয়ার অন্যান্য জায়গায় নির্মম দমননীতি চালায়। তাদের জয়ের পর সেটি আরো বেড়ে যায়। স্পেনীয় একনায়ক ফ্রাঙ্কো তাঁর ৩০ বছরের শাসনামলে কাতালান ভাষা ও সংস্কৃতি মুছে ফেলার চেষ্টা করেছেন, তবে পুরোপুরি সফল হতে পারেননি।’ বললাম, ‘দেখ, আমাদেরও একই রকম অভিজ্ঞতা রয়েছে। আমাদের ভাষা ও সংস্কৃতিকে অবদমিত করার চেষ্টা করা হয়। মূলত তার বিরুদ্ধে প্রতিবাদ থেকেই শুরু হয় আমাদের দেশের মুক্তিযুদ্ধ এবং পরিণতিতে স্বাধীনতা।’ এলিজা হেরাদা সবশেষে বললেন শান্ত, কিন্ত দৃঢ়কণ্ঠে,‘কাতালুনিয়া স্বাধীন হবেই। এটি সময়ের ব্যাপার মাত্র’। বললাম, ‘আমরা ফিরে আসব তোমাদের স্বাধীন কাতালুনিয়া দেখতে। তোমাদের জন্য থাকল আমাদের ভালবাসা।’ এলিজা মৃদু হেসে, কিন্তু করুণকণ্ঠে বললেন,‘ধন্যবাদ! তবে আমার জীবনকালে মনে হয় সে স্বাধীনতা দেখব না।’ নাতাশা তাঁকে জড়িয়ে ধরে বলল,‘আমাদের প্রার্থনা: তুমি বেঁচে থাকবে, স্বাধীন কাতালুনিয়া দেখবে।’ এলিজা হেরাদা বুকে ক্রশ এঁকে বললেন,‘ঈশ্বর তোমার প্রার্থনা গ্রহণ করুন। আমেন!’ আমরাও একই সাথে বললাম,‘আমেন।’
সামনেই বিশাল ও সুন্দর বার্সেলোনা ক্যাথেড্রাল-এ শহরের ইতিহাসের প্রতিচ্ছবি। ২০০০ বছর ধরে এটি বার্সেলোনাবাসীর প্রধান উপাসানালয়। প্রথমে রোমানরা এখানে নির্মাণ করে জুপিটারের মন্দির। ৩৪৩ সালে সেটি সরিয়ে নির্মাণ করা হয় খ্রিস্টান এক ক্যাথেড্রাল। ১০০০ সালের দিকে তা সরিয়ে নির্মিত হয় এক রোমানেস্ক শৈলীর ক্যাথেড্রাল। তবে আরো পরে, কাতালান জাতির স্বর্ণযুগে, ১৩০০ সালের দিকে বর্তমান গথিক স্থাপত্যের কাজ শুরু হয় এবং তা শেষ হয় ১৪৫০ সালে। সবশেষে, ক্যাথেড্রালের নতুন ফসাদ তৈরি করা হয়‘কাতালান মদারনিসমা’-র নব্য-গথিক শৈলীতে, কাজ শুরু হয় ১৮শ শতাব্দীতে, বার্সেলোনার পুনর্জীবনের সময়কালে। কাজটি শেষ হয় ১৯১৩ সালে। বার্সেলোনা ক্যাথেড্রাল এর চেহারা বদলেছে বার্সেলোনা শহরের ভাগ্যের সাথে সাথে, ইতিহাসের অমোঘ নিয়মে।
আমার খুব আগ্রহ এ ঐতিহাসিক ক্যাথেড্রালটির ভেতরেও দেখার। তবে নাতাশা বলল, ‘আমাদের হাতে বেশী সময় নেই। ২টার সময় আমাদের পিকাসো মিউজিয়মে ঢুকতে হবে, আর আছে মাত্র ৩৫ মিনিট।’ নাবিল বলল,‘তার আগে আমাদের লাঞ্চ করতে হবে। আমি ভাল একটি রেস্টুরেন্ট সার্চ করি।’ বললাম, ‘এখন রেস্টুরেন্টে বসে খাওয়ার সময় হবে না। এখান থেকে মিউজিয়মে হেঁটে যেতে লাগবে ১৫ মিনিট, আর খেতেও হবে। মাঝখানে কোন স্ট্রিট ফুড খেয়ে নেব।’ এখানে সব জায়গায় টাটকা বানানো গরম স্ট্রিট ফুড পাওয়া যায়। তার মধ্যে শরমা এরা খুব পছন্দ করে। এটি রুটির মধ্যে মোড়ানো মাংসের কাবাব ও সালাদ, সাথে হট সস। তাই খেয়ে নিলাম সবাই।
পাবলো পিকাসো মিউজিয়মের দিকে যাচ্ছি বার্সেলোনার পুরনো এলাকার ভেতর হেঁটে হেঁটে- এখানেই অলিতে গলিতে একা একা ঘুরে বেড়িয়েছেন পিকাসো তাঁর ১৪ থেকে ২৩ বছর বয়সকালে, আর ছবি আঁকা রপ্ত করেছেন। পিকাসোর স্মৃতি-মাখা এলাকা দেখতে দেখতে তাঁর মিউজিয়মে পৌঁছে গেলাম।
ধীরে সুস্থে দেখব বলে টিকেটে গাইডেড ট্যুর যোগ করিনি। তবে আমি এদের নির্ধারিত রুট ম্যাপ নিলাম, যেখানে পিকাসোর শিল্পী জীবনের উত্তরণ দেখানো হয়েছে বিভিন্ন কক্ষে- বিস্ময় বালক, প্রতিভার উন্মোচন, প্রথমদিকের সাফল্য, বার্সেলোনা স্বাধীনতা, প্যারিস, ব্লু পিরিয়ড, রোজ পিরিয়ড, কিউবিজম, বার্সেলোনা প্রত্যাবর্তন, পিকাসো ও ভেলাসকাস, শেষ বছরসমূহ। একজন শিল্পীর আঁকা এত বিশাল সংগ্রহ। আরো অনেক জাদুঘরেও আছে পিকাসোর আঁকা বহু ছবি, আর আছে সারা পৃথিবীতে ব্যক্তিগত সংগ্রহে। একজন শিল্পী এক জীবনে এতগুলো ছবি এঁকেছেন, চিত্রশিল্পে সীমিত ধারণা নিয়েও ভাবতে থাকি, কি বিশাল পাবলো পিকাসো-র প্রতিভা।
গাইড বই দেখে দেখে মিউজিয়ম ঘুরছি আর ছবি দেখছি। এর মধ্যে দেখা হয়ে গেল নাবিল, নাতাশা ও ফারজানার সাথে। দেখি, এক ছবির দিকে তারা খুব নিবিড়ভাবে তাকিয়ে আছে, আর ফিসফিসিয়ে আলাপ করছে। তারা সবসময় অভিযোগ করে যে আমি সব জায়গায় খুব চড়া গলায় কথা বলি। আমি পাশে দাঁড়ালেও কেউ দেখি কথা বলছে না। যাক, অন্তত দেখি কোন ছবিটি দেখে তাদের এত আগ্রহ। এটি হলো পিকাসোর বিখ্যাত ছবি ‘Science and Charity’। আগে এ ছবিটির প্রিন্ট দেখেছি, আজ আসল ছবিটিই দেখছি। এ দুটি দেখা ও উপলদ্ধির কত পার্থক্য। পিকাসোর আঁকা কিম্ভুদকিমাকার সব ছবি দেখে দেখে আমাদের ধারণা হয়ে গিয়েছিল যে তিনি শুধু সেরকম ছবিই এঁকেছেন। সামনের ছবিটি কত মানবিক, কত বাস্তব, কত জীবন-ঘনিষ্ঠ।
সত্যিই এক অসাধারণ ছবি ‘Science and Charity’। মনে হয় ছবি নয়, বাস্তবের ৩ জনকে দেখছি সামনে- একজন রোগী শায়িতা বিছানায়, তাঁকে দেখছেন পাশের চেয়ারে বসে ডাক্তার, বিছানার অপর পাশে দাঁড়িয়ে আছেন নার্স। একজন শুয়ে আছেন জীবনের শেষ প্রান্তে, তাঁকে বাঁচানোর যুদ্ধ করছেন দুজন। ডাক্তার হলেন Science এর প্রতীক, আর নার্স Charity¡ এর। ডাক্তারের মডেল ছিলেন পাবলো পিকাসোর বাবা। এখানে পিকাসো খুব বাস্তবধর্মী প্রতীক ব্যবহার করেছেন। তিনি এটি এঁকেছেন ১৮৯৭ সালে, যখন চলছিল ৯০ শতকের শেষ দিকের সামজিক বাস্তববাদ আন্দোলন।
আরো অনেক বিখ্যাত ছবি আছে। নাবিল ও নাতাশা সেসব আর দেখবে না। যাক, অন্তত একটি ছবি ভাল লাগার অনুভূতি নিয়ে তারা ফিরতে পারবে। মালাগার পিকাসো মিউজিয়ম থেকে বের হয়ে এসে তারা বলেছিল, পিকাসোর ছবি বোঝা খুব কঠিন। আজ সে কথার পুনরাবৃত্তি হলো না। এটি আজকের ছবি দেখার সার্থকতা।
তবে আমার তো ছবি দেখা এখনো শেষ হয়নি। তাদেরকে বললাম, ‘তোমরা ক্যান্টিনে যেয়ে অপেক্ষা কর। কিছু ¯œ্যাকসও খেতে পার। আমি আরো কিছু ছবি দেখে তোমাদের সাথে যোগ দেব।’
ঘন্টখানেক পরে নাবিল বলল, ‘আর্ক দে থ্রিয়াম্প’ দেখবে। ম্যাপে বের করল, হেঁটে যেতে লাগবে ২০ মিনিট। যাওয়া যাক।
‘আর্ক দে থ্রিয়াম্প’ দেখেছিলাম প্যারিসে আমি ও ফারজানা ১৯৯৪ সালে জুলাইতে। একই নামের, ও অনেকটা একই ডিজাইনের আর একটি আর্ক যে বার্সেলোনায় আছে তা জানতাম না।
পিকাসো মিউজিয়ম থেকে নাবিলকে অনুসরণ করে আসলাম ‘পার্ক দে লা সিওয়াদেইয়া’ নামক এক সুন্দর পার্কে। নাতাশা বলল, এখানে নিবিড় সবুজের মাঝে সে কিছুক্ষণ বসবে। এখানে এসে জানলাম ১৮৮৮ সালের বার্সেলোনা ইউনিভার্সেল এক্সপোজিশন অনুষ্ঠিত হয়েছিল এ পার্কটিতে। তবে একটি দুঃখজনক অতীত জেনে সবার মন খারাপ হয়ে গেল। নেপোলিয়নের স্পেন অধিকারের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করার অপরাধে ২ জন ধর্মযাজক সহ মোট ৫ জন কাতালানকে মৃত্যুদ- দেয়া হয়। ১৮০৯ সালে এই পার্কে গ্যারট-এর দ্বারা সে মৃত্যুদ- কার্যকর করা হয়। মনে পড়ে গেল গ্রানাদার সংগ্রামী নারী মারিয়েনা পিনেদাকে গ্যারট এর দ্বারা মৃত্যুদ- কার্যকর করা হয়েছিল ২৬ মে ১৮৩১ সালে, সে শহরের ‘ক্যাম্পে দেল থ্রিয়ানফো’ চত্বরে। পরে সেখানে মারিয়েনা পিনেদার স্মরণে এক মনুমেন্ট নির্মাণ করে স্থানটির নামকরণ করা হয় ‘প্লাসা দে মারিয়েনা পিনেদা’। এ সংগ্রামী নারীর নামটি সারা বিশ্বে পরিচিত করান লোরকা তাঁর ‘মারিয়েনা পিনেদা’ নাটক দিয়ে। এর মধ্যে নাতাশা সার্চ করে দেখল, যে ৫ জন কাতালান বীরের প্রাণ হরণ করা হয়েছিল এ পার্কে, তাঁদের মনুমেন্ট আছে বার্সেলোনা ক্যাথেড্রাল এর কাছে। তারা দুজনে সেটি দেখতে চায়। তাদের বললাম আগে পাশের ‘আর্ক দে থ্রিয়ম্ফ’ দেখা শেষ করতে, এর পর দেখা যাবে।
‘আর্ক দে থ্রিয়ম্ফ’ তৈরি করা হয়েছিল বার্সেলোনা ইউনিভার্সেল এক্সপোজিশন এর প্রধান ফটক হিসেবে। স্থপতি জোসেপ ভিলাসেকা এর ডিজাইন করা অসাধারণ এ স্থাপত্যে রয়েছে ইটের কাজের ওপর অনুপম অলংকরণ ও ভাস্কর্য রিলিফ। এ অনুপম স্থাপত্য দেখে সবার খুব ভালো লাগলো ।
কিছুটা হেঁটেই পেয়ে গেলাম ‘মনুমেন্ত আলস হিরোস দে লা ইনদিপেনদেনসিয়া’ ৫ জন কাতালান দেশপ্রেমিকের উদ্দেশ্যে নির্মিত মনুমেন্ট। তাঁদের মৃত্যুদ- কার্যকরী করার স্থানটি একটু আগেই দেখেছি। এখানে মনুমেন্টে তাঁদের ভাস্কর্য স্থাপিত, এর নিচে ভিত্তির ফলকে সে ৫ জন বীরের নাম লেখা আছে, সাথে আছে ‘por Dios, por la Patria, y por el Rey’। নাতাশা গুগলে বের করে ফেলল এর অর্থ: ‘ঈশ্বরের জন্য, দেশের জন্য ও রাজার জন্য’। এ বীরদের শ্রদ্ধা জানিয়ে বিষণœ মনে আমরা সে মনুমেন্ট ছেড়ে আসলাম।
আমিই ঠিক করলাম এরপরের গন্তব্যটি-‘এতেনেও বার্সেলোনেস’ বার্সেলোনার শিল্প-সাহিত্যের এক বড় কেন্দ্র। সেখানে পৌঁছে এর চমৎকার স্থাপত্য, বিশেষ করে অডিটরিয়াম দেখে সবাই খুব খুশি হলো।
এর ১৫০ বছরের ইতিহাসে অনেক গৌরবের মুহূর্ত আছে। লোরকার এক অনন্য স্মৃতি তার অন্যতম।
সেদিন ছিল ৬ অক্টোবর ১৯৩৫। ‘এতেনেও বার্সেলোনেস’ আয়োজন করেছে আসটুরিয়ান বিপ্লবের১ ১ম বার্ষিকী উদযাপনের এক অনুষ্ঠান। অডিটরিয়ামে লোরকা আবৃত্তি করছেন তাঁর কবিতা। পাশে বসে আছেন বান্ধবী ও তাঁর থিয়েটারের নায়িকা মার্গারিটা জিরগু। এটি রেডিও বার্সেলোনা সরাসরি সম্প্রচার করছে, তাদের লক্ষ্য কাতালুনিয়ার শ্রমিকশ্রেণি। সামনে রাখা আছে রেডিও মাইক্রোফোন।
লোরকা প্রথমে আবৃত্তি করলেন ‘হার্লেমের রাজা’ কবিতা:২
হা হার্লেম! হা হার্লেম! হা হার্লেম!
কোন যন্ত্রণাই নয় তোমার ওই বুকপেষা লাল, তার মতো,
তোমার ওই কালো রাহুগ্রাসের ভেতর আর্ত শিউরোনো রুধির, তার মতো,
তোমার ওই রক্তপাথরের মতো বোবাকালা ক্রোধ অর্ধালোকে, তার মতো,
ফটকরক্ষীর ঊর্দি-পরা তোমার ওই বন্দী মহান যে রাজা তার মতো।৩
এরপর লোরকা আবৃত্তি করলেন তাঁর কবিতা ‘স্পেনীয় চৌকিদারের বালাদ’:
কালো কালো আঁধুলিয়া ঘোড়া।
কালো কালো নাল পরা পায়ে।
জামায় জ্বলছে লোকগুলোর
মোম আর কালির কষ দাগ।
মাথার খুলি যেন সীসে গড়া,
তাই ওরা কাঁদে না, কোনদিনও।
রাতপাওয়া, কুঁজ পিঠে পিঠে,
যেখানেই নাড়া দিয়ে যায়
রবার স্তব্ধতার কালো আর
মিহি, বালিচুরো সন্ত্রাসের
হুঙ্কার জাগিয়ে যায় যেন।৪
লোরকার আবৃত্তি অনুষ্ঠানে সেদিন এত জনসমাগম হয়েছিল যে, অডিটরিয়ামে সবার জায়গা হয়নি। এদের মধ্যে অনেক শ্রমজীবী মানুষ ছিল। তাদের জন্য হলের বাইরে লাউড স্পিকার যোগ করা হয়েছিল, যাতে তারা লোরকার আবৃত্তি শুনতে পারে।
আবৃত্তি শেষ হলে সবদিকে লোরকাকে লক্ষ্য করে স্লোগান: ‘জনগণের কবি দীর্ঘজীবী হোন।’ এরপর সবাই লাইন ধরে ঘণ্টাখানেকের বেশি সময় অপেক্ষা করল লোরকার সাথে হাত মেলানোর জন্য।
লোরকা এতে খুবই অভিভূত হয়েছিলেন। তাই মন্তব্য করেন যে, তাঁর কবিতা নিয়ে প্রশংসামুখর এত মানুষের ভিড় তিনি আর কোন সময় দেখেননি।
‘এতেনেও বার্সেলোনেস’ থেকে বের হওয়ার সময় ভাবছিলাম শ্রমজীবী মানুষের জন্য লোরকার অকৃত্রিম দরদের কথা।
এবার লোরকার স্মৃতিধন্য ‘দালমাউ গ্যালারী’ দেখা যেতে পারে। বন্ধু সালভাদর দালি-র উৎসাহে লোরকা ১৯২৭ সালের ২৫ জুন থেকে ২ জুলাই এ গ্যালারীতে তাঁর ২৪ টি ড্রইং নিয়ে এক প্রদর্শনীর আয়োজন করেন। একসময় ‘দালমাউ গ্যালারী’ বিশ্বের শিল্প জগতে খুবই পরিচিত ছিল। খবর নিয়ে দেখি, বহু বছর আগে গ্যালারীটি বন্ধ হয়ে গেছে। দুর্ভাগ্য!
সবাই ঠিক করল এবার একটু মজার কোনো জায়গায় যাবে। আমি “এলস কোয়ার্থে গাথস” এ ডিনার করার প্রস্তাব করলাম। নাবিল চট করে গুগলে রেটিং দেখে নিয়ে বলল, ‘রেটিং খুব ভাল, কিন্ত অনেক এক্সপেন্সিভ।’ বললাম,‘রেটিং ভাল হলে তো এক্সপেন্সিভ হবেই’। সবাই একমত হওয়ার পর সেখানে ডিনারের রিজার্ভেশন দেয়া হলো। এরপর টেক্সি করে রওয়ানা দিলাম সেখানে।
এলস কোয়ার্থে গাথস-এর প্রবেশ পথে দেখি একটি চিত্রকর্ম, যার ওপরে লেখা 4Cats। পরে জানলাম নামটি এলস ‘কোয়ার্থে গাথস’এর ইংরেজি অনুবাদ, এ নামেও এটি পরিচিত। আর চিত্রকর্মটি পিকাসো এঁকেছিলেন রেস্তোরাঁটির মেনু বইয়ের প্রচ্ছদ পৃষ্ঠা হিসেবে। ১৭-বছর বয়সের পিকাসো বার্সেলোনা এসে এখানকার শিল্পী-সাহিত্যিকদের সবচেয়ে বড় আড্ডার স্থান খুঁজে পেতে দেরি করেননি। আর এই এলস কোয়ার্থে গাথস-এর হলে জীবনের প্রথম চিত্র প্রদর্শনীতে প্রদর্শিত হয়েছিল তাঁর চারকোল ও জলরঙের ২৫টি পোর্ট্রটে।
রেস্তোরঁিটির দেয়ালে অনেক শিল্পকর্ম। তা দেখতে দেখতে অর্ডার দিলাম কাতালুনিয়ার ঐতিহ্যবাহী খাবার কাপিপোতা আ লা কাতালানা, যা মূলত বিফ স্টু। সাথে কমলার তাজা রস।
ডিনার শেষ করে ম্যানেজার মিগেল রিকোকে বললাম, রেস্তোরঁিটি একটু ঘুরে দেখতে চাই। উনি খুশি হয়ে নিজেই ঘুরে দেখালেন। বললেন, ‘বিখ্যাত মডার্নিস্ট ভবন কাসা মার্টির নিচতলায় ১২ জুন ১৮৯৭ সালে রেস্তোরঁিটি খোলা হয়। এর পর থেকে এটি পরিণত হয় বার্সেলোনার শিল্প-সাহিত্য জগতের সবচেয়ে প্রতিভাবানদের মিলন মেলায়। মদারনিসমা সময়ের বিখ্যাত সবাই এখানে এসেছেন বারবার। এখনও এ ধারা অব্যাহত আছে।’ জিজ্ঞেস করলাম, ‘লোরকা কি এখানে এসেছিলেন? তাঁর কোনো স্মৃতিচিহ্ন কি এখানে আছে?’ মিগেল বললেন, ‘হ্যাঁ! লোরকা এসেছেন একবার নয়, বহুবার। তিনি এখানে ঢুঁ মারতেন বার্সেলোনা আসলেই । এখানে নিয়মিত আরো আসতেন আন্তনি গাউদি, সালভাদর দালি ও পাবলো পিকাসো। দুঃখিত, পিকাসো ছাড়া আর কারো স্মৃতিচিহ্ন নেই।’ বললাম, ‘এটি চার নক্ষত্রের আরেকটি মিলন ক্ষেত্র- এখানে রয়েছে তাদের মিলিত স্মৃতি। তাই রেস্তোরাঁটির নাম৪ঈধঃংসার্থক হয়েছে।’ মিগেল হেসে বললেন,‘তবে নামটি এদের উদ্দেশ্যে হয়নি। এর অন্য ইতিহাস আছে।’ একটু হেসে, মজা করে বললাম,‘ইতিহাসটি আরেকদিন সময় করে, মজা করে শুনবো। এখন আপনাদের হল ঘরটি কি দেখতে পারি?’
দেখলাম সে হলঘরটি যেখানে পাবলো পিকাসোর চিত্রকর্মের প্রথম প্রদর্শনী হয়েছিল। কল্পনা করলাম এ হলে লোরকাও এসেছেন, করিডোরে বসে আড্ডা দিয়েছেন, আর আমরা যেখানে ডিনার করেছি তার আশেপাশে বসে তিনিও লাঞ্চ ডিনার করেছেন।
বার্সেলোনায় আমাদের শেষ দিনটি লোরকার স্মৃতিধন্য বিশেষ কোন জায়গায় শেষ করতে চাইলাম। তাই বেছে নিলাম ‘থ্রিয়েথ্রো গয়া’, লা রাম্বলার কাছেই, সবাই গেলাম সেখানে। মাঝারি আকারের এক থিয়েটার হল, মূলত নাটকের মঞ্চায়ন হয় এখানে। ২৪ জুন ১৯২৭ এর রাতে এখানে এক নাটক মঞ্চায়িত হওয়ায় এ হলটি বিখ্যাত হয়ে আছে। নাটকটি ছিল লোরকার, ট্র্যাজেডি নাটক ‘মারিয়ানা পিনেদা’, সেদিন ছিল এর শুভ মহরত।৫
মারিয়ানা পিনেদা নাটকটি শুরু ও শেষ হতো লোরকা-রচিত নীচের গান দিয়ে:
কি এক দুঃখের দিন গ্রানাদায়
পাথরগুলো কান্না শুরু করেছে
মারিয়ানার মৃত্যু দেখে
সে যে আর কথা বলবে না।৬
থ্রিয়েথ্রো গয়া-র মঞ্চে যেন এখনো শুনতে পাচ্ছি এ গান, সাথে মারিয়ানা পিনেদা-র শেষ সময়ের নীরব কান্না। ক্রমশ...
সূত্র
১. আসটুরিয়ান বিপ্লব: এটি ছিল ১৯৩৪ সালে সংঘটিত উত্তর স্পেনের অ্যাসটুরিয়া অঞ্চলের একটি সমাজতান্ত্রিক বিদ্রোহ যা সরকার কঠোরভাবে দমন করে। পরবর্তীতে ১৯৩৬ সালে শুরু হওয়া স্পেনীয় গৃহযুদ্ধের এটি একটি বড় কারণ।
২. Lorca: a dream of life by Leslie Stainton, page 405।
৩. El rey de Harlem: অনুবাদ: দেবীপ্রসাদ বন্দ্যোপাধ্যায়
৪. Romance de la Guardia Civil Espanola:স্পেনীয় চৌকিদারের বালাদ: অনুবাদ: দেবীপ্রসাদ বন্দ্যোপাধ্যায়
৫. ‘থ্রিয়েথ্রো গয়া’-তে মঞ্চস্থ হওয়া Mariana Pineda (মারিয়ানা পিনেদা) নাটকটির নির্দেশনায় ছিলেন স্বয়ং লোরকা, আর তার মঞ্চসজ্জা ও পরিচ্ছদ পরিকল্পনায় ছিলেন সালভাদর দালি। প্রধান চরিত্রে অভিনয় করেছেন মার্গারিটা জিরগু। ‘থ্রিয়েথ্রো গয়া’-তে এ নাটকটির বহু সপ্তাহ ধরে দর্শক পরিপূর্ণ প্রদর্শনী ছিল। ১৯২৩-২৫ সালে লিখিত ‘মারিয়ানা পিনেদা’ ছিল লোরকার কোন নাটকের প্রথম সফল মঞ্চায়ন। লোরকার প্রথম মঞ্চ নাটক ছিল El maleficio de la mariposa (এল মালেফিসিও দে লা মারিপোসা), যার শুভ মহরত হয়েছিল ২২ মার্চ ১৯২০ সালে মাদ্রিদের ‘থ্রিয়েথ্রো এসলাভা’-তে । দর্শকদের সাড়া না পাওয়ায় মাত্র ৪টি প্রদর্শনীর পর এটি আর মঞ্চস্থ হয়নি।
১২ অক্টোবর ১৯২৭ সালে মাদ্রিদের ‘থ্রিয়েথ্রো ফনথালবা’-তে মারিয়ানা পিনেদা-র শুভ মহরত হয়। মাদ্রিদ্রে এ নাটকটি বিপুল সফলতা পায়।
লোরকার নিজ শহর গ্রানাদায় নাটকটির মঞ্চায়ন শুরু হয় ২৯ এপ্রিল ১৯২৯ সালে ‘প্লাসা দে মারিয়েনা পিনেদা’-এর পাশের ‘থ্রিয়েথ্রো সারভেন্তাস’-এ। পরের সপ্তাহে স্থানীয় হোটেল আলহাম্বরা প্যালেসে গ্রানাদায় নাটকটির শুভ মহরত উপলক্ষে মার্গারিটা জিরগু ও লোরকার সম্মানে এক সংবর্ধনা সভার আয়োজন করা হয়। সেখানে এক বক্তৃতায় লোরকা বলেন, ‘আমার নাটক অত্যন্ত দুর্বল, যেন একজন শিক্ষানবিশের কাজ। যদিও এতে আমার কিছু কাব্যিক মেজাজ রয়েছে, তবু থিয়েটার নিয়ে আমার যে মানদ- তা এতে নেই।’ এর মাত্র ১ মাস পরে লোরকা নিউ ইয়র্ক যান ৯ মাসের সফরে। সেখানে তিনি স্পেনের থিয়েটারের মৌলিক পরিবর্তনের বিষয়ে চিন্তাভাবনা ও কাজ শুরু করেন। সে বছরের অক্টোবরে লোরকা পরিবারের কাছে এক চিঠিতে লিখেন,‘আমি থিয়েটার নিয়ে কিছু লিখা শুরু করেছি, যা চমকপ্রদ হতে পারে। ভবিষ্যতের থিয়েটার নিয়ে এখনই কাউকে ভাবতে হবে। এখন স্পেনে যা কিছু আছে তা সবই মৃত। হয় থিয়েটার তার মূল পরিবর্তন করবে, না হয় সে চিরবিদায় নেবে। আর কোন সমাধান নেই।’ Reference: `Barouque Lorca: An Archaist Playwright for the new stage’ by Andres Peres Perez-Simon|।
অর্থ-বাণিজ্য: নির্বাচনের প্রার্থীদের জন্য শনিবার সব ব্যাংক খোলা থাকবে