বাদল বিহারী চক্রবর্তী
কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ লিখেছেন- “জন্মদিন এল তব আজি,/ ভরি লয়ে সংগীতের সাজি / বিজ্ঞানের রসায়ন রাগ রাগিণীর রসায়নে / পূর্ণ হল তোমার জীবনে। /কর্মের ধারায় তব রসের প্রবাহ যেথা মেশে / সেইখানে ভারতীর আশীর্ব্বাদ অমৃত বরষে।”
বলা বাহুল্য, উপরের আশীর্বাণীটি কবি দিয়েছেন তাঁরই পরম ¯েœহধন্য সহচর, রবীন্দ্রসঙ্গীত বিশেষজ্ঞ ও স্বরলিপিকার শৈলজারঞ্জন মজুদারের কোনো এক জন্মদিনে।
শৈশব থেকে সঙ্গীতের প্রতি ঝোঁক। পাঠশালায় মাত্র ৮-৯ বছর বয়সে তিনি ঠাকুমার কাছে গান শেখেন। ঠাকুমার মুখেই রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ও তাঁর গানের কথা শুনেছেন। বিদ্যাসাগর কলেজে আই, এস-সি পড়ার সময়ে তিনি সৌমেন্দ্রনাথ ঠাকুরের ‘পাগলাঝোরা’ নামের এক অনুষ্ঠানে নাম লেখান। আপাদমস্তক একজন বিজ্ঞানের ব্রতসাধক কীভাবে সঙ্গীতের রবীন্দ্রসাগরে ডুবে রইলেন আমৃত্যু, তা ভাবনার বিষয়। অগাধ সঙ্গীত পিপাসা ও সঙ্গীতের রাগ, তাল, খেয়াল ও ক্ষুদ্রাতিক্ষুদ্র শাখা-প্রশাখায় তাঁর পদচারণার কথা চিন্তা করলে অবাক হওয়ারই কথা।
১৯৩২ খ্রিস্টাব্দে শ্রী মজুমদার বিশ^ভারতীর রসায়নের শিক্ষক হিসেবে যোগদান করেন এবং এখানে অধ্যাপক থাকার সুবাদে তিনি কবিগুরুর কাছে গান শেখাসহ গুরুর সান্নিধ্যে এসে তাঁর গানের সুর ও স্বরলিপিকার হয়ে উঠলেন। রবীন্দ্রসঙ্গীতই তাঁর ধ্যান-জ্ঞান সব। শৈলজারঞ্জন প্রসঙ্গে বিচারপতি ওবায়দুল হাসানের একটি আর্টিক্যালের অংশবিশেষ বেশ মজাদার। সেটার সার-সংক্ষেপ, গুরু ও শৈলজাবাবুর কথোপকথন। কবিগুরু একদিন মিঃ মজুমদারকে জিজ্ঞেস করলেন-
-কেউ যদি তোমাকে জিজ্ঞেস করে তুমি শান্তিনিকেতনে কী করো? তবে কী বলবে?
-আমি অধ্যাপনা করি একথাই বলব।
-অধ্যাপনা করো কী বিষয়ে বলবে?
-কেন, কেমিস্ট্রি?
-না না, দুটো মিশিয়ে বলবে।
-কার সঙ্গে কী মেশাবো?
-হয় কেমিক্যাল মিউজিক, নয়তো বলবে মিউজিক্যাল কেমিস্ট্রি।
... কী আশ্চর্য রসবোধ গুরু-শিষ্য দুই মনীষীতে! শৈলজাবাবুর নিষ্ঠাই একদিন অর্থাৎ ১৯৩৯ সালে তাঁকে শান্তিনিকেতনের সঙ্গীত ভবনের অধ্যক্ষ পদে সমাসীন করে এবং একটানা ১৯৬০ সাল পর্যন্ত তিনি এ পদ অলঙ্কৃত করে রাখেন। এরই মধ্যে তিনি ধ্রুপদী সঙ্গীতে তালিম নেন হেমেন্দ্রলাল রায়ের কাছে।
কবিগুরুর তত্ত্বাবধানে শান্তিনিকেতনে প্রতিবছর ‘বর্ষামঙ্গল’ অনুষ্ঠিত হতো বেশ সাড়ম্বরে। কবিতা, গান, নাচ ও গীতিনৃত্যনাট্যে মুখরিত হয়ে উঠতো শান্তিনিকেতন- যেখানে পরিচালক, প্রশিক্ষক ও নীতিনির্ধারণী ভূমিকায় গুরুদায়িত্ব পালন করতেন শৈলজারঞ্জন। একবার এক দুর্ঘটনায় ১৯৩৭ সালে ‘বর্ষামঙ্গল’ অনুষ্ঠান স্থগিত হয়ে গেল। অধ্যাপক নিত্যানন্দবিনোদ গোস্বামীর একমাত্র পুত্র বীরেশ^রের মৃত্যু ঘটায় অনুষ্ঠান কিছুদিন পিছিয়ে তা কলকাতার ‘ছায়া’ প্রেক্ষাগৃহে অনুষ্ঠিত হলো ৪ ও ৫ সেপ্টেম্বর দু’দিনব্যাপী। সেখানে যে গানগুলো গাওয়া হলো তার প্রায় সবই ছিল কবিগুরুর নতুন রচনা। কিন্তু সব বর্ষার গান নয়। বর্ষার গান ছিল সাতটি; তার মধ্যে ‘আমি তখন ছিলেম মগন গহন...’- এই গান সম্পর্কে শৈলজারঞ্জন লিখেছেন, “বর্ষামঙ্গলে একটা নতুন নাম শোনালেন গুরুদেব- ‘কোলকাতার বাউল’।”- গানটি কলকাতায় রচিত হয় বলে এই নাম। আবার অন্য একটি গান- ‘আমার প্রাণের মাঝে সুধা আছে’- একে ‘শান্তিনিকেতনের বাউল’ বলতেন রবীন্দ্রনাথ। মিঃ মজুমদার শৈলজারঞ্জন মজুমদার) ওই অনুষ্ঠানটির একটি চমৎকার স্মৃতিচারণ করেছেন- “অনুষ্ঠানটি, তার রিহার্সাল, তার পর্দার আড়ালের নাটক, সব যেন মনশ্চক্ষে দেখতে পাওয়া যায়।”
১৯৩৯ সালের বর্ষামঙ্গল হয় ২৭ আগস্ট- নতুন গান তৈরি হয় ষোলটি। এ প্রসঙ্গে শৈলজাবাবুর বুদ্ধিমত্তা হলো- কেমন করে তিনি গুরুদেবকে উত্তেজিত করে একের পর এক গান লিখিয়ে নিয়েছিলেন, তাঁর স্মৃতিকথায় তিনি বিবৃত করেছিলেন তার ইতিহাস। ছ’টি মাত্র গান- তাও পুরোনো; তাই নিয়ে বর্ষামঙ্গলের প্রস্তুতি চলছিল মিঃ মজুমদারের পরিচালনায়। পশ্চিমবঙ্গের প্রখ্যাত প্রাবন্ধিক ও রবীন্দ্র গবেষক ইন্দ্রজিৎ সেনগুপ্তের লেখায় জানা যায়- রবীন্দ্রনাথ কলকাতা থেকে ফিরেছেন ২১ আগস্ট। শৈলজাবাবু লেখেন- “আমি উত্তরায়ণে গানের দল নিয়ে গিয়ে ছ’টি পুরনো গানের মহড়া গুরুদেবকে শোনালাম।... খেতে যাবার ঘণ্টা পড়ল, ছেলেমেয়েরা খেতে চলে গেল। এই সুযোগে আমি গুরুদেবকে বললাম যে, ছেলেমেয়েরা বলছে নতুন গান চাই, পুরনো গানে আর ওরা বর্ষামঙ্গল করবে না।
গুরুদেব বললেন- “এই অল্প সময়ের মধ্যে কী করে আর নতুন গান লেখা যায়? অন্য অনেক কাজও তো আছে।” মজুমদার আরও লিখলেন- “পরদিন বেলা এগারোটায় গুরুদেব আমাকে ডেকে পাঠালেন। কাছে গিয়ে দাঁড়াতেই নতুন লেখা একটি গান হাতে দিলেন। গানটি- ‘ওগো সাঁওতালি ছেলে।’...
বর্ষামঙ্গলের জন্য দ্বিতীয় গান সম্পর্কে শৈলজারঞ্জন মজুমদারের যেমন স্মৃতিচারণ- “‘বাদল-দিনের প্রথম কদম ফুল’- পেলাম ‘ওগো সাঁওতালি ছেলে’ লেখার পরের দিনই।” পরদিন ভোরবেলা তিনি বনমালীর সঙ্গে যোগাযোগ করে একটি কাগজে ‘বেহাগ ’ কথাটি লিখে যখন গুরুদেবের লেখার টেবিলে চাপা দিয়ে রেখে এলেন, সেটা দেখে পড়ামাত্রই কবিগুরু বনমালীকে ডেকে বকতে শুরু করেন, বনমালী ‘যাকে-তাকে’ তাঁর লেখার ঘরে ঢুকতে দেয় বলে। অনুরোধটি ছিল ‘বেহাগ রাগিণীতে’তে বর্ষামঙ্গলের গান তৈরি করার। মজুমদার লিখলেন- “বনমালী চাপা হাসি হেসে চলে গেল। সেই বেহাগে পেলাম এই গান- ‘আজি তোমায় আবার চাই শুনাবারে’। এর পরদিন আবার কাগজে লিখে এলাম ‘ইমন’, পেলামও- ‘এসো গো, জে¦লে দিয়ে যাও প্রদীপখানি’ গানটি ...লিখে রেখে এলাম, ‘তান দেওয়া গান’। পেয়ে গেলাম, ‘আজ শ্রাবণের গগনের গায়।”...এছাড়া গুরুদেব নিজেই লেখেন- ‘আজি ঝরঝর মুখর বাদর-দিনে’।
শৈলজারঞ্জন তাঁর সুদীর্ঘ সঙ্গীত জীবনে বহু ছাত্র-ছাত্রীকে সঙ্গীত শিক্ষা দিয়েছেন; এঁদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য ছিলেন- কণিকা বন্দ্যোপাধ্যায়, নীলিমা সেন, সুচিত্রা মিত্র, অরুন্ধতী দেবী প্রমুখ। বিশেষজ্ঞ পরীক্ষকরূপে গিয়েছেন বিশ^ভারতী, রবীন্দ্রভারতী, পাটনা, ভাগলপুর, রাঁচি ও বর্ধমান প্রভৃতি বিশ^বিদ্যালয়ে। তিনি প্রথমদিকে গ্রামোফোন রেকর্ডে ও ছায়াছবিতে গাওয়া রবীন্দ্রসঙ্গীতের অনুমোদন কার্যের সাথে যুক্ত ছিলেন।
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ও শৈলজারঞ্জন মজুমদার
১৯৩৫-এ তিনি নিজ জন্মভিটায় এসে তাঁরই উদ্যোগে শান্তিনিকেতন বা কলকাতার বাইরে নেত্রকোণাতেই প্রথম রবীন্দজয়ন্তী উদযাপনের পরিচালনা ও মুখ্য ভূমিকা পালন করেন। বিচারপতি হাসানের লেখায় আরও জানা যায়, বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পর ১৯৭৪ সালে এদেশের স্থপতি রাষ্ট্রনেতা জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের সঙ্গে সাক্ষাৎ করতে আসেন শৈলজারঞ্জন। বঙ্গবন্ধু তাঁকে সাদর অভ্যর্থনা জানিয়ে বলেছিলেন- ‘আপনেরে আর ছাড়ুমই না।’ শৈলজাবাবু তখন বলেছেলেন- ‘আমার গ্রামের বাড়ি উদ্বাস্তুদের দখলে, শহরের বাড়িতে মসজিদ হয়েছে, থাকার জায়গা কোথায়? উত্তরে বঙ্গবন্ধু- ‘ছাইড়্যা দেন। আপনেরে বাড়ি দেব, গাড়ি দেব। আপনার জায়গার অভাব হবে না।’ শৈলজাবাবু মুগ্ধ হয়েছিলেন বঙ্গবন্ধুর আন্তরিকতায়। তিনি তাঁর আত্মজীবনী গ্রন্থ ‘যাত্রাপথের আনন্দগান’-এ বঙ্গবন্ধুর উদ্ধৃতি দিয়ে লিখেছেন- ‘সে আমি ও আমার অন্তরের অন্তস্থলে উপলব্ধি করেছি।’
১৯৮১ খ্রিস্টাব্দে তিনি আবার বাংলাদেশে আসেন এবং বিপুল সংবর্ধনা পান এখানে। এ সময় ছায়ানটের সাথে প্রত্যক্ষ সখ্য গড়ে ওঠে তাঁর। অধ্যাপক সন্জীদা খাতুন ও ওয়াহিদুল হকসহ এখানকার তৎকালীন রবীন্দ্রানুরাগীদের পৃষ্ঠপোষকতায় স্মরণীয় হয়ে থাকে তাঁর জন্মভূমি ভ্রমণের স্মৃতি। তিনি ছায়ানটে রবীন্দ্রসঙ্গীতের প্রশিক্ষণ দেন। সঙ্গীতে প্রশিক্ষণ ও পরিচালনা করেন ময়মনসিংহ ও চট্টগ্রামেও।
অথচ আক্ষেপের কথা এই যে, মানুষটি ছিলেন কবিগুরুর যোগ্য সহচর, নিজের ভেতর যিনি বহুগুণের সমন্বয় ঘটিয়েছিলেন, এই কীর্তিমান মনীষীকে ভুলে থাকার যে প্রবণতা লক্ষণীয় তা অত্যন্ত দুঃখজনক বটে। তবে এই প্রবণতার মাঝেও কয়েক বছর আগে একবার মিঃ মজুমদারের ১১৬-তম জন্মবার্ষিকী উদযাপিত হয়েছিল বাংলাদেশের জাতীয় গ্রন্থাগারের শওকত ওসমান স্মৃতি মিলনায়তনে। এর আয়োজক ছিল ‘চয়নিকা’ নামের একটি সংগঠন; তাতে সহায়তা করেছিল ঢাকাস্থ ‘ইন্দিরা গান্ধী কালচারাল সেন্টার’। দুই বাংলার শিল্পীদের পরিবেশনায় মুখরিত হয়ে উঠেছিল এ জন্মোৎসব।
ভারতের প্রাক্তন প্রধানমন্ত্রী শ্রীমতি ইন্দিরা গান্ধী শান্তিনিকেতনে ছাত্রজীবনে শৈলজাবাবুর অত্যন্ত প্রিয় ও স্নেহধন্যা হয়ে উঠেছিলেন, যদিও ইন্দিরাজি ছিলেন কলাভবনের শিক্ষার্থী। পরবর্তীকালে জননায়ক ইন্দিরা ভারতের তথ্য ও বেতার মন্ত্রী হন এবং সময়ের পরিক্রমণ ও সুপথ অভিজ্ঞতায় প্রধানমন্ত্রী। তিনি যখন তথ্য ও বেতারমন্ত্রী তখন দিল্লির এক অনুষ্ঠানে মিঃ মজুমদারের অনুযোগ ছিল- ‘রবীন্দ্রসঙ্গীত নিয়ে কোলকাতায় কী অনাচারই না চলছে।’ তাঁর এমন প্রতিক্রিয়ার তাৎক্ষণিক সুফল- ‘আকাশবাণী’ কর্তৃপক্ষকে ইন্দিরাজি সতর্ক করে দিলেন; তাতে সংস্থার ডি, জি, থেকে নবাগত শিল্পী পর্যন্ত সবাই রবীন্দ্রসঙ্গীত পরিবেশনে অনাচার রোধে সতর্ক হয়ে ওঠেন।
শৈলজাবাবুর জন্ম তৎকালীন বৃটিশ ভারতের ময়মনসিংহ জেলার নেত্রকোণা মহকুমার (নেত্রকোণা বর্তমানে জেলা) মোহনগঞ্জ উপজেলার বাহাম গ্রামে, ১৯০০ সালের ১৯ জুলাই (৪ঠা শ্রাবণ, ১৩০৭ বঙ্গাব্দ)। তাঁর পিতা-রমণীকিশোর দত্ত মজুমদার ছিলেন নেত্রকোণা সদরের আইনজীবী এবং মায়ের নাম সরলা সুন্দরী। শ্রী মজুমদার ১৯১৭ খ্রিস্টাব্দে নেত্রকোণা হাই স্কুল থেকে ম্যাট্রিক এবং ১৯২০ খ্রিস্টাব্দে কলকাতার মেট্রোপলিটন কলেজ (অধুনা বিদ্যাসাগর কলেজ) থেকে আই, এস-সি, পাস করেন। ১৯২২-এ স্কটিশ চার্চ কলেজ থেকে বি, এস-সি, এবং ১৯২৪-এ তিনি কলকাতা বিশ^বিদ্যালয় থেকে রসায়ন শাস্ত্রে প্রথম শ্রেণিতে এম, এস-সি পাস করেন।
১৯৮৫ খ্রিস্টাব্দে বিশ^ভারতী থেকে ‘দেশিকোত্তম’ সম্মাননা পাওয়া কিংবদন্তিতুল্য এই সঙ্গীতগুরু ১৯৯২ সালের ২৪ মে ভোররাতে কলকাতার সল্টলেকের বাড়িতে মহাপ্রস্থানে যাত্রা করেন। কীর্তিমান এই মনীষীর অবদান ও কর্ম আজকের ও আগামীদিনের রবীন্দ্রসঙ্গীত শিল্পীদের কাছে অনুসরণযোগ্য করে রাখতে হলে সকল সীমাবদ্ধতা অতিক্রম করে ভক্ত ও রবীন্দ্রসঙ্গীত পিপাসুদের কাছে তাঁর স্মরণ-অনুষ্ঠান করার বিকল্প নেই। ১৯২১-তম জন্মবার্ষিকীতে এই সুর-সাধকের প্রতি রইল আমার অন্তরাঞ্জলি।
বাদল বিহারী চক্রবর্তী
বৃহস্পতিবার, ১৫ জুলাই ২০২১
কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ লিখেছেন- “জন্মদিন এল তব আজি,/ ভরি লয়ে সংগীতের সাজি / বিজ্ঞানের রসায়ন রাগ রাগিণীর রসায়নে / পূর্ণ হল তোমার জীবনে। /কর্মের ধারায় তব রসের প্রবাহ যেথা মেশে / সেইখানে ভারতীর আশীর্ব্বাদ অমৃত বরষে।”
বলা বাহুল্য, উপরের আশীর্বাণীটি কবি দিয়েছেন তাঁরই পরম ¯েœহধন্য সহচর, রবীন্দ্রসঙ্গীত বিশেষজ্ঞ ও স্বরলিপিকার শৈলজারঞ্জন মজুদারের কোনো এক জন্মদিনে।
শৈশব থেকে সঙ্গীতের প্রতি ঝোঁক। পাঠশালায় মাত্র ৮-৯ বছর বয়সে তিনি ঠাকুমার কাছে গান শেখেন। ঠাকুমার মুখেই রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ও তাঁর গানের কথা শুনেছেন। বিদ্যাসাগর কলেজে আই, এস-সি পড়ার সময়ে তিনি সৌমেন্দ্রনাথ ঠাকুরের ‘পাগলাঝোরা’ নামের এক অনুষ্ঠানে নাম লেখান। আপাদমস্তক একজন বিজ্ঞানের ব্রতসাধক কীভাবে সঙ্গীতের রবীন্দ্রসাগরে ডুবে রইলেন আমৃত্যু, তা ভাবনার বিষয়। অগাধ সঙ্গীত পিপাসা ও সঙ্গীতের রাগ, তাল, খেয়াল ও ক্ষুদ্রাতিক্ষুদ্র শাখা-প্রশাখায় তাঁর পদচারণার কথা চিন্তা করলে অবাক হওয়ারই কথা।
১৯৩২ খ্রিস্টাব্দে শ্রী মজুমদার বিশ^ভারতীর রসায়নের শিক্ষক হিসেবে যোগদান করেন এবং এখানে অধ্যাপক থাকার সুবাদে তিনি কবিগুরুর কাছে গান শেখাসহ গুরুর সান্নিধ্যে এসে তাঁর গানের সুর ও স্বরলিপিকার হয়ে উঠলেন। রবীন্দ্রসঙ্গীতই তাঁর ধ্যান-জ্ঞান সব। শৈলজারঞ্জন প্রসঙ্গে বিচারপতি ওবায়দুল হাসানের একটি আর্টিক্যালের অংশবিশেষ বেশ মজাদার। সেটার সার-সংক্ষেপ, গুরু ও শৈলজাবাবুর কথোপকথন। কবিগুরু একদিন মিঃ মজুমদারকে জিজ্ঞেস করলেন-
-কেউ যদি তোমাকে জিজ্ঞেস করে তুমি শান্তিনিকেতনে কী করো? তবে কী বলবে?
-আমি অধ্যাপনা করি একথাই বলব।
-অধ্যাপনা করো কী বিষয়ে বলবে?
-কেন, কেমিস্ট্রি?
-না না, দুটো মিশিয়ে বলবে।
-কার সঙ্গে কী মেশাবো?
-হয় কেমিক্যাল মিউজিক, নয়তো বলবে মিউজিক্যাল কেমিস্ট্রি।
... কী আশ্চর্য রসবোধ গুরু-শিষ্য দুই মনীষীতে! শৈলজাবাবুর নিষ্ঠাই একদিন অর্থাৎ ১৯৩৯ সালে তাঁকে শান্তিনিকেতনের সঙ্গীত ভবনের অধ্যক্ষ পদে সমাসীন করে এবং একটানা ১৯৬০ সাল পর্যন্ত তিনি এ পদ অলঙ্কৃত করে রাখেন। এরই মধ্যে তিনি ধ্রুপদী সঙ্গীতে তালিম নেন হেমেন্দ্রলাল রায়ের কাছে।
কবিগুরুর তত্ত্বাবধানে শান্তিনিকেতনে প্রতিবছর ‘বর্ষামঙ্গল’ অনুষ্ঠিত হতো বেশ সাড়ম্বরে। কবিতা, গান, নাচ ও গীতিনৃত্যনাট্যে মুখরিত হয়ে উঠতো শান্তিনিকেতন- যেখানে পরিচালক, প্রশিক্ষক ও নীতিনির্ধারণী ভূমিকায় গুরুদায়িত্ব পালন করতেন শৈলজারঞ্জন। একবার এক দুর্ঘটনায় ১৯৩৭ সালে ‘বর্ষামঙ্গল’ অনুষ্ঠান স্থগিত হয়ে গেল। অধ্যাপক নিত্যানন্দবিনোদ গোস্বামীর একমাত্র পুত্র বীরেশ^রের মৃত্যু ঘটায় অনুষ্ঠান কিছুদিন পিছিয়ে তা কলকাতার ‘ছায়া’ প্রেক্ষাগৃহে অনুষ্ঠিত হলো ৪ ও ৫ সেপ্টেম্বর দু’দিনব্যাপী। সেখানে যে গানগুলো গাওয়া হলো তার প্রায় সবই ছিল কবিগুরুর নতুন রচনা। কিন্তু সব বর্ষার গান নয়। বর্ষার গান ছিল সাতটি; তার মধ্যে ‘আমি তখন ছিলেম মগন গহন...’- এই গান সম্পর্কে শৈলজারঞ্জন লিখেছেন, “বর্ষামঙ্গলে একটা নতুন নাম শোনালেন গুরুদেব- ‘কোলকাতার বাউল’।”- গানটি কলকাতায় রচিত হয় বলে এই নাম। আবার অন্য একটি গান- ‘আমার প্রাণের মাঝে সুধা আছে’- একে ‘শান্তিনিকেতনের বাউল’ বলতেন রবীন্দ্রনাথ। মিঃ মজুমদার শৈলজারঞ্জন মজুমদার) ওই অনুষ্ঠানটির একটি চমৎকার স্মৃতিচারণ করেছেন- “অনুষ্ঠানটি, তার রিহার্সাল, তার পর্দার আড়ালের নাটক, সব যেন মনশ্চক্ষে দেখতে পাওয়া যায়।”
১৯৩৯ সালের বর্ষামঙ্গল হয় ২৭ আগস্ট- নতুন গান তৈরি হয় ষোলটি। এ প্রসঙ্গে শৈলজাবাবুর বুদ্ধিমত্তা হলো- কেমন করে তিনি গুরুদেবকে উত্তেজিত করে একের পর এক গান লিখিয়ে নিয়েছিলেন, তাঁর স্মৃতিকথায় তিনি বিবৃত করেছিলেন তার ইতিহাস। ছ’টি মাত্র গান- তাও পুরোনো; তাই নিয়ে বর্ষামঙ্গলের প্রস্তুতি চলছিল মিঃ মজুমদারের পরিচালনায়। পশ্চিমবঙ্গের প্রখ্যাত প্রাবন্ধিক ও রবীন্দ্র গবেষক ইন্দ্রজিৎ সেনগুপ্তের লেখায় জানা যায়- রবীন্দ্রনাথ কলকাতা থেকে ফিরেছেন ২১ আগস্ট। শৈলজাবাবু লেখেন- “আমি উত্তরায়ণে গানের দল নিয়ে গিয়ে ছ’টি পুরনো গানের মহড়া গুরুদেবকে শোনালাম।... খেতে যাবার ঘণ্টা পড়ল, ছেলেমেয়েরা খেতে চলে গেল। এই সুযোগে আমি গুরুদেবকে বললাম যে, ছেলেমেয়েরা বলছে নতুন গান চাই, পুরনো গানে আর ওরা বর্ষামঙ্গল করবে না।
গুরুদেব বললেন- “এই অল্প সময়ের মধ্যে কী করে আর নতুন গান লেখা যায়? অন্য অনেক কাজও তো আছে।” মজুমদার আরও লিখলেন- “পরদিন বেলা এগারোটায় গুরুদেব আমাকে ডেকে পাঠালেন। কাছে গিয়ে দাঁড়াতেই নতুন লেখা একটি গান হাতে দিলেন। গানটি- ‘ওগো সাঁওতালি ছেলে।’...
বর্ষামঙ্গলের জন্য দ্বিতীয় গান সম্পর্কে শৈলজারঞ্জন মজুমদারের যেমন স্মৃতিচারণ- “‘বাদল-দিনের প্রথম কদম ফুল’- পেলাম ‘ওগো সাঁওতালি ছেলে’ লেখার পরের দিনই।” পরদিন ভোরবেলা তিনি বনমালীর সঙ্গে যোগাযোগ করে একটি কাগজে ‘বেহাগ ’ কথাটি লিখে যখন গুরুদেবের লেখার টেবিলে চাপা দিয়ে রেখে এলেন, সেটা দেখে পড়ামাত্রই কবিগুরু বনমালীকে ডেকে বকতে শুরু করেন, বনমালী ‘যাকে-তাকে’ তাঁর লেখার ঘরে ঢুকতে দেয় বলে। অনুরোধটি ছিল ‘বেহাগ রাগিণীতে’তে বর্ষামঙ্গলের গান তৈরি করার। মজুমদার লিখলেন- “বনমালী চাপা হাসি হেসে চলে গেল। সেই বেহাগে পেলাম এই গান- ‘আজি তোমায় আবার চাই শুনাবারে’। এর পরদিন আবার কাগজে লিখে এলাম ‘ইমন’, পেলামও- ‘এসো গো, জে¦লে দিয়ে যাও প্রদীপখানি’ গানটি ...লিখে রেখে এলাম, ‘তান দেওয়া গান’। পেয়ে গেলাম, ‘আজ শ্রাবণের গগনের গায়।”...এছাড়া গুরুদেব নিজেই লেখেন- ‘আজি ঝরঝর মুখর বাদর-দিনে’।
শৈলজারঞ্জন তাঁর সুদীর্ঘ সঙ্গীত জীবনে বহু ছাত্র-ছাত্রীকে সঙ্গীত শিক্ষা দিয়েছেন; এঁদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য ছিলেন- কণিকা বন্দ্যোপাধ্যায়, নীলিমা সেন, সুচিত্রা মিত্র, অরুন্ধতী দেবী প্রমুখ। বিশেষজ্ঞ পরীক্ষকরূপে গিয়েছেন বিশ^ভারতী, রবীন্দ্রভারতী, পাটনা, ভাগলপুর, রাঁচি ও বর্ধমান প্রভৃতি বিশ^বিদ্যালয়ে। তিনি প্রথমদিকে গ্রামোফোন রেকর্ডে ও ছায়াছবিতে গাওয়া রবীন্দ্রসঙ্গীতের অনুমোদন কার্যের সাথে যুক্ত ছিলেন।
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ও শৈলজারঞ্জন মজুমদার
১৯৩৫-এ তিনি নিজ জন্মভিটায় এসে তাঁরই উদ্যোগে শান্তিনিকেতন বা কলকাতার বাইরে নেত্রকোণাতেই প্রথম রবীন্দজয়ন্তী উদযাপনের পরিচালনা ও মুখ্য ভূমিকা পালন করেন। বিচারপতি হাসানের লেখায় আরও জানা যায়, বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পর ১৯৭৪ সালে এদেশের স্থপতি রাষ্ট্রনেতা জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের সঙ্গে সাক্ষাৎ করতে আসেন শৈলজারঞ্জন। বঙ্গবন্ধু তাঁকে সাদর অভ্যর্থনা জানিয়ে বলেছিলেন- ‘আপনেরে আর ছাড়ুমই না।’ শৈলজাবাবু তখন বলেছেলেন- ‘আমার গ্রামের বাড়ি উদ্বাস্তুদের দখলে, শহরের বাড়িতে মসজিদ হয়েছে, থাকার জায়গা কোথায়? উত্তরে বঙ্গবন্ধু- ‘ছাইড়্যা দেন। আপনেরে বাড়ি দেব, গাড়ি দেব। আপনার জায়গার অভাব হবে না।’ শৈলজাবাবু মুগ্ধ হয়েছিলেন বঙ্গবন্ধুর আন্তরিকতায়। তিনি তাঁর আত্মজীবনী গ্রন্থ ‘যাত্রাপথের আনন্দগান’-এ বঙ্গবন্ধুর উদ্ধৃতি দিয়ে লিখেছেন- ‘সে আমি ও আমার অন্তরের অন্তস্থলে উপলব্ধি করেছি।’
১৯৮১ খ্রিস্টাব্দে তিনি আবার বাংলাদেশে আসেন এবং বিপুল সংবর্ধনা পান এখানে। এ সময় ছায়ানটের সাথে প্রত্যক্ষ সখ্য গড়ে ওঠে তাঁর। অধ্যাপক সন্জীদা খাতুন ও ওয়াহিদুল হকসহ এখানকার তৎকালীন রবীন্দ্রানুরাগীদের পৃষ্ঠপোষকতায় স্মরণীয় হয়ে থাকে তাঁর জন্মভূমি ভ্রমণের স্মৃতি। তিনি ছায়ানটে রবীন্দ্রসঙ্গীতের প্রশিক্ষণ দেন। সঙ্গীতে প্রশিক্ষণ ও পরিচালনা করেন ময়মনসিংহ ও চট্টগ্রামেও।
অথচ আক্ষেপের কথা এই যে, মানুষটি ছিলেন কবিগুরুর যোগ্য সহচর, নিজের ভেতর যিনি বহুগুণের সমন্বয় ঘটিয়েছিলেন, এই কীর্তিমান মনীষীকে ভুলে থাকার যে প্রবণতা লক্ষণীয় তা অত্যন্ত দুঃখজনক বটে। তবে এই প্রবণতার মাঝেও কয়েক বছর আগে একবার মিঃ মজুমদারের ১১৬-তম জন্মবার্ষিকী উদযাপিত হয়েছিল বাংলাদেশের জাতীয় গ্রন্থাগারের শওকত ওসমান স্মৃতি মিলনায়তনে। এর আয়োজক ছিল ‘চয়নিকা’ নামের একটি সংগঠন; তাতে সহায়তা করেছিল ঢাকাস্থ ‘ইন্দিরা গান্ধী কালচারাল সেন্টার’। দুই বাংলার শিল্পীদের পরিবেশনায় মুখরিত হয়ে উঠেছিল এ জন্মোৎসব।
ভারতের প্রাক্তন প্রধানমন্ত্রী শ্রীমতি ইন্দিরা গান্ধী শান্তিনিকেতনে ছাত্রজীবনে শৈলজাবাবুর অত্যন্ত প্রিয় ও স্নেহধন্যা হয়ে উঠেছিলেন, যদিও ইন্দিরাজি ছিলেন কলাভবনের শিক্ষার্থী। পরবর্তীকালে জননায়ক ইন্দিরা ভারতের তথ্য ও বেতার মন্ত্রী হন এবং সময়ের পরিক্রমণ ও সুপথ অভিজ্ঞতায় প্রধানমন্ত্রী। তিনি যখন তথ্য ও বেতারমন্ত্রী তখন দিল্লির এক অনুষ্ঠানে মিঃ মজুমদারের অনুযোগ ছিল- ‘রবীন্দ্রসঙ্গীত নিয়ে কোলকাতায় কী অনাচারই না চলছে।’ তাঁর এমন প্রতিক্রিয়ার তাৎক্ষণিক সুফল- ‘আকাশবাণী’ কর্তৃপক্ষকে ইন্দিরাজি সতর্ক করে দিলেন; তাতে সংস্থার ডি, জি, থেকে নবাগত শিল্পী পর্যন্ত সবাই রবীন্দ্রসঙ্গীত পরিবেশনে অনাচার রোধে সতর্ক হয়ে ওঠেন।
শৈলজাবাবুর জন্ম তৎকালীন বৃটিশ ভারতের ময়মনসিংহ জেলার নেত্রকোণা মহকুমার (নেত্রকোণা বর্তমানে জেলা) মোহনগঞ্জ উপজেলার বাহাম গ্রামে, ১৯০০ সালের ১৯ জুলাই (৪ঠা শ্রাবণ, ১৩০৭ বঙ্গাব্দ)। তাঁর পিতা-রমণীকিশোর দত্ত মজুমদার ছিলেন নেত্রকোণা সদরের আইনজীবী এবং মায়ের নাম সরলা সুন্দরী। শ্রী মজুমদার ১৯১৭ খ্রিস্টাব্দে নেত্রকোণা হাই স্কুল থেকে ম্যাট্রিক এবং ১৯২০ খ্রিস্টাব্দে কলকাতার মেট্রোপলিটন কলেজ (অধুনা বিদ্যাসাগর কলেজ) থেকে আই, এস-সি, পাস করেন। ১৯২২-এ স্কটিশ চার্চ কলেজ থেকে বি, এস-সি, এবং ১৯২৪-এ তিনি কলকাতা বিশ^বিদ্যালয় থেকে রসায়ন শাস্ত্রে প্রথম শ্রেণিতে এম, এস-সি পাস করেন।
১৯৮৫ খ্রিস্টাব্দে বিশ^ভারতী থেকে ‘দেশিকোত্তম’ সম্মাননা পাওয়া কিংবদন্তিতুল্য এই সঙ্গীতগুরু ১৯৯২ সালের ২৪ মে ভোররাতে কলকাতার সল্টলেকের বাড়িতে মহাপ্রস্থানে যাত্রা করেন। কীর্তিমান এই মনীষীর অবদান ও কর্ম আজকের ও আগামীদিনের রবীন্দ্রসঙ্গীত শিল্পীদের কাছে অনুসরণযোগ্য করে রাখতে হলে সকল সীমাবদ্ধতা অতিক্রম করে ভক্ত ও রবীন্দ্রসঙ্গীত পিপাসুদের কাছে তাঁর স্মরণ-অনুষ্ঠান করার বিকল্প নেই। ১৯২১-তম জন্মবার্ষিকীতে এই সুর-সাধকের প্রতি রইল আমার অন্তরাঞ্জলি।