কবি মাহফুজ আল-হোসেন
প্রেম বিষয়ক
আপনি হতে তুমি কিংবা তুইয়ের মাঝামাঝি সারিসারি সন্নিবদ্ধ তমাল-তার পাশে একটা মেহগনিও  ছিল  না থাকার মতোই—তার গায়ে অযথাই একশ চার ডিগ্ৰি জ্বর ধরে আসা বৃষ্টিতে সেভাবে না ভিজেও —সেইসাথে কাশিও ছিল—তাও বোধহয় দিন-দুয়েক হবে—অনেকটা না থাকার মতোই—যেভাবে আনমনে ভাত গেলার সময় কারো অনুপস্থিতি মনে করিয়ে দিতে যতটুকু গলায় আটকায়—দীঘল দীর্ঘশ্বাস আর তার সাথে হৃদস্পন্দনের  হঠাৎ বৃদ্ধি পালস্ অক্সিমিটাররের রিডিংয়ের বাইরে;
জ্বর হলো মেহগনির আর তার ভাঁপে তমাল—তমালের মা-বাপ-দাদা-চৌদ্দগুষ্টি এখন লাইফ সাপোর্টে।
বলা নেই কওয়া নেই নিপাট ভদ্রলোক ‘আপনি’ হঠাৎ করেই তুইয়ের সাথে তুই-তোকারি শুরু করেছে আর এই ন্যক্কারজনক পরিস্থিতি সামলাতে নৃতাত্ত্বিকভাবে তুমিই তো পারবে। কী বললে, ফেল মেরেছো? ভরসা রাখো— এখন নৈঃশব্দ্যের অশ্রুত অস্ফুট ধ্বনিগুলো সব সরব হয়ে উঠবে দ্বি-পাক্ষিক বরষা নামাতে ...
যখন তুমি আমায় ভাবছো 
যখন তুমি আমায় ভাবছো
ঠিক সে মুহূর্তেই আমিও যুক্ত হয়ে যাই তোমার সাথে
এখানে ব্যান্ডউডথ্ কিংবা বাফারিংয়ের কোনো বিড়ম্বনা নেই
এমনকি ন্যানো সেকেন্ডের নিযুত ভগ্নাংশের ঢের আগেই পৌঁছে যায় ভালোবাসার প্রতিটি হৃদকম্পন
আর আলোর গতিবেগের গণিত
বড় বেশি মন্থর মনে হয় এ মনোযোগাযোগের কাছে
এ অভাবিত অদৃশ্য অনুভবের জন্য কখনোই কোনো সাংখ্যিক প্রযুক্তির প্রয়োজন অনুভব করি না
ফিরে পাওয়া নিঃশ্বাসের অনির্বচনীয় সৌরভ আর কপালে জমে থাকা স্বেদবিন্দুর হীরকদ্যুতিময় স্ফটিক আনুবীক্ষণিক ক্ষুদেবার্তা হয়ে ঝড় তোলে সুতপ্ত রক্তকণিকায়...
শিল্পী : কামরুল হাসান
ভালোবাসলে বুকে বিপ্লব বেঁধে রাখতে হয়
ঠাসঘন কাচপোঁতা পাঁচিলে পীত ছত্রাক
তার ওপরে তিন সারি দাঁতাল কাঁটাতার
এদের নির্বিকার নিষেধাজ্ঞা
আর প্রহরারত অ্যালসেশিয়ানের আনুভূমিক উল্লম্ফন
এসবকিছুই উপেক্ষা করে প্রতি নিশীথে তোমার এই গবাক্ষ সাক্ষাৎ
লোকলজ্জা ভয়-সঙ্কোচ এ সবই যেন তোমার কাছে হাওয়াই মিঠাই
ছোটকাও আসতেন ঠিক এভাবে— একাত্তরে
মুখে দাঁড়ির ঘন জঙ্গল
পিঠ থেকে নামিয়ে রাখা স্টেনগান
ঠান্ডা চাহনির এক পলকে লাল সবুজের দিগন্ত রেখাটি যেন অনেকটাই স্পষ্ট
অবোধ শিশুর মতো দাদির কোলে বসে এক লোকমা দু’লোকমা করে পুরো হাঁড়িই সাবাড়
হঠাৎ দরজায় বুটের লাথি:
‘তুম লোগ সব ঝুট বোলা
শালে লোগ দরওয়াজা খোল দে’...
এ কী আমার গোলাপগোঁজা বিন্যস্ত চুল এক ঝটকায় মায়ের হলদেটে হাতে
ঘুরে দাঁড়াতেই দৃষ্টি আটকায় আধখোলা বুকশেলফে
ছোটকার অপ্রকাশিত পাণ্ডুলিপি
অব্যক্ত উচ্চারণে জানিয়ে দ্যায় :
ভালোবাসলে মায়াজাল মাড়িয়েই অনন্তের পথে হাঁটতে হয়
ভালোবাসলে বুকে বিপ্লব বেঁধে রাখতে হয়...
হলদে ঝুটিওয়ালা পাখিটি 
ব্যক্তিগত ঝুলবারান্দায় নিত্যদিন দোল খাওয়া 
হলদে ঝুটিওয়ালা পাখিটাকে
ইদানিং আর কোথাও দেখিনা
খুঁজেছি অনেক
ভাবলেশহীন ভর দুপুরে
মন খারাপের বিষন্ন বিকেলে
এমনকি কোজাগরি জোৎস্নায়
না কোথাও চিহ্ন মাত্র নেই
নিন্দুকেরা হয়তো বলবে ছিল নাকি কখনো
আরও ভালো করে খুঁজে দ্যাখো
হাইওয়ের পাশে দখল হয়ে যাওয়া ধানক্ষেতে
হঠাৎ হাঁটু গেঁড়ে বসা স্বপ্ন প্রকল্পের খালি জায়গায়
ঐতিহাসিক সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে—কর্তিত বৃক্ষের পড়ে থাকা অপাঙক্তেয় ডালে
অথবা অভিমানী চ্যাটবক্সে— ডিলিট করে দেয়া মেলোড্রামাটিক মেসেজে
পাখিটা আমার ওপরে না জানি রাগ করে অকস্মৎ দানাপানি খাওয়া ছেড়ে দিলো কিনা
ভীষণ শান্ত আর নির্বিবাদী বলেই তো জানতাম এতদিন
মানুষের অনায্য কোনো আচরণে হয়তো সে প্রবল প্রতিবাদী হয়ে উঠেছে
যেভাবে ভাষা কিংবা আত্মনিয়ন্ত্রণাধিকারের প্রশ্নে বিক্ষুব্ধ রাজবন্দি মৃত্যুঝুঁকি নিয়েও ঔপনিবেশিক কারাগারে আমরণ অনশনের কৌশল বেছে নেয়
অবলীলায়
নাকি— এই আষাঢ়ে জবুথবু হয়ে নীড় খুঁজে ফিরছে
অন্য কোনো হরিৎ হৃদয়ারণ্যে...
শীতাকাঙ্ক্ষী ভালোবাসা
মেট্রোপলিটন শীত না হয় থাকুক এমনই কোমল গান্ধার সৌগন্ধময় জেসমিন চায়ের মতোই;
অথবা সামান্য বেড়ে কর্কটক্রান্তির রেখায় আপতিত চুয়াডাঙ্গার কুলফি মালাই শৈত্যের চেয়ে কিছুটা কম— খানিকটা তোমার মার্জার গমনের বীতশোকের মতো;
কিংবা আত্মমগ্নতার আর্কটিক টালাজলে দীর্ঘক্ষণ ডুবে থাকা টার্ডিগ্ৰেডের মতোই পরপর দেয়া স্ট্যাটাসগুলোতে নীল পছন্দ কিংবা প্রগাঢ় ভালোবাসাসূচক টকটকে লাল প্রতিক্রিয়া না দেয়া কিংবা দাঁতকপাটি মেরে অবিমৃষ্যকারী মন্তব্য করা থেকে কিয়ৎকাল বিরত থেকে যদি হৃদস্পন্দনহীন টেস্টের পঞ্চম দিনে অপ্রত্যাশিত জয় কুড়িয়ে নেয়া যায় তবে মন্দ কী!
সুনসান সুনাব্য সেই ভালোবাসার শিউলি ভাত গ্যাসীয় চুলোয় চাপানো জলমগ্ন নাজিরশাইলের মতো হঠাৎ উথলে নাইবা পড়ুক;
বরং পৌষালি পড়ন্ত বিকেলে প্রাকবৈবাহিক অনিশ্চিত চুম্বন পর্বের মতো দুরুদুরু বক্ষে অপেক্ষমাণ প্রেম বিশুষ্ক কাঙাল ঠোঁটের আদলে পাতলা কাঁথার নিচে ঝিম মেরে পড়ে থাকুক হাড়কাঁপানো প্রবল শীতের প্রত্ন-প্রত্যাশায়...
মৃত্যু পরোয়ানা
অর্বাচীন অবুঝ ভালোবাসার এ অপূর্ণ প্রহর 
নিযুত নির্বাক মৃত্যুমুল্যে কেনা
তবুও আচম্বিতে আজ রাঙিয়ে দিয়ে যাও আমায়
প্রতিরোধহীন সশব্দ সহস্র চুম্বনে
ওষ্ঠাগত প্রাণ তবুও সে তৃপ্ত হোক
পুষ্পল পেলব ওই ওষ্ঠাধারের অমৃত অম্লতায়
স্বতঃই ক্রমহ্রাসমান অম্লজানের সমসত্বতা
তদুপরি স্পর্শিত স্তনাগ্ৰের নৃত্যানন্দে
লাভাতপ্ত হয়ে উঠুক ক্ষয়িষ্ণু শ্বাসপ্রশ্বাস
ম্রিয়মান মৃত্যুদূত শিয়রে দাঁড়িয়ে
সকলের অলক্ষ্যে সে সাক্ষী হোক
স্নায়ুক্ষয়ী সর্পিল শেষ শৃঙ্গারের
আর ভ্রূক্ষেপহীন প্রণত প্রণয়লীলায়
লজ্জিত হোক—পূনর্মুদ্রিত নৃশংস মৃত্যু পরোয়ানা
আটাশ বছর ধরে একটা আটপৌরে সুতি শাড়ি পরে
যখনই তুমি আমার মূর্ছিত ভাবনা জুড়ে  কিংবা অলীক দিবাস্বপ্নে হঠাৎ উদিত হও
জানিনা কেন প্রত্যেকবার পুরোনো নীল পাখি কাঁথাস্টিচের সেই সুতি শাড়িটি পরে একবয়েসি মুখাবয়ব নিয়ে সামনে এসে দাঁড়াও আলুথালু প্রসাধনবিহীন
যেন বিগত আটাশ বছর ধরে একটা সুতি শাড়ি পরে রয়েছো তুমি
অথচ ঘরমোছার কাজে বহুব্যবহারে জীর্ণবিশীর্ণ বিবর্ণ ছেঁড়া ন্যাকড়া হয়ে মহার্ঘ শাড়িটি অ্যাদ্দিনে হয়তো ফেলেই দিয়েছো সিটি কর্পোরেশনের নরক গুলজার ডাস্টবিনে
অথবা দিয়ে দিয়েছো কি যেন নাম কাপড়কাচার ওই কটূগন্ধী মেয়েটিকে যে আমার চিঠি পৌঁছে দিত তোমায় শাহী জর্দা দেয়া মিস্টি পানের বিনিময়ে
খেয়ে না খেয়ে টিউশনির টাকা দিয়ে হুট করেই কিনেছিলাম তোমার জন্য নিমা আনাম কালেকশনের বাজেটীয় রেঞ্জ থেকে
অনেকক্ষণ খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখছিলাম শাড়িটা
যেন বহতা অংশমালীর পাঠোদ্ধারকৃত অবোধ্য সিন্ধুলিপি
তিনি হেসে বললেন আপনার উনি বোধহয় শ্যামল বরণ— লম্বা চওড়া আর আমার মতোই মুখরা হবেন
শেক্সপিয়ার থেকে শ’চারেক বছর পরের বলেই হয়তো সে অব্দি আমি তোমার তেমন কেউ হয়ে উঠতে পারিনি কিংবা মুখচোরা তুমিও আমার ...
তুমিতো তখন শাড়িটি নিতেই চাওনি
কারণ বাড়িতে গিয়ে কী বলবে তোমার ধরিত্রীর মতো ছায়াপ্রহরী মাকে আর কী করেই বা সামলাবে ছোট দু’বোনের আনুবীক্ষণিক জিজ্ঞাসু দৃষ্টির সুতীক্ষ্মতাকে
মিথ্যেটা যে কখনোই রপ্ত করতে পারোনি তুমি
যেমন রপ্ত করতে পারোনি ভালোবাসার একটি বাক্যও গত আটাশ বছর দুশছাপ্পান্ন দিনে
তোমার আপাতসরল অভিব্যক্তির অপাপবিদ্ধ উত্তরাধুনিকতা নন্দনতাত্ত্বিক দূরত্বে ঠেলে দিয়েছে এই আমায় পিঠ চাপড়ানো কৌশলী কবিতায়
অথচ নীল পাখি কাঁথাস্টিচের একটা পুরনো সুতি শাড়ি পরে অবলীলায় কাটিয়ে দিলে তুমি গত আটাশটি বছর
অনামিকা
দীপান্বিতা— তোমার আলোতে পথ চিনে নেব বলেই কি চারপাশে জমাট অন্ধকার যেন কৃষ্ণ-গহ্বর !
পুষ্পিতা— তোমার স্বর্গীয় সৌরভে মাতাল বলেই হয়তো পুঁতিগন্ধময় এ ভাগাড়ে পড়ে আছি একনাগাড়ে অনেকদিন;
অনিন্দিতা— তোমার বিনম্র উচ্চারণে সত্য-সুন্দরের ঝিলিক আছে বলেই কি নিন্দুকের বাজখাঁই আওয়াজ নিমেষেই ছত্রখান, যেন বিলীয়মান বুদ্বুদ;
অপরাজিতা— তোমার বাড়িয়ে দেয়া হিরণ্ময় হাতখানি আঁকড়ে ধরেছি বলেই হয়তো এক কুটিল কুরুক্ষেত্রে আমি কতোটা অচঞ্চল আর নিঃশঙ্কচিত্ত!
দ্বিধান্বিতা— তোমায় সহজে বুঝতে পেরেছি বলেই হয়তো পরিচিত আর সবাই মুখোশ পাল্টে অসম্ভব অচেনা, যেন গোলক ধাঁধা...
সমর্পিতা— তোমায় একদিন না একদিন হারাবো বলেই কি তবে এমনি করে সব কাঁটা পায়ে দলে অবশেষে আমার কাছে ফিরে আসা!
একটি ভালোবাসার কবিতা
বলো, ভালোবাসা কী দ্রোহের আরেক নাম নয়?
নাই যদি হবে কেনই বা অযথা আদি যুগলের স্বর্গচ্যূতি, গণদয়িতার জন্য ভ্যানগঘের স্বপ্রণোদিত কর্ণচ্ছেদ,
প্রণয়ী লেডি সিম্পসনের হাত ধরে অষ্টম এডওয়ার্ডের রাজ-সিংহাসন ত্যাগ,
কিংবা অবলীলায় ত্রিশ লাখ মানুষের আত্মাহুতি ।
বৈঠকী কবি, তোমার চাঁদ-ফুল-জোৎস্নার হাই তোলা কবিতাগুলোকে মীরাক্কেলের ভাঁড়ামিপূর্ণ পরিভাষায় ‘ভালোবাসা’ বলতে যেওনা, কারণ পেরেস্ত্রোয়কা গ্লাসনস্তের অব্যবহিত পর থেকে ভোদকা স্মিরনফের ছিপি গলে না বুঝে ঢুকে পড়ে খামোখাই খাবি খাচ্ছে বোতলবন্দি পঙক্তিগুলো আর লাল গুবরেপোকা।
তোমায় ভালোবাসতে
তোমায় ভালোবাসতে-বাসতে পুরোপুরি 
ভারসাম্যহীন হয়ে যেতে চাই আমি
আর ভারিক্কিগুলো সব খুট করে
ছেঁটে দিতে চাই
মর্মের মগডাল থেকে
ভারটা যে আসলেই ধারে কাটছে না
সেটা তো কাঠঠোকরাও জানে
ভারের কথায় ভারাক্রান্ত না হয়ে
এসো এবার সাম্যের কথাই বলি
আকৃতির অসমতাকে পুঁজি করে
সেই যে ঈশ্বর বনে গিয়েছিলাম তোমার
বেআক্কেলে সেসব অনেককাল ধরেই চলছে
অনায্য উদ্ভট উচ্চতাটাই কী শেষাবধি
তোমার প্রেমার্দ্র নোনতা ঠোঁটের কাছে
আমায় পৌঁছুতে দিচ্ছেনা কিছুতেই
সুহাসিনীর অলোকস্পর্শী শুভদৃষ্টি
নীরবতার  নীল খামে বন্দি  
প্রগাঢ় মর্মবেদনার যে শুকনো গোলাপকুঁড়ি
আর অনতি অতীতের
কুয়াশাকীর্ণ যে দীঘল দীর্ঘশ্বাস
বলো সাধ্য কী তার
রুখবে এই জোৎস্নাপ্লাবিত দন্তকৌমুদী হাসি;
আমার অন্তরের অন্তঃপুরে
প্রোথিত বিশ্বাসের যে শ্বাসমূল
ইস্পাতদৃঢ় নবায়িত প্রত্যয় তার:
সুহাসিনীর এই অলোকস্পর্শী শুভদৃষ্টি
সুকোমল শুশ্রূষা হবে
যাবতীয় জাগতিক দুঃখযন্ত্রণার;
অধিকন্তু , স্বাভাবিক সারল্যের এই উদ্ভাসিত মুখভঙ্গি
জানি বীরদর্পে লড়াই করে যাবে আমৃত্যু—
মানুষে মানুষে আরোপিত বৈষম্য,
বহুজাতিক সংঘপুঁজির বাজারী বেসাতি,
একপাক্ষিক দেহলিপ্সা
আর ক্ষমতায়িত বলাৎকারের প্রবল প্রতিপক্ষ রূপে।
ছোট ছোট লোকমার দুঃখগুলো
সুলোচনা— ছোট ছোট লোকমায় তোমার দেয়া  
দুঃখের মহার্ঘ সঞ্চয়গুলোই আমাকে প্রতিনিয়ত
বেজোস, বাফেট কিংবা গেটসের চাইতেও
ঐশ্বযর্শালী করে চলেছে;
আর সেকারণেই তোমার মৃণাল বাহুপাশে নিজেকে জড়িয়ে রেখে ঈজিয়ান সাগরের তীরে স্যান্টোরিনির সুর্যাস্ত দৃশ্য অবলোকনের স্বপ্নসাধ লালন করার চাইতেও মীর মশাররফ-এর বিষাদসিন্ধুর জলভাগে নিশ্চুপ অশ্রুপাত অধিকতর শ্রেয় মনে হয়।
সুলোচনা— তোমার নিপাতনে সিদ্ধ নৈয়ায়িক নিরুত্তাপ ভালোবাসা এই আমাকে
গড়চাপড়ার চালচুলোহীন মৌসুমী জাদুকর ফৈজদ্দির পযার্য়ে নামিয়ে দিয়েছে;
অথচ দেখো, তোমার উৎকেন্দ্রিক উপেক্ষার প্রতিটি প্রহর যন্ত্রণাদায়ক না হয়ে ক্রমাগতভাবে অনন্যকুশল উৎপ্রেক্ষায় রূপান্তরিত হচ্ছে ।
ভালোবাসার কাঙাল হয়তো ছিলাম এতোদিন না বুঝেই—
সুলোচনা বিশ্বাস করো— আমি তোমার ছোট ছোট লোকমায় দেয়া দুঃখগুলোর জন্য দারুণ ক্ষুধার্ত থাকি নিশিদিন!
© মাহফুজ আল-হোসেন
আমিনা’স পার্ল, মিরপুর, ঢাকা
কবি পরিচিতি
মাহফুজ আল-হোসেন গত শতকের নব্বইয়ের দশকের প্রথিতযশা কবি, নন্দনতাত্ত্বিক ও অনুবাদক। ১৯৬৮ সালের ২২ নভেম্বর কুষ্টিয়া জেলার নওদাখাঁড়ারা গ্ৰামে মাতুলালয়ে তাঁর জন্ম।শৈশবের কিছুকাল কেটেছে পৈত্রিক নিবাস চুয়াডাঙ্গা জেলার গড়চাপড়া গ্ৰামে। বেড়ে ওঠা, লেখাপড়া ও বসবাস ঢাকা শহরে। তিনি অধুনাবাদী চিন্তার লিটল ম্যাগাজিন ‘শালুক’-এর সহযোগী সম্পাদক এবং ভারতের কলকাতা থেকে প্রকাশিত  দ্বিভাষিক লিটারারি জার্নাল Litinfinite-এর এডিটোরিয়াল বোর্ড মেম্বার। এছাড়া তিনি ২০২১ সাল থেকে  Poetry and Literature World Vision-এর এক্সিকিউটিভ বোর্ড মেম্বার এবং এডমিন হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন। তাঁর প্রকাশিত কাব্যগ্ৰন্থসমূহ হলো : সুবাসিত  শব্দের ঘুমঘোর, প্রতীচ্যের বিউগল, কালকেউটের ট্যাক্সিডার্মি, Probably Poems Or May Not, দুঃখবিলাসের পুলিৎজার, সিজোফ্রেনিক রাখালবালিকা ও মনের বাঘ  এবং নিজের হাতে খুন  করেছি গতকাল। এছাড়াও বাংলা ও ইংরেজি ভাষায় লেখা কবির শতাধিক অগ্ৰন্থিত কবিতা , কাব্যানুবাদ এবং প্রবন্ধ প্রকাশিত হয়েছে স্বদেশ ও বিশ্বের অসংখ্য  লিটল্ ম্যাগাজিন, লিটারারি জার্নাল, পত্রপত্রিকাসহ কয়েকটি গ্লোবাল অ্যান্থোলজিতে। তাঁর বেশ কিছু  কবিতা অনূদিত হয়েছে ইংরেজি, সুইডিশ এবং স্প্যানিশ ভাষায়। তিনি ২০১৯ সালে তাঁর কাব্যগ্ৰন্থ ‘সুবাসিত শব্দের ঘুমঘোর’ -এর জন্য বেহুলাবাংলা বেস্টসেলার পুরস্কার লাভ করেন। এছাড়া  দ্বিভাষিক কবি হিসেবে তিনি এবছর কিরগিজস্তানের প্রবীণ কবি Rahim Karim Karimov-এর নামে নবপ্রবর্তিত Rahim Karim World Prize 2022-এর জন্য মনোনীত হয়েছেন। হিসাববিজ্ঞানে স্নাতকোত্তর এবং আইনশাস্ত্রে স্নাতক কবি কর্মজীবনে জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের রেজিস্ট্রার পদে নিয়োজিত রয়েছেন। আইনজীবী পিতা ও সমাজসেবী মাতার পাঁচ সন্তানের মধ্যে মাহফুজ দ্বিতীয় এবং একটি উন্নয়ন সংস্থায় কর্মরত  ছায়াসঙ্গী মাহবুবা রহমানের সাথে বিগত আটাশ বছর ধরে প্রেমময় ও সুখী দাম্পত্য জীবন অতিবাহিত করছেন।
ইমেইল: mahfuzalhossain.bd2018@gmail.com
                                        
                                        
                                        
                                        
                                        
                                        
                                        
                                        
                                        
                                        
                                        
                                        
                        ইপেপার
                        
                                                	                            	জাতীয়
                           	                            	সারাদেশ
                           	                            	আন্তর্জাতিক
                           	                            	নগর-মহানগর
                           	                            	খেলা
                           	                            	বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি
                           	                            	শিক্ষা
                           	                            	অর্থ-বাণিজ্য
                           	                            	সংস্কৃতি
                           	                            	ক্যাম্পাস
                           	                            	মিডিয়া
                           	                            	অপরাধ ও দুর্নীতি
                           	                            	রাজনীতি
                           	                            	শোক ও স্মরন
                           	                            	প্রবাস
                           	                            নারীর প্রতি সহিংসতা
                            বিনোদন
                                                                        	                            	সম্পাদকীয়
                           	                            	উপ-সম্পাদকীয়
                           	                            	মুক্ত আলোচনা
                           	                            	চিঠিপত্র
                           	                            	পাঠকের চিঠি
                           	                                            সোমবার, ০৩ অক্টোবর ২০২২
কবি মাহফুজ আল-হোসেন
প্রেম বিষয়ক
আপনি হতে তুমি কিংবা তুইয়ের মাঝামাঝি সারিসারি সন্নিবদ্ধ তমাল-তার পাশে একটা মেহগনিও  ছিল  না থাকার মতোই—তার গায়ে অযথাই একশ চার ডিগ্ৰি জ্বর ধরে আসা বৃষ্টিতে সেভাবে না ভিজেও —সেইসাথে কাশিও ছিল—তাও বোধহয় দিন-দুয়েক হবে—অনেকটা না থাকার মতোই—যেভাবে আনমনে ভাত গেলার সময় কারো অনুপস্থিতি মনে করিয়ে দিতে যতটুকু গলায় আটকায়—দীঘল দীর্ঘশ্বাস আর তার সাথে হৃদস্পন্দনের  হঠাৎ বৃদ্ধি পালস্ অক্সিমিটাররের রিডিংয়ের বাইরে;
জ্বর হলো মেহগনির আর তার ভাঁপে তমাল—তমালের মা-বাপ-দাদা-চৌদ্দগুষ্টি এখন লাইফ সাপোর্টে।
বলা নেই কওয়া নেই নিপাট ভদ্রলোক ‘আপনি’ হঠাৎ করেই তুইয়ের সাথে তুই-তোকারি শুরু করেছে আর এই ন্যক্কারজনক পরিস্থিতি সামলাতে নৃতাত্ত্বিকভাবে তুমিই তো পারবে। কী বললে, ফেল মেরেছো? ভরসা রাখো— এখন নৈঃশব্দ্যের অশ্রুত অস্ফুট ধ্বনিগুলো সব সরব হয়ে উঠবে দ্বি-পাক্ষিক বরষা নামাতে ...
যখন তুমি আমায় ভাবছো 
যখন তুমি আমায় ভাবছো
ঠিক সে মুহূর্তেই আমিও যুক্ত হয়ে যাই তোমার সাথে
এখানে ব্যান্ডউডথ্ কিংবা বাফারিংয়ের কোনো বিড়ম্বনা নেই
এমনকি ন্যানো সেকেন্ডের নিযুত ভগ্নাংশের ঢের আগেই পৌঁছে যায় ভালোবাসার প্রতিটি হৃদকম্পন
আর আলোর গতিবেগের গণিত
বড় বেশি মন্থর মনে হয় এ মনোযোগাযোগের কাছে
এ অভাবিত অদৃশ্য অনুভবের জন্য কখনোই কোনো সাংখ্যিক প্রযুক্তির প্রয়োজন অনুভব করি না
ফিরে পাওয়া নিঃশ্বাসের অনির্বচনীয় সৌরভ আর কপালে জমে থাকা স্বেদবিন্দুর হীরকদ্যুতিময় স্ফটিক আনুবীক্ষণিক ক্ষুদেবার্তা হয়ে ঝড় তোলে সুতপ্ত রক্তকণিকায়...
শিল্পী : কামরুল হাসান
ভালোবাসলে বুকে বিপ্লব বেঁধে রাখতে হয়
ঠাসঘন কাচপোঁতা পাঁচিলে পীত ছত্রাক
তার ওপরে তিন সারি দাঁতাল কাঁটাতার
এদের নির্বিকার নিষেধাজ্ঞা
আর প্রহরারত অ্যালসেশিয়ানের আনুভূমিক উল্লম্ফন
এসবকিছুই উপেক্ষা করে প্রতি নিশীথে তোমার এই গবাক্ষ সাক্ষাৎ
লোকলজ্জা ভয়-সঙ্কোচ এ সবই যেন তোমার কাছে হাওয়াই মিঠাই
ছোটকাও আসতেন ঠিক এভাবে— একাত্তরে
মুখে দাঁড়ির ঘন জঙ্গল
পিঠ থেকে নামিয়ে রাখা স্টেনগান
ঠান্ডা চাহনির এক পলকে লাল সবুজের দিগন্ত রেখাটি যেন অনেকটাই স্পষ্ট
অবোধ শিশুর মতো দাদির কোলে বসে এক লোকমা দু’লোকমা করে পুরো হাঁড়িই সাবাড়
হঠাৎ দরজায় বুটের লাথি:
‘তুম লোগ সব ঝুট বোলা
শালে লোগ দরওয়াজা খোল দে’...
এ কী আমার গোলাপগোঁজা বিন্যস্ত চুল এক ঝটকায় মায়ের হলদেটে হাতে
ঘুরে দাঁড়াতেই দৃষ্টি আটকায় আধখোলা বুকশেলফে
ছোটকার অপ্রকাশিত পাণ্ডুলিপি
অব্যক্ত উচ্চারণে জানিয়ে দ্যায় :
ভালোবাসলে মায়াজাল মাড়িয়েই অনন্তের পথে হাঁটতে হয়
ভালোবাসলে বুকে বিপ্লব বেঁধে রাখতে হয়...
হলদে ঝুটিওয়ালা পাখিটি 
ব্যক্তিগত ঝুলবারান্দায় নিত্যদিন দোল খাওয়া 
হলদে ঝুটিওয়ালা পাখিটাকে
ইদানিং আর কোথাও দেখিনা
খুঁজেছি অনেক
ভাবলেশহীন ভর দুপুরে
মন খারাপের বিষন্ন বিকেলে
এমনকি কোজাগরি জোৎস্নায়
না কোথাও চিহ্ন মাত্র নেই
নিন্দুকেরা হয়তো বলবে ছিল নাকি কখনো
আরও ভালো করে খুঁজে দ্যাখো
হাইওয়ের পাশে দখল হয়ে যাওয়া ধানক্ষেতে
হঠাৎ হাঁটু গেঁড়ে বসা স্বপ্ন প্রকল্পের খালি জায়গায়
ঐতিহাসিক সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে—কর্তিত বৃক্ষের পড়ে থাকা অপাঙক্তেয় ডালে
অথবা অভিমানী চ্যাটবক্সে— ডিলিট করে দেয়া মেলোড্রামাটিক মেসেজে
পাখিটা আমার ওপরে না জানি রাগ করে অকস্মৎ দানাপানি খাওয়া ছেড়ে দিলো কিনা
ভীষণ শান্ত আর নির্বিবাদী বলেই তো জানতাম এতদিন
মানুষের অনায্য কোনো আচরণে হয়তো সে প্রবল প্রতিবাদী হয়ে উঠেছে
যেভাবে ভাষা কিংবা আত্মনিয়ন্ত্রণাধিকারের প্রশ্নে বিক্ষুব্ধ রাজবন্দি মৃত্যুঝুঁকি নিয়েও ঔপনিবেশিক কারাগারে আমরণ অনশনের কৌশল বেছে নেয়
অবলীলায়
নাকি— এই আষাঢ়ে জবুথবু হয়ে নীড় খুঁজে ফিরছে
অন্য কোনো হরিৎ হৃদয়ারণ্যে...
শীতাকাঙ্ক্ষী ভালোবাসা
মেট্রোপলিটন শীত না হয় থাকুক এমনই কোমল গান্ধার সৌগন্ধময় জেসমিন চায়ের মতোই;
অথবা সামান্য বেড়ে কর্কটক্রান্তির রেখায় আপতিত চুয়াডাঙ্গার কুলফি মালাই শৈত্যের চেয়ে কিছুটা কম— খানিকটা তোমার মার্জার গমনের বীতশোকের মতো;
কিংবা আত্মমগ্নতার আর্কটিক টালাজলে দীর্ঘক্ষণ ডুবে থাকা টার্ডিগ্ৰেডের মতোই পরপর দেয়া স্ট্যাটাসগুলোতে নীল পছন্দ কিংবা প্রগাঢ় ভালোবাসাসূচক টকটকে লাল প্রতিক্রিয়া না দেয়া কিংবা দাঁতকপাটি মেরে অবিমৃষ্যকারী মন্তব্য করা থেকে কিয়ৎকাল বিরত থেকে যদি হৃদস্পন্দনহীন টেস্টের পঞ্চম দিনে অপ্রত্যাশিত জয় কুড়িয়ে নেয়া যায় তবে মন্দ কী!
সুনসান সুনাব্য সেই ভালোবাসার শিউলি ভাত গ্যাসীয় চুলোয় চাপানো জলমগ্ন নাজিরশাইলের মতো হঠাৎ উথলে নাইবা পড়ুক;
বরং পৌষালি পড়ন্ত বিকেলে প্রাকবৈবাহিক অনিশ্চিত চুম্বন পর্বের মতো দুরুদুরু বক্ষে অপেক্ষমাণ প্রেম বিশুষ্ক কাঙাল ঠোঁটের আদলে পাতলা কাঁথার নিচে ঝিম মেরে পড়ে থাকুক হাড়কাঁপানো প্রবল শীতের প্রত্ন-প্রত্যাশায়...
মৃত্যু পরোয়ানা
অর্বাচীন অবুঝ ভালোবাসার এ অপূর্ণ প্রহর 
নিযুত নির্বাক মৃত্যুমুল্যে কেনা
তবুও আচম্বিতে আজ রাঙিয়ে দিয়ে যাও আমায়
প্রতিরোধহীন সশব্দ সহস্র চুম্বনে
ওষ্ঠাগত প্রাণ তবুও সে তৃপ্ত হোক
পুষ্পল পেলব ওই ওষ্ঠাধারের অমৃত অম্লতায়
স্বতঃই ক্রমহ্রাসমান অম্লজানের সমসত্বতা
তদুপরি স্পর্শিত স্তনাগ্ৰের নৃত্যানন্দে
লাভাতপ্ত হয়ে উঠুক ক্ষয়িষ্ণু শ্বাসপ্রশ্বাস
ম্রিয়মান মৃত্যুদূত শিয়রে দাঁড়িয়ে
সকলের অলক্ষ্যে সে সাক্ষী হোক
স্নায়ুক্ষয়ী সর্পিল শেষ শৃঙ্গারের
আর ভ্রূক্ষেপহীন প্রণত প্রণয়লীলায়
লজ্জিত হোক—পূনর্মুদ্রিত নৃশংস মৃত্যু পরোয়ানা
আটাশ বছর ধরে একটা আটপৌরে সুতি শাড়ি পরে
যখনই তুমি আমার মূর্ছিত ভাবনা জুড়ে  কিংবা অলীক দিবাস্বপ্নে হঠাৎ উদিত হও
জানিনা কেন প্রত্যেকবার পুরোনো নীল পাখি কাঁথাস্টিচের সেই সুতি শাড়িটি পরে একবয়েসি মুখাবয়ব নিয়ে সামনে এসে দাঁড়াও আলুথালু প্রসাধনবিহীন
যেন বিগত আটাশ বছর ধরে একটা সুতি শাড়ি পরে রয়েছো তুমি
অথচ ঘরমোছার কাজে বহুব্যবহারে জীর্ণবিশীর্ণ বিবর্ণ ছেঁড়া ন্যাকড়া হয়ে মহার্ঘ শাড়িটি অ্যাদ্দিনে হয়তো ফেলেই দিয়েছো সিটি কর্পোরেশনের নরক গুলজার ডাস্টবিনে
অথবা দিয়ে দিয়েছো কি যেন নাম কাপড়কাচার ওই কটূগন্ধী মেয়েটিকে যে আমার চিঠি পৌঁছে দিত তোমায় শাহী জর্দা দেয়া মিস্টি পানের বিনিময়ে
খেয়ে না খেয়ে টিউশনির টাকা দিয়ে হুট করেই কিনেছিলাম তোমার জন্য নিমা আনাম কালেকশনের বাজেটীয় রেঞ্জ থেকে
অনেকক্ষণ খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখছিলাম শাড়িটা
যেন বহতা অংশমালীর পাঠোদ্ধারকৃত অবোধ্য সিন্ধুলিপি
তিনি হেসে বললেন আপনার উনি বোধহয় শ্যামল বরণ— লম্বা চওড়া আর আমার মতোই মুখরা হবেন
শেক্সপিয়ার থেকে শ’চারেক বছর পরের বলেই হয়তো সে অব্দি আমি তোমার তেমন কেউ হয়ে উঠতে পারিনি কিংবা মুখচোরা তুমিও আমার ...
তুমিতো তখন শাড়িটি নিতেই চাওনি
কারণ বাড়িতে গিয়ে কী বলবে তোমার ধরিত্রীর মতো ছায়াপ্রহরী মাকে আর কী করেই বা সামলাবে ছোট দু’বোনের আনুবীক্ষণিক জিজ্ঞাসু দৃষ্টির সুতীক্ষ্মতাকে
মিথ্যেটা যে কখনোই রপ্ত করতে পারোনি তুমি
যেমন রপ্ত করতে পারোনি ভালোবাসার একটি বাক্যও গত আটাশ বছর দুশছাপ্পান্ন দিনে
তোমার আপাতসরল অভিব্যক্তির অপাপবিদ্ধ উত্তরাধুনিকতা নন্দনতাত্ত্বিক দূরত্বে ঠেলে দিয়েছে এই আমায় পিঠ চাপড়ানো কৌশলী কবিতায়
অথচ নীল পাখি কাঁথাস্টিচের একটা পুরনো সুতি শাড়ি পরে অবলীলায় কাটিয়ে দিলে তুমি গত আটাশটি বছর
অনামিকা
দীপান্বিতা— তোমার আলোতে পথ চিনে নেব বলেই কি চারপাশে জমাট অন্ধকার যেন কৃষ্ণ-গহ্বর !
পুষ্পিতা— তোমার স্বর্গীয় সৌরভে মাতাল বলেই হয়তো পুঁতিগন্ধময় এ ভাগাড়ে পড়ে আছি একনাগাড়ে অনেকদিন;
অনিন্দিতা— তোমার বিনম্র উচ্চারণে সত্য-সুন্দরের ঝিলিক আছে বলেই কি নিন্দুকের বাজখাঁই আওয়াজ নিমেষেই ছত্রখান, যেন বিলীয়মান বুদ্বুদ;
অপরাজিতা— তোমার বাড়িয়ে দেয়া হিরণ্ময় হাতখানি আঁকড়ে ধরেছি বলেই হয়তো এক কুটিল কুরুক্ষেত্রে আমি কতোটা অচঞ্চল আর নিঃশঙ্কচিত্ত!
দ্বিধান্বিতা— তোমায় সহজে বুঝতে পেরেছি বলেই হয়তো পরিচিত আর সবাই মুখোশ পাল্টে অসম্ভব অচেনা, যেন গোলক ধাঁধা...
সমর্পিতা— তোমায় একদিন না একদিন হারাবো বলেই কি তবে এমনি করে সব কাঁটা পায়ে দলে অবশেষে আমার কাছে ফিরে আসা!
একটি ভালোবাসার কবিতা
বলো, ভালোবাসা কী দ্রোহের আরেক নাম নয়?
নাই যদি হবে কেনই বা অযথা আদি যুগলের স্বর্গচ্যূতি, গণদয়িতার জন্য ভ্যানগঘের স্বপ্রণোদিত কর্ণচ্ছেদ,
প্রণয়ী লেডি সিম্পসনের হাত ধরে অষ্টম এডওয়ার্ডের রাজ-সিংহাসন ত্যাগ,
কিংবা অবলীলায় ত্রিশ লাখ মানুষের আত্মাহুতি ।
বৈঠকী কবি, তোমার চাঁদ-ফুল-জোৎস্নার হাই তোলা কবিতাগুলোকে মীরাক্কেলের ভাঁড়ামিপূর্ণ পরিভাষায় ‘ভালোবাসা’ বলতে যেওনা, কারণ পেরেস্ত্রোয়কা গ্লাসনস্তের অব্যবহিত পর থেকে ভোদকা স্মিরনফের ছিপি গলে না বুঝে ঢুকে পড়ে খামোখাই খাবি খাচ্ছে বোতলবন্দি পঙক্তিগুলো আর লাল গুবরেপোকা।
তোমায় ভালোবাসতে
তোমায় ভালোবাসতে-বাসতে পুরোপুরি 
ভারসাম্যহীন হয়ে যেতে চাই আমি
আর ভারিক্কিগুলো সব খুট করে
ছেঁটে দিতে চাই
মর্মের মগডাল থেকে
ভারটা যে আসলেই ধারে কাটছে না
সেটা তো কাঠঠোকরাও জানে
ভারের কথায় ভারাক্রান্ত না হয়ে
এসো এবার সাম্যের কথাই বলি
আকৃতির অসমতাকে পুঁজি করে
সেই যে ঈশ্বর বনে গিয়েছিলাম তোমার
বেআক্কেলে সেসব অনেককাল ধরেই চলছে
অনায্য উদ্ভট উচ্চতাটাই কী শেষাবধি
তোমার প্রেমার্দ্র নোনতা ঠোঁটের কাছে
আমায় পৌঁছুতে দিচ্ছেনা কিছুতেই
সুহাসিনীর অলোকস্পর্শী শুভদৃষ্টি
নীরবতার  নীল খামে বন্দি  
প্রগাঢ় মর্মবেদনার যে শুকনো গোলাপকুঁড়ি
আর অনতি অতীতের
কুয়াশাকীর্ণ যে দীঘল দীর্ঘশ্বাস
বলো সাধ্য কী তার
রুখবে এই জোৎস্নাপ্লাবিত দন্তকৌমুদী হাসি;
আমার অন্তরের অন্তঃপুরে
প্রোথিত বিশ্বাসের যে শ্বাসমূল
ইস্পাতদৃঢ় নবায়িত প্রত্যয় তার:
সুহাসিনীর এই অলোকস্পর্শী শুভদৃষ্টি
সুকোমল শুশ্রূষা হবে
যাবতীয় জাগতিক দুঃখযন্ত্রণার;
অধিকন্তু , স্বাভাবিক সারল্যের এই উদ্ভাসিত মুখভঙ্গি
জানি বীরদর্পে লড়াই করে যাবে আমৃত্যু—
মানুষে মানুষে আরোপিত বৈষম্য,
বহুজাতিক সংঘপুঁজির বাজারী বেসাতি,
একপাক্ষিক দেহলিপ্সা
আর ক্ষমতায়িত বলাৎকারের প্রবল প্রতিপক্ষ রূপে।
ছোট ছোট লোকমার দুঃখগুলো
সুলোচনা— ছোট ছোট লোকমায় তোমার দেয়া  
দুঃখের মহার্ঘ সঞ্চয়গুলোই আমাকে প্রতিনিয়ত
বেজোস, বাফেট কিংবা গেটসের চাইতেও
ঐশ্বযর্শালী করে চলেছে;
আর সেকারণেই তোমার মৃণাল বাহুপাশে নিজেকে জড়িয়ে রেখে ঈজিয়ান সাগরের তীরে স্যান্টোরিনির সুর্যাস্ত দৃশ্য অবলোকনের স্বপ্নসাধ লালন করার চাইতেও মীর মশাররফ-এর বিষাদসিন্ধুর জলভাগে নিশ্চুপ অশ্রুপাত অধিকতর শ্রেয় মনে হয়।
সুলোচনা— তোমার নিপাতনে সিদ্ধ নৈয়ায়িক নিরুত্তাপ ভালোবাসা এই আমাকে
গড়চাপড়ার চালচুলোহীন মৌসুমী জাদুকর ফৈজদ্দির পযার্য়ে নামিয়ে দিয়েছে;
অথচ দেখো, তোমার উৎকেন্দ্রিক উপেক্ষার প্রতিটি প্রহর যন্ত্রণাদায়ক না হয়ে ক্রমাগতভাবে অনন্যকুশল উৎপ্রেক্ষায় রূপান্তরিত হচ্ছে ।
ভালোবাসার কাঙাল হয়তো ছিলাম এতোদিন না বুঝেই—
সুলোচনা বিশ্বাস করো— আমি তোমার ছোট ছোট লোকমায় দেয়া দুঃখগুলোর জন্য দারুণ ক্ষুধার্ত থাকি নিশিদিন!
© মাহফুজ আল-হোসেন
আমিনা’স পার্ল, মিরপুর, ঢাকা
কবি পরিচিতি
মাহফুজ আল-হোসেন গত শতকের নব্বইয়ের দশকের প্রথিতযশা কবি, নন্দনতাত্ত্বিক ও অনুবাদক। ১৯৬৮ সালের ২২ নভেম্বর কুষ্টিয়া জেলার নওদাখাঁড়ারা গ্ৰামে মাতুলালয়ে তাঁর জন্ম।শৈশবের কিছুকাল কেটেছে পৈত্রিক নিবাস চুয়াডাঙ্গা জেলার গড়চাপড়া গ্ৰামে। বেড়ে ওঠা, লেখাপড়া ও বসবাস ঢাকা শহরে। তিনি অধুনাবাদী চিন্তার লিটল ম্যাগাজিন ‘শালুক’-এর সহযোগী সম্পাদক এবং ভারতের কলকাতা থেকে প্রকাশিত  দ্বিভাষিক লিটারারি জার্নাল Litinfinite-এর এডিটোরিয়াল বোর্ড মেম্বার। এছাড়া তিনি ২০২১ সাল থেকে  Poetry and Literature World Vision-এর এক্সিকিউটিভ বোর্ড মেম্বার এবং এডমিন হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন। তাঁর প্রকাশিত কাব্যগ্ৰন্থসমূহ হলো : সুবাসিত  শব্দের ঘুমঘোর, প্রতীচ্যের বিউগল, কালকেউটের ট্যাক্সিডার্মি, Probably Poems Or May Not, দুঃখবিলাসের পুলিৎজার, সিজোফ্রেনিক রাখালবালিকা ও মনের বাঘ  এবং নিজের হাতে খুন  করেছি গতকাল। এছাড়াও বাংলা ও ইংরেজি ভাষায় লেখা কবির শতাধিক অগ্ৰন্থিত কবিতা , কাব্যানুবাদ এবং প্রবন্ধ প্রকাশিত হয়েছে স্বদেশ ও বিশ্বের অসংখ্য  লিটল্ ম্যাগাজিন, লিটারারি জার্নাল, পত্রপত্রিকাসহ কয়েকটি গ্লোবাল অ্যান্থোলজিতে। তাঁর বেশ কিছু  কবিতা অনূদিত হয়েছে ইংরেজি, সুইডিশ এবং স্প্যানিশ ভাষায়। তিনি ২০১৯ সালে তাঁর কাব্যগ্ৰন্থ ‘সুবাসিত শব্দের ঘুমঘোর’ -এর জন্য বেহুলাবাংলা বেস্টসেলার পুরস্কার লাভ করেন। এছাড়া  দ্বিভাষিক কবি হিসেবে তিনি এবছর কিরগিজস্তানের প্রবীণ কবি Rahim Karim Karimov-এর নামে নবপ্রবর্তিত Rahim Karim World Prize 2022-এর জন্য মনোনীত হয়েছেন। হিসাববিজ্ঞানে স্নাতকোত্তর এবং আইনশাস্ত্রে স্নাতক কবি কর্মজীবনে জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের রেজিস্ট্রার পদে নিয়োজিত রয়েছেন। আইনজীবী পিতা ও সমাজসেবী মাতার পাঁচ সন্তানের মধ্যে মাহফুজ দ্বিতীয় এবং একটি উন্নয়ন সংস্থায় কর্মরত  ছায়াসঙ্গী মাহবুবা রহমানের সাথে বিগত আটাশ বছর ধরে প্রেমময় ও সুখী দাম্পত্য জীবন অতিবাহিত করছেন।
ইমেইল: mahfuzalhossain.bd2018@gmail.com