বাংলাদেশের বহুজাতিক সংস্কৃতির ভাণ্ডারে মণিপুরী সম্প্রদায় এক উজ্জ্বল অধ্যায়। ইতিহাস, পৌরাণিক কাহিনি, লোককথা ও সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যের সংমিশ্রণে মণিপুরী জনগোষ্ঠী গড়ে তুলেছে স্বতন্ত্র পরিচয়। আজকের প্রতিবেদনে আলোচনায় থাকছে তাদের ইতিহাস, সংস্কৃতি, ধর্ম, জীবনযাপন ও বাংলাদেশের সামাজিক প্রেক্ষাপটে তাদের অবদান। মহাভারতে বর্ণিত আছে, উত্তর-পূর্ব ভারতের পঞ্চপর্বত-বেষ্টিত মণিপুর রাজ্যে বাস করত নৃত্যগীতে পারদর্শী গন্ধর্ব জাতি। তাদের নামানুসারে একে বলা হতো ‘গন্ধর্ব রাজ্য’।
পরবর্তীতে দেবী দুর্গা ও মহাদেবের পৌরাণিক লীলাখেলার স্মৃতিচিহ্নস্বরূপ, যেখানে নাগপতি অনন্তের মণিবৃষ্টিতে উপত্যকা আলোকিত হয়েছিল, সেই ভূমিই পরিচিত হয় ‘মণিপুর’ নামে। মণিপুরে তিন প্রধান জনগোষ্ঠীর বসবাস। বিষ্ণুপ্রিয়া মণিপুরী: অর্জুন ও চিত্রাঙ্গদার বংশধর ক্ষত্রিয় বংশোদ্ভূত বৈষ্ণব সম্প্রদায়। মৈতৈ মণিপুরী: মঙ্গোলীয়-তিব্বতীয় উৎস থেকে আগত, যারা সনাতন বৈষ্ণব ধর্মে দীক্ষিত। পাঙান মণিপুরী: মৈতৈ মাতা ও মুসলিম পিতার সন্তানরা, যারা ইসলাম ধর্ম অনুসরণ করলেও মাতৃভাষায় কথা বলে।
১৮১৯-২৫ সালে মণিপুর-মায়ানমার যুদ্ধে পরাজয়ের পর বিপুলসংখ্যক মণিপুরী আশ্রয় নেন সিলেট অঞ্চলে। পরবর্তীতে ঢাকার তেজগাঁও, ব্রাহ্মণবাড়িয়ার কসবা, ময়মনসিংহের দুর্গাপুরসহ বিভিন্ন অঞ্চলে তাদের বসতি গড়ে ওঠে। বর্তমানে বৃহত্তর সিলেট—বিশেষত মৌলভীবাজার, সুনামগঞ্জ, হবিগঞ্জ ও সিলেটে সবচেয়ে বেশি মণিপুরী বাস করেন।
মণিপুরীরা আজ দুটি ভাষায় কথা বলেন। বিষ্ণুপ্রিয়া মণিপুরী, মৈতৈ বা মেইতেই লন মণিপুরী। উভয় ভাষাই ভারতের সংবিধানে স্বীকৃত। প্রাচীনতম সাহিত্য নিদর্শন ‘ঔগগি’ গীতিকবিতা। অষ্টম শতকে পাওয়া তাম্রলিপিও মণিপুরী সাহিত্যের প্রমাণ বহন করে।
আধুনিককালে কবি রবীন্দ্রনাথ, নজরুল ও জীবনানন্দ দাশ প্রমুখ বাংলা সাহিত্যিকদের প্রভাবে মণিপুরী কবিতা ও সাহিত্য সমৃদ্ধ হয়েছে। মণিপুরী সংস্কৃতির প্রাণ হলো নৃত্যগীত। রাসনৃত্য: রাধা-কৃষ্ণের লীলাকে কেন্দ্র করে ষড়ভাগে বিভক্ত—কুঞ্জরাস, গোপরাস, মহারাস, বসন্তরাস, নৃত্যরাস ও বেণিরাস। লাই হারাউবা: দেবতাদের উদ্দেশ্যে আনন্দ-নৃত্য। খুবাকুশেই: করতালি নৃত্য, বিশেষত রথযাত্রায় প্রচলিত। অন্যান্য: থাংচোলবী, পালা পূংচলোম, সাত সম্প্রদায় নৃত্য ইত্যাদি।
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর সিলেটে এসে মণিপুরী নৃত্য দেখে অভিভূত হন এবং শান্তিনিকেতনে তা প্রবর্তন করেন। ফলে মণিপুরী নৃত্য আন্তর্জাতিক পরিচিতি লাভ করে।
অধিকাংশ মণিপুরী গৌড়ীয় বৈষ্ণব, কৃষ্ণলীলাকে কেন্দ্র করে তাদের সমস্ত সামাজিক ও ধর্মীয় অনুষ্ঠান সম্পন্ন হয়। তবে ইসলাম গ্রহণকারী পাঙান মণিপুরীরাও আছেন। বৈষ্ণব আচার অনুযায়ী মণিপুরীরা নিরামিষাশী হলেও পাঙানরা মাংসাশী। তাদের সর্বোচ্চ ধর্মীয় অনুষ্ঠান শারদীয় মহারাসলীলা, যা আজও সিলেট অঞ্চলে গভীর আবেগে পালিত হয়। মণিপুরীরা মূলত কৃষিজীবী হলেও বয়নশিল্পেও তাদের বিশেষ খ্যাতি রয়েছে। প্রতিটি পরিবারে তাঁত থাকে, যেখানে নারীরা শাড়ি, চাদর, ঝুলন ব্যাগ ইত্যাদি বুনে। আত্মনির্ভরশীল মণিপুরীদের মধ্যে ভিক্ষুক নেই; নারী-পুরুষ উভয়ই অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডে যুক্ত। সিলেট অঞ্চলে মণিপুরীদের নিজস্ব ললিতকলা একাডেমি গড়ে উঠেছে।
বেতার ও টেলিভিশনে নিয়মিত সম্প্রচার হয় মণিপুরী গান ও নৃত্যের অনুষ্ঠান। শিক্ষা ও সামাজিক উন্নয়নে নতুন প্রজন্ম এগিয়ে আসছে।
মণিপুরী কবি-সাহিত্যিকরা বারবার স্বীকার করেছেন বাংলা ভাষা ও সাহিত্যের প্রতি তাদের গভীর ঋণ।
রবীন্দ্রনাথ, নজরুল ও জীবনানন্দের প্রভাব তাদের সাহিত্য ও সংস্কৃতিতে স্পষ্ট। বাংলাদেশে মণিপুরী সমাজ কেবল একটি জাতিগত গোষ্ঠী নয়, বরং নৃত্য, সংগীত, শিল্প ও সাহিত্যের এক অপরিসীম ভাণ্ডার। তাদের ঐতিহ্যবাহী নৃত্যগীত, বয়নশিল্প, ধর্মীয় অনুষ্ঠান ও সাহিত্যচর্চা আজও বাংলাদেশের সাংস্কৃতিক ভুবনে অপরিহার্য ভূমিকা রাখছে। মণিপুরীরা প্রমাণ করেছেন—সংস্কৃতি শুধু বিনোদনের মাধ্যম নয়, বরং অস্তিত্ব ও পরিচয়ের দৃঢ় ভিত্তি।
সোমবার, ০৮ সেপ্টেম্বর ২০২৫
বাংলাদেশের বহুজাতিক সংস্কৃতির ভাণ্ডারে মণিপুরী সম্প্রদায় এক উজ্জ্বল অধ্যায়। ইতিহাস, পৌরাণিক কাহিনি, লোককথা ও সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যের সংমিশ্রণে মণিপুরী জনগোষ্ঠী গড়ে তুলেছে স্বতন্ত্র পরিচয়। আজকের প্রতিবেদনে আলোচনায় থাকছে তাদের ইতিহাস, সংস্কৃতি, ধর্ম, জীবনযাপন ও বাংলাদেশের সামাজিক প্রেক্ষাপটে তাদের অবদান। মহাভারতে বর্ণিত আছে, উত্তর-পূর্ব ভারতের পঞ্চপর্বত-বেষ্টিত মণিপুর রাজ্যে বাস করত নৃত্যগীতে পারদর্শী গন্ধর্ব জাতি। তাদের নামানুসারে একে বলা হতো ‘গন্ধর্ব রাজ্য’।
পরবর্তীতে দেবী দুর্গা ও মহাদেবের পৌরাণিক লীলাখেলার স্মৃতিচিহ্নস্বরূপ, যেখানে নাগপতি অনন্তের মণিবৃষ্টিতে উপত্যকা আলোকিত হয়েছিল, সেই ভূমিই পরিচিত হয় ‘মণিপুর’ নামে। মণিপুরে তিন প্রধান জনগোষ্ঠীর বসবাস। বিষ্ণুপ্রিয়া মণিপুরী: অর্জুন ও চিত্রাঙ্গদার বংশধর ক্ষত্রিয় বংশোদ্ভূত বৈষ্ণব সম্প্রদায়। মৈতৈ মণিপুরী: মঙ্গোলীয়-তিব্বতীয় উৎস থেকে আগত, যারা সনাতন বৈষ্ণব ধর্মে দীক্ষিত। পাঙান মণিপুরী: মৈতৈ মাতা ও মুসলিম পিতার সন্তানরা, যারা ইসলাম ধর্ম অনুসরণ করলেও মাতৃভাষায় কথা বলে।
১৮১৯-২৫ সালে মণিপুর-মায়ানমার যুদ্ধে পরাজয়ের পর বিপুলসংখ্যক মণিপুরী আশ্রয় নেন সিলেট অঞ্চলে। পরবর্তীতে ঢাকার তেজগাঁও, ব্রাহ্মণবাড়িয়ার কসবা, ময়মনসিংহের দুর্গাপুরসহ বিভিন্ন অঞ্চলে তাদের বসতি গড়ে ওঠে। বর্তমানে বৃহত্তর সিলেট—বিশেষত মৌলভীবাজার, সুনামগঞ্জ, হবিগঞ্জ ও সিলেটে সবচেয়ে বেশি মণিপুরী বাস করেন।
মণিপুরীরা আজ দুটি ভাষায় কথা বলেন। বিষ্ণুপ্রিয়া মণিপুরী, মৈতৈ বা মেইতেই লন মণিপুরী। উভয় ভাষাই ভারতের সংবিধানে স্বীকৃত। প্রাচীনতম সাহিত্য নিদর্শন ‘ঔগগি’ গীতিকবিতা। অষ্টম শতকে পাওয়া তাম্রলিপিও মণিপুরী সাহিত্যের প্রমাণ বহন করে।
আধুনিককালে কবি রবীন্দ্রনাথ, নজরুল ও জীবনানন্দ দাশ প্রমুখ বাংলা সাহিত্যিকদের প্রভাবে মণিপুরী কবিতা ও সাহিত্য সমৃদ্ধ হয়েছে। মণিপুরী সংস্কৃতির প্রাণ হলো নৃত্যগীত। রাসনৃত্য: রাধা-কৃষ্ণের লীলাকে কেন্দ্র করে ষড়ভাগে বিভক্ত—কুঞ্জরাস, গোপরাস, মহারাস, বসন্তরাস, নৃত্যরাস ও বেণিরাস। লাই হারাউবা: দেবতাদের উদ্দেশ্যে আনন্দ-নৃত্য। খুবাকুশেই: করতালি নৃত্য, বিশেষত রথযাত্রায় প্রচলিত। অন্যান্য: থাংচোলবী, পালা পূংচলোম, সাত সম্প্রদায় নৃত্য ইত্যাদি।
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর সিলেটে এসে মণিপুরী নৃত্য দেখে অভিভূত হন এবং শান্তিনিকেতনে তা প্রবর্তন করেন। ফলে মণিপুরী নৃত্য আন্তর্জাতিক পরিচিতি লাভ করে।
অধিকাংশ মণিপুরী গৌড়ীয় বৈষ্ণব, কৃষ্ণলীলাকে কেন্দ্র করে তাদের সমস্ত সামাজিক ও ধর্মীয় অনুষ্ঠান সম্পন্ন হয়। তবে ইসলাম গ্রহণকারী পাঙান মণিপুরীরাও আছেন। বৈষ্ণব আচার অনুযায়ী মণিপুরীরা নিরামিষাশী হলেও পাঙানরা মাংসাশী। তাদের সর্বোচ্চ ধর্মীয় অনুষ্ঠান শারদীয় মহারাসলীলা, যা আজও সিলেট অঞ্চলে গভীর আবেগে পালিত হয়। মণিপুরীরা মূলত কৃষিজীবী হলেও বয়নশিল্পেও তাদের বিশেষ খ্যাতি রয়েছে। প্রতিটি পরিবারে তাঁত থাকে, যেখানে নারীরা শাড়ি, চাদর, ঝুলন ব্যাগ ইত্যাদি বুনে। আত্মনির্ভরশীল মণিপুরীদের মধ্যে ভিক্ষুক নেই; নারী-পুরুষ উভয়ই অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডে যুক্ত। সিলেট অঞ্চলে মণিপুরীদের নিজস্ব ললিতকলা একাডেমি গড়ে উঠেছে।
বেতার ও টেলিভিশনে নিয়মিত সম্প্রচার হয় মণিপুরী গান ও নৃত্যের অনুষ্ঠান। শিক্ষা ও সামাজিক উন্নয়নে নতুন প্রজন্ম এগিয়ে আসছে।
মণিপুরী কবি-সাহিত্যিকরা বারবার স্বীকার করেছেন বাংলা ভাষা ও সাহিত্যের প্রতি তাদের গভীর ঋণ।
রবীন্দ্রনাথ, নজরুল ও জীবনানন্দের প্রভাব তাদের সাহিত্য ও সংস্কৃতিতে স্পষ্ট। বাংলাদেশে মণিপুরী সমাজ কেবল একটি জাতিগত গোষ্ঠী নয়, বরং নৃত্য, সংগীত, শিল্প ও সাহিত্যের এক অপরিসীম ভাণ্ডার। তাদের ঐতিহ্যবাহী নৃত্যগীত, বয়নশিল্প, ধর্মীয় অনুষ্ঠান ও সাহিত্যচর্চা আজও বাংলাদেশের সাংস্কৃতিক ভুবনে অপরিহার্য ভূমিকা রাখছে। মণিপুরীরা প্রমাণ করেছেন—সংস্কৃতি শুধু বিনোদনের মাধ্যম নয়, বরং অস্তিত্ব ও পরিচয়ের দৃঢ় ভিত্তি।