যশোরের শার্শার কুমারপাড়ায় রং দেয়া মাটির খেলনা সাজাচ্ছেন এক নারী -সংবাদ
একসময় উৎসব এলে শিশুদের হাতে হাতে দেখা যেত মাটির খেলনা। হাঁড়ি-পাতিল, পুতুল, নৌকা, পালকি, হাতি, ঘোড়া, টিয়াপাখি, হাঁস, আম, কাঁঠালসহ নানা রঙে কারুকার্য করা খেলনা। তবে এই প্লাস্টিকের যুগে গ্রামবাংলার ঐতিহ্যবাহী মৃৎশিল্প আজ প্রায় বিলুপ্তির পথে।
তা সত্ত্বেও যশোরের শার্শা উপজেলার কুমোরপাড়ার পাল সম্প্রদায়ের ১৫-২০টি পরিবার এখনও ব্যস্ত সময় পার করছে। সারাবছর মাটির তৈরি পণ্যের তেমন চাহিদা না থাকলেও, আয়-রোজগারের আশায় এই পূজার সময়টাকেই বেছে নেন স্থানীয় মৃৎশিল্পীরা।
এবারও দুর্গাপূজায় প্রতিটি পূজামণ্ডপে মেলা বসবে। পূজামণ্ডপের আশেপাশে মাটির তৈরি রকমারি পণ্যের পসরা নিয়ে দোকান বসেছে। ক্রেতা টানতে সেগুলোতে নানা রঙের ছোঁয়ায় বাহারি নকশা ফুটিয়ে তুলছেন তারা।
শার্শা উপজেলার বেনাপোল, গোড়পাড়া, লক্ষণপুর, বালুন্ডা ও বাগআঁচড়া এলাকায় পাল সম্প্রদায়ের প্রায় শতাধিক মানুষ বসবাস করে। দীর্ঘদিন ধরে তারা এই পেশায় জীবিকা নির্বাহ করে আসছেন।
সামটার লক্ষণ পাল বলেন, ‘সকাল থেকে গভীর রাত পর্যন্ত নারী-পুরুষ সবাই মিলে তৈরি করছি মাটির হাঁড়ি-পাতিল, কড়াই, তৈজসপত্র, পুতুল, তরমুজ, আম, জাম, কাঁঠাল, টিয়া, হাঁস, মোরগ, হাতি, বাঘ, হরিণ, মাছ, গরু, বিড়াল, চাকা লাগানো নৌকা ও অন্য খেলনা সামগ্রী। সেগুলো পূজার মণ্ডপে বিক্রির জন্য এনেছি। আমি বানিয়ে দিই, বাড়ির ছেলে-মেয়েরা সেগুলিতে রঙ করে দেয়। পুজোর সময় এসব খেলনা বিক্রি করে আমাদের ছেলে-মেয়েরা আনন্দ করে।’
মৃৎশিল্পী বিশাখা পাল বলেন, ‘মাটির জিনিসপত্র তৈরি করে আমরা মেলায় বিক্রি করি। শিশুরা মাটির তৈরি খেলনা বেশি পছন্দ করে।’
শিশুরা কোন ধরনের খেলনা বেশি পছন্দ করে জানতে চাইলে জামতলার বরুণ পাল বলেন, ‘মাটির জিনিসের মধ্যে হাঁড়ি-পাতিল, টিয়াপাখি, চাকা লাগানো নৌকা এগুলোই শিশুরা বেশি পছন্দ করে। নারী ক্রেতারাই মাটির তৈরি ব্যাংকগুলো বেশি কেনেন।’
বাগআঁচড়ার মায়ারানী পাল বলেন, ‘পূজার সময় আমাদের দম ফেলার সময় থাকে না। সকাল থেকে রাত পর্যন্ত কাজ করতে হয়। তবে যে পরিমাণ পরিশ্রম করি, সে অনুযায়ী লাভ হয় না। অন্য কোথাও কাজ না করে বাড়িতে বসেই কাজ করি, তাই ভাল লাগে।’
জামতলার মৃৎশিল্পী জগন্নাথ পাল বলেন, ‘ক্রেতাদের পছন্দকে প্রাধান্য দিয়ে বাস্তবের সঙ্গে মিল রেখে নানা রঙের মিশ্রণে খেলনা ফুটিয়ে তোলা হয়। মাটির খেলনা বানাতে অনেক পরিশ্রম লাগে, কিন্তু দাম খুব কম পাওয়া যায়। তাই অনেকেই এই পেশা ছেড়ে দিয়েছেন।’
মৃৎশিল্পী চায়না রানী পাল বলেন, ‘আমাদের এই ব্যবসা এখন আর আগের মতো চলে না। তবে পূজার সময় ছোট ছোট ছেলেমেয়েদের খুশির জন্য মাটির খেলনা তৈরি করি। তাও বাজারে প্লাস্টিকের খেলনার কারণে এসব মাটির তৈরি খেলনা ও হাঁড়ি-পাতিল হারিয়ে যাচ্ছে।’
বাজারে মাটির তৈরি জিনিসপত্রের এখন আর তেমন চাহিদা নেই জানিয়ে লক্ষণপুরের মৃৎশিল্পী অন্ন পাল বলেন, ‘বাপ-দাদার পেশা বদলাতে পারছি না, তাই আঁকড়ে ধরে আছি। সারা বছর মাটির হাঁড়ি, পাতিল, সরা, কলসসহ বিভিন্ন সামগ্রী তৈরি করে বাজারে বিক্রি করি। তবে ভালো দাম না পাওয়ায় সংসার চালাতে কষ্ট হয়। তাই প্রতি বছর এই পূজার সময়টার জন্য আমরা অপেক্ষা করি।’
লোলিত পাল বলেন, ‘আগে পূজার সময় প্রচুর খেলনা বানাতাম, এখন প্লাস্টিকের খেলনার কারণে বিক্রি নেই, সংসার চালানো কঠিন হয়ে পড়েছে। আমাদের এই ব্যবসাটা বাপ-দাদারা করেছে, সেই ঐতিহ্য ধরে রাখার জন্য এখনও ছাড়তে পারছি না। সরকার যদি একটু সুদৃষ্টি দেয়, তাহলে আমরা আমাদের বাপ-দাদার ঐতিহ্য টিকিয়ে রাখতে পারব।’
যশোর জেলা পূজা উদযাপন পরিষদের সভাপতি বৈদ্যনাথ দাস বলেন, ‘শার্শা উপজেলার বেনাপোল, গোড়পাড়া, লক্ষণপুর, বালুন্ডা ও বাগআঁচড়া এলাকায় প্রায় শতাধিক পাল সম্প্রদায়ের লোকজন বসবাস করেন। এই অঞ্চলের পাল সম্প্রদায়ের মানুষ দীর্ঘদিন ধরে এই পেশার সঙ্গে জড়িয়ে জীবিকা নির্বাহ করে আসছেন। ঐতিহ্য ধরে রাখতে তারা এখনও পেশা বদল না করে মৃৎশিল্পের কাজ করে যাচ্ছেন। বর্তমানে তারা খুব কষ্টে আছেন।’
যশোরের শার্শার কুমারপাড়ায় রং দেয়া মাটির খেলনা সাজাচ্ছেন এক নারী -সংবাদ
সোমবার, ২৯ সেপ্টেম্বর ২০২৫
একসময় উৎসব এলে শিশুদের হাতে হাতে দেখা যেত মাটির খেলনা। হাঁড়ি-পাতিল, পুতুল, নৌকা, পালকি, হাতি, ঘোড়া, টিয়াপাখি, হাঁস, আম, কাঁঠালসহ নানা রঙে কারুকার্য করা খেলনা। তবে এই প্লাস্টিকের যুগে গ্রামবাংলার ঐতিহ্যবাহী মৃৎশিল্প আজ প্রায় বিলুপ্তির পথে।
তা সত্ত্বেও যশোরের শার্শা উপজেলার কুমোরপাড়ার পাল সম্প্রদায়ের ১৫-২০টি পরিবার এখনও ব্যস্ত সময় পার করছে। সারাবছর মাটির তৈরি পণ্যের তেমন চাহিদা না থাকলেও, আয়-রোজগারের আশায় এই পূজার সময়টাকেই বেছে নেন স্থানীয় মৃৎশিল্পীরা।
এবারও দুর্গাপূজায় প্রতিটি পূজামণ্ডপে মেলা বসবে। পূজামণ্ডপের আশেপাশে মাটির তৈরি রকমারি পণ্যের পসরা নিয়ে দোকান বসেছে। ক্রেতা টানতে সেগুলোতে নানা রঙের ছোঁয়ায় বাহারি নকশা ফুটিয়ে তুলছেন তারা।
শার্শা উপজেলার বেনাপোল, গোড়পাড়া, লক্ষণপুর, বালুন্ডা ও বাগআঁচড়া এলাকায় পাল সম্প্রদায়ের প্রায় শতাধিক মানুষ বসবাস করে। দীর্ঘদিন ধরে তারা এই পেশায় জীবিকা নির্বাহ করে আসছেন।
সামটার লক্ষণ পাল বলেন, ‘সকাল থেকে গভীর রাত পর্যন্ত নারী-পুরুষ সবাই মিলে তৈরি করছি মাটির হাঁড়ি-পাতিল, কড়াই, তৈজসপত্র, পুতুল, তরমুজ, আম, জাম, কাঁঠাল, টিয়া, হাঁস, মোরগ, হাতি, বাঘ, হরিণ, মাছ, গরু, বিড়াল, চাকা লাগানো নৌকা ও অন্য খেলনা সামগ্রী। সেগুলো পূজার মণ্ডপে বিক্রির জন্য এনেছি। আমি বানিয়ে দিই, বাড়ির ছেলে-মেয়েরা সেগুলিতে রঙ করে দেয়। পুজোর সময় এসব খেলনা বিক্রি করে আমাদের ছেলে-মেয়েরা আনন্দ করে।’
মৃৎশিল্পী বিশাখা পাল বলেন, ‘মাটির জিনিসপত্র তৈরি করে আমরা মেলায় বিক্রি করি। শিশুরা মাটির তৈরি খেলনা বেশি পছন্দ করে।’
শিশুরা কোন ধরনের খেলনা বেশি পছন্দ করে জানতে চাইলে জামতলার বরুণ পাল বলেন, ‘মাটির জিনিসের মধ্যে হাঁড়ি-পাতিল, টিয়াপাখি, চাকা লাগানো নৌকা এগুলোই শিশুরা বেশি পছন্দ করে। নারী ক্রেতারাই মাটির তৈরি ব্যাংকগুলো বেশি কেনেন।’
বাগআঁচড়ার মায়ারানী পাল বলেন, ‘পূজার সময় আমাদের দম ফেলার সময় থাকে না। সকাল থেকে রাত পর্যন্ত কাজ করতে হয়। তবে যে পরিমাণ পরিশ্রম করি, সে অনুযায়ী লাভ হয় না। অন্য কোথাও কাজ না করে বাড়িতে বসেই কাজ করি, তাই ভাল লাগে।’
জামতলার মৃৎশিল্পী জগন্নাথ পাল বলেন, ‘ক্রেতাদের পছন্দকে প্রাধান্য দিয়ে বাস্তবের সঙ্গে মিল রেখে নানা রঙের মিশ্রণে খেলনা ফুটিয়ে তোলা হয়। মাটির খেলনা বানাতে অনেক পরিশ্রম লাগে, কিন্তু দাম খুব কম পাওয়া যায়। তাই অনেকেই এই পেশা ছেড়ে দিয়েছেন।’
মৃৎশিল্পী চায়না রানী পাল বলেন, ‘আমাদের এই ব্যবসা এখন আর আগের মতো চলে না। তবে পূজার সময় ছোট ছোট ছেলেমেয়েদের খুশির জন্য মাটির খেলনা তৈরি করি। তাও বাজারে প্লাস্টিকের খেলনার কারণে এসব মাটির তৈরি খেলনা ও হাঁড়ি-পাতিল হারিয়ে যাচ্ছে।’
বাজারে মাটির তৈরি জিনিসপত্রের এখন আর তেমন চাহিদা নেই জানিয়ে লক্ষণপুরের মৃৎশিল্পী অন্ন পাল বলেন, ‘বাপ-দাদার পেশা বদলাতে পারছি না, তাই আঁকড়ে ধরে আছি। সারা বছর মাটির হাঁড়ি, পাতিল, সরা, কলসসহ বিভিন্ন সামগ্রী তৈরি করে বাজারে বিক্রি করি। তবে ভালো দাম না পাওয়ায় সংসার চালাতে কষ্ট হয়। তাই প্রতি বছর এই পূজার সময়টার জন্য আমরা অপেক্ষা করি।’
লোলিত পাল বলেন, ‘আগে পূজার সময় প্রচুর খেলনা বানাতাম, এখন প্লাস্টিকের খেলনার কারণে বিক্রি নেই, সংসার চালানো কঠিন হয়ে পড়েছে। আমাদের এই ব্যবসাটা বাপ-দাদারা করেছে, সেই ঐতিহ্য ধরে রাখার জন্য এখনও ছাড়তে পারছি না। সরকার যদি একটু সুদৃষ্টি দেয়, তাহলে আমরা আমাদের বাপ-দাদার ঐতিহ্য টিকিয়ে রাখতে পারব।’
যশোর জেলা পূজা উদযাপন পরিষদের সভাপতি বৈদ্যনাথ দাস বলেন, ‘শার্শা উপজেলার বেনাপোল, গোড়পাড়া, লক্ষণপুর, বালুন্ডা ও বাগআঁচড়া এলাকায় প্রায় শতাধিক পাল সম্প্রদায়ের লোকজন বসবাস করেন। এই অঞ্চলের পাল সম্প্রদায়ের মানুষ দীর্ঘদিন ধরে এই পেশার সঙ্গে জড়িয়ে জীবিকা নির্বাহ করে আসছেন। ঐতিহ্য ধরে রাখতে তারা এখনও পেশা বদল না করে মৃৎশিল্পের কাজ করে যাচ্ছেন। বর্তমানে তারা খুব কষ্টে আছেন।’