চুয়াডাঙ্গা : বৈঠা হাতে মাঝি -সংবাদ
নদীর স্রোত থেমে থাকে না। দিনশেষে সূর্য যেমন ডুবে যায়, আবার নতুন ভোর আসে তেমনি অনবরত সময় বয়ে যায় নিজের মতো করে। এই সময়ের স্রোতের সঙ্গেই লড়ছেন চুয়াডাঙ্গার দামুড়হুদা উপজেলার জীরাট ঘাটের এক অক্লান্ত মানুষ লিয়াকত আলী, যাকে স্থানীয়রা ভালোবেসে ডাকে লিয়াকত মাঝি নামে। ৬৭ বছরের এই বৃদ্ধ মাঝি যেন জীবন্ত এক কবিতা, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের খেয়ানৌকা কবিতার চরিত্রের মতো। ভোর থেকে রাত পর্যন্ত মাথাভাঙ্গা নদীর ঢেউয়ের সঙ্গে যুদ্ধ করে মানুষ পারাপার করান তিনি। তাঁর হাতে ধরা দাড় যেন জীবনের বৈঠা, যে বৈঠা দিয়ে তিনি শুধু মানুষ নয়, পার করান নিজের দিনকালকেও।
লিয়াকত মাঝির ঘর নদীর পাশেই, দামুড়হুদার পারকষ্ণপুর-মদনা ইউনিয়নের জীরাট গ্রামে। মাথাভাঙ্গা নদীর তীরে তাঁর ছোট্ট ঝুপড়ি ঘর, যেখানে তিনি থাকেন একা। বয়সের ভারে নুয়ে পড়া শরীর, মুখে কালের ছাপ, কিন্তু তবুও জীবনের সঙ্গে আপোষ করেননি তিনি। প্রতিদিন সকালে প্রথম সূর্যের আলো পড়ার আগেই তিনি চলে আসেন ঘাটে। হাতে পুরনো বৈঠা, গায়ে মলিন গামছা, চোখে দৃঢ়তা, নদীর ঢেউয়ের সঙ্গে যেন এক বন্ধুত্ব গড়ে উঠেছে তার।
নৌকায় ছই টাঙানো, পাশে জড়ানো পুরনো কাপড়,যেন জীবনক্লান্ত এক সঙ্গী তার সঙ্গে ভেসে চলে। কেউ অসুস্থ হলে, কেউ ওষুধ আনতে গেলে, কেউ বাজারে সবাই ভরসা করেন লিয়াকত মাঝির নৌকায়। দিনভর খাটুনি শেষে তার আয় মাত্র তিন থেকে চার শ’ টাকা। আজকের দ্রব্যমূল্যের আকাশছোয়া দিনে এই টাকায় সংসার টিকিয়ে রাখা যেন যুদ্ধের চেয়েও কঠিন। লিয়াকত মাঝি বলেন, আমার নিজের জমি নাই, ঘরও নাই। এক সময় অন্যের জমিতে থাকতাম, পরে চেয়ারম্যান-মেম্বাররা একটু সাহায্য করে সরকারি খাসজমিতে একটা ঘর পাই। এখন সেই ঘরেই থাকি একা। দুই ছেলে, এক মেয়ে, সবাই আলাদা হয়ে গেছে। এখন নিজের পেটে ভাত জোটাতে খেয়াই আমার ভরসা। কথার শেষে একরাশ দীর্ঘশ্বাস মিশে থাকে তাঁর গলায়। নদীর স্রোতের মতোই বয়ে চলে তাঁর জীবন,কখনও শান্ত, কখনও উত্তাল। জীরাট গ্রামের রুবেল বলেন, লিয়াকত ভাই না থাকলে এই ঘাট একেবারে বন্ধ হয়ে যেত। দশ বছর ধরে তিনি একা মানুষ পারাপার করে যাচ্ছেন। রাত-বিরেতেও যদি কারও দরকার পড়ে, তিনি না বলেন না। দর্শনা দাসপাড়ার শ্রী গিরিবালা বাঘদি যোগ করেন নদীতে যতই ঝড়-বৃষ্টি হোক, লিয়াকত মাঝি ঠিকই নৌকা নিয়ে ঘাটে হাজির হন। এমন মানুষ এখন আর দেখা যায় না।
দিন শেষে নদীর ঢেউ যেমন মিলিয়ে যায় অন্ধকারে, লিয়াকতের জীবনও তেমনি ডুবে যায় ক্লান্তির ঘূর্ণিতে। কিন্তু পরদিন আবার তিনি ভোরের আলোয় জেগে ওঠেন, যেন নদীরই এক অংশ হয়ে গেছেন তিনি। সম্ভবত নদীও জানে যতদিন মাঝি লিয়াকত বেচে আছেন, ততদিন মাথাভাঙ্গা নদী তার গল্প বলবে, বলবে এক মানুষ ও নদীর অবিচ্ছেদ্য সম্পর্কের কথা। নদী বয়ে চলে নিজের গতিতে, আর লিয়াকত মাঝি বয়ে চলেন জীবনের স্রোতে অক্লান্ত, অবিচল, নীরবে।
চুয়াডাঙ্গা : বৈঠা হাতে মাঝি -সংবাদ
বৃহস্পতিবার, ১৬ অক্টোবর ২০২৫
নদীর স্রোত থেমে থাকে না। দিনশেষে সূর্য যেমন ডুবে যায়, আবার নতুন ভোর আসে তেমনি অনবরত সময় বয়ে যায় নিজের মতো করে। এই সময়ের স্রোতের সঙ্গেই লড়ছেন চুয়াডাঙ্গার দামুড়হুদা উপজেলার জীরাট ঘাটের এক অক্লান্ত মানুষ লিয়াকত আলী, যাকে স্থানীয়রা ভালোবেসে ডাকে লিয়াকত মাঝি নামে। ৬৭ বছরের এই বৃদ্ধ মাঝি যেন জীবন্ত এক কবিতা, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের খেয়ানৌকা কবিতার চরিত্রের মতো। ভোর থেকে রাত পর্যন্ত মাথাভাঙ্গা নদীর ঢেউয়ের সঙ্গে যুদ্ধ করে মানুষ পারাপার করান তিনি। তাঁর হাতে ধরা দাড় যেন জীবনের বৈঠা, যে বৈঠা দিয়ে তিনি শুধু মানুষ নয়, পার করান নিজের দিনকালকেও।
লিয়াকত মাঝির ঘর নদীর পাশেই, দামুড়হুদার পারকষ্ণপুর-মদনা ইউনিয়নের জীরাট গ্রামে। মাথাভাঙ্গা নদীর তীরে তাঁর ছোট্ট ঝুপড়ি ঘর, যেখানে তিনি থাকেন একা। বয়সের ভারে নুয়ে পড়া শরীর, মুখে কালের ছাপ, কিন্তু তবুও জীবনের সঙ্গে আপোষ করেননি তিনি। প্রতিদিন সকালে প্রথম সূর্যের আলো পড়ার আগেই তিনি চলে আসেন ঘাটে। হাতে পুরনো বৈঠা, গায়ে মলিন গামছা, চোখে দৃঢ়তা, নদীর ঢেউয়ের সঙ্গে যেন এক বন্ধুত্ব গড়ে উঠেছে তার।
নৌকায় ছই টাঙানো, পাশে জড়ানো পুরনো কাপড়,যেন জীবনক্লান্ত এক সঙ্গী তার সঙ্গে ভেসে চলে। কেউ অসুস্থ হলে, কেউ ওষুধ আনতে গেলে, কেউ বাজারে সবাই ভরসা করেন লিয়াকত মাঝির নৌকায়। দিনভর খাটুনি শেষে তার আয় মাত্র তিন থেকে চার শ’ টাকা। আজকের দ্রব্যমূল্যের আকাশছোয়া দিনে এই টাকায় সংসার টিকিয়ে রাখা যেন যুদ্ধের চেয়েও কঠিন। লিয়াকত মাঝি বলেন, আমার নিজের জমি নাই, ঘরও নাই। এক সময় অন্যের জমিতে থাকতাম, পরে চেয়ারম্যান-মেম্বাররা একটু সাহায্য করে সরকারি খাসজমিতে একটা ঘর পাই। এখন সেই ঘরেই থাকি একা। দুই ছেলে, এক মেয়ে, সবাই আলাদা হয়ে গেছে। এখন নিজের পেটে ভাত জোটাতে খেয়াই আমার ভরসা। কথার শেষে একরাশ দীর্ঘশ্বাস মিশে থাকে তাঁর গলায়। নদীর স্রোতের মতোই বয়ে চলে তাঁর জীবন,কখনও শান্ত, কখনও উত্তাল। জীরাট গ্রামের রুবেল বলেন, লিয়াকত ভাই না থাকলে এই ঘাট একেবারে বন্ধ হয়ে যেত। দশ বছর ধরে তিনি একা মানুষ পারাপার করে যাচ্ছেন। রাত-বিরেতেও যদি কারও দরকার পড়ে, তিনি না বলেন না। দর্শনা দাসপাড়ার শ্রী গিরিবালা বাঘদি যোগ করেন নদীতে যতই ঝড়-বৃষ্টি হোক, লিয়াকত মাঝি ঠিকই নৌকা নিয়ে ঘাটে হাজির হন। এমন মানুষ এখন আর দেখা যায় না।
দিন শেষে নদীর ঢেউ যেমন মিলিয়ে যায় অন্ধকারে, লিয়াকতের জীবনও তেমনি ডুবে যায় ক্লান্তির ঘূর্ণিতে। কিন্তু পরদিন আবার তিনি ভোরের আলোয় জেগে ওঠেন, যেন নদীরই এক অংশ হয়ে গেছেন তিনি। সম্ভবত নদীও জানে যতদিন মাঝি লিয়াকত বেচে আছেন, ততদিন মাথাভাঙ্গা নদী তার গল্প বলবে, বলবে এক মানুষ ও নদীর অবিচ্ছেদ্য সম্পর্কের কথা। নদী বয়ে চলে নিজের গতিতে, আর লিয়াকত মাঝি বয়ে চলেন জীবনের স্রোতে অক্লান্ত, অবিচল, নীরবে।