মেট্রোরেলের বিয়ারিং প্যাড দুর্ঘটনায় নিহত আবুল কালাম আজাদের(৩৫) কফিনবাহী গাড়িটি সোমবার দিবাগত রাত ২টার দিকে শরীয়তপুরের নড়িয়া উপজেলার ঈশ্বরকাঠি গ্রামে পৌঁছায়।
সেই সঙ্গে নেমে আসে শোকের ছায়া—পরিবার, আত্মীয়স্বজন, প্রতিবেশী—সবাই তখন বুকফাটা কান্নায় ভেঙে পড়েন।
লাশবাহী ফ্রিজিং গাড়ির বাম পাশের জানালাটি খোলা রাখা হয়েছিল, যেন শেষবারের মতো সবাই প্রিয় আজাদকে দেখতে পারেন। জানালাটি কাচে আটকানো থাকায় বারবার ঘেমে যাচ্ছিল। সেই ঘাম জমা কাচ মুছছিলেন আজাদের স্ত্রী আইরিন আক্তার।
কাচের ওপারে তাকিয়ে তিনি কাঁদতে কাঁদতে বলতে থাকেন—“তুমি তোমার কলিজাদের (সন্তানদের) এতিম করে কোথায় গেলা? কে এখন ওদের কোক আর চকলেট কিনে দিবে?” িতিনি কান্না করতে করতে আরও বলেন—“আমার কলিজা ফেরত দেন, আর কিছু চাই না”
সাংবাদিকদের আইরিন বলেন, “যে জিনিসটা (মেট্রোরেলের বিয়ারিং প্যাড) পড়ে আমার স্বামী মারা গেল, যদি সচেতনভাবে ঠিকভাবে কাজ করা হতো—তাহলে আজকে আমার কলিজাকে হারাতে হতো না। সরকারের জানা উচিত ছিল মেট্রোরেলের নিচ দিয়ে মানুষ চলাচল করবে। তাহলে কেন তারা নিরাপত্তা নিশ্চিত করেনি? আজ আমার স্বামী মারা গেছে, কালকে অন্য কেউ মারা যেতে পারে। আমি সরকারের কাছে দাবি জানাই—এভাবে যেন আর কারও মৃত্যু না হয়। আমার মতো স্বামীহারা কিংবা সন্তানহারা যেন কেউ না হয়।”
আহাজারি করতে করতে আরও আইরিন বলেন, “গতকাল থেকেই ওরা (সন্তানরা) শুধু বাবাকে খুঁজে বেড়াচ্ছে। এখনো বোঝে না বাবাকে আর দেখা যাবে না। কিছুক্ষণ পরেই আবার বলবে—‘মা, ড্যাডি আসে নাই, ড্যাডি কোথায়?’ ওরা জানে না ওদের ড্যাডি আর কোক-চকলেট নিয়ে ফিরবে না।’’
স্বামীর মৃত্যুর খবর কীভাবে জানতে পারেন জানতে চাইলে আইরিন বলেন, “রাত বারোটার সময় ফোনে জানায়—আমার স্বামী দুর্ঘটনায় আহত হয়েছেন, হাসপাতালে ভর্তি আছেন। তখনও জানতাম না তিনি আর নেই। কেউ বলেনি আমার স্বামী মারা গেছেন।”
তিনি বলেন, “আমরা সাধারণ মানুষ, তেমন বড়লোক না, ভিআইপিও না। কিন্তু আমার স্বামী আমাদের ভিআইপির মতো রেখেছিল। ছেলেমেয়েদের কষ্ট হতে দিত না। সৎ উপায়ে রোজগার করে আমাদের হাসিখুশি রাখত। প্রতিদিন সন্তানদের খরচে দুই হাজার টাকার মতো দিত। এখন সব শেষ হয়ে গেছে।
সরকারকে উদ্দেশ্য করে তিনি বলেন, “আমার কলিজা কে ফেরত দেন। আমার স্বামীকে ফেরত দেন। আমার সন্তানদের বাবাকে দেখতে দিন। ওরা এখন কীভাবে বাঁচবে, কে ওদের দেখবে?
আজাদের বড় ভাইয়ের স্ত্রী আসমা বেগম বাড়ির উঠোনে বসে হাউমাউ করে কাঁদছিলেন। তিনি বলেন, “শ্বশুর-শাশুড়ি মারা যাওয়ার পর ওকে (আবুল কালাম) আমি নিজের সন্তানের মতো মানুষ করেছি। ও আমাকে মায়ের মতো জানত। সব আবদার আমার কাছেই করত।গতকাল সকাল ১১টার দিকে ফোনে বলেছিল—‘নদীতে ইলিশ ধরা শেষ হয়েছে, আমার জন্য কিছু পদ্মার ইলিশ রেখে দিও। বৃহস্পতিবার এসে নিয়ে যাব। কিন্তু তার আগেই এলো ওর লাশ। কে জানত এটাই হবে শেষ কথা!”
শরীয়তপুরের নড়িয়া উপজেলার ঈশ্বরকাঠি গ্রামের মৃত জলিল চৌকদারের ছোট ছেলে আবুল কালাম আজাদ চার ভাই ও ছয় বোনের মধ্যে সবার ছোট। বাবা-মা মারা যান ২০ বছর আগে। এরপর বড় ভাই-বোনের সংসারে বড় হন তিনি। পরিবারের স্বাচ্ছন্দ ফেরাতে ২০১২ সালে মালয়েশিয়া যান কাজের সন্ধানে। দেশে ফিরে ২০১৮ সালে পাশের গ্রামের আইরিন আক্তারকে বিয়ে করেন। তাদের মোহাম্মদ আব্দুল্লাহ(৫) নামে এক ছেলে ও সুরাইয়া আক্তার(৩) নামে এক মেয়ে রয়েছে।
দেশে ফিরে আজাদ ট্রাভেল এজেন্সির ব্যবসার সঙ্গে যুক্ত হন এবং পরিবার নিয়ে নারায়ণগঞ্জের জলকাঠি এলাকায় বসবাস করছিলেন।
রোববার (২৬ অক্টোবর) দুপুর সোয়া ১২টার দিকে রাজধানীর ফার্মগেট এলাকায় মেট্রোরেলের একটি পিলারের বিয়ারিং প্যাড খুলে পড়ে। সেটি পড়ে যায় পথচারী আবুল কালাম আজাদের উপর। ঘটনাস্থলেই তিনি মারা যান।
সোমবার সকালে নড়িয়ার পোরাগাছা ইসলামিয়া দাখিল মাদ্রাসা মাঠে জানাজা শেষে তাঁকে পৌর কবরস্থানে দাফন করা হয়।
ইপেপার
জাতীয়
সারাদেশ
আন্তর্জাতিক
নগর-মহানগর
খেলা
বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি
শিক্ষা
অর্থ-বাণিজ্য
সংস্কৃতি
ক্যাম্পাস
মিডিয়া
অপরাধ ও দুর্নীতি
রাজনীতি
শোক ও স্মরন
প্রবাস
নারীর প্রতি সহিংসতা
বিনোদন
সম্পাদকীয়
উপ-সম্পাদকীয়
মুক্ত আলোচনা
চিঠিপত্র
পাঠকের চিঠি
সোমবার, ২৭ অক্টোবর ২০২৫
মেট্রোরেলের বিয়ারিং প্যাড দুর্ঘটনায় নিহত আবুল কালাম আজাদের(৩৫) কফিনবাহী গাড়িটি সোমবার দিবাগত রাত ২টার দিকে শরীয়তপুরের নড়িয়া উপজেলার ঈশ্বরকাঠি গ্রামে পৌঁছায়।
সেই সঙ্গে নেমে আসে শোকের ছায়া—পরিবার, আত্মীয়স্বজন, প্রতিবেশী—সবাই তখন বুকফাটা কান্নায় ভেঙে পড়েন।
লাশবাহী ফ্রিজিং গাড়ির বাম পাশের জানালাটি খোলা রাখা হয়েছিল, যেন শেষবারের মতো সবাই প্রিয় আজাদকে দেখতে পারেন। জানালাটি কাচে আটকানো থাকায় বারবার ঘেমে যাচ্ছিল। সেই ঘাম জমা কাচ মুছছিলেন আজাদের স্ত্রী আইরিন আক্তার।
কাচের ওপারে তাকিয়ে তিনি কাঁদতে কাঁদতে বলতে থাকেন—“তুমি তোমার কলিজাদের (সন্তানদের) এতিম করে কোথায় গেলা? কে এখন ওদের কোক আর চকলেট কিনে দিবে?” িতিনি কান্না করতে করতে আরও বলেন—“আমার কলিজা ফেরত দেন, আর কিছু চাই না”
সাংবাদিকদের আইরিন বলেন, “যে জিনিসটা (মেট্রোরেলের বিয়ারিং প্যাড) পড়ে আমার স্বামী মারা গেল, যদি সচেতনভাবে ঠিকভাবে কাজ করা হতো—তাহলে আজকে আমার কলিজাকে হারাতে হতো না। সরকারের জানা উচিত ছিল মেট্রোরেলের নিচ দিয়ে মানুষ চলাচল করবে। তাহলে কেন তারা নিরাপত্তা নিশ্চিত করেনি? আজ আমার স্বামী মারা গেছে, কালকে অন্য কেউ মারা যেতে পারে। আমি সরকারের কাছে দাবি জানাই—এভাবে যেন আর কারও মৃত্যু না হয়। আমার মতো স্বামীহারা কিংবা সন্তানহারা যেন কেউ না হয়।”
আহাজারি করতে করতে আরও আইরিন বলেন, “গতকাল থেকেই ওরা (সন্তানরা) শুধু বাবাকে খুঁজে বেড়াচ্ছে। এখনো বোঝে না বাবাকে আর দেখা যাবে না। কিছুক্ষণ পরেই আবার বলবে—‘মা, ড্যাডি আসে নাই, ড্যাডি কোথায়?’ ওরা জানে না ওদের ড্যাডি আর কোক-চকলেট নিয়ে ফিরবে না।’’
স্বামীর মৃত্যুর খবর কীভাবে জানতে পারেন জানতে চাইলে আইরিন বলেন, “রাত বারোটার সময় ফোনে জানায়—আমার স্বামী দুর্ঘটনায় আহত হয়েছেন, হাসপাতালে ভর্তি আছেন। তখনও জানতাম না তিনি আর নেই। কেউ বলেনি আমার স্বামী মারা গেছেন।”
তিনি বলেন, “আমরা সাধারণ মানুষ, তেমন বড়লোক না, ভিআইপিও না। কিন্তু আমার স্বামী আমাদের ভিআইপির মতো রেখেছিল। ছেলেমেয়েদের কষ্ট হতে দিত না। সৎ উপায়ে রোজগার করে আমাদের হাসিখুশি রাখত। প্রতিদিন সন্তানদের খরচে দুই হাজার টাকার মতো দিত। এখন সব শেষ হয়ে গেছে।
সরকারকে উদ্দেশ্য করে তিনি বলেন, “আমার কলিজা কে ফেরত দেন। আমার স্বামীকে ফেরত দেন। আমার সন্তানদের বাবাকে দেখতে দিন। ওরা এখন কীভাবে বাঁচবে, কে ওদের দেখবে?
আজাদের বড় ভাইয়ের স্ত্রী আসমা বেগম বাড়ির উঠোনে বসে হাউমাউ করে কাঁদছিলেন। তিনি বলেন, “শ্বশুর-শাশুড়ি মারা যাওয়ার পর ওকে (আবুল কালাম) আমি নিজের সন্তানের মতো মানুষ করেছি। ও আমাকে মায়ের মতো জানত। সব আবদার আমার কাছেই করত।গতকাল সকাল ১১টার দিকে ফোনে বলেছিল—‘নদীতে ইলিশ ধরা শেষ হয়েছে, আমার জন্য কিছু পদ্মার ইলিশ রেখে দিও। বৃহস্পতিবার এসে নিয়ে যাব। কিন্তু তার আগেই এলো ওর লাশ। কে জানত এটাই হবে শেষ কথা!”
শরীয়তপুরের নড়িয়া উপজেলার ঈশ্বরকাঠি গ্রামের মৃত জলিল চৌকদারের ছোট ছেলে আবুল কালাম আজাদ চার ভাই ও ছয় বোনের মধ্যে সবার ছোট। বাবা-মা মারা যান ২০ বছর আগে। এরপর বড় ভাই-বোনের সংসারে বড় হন তিনি। পরিবারের স্বাচ্ছন্দ ফেরাতে ২০১২ সালে মালয়েশিয়া যান কাজের সন্ধানে। দেশে ফিরে ২০১৮ সালে পাশের গ্রামের আইরিন আক্তারকে বিয়ে করেন। তাদের মোহাম্মদ আব্দুল্লাহ(৫) নামে এক ছেলে ও সুরাইয়া আক্তার(৩) নামে এক মেয়ে রয়েছে।
দেশে ফিরে আজাদ ট্রাভেল এজেন্সির ব্যবসার সঙ্গে যুক্ত হন এবং পরিবার নিয়ে নারায়ণগঞ্জের জলকাঠি এলাকায় বসবাস করছিলেন।
রোববার (২৬ অক্টোবর) দুপুর সোয়া ১২টার দিকে রাজধানীর ফার্মগেট এলাকায় মেট্রোরেলের একটি পিলারের বিয়ারিং প্যাড খুলে পড়ে। সেটি পড়ে যায় পথচারী আবুল কালাম আজাদের উপর। ঘটনাস্থলেই তিনি মারা যান।
সোমবার সকালে নড়িয়ার পোরাগাছা ইসলামিয়া দাখিল মাদ্রাসা মাঠে জানাজা শেষে তাঁকে পৌর কবরস্থানে দাফন করা হয়।