ভাঙ্গুড়া (পাবনা) : রাসায়নিক মেশানো সাদা বিষ বাজারে ছড়িয়ে পড়ছে খাঁটি দুধের নামে -সংবাদ
বাংলাদেশের দুধের রাজধানী হিসেবে পরিচিত পাবনা জেলার ভাঙ্গুড়া, চাটমোহর ও ফরিদপুর উপজেলা। চলনবিল অধ্যুষিত এ অঞ্চল থেকে প্রতিদিন সারাদেশে যায় কয়েক লাখ লিটার দুধ। কিন্তু এই বিশাল উৎপাদনের আড়ালে দীর্ঘদিন ধরে গড়ে উঠেছে ভয়ংকর নকল দুধের একটি চক্র। রাসায়নিক মেশানো সাদা বিষ বাজারে ছড়িয়ে পড়ছে খাঁটি দুধের নামে।
ভাঙ্গুড়া উপজেলা প্রাণিসম্পদ দপ্তরের তথ্য অনুযায়ী, শুধু ভাঙ্গুড়া উপজেলাতেই রয়েছে ৪ হাজার ৮৯০ জন গো–খামারি। প্রতিদিন তাঁরা উৎপাদন করেন প্রায় ১ লাখ ৬ হাজার ৭০০ লিটার খাঁটি দুধ। কিন্তু মাঠের বাস্তবতা বলছে সম্পূর্ণ ভিন্ন চিত্র।
অনুসন্ধানে জানা যায়, ভাঙ্গুড়া, চাটমোহর ও ফরিদপুরে ছোট ছোট বাড়ি, মাচা, দোকানঘর কিংবা বারান্দায় দীর্ঘদিন ধরে চলছে শতাধিক গোপন দুধ কারখানা। সেখানে ননী ফ্যাট তুলে নেওয়া পাতলা দুধে মেশানো হয় পানি, সয়াবিন তেল, গ্লুকোজ, স্যাকারিন, ইউরিয়া, ডিটারজেন্ট, কস্টিক সোডা ও নানা অজ্ঞাত রাসায়নিক জেলি। ব্লেন্ডারে কয়েক মিনিটেই তৈরি হয় দেখতে খাঁটি দুধের মতো সাদা ঘন তরল। পরিচয় গোপন রাখার শর্তে নকল দুধ তৈরির এক সহযোগী বলেন, ‘ঢাকার একটি সিন্ডিকেট কুরিয়ারে পাঠায় কেমিক্যাল। ৪০ লিটার পানসে দুধে মাত্র ৪৫০ টাকার কেমিক্যাল মিশালেই হয়ে যায় উচ্চ ফ্যাটের দুধ। এটি বিক্রি করা হয় প্রায় ২ হাজার ২০০ টাকায়। প্রতি ৪০ লিটারে লাভ ১ হাজার ৭৫০ টাকা। তিনি আরও জানান, প্রতিটি চিলিং সেন্টারে দুধ দিতে হলে কর্মকর্তাকে দিতে হয় ৫০০ টাকা করে। এই টাকা না দিলে নকল দুধ কেউ নেয় না বলেও দাবি তাঁর। ভাঙ্গুড়ায় রয়েছে নামে–বেনামে প্রায় অর্ধশত চিলিং সেন্টার। এর মধ্যে ২৭টি বিভিন্ন নামিদামি কোম্পানির। খামারিদের অভিযোগ, প্রতিযোগিতা ও লাভের লোভে অধিকাংশ চিলিং সেন্টারেই মান নিয়ন্ত্রণের নিয়ম মানা হয় না।
সাংবাদিক পরিচয়ে বক্তব্য চাইলে জগাতলা আকিজ চিলিং সেন্টারের কর্মকর্তা অভিযোগ অস্বীকার করেন। রাঙ্গালিয়া প্রাণ ডেইরির কর্মকর্তা কোনো মন্তব্য করতে চাননি। জগাতলা আড়ং ডেইরির চিলিং সেন্টারের কর্মকর্তা আবার ল্যাব ও অফিসে তালা ঝুলিয়ে সরে পড়েন। প্রশাসনের অভিযানে মিলেছে চাঞ্চল্যকর তথ্য, চলতি বছরের ২২ জুলাই চাটমোহরের নাঙ্গলমোড়া হাব সেন্টারে ভ্রাম্যমাণ আদালতের অভিযানে জব্দ হয় কয়েক হাজার লিটার নকল দুধ, কেমিক্যাল ও সরঞ্জাম।
ঘটনাস্থলেই তিন কর্মকর্তাকে ছয় মাসের কারাদ- দেওয়া হয়। ২০ সেপ্টেম্বর ভাঙ্গুড়ার মেন্দা খালপাড়ে পুলিশের অভিযানে উদ্ধার হয় আরও এক নকল দুধ কারখানা। মালিক পালিয়ে গেলেও পরদিন দায়ের করা মামলায় গ্রেপ্তারের পর আদালত তাঁদের জামিন নামঞ্জুর করে কারাগারে পাঠায়।
খামারিরা বলেন, রাতদিন খেটে দুধ উৎপাদন করি, কিন্তু নকল দুধ কম দামে চিলিং সেন্টারে ঢুকে যায়। খাঁটি দুধ নিয়ে দাঁড়িয়ে থেকেও দাম পাই না। অন্য খামারি রহিম উদ্দিন বলেন, এভাবে চললে খামার বন্ধ করে দিতে হবে। উপজেলা দুগ্ধ ব্যবসায়ী সমিতির সাধারণ সম্পাদক শামীম আহমেদ বলেন, নকল দুধে পুরো বাজার বিপর্যস্ত। মান নিয়ন্ত্রণ নিশ্চিত করা ছাড়া সমাধান নেই।
ভাঙ্গুড়া প্রেসক্লাবের সভাপতি মো. রায়হান আলী বলেন, নকল দুধ চক্র এতটাই প্রভাবশালী যে তারা প্রশাসনকেও প্রভাবিত করতে পারে। সাংবাদিকরা বিষয়টি বহুদিন ধরে তুললেও বড় কোনো পদক্ষেপ নেই। দুর্নীতি প্রতিরোধ কমিটির সভাপতি অধ্যক্ষ শহিদুজ্জামান তরুণ বলেন, নিয়মিত অভিযান ও জড়িতদের সম্পদের উৎস অনুসন্ধান জরুরি। দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি ছাড়া এই চক্র ভাঙা যাবে না।
স্যানিটারি ইন্সপেক্টর নূরুল ইসলাম বলেন, ডিটারজেন্ট, ইউরিয়া, কেমিক্যাল মানুষের শরীরে স্থায়ী ক্ষতি করে। নকল দুধের এক ফোঁটাও নিরাপদ নয়। উপজেলা স্বাস্থ্য ও পরিবার পরিকল্পনা কর্মকর্তা ডা. হালিমা খানম বলেন, নকল দুধ দীর্ঘমেয়াদে ক্যানসার, অঙ্গ বিকল, শিশুর বিকাশগত সমস্যা এমনকি মৃত্যুঝুঁকি বাড়ায়। চলনবিলের সুনামঘেরা দুধ এখন ধীরে ধীরে গ্রাস করছে এক শক্তিশালী চক্র। খামারি, ভোক্তা ও ভবিষ্যৎ প্রজন্মকে রক্ষায় এখনই রাষ্ট্রীয় কঠোর ব্যবস্থা জরুরি। নইলে দুধের পরিবর্তে মানুষ পান করবে বিষ, আর নকল দুধের সাম্রাজ্য আরও ভয়ংকর হয়ে উঠবে।
ইপেপার
জাতীয়
সারাদেশ
আন্তর্জাতিক
নগর-মহানগর
খেলা
বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি
শিক্ষা
অর্থ-বাণিজ্য
সংস্কৃতি
ক্যাম্পাস
মিডিয়া
অপরাধ ও দুর্নীতি
রাজনীতি
শোক ও স্মরন
প্রবাস
নারীর প্রতি সহিংসতা
বিনোদন
সম্পাদকীয়
উপ-সম্পাদকীয়
মুক্ত আলোচনা
চিঠিপত্র
পাঠকের চিঠি
ভাঙ্গুড়া (পাবনা) : রাসায়নিক মেশানো সাদা বিষ বাজারে ছড়িয়ে পড়ছে খাঁটি দুধের নামে -সংবাদ
বৃহস্পতিবার, ২৭ নভেম্বর ২০২৫
বাংলাদেশের দুধের রাজধানী হিসেবে পরিচিত পাবনা জেলার ভাঙ্গুড়া, চাটমোহর ও ফরিদপুর উপজেলা। চলনবিল অধ্যুষিত এ অঞ্চল থেকে প্রতিদিন সারাদেশে যায় কয়েক লাখ লিটার দুধ। কিন্তু এই বিশাল উৎপাদনের আড়ালে দীর্ঘদিন ধরে গড়ে উঠেছে ভয়ংকর নকল দুধের একটি চক্র। রাসায়নিক মেশানো সাদা বিষ বাজারে ছড়িয়ে পড়ছে খাঁটি দুধের নামে।
ভাঙ্গুড়া উপজেলা প্রাণিসম্পদ দপ্তরের তথ্য অনুযায়ী, শুধু ভাঙ্গুড়া উপজেলাতেই রয়েছে ৪ হাজার ৮৯০ জন গো–খামারি। প্রতিদিন তাঁরা উৎপাদন করেন প্রায় ১ লাখ ৬ হাজার ৭০০ লিটার খাঁটি দুধ। কিন্তু মাঠের বাস্তবতা বলছে সম্পূর্ণ ভিন্ন চিত্র।
অনুসন্ধানে জানা যায়, ভাঙ্গুড়া, চাটমোহর ও ফরিদপুরে ছোট ছোট বাড়ি, মাচা, দোকানঘর কিংবা বারান্দায় দীর্ঘদিন ধরে চলছে শতাধিক গোপন দুধ কারখানা। সেখানে ননী ফ্যাট তুলে নেওয়া পাতলা দুধে মেশানো হয় পানি, সয়াবিন তেল, গ্লুকোজ, স্যাকারিন, ইউরিয়া, ডিটারজেন্ট, কস্টিক সোডা ও নানা অজ্ঞাত রাসায়নিক জেলি। ব্লেন্ডারে কয়েক মিনিটেই তৈরি হয় দেখতে খাঁটি দুধের মতো সাদা ঘন তরল। পরিচয় গোপন রাখার শর্তে নকল দুধ তৈরির এক সহযোগী বলেন, ‘ঢাকার একটি সিন্ডিকেট কুরিয়ারে পাঠায় কেমিক্যাল। ৪০ লিটার পানসে দুধে মাত্র ৪৫০ টাকার কেমিক্যাল মিশালেই হয়ে যায় উচ্চ ফ্যাটের দুধ। এটি বিক্রি করা হয় প্রায় ২ হাজার ২০০ টাকায়। প্রতি ৪০ লিটারে লাভ ১ হাজার ৭৫০ টাকা। তিনি আরও জানান, প্রতিটি চিলিং সেন্টারে দুধ দিতে হলে কর্মকর্তাকে দিতে হয় ৫০০ টাকা করে। এই টাকা না দিলে নকল দুধ কেউ নেয় না বলেও দাবি তাঁর। ভাঙ্গুড়ায় রয়েছে নামে–বেনামে প্রায় অর্ধশত চিলিং সেন্টার। এর মধ্যে ২৭টি বিভিন্ন নামিদামি কোম্পানির। খামারিদের অভিযোগ, প্রতিযোগিতা ও লাভের লোভে অধিকাংশ চিলিং সেন্টারেই মান নিয়ন্ত্রণের নিয়ম মানা হয় না।
সাংবাদিক পরিচয়ে বক্তব্য চাইলে জগাতলা আকিজ চিলিং সেন্টারের কর্মকর্তা অভিযোগ অস্বীকার করেন। রাঙ্গালিয়া প্রাণ ডেইরির কর্মকর্তা কোনো মন্তব্য করতে চাননি। জগাতলা আড়ং ডেইরির চিলিং সেন্টারের কর্মকর্তা আবার ল্যাব ও অফিসে তালা ঝুলিয়ে সরে পড়েন। প্রশাসনের অভিযানে মিলেছে চাঞ্চল্যকর তথ্য, চলতি বছরের ২২ জুলাই চাটমোহরের নাঙ্গলমোড়া হাব সেন্টারে ভ্রাম্যমাণ আদালতের অভিযানে জব্দ হয় কয়েক হাজার লিটার নকল দুধ, কেমিক্যাল ও সরঞ্জাম।
ঘটনাস্থলেই তিন কর্মকর্তাকে ছয় মাসের কারাদ- দেওয়া হয়। ২০ সেপ্টেম্বর ভাঙ্গুড়ার মেন্দা খালপাড়ে পুলিশের অভিযানে উদ্ধার হয় আরও এক নকল দুধ কারখানা। মালিক পালিয়ে গেলেও পরদিন দায়ের করা মামলায় গ্রেপ্তারের পর আদালত তাঁদের জামিন নামঞ্জুর করে কারাগারে পাঠায়।
খামারিরা বলেন, রাতদিন খেটে দুধ উৎপাদন করি, কিন্তু নকল দুধ কম দামে চিলিং সেন্টারে ঢুকে যায়। খাঁটি দুধ নিয়ে দাঁড়িয়ে থেকেও দাম পাই না। অন্য খামারি রহিম উদ্দিন বলেন, এভাবে চললে খামার বন্ধ করে দিতে হবে। উপজেলা দুগ্ধ ব্যবসায়ী সমিতির সাধারণ সম্পাদক শামীম আহমেদ বলেন, নকল দুধে পুরো বাজার বিপর্যস্ত। মান নিয়ন্ত্রণ নিশ্চিত করা ছাড়া সমাধান নেই।
ভাঙ্গুড়া প্রেসক্লাবের সভাপতি মো. রায়হান আলী বলেন, নকল দুধ চক্র এতটাই প্রভাবশালী যে তারা প্রশাসনকেও প্রভাবিত করতে পারে। সাংবাদিকরা বিষয়টি বহুদিন ধরে তুললেও বড় কোনো পদক্ষেপ নেই। দুর্নীতি প্রতিরোধ কমিটির সভাপতি অধ্যক্ষ শহিদুজ্জামান তরুণ বলেন, নিয়মিত অভিযান ও জড়িতদের সম্পদের উৎস অনুসন্ধান জরুরি। দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি ছাড়া এই চক্র ভাঙা যাবে না।
স্যানিটারি ইন্সপেক্টর নূরুল ইসলাম বলেন, ডিটারজেন্ট, ইউরিয়া, কেমিক্যাল মানুষের শরীরে স্থায়ী ক্ষতি করে। নকল দুধের এক ফোঁটাও নিরাপদ নয়। উপজেলা স্বাস্থ্য ও পরিবার পরিকল্পনা কর্মকর্তা ডা. হালিমা খানম বলেন, নকল দুধ দীর্ঘমেয়াদে ক্যানসার, অঙ্গ বিকল, শিশুর বিকাশগত সমস্যা এমনকি মৃত্যুঝুঁকি বাড়ায়। চলনবিলের সুনামঘেরা দুধ এখন ধীরে ধীরে গ্রাস করছে এক শক্তিশালী চক্র। খামারি, ভোক্তা ও ভবিষ্যৎ প্রজন্মকে রক্ষায় এখনই রাষ্ট্রীয় কঠোর ব্যবস্থা জরুরি। নইলে দুধের পরিবর্তে মানুষ পান করবে বিষ, আর নকল দুধের সাম্রাজ্য আরও ভয়ংকর হয়ে উঠবে।