image

গাইবান্ধার ১৫ অদম্য নারী সম্মাননা অর্জন

বৃহস্পতিবার, ১১ ডিসেম্বর ২০২৫
প্রতিনিধি, গাইবান্ধা

দারিদ্র্য, নির্যাতন, প্রাকৃতিক বিপর্যয় ও সামাজিক বাধার মধ্য দিয়ে সংগ্রাম করে জীবনে নিজের অবস্থান গড়ে তোলার দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছেন গাইবান্ধার ১৫ নারী। অর্থনৈতিকভাবে স্বাবলম্বী হওয়া, শিক্ষা ও চাকরিতে সাফল্য অর্জন, পরিবার ও সমাজে অনুপ্রেরণার উদাহরণ হিসেবে দাঁড়ানো-এই সব দিক বিবেচনা করে তাদেরকে মহিলা বিষয়ক অধিদপ্তরের মাধ্যমে জেলা ও উপজেলা প্রশাসন বেগম রোকেয়া দিবস ২০২৫ এ ‘অদম্য নারী’ হিসেবে সম্মাননা প্রদান করা হয়েছে।

জীবনের গ্রতিকূলতা জয় করে আজ এই নারীরা শুধু নিজেদের জীবন পরিবর্তন করেননি, বরং গ্রামের নারী সমাজে সাহস ও আত্মনির্ভরতার নতুন দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছেন। তাদের সাফল্যের পেঁছনো সহযোগিতা বেসরতরকারি উন্নয়ন সংস্থা গণউন্নয়ন কেন্দ্র’র বিভিন্ন কর্মকান্ড। নিচে তাদের সংগ্রামী জীবন ও সাফল্যের গল্প তুলে ধরা হলো।

আনজু বেগম : গাইবান্ধার ফুলছড়ি উপজেলার উত্তর উড়িয়া গ্রামের আনজু বেগম (৪৩)। স্বামী সবুর মিয়াকে নিয়ে প্রতিনিয়ত বন্যা ও নদীভাঙনের সাথে লড়াই করেই তাদের বেঁচে থাকা। দারিদ্র্যের চক্র ভাঙতে মাঝে মধ্যে তাকে দাতা সংস্থার ত্রাণ সহায়তার ওপর নির্ভর করতে হয়।

কষ্টের সংসার হলেও দুই কন্যাকে নিয়ে স্বপ্ন দেখেন তিনি-তাদের পড়াশোনা শিখিয়ে আত্মনির্ভরশীল করা। নিজের শিক্ষাজীবন খুব বেশি এগিয়ে নিতে না পারলেও মেয়েদের বিষয়ে তার অদম্য মনোবল ও ইচ্ছাশক্তিই বড় শক্তি হয়ে দাঁড়ায়।

সিমা বেগম : গোবিন্দগঞ্জ উপজেলার ঘুগা নয়াপাড়ার মোছা সিমা বেগম (৩৮)। বিয়ের কিছুদিন পর স্বামী থেকে বিচ্ছিন্ন হতে হয় তাকে। এইসময়ে এক শিশু কন্যার মাও হতে হয়। অভাব অনটনের মধ্যে চরম হতাতাশায় জীবনসংসারের হাল ধরতে হয়। সময়ের সঙ্গে জীবনযুদ্ধে ঘুরে দাঁড়াতে শুরু করেন সিমা। ছোট ব্যবসা, গৃহিণীর কাজ এবং শালিক পাখি পালন করে ধীরে ধীরে নিজের অবস্থার উন্নতি ঘটান। তিনি গণউন্নয়ন কেন্দ্রের ‘সিডস’ প্রকল্পের শালিক পাখি আত্মনির্ভরশীল দলের সঙ্গে যুক্ত হয়ে আত্মনির্ভরতা অর্জনের পথে আরও এগিয়ে যান।

লাকী আক্তার: সাঘাটা উপজেলার দক্ষিণ উল্যা গ্রামের লাকী আক্তার মাত্র ১৭ বছর বয়সে বিয়ে হয়। স্বামী ছিলেন বেকার ও মাদকাসক্ত এবং যৌতুকের দাবিতে প্রতিদিনই লাকি নির্যাতনের শিকার হতেন। বাধ্য হয়ে বাবার বাড়ি ফিরে গেলেও সেখানে কটূক্তি ও মানসিক চাপ থেকে তিনি মুক্তি পাননি। তবে লাকি হাল ছাড়েননি। আবার পড়াশোনা শুরু করেন, প্রাইভেট পড়িয়ে এবং বিভিন্ন এনজিওর স্বেচ্ছাসেবক হিসেবে কাজ করে নিজেকে গড়ে তুলতে থাকেন। ২০২৪ সালে তার মা স্ট্রমি ফাউন্ডেশনের ‘সিডস’ প্রকল্পের সদস্য হওয়ার সুযোগের মাধ্যমে লাকি তিন মাসের সেলাই প্রশিক্ষণ নেন এবং সংলাপ সেন্টারের এনিমেটর হিসেবে চাকরি পান। তার এই সংগ্রামী মনোবল ও অধ্যবসায়ের জন্য তিনি ‘অদম্য নারী’ পুরস্কারেও ভূষিত হয়েছেন।

ছায়া আকতার : ফুলছড়ির সিংড়িয়া গ্রামের মোছা ছায়া আকতার (৩৫) দারিদ্র্যের মধ্যে থেকেও শিক্ষার প্রতি অনমনীয় মনোযোগ বজায় রেখেছেন। রাষ্ট্রবিজ্ঞানে এমএ ডিগ্রি অর্জনের পর চাকরি করে তিনি নিজেকে ধীরে ধীরে এগিয়ে নিয়ে যাচ্ছেন।

ছায়ার পরিবার চলত বাবার সামান্য আয়ের ওপর নির্ভর করে, তবে নিজ চেষ্টায় তিনি আর্থিকভাবে স্বাবলম্বী হতে শুরু করেন। বর্তমানে তার সঞ্চয় ১০ হাজার টাকা, সঙ্গে রয়েছে দুইটি গরু ও হাঁস-মুরগি। তিনি আরও ভালো চাকরির সুযোগের দিকে নজর দিচ্ছেন।

মনিকা রানী : গাইবান্ধার ফুলছড়ি উপজেলার কাতলামারীর শ্রীমতি মনিকা রানী (৫০) দীর্ঘদিন দারিদ্র্য ও পারিবারিক অশান্তির সঙ্গে সংগ্রাম করেছেন। অষ্টম শ্রেণি পর্যন্ত পড়াশোনা করলেও জীবনের কঠিন বাস্তবতায় দিনমজুরের কাজ করতে বাধ্য হন। স্বামী বেকার হওয়ায় দুই সন্তানের দায়িত্ব একাই সামলেছেন তিনি।

লিমা খাতুন : সিরাজগঞ্জের উল্লাপাড়া উপজেলার পাঞ্চাকুরাসি ইউনিয়নের মোছা. লিমা খাতুন দীর্ঘদিন দাম্পত্য সহিংসতা ও মানসিক নির্যাতনের ভেতর দিয়ে জীবনের কঠিন পথ অতিক্রম করেছেন। সংসারে অশান্তি, অপমান ও অবহেলা তাকে একসময় মানসিকভাবে ভেঙে দিলেও হার মানেননি তিনি। নিজের আত্মসম্মান ও সন্তানদের ভবিষ্যতের কথা ভেবে তিনি সিদ্ধান্ত নেন নতুন করে দাঁড়ানোর।

মুক্তা রানী : নওগাঁর মান্দা উপজেলার মান্দা ইউনিয়নের মুক্তা রানী ছোটবেলা থেকেই নানা ধরনের সামাজিক চাপ, আর্থিক সংকট ও পরিবারিক নির্যাতনের মধ্য দিয়ে বেড়ে উঠেছেন। একসময় বাল্যবিয়ের শিকার হতে হতে তিনি জীবনের মোড় ঘুরিয়ে দেন।

সুমাইয়া আকতার : চাঁপাইনবাবগঞ্জের শিবগঞ্জ উপজেলার দুর্লভপুর ইউনিয়নের সুমাইয়া আকতার অল্প বয়সে বৈবাহিক নির্যাতন দেখে বুঝে ফেলেছিলেন, তাকে নিজের ভবিষ্যত নিজেকেই গড়ে নিতে হবে। শিক্ষার পাশাপাশি কর্মমুখী দক্ষতা অর্জন করে তিনি এখন স্বাবলম্বী ও সক্রিয় সামাজিক কর্মী হিসেবে পরিচিত।

ইসমেতারা খাতুন : সিরাজগঞ্জের উল্লাপাড়া উপজেলার পূর্ণিমাগাতী ইউনিয়নের মোছা. ইসমেতারা খাতুন বহু বছর ধরে তৃণমূল পর্যায়ে নারী ও কিশোরী উন্নয়নে নিরলসভাবে কাজ করছেন। শিক্ষা, স্বাস্থ্য সচেতনতা, নারীর নিরাপত্তা, সহিংসতা প্রতিরোধসহ বিভিন্ন ক্ষেত্রে তিনি নেতৃত্ব দিচ্ছেন।

মাজেদা বিবি : নওগাঁর মান্দা উপজেলার কুসুম্বা ইউনিয়নের মাজেদা বিবি সমাজসেবামূলক কাজ, অসহায় মানুষের সহায়তা, নারী অধিকার রক্ষা এবং শিক্ষায় সহযোগিতার ক্ষেত্রে উল্লেখযোগ্য ভূমিকা রেখেছেন।

আসমা বেগম : গাইবান্ধা জেলার সুন্দরগঞ্জ উপজেলার বরুয়াহাট গ্রামের আসমা বেগম দারিদ্র্য, নির্যাতন ও প্রাকৃতিক বিপর্যয়ের মধ্য দিয়ে আজ নিজের উদ্যোগে স্বনির্ভরতা হয়েছেন। মাত্র ১৩ বছর বয়সে বিয়ে হওয়ার পর কঠিন জীবনযাপন, শারীরিক সমস্যা ও মানসিক নির্যাতন সহ্য করতে হয়েছে।

আম্বিয়া বেগম : লালমনিরহাটের হাতিবান্ধা উপজেলার আম্বিয়া বেগম একসময়ে তিস্তা নদীর ভাঙনে ঘরবাড়ি হারানো এক সংগ্রামী নারী ছিলেন। বাবার মৃত্যু ও সংসারের সমস্ত দায়ভার নিজের কাঁধে নিয়ে তিনি দিনমজুরি, কৃষিকাজ ও বিভিন্ন কর্মসূচিতে অংশগ্রহণ করে জীবন কাটিয়েছেন। বর্তমানে তিনি গণ উন্নয়ন কেন্দ্র ও কনসার্ণ ওয়াল্ডওয়াইড এর সহায়তায় বাস্তবায়িত প্রকল্পের মাধ্যমে তিনি দোয়ানী গ্রামের কমিউনিটি রেজিলিয়েন্স অ্যাকশন গ্রুপ(ক্রাগ) এর কোষাধ্যক্ষ ও স্বনির্ভর দলের সভাপতিা দায়িত্ব পালন করছেন। তার নেতৃত্বে গ্রামে নারীদের প্রশিক্ষণ, স্বাস্থ্য সেবা, ভাতা প্রাপ্তি এবং দুর্যোগ প্রস্ততি নিশ্চিত হয়েছে।

শামছুনাহার বেগম : গাইবান্ধা সদর উপজেলার বোয়ালী ইউনিয়নের শামছুনাহার বেগম স্বামীর আকস্মিক মৃত্যুতে তিন সন্তান নিয়ে দারিদ্র্যের সঙ্গে লড়ছিলেন। এরপর গণ উন্নয়ন কেন্দ্রের প্রোসপারিটি প্রকল্পে যুক্ত হয়ে মুদির দোকান প্রশিক্ষণ গ্রহণ করেন।

প্রশিক্ষণ শেষে দোকানের মালামাল পেয়ে নিয়মিত বেচাকেনা ও হিসাব-নিকাশ চালিয়ে তিনি ব্যবসা সম্প্রসারিত করেন। আজ তার সংসার সুসম্পন্ন, সন্তানরা পড়াশোনায় মনোযোগী, এবং পরিবার অর্থনৈতিকভাবে স্বাবলম্বী। শামছুনাহার বেগম বলেন, প্রকল্পের সহায়তা ছাড়া আজ এই পর্যায়ে পৌঁছানো সম্ভব হতো না।

মহারানী বেগম : ফুলছড়ি উপজেলার কঞ্চিপাড়া ইউনিয়নের মহারানী বেগম জীবনের কঠিন পরিস্থিতি জয় করে নিজেকে স্বাবলম্বী করেছেন। স্বামীর অকাল মৃত্যু ও পারিবারিক সংকটের পর দুই সন্তান নিয়ে তিনি ২০০০ টাকা দিয়ে একটি কাঁচা সবজির দোকান খোলেন।

পরবর্তীতে গণ উন্নয়ন কেন্দ্রের প্রোসপারিটি প্রকল্প থেকে ক্ষুদ্র ব্যবসা প্রশিক্ষণ গ্রহণ করে কাঁচা সবজির দোকানের পাশাপাশি মুদির দোকানও চালু করেন। নিয়মিত বেচাকেনা ও হিসাব-নিকাশের মাধ্যমে আজ তার দৈনন্দিন আয়ের পরিমাণ এক হাজার টাকার বেশি। সন্তানদের পড়াশোনার খরচ দেওয়া ও সংসার চালানোসহ তিনি এখন আর্থিকভাবে স্বাবলম্বী।

‘সারাদেশ’ : আরও খবর

সম্প্রতি