চট্টগ্রামের ১০ ট্রাক অস্ত্র মামলায় হাইকোর্টের রায়
চট্টগ্রামের ১০ ট্রাক অস্ত্র চোরাচালান মামলায় সাবেক স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী লুৎফুজ্জামান বাবরসহ সাতজনকে খালাস দিয়েছেন হাইকোর্ট। একই সঙ্গে ছয় আসামির মৃত্যুদণ্ড কমিয়ে ১০ বছরের কারাদণ্ড এবং ভারতের বিচ্ছিন্নতাবাদী সংগঠন উলফার সামরিক কমান্ডার পরেশ বড়ুয়ার সাজা কমিয়ে আমৃত্যু কারাদণ্ড দিয়েছেন আদালত।
বিচারপতি মোস্তফা জামান ইসলাম ও বিচারপতি নাসরিন আক্তারের সমন্বয়ে গঠিত হাইকোর্ট বেঞ্চ বুধবার (১৭ ডিসেম্বর) এই রায় ঘোষণা করেন। ডেথ রেফারেন্স (মৃত্যুদণ্ড অনুমোদন) এবং আসামিদের আপিলের ওপর দীর্ঘ শুনানি শেষে এই রায় দেওয়া হয়।
হাইকোর্টের রায়ে খালাস পাওয়া আসামিরা হলেন:
১. সাবেক স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী লুৎফুজ্জামান বাবর
২. এনএসআইয়ের সাবেক মহাপরিচালক মেজর জেনারেল (অব.) রেজ্জাকুল হায়দার চৌধুরী
৩. রাষ্ট্রায়ত্ত সার কারখানা চিটাগং ইউরিয়া ফার্টিলাইজার লিমিটেডের (সিইউএফএল) সাবেক ব্যবস্থাপনা পরিচালক মোহসিন তালুকদার
৪. সিইউএফএলের সাবেক মহাব্যবস্থাপক (প্রশাসন) এ কে এম এনামুল হক
৫. সাবেক ভারপ্রাপ্ত শিল্প সচিব নুরুল আমিন
৬. এনএসআইয়ের সাবেক মহাপরিচালক ব্রিগেডিয়ার জেনারেল (অব.) আব্দুর রহিম
৭. জামায়াতের সাবেক আমির মাওলানা মতিউর রহমান নিজামী (তিনি অন্য মামলায় ফাঁসি কার্যকর হওয়ায় তার মামলাটি অকার্যকর হয়ে গেছে)।
এর মধ্যে মতিউর রহমান নিজামী এবং আব্দুর রহিম মৃত্যুবরণ করায় তাদের বিরুদ্ধে মামলা অকার্যকর হয়ে গেছে।
মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত পরেশ বড়ুয়ার সাজা কমিয়ে আমৃত্যু কারাদণ্ড দিয়েছেন হাইকোর্ট। উল্লেখ্য, তিনি ভারতের বিচ্ছিন্নতাবাদী সংগঠন উলফার (উইন্ডিপেন্ডেন্ট লিবারেশন ফ্রন্ট অব আসাম) সামরিক কমান্ডার।
হাইকোর্ট আরও ছয় আসামির মৃত্যুদণ্ড কমিয়ে ১০ বছরের কারাদণ্ড দিয়েছেন। তারা হলেন:
১. এনএসআইয়ের সাবেক উপ-পরিচালক মেজর (অব.) লিয়াকত হোসেন
২. এনএসআইয়ের সাবেক পরিচালক (নিরাপত্তা) উইং কমান্ডার (অব.) সাহাব উদ্দিন আহমেদ
৩. এনএসআইয়ের সাবেক মাঠ কর্মকর্তা আকবর হোসেন খান
৪. চোরাচালানি হিসেবে অভিযুক্ত হাফিজুর রহমান
৫. দীন মোহাম্মদ
৬. ট্রলার মালিক হাজী আবদুস সোবহান।
রাষ্ট্রপক্ষে ছিলেন ডেপুটি অ্যাটর্নি জেনারেল সুলতানা আক্তার রুবী ও সহকারী অ্যাটর্নি জেনারেল মো. আসিফ ইমরান জিসান। আসামিদের পক্ষে শুনানিতে অংশ নেন জ্যেষ্ঠ আইনজীবী এস এম শাহজাহান এবং বাবরের পক্ষে ছিলেন আইনজীবী মোহাম্মদ শিশির মনির।
রায়ের পর শিশির মনির সাংবাদিকদের বলেন, “মোট সাতজন খালাস পেয়েছেন, যাদের মধ্যে চারজন কন্টেস্ট করেছেন এবং একজন পলাতক ছিলেন। বাকি দুইজনের (নিজামী ও আব্দুর রহিম) মৃত্যুর কারণে তাদের মামলা এবেটেড হয়েছে।”
তিনি আরও বলেন, “লুৎফুজ্জামান বাবরের বিরুদ্ধে সুনির্দিষ্ট কোনো সাক্ষ্য-প্রমাণ পাওয়া যায়নি। তাকে দ্বিতীয় তদন্তের ভিত্তিতে মামলার প্রধান আসামি করা হয়েছিল, যা আদালত গ্রহণযোগ্য মনে করেননি।”
২০০৪ সালের ১ এপ্রিল চট্টগ্রামের কর্ণফুলী নদীর সিইউএফএল ঘাট থেকে ১০ ট্রাক ভর্তি চোরাচালান করা অস্ত্র ও গোলাবারুদ আটক করা হয়। এই বিপুল পরিমাণ অস্ত্র ভারতীয় বিচ্ছিন্নতাবাদী সংগঠন উলফার কাছে পাচারের উদ্দেশ্যে আনা হয়েছিল।
ঘটনার পরদিন কর্ণফুলী থানায় দুটি মামলা দায়ের করা হয়।একটি অস্ত্র আইনে এবং আরেকটি বিশেষ ক্ষমতা আইনে। তদন্তে বেরিয়ে আসে, এই অস্ত্র চোরাচালানে সরকারের উচ্চ পর্যায়ের কর্মকর্তা এবং রাজনীতিবিদদের সংশ্লিষ্টতা ছিল।
২০১৪ সালের ৩০ জানুয়ারি চট্টগ্রামের স্পেশাল ট্রাইব্যুনাল-১ এর বিচারক এসএম মজিবুর রহমান ১৪ আসামিকে মৃত্যুদণ্ড দেন। দণ্ডপ্রাপ্তদের মধ্যে ছিলেন:
লুৎফুজ্জামান বাবর,মতিউর রহমান নিজামী,পরেশ বড়ুয়া,রেজ্জাকুল হায়দার চৌধুরী,আব্দুর রহিম,নুরুল আমিন,মোহসিন তালুকদার,এ কে এম এনামুল হক
অন্যদিকে, অস্ত্র আইনে করা মামলায় আসামিদের সবাইকে যাবজ্জীবন কারাদণ্ড দেওয়া হয় এবং একটি ধারায় সাত বছরের কারাদণ্ডসহ পাঁচ লাখ টাকা জরিমানা করা হয়।
জজ আদালতের রায়ের পর ২০১৪ সালের ৬ ফেব্রুয়ারি ডেথ রেফারেন্স হাইকোর্টে পৌঁছায়। একই বছরের মধ্যেই দণ্ডপ্রাপ্ত আসামিরা হাইকোর্টে আপিল করেন।
হাইকোর্ট তার রায়ে উল্লেখ করেন, “মামলাটির তদন্তে গাফিলতি ছিল এবং সঠিক প্রক্রিয়ায় তথ্য-প্রমাণ উপস্থাপন করা হয়নি। রাজনৈতিক উদ্দেশ্যপ্রণোদিতভাবে কিছু আসামির বিরুদ্ধে অভিযোগ আনা হয়েছিল। সুনির্দিষ্ট প্রমাণের অভাবে লুৎফুজ্জামান বাবরসহ কয়েকজনকে খালাস দেওয়া হলো।”
১০ ট্রাক অস্ত্র চোরাচালান মামলা বাংলাদেশের ইতিহাসে অন্যতম বড় চোরাচালান মামলা। এই ঘটনায় প্রাথমিক তদন্তে গাফিলতির অভিযোগ ওঠে এবং রাজনৈতিক পট পরিবর্তনের পর দ্বিতীয় তদন্তে নতুন করে বেশ কয়েকজনকে আসামি করা হয়।
এই মামলার রায়ে রাজনৈতিক ও প্রশাসনিক মহলে ব্যাপক আলোচনা সৃষ্টি হয় এবং জাতীয় নিরাপত্তা ব্যবস্থার দুর্বলতা ও দুর্নীতি প্রকাশ্যে আসে।
এই রায়ের ফলে উচ্চ আদালত তদন্তের মান এবং বিচারিক প্রক্রিয়ার নিরপেক্ষতা নিশ্চিতের ওপর জোর দিয়েছে। একইসঙ্গে চোরাচালানের মতো গুরুতর অপরাধে রাজনৈতিক প্রভাবের বিষয়টিও আলোচনার কেন্দ্রবিন্দুতে এসেছে।
সংশোধিত এই রায়ের মাধ্যমে ১০ ট্রাক অস্ত্র চোরাচালান মামলার দীর্ঘ ২০ বছরের আইনি লড়াইয়ে নতুন মোড় নিল।
চট্টগ্রামের ১০ ট্রাক অস্ত্র মামলায় হাইকোর্টের রায়
বৃহস্পতিবার, ১৯ ডিসেম্বর ২০২৪
চট্টগ্রামের ১০ ট্রাক অস্ত্র চোরাচালান মামলায় সাবেক স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী লুৎফুজ্জামান বাবরসহ সাতজনকে খালাস দিয়েছেন হাইকোর্ট। একই সঙ্গে ছয় আসামির মৃত্যুদণ্ড কমিয়ে ১০ বছরের কারাদণ্ড এবং ভারতের বিচ্ছিন্নতাবাদী সংগঠন উলফার সামরিক কমান্ডার পরেশ বড়ুয়ার সাজা কমিয়ে আমৃত্যু কারাদণ্ড দিয়েছেন আদালত।
বিচারপতি মোস্তফা জামান ইসলাম ও বিচারপতি নাসরিন আক্তারের সমন্বয়ে গঠিত হাইকোর্ট বেঞ্চ বুধবার (১৭ ডিসেম্বর) এই রায় ঘোষণা করেন। ডেথ রেফারেন্স (মৃত্যুদণ্ড অনুমোদন) এবং আসামিদের আপিলের ওপর দীর্ঘ শুনানি শেষে এই রায় দেওয়া হয়।
হাইকোর্টের রায়ে খালাস পাওয়া আসামিরা হলেন:
১. সাবেক স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী লুৎফুজ্জামান বাবর
২. এনএসআইয়ের সাবেক মহাপরিচালক মেজর জেনারেল (অব.) রেজ্জাকুল হায়দার চৌধুরী
৩. রাষ্ট্রায়ত্ত সার কারখানা চিটাগং ইউরিয়া ফার্টিলাইজার লিমিটেডের (সিইউএফএল) সাবেক ব্যবস্থাপনা পরিচালক মোহসিন তালুকদার
৪. সিইউএফএলের সাবেক মহাব্যবস্থাপক (প্রশাসন) এ কে এম এনামুল হক
৫. সাবেক ভারপ্রাপ্ত শিল্প সচিব নুরুল আমিন
৬. এনএসআইয়ের সাবেক মহাপরিচালক ব্রিগেডিয়ার জেনারেল (অব.) আব্দুর রহিম
৭. জামায়াতের সাবেক আমির মাওলানা মতিউর রহমান নিজামী (তিনি অন্য মামলায় ফাঁসি কার্যকর হওয়ায় তার মামলাটি অকার্যকর হয়ে গেছে)।
এর মধ্যে মতিউর রহমান নিজামী এবং আব্দুর রহিম মৃত্যুবরণ করায় তাদের বিরুদ্ধে মামলা অকার্যকর হয়ে গেছে।
মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত পরেশ বড়ুয়ার সাজা কমিয়ে আমৃত্যু কারাদণ্ড দিয়েছেন হাইকোর্ট। উল্লেখ্য, তিনি ভারতের বিচ্ছিন্নতাবাদী সংগঠন উলফার (উইন্ডিপেন্ডেন্ট লিবারেশন ফ্রন্ট অব আসাম) সামরিক কমান্ডার।
হাইকোর্ট আরও ছয় আসামির মৃত্যুদণ্ড কমিয়ে ১০ বছরের কারাদণ্ড দিয়েছেন। তারা হলেন:
১. এনএসআইয়ের সাবেক উপ-পরিচালক মেজর (অব.) লিয়াকত হোসেন
২. এনএসআইয়ের সাবেক পরিচালক (নিরাপত্তা) উইং কমান্ডার (অব.) সাহাব উদ্দিন আহমেদ
৩. এনএসআইয়ের সাবেক মাঠ কর্মকর্তা আকবর হোসেন খান
৪. চোরাচালানি হিসেবে অভিযুক্ত হাফিজুর রহমান
৫. দীন মোহাম্মদ
৬. ট্রলার মালিক হাজী আবদুস সোবহান।
রাষ্ট্রপক্ষে ছিলেন ডেপুটি অ্যাটর্নি জেনারেল সুলতানা আক্তার রুবী ও সহকারী অ্যাটর্নি জেনারেল মো. আসিফ ইমরান জিসান। আসামিদের পক্ষে শুনানিতে অংশ নেন জ্যেষ্ঠ আইনজীবী এস এম শাহজাহান এবং বাবরের পক্ষে ছিলেন আইনজীবী মোহাম্মদ শিশির মনির।
রায়ের পর শিশির মনির সাংবাদিকদের বলেন, “মোট সাতজন খালাস পেয়েছেন, যাদের মধ্যে চারজন কন্টেস্ট করেছেন এবং একজন পলাতক ছিলেন। বাকি দুইজনের (নিজামী ও আব্দুর রহিম) মৃত্যুর কারণে তাদের মামলা এবেটেড হয়েছে।”
তিনি আরও বলেন, “লুৎফুজ্জামান বাবরের বিরুদ্ধে সুনির্দিষ্ট কোনো সাক্ষ্য-প্রমাণ পাওয়া যায়নি। তাকে দ্বিতীয় তদন্তের ভিত্তিতে মামলার প্রধান আসামি করা হয়েছিল, যা আদালত গ্রহণযোগ্য মনে করেননি।”
২০০৪ সালের ১ এপ্রিল চট্টগ্রামের কর্ণফুলী নদীর সিইউএফএল ঘাট থেকে ১০ ট্রাক ভর্তি চোরাচালান করা অস্ত্র ও গোলাবারুদ আটক করা হয়। এই বিপুল পরিমাণ অস্ত্র ভারতীয় বিচ্ছিন্নতাবাদী সংগঠন উলফার কাছে পাচারের উদ্দেশ্যে আনা হয়েছিল।
ঘটনার পরদিন কর্ণফুলী থানায় দুটি মামলা দায়ের করা হয়।একটি অস্ত্র আইনে এবং আরেকটি বিশেষ ক্ষমতা আইনে। তদন্তে বেরিয়ে আসে, এই অস্ত্র চোরাচালানে সরকারের উচ্চ পর্যায়ের কর্মকর্তা এবং রাজনীতিবিদদের সংশ্লিষ্টতা ছিল।
২০১৪ সালের ৩০ জানুয়ারি চট্টগ্রামের স্পেশাল ট্রাইব্যুনাল-১ এর বিচারক এসএম মজিবুর রহমান ১৪ আসামিকে মৃত্যুদণ্ড দেন। দণ্ডপ্রাপ্তদের মধ্যে ছিলেন:
লুৎফুজ্জামান বাবর,মতিউর রহমান নিজামী,পরেশ বড়ুয়া,রেজ্জাকুল হায়দার চৌধুরী,আব্দুর রহিম,নুরুল আমিন,মোহসিন তালুকদার,এ কে এম এনামুল হক
অন্যদিকে, অস্ত্র আইনে করা মামলায় আসামিদের সবাইকে যাবজ্জীবন কারাদণ্ড দেওয়া হয় এবং একটি ধারায় সাত বছরের কারাদণ্ডসহ পাঁচ লাখ টাকা জরিমানা করা হয়।
জজ আদালতের রায়ের পর ২০১৪ সালের ৬ ফেব্রুয়ারি ডেথ রেফারেন্স হাইকোর্টে পৌঁছায়। একই বছরের মধ্যেই দণ্ডপ্রাপ্ত আসামিরা হাইকোর্টে আপিল করেন।
হাইকোর্ট তার রায়ে উল্লেখ করেন, “মামলাটির তদন্তে গাফিলতি ছিল এবং সঠিক প্রক্রিয়ায় তথ্য-প্রমাণ উপস্থাপন করা হয়নি। রাজনৈতিক উদ্দেশ্যপ্রণোদিতভাবে কিছু আসামির বিরুদ্ধে অভিযোগ আনা হয়েছিল। সুনির্দিষ্ট প্রমাণের অভাবে লুৎফুজ্জামান বাবরসহ কয়েকজনকে খালাস দেওয়া হলো।”
১০ ট্রাক অস্ত্র চোরাচালান মামলা বাংলাদেশের ইতিহাসে অন্যতম বড় চোরাচালান মামলা। এই ঘটনায় প্রাথমিক তদন্তে গাফিলতির অভিযোগ ওঠে এবং রাজনৈতিক পট পরিবর্তনের পর দ্বিতীয় তদন্তে নতুন করে বেশ কয়েকজনকে আসামি করা হয়।
এই মামলার রায়ে রাজনৈতিক ও প্রশাসনিক মহলে ব্যাপক আলোচনা সৃষ্টি হয় এবং জাতীয় নিরাপত্তা ব্যবস্থার দুর্বলতা ও দুর্নীতি প্রকাশ্যে আসে।
এই রায়ের ফলে উচ্চ আদালত তদন্তের মান এবং বিচারিক প্রক্রিয়ার নিরপেক্ষতা নিশ্চিতের ওপর জোর দিয়েছে। একইসঙ্গে চোরাচালানের মতো গুরুতর অপরাধে রাজনৈতিক প্রভাবের বিষয়টিও আলোচনার কেন্দ্রবিন্দুতে এসেছে।
সংশোধিত এই রায়ের মাধ্যমে ১০ ট্রাক অস্ত্র চোরাচালান মামলার দীর্ঘ ২০ বছরের আইনি লড়াইয়ে নতুন মোড় নিল।