বুদ্ধিজীবী হত্যা নিয়ে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের উপ-উপাচার্য (অ্যাকাডেমিক) অধ্যাপক শামীম উদ্দিন খানের একটি বক্তব্য ঘিরে সমালোচনা ও বিক্ষোভের প্রেক্ষাপটে বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন আনুষ্ঠানিকভাবে তাদের অবস্থান ব্যাখ্যা করেছে।
বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষের ভাষ্য অনুযায়ী, শহীদ বুদ্ধিজীবী দিবস উপলক্ষে আয়োজিত আলোচনা সভায় অধ্যাপক শামীম উদ্দিন খানের বক্তব্যের কিছু অংশ খণ্ডিতভাবে প্রচার করা হয়েছে, যার ফলে জনমনে বিভ্রান্তি সৃষ্টি হচ্ছে বলে তারা মনে করে।
সোমবার সন্ধ্যায় বিশ্ববিদ্যালয়ের ভারপ্রাপ্ত রেজিস্ট্রার অধ্যাপক মোহাম্মদ সাইফুল ইসলামের স্বাক্ষর করা এক বিজ্ঞপ্তিতে এ বিষয়ে প্রশাসনের বক্তব্য তুলে ধরা হয়।
বিজ্ঞপ্তিতে উল্লেখ করা হয়, ১৪ ডিসেম্বর শহীদ বুদ্ধিজীবী দিবসে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনের উদ্যোগে ‘মুক্তচিন্তা, মুক্তিযুদ্ধ এবং একাত্তরের বুদ্ধিজীবী হত্যা’ শীর্ষক একটি আলোচনা সভা অনুষ্ঠিত হয়। সেখানে প্রবন্ধ উপস্থাপকের বক্তব্য এবং অন্যান্য বক্তার আলোচনার প্রেক্ষাপটে অধ্যাপক শামীম উদ্দিন খান তার আলোচনা পেশ করেন।
ওই আলোচনায় তিনি বলেন, একাত্তরে বুদ্ধিজীবী হত্যাকাণ্ড একটি আন্তর্জাতিক ষড়যন্ত্রের অংশ হতে পারে—এমন একটি ধারণার কথা তিনি একাডেমিক আলোচনার অংশ হিসেবে উপস্থাপন করেন। এ বিষয়ে বিভ্রান্তি দূর করতে সঠিক তথ্য উদঘাটনের লক্ষ্যে একটি স্বাধীন ও নিরপেক্ষ তদন্ত কমিশন গঠনের জন্য অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের কাছে দাবি জানান তিনি।
বিবৃতিতে আরও বলা হয়, উপ-উপাচার্য (অ্যাকাডেমিক) মনে করেন, ১৯৭২ সালে গুম হওয়া চলচ্চিত্রকার জহির রায়হানকে খুঁজে পাওয়া গেলে বুদ্ধিজীবী হত্যাকাণ্ড সংক্রান্ত অনেক গুরুত্বপূর্ণ তথ্য জানা সম্ভব হতো। তার মতে, মানুষ যেন সঠিক ইতিহাস জানতে না পারে, সেজন্যই জহির রায়হানকে গুম করা হয়েছিল। এ কারণে বিষয়টির সঠিক তদন্ত প্রয়োজন, যাতে জাতির মধ্যে কোনো বিভ্রান্তি না থাকে।
প্রশাসনের ব্যাখ্যায় বলা হয়, আলোচনা সভায় অধ্যাপক শামীম উদ্দিন খান জোর দিয়ে উল্লেখ করেন যে, সত্যিকারের ইতিহাস জানতে হলে ইতিহাসচর্চার সঠিক পদ্ধতি অনুসরণ করে গবেষণা করা জরুরি। গবেষণা ছাড়া কোনো ঐতিহাসিক প্রশ্নের মীমাংসায় পৌঁছানো সম্ভব নয় বলেও তিনি মন্তব্য করেন। একই সঙ্গে তিনি বলেন, ১৪ ডিসেম্বর বাঙালি জাতির বুদ্ধিজীবীদের হত্যা করা হয়েছে—এ বিষয়টি সবাই জানে।
বিজ্ঞপ্তিতে আরও উল্লেখ করা হয়, আলোচনার সময় তিনি মুজিবনগর সরকারের ভ্রাম্যমাণ রাষ্ট্রদূত ও বীর মুক্তিযোদ্ধা নুরুল কাদিরের লেখা ‘দুশো ছেষট্টি দিনে স্বাধীন’ বইয়ের একটি অংশ উদ্ধৃত করেন। সেখানে বলা হয়েছে, ৬ ডিসেম্বর থেকে পিছু হটতে থাকা পাকিস্তানি বাহিনীর পক্ষে ১৪ ডিসেম্বর এতগুলো মানুষের বাসায় গিয়ে গিয়ে বুদ্ধিজীবী হত্যা করা বিশ্বাসযোগ্য নয়।
এ ছাড়া শহীদ বুদ্ধিজীবী মুনির চৌধুরীর ছেলে আসিফ মুনিরের একটি টেলিভিশন সাক্ষাৎকারের কথাও তিনি উল্লেখ করেন, যেখানে আসিফ মুনির বলেছেন, ‘পাকিস্তানিরা আমার বাবাকে হত্যা করেনি’। এসব রেফারেন্সের আলোকে আলোচনা করতে গিয়ে অধ্যাপক শামীম উদ্দিন খান বলেন, যখন পাকিস্তানি বাহিনী বুঝতে পারে যে বাংলাদেশ স্বাধীন হতে যাচ্ছে, তখন তারা নিজের জীবন রক্ষার চিন্তায় ছিল। সেই পরিস্থিতিতে পাকিস্তানি বাহিনী পরিকল্পিতভাবে এমন হত্যাকাণ্ড ঘটিয়েছে—এটি তার কাছে বিশ্বাসযোগ্য মনে হয়নি। এই প্রসঙ্গেই তিনি ‘অবান্তর’ শব্দটি ব্যবহার করেন বলে বিবৃতিতে উল্লেখ করা হয়।
এ বক্তব্য গণমাধ্যমে ছড়িয়ে পড়ার পর বিভিন্ন ছাত্র সংগঠন ক্যাম্পাসে বিক্ষোভ করে। অধ্যাপক শামীম উদ্দিন খানের পদত্যাগ দাবিতে রোববার দুপুরে সর্বদলীয় ছাত্র ঐক্যের ব্যানারে প্রশাসনিক ভবনে তালা দেওয়া হয়।
বিজ্ঞপ্তির শেষাংশে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ জানায়, তারা সংবাদপত্রের স্বাধীনতায় পূর্ণ আস্থাশীল ও বিশ্বাসী। একই সঙ্গে সংবাদ পরিবেশনের সময় জনমনে যেন বিভ্রান্তি সৃষ্টি না হয়, সে বিষয়ে সংশ্লিষ্ট সবাইকে সতর্ক থাকার আহ্বান জানানো হয়।