image
ছবি: ইন্টারনেট থেকে সংগৃহীত

মোহাম্মদপুরে মা-মেয়ে খুন: আরেক বাসার চুরির তথ্যে গ্রেপ্তার, স্বামীসহ আয়েশা রিমান্ডে

বৃহস্পতিবার, ১১ ডিসেম্বর ২০২৫
নিজস্ব বার্তা পরিবেশক

রাজধানীর মোহাম্মদপুরে মা ও মেয়েকে হত্যার ঘটনায় গৃহকর্মী আয়েশাকে গ্রেপ্তারের পর পুলিশ বলছে, গৃহকর্মীর কাজে আগে থেকেই তার চুরির অভ্যাস ছিল। গত জুলাইয়ে মোহাম্মদপুরের বাবর রোডের একটি বাসা থেকে আয়েশা ৮ হাজার টাকা চুরি করেছিল বলে থানায় সাধারণ ডায়েরি রয়েছে। ৫ মাসের মধ্যে গৃহকর্মী হিসেবে কাছাকাছি এলাকাতেই আয়েশা কাজ নেয়ার চারদিনের মাথায় নতুন বাসার গৃহকর্ত্রী ও তার মেয়ে নৃশংসভাবে খুন হন।

শুরু থেকে প্রধান সন্দেহভাজন হিসেবে গৃহকর্মী আয়েশার কথা বললেও কোথাও তার বিস্তারিত তথ্য পাচ্ছিলেন না পুলিশ সদস্যরা। কাজে আসা-যাওয়ার চার দিনই মুখ ঢেকে চলাফেরা করায় সিসিটিভি ভিডিওতে তার চেহারা স্পষ্ট নয়। গলার একপাশে পোড়া দাগের তথ্যের ভিত্তিতে মোহাম্মদপুর থানার এক বছরের চুরির মামলা পর্যালোচনা করে বেরিয়ে আসে গত জুলাইয়ের একটি চুরির তথ্য। সেই তথ্যের সূত্র ধরেই আয়েশাকে শনাক্ত করে ঝালকাঠির নলছিটি থেকে গ্রেপ্তার করার কথা বলেছে পুলিশ।

স্বামীসহ আয়েশা রিমান্ডে

হত্যার ঘটনায় গ্রেপ্তার গৃহকর্মী আয়েশা আক্তারকে ৬ দিন এবং তার স্বামী রাব্বিকে ৩ দিন রিমান্ডে নিয়ে জিজ্ঞাসাবাদের অনুমতি দিয়েছে আদালত। মামলার তদন্ত কর্মকর্তা মোহাম্মদপুর থানার এসআই সহিদুল ওসমান মাসুম বৃহস্পতিবার, (১১ ডিসেম্বর ২০২৫) দুই আসামিকে আদালতে হাজির করে ১০ দিনের রিমান্ড চেয়ে আবেদন করেন। শুনানি শেষে ঢাকার মেট্রোপলিটন ম্যাজিস্ট্রেট মাহবুব আলম ৬ ও ৩ দিনের রিমান্ড মঞ্জুর করে আদেশ দেন বলে রাষ্ট্রপক্ষের আইনজীবী হারুনুর রশীদ জানান। রাষ্ট্রপক্ষের আইনজীবী হারুনুর রশীদ ও কাইয়ুম হোসেন নয়ন রিমান্ড আবেদনের ওপর শুনানি করেন।

কাইয়ুম হোসেন আদালতকে বলেন, ‘এটা একটা বীভৎস ঘটনা। ঢাকা শহরে এর আগে এমন বীভৎস ঘটনা দেখিনি। আমরা আমাদের স্ত্রী-সন্তান, বাবা-মাদের গৃহকর্মীর কাছে বাসায় রেখে আসি। তারা যদি এমন করে, তাহলে আমরা কাদের ওপর ভরসা করবো। ঘটনার সঙ্গে আরও কেউ জড়িত কিনা, তা জানার জন্য রিমান্ড প্রার্থনা করছি।’ আসামিদের পক্ষে আদালতে কোনো আইনজীবী ছিলেন না।

বৃহস্পতিবার, দুপুরে ডিএমপি মিডিয়া সেন্টারে সংবাদ সম্মেলনে এসে পুলিশের অতিরিক্ত কমিশনার (ক্রাইম অ্যান্ড অপারেশন্স) এস এন মো. নজরুল ইসলাম বলেছেন, ওই বাসায় কাজে যোগ দেয়ার সময় আয়েশার কোনো ঠিকানা বা যোগাযোগের নম্বর রাখা হয়নি। আগের একটি জিডির সূত্র ধরে জেনেভা ক্যাম্প এলাকায় বসবাস করে এমন একজন গৃহকর্মীর সন্ধান পাওয়া যায়।

এরপর সংশ্লিষ্টদের সঙ্গে কথা বলে প্রাপ্ত তথ্য ‘যাচাই-বাছাই’ করে আয়েশার সংশ্লিষ্ট একটি মোবাইল নম্বর পাওয়ার কথা জানিয়ে তিনি বলেন, ওই নম্বরে যোগাযোগ করলে ফোন রিসিভকারী তার নম্বর কখন, কে ব্যবহার করেছে তা বলতে পারেননি। ওই ব্যক্তি বলেন, মোবাইলের ডিসপ্লে নষ্ট থাকায় তা ঠিক করতে কিছুদিন আগে রাব্বী নামের এক ছোটভাইকে দিয়েছিলেন। তখন রাব্বী নম্বরটি ব্যবহার করে কথা বলে থাকতে পারে।

‘এভাবে রাব্বীকে শনাক্ত করা হয়। ওই ব্যক্তি জানান, রাব্বীর স্ত্রীর নাম আয়েশা, সে গৃহকর্মীর কাজ করে এবং জেনেভা ক্যাম্পে ভাড়া বাসায় থাকে। এভাবে ঘটনার ২৪ ঘণ্টার মধ্যে হত্যাকারী আয়েশার পরিচয় নিশ্চিত হওয়া যায়।’ এরপর আয়েশার খোঁজে হেমায়েতপুরে তার মায়ের বাসায়, রাব্বীর মায়ের বাসায় অভিযান চালানো হয়। তাদের কাছ থেকে বরিশাল যাওয়ার ধারণা পেয়ে পটুয়াখালীর দুমকিতে এবং পরে ঝালকাঠির নলছিটিতে রাব্বীর দাদার বাড়িতে অভিযান চালিয়ে রাব্বীসহ আয়েশাকে গ্রেপ্তার করা হয়। তাদের কাছ থেকে মোহাম্মদপুরের ওই বাসা থেকে খোয়া যাওয়া একটি ল্যাপটপও উদ্ধার করা হয়।

গত সোমবার মোহাম্মদপুরের শাহজাহান রোডের এক বাসায় ৪৮ বছর বয়সী লায়লা আফরোজ এবং তার ১৫ বছর বয়সী মেয়ে নাফিসা লাওয়াল বিনতে আজিজকে গলা কেটে খুন করা হয়। ওই বাসায় ঘটনার চার দিন আগে গৃহকর্মী হিসেবে কাজ নিয়েছিলেন আয়েশা। বুধবার বেলা সাড়ে ১২টায় ঝালকাঠির নলছিটি থেকে আয়েশাকে গ্রেপ্তারের মধ্য দিয়ে ‘ক্লুলেস’ হত্যাকা-ের রহস্য উদ্ঘাটনের দাবি করে পুলিশ বলছে, চুরির জেরেই মা-মেয়েকে এলোপাথারি ছুরিকাঘাত করে হত্যা করেন আয়েশা। পুলিশ কর্মকর্তা নজরুল বলেন, ‘প্রাথমিক জিজ্ঞাসাবাদে আয়েশা ঘটনার সঙ্গে নিজের সম্পৃক্ততা স্বীকার করেছে। গৃহকর্মী হিসেবে নিয়োজিত থেকে চুরির অভ্যাস তার পূর্ব থেকেই ছিল। ‘সে মোবাইল ব্যবহার করতো না, ছবি ছিল না। তার গলার পোড়া দাগ শুধু এটাই ক্লু ছিল। তার বিরুদ্ধে করা আগের একটা জিডির ক্লু ধরে রহস্য উদ্ঘাটন সম্ভব হয়েছে।’

এই জোড়া খুনের মোটিভের বিষয়ে প্রাথমিক তথ্যের বরাতে তিনি বলেন, ‘কাজে যোগ দেয়ার দ্বিতীয় দিন সে ওই বাসা থেকে দুই হাজার টাকা চুরি করে। এ নিয়ে তাকে প্রশ্ন করলে গৃহকর্ত্রী লায়লা আফরোজের সঙ্গে তার বাগবিত-া হয়। গৃহকর্ত্রী আয়েশাকে পুলিশে দেয়ার ভয় দেখায়। ‘চতুর্থ দিন কাজে যাওয়ার সময় একটি সুইচগিয়ার চাকু নিয়ে গিয়েছিল আয়েশা। সেদিন আবারও কথাকাটাকাটি হলে তাদের মধ্যে এটি নিয়ে ধস্তাধস্তির একপর্যায়ে সুইচ গিয়ার দিয়ে ছুরিকাঘাত করে। পরে মেয়ে এগিয়ে আসলে তাকেও ছুরিকাঘাত করা হয়।’

অতিরিক্ত কমিশনার নজরুল ইসলাম বলেন, ‘ঘটনার দিন আয়েশা নিজেও আহত হয়েছেন। এরপর সে নিজের রক্তাক্ত পোশাক পাল্টে মেয়ে নাফিসার স্কুলড্রেস পরে একটি ল্যাপটপ ও মোবাইল নিয়ে চলে যায়।’ জিজ্ঞাসাবোদে পাওয়া তথ্যের ভিত্তিতে পুলিশ বলছে, খুন করার পর আয়েশা সেই বাড়ি থেকে বের হয়ে সোহ্রাওয়ার্দী হাসপাতালে যায়। সেখানে হাসপাতালের ভেতরে গিয়ে পোশাক পরিবর্তন করে সাভারের দিকে চলে যায়। চুরি করা ফোন ও রক্তাক্ত কাপড় সিঙ্গাইর ব্রিজ থেকে নদীতে ফেলে দেয়ার কথা পুলিশকে বলেছে আয়েশা।

সংবাদ সম্মেলনে পুলিশের তেজগাঁও বিভাগের উপ-কমিশনার ইবনে মিজান বলেন, ‘আমরা জানতে পেরেছি ঘটনার দিন গৃহকর্ত্রী যখন চুরির বিষয়টি গৃহকর্তাকে জানানোর জন্য উদ্যত হন, সেই মুহূর্তে আয়েশা ছুরি নিয়ে তাকে আক্রমণ করে। ‘তখন তাদের মধ্যে ধস্তাধস্তি হয়। সে সময় মেয়েটি ঘুমিয়ে ছিল। কিন্তু তাদের ধস্তাধস্তিতে মেয়েটি ওঠে যখন ইন্টারকমে সিকিউরিটি গার্ডকে জানাতে গিয়েছিল তখন মাকে রেখে মেয়েকে আক্রমণ করে।’

কেবল দুই হাজার টাকা চুরির জন্যই এ জোড়া খুন, এমন প্রশ্নের উত্তরে অতিরিক্ত কমিশনার নজরুল বলেন, ‘যদি দুই হাজার টাকার জন্য বিত-া হইতো, তাহলে সে কাজে নাও আসতে পারতো। কিন্তু পরদিন সে ওই বাসায় ছুরি নিয়ে ঢুকেছে, ক্রাইম করার জন্যই ঢুকছে। ‘সে কোনো মোবাইল ব্যবহার করেনি। মুখ ঢেকে আসছে, কাজটা করার পর কীভাবে সেইফ এক্সিট হবে, মেয়ের স্কুলড্রেস পরে ব্যাগ নিয়ে বের হয়ে গেছে। তার ক্লিয়ার ক্রিমিনাল ইনটেনশন আছে।’

এর পাশাপাশি পুলিশে দেয়ার ভয়, রাগারাগির ক্ষোভ এবং নতুন করে চুরির পরিকল্পনা থাকার সম্ভাবনার কথা বলেছেন তিনি। নজরুল বলেন, ‘রিমান্ডে আনলে আরও হয়তো বিস্তারিত তথ্য পাবো। তার সঙ্গে আরও কেউ জড়িত কিনা বা তার সিন্ডিকেট আছে কিনা।’ আয়েশার স্বামী রাব্বীকে গ্রেপ্তারের কারণ হিসেবে তিনি বলেন, ঘটনাটি জেনে তিনি তার স্ত্রীকে পালাতে সাহায্য করেছেন। গৃহকর্মী রাখার আগে অবশ্যই তাদের পরিচিতি নিশ্চিত হয়ে নেয়ার অনুরোধ জানিয়ে অতিরিক্ত কমিশনার নজরুল বলেন, ‘তার ছবি জাতীয় পরিচয়পত্র রাখার পাশাপাশি তাকে চিহ্নিত করতে পারে এমন দুই-একজনের নম্বরও রাখতে হবে। তাহলে আমরা এমন অনাকাক্সিক্ষত ঘটনা এড়াতে পারবো।’

‘নগর-মহানগর’ : আরও খবর

» মেট্রোরেলের কর্মকর্তা কর্মচারীদের দাবি আদায়ে কর্মবিরতি ঘোষণা

» শ্যামবাজারে প্রকাশ্যে ব্যবসায়ীকে গুলি করে হত্যা

সম্প্রতি