alt

চালের সাইলোতে গম, নেপথ্যে ‘দুর্নীতি’

শফিউল আল ইমরান : মঙ্গলবার, ১৫ অক্টোবর ২০২৪

খাদ্য নিরাপত্তা নিশ্চিত ও মজুত ব্যবস্থাপনা শক্তিশালী করতে দেশে সাতটি চাল সংরক্ষণাগার বা সাইলো নির্মাণ করছে খাদ্য অধিদপ্তর। পুষ্টিগুণ অটুট রেখে এখানে কয়েক বছর চাল সংরক্ষণ করা সম্ভব। আধুনিক স্টিল রাইস সাইলো নির্মাণে বেশির ভাগ অর্থ দিয়েছে বিশ্বব্যাংক। এর মধ্যে ময়মনসিংহে ২০৭ কোটি টাকা ব্যয়ে ৪৮ হাজার টন ধারণক্ষমতার সাইলোটি উদ্বোধন হয়েছে গত বছরের নভেম্বরে। টাঙ্গাইলের সাইলোও যাত্রা শুরু করেছে।

তবে উদ্বোধনের পর থেকেই এসব সাইলোতে শুরু হয়েছে অনিয়ম। চালের জন্য প্রস্তুত করা সাইলোতে রাখা হয়েছে গম।

সংশ্লিষ্টরা বলছেন, সাইলোতে চালের বদলে গম রাখার বিষয়টি ছোটখাটো হেরফের মনে হলেও এর মধ্যে রয়েছে দুর্নীতির বড় উপাদান। কারণ, আধুনিক এসব সাইলোর পুরোটাই ডিজিটাল। মাঠ থেকে সংগ্রহ করা চাল এখানে রাখতে গেলেই মুহূর্তেই চালের আর্দ্রতা, তাপমাত্রা, ওজন, মজুতের তারিখসহ সব তথ্য সংরক্ষণ হয়ে যাবে। পুরোনো চালকে নতুন বলে চালিয়ে দেয়ারও সুযোগ নেই। ফলে অনিয়মের সুযোগ না পেয়ে এসব সাইলোতে রাখা হচ্ছে আমদানি করা গম।

সম্প্রতি ময়মনসিংহের সাইলো পরিদর্শন করেছে ঋণদাতা প্রতিষ্ঠান বিশ্বব্যাংকের প্রতিনিধি দল। তারা চালের সাইলোতে গম দেখে বিস্ময় প্রকাশ করেছেন বলে একটি সূত্র নিশ্চিত করেছে। বিশ্বব্যাংকের প্রতিনিধি দল জানিয়েছে, চালের সাইলোতে গম রাখার প্রযুক্তিগত কোনো সুবিধা নেই। গম রাখা বিপজ্জনক ও ঝুঁকিপূর্ণ। ‘বিস্ফোরণের আশঙ্কাও’ আছে।

খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, দীর্ঘদিন ধরে জেলা-উপজেলার খাদ্যগুদামগুলোতে চাল সংরক্ষণ করা হয়। এসব গুদামে চাল সবহন ঠিকাদারদের ছিল ‘বড় অনিয়ম’। সংগ্রহ মৌসুমে চাল না কিনেও পুরোনো চাল নতুন কেনা বলে দেখানো হতো। গুদামে চালের ধারণক্ষমতাও ছিল খুবই কম। ফলে চাল নিয়ে কারসাজির কারণে বাজারে দাম বেড়ে যেত।

এমন পরিস্থিতিতে আধুনিক খাদ্য সংরক্ষণাগার নির্মাণ প্রকল্পের মাধ্যমে সাতটি সাইলো নির্মাণের কাজ শুরু হয় ২০১৪ সালে। প্রথমে আটটি সাইলো নির্মাণের কথা থাকলেও শেষে নওগাঁর সাইলো বাদ দিয়ে এখন বরিশাল, নারায়ণগঞ্জ, আশুগঞ্জ, ময়মনসিংহ, মহেশ্বরপাশা, চট্টগ্রাম ও মধুপুরে ৪ দশমিক ৮৭ লাখ টন ধারণক্ষমতাসম্পন্ন আধুনিক স্টিল সাইলো নির্মাণ হচ্ছে। খাদ্য ঘাটতি থেকে মুক্তি দেয়াই ছিল এ প্রকল্পের উদ্দেশ্য।

ময়মনসিংহের সাইলোর পাশাপাশি টাঙ্গাইলের মধুপুরসহ আরও কয়েকটি সাইলোতে গম রাখার সিদ্ধান্ত নিয়েছে খাদ্য অধিদপ্তর। এজন্য তড়িঘড়ি করে গত জুন ও সেপ্টেম্বরে দুই দফায় ২০ হাজার টন গম স্থানান্তরের সূচি জারি করা হয়েছে।

গম রাখায় যান্ত্রিক ত্রুটি
বিশ্বব্যাংকের প্রতিনিধি দল রাইস সাইলো পরিদর্শনে গিয়ে দেখতে পায়, সাইলোর ক্লিনার টাওয়ার না থাকায় ধুলা-ময়লায় বিল লাইনার (পরিষ্কার করার কাজে ব্যবহার হয়)

পুরোপুরি বন্ধ হয়ে গেছে। চিলার (তাপমাত্রা নিয়ন্ত্রণের যন্ত্র) ও ফিউমেগেশন (জীবাণুমুক্তকরণ) প্রক্রিয়া অকেজো হয়ে পড়েছে। চালের সাইলোতে প্রযুক্তিগত কারণে গম রাখা সম্ভব নয় বলে প্রকল্পের সাবেক পরিচালক রেজাউল করিম শেখ মতো দিয়েছিলেন।

তিনি এক প্রতিবেদনে বলেন, ‘সাইলোতে বিকল্প কোনো পণ্য রাখা হলে যন্ত্রাংশগুলো সঠিকভাবে কাজ করবে না। কিছু কিছু যন্ত্র নষ্ট হয়ে যেতে পারে। এমনকি বিস্ফোরণের আশঙ্কাও আছে।’

গত জুনে খাদ্য অধিদপ্তরের মহাপরিচালককে একটি চিঠিতে ময়মনসিংহ স্টিল রাইস সাইলোর সুপার ফয়জুল্লাহ খান শিবলী জানান, চালের সাইলোতে ক্লিনার টাওয়ার না থাকায় গম ডাস্টমুক্ত করা সম্ভব হচ্ছে না। চিলার ও নাইট্রোজেন ফিউমিগেশন কতটা কার্যকর হবে, তা নিয়ে সন্দেহ প্রকাশ করেন তিনি।

ময়মনসিংহের সুপার বলেন, ‘কোনো যান্ত্রিক পরিবর্তন না করেই চালের সাইলোতে গম রাখার সিদ্ধান্ত দিয়েছেন প্রকল্প-সংশ্লিষ্টরা। এখানে আমার কিছু করার নেই। আমরা এটি বিশ্বব্যাংকের প্রতিনিধি দলকেও জানিয়েছি।’

প্রকল্পের সাবেক পরিচালক রেজাউল করিম শেখ বলেন, ‘তখন পরীক্ষা করার জন্য চাল পাওয়া যাচ্ছিল না। তাই পরীক্ষা করার জন্য গম রাখা হয়েছে।’

কিন্তু খাদ্য অধিদপ্তরের চলাচল সংরক্ষণ ও সাইলো বিভাগের পরিচালক মাহবুবুর রহমান বলেন, ‘এ বিষয়ে মন্ত্রণালয় থেকে অনুমোদন নেয়া আছে। প্রকল্পের টেকনিক্যাল কমিটিও গম রাখার পক্ষে মত দিয়েছে। কারণ আমাদের গমের সাইলো মাত্র দুটি। ফলে চালের সাইলোতে গম রাখার অনুমোদন দিয়েছে খাদ্য মন্ত্রণালয়। দু’জনের কথাতেই বিভ্রান্তি তৈরি হয়েছে।’

খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, প্রকল্পের সাবেক পরিচালক রেজাউল করিম শেখও টেকনিক্যাল কমিটিতে ছিলেন। তিনি প্রকল্পের শুরুতে বলেছিলেন গম রাখা ঝুঁকিপূর্ণ। ওই কমিটিতে আরও ছিলেন প্রকল্পের একজন কনসালট্যান্ট, যিনি সাইলো প্রকৌশলী। তারা কোনো পরীক্ষা-নিরীক্ষা না করেই মন্ত্রণালয়ে প্রতিবেদন দাখিল করেছেন বলে অভিযোগ রয়েছে। খাদ্য কর্মকর্তাদের অভিযোগ, স্বার্থান্বেষী সিন্ডিকেটের স্বার্থরক্ষার জন্য এ প্রতিবেদন দিয়েছেন তারা।

এ বিষয়ে রেজাউল করিম বলেন, ‘গমের সাইলোতে চাল রাখা যাবে না, চালের সাইলোতে গম রাখা যাবে। প্রকল্প শুরুতে আমি কী বলেছি, মনে নেই। মন্ত্রণালয়ের প্রতিবেদনে কোনো সাইলোতে দীর্ঘ মেয়াদে গম রাখার কথা বলিনি। পরীক্ষামূলকভাবে রাখা যাবে বলেছি। এখন আমি নেই। যদি বর্তমান প্রশাসন মনে করে এটা রাখা ঠিক নয়, তাহলে চাল রাখবে।’

এ বিষয়ে প্রকল্পের কনসালট্যান্ট মহিউদ্দিন বলেন, ‘আমি চাকরি থেকে অবসর নিয়েছি। ফলে এ বিষয়ে আমি কিছুই বলতে পারব না।’

নেপথ্য কারণ
দেশে চাল উৎপাদনে ময়মনসিংহ প্রসিদ্ধ। এ বিভাগে ১ দশমিক ১৯ লাখ টন ধারণক্ষমতার খাদ্যগুদাম আছে। সংগ্রহ করা চাল সরবরাহ, বস্তা কেনা, গোডাউনে রাখাসহ বিভিন্ন এলাকায় পরিবহনসহ নানা কাজে রয়েছে সরকারের বড় বরাদ্দ। এছাড়া কর্মকর্তারা মিলার ও পরিবহন ঠিকাদারদের কাছ থেকে ‘বিপুল অর্থ উৎকোচ’ পান। পাশাপাশি সংগ্রহ মৌসুমে চাল না কিনেও পুরোনো চাল নতুন কেনা দেখানোর মতো অনিয়মের অভিযোগ আছে। মানহীন চালও পুরোনো এই গোডাউনে রাখা যায়, যা আধুনিক সাইলোতে সম্ভব নয়।

নাম প্রকাশ না করার শর্তে এক খাদ্য কর্মকর্তা বলেন, ‘আধুনিক চালের সাইলোতে গেলে এসব অনিয়ম বন্ধ হয়ে যাবে। কারণ সব অটোমেশন হবে।’

প্রকল্পে কর্মরত দায়িত্বশীল আরেক কর্মকর্তা জানান, ‘দীর্ঘদিন ধরে চলা অভ্যন্তরীণ চাল সংগ্রহকেন্দ্রিক দুর্নীতিতে জড়িত ব্যক্তি ও মন্ত্রণালয়ের উচ্চ পর্যায়ের নির্দেশনায় চালের সাইলোতে গম রাখার বিষয়ে প্রকল্প অফিস থেকে মতামত দেয়া হয়েছে। এভাবে প্রতিটি সংগ্রহ মৌসুমে দুর্নীতির মাধ্যমে শত শত কোটি টাকা হাতিয়ে নিচ্ছে ওই চক্র। এতে একদিকে যেমন অর্থ অপচয় হচ্ছে, অন্যদিকে সাইলোর যন্ত্রাংশ ও রক্ষিত গম নষ্ট হচ্ছে।’

এদিকে খাদ্য অধিদপ্তরের একটি সূত্র জানিয়েছে, ‘সাইলোগুলো নির্মাণের স্থান নিয়েও নানা আলোচনা রয়েছে। যেমন মধুপুরে সাইলোর কোনো প্রয়োজন ছিল না, তবুও সে সময় খাদ্যমন্ত্রী আবদুর রাজ্জাক তার এলাকা মধুপুরে একটি সাইলো নির্মাণ করেন।’

ছবি

‘সন্দেহজনক ঘোরাঘুরি’: সেই মার্কিন নাগরিক ফের ৫ দিনের রিমান্ডে

ছবি

যশোরের চিহ্নিত সন্ত্রাসী সোহেলের ১০ বছরের কারাদণ্ড

ছবি

অপরাধ বেড়েছে জামালপুর শহরে

ছবি

মহেশখালীতে পুলিশের উপর হামলার প্রধান আসামি অস্ত্রসহ গ্রেপ্তার

ছবি

চট্টগ্রাম কাস্টমসে ঘুষের টাকাসহ সহকারী রাজস্ব কর্মকর্তা গ্রেপ্তার

ছবি

ডিএসসিসির বিরুদ্ধে ২৫ কোটি টাকা আত্মসাতের মামলা করবে দুদক

ছবি

গৃহবধূ হত্যার প্রধান আসামী গ্রেপ্তার

দর্শনায় জুয়েলার্সে হামলা ছাত্রলীগ নেতা গ্রেপ্তার

ছবি

চাকরির প্রলোভনে ১০ কোটি টাকা হাতিয়ে নেয়ার অভিযোগ

ছবি

পাসপোর্ট অফিসে দালালবিরোধী অভিযানে চারজনকে বিভিন্ন মেয়াদে কারাদণ্ড

ছবি

পৃথক হত্যাচেষ্টা মামলা: আনিসুলকে দেখানো হলো গ্রেপ্তার, পাভেল রিমান্ডে

ছবি

দুর্নীতির মামলায় মোরশেদ আলমের জামিন নাকচ

ছবি

শেখ হাসিনার বিরুদ্ধে ‘যথেষ্ট’ প্রমাণ পাওয়া গেছে: চিফ প্রসিকিউটর

ছবি

সংসদের আসন পুনর্বিন্যাস, ফরিদপুরের ভাঙ্গা রণক্ষেত্র

ছবি

চকরিয়ায় থানা হাজতে দুজর্য়ের মৃত্যুর ঘটনায় ওসিসহ নয় জনের বিরুদ্ধে মামলার নির্দেশ

ছবি

বরিশালে তরুণীকে ধর্ষণ ও হত্যা মামলায় দুই আসামির মৃত্যুদণ্ড

ছবি

ডিবি পরিচয়ে ডাকাতচক্রের তিনসদস্য গ্রেপ্তার

ছবি

সাদা পাথর লুট: সাহাব উদ্দিন গ্রেপ্তার, ৫ দিনের রিমান্ড আবেদন

ছবি

সাগর-রুনি হত্যা: তদন্ত নিয়ে অসন্তুষ্ট আদালত বললো ‘আপ্রাণ চেষ্টা’ চালাতে

ছবি

মালয়েশিয়ায় শ্রমিক পাঠাতে ৫ গুণ বেশি টাকা নেয়ার অভিযোগ, ১৩ কোম্পানির বিরুদ্ধে মামলা

ছবি

ভোলায় মুভি দেখে বাবা খুন করল ছেলে

ছবি

বুড়িমারী স্থলবন্দর ইয়ার্ডে বাংলাদেশী দুই টাকার নতুন নোট জব্দ

ছবি

বনানীতে চুরি হওয়া ২৪ লাখ টাকা উদ্ধার, গ্রেপ্তার ১

ছবি

প্রতারণার নতুন ফাঁদ: ফেইসবুকে ‘টু-লেট’ বিজ্ঞাপন, বাসা নিতে গিয়ে কলেজ ছাত্রকে হেনস্থা

ছবি

স্কুলছাত্রীকে যৌন নির্যাতনের মামলায় গ্রেপ্তার ১

ছবি

নারায়ণগঞ্জে ‘ব্লগারকে’ কুপিয়ে বাইক ও ফোন ছিনতাই

ছবি

টঙ্গীতে দুপুরে ‘চোর সন্দেহে’ যুবক আটক, রাতে মৃত্যু

ছবি

উত্তরায় ‘সমন্বয়ক পরিচয়ে চাঁদাবাজি’, তিনজন কারাগারে

ছবি

একদিনে সারাদেশে পুলিশের বিশেষ অভিযানে গ্রেপ্তার ১৮০৯

সমন্বয়ক পরিচয়ে চাঁদাবাজি, তিনজন কারাগারে

ছবি

‘সন্দেহজনক’ লেনদেন, সাবেক এমপি দিদার দম্পতির বিরুদ্ধে দুদকের মামলা

ছবি

ফরিদপুরে শিশু ধর্ষণ: ২ যুবকের যাবজ্জীবন, শিশুর ১০ বছরের কারাদণ্ড

ছবি

চানখাঁরপুলে ৬ হত্যা: ২ জনের সাক্ষ্যে ৩ জনের গুলিবিদ্ধ হওয়ার বর্ণনা

ছবি

ফ্ল্যাট বরাদ্দে ‘অনিয়ম’: সচিব পদমর্যাদার সাবেক ১২ কর্মকর্তাকে দুদকে তলব

ছবি

‘অবৈধ সম্পদ ও প্লট জালিয়াতি’ বিচারপতি মানিকের বিরুদ্ধে দুদকের দুই মামলা

ছবি

রাষ্ট্রদ্রোহ মামলা: ভারতে থাকা হাসিনাসহ ২৮৬ জনের দেশত্যাগে নিষেধাজ্ঞা

tab

চালের সাইলোতে গম, নেপথ্যে ‘দুর্নীতি’

শফিউল আল ইমরান

মঙ্গলবার, ১৫ অক্টোবর ২০২৪

খাদ্য নিরাপত্তা নিশ্চিত ও মজুত ব্যবস্থাপনা শক্তিশালী করতে দেশে সাতটি চাল সংরক্ষণাগার বা সাইলো নির্মাণ করছে খাদ্য অধিদপ্তর। পুষ্টিগুণ অটুট রেখে এখানে কয়েক বছর চাল সংরক্ষণ করা সম্ভব। আধুনিক স্টিল রাইস সাইলো নির্মাণে বেশির ভাগ অর্থ দিয়েছে বিশ্বব্যাংক। এর মধ্যে ময়মনসিংহে ২০৭ কোটি টাকা ব্যয়ে ৪৮ হাজার টন ধারণক্ষমতার সাইলোটি উদ্বোধন হয়েছে গত বছরের নভেম্বরে। টাঙ্গাইলের সাইলোও যাত্রা শুরু করেছে।

তবে উদ্বোধনের পর থেকেই এসব সাইলোতে শুরু হয়েছে অনিয়ম। চালের জন্য প্রস্তুত করা সাইলোতে রাখা হয়েছে গম।

সংশ্লিষ্টরা বলছেন, সাইলোতে চালের বদলে গম রাখার বিষয়টি ছোটখাটো হেরফের মনে হলেও এর মধ্যে রয়েছে দুর্নীতির বড় উপাদান। কারণ, আধুনিক এসব সাইলোর পুরোটাই ডিজিটাল। মাঠ থেকে সংগ্রহ করা চাল এখানে রাখতে গেলেই মুহূর্তেই চালের আর্দ্রতা, তাপমাত্রা, ওজন, মজুতের তারিখসহ সব তথ্য সংরক্ষণ হয়ে যাবে। পুরোনো চালকে নতুন বলে চালিয়ে দেয়ারও সুযোগ নেই। ফলে অনিয়মের সুযোগ না পেয়ে এসব সাইলোতে রাখা হচ্ছে আমদানি করা গম।

সম্প্রতি ময়মনসিংহের সাইলো পরিদর্শন করেছে ঋণদাতা প্রতিষ্ঠান বিশ্বব্যাংকের প্রতিনিধি দল। তারা চালের সাইলোতে গম দেখে বিস্ময় প্রকাশ করেছেন বলে একটি সূত্র নিশ্চিত করেছে। বিশ্বব্যাংকের প্রতিনিধি দল জানিয়েছে, চালের সাইলোতে গম রাখার প্রযুক্তিগত কোনো সুবিধা নেই। গম রাখা বিপজ্জনক ও ঝুঁকিপূর্ণ। ‘বিস্ফোরণের আশঙ্কাও’ আছে।

খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, দীর্ঘদিন ধরে জেলা-উপজেলার খাদ্যগুদামগুলোতে চাল সংরক্ষণ করা হয়। এসব গুদামে চাল সবহন ঠিকাদারদের ছিল ‘বড় অনিয়ম’। সংগ্রহ মৌসুমে চাল না কিনেও পুরোনো চাল নতুন কেনা বলে দেখানো হতো। গুদামে চালের ধারণক্ষমতাও ছিল খুবই কম। ফলে চাল নিয়ে কারসাজির কারণে বাজারে দাম বেড়ে যেত।

এমন পরিস্থিতিতে আধুনিক খাদ্য সংরক্ষণাগার নির্মাণ প্রকল্পের মাধ্যমে সাতটি সাইলো নির্মাণের কাজ শুরু হয় ২০১৪ সালে। প্রথমে আটটি সাইলো নির্মাণের কথা থাকলেও শেষে নওগাঁর সাইলো বাদ দিয়ে এখন বরিশাল, নারায়ণগঞ্জ, আশুগঞ্জ, ময়মনসিংহ, মহেশ্বরপাশা, চট্টগ্রাম ও মধুপুরে ৪ দশমিক ৮৭ লাখ টন ধারণক্ষমতাসম্পন্ন আধুনিক স্টিল সাইলো নির্মাণ হচ্ছে। খাদ্য ঘাটতি থেকে মুক্তি দেয়াই ছিল এ প্রকল্পের উদ্দেশ্য।

ময়মনসিংহের সাইলোর পাশাপাশি টাঙ্গাইলের মধুপুরসহ আরও কয়েকটি সাইলোতে গম রাখার সিদ্ধান্ত নিয়েছে খাদ্য অধিদপ্তর। এজন্য তড়িঘড়ি করে গত জুন ও সেপ্টেম্বরে দুই দফায় ২০ হাজার টন গম স্থানান্তরের সূচি জারি করা হয়েছে।

গম রাখায় যান্ত্রিক ত্রুটি
বিশ্বব্যাংকের প্রতিনিধি দল রাইস সাইলো পরিদর্শনে গিয়ে দেখতে পায়, সাইলোর ক্লিনার টাওয়ার না থাকায় ধুলা-ময়লায় বিল লাইনার (পরিষ্কার করার কাজে ব্যবহার হয়)

পুরোপুরি বন্ধ হয়ে গেছে। চিলার (তাপমাত্রা নিয়ন্ত্রণের যন্ত্র) ও ফিউমেগেশন (জীবাণুমুক্তকরণ) প্রক্রিয়া অকেজো হয়ে পড়েছে। চালের সাইলোতে প্রযুক্তিগত কারণে গম রাখা সম্ভব নয় বলে প্রকল্পের সাবেক পরিচালক রেজাউল করিম শেখ মতো দিয়েছিলেন।

তিনি এক প্রতিবেদনে বলেন, ‘সাইলোতে বিকল্প কোনো পণ্য রাখা হলে যন্ত্রাংশগুলো সঠিকভাবে কাজ করবে না। কিছু কিছু যন্ত্র নষ্ট হয়ে যেতে পারে। এমনকি বিস্ফোরণের আশঙ্কাও আছে।’

গত জুনে খাদ্য অধিদপ্তরের মহাপরিচালককে একটি চিঠিতে ময়মনসিংহ স্টিল রাইস সাইলোর সুপার ফয়জুল্লাহ খান শিবলী জানান, চালের সাইলোতে ক্লিনার টাওয়ার না থাকায় গম ডাস্টমুক্ত করা সম্ভব হচ্ছে না। চিলার ও নাইট্রোজেন ফিউমিগেশন কতটা কার্যকর হবে, তা নিয়ে সন্দেহ প্রকাশ করেন তিনি।

ময়মনসিংহের সুপার বলেন, ‘কোনো যান্ত্রিক পরিবর্তন না করেই চালের সাইলোতে গম রাখার সিদ্ধান্ত দিয়েছেন প্রকল্প-সংশ্লিষ্টরা। এখানে আমার কিছু করার নেই। আমরা এটি বিশ্বব্যাংকের প্রতিনিধি দলকেও জানিয়েছি।’

প্রকল্পের সাবেক পরিচালক রেজাউল করিম শেখ বলেন, ‘তখন পরীক্ষা করার জন্য চাল পাওয়া যাচ্ছিল না। তাই পরীক্ষা করার জন্য গম রাখা হয়েছে।’

কিন্তু খাদ্য অধিদপ্তরের চলাচল সংরক্ষণ ও সাইলো বিভাগের পরিচালক মাহবুবুর রহমান বলেন, ‘এ বিষয়ে মন্ত্রণালয় থেকে অনুমোদন নেয়া আছে। প্রকল্পের টেকনিক্যাল কমিটিও গম রাখার পক্ষে মত দিয়েছে। কারণ আমাদের গমের সাইলো মাত্র দুটি। ফলে চালের সাইলোতে গম রাখার অনুমোদন দিয়েছে খাদ্য মন্ত্রণালয়। দু’জনের কথাতেই বিভ্রান্তি তৈরি হয়েছে।’

খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, প্রকল্পের সাবেক পরিচালক রেজাউল করিম শেখও টেকনিক্যাল কমিটিতে ছিলেন। তিনি প্রকল্পের শুরুতে বলেছিলেন গম রাখা ঝুঁকিপূর্ণ। ওই কমিটিতে আরও ছিলেন প্রকল্পের একজন কনসালট্যান্ট, যিনি সাইলো প্রকৌশলী। তারা কোনো পরীক্ষা-নিরীক্ষা না করেই মন্ত্রণালয়ে প্রতিবেদন দাখিল করেছেন বলে অভিযোগ রয়েছে। খাদ্য কর্মকর্তাদের অভিযোগ, স্বার্থান্বেষী সিন্ডিকেটের স্বার্থরক্ষার জন্য এ প্রতিবেদন দিয়েছেন তারা।

এ বিষয়ে রেজাউল করিম বলেন, ‘গমের সাইলোতে চাল রাখা যাবে না, চালের সাইলোতে গম রাখা যাবে। প্রকল্প শুরুতে আমি কী বলেছি, মনে নেই। মন্ত্রণালয়ের প্রতিবেদনে কোনো সাইলোতে দীর্ঘ মেয়াদে গম রাখার কথা বলিনি। পরীক্ষামূলকভাবে রাখা যাবে বলেছি। এখন আমি নেই। যদি বর্তমান প্রশাসন মনে করে এটা রাখা ঠিক নয়, তাহলে চাল রাখবে।’

এ বিষয়ে প্রকল্পের কনসালট্যান্ট মহিউদ্দিন বলেন, ‘আমি চাকরি থেকে অবসর নিয়েছি। ফলে এ বিষয়ে আমি কিছুই বলতে পারব না।’

নেপথ্য কারণ
দেশে চাল উৎপাদনে ময়মনসিংহ প্রসিদ্ধ। এ বিভাগে ১ দশমিক ১৯ লাখ টন ধারণক্ষমতার খাদ্যগুদাম আছে। সংগ্রহ করা চাল সরবরাহ, বস্তা কেনা, গোডাউনে রাখাসহ বিভিন্ন এলাকায় পরিবহনসহ নানা কাজে রয়েছে সরকারের বড় বরাদ্দ। এছাড়া কর্মকর্তারা মিলার ও পরিবহন ঠিকাদারদের কাছ থেকে ‘বিপুল অর্থ উৎকোচ’ পান। পাশাপাশি সংগ্রহ মৌসুমে চাল না কিনেও পুরোনো চাল নতুন কেনা দেখানোর মতো অনিয়মের অভিযোগ আছে। মানহীন চালও পুরোনো এই গোডাউনে রাখা যায়, যা আধুনিক সাইলোতে সম্ভব নয়।

নাম প্রকাশ না করার শর্তে এক খাদ্য কর্মকর্তা বলেন, ‘আধুনিক চালের সাইলোতে গেলে এসব অনিয়ম বন্ধ হয়ে যাবে। কারণ সব অটোমেশন হবে।’

প্রকল্পে কর্মরত দায়িত্বশীল আরেক কর্মকর্তা জানান, ‘দীর্ঘদিন ধরে চলা অভ্যন্তরীণ চাল সংগ্রহকেন্দ্রিক দুর্নীতিতে জড়িত ব্যক্তি ও মন্ত্রণালয়ের উচ্চ পর্যায়ের নির্দেশনায় চালের সাইলোতে গম রাখার বিষয়ে প্রকল্প অফিস থেকে মতামত দেয়া হয়েছে। এভাবে প্রতিটি সংগ্রহ মৌসুমে দুর্নীতির মাধ্যমে শত শত কোটি টাকা হাতিয়ে নিচ্ছে ওই চক্র। এতে একদিকে যেমন অর্থ অপচয় হচ্ছে, অন্যদিকে সাইলোর যন্ত্রাংশ ও রক্ষিত গম নষ্ট হচ্ছে।’

এদিকে খাদ্য অধিদপ্তরের একটি সূত্র জানিয়েছে, ‘সাইলোগুলো নির্মাণের স্থান নিয়েও নানা আলোচনা রয়েছে। যেমন মধুপুরে সাইলোর কোনো প্রয়োজন ছিল না, তবুও সে সময় খাদ্যমন্ত্রী আবদুর রাজ্জাক তার এলাকা মধুপুরে একটি সাইলো নির্মাণ করেন।’

back to top